১৪. বাতি নিভিয়ে

হাত ফিরিয়ে আনল বাবর। সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠল সে। বাতি নিভিয়ে হাতরে হাতরে জাহেদার খাটের কাছে এসে দাঁড়াল। বসল। বসে রইল। কিছুক্ষণ। তারপর সন্তৰ্পণে লম্বা হয়ে শুল তার পাশে। বাবরের বাবা মারা গেলেন তার তিনদিন আগে এক রাতে ঘুমিয়েছিল সে। হঠাৎ স্বপ্ন কী স্বপ্নের মত বাস্তবে সে দেখতে পেয়েছিল ঘন কালো কাপড়ে টানটান আবৃত এক পুরুষকে। লোকটা তার পাশে এসে বসল। অপেক্ষা করল। তারপর কাৎ হলো। ধীরে ধীরে পা ছড়িয়ে একটা লাশের মত নিজেকে বিস্তৃত করল। অনেকক্ষণ পর একটা পা তুলে দিল বাবরের গায়ে। বাবর তখন কিছু বলছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। লোকটা এবার তার দিকে পাশ ফিরল। আরো এক যুগ পরে জড়িয়ে ধরল। তাকে একটা কালো আলিঙ্গনে, তখন চিৎকার করে উঠল বাবর। তার অসুস্থ বাবা স্বপ্নটা শুনে পরদিন সকালেই মৌলবী ডেকে তওবা করলেন। মারা গেলেন তিন দিনের দিন।

কিন্তু আমি এখন জ্যোতির্ময়। জীবনের আলোয় উদ্ভাসিত। আমার স্বচ্ছ শরীরে দৃষ্টি কর।

বাবর পাশ ফিরল জাহেদার দিকে। কম্বলের একটা প্ৰান্ত তুলে প্ৰথমে বাঁ পায়ের আঙুল ঢোকাল, তারপর গোঁড়ালি পর্যন্ত, অবশেষে সম্পূর্ণ ঊরুটা। উষ্ণতায় শরীরের ঐ অংশটা যেন অন্য কারো হয়ে গেল। বাবর এবার একবারে ডান পা ঢুকিয়ে দিয়ে নাভি পর্যন্ত টেনে দিল কম্বলটা।

সে একটা সিগারেটের তৃষ্ণা অনুভব করতে লাগল। কিন্তু না, থাক।

একেবারে প্রথম বারের মত লাগছে। এ-রকম খুব কম মনে হয় তার। বোধহয় আজ সারাদিন ধরে ভেবেছে, তাই এমন মনে হচ্ছে।

সমস্ত শরীর তার সাহসে, বাসনায় এখন উষ্ণ স্ফীত হয়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ দেহটা সে কম্বলের তলায় নিয়ে গেল। তারপর সামান্য একটু সঞ্চালনে সংলগ্ন হলো জাহেদার। সঙ্গে সঙ্গে সুবাসিত নিঃশ্বাসে তৈরি, মধুর গ্ৰীষ্ম যেখানে বারো মাস, এমন একটা পৃথিবীতে পৌঁছে গেল সে। জাহেদার পিঠে হাত রাখল। জায়গাটা পছন্দ হল না। হাতটাকে আস্তে আস্তে নাবিয়ে আনল আরো নিচে, দুই পাহাড়ে বেষ্টন করা ব্রীজের মত স্থাপিত হল জাহেদার নিতম্বের ওপর।

মুখটাকে আরো কাছে নিয়ে গেল সে। প্রায় সেদিয়ে গেল চুলের অজস্র টিকার-টেপের প্ৰপাতে। সেই প্রপাত পার হয়ে জাহেদার তন্দুর থেকে সদ্য টানা রুটির মত উষ্ণ গালে গাল রাখল এবং সেখানেও স্থির হলো না। মাথা তুলে জাহেদার মুখের ওপর ঝুঁকে রইল সে একটা কনুইয়ে ভর করে, যেন রবি বৰ্মার ছবিতে বালকৃষ্ণেরা ঘুমন্ত মুখের ওপর নাগরূপী ঈশ্বর। জাহেদার নিঃশ্বাস তার সমস্ত মুখ পুড়িয়ে দিতে লাগল সকাল বেলার প্রথম সূর্যের মত। সে আলতো করে একটা চুমু দিল তার কপালে, অবিকল বলির আগে ছাগলের কপালে যেমন করে পরানো হয় রক্ত সিঁদুরের ফোঁটা।

আস্তে আস্তে উপুড় থেকে চিৎ করে দিল জাহেদাকে। জাহেদা দুদিকে দুহাত বিছিয়ে শিথিল দেহে পড়ে রইল। একতালে বইতে লাগল তার নিঃশ্বাস। এখনো সে ঘুমিয়ে আছে। এখনো সে জানে না। সে আর একা নয়। এখন সে হয়ত একটা স্বপ্ন দেখছে। বাবর তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। শিউরে উঠল জাহেদা। সে ঠোঁট চুষে ঢোক গিলে আবার প্রশান্ত হল। তখন আরেকটা চুমু দিল তাকে বাবর। স্বলিত কণ্ঠে বলল, তুমি ঘুমোও।

নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল তার। হাঁপানি রোগীর মত মনে হতে লাগল। বারবার মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে। এটা খুব খারাপ লক্ষণ। ঢাকায় ফিরেই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। রক্তচাপের যে উপসর্গগুলো প্ৰায় দেখা দিচ্ছে বলে ডাক্তার বলছিলেন তার জন্যে ওষুধ-বিষুধ বাছবিচার তো নিয়ত করছে। তবু এ রকম হচ্ছে কেন? লতিফার সঙ্গে সে রাতেও ঠিক এই রকম বোধ হচ্ছিল। না, এত দ্রুত জরার শিকার হতে চায় না। ওষুধে কিছু না হোক, ইচ্ছে দিয়ে সে ঠেকিয়ে রাখবে। সে এখন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করল।

আশ্চৰ্য, ফল হলো। স্বচ্ছন্দ হয়ে এলো নিঃশ্বাস।

বোবর জাহেদাকে আলতো করে পাশ ফিরিয়ে পিঠে বোতাম সন্ধান করল। হাতে ঠেকল জিপের ছোট লকলকে জিভেটা। আস্তে আস্তে নিচের দিকে টান দিল সে। কোমর পর্যন্ত খুলে গেল। তখন আবার তাকে চিৎ করে প্রথমে জামাটা নিচ দিয়ে খোলার চেষ্টা করল, পরে ওপর দিয়ে দেখল হলো না। কোমল অথচ গুরুভার মনে হলো জাহেদার হাত দুটো। তখন জামাটা ঠেলে গলা পর্যন্ত তুলে দিয়ে একটা হাতে বুকের ছোট জামাটা ঠেলে দিল। ঢ়িলে করে পরেছে জাহেদা।

এতটুকু কষ্ট হলো না। কাপড়ের পেয়ালা দুটোর ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরুল স্তন। বাবর প্ৰথমে ঠোঁট দিয়ে একটিতে স্পর্শ করল আলতোভাবে। তারপর আরেকটার কথা মনে পড়ল। তখন সেটাও স্পর্শ করল সে। তারপর আবার প্রথমটা। যেন দুটি ছোট্ট মেয়েকে সে পছন্দ করে একই রকম। কখনো একে কখনো ওকে আদর করছে সে। প্ৰথমে একেকজনকে অনেকক্ষণ করে। তারপর কমে আসতে লাগল সময়। কমতে কমতে চলচ্চিত্রের মত দ্রুতগতিতে এটা ওটা এটা ওটা করতে লাগল। এবং পরিণামে হঠাৎ দুই ঠোঁটে দৃঢ় নিবদ্ধ করে মুখ গুঁজে দিল। যেন এক শিশু মিথ্যে কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হঠাৎ। এবং সেই শিশুর মত অবিকল একটা ক্ৰন্দনধ্বনি, কিন্তু ক্ৰন্দন নয়, তার কণ্ঠ দিয়ে বেরুতে লাগল। বুজে থাকা চোখের ভেতরে উজ্জ্বল কতগুলো বর্ণের প্রলেপ ঘনঘন বদলাতে লাগল অবিরাম। কালো, লাল, নীল, বেগুনি আবার লাল। কখনো লালের মধ্যে ছিটে পড়তে লাগল। গাঢ় নীল বিন্দুর। ঘুরতে লাগল। পরীক্ষণে নীল বিন্দুগুলো মুহূর্তে লাল হয়ে গেল এবং লাল পটভূমি কালো। অভিভূতের মত মুখ তুলে ঠোঁট দিয়ে সন্ধান করতে লাগল জাহেদার চোখ, ক্যানের লতি, চিবুকের কর্নিশ, গ্ৰীবার পেছনে ছোট ছোট সোনালি রোমের সীমানা, যেন একটা বুলডোজারের প্রশস্ত লেভেলার-ফলার মত সচল মাতাল তার মুখ এবড়ো থেবেড়ো মাঠে, যেখানে শহরের পত্তন হবে। সে তার এবং আবহমান কাল মানুষের রক্তের স্বভাব্যবশত অতি সুন্দর ব্যক্তিগত কণ্ঠে রাসের মেলায় কেনা পুতুলের মত— যার ভেতর ফাঁপা এবং পেছনটা রং করা হয়নি– শব্দগুলো উচ্চারণ করতে লাগল। সে জানে এ সত্য নয়। তবু নাটকের সংলাপ। এইই, তাই বলে বলল, তন্ময় অভিনেতার মত।

সে জাহেদার কানের লতিতে ঠোঁট রেখে বলতে লাগল, আমি তোমাকে ভালবাসি জাহেদা। জাহেদা। জাহেদা। জাহেদা। তোমাকে ভালবাসি। তোমার জন্যে আমি মরতে পারি। আমি জীবন জানি না, মৃত্যু দেখিনি। আমি তোমাকে জানি তোমাকে দেখেছি জাহেদা। আমি তোমাকে ভালবাসি। ও জাহেদা, ভালবাসি। জাহেদা হেডা, হেডা, আমার হেডা।

বলতে বলতে এমন একটা গুঞ্জনের সৃষ্টি হলো যে তার অভিভাব তাকে সম্পূর্ণ গ্ৰাস করে ফেলল। সে কিছুক্ষণ নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইল জাহেদার গালে মুখ রেখে। তারপর হঠাৎ সচল হয়ে দুই ঠোঁটে ব্যগ্রতার সঙ্গে সবুজ একটা অশ্বথ পাতার মত স্তনমুখ তুলে নিল। এবং ক্রমশ টের পেতে লাগল কোমলতার ভেতর থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা এক অপরূপ কাঠিন্য। আবেগের একটি ক্ষুদ্র মিনার তার মুখের মধ্যে এখন, ঋজু, অনমনীয়, উদ্ধত, তার তালুর আকাশের নিচে। বৃষ্টির মত স্নেহে সে সিক্ত করে দিতে লাগল তা। আর করতল বিস্তৃত করে, পাঁচ আঙুল প্রসারিত করে দুহাতে জাহেদার কাঁধ থেকে পাঁজরের পাশ দিয়ে নিতম্ব দিয়ে নেমে হাঁটু পর্যন্ত বারবার সে ভ্রমণ করতে লাগল, যেন কুমারী কোনো দ্বীপে সে একজন আবিষ্কারকের মত প্রতিটি বাঁক, চড়াই, উৎরাই হেঁটে হেঁটে স্মৃতির অন্তর্গত করছে।

আহ।

চমকে উঠল বাবার। জাহেদার কণ্ঠ থেকে নিৰ্গত ঐ ধ্বনি কত পরিচিত, কতবার সে শুনেছে অন্য কণ্ঠে, অন্য আধারে, তবু তাকে বিস্মিত করল, অভিভূত করল এবং আরো ব্যাকুল করে তুলল। সে টের পেল জাহেদা একটা হাত নাভির নিচে এনে রাখল। বাবর আর তার সংলগ্ন শরীরের ভেতরে একরোখার মত প্ৰবেশ করে হাতটা মুঠিবদ্ধ হয়ে উঠল। আঙুলের কঠিন পিরামিড বসে গেল বাবরের পেটে। মৃদু যন্ত্রণা এবং অস্বস্তি করে উঠল ওখানে। বাবর পিরামিডাটা ভাঙ্গতে চেষ্টা করল। পারল না। সরিয়ে দিতে চাইল, অনড় হয়ে রইল। তখন শক্তি প্রয়োগ করল। তাতেও কাজ হলো না। বরং আরো উঁচু হয়ে উঠল পিরামিডটা, আরো কঠিন হয়ে গেল। বাবর তখন দুহাতে জাহেদার মুখ ঘোমটার মত ঘিরে তার শরীরের ওপর নিজের শরীর টেনে কাছে এলো। এক আঁজলা নাকের ডগা, ঠোঁট, চিবুক পান করে কানের কাছে মুখ রেখে বলল, ও জাহেদা, হেডা, হেডা, হেডা আমাকে ধরে রাখ।

এবং সঙ্গে সঙ্গে কানের লতি দংশন করল সে তার, স্বর্ণকার যেমন অলংকার তৈরির আগে সোনার পাতে আলতো একটা কামড় দিয়ে দেখে। একই মুহূর্তে নিজে হাত দিয়ে জাহেদার প্রহরী হাতে চাপ দিল। পুরনো একটা হাতলের মত সরে গেল তা। বাবর তার করতল দিয়ে চেপে ধরল। শূন্যস্থান এবং ধীরে ধীরে মুঠিবদ্ধ করতে লাগল; আধখানা মুঠো করে সে ধরে দুই ঊরুর মাঝখানে, আর জাহেদার চিবুকের তলায় মুখ গুঁজে চিবুকটা ধীরে ধীরে ঠেলে নিতে লাগল ওপরে যেন একটা লাল ইটে তৈরি বাংলোবাড়ির শাদা জানালার শার্সী সে খুলেছে।

আহ।

আবার অদ্ভুত আর্তনাদ করে উঠল জাহেদা।

কী সোনা?

আহ

হেডা সোনা।

না।

জাহেদার দুটো হাত হঠাৎ জড়িয়ে ধরল বাবরের গলা। প্ৰচণ্ড চাপে যেন শ্বাসরুদ্ধ করে তাকে মারবে। উপরের দিকে টেনে তুলতে চাইল সে বাবরের মুখ। এবং নিজেও নামিয়ে আনল। বাবরের চোখের নিচে জাহেদার ঠোঁট এসে যুক্ত হতেই মেঘ ফেটে রৌদ্র বেরুল যেন। জাহেদা তাকে কম্পিত ঠোঁটে চেপে ধরল। সারা জীবনের মত। তারপর একটা জীবন অতিবাহিত হয়ে গেল। বাবর উঠে এলো আরো কাছে। উপহার করে ধরল তার ঠোঁট। জাহেদা একটু ইস্ততত করল। একবার স্পষ্ট হলো। আবার বিযুক্ত হল। তারপর গলা টান করে রেসের ঘোড়া শেষ মুহূর্তে যেমন প্রথম হয়ে যায় তেমনি ক্ষিপ্ৰতার সঙ্গে বাবরকে সে স্পর্শ করল। দূর থেকে, কিন্তু কাছে। যেমন দুটো দালানের ছায়া পথের কংক্রীটে একে অপরকে ছুঁয়ে থাকে। কিন্তু তারা ছুঁয়ে নেই, তেমনি।

অনেকক্ষণ পর বাবর মুখ সরিয়ে জাহেদার কানের কাছে অস্পষ্ট একটু হাসল। বোধহয় কুঞ্চিত হলো জাহেদার কপাল। বাবর তখন মুখ তুলে অন্ধকারে জাহেদার মুখ দেখতে লাগল যেন আগে কখনো দেখেনি, যেন এইমাত্র কিছু সৃষ্টি করছিল সে, কী করছিল জানে না, এখন দেখছে এবং অবাক হয়ে যাচ্ছে। ফ্রানজ ক্লাইনের মত। মেঝেতে ক্যানভাস বিছিয়ে উন্মাদের মত বালতি বালতি রং ঢেলে, পা দিয়ে মথিত করে, তার ওপরে মডেলের নগ্ন নিতম্ব স্থাপন করে দুহাতে তাকে এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো টেনে নিয়ে দৌড়ে একটা মই বেয়ে উঠে। ফ্রানজ ক্লাইন দেখছে এইমাত্র আঁকা তার ছবিটা।

বাবর হাসল। হাসিটা স্থির হয়ে রইল। তার মুখে।

অন্ধকারে জাহেদার চোখ শুধু দেখা যাচ্ছে। কোথা থেকে এক বিন্দু আলো এসে বন্দি হয়ে আছে মাঝখানে। আলোটা ধীরে ধীরে ডান থেকে বাম দিকে নড়ছে, আবার ফিরে আসছে। বাবর বুঝতে পারল জাহেদাও তাকে এই প্ৰথম দেখার মত দেখছে। বাবর জানে, সে এখন ক্রমশ জাহেদার স্মৃতির অন্তর্গত হয়ে যাচ্ছে।

বাবর মুখ নামিয়ে তার গালে গাল ঘষতে ঘষতে বলল, তুমি ভাল তুমি আমার ভাল। হেডা? হেডা নামটা পছন্দ হয়? বল, সোনা, বল। হেডা সোনা। ও হেডা সোনা, তুমি ভাল।

বলতে বলতে সে জাহেদার পাজামার ইলাস্টিক প্রসারিত করে ধরল। একটু কেঁপে উঠল জাহেদা, জানালার পর্দায় হঠাৎ বাতাস লেগে যেমন। বাবরের হাত মুঠো করে ধরল সে। হাসতে হাসতে বলতে বলতে বাবর সে হাত সরিয়ে দিয়ে পাজামা নামিয়ে দিল হাঁটুর কাছে। হাঁটুর ডিম দুটো গোটান করতলে মাজতে লাগল ক্রিকেট খেলোয়াড় যেমন বল নিয়ে করে।

হেডা, ও হেডা, দ্যাখ না। তোমার ঠাণ্ডা করছে না তো?

বাবর একটু অবাকই হয়েছে, তার হাতের নিচে জাহেদা আর কেঁপে উঠছে না দেখে। এমনকি কি লোমকুপের অসংখ্য চুমকিও ঠেকছে না তার হাতে। মসৃণ, প্রশান্ত, অন্তহীন তার দেহ। বাবর তার রংটা পর্যন্ত আঙুলের ডগা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে।

মনে মনে হাসল সে। হোস্টেলে শরমিন, পাপ্পু আর জাহেদা নিশ্চয়ই কখনো কখনো একজন আরেকজনকে আবিষ্কার করে। নইলে সে চমক নেই কেন জাহেদার? সেই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলীনের মরা ব্যাংয়ের মত নড়ে ওঠা? হঠাৎ থমকে গেল বাবর। দ্রুত আঙুল বুলিয়ে দেখল। অ্যাকসিডেন্ট হলে শাদা ট্রাফিক পুলিশ যেমন ছুটে যায় তেমনি হাতটা পাঠিয়ে দিল সে। অবাক হয়ে টের পেল একটা শক্ত মোটা খসখসে কাপড়ের ফালি দিয়ে দৃঢ় আবৃত জাহেদার অঙ্গ। ফালিটা অনুসরণ করে কোমরে পৌঁছে অনুভব করল চওড়া একটা ফিতের ঘের, চেপে বসে আছে কোমল মাংসে। সন্ধান করল গ্রন্থি। কিন্তু পেল না। উন্মোচনের অধীরতায় বারবার পিছলে যেতে লাগল তার আঙুল। আবার ফিরিয়ে আনতে লাগল। জাহেদা মাথা এপোশ ওপাশ করতে করতে অনুচ্চ কিন্তু তীব্র স্বরে উচ্চারণ করল, না, না।

শান্ত হলো বাবরের হাত। সে হাসল। জিগ্যেস করল, তোমার শরীর খারাপ?

জাহেদা কিছু না বলে মাথা নাড়তে লাগল শুধু।

কবে থেকে?

তবু কিছু বলল না জাহেদা। বাবর মনে মনে ভাবল, কপাল একেই মন্দ বলে। কিন্তু তাতে নিবৃত্ত হলো না সে। আবার সচল হয়ে উঠল।

না।

হেডা সোনা।

না।

কবে থেকে খারাপ।

না।

খারাপ নয়?

না।

না?

যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেল বাবর। শরীর খারাপ নয়? তাহলে। তাহলে এই দেয়াল কেন তুলেছে জাহেদা? কখন সে নিজেকে এভাবে বেঁধেছে? তার মনে পড়ল, ঢাকায় তার বাড়িতে বাথরুমে গিয়েছিল জাহেদা, তারপর বাঘাবাড়িতে, আরেকবার এখানে এই ডাকবাংলোয়। হঠাৎ একটা কথার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার চেতনা। জাহেদা যখন আসতে রাজি হয়েছে তখন থেকেই জানত পরিণামে এই-ই হবে। হয়ত তাই আজ হোস্টেল থেকে বেরুবার আগেই নিজেকে সুরক্ষিত করে নিয়ে বেরিয়েছে। বাবরের মনে পড়ল প্ৰতিবার বাথরুমে অনেকক্ষণ সময় নিচ্ছিল সে। বান্ধন খোলা এবং লাগানোয় তো সময় লাগবেই। সারাদিনে সেই জন্যেই তো তিনবার।

জাহেদা জেনে শুনেই এসেছে। কী বোকা আমি। আমার সঙ্গে এতদূর ওভাবে হোস্টেল পালিয়ে কোনো মেয়ে কেন রাজি হয়েছে দেখেই বোঝা উচিত ছিল। বোধহয় ভালবাসে। ভালবেসে ফেলেছে আমাকে। কিন্তু কবে থেকে? কই, আমি তো কিছুই লক্ষ করিনি। সে জন্যেই কী ভালবাসার অর্থ জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েটা?

ঈশ্বর, এদের দয়া কর। এবং আমাকেও। আমি এত মোটা মাথা বলে।

তাই জাহেদা আসবার পথে প্ৰথমে আমন চুপ করেছিল। আবার এ ঘরে শুতে আসার সময় কথা বলে চলেছিল অনর্গল যেন ভাবনাটা মাথায় না বাসা বেঁধে থাকে। আর এই সারাক্ষণ তার পাজামার ভেতরে শক্ত কাপড়ের কামড় ধরে রেখেছে সে। আশ্চর্য! আমি তাহলে এখনো বুড়ো হয়ে যাইনি।

ভেতরটা খুব উদার হয়ে এলো বাবরের। কিন্তু সেই সঙ্গে বাসনাও গাঢ় হলো আরো। সে আবার খুঁজতে লাগল উন্মোচনের গ্রন্থি। দুহাতে তাকে চেপে ধরল জাহেদা। না, না। মা, মা, আম্মি।

কণ্ঠে কান্নার ধ্বনি। বাবর তার মাথায় সস্নেহে হাত রাখল।

মাকে কেন ডাকছ সোনা?

আম্মি, আম্মি।

আমি তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাব সোনা। যাবে তুমি?

জাহেদা শুধু মাথা এপাশ ও পাশ করতে লাগল।

বাবর তখন কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ও-রকম করে না।

জাহেদা বাবরকে জড়িয়ে ধরল।

আবার তার গ্ৰীবায় একটা দীর্ঘ চুমু দিয়ে বলল, আমাকে ধরে শুয়ে থাক। তোমার কোনো ভয় নেই।

চুলে হাত বুলিয়ে দিল তার। তারপর তাকে বুকে করে পিঠের পরে একটা হাত রেখে আরেকটা হাতে জাহেদার মাথা তুলে নিয়ে সে বলল, হেডা তুমি ভাল মেয়ে। তুমি ঘুমোও। আমি আর কিছু করব না। হেডা, ও হেডা, তুমি মাকে কেন ডাকলে? তুমি কার মত দেখতে হয়েছ? মা-র মত? ও সোনা, তুমি ঘুমাও। আমি তোমাকৈ ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

জাহেদার পিঠে। মৃদু চাপড় দিতে দিতে বাবর গুনগুন করে উঠল, অনেক আগে শোনা জোন বাজের একটা গান। ঘুমপাড়ানির মত সুর! কোথায় যেন কান্না। ছেলেবেলা থেকে কনভেন্টে ইংরেজি পড়া মেয়ের জন্যে আর কোনো এই মুহূর্তের গান তার জানা নেই। সে গাইতে লাগল–

সেই গ্রীষ্মের কথা স্মরণ কর
এবং ক্ৰন্দন কর মাথা নিচু করে,
প্ৰাণনাথ তুমি ক্ৰন্দন কর।
লোকে বলে বিচ্ছেদ আসে
প্রতিটি ভাল বন্ধুর জীবনে;
তাহলে তুমি আর আমিই বাঁ ব্যতিক্রম কীসে?
প্ৰাণনাথ তুমি ক্ৰন্দন কর।
সেই গ্রীষ্মের কথা স্মরণ কর
এবং ক্ৰন্দন কর মাথা নিচু করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *