০৭. একজন আসবে বলেও

একজন আসবে বলেও তক্ষুণি বেরুন সম্ভব হয়নি। আরো কিছুক্ষণ বসতে হয়েছে। বসেছে সে। বারবার তার মনে হচ্ছিল বাবলি একবার এ ঘরে আসবে। এলে কী হবে তা সে জানে। না। কিন্তু প্ৰতীক্ষ্ণ করেছে উৎকৰ্ণ হয়ে প্রতিটি মুহূর্ত।

ঝুঁকির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার প্রবল একটা আকর্ষণ চিরকাল অনুভব করেছে বাবর। বিপদ তার স্বাভাবিক পরিবেশ। উদ্বেগ তার পরিচ্ছেদ। এই দুয়ের বিহনে সে অস্বস্তি বোধ করে, মনে হয় বিশ্বসংসার থেকে সে বিযুক্ত। তাই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, স্বাভাবিকতার প্রয়োজনে, সে অবিরাম সৃষ্টি করে বিপদ আর ঝুঁকি।

বাবলি এলো না।

সুলতানা বলল, আরেকদিন আসবেন।

আসব। তার জন্যে বিশেষ করে বলতে হবে না।

আচ্ছা, সবসময় টিভির মত কথা না বলে বুঝি আপনি পারেন না?

সুলতানার ঐ হঠাৎ মন্তব্যে মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল বাবর। তারপর হেসে ফেলে বলল, দেশে যখন টিভি ছিল না তখনও আমি এমনি করেই কথা বলতাম। আচ্ছা, চলি।

বেরিয়ে এসে দেখল এগারটা বাজতে এখনো অনেক দেরি। বাবলিকে হঠাৎ এগারটা সময় দিতে গেল কেন? না, ভেবে চিন্তে দেয়নি। এমনিই বেরিয়ে গেছে মুখ থেকে। বোধহয় এগারটা শুনতে ভাল, বলতে গেলে জিহ্বার এক রকম তৃপ্তি হয়। এ-গা-র-টা। বাবলির স্তনের ঘ্রাণটা অস্পষ্টভাবে আবার নাকে এসে লাগল হঠাৎ। নিজের আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করল বাবর যে আঙুলে সে তার শরীর সন্ধান করেছিল আজ বিকেলে।

বাসায় ফিরে যাবে?

আজ বড় একা লাগছে বাবরের। আজ নয়, কাল থেকে একা লাগছে। কিন্তু কেন লাগছে। তা এখনও বুঝতে পারেনি।

ধুত্তোর ছাই। খেলারাম খেলে যা।

এক নিমেষে মনটা প্ৰফুল্ল হয়ে উঠল তার। ভিআইপি স্টোরে গাড়ি থামাল সে। কিছু জিনিসপত্র কেনা দরকার। ব্লেড ফুরিয়ে গেছে, শেভিং লোশনও তলানিতে এসে ঠেকেছে। আরো কী কী যেন ফুরিয়েছে চট করে মনে পড়ল না তার।

স্টোরে ঢুকে বলল, একটা টেলিফোন করতে পারি?

টেলিফোনে বাসায় খোঁজ নিল, কেউ এসেছিল কি-না। না, কেউ আসেনি। মান্নান জিগ্যেস করল রাতে খাবে কি-না? না, সে খাবে না। বাইরে খাবে। আবার জিজ্ঞেস করল কেউ আসেনি? কেউ ফোন করেনি? না। হ্যাঁ, না।

বিশেষ কারো কথা ভেবে বাবর জিজ্ঞেস করেছে কি? না, তা করেনি? ওটা তার স্বভাবের অন্তৰ্গত। তার কেবলই মনে হয়। কেউ যেন তাকে খুঁজছে। বাসা থেকে বেরুলেই মনে হয়। কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। তখন বাসায় ফেরবার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে। আবার বাসায় ফিরলে মনে হয় বাইরে, শহরে, কী যেন হয়ে যাচ্ছে যা সে জানতে পারছে না।

শো কেসে লাল সবুজ নীল রংয়ের মেলা। লোশন, সাবান, শ্যাম্পু, ক্রম, পাফ, কত কী! হ্যাঁ, শ্যাম্পূও দরকার। ওটা নিতে হবে। ব্লেড দিন দুপ্যাকেট, সাবানটা কী রকম? নতুন বেরিয়েছে? ভাল? দিন। বাহ, চাবির রিংটা তো সুন্দর। কত দাম? সাত টাকা? না, থাক। ওটা কী? মিনি লাইট? দেখি দেখি, কী রকম? সুন্দর প্যাস্টেল নীল রংয়ের এতটুকু একটা টর্চ। মুঠোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে এত ছোট। পকেটে রাখা যায় স্বচ্ছন্দে। দিন একটা। বাবর পছন্দ করল প্যাস্টেল গোলাপি রং। কয়েকবার নেড়েচেড়ে দেখল। লাইটটা সুন্দর। মনটা খুব খুশি হয়ে উঠল তার। আর, দুপ্যাকেট সিগারেট দিন। লাইফ ম্যাগাজিন এটাই নতুন এসেছে? দিন এক কপি। পনির দেবেন। হাফ পাউণ্ড। এক বোতল টমাটো কেচাপ। আর–আর কী? আর কিছু না।

প্যাকেটটা নিয়ে গাড়িতে বসল বাবর। বাসায় ফিরবে পৌনে এগারটায়। তারপর ঠিক এগারটায় ফোন করবে বাবলিকে। এখনো ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে। বরং খাওয়াটা সেরে নেয়া যাক। কোথায় খাবে?

ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাবর এসে ঢুকল। বইয়ের দোকানে দেখল। চমৎকার সব নতুন বই এসেছে। বই দেখল কিছুক্ষণ। কিন্তু কিনল না। আজ বই কেনার মুড নেই তার। শুধু দেখতে ভাল লাগছে।

হঠাৎ তার পিঠ স্পর্শ করল কেউ। বাবর ঘুরে দেখল। আলতাফ। তার বিজনেস পার্টনার। আলতাফ বলল, আমি তোমাকে গরুখোঁজা করছি।

বাজে কথা! বাসায় এইমাত্র খবর নিয়েছি, কেউ আসেনি।

মানে, বাসায় এখুনি যেতাম।

এই তোমার গরুখোঁজা?

চল কোথাও বসি, জরুরি কথা আছে।

কী ব্যাপার?

এমন কিছু নয়। চল।

তোমার পারিবারিক কিছু?

না, না।

ব্যবসা?

হ্যাঁ, ব্যবসার।

চল, খেয়ে নিই। খেতে খেতে শুনব।

সে অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে বারে চল। কুইক দুটো হয়ে যাবে।

চল।

বারে এসে অর্ডার দিয়ে আলতাফ বলল, শুনেছ বোধ হয় সরকারি কিছু বড় অফিসার সাসপেণ্ড হচ্ছে?

হ্যাঁ, শুনেছি। আমাদের বন্ধুবান্ধব কে কে গেল?

এখনো পুরো খবর পাইনি। সবাই তো আল্লা আল্লা করছে।

ভালই তো।

তবে, একজনের একেবারে পাকা খবর।

কে?

আমাদের হতরন সাহেব।

বল কী? লাফিয়ে উঠল বাবর। সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

যার কথা তারা বলছে তিনি ব্রিজ খেলায় এক্সপার্ট। কিন্তু হরতন বলতে পারেন না। বলেন হতরন। সেই থেকে তার নাম হয়ে গেছে হতরন সাহেব।

মুশকিলের কথা।

বাবরকে চিন্তিত দেখাল।

হতরন যাচ্ছে তাহলে?

ইয়েস, স্যার। পাকা খবর। সেই জন্যেই তোমাকে খুঁজছিলাম।

এইমাত্র কিছুদিনের কথা, হতরন তাদের একটা বড় কাজ পাইয়ে দেবে বলেছে, যার কমিশনই হবে প্ৰায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। শর্ত ছিল এই হতরনের বড় মেয়ের বিয়ে সামনে, গহনার সম্পূর্ণ টাকা দেবে তারা। গহনার অর্ডারও দেয়া হয়ে গেছে। কথা ছিল, গহনা নিয়ে যাবেন হতরন সাহেব, টাকাটা ওরা জুয়েলারকে দিয়ে দেবে।

বাবর জিজ্ঞেস করল, গহনা নিয়ে গেছে?

হ্যাঁ, আজই সকালে নিয়েছে। আমি টেলিফোন করেছিলাম।

আমাদের কাজটা।

সাসপেণ্ড হলে তো কাঁচা কলা পেলাম।

তা বটে।

আর সাসপেণ্ড না হলেই বা কী? এই সময় হতরন কেন হতরনের বাবাও কাজ দিতে সাহস করবে না।

তাইতো।

আলতাফ তাকে একবার ভাল করে দেখে বলল, মনে হচ্ছে তুমিও আজ খুব মনোযোগ দিতে পারছ না।

চমকে উঠল বাবর। বলল, না, তা কেন?

আমার যেন মনে হচ্ছে। আসল কথা কী জান? কথা হচ্ছে, গহনার টাকাগুলো। কাজ দশটা আসবে, একটা পাব, একটা পাব না।

তো কী করবে?

তুমি আজ সত্যি কিছু চিন্তা করতে পারছ না। কী হয়েছে?

কিছু না।

বুঝেছি। চল এবার গহনার দোকানে যাই।

গিয়ে কী হবে?

আচ্ছা, তোমার কী হয়েছে বল তো?

বাবর এবার সত্যি বিরক্ত বোধ করল। এক ঢোকে সবটা হুইস্কি গলায় ঢেলে দিয়ে বলল, চল গহনার দোকানে যাই।

গহনার দোকানে গিয়ে জানা গেল মোট দাম নহাজার সাতশ চুরাশি টাকা। সাড়ে নহাজার দিলেই চলবে।

আলতাফ বলল, দামটা আপনারা ওঁর কাছ থেকেই পাবেন।

কিন্তু কথা তো ছিল আপনারা দেবেন।

হাত কচলে অনাবিল একটা হাসি দিয়ে দোকানদার নিবেদন করল।

আলতাফ বলল, না, সে রকম কথা ছিল না।

মানে? বাবর চমকে উঠল। কিন্তু আর কিছু বলার আগেই নিজের হাতের উপর আলতাফের চাপ অনুভব করল সে।

আলতাফ এবার জোর দিয়েই বলল, আপনারা ভুল করছেন, সে রকম কোনো কথা ছিল না। দাম উনিই দেবেন। গয়না উনি নিয়ে গেছেন?

তা, নিয়েছেন।

তবে আর কথা কী?

কিন্তু আপনিই তো বলেছিলেন—

আপনি তখন ঠিক বুঝতে পারেননি। কথা ছিল, উনি গয়না নিয়ে যাবেন, যদি দাম নিয়ে গোলমাল হয়, তবে জিম্মা আমরা রইলাম।

কী বলছেন স্যার?

হ্যাঁ আপনারা যান তার কাছে। টাকা চান।

দোকান থেকে বেরিয়েই বাবর বলল, এটা কিন্তু ঠিক হলো না?

কী ঠিক হলো না?

এভাবে মিথ্যে বলাটা। দাম তো আমরাই দিতে চেয়েছিলাম।

আলতাফ গাড়িতে বসতে বসতে বলল, হঠাৎ এমন নীতিবাগিশ হয়ে উঠলে যে।

না, এটা নীতিবাগিশ টাগিশ কিছু না। কাজ পাচ্ছি না বলে ভদ্রলোককে তার মেয়ের বিয়ের সময় বিপদে ফেলাটা কিছু কাজের কথা নয়।

কী বলতে চাও তুমি?

ভদ্রলোকের কাছ থেকে অতীতে অনেক উপকার পেয়েছ। দু বার দু। দুটো কাজ দিয়েছিলেন।

তখন তাকে টাকাও দিয়েছি।

দিয়েছ, কিন্তু সেই দুটো কাজে কম লাভ আমরা করিনি। না হয় তার থেকে এই নয়। সাড়ে নয় হাজার টাকা দিলামই।

বুঝলাম না, আজ তুমি এই সাধারণ কথাটা বুঝতে পারছি না কেন। এই টাকাটা একেবারে পানিতে ঢালা হবে। অফিসার হিসেবে হি ইজ ডেড, ডেড ফর গুড়। কিম্বা তোমাদের ইংরেজিতে যাকে বলে ডেড আজ এ ডোর নেইল।

আলতাফ ইংরেজি একটু কম জানে বলে বাবরকে ইংরেজি নিয়ে মাঝে মধ্যে ঠাট্টা করতে ছাড়ে না।

বাবর দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, তবু আমার মনে হয়, গহনার দামটা আমাদের দিয়ে দেয়া উচিত। কী ব্যাপার, হতরনের বড় মেয়েকে দেখেছ নাকি?

দেখেছি, কেন?

চোখ টোখ ছিল নাকি তোমার?

বাজে কথা বল না।

কী জানি। তবে যাই বল, টাকা দেওয়ার বিরুদ্ধে আমি।

বাবর কিছু বলল না। অস্বাভাবিক একটা নীরবতার আশ্রয়ে সে বসে রইল। এ রকম বসে থাকা বাবরের স্বভাব নয়। কথা সে ভালবাসে। কথা না বলতে পারলে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত খাবি খায় সে।

আলতাফ বলল, চল হোটেলে যাই।

যেখানে তোমার খুশি।

তুমি রাগ করেছ?

মোটেই না।

এই জন্যেই মাঝে মাঝে তোমার ওপর আমার ভীষণ রাগ হয়। আলতাফ বলে চলল, তুমি সাধারণ একটু রাগও করতে পার না।

একেবারে মেয়েদের মত কথা বলছি। হা হা করে হেসে উঠল বাবর। বলল, ব্যবসা করতে গেলে রাগ করলে চলে না। ব্যবসা প্ৰেম নয়।

প্ৰেম তো তোমার কাছে বিছানায় যাবার রাস্তার নাম।

আবার হা হা করে হেসে উঠল বাবর। হাসতে দেখে আলতাফ আশ্বস্ত হলো। মনে করল, টাকা দেয়া না-দেয়া সম্পর্কে তার সিদ্ধান্তটাই বাবর মেনে নিয়েছে শেষপর্যন্ত। কিন্তু বাবরের সঙ্গে এতদিন ব্যবসা করলেও বাবরকে সে চেনে না, এইটে তার অজানা।

পরপর কয়েকটা হুইস্কি খেল বাবর। খুব দ্রুত সেরে নিল রাতের আহার। তারপর বলল, আলতাফ, আমি একটু অন্যখানে যাব। কাল দেখা হবে।

কাল কোথায় দেখা হবে?

কেন, অফিসে?

ভুলে গেছ, কাল রাওয়ালপিণ্ডি যাচ্ছি।

ওহো তাইতো।

সেই জন্যেই তোমাকে খুঁজছিলাম। চল আমার বাসায়। কাগজপত্র নিয়ে একটু বসব। কমার্স সেক্রেটারির সঙ্গে সেই ফাইলটা নিয়ে–

হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে। চল।

আলতাফ তাকে বাসায় এনে আবার একটা হুইস্কি দিল।

আবার কেন?

খাও না? ভাল জিনিস। জাপানের।

বাহ, বেশ চমৎকার তো।

বোতলাটা শেষ করবে নাকি আজ?

তুমি ফাইল বের কর।

ফাইল নিয়ে ড়ুবে গেল বাবর। কয়েকটা এষ্টিমেট দুজনে বসে আবার দেখল। না, যা করা হয়েছে, ঠিকই আছে। এই ড্রাফটা ভাল করে লেখা হয়নি। নতুন করে আবার লিখে দিল বাবর। কয়েকটা সই বাকি ছিল, সই করল। তারপর বলল, রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ফিরছ কবে?

তা এক সপ্তাহ লাগবে।

পারলে একবার করাচি ঘুরে এসো। জাহাজের সেই—

হ্যাঁ, মনে আছে। ওটা তদ্বির করতে হবে।

এবারে একটা ফাইন্যাল কিছু করে আসা চাই-ই।

দেখি। মনে হয় করতে পারব।

আমি চললাম। গুড লাক।

বোতলাটা নিয়ে যাও।

না, থাক।

আরো জাপানি জিনিস।

থাক। ফিরে এসো এক সঙ্গে খাওয়া যাবে।

আলতাফ ফটিক পর্যন্ত এলো। বলল, আর শোন হতরন টেলিফোন করলে নিজে বলতে না পার বল আলতাফ না আসা পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না।

আচ্ছা।

সাড়ে নহাজার খুব কম টাকা নয়।

আমি জানি।

আচ্ছা দেখা হবে।

বাবর তীব্ৰবেগে গাড়ি ছুটিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ল। তারপর গাড়ি থামিয়ে পকেট থেকে নোটবুক বের করে দেখে নিল হতরনের বাড়ির ঠিকানা। বাড়িটা খুঁজে পেতে দেরি হলো না। দরোজায় বিজলী বোতাম টিপল সে। একজন এলো। তাকে বলল, সাহেবকে ডেকে দাও।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন তিনি। বাবরকে দেখেই বিস্ময়ে স্থলিত গলায় বলে উঠলেন, আপনি?

হ্যাঁ, আমি।

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বাবরের হাত চেপে ধরলেন। আমার কথা শুনেছেন সব?

হ্যাঁ শুনেছি।

আপনার কী মনে হয়, আমার বাড়ি ওয়াচ করছে ওরা?

ভয় পাবেন না। গাড়ি দূরে পার্ক করেছি। আমি এসেছি। কেউ জানবে না।

আমি, আমি কিন্তু গয়নাগুলো নিয়ে এসেছি।

জানি।

আপনাদের কাজটা করে দিতে পারলাম না। এদিকে এই বয়সে দেখুন দিকি, একটা কিছু হলো লজ্জায়–সামনে মেয়ের বিয়ে–অথচ জানেন, বহু অফিসার যারা রিয়ালি কিছু করেছে, তারা দিব্যি আছে, তাদের নাম পর্যন্ত কেহ করছে না।

আপনি শান্ত হয়ে বসুন।

বসছি, বসছি। এখন কী হবে। বলতে পারেন?

কী আর হবে? যা হবার তাই হবে। ঘাবড়াচ্ছেন কেন?

না। ঘাবড়ে আর কী হবে। চা খাবেন?

থাক, কষ্ট করবেন না। আলতাফের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

না।

টেলিফোন করেছিল?

না। কেন বলুন তো?

আপনার মেয়ের বিয়ে কবে?

সামনের বারো তারিখে।

কেনাকাটা সব হয়ে গেছে?

জি, এক রকম সবই হয়েছে। যদি লিষ্টে আমার নাম বেরোয় তাহলে কী করে যে বিয়ের দিন সবার সামনে দাঁড়াব। আচ্ছা, আপনি আলতাফ সাহেবের কথা জিগ্যেস করলেন কেন? উনি হাই সার্কেল থেকে কিছু শুনেছেন নাকি? আমার নাম আছে?

সত্যি, আপনি ছেলে মানুষের মত করছেন।

ভদ্রলোক তখন দুহাতে মাথা চেপে শূন্যদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। এক আধবার চেষ্টা করলেন শুকনো ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিতে। কিন্তু সে শক্তিটুকু তার দেহে অবশিষ্ট নেই। জিভটা বেরিয়েও যেন বেরুল না। দেখে হাসি পেল বাবরের। কিন্তু না, হাসলে নিষ্ঠুরতা করা হবে।

ভদ্রলোক হঠাৎ চোখ তুলে কিছু একটা বলার জন্যেই যেন বললেন, আপনি এলেন বাবর সাহেব, খুব ভাল করেছেন। সারাদিন ঘরের মধ্যে ছটফট করেছি। রোজা ছিলাম। তারাবির নামাজ পর্যন্ত পড়তে যাইনি। আমার এই বড় মেয়েটা বুঝলেন বাবর সাহেব খুব আদরের। ছেলেটাও ভাল পেয়েছি। এ রকম ভাল পাত্র পাওয়া ভাগ্যের কথা; এবার এমআরসিপি করে ফিরেছে। আলতাফ সাহেব এলেন না?

কী বলতে কী বলছেন ভদ্ৰলোক। এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে যাচ্ছেন ঠিক যেন একটা চড়াই। না, উপমাটা ঠিক হলো না। মাথার ভেতরে হুইঙ্কি কাজ করতে শুরু করেছে। বাবর দেখেছে, একটু বেশি সুরা পান করলেই এ রকম হাস্যকর কথা সব তার মনে পড়তে থাকে।

হতরন সাহেব আবার নীরব হয়ে গেলেন। আবার তার ঠোঁট শুকিয়ে এলো। আবার তিনি জিভ দিয়ে তা ভেজাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলেন। এবারে তিনি বাবরের দিকে ভীত কিন্তু গভীর চোখে তাকিয়ে অনুমান করতে চেষ্টা কলেন কেন সে এসেছে। তার ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল। কেন লোকটা বলছে না। তার আসার আসল উদ্দেশ্য কী?

কিন্তু বাবর নিজে যে কোন চুপ করে আছে তা সে নিজেও বলতে পারবে না। একবার তার মনে হচ্ছে, সে গভীর ভাবে কী ভাবছে, আবার মাচ্ছে, না ভাবছে না। শূন্যতা, অসীম এক শূন্যতার মধ্যে বিনিসুতো ঝুলে আছে সে।

সোয়াতের গিরিশৃঙ্গগুলোর ফাঁকে ফাঁকে যেমন নীল শূন্যতা, শীতল শূন্যতা, স্তব্ধ শূন্যতা–এ যেন তেমনি। বাবর একবার মনোযোগ দিয়ে দেখছে–হতরন সাহেবের পা জোড়া যেন সেখানে কোনো দুর্বোধ্য লিপিতে কিছু লেখা আছে। আবার সেখানে থেকে চোখ ফিরিয়ে ভদ্রলোকের গালে কাটা জায়গাটা দেখছে। দেখতে দেখতে সেই দাগটা এত বড় হয়ে গেল যে তাতে আবৃত হয়ে গেল দৃশ্যমান সব কিছু। কোথায় যেন ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। ঝরে যাচ্ছে। আশা, উদ্যম, বর্তমান, ফোঁটায় ফোঁটায় নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। বাবরের হাতে সিগারেট পুড়ছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ছাই। আস্তে আস্তে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে ধনুকের মত। বাবর উদ্বেগ নিয়ে এখন তাকিয়ে দেখছে কখন খসে পড়বে হাইটুকু। এই বুঝি পড়ে। এই বুঝি পড়ল। না, এখনো কিছুটা শক্তি, কিছুটা আকর্ষণ অবশিষ্ট আছে। বশির মত বাঁকা হয়ে এসেছে, তবু ধূসর সুগোল দীর্ঘ ছাইটা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে না সিগারেট থেকে।

হতরন সাহেব বলে উঠলেন, বাবার সাহেব?

বাবর সচকিতে তাকাল তার দিকে। অভ্যাসবশত এক টুকরো হাসিও ফুটে উঠল তার সমস্ত মুখে।

বলুন।

বাবর ছাইটা নিজেই ঝেড়ে ফেলে দিল।

আমি এই এত বছর চাকরি করলাম, মনে করতে পারেন লাখ লাখ টাকা বানিয়েছি। সবাই তাই মনে করে। গভর্ণমেন্টও তাই মনে করছে। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন, আমার ব্যাংকে একটা পয়সাও নেই। বড় কষ্ট করে জীবনটা চালিয়ে এলাম। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পেরেছি, ঐ যা। কিন্তু একটা বাড়ি বলুন, এক টুকরা জমি, বেনামিতে টাকা–কিছু না। শুনি, আমাদের কোনো কোনো সাহেবের ফরেনে টাকা পয়সা আছে—

থাক ওসব। নাইবা বললেন।

না, না, বলছি। এই জন্যে যে, আপনাদের কাজটা করে দিতে চেয়েছিলাম বলে মনে করবেন না, আমি যে আসে তার জন্যেই করি। আপনারা মানে আপনাকে আমি অন্য চোখে দেখি। আপনিও রিফিউজি, আমিও আমার পৈতৃক বাড়িঘর জমিজমা সব মুর্শীদাবাদে ছেড়ে এসেছি। মেয়েটার বিয়ে যে কষ্ট করে দিতে হচ্ছে তা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না–আপনারা আমার মেয়েকে নিজের মনে করে কিছু দিতে চেয়েছিলেন–বলতে বলতে ভদ্ৰলোক উদগ্রীব চোখে তাকালেন বাবরের দিকে। কথা শেষ করতে পারলেন না। ভয়, পাছে বাবর তার প্রতিবাদ করে। কে জানে হয়ত সে জন্যেই এত রাতে সে এখানে এসেছে কি-না।

বাবল বলল, আমি সেই ব্যাপারে এসেছি।

কেন, কিছু–অন্য রকম কিছু–মানে–বলুন।

গয়নার টাকাটা আমরা দেব বলেছিলাম।

সে আপনাদের দয়া।

বাবরের হঠাৎ রাগ হলো ভদ্রলোকের দীনতা দেখে। এরা পৃথিবীতে বাস করে কী করে? তার সামনে বাবর তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে ঈশ্বরের মত মনে করতে বাধ্য হচ্ছে। বাবরের হাতে তার সব কিছু নির্ভর করছে এখন– অথচ বাবর মোটেই তা উপভোগ করতে পারছে না। তাই সে চুপ করল।

ভদ্রলোক বললেন, গয়না। আমি নিয়ে এসেছি। এখন—

জানি। টাকাটা দেব বলেছিলাম।

হ্যাঁ।

টাকাটা চেকে দিলে অসুবিধে হতো। আপনার নাম জানি না লিষ্টে আছে কি-না। কিছু চিন্তা করবেন না। টাকাটা নগদ কাল আপনি পেয়ে যাবেন। আমি দিয়ে যাব।

ভদ্রলোকে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। এক মুহূর্তে তার চেহারাটা আলো হয়ে উঠল। তিনি কিছু শব্দ খুঁজলেন, কিন্তু পেলেন না। শেষে বললেন, একটু চা খান।

না, আমি চলি। এই কথাটা বলতে এসেছিলাম।

অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে কী আর বলব।

আর শুনুন, আলতাফ যেন না জানে।

আমার মেয়ের বিয়েতে আসবেন না?

আসব। চলি এখন।

কিছু খেলেন না?

আবার কোনোদিন।

আচ্ছা, আমার নাম কী লিষ্টে আছে বলে মনে করেন?

আমি খবর পাইনি। ভয়ের কি আছে। বিপদ তো পুরুষ মানুষের জন্যেই। ভয় করলেই ভয়।

তবু, এই বয়সে মান সম্মান।

আমি যাচ্ছি। কাল টাকা পাবেন।

ভদ্রলোক বাবরকে দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দেবার শক্তি পর্যন্ত পেলেন না। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ঘরের মাঝখানে।

ঘরে এসে শুতে যাবে হঠাৎ বাবরের মনে পড়ল বাবলির কথা। দৌড়ে সে টেলিফোনের কাছে গেল। রিসিভারটা তুলল। নামিয়ে রাখল। নিজের বুকের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছে সে স্পষ্ট। হাতঘড়িটা খুঁজল। বাথরুমে খুলে রেখেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার সমস্ত শরীর যেন পাকিয়ে উঠল একটা দীর্ঘ স্কুর মত। ঘড়িতে সাড়ে বারোটা বাজে। সে বলে এসেছিল, বাবলিকে, এগারটায় তার টেলিফোনের অপেক্ষা করতে। বাবলির দুটো স্তন আবার সে দেখতে পেল ঘড়ির ডায়ালে। আর নাকে সেই অস্পষ্ট সুঘ্ৰাণ।ধীরে, যেন স্বাস্থ্যস্বচ্ছল। খোকা মায়ের কোলে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, তেমনি নড়ে চড়ে উঠল তার শিশ্ন। বড় হতে লাগল। উত্তাপ বিকিরণ করতে শুরু করল। উত্তাপে, আয়তনে, সে তার দেহের চেয়েও বিশাল হয়ে উঠল যেন। তারপর আবার হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল। শীতল হয়ে গেল। অস্তিত্ব অবলুপ্ত হলো তার। বাবর টেলিফোনের কাছে এলো।

এখন ডায়াল করবে বাবলিকে? এই মাঝ রাতে, যখন ওদের বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চারদিক। গভীর রাতে টেলিফোনের আওয়াজ বড় উচ্চগ্রামে বাজে। যদি সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়? যদি বাবলির ভাই টেলিফোন ধরে? যদি বাবলিই ধরে আর পাশের ঘরে কান খাড়া করে থাকে তার ভাবী?

হাসি ফুটে উঠল বাবরের ঠোঁটে। খেলারাম, খেলে যা। মন্দ কী? বাবর প্রলুব্ধ হলো বিপদের সামনা করতে। বিপদ যদি আসেই দেখা যাক না আমি কী করে সামলাই। রিসিভারটা তুলে নিল বাবর। ধীরে, একটার পর একটা নম্বর ঘোরাল সে। শুনল অন্য দিকে বেজে উঠল টেলিফোন। কিম্বা এত দ্রুত যে, বেজে ওঠার আগেই কেউ রিসিভার তুলল। কিন্তু অপর পক্ষ কোনো সাড়া দিল না।

গাঢ় হিংস্র একটি স্তব্ধতা।

তখন বাবর বলল, হ্যালো।

সে স্তব্ধতা আরো বিকট হয়ে উঠল।

বাবর আবার বলল, হ্যালো।

তবু সেই স্তব্ধতা হত্যা করে কেউ উত্তর দিল না। কিন্তু আশ্চৰ্য, বাবরের মনে হলো স্তব্ধতা এখন তার হিংস্ৰ নখরগুলো গুটিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। ঘুমিয়ে পড়ছে। বাঘের সুবৰ্ণ পিঠে ধীরে ধীরে সূর্যোদয়ের আলো এসে পড়ছে। নির্মল বাতাস বইতে শুরু করেছে দিগন্তের দিক থেকে।

বাবর অত্যন্ত কোমল প্ৰশান্ত কণ্ঠে প্ৰায় ফিস ফিস করে উচ্চারণ করল, হ্যালো।

অপর দিক থেকে জবাব এলো, এখন পৌন একটা বাজে।

বাবলি! বাবলি! বাবলি!

নামটা বারবার উচ্চারণ করেও তাপ্তি হলো না বাবরের। যেন এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে টেলিফোনের তারের ভেতর দিয়ে তার ঈষৎ কম্পিত দুটো হাত বাবলির শ্যামল মুখটাকে আদর করতে লাগল।

বাবলি তুমি জেগে আছ? কী করছ বাবলি? কোন ঘরে টেলিফোন? বাবলি, তুমি রাগ করেছ? আমি এগারটায় টেলিফোন করেছিলাম।

মিথ্যে কথা।

তুমি টেলিফোনের কাছে ছিলে?

বাবলি তার উত্তর করল না।

ছিলে তুমি টেলিফোনের কাছে?

আপনি মিথ্যে কথা বলেন।

হাসল বাবর। বলল, হ্যাঁ মিথ্যে বলেছি। তোমাকে মিথ্যে বলে দেখলাম কেমন লাগে। তুমি আমাকে বকবে না। বাবলি? বকো না? আমি খুব খারাপ। আমি খুব খারাপ লোক। তোমাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি।

জি না, আমি আপনার জন্যে বসেছিলাম না।

টেলিফোন তোমার ঘরে? ঘুমুচ্ছিলে? আজ জান, সারাক্ষণ তোমার কথা মনে পড়েছে। মনে হয়েছে। জীবনের সবচে ভাল একটা দিন আমার আজ। এই দিনটার জন্যেই আমার জন্ম হয়েছিল। বাবলি! তোমাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে। কাল আসবে?

না।

এসো না কাল?— আচ্ছা, পরশু সকালে। কলেজ যাবার পথে।

না।

তুমি খুব রাগ করেছ। এত রাগ করতে নেই। আমি তোমার ভাল চাই। তুমি কত বড় হবে। কত নাম হবে তোমার। তোমার বিয়ে হবে। আমি তোমার বাড়িতে বেড়াতে যাব। আচ্ছা, আমি গেলে আমাকে কী খেতে দেবে?–বল। বল? বাবলি?–না, তুমি সত্যি রাগ করেছি। আমাকে একবার বকে দাও। বাবলি? সত্যি একটা জরুরি কাজে এমন আটকে গেলাম, তাছাড়া টেলিফোনটাও খারাপ ছিল, এই একটু আগে ঠিক হয়েছে। মাত্র কয়েক মিনিট আগে। বিশ্বাস কর।

আপনি মনে করেন, আমি ছেলে মানুষ, না?

যাক, কথা বললে তাহলে। আমি ভাবলম, আর কোনোদিন আমার সঙ্গে কথা বলবে না।

আপনি মনে করেন, আমি কিছু বুঝি না?

তা কেন? তুমি সব বোঝা। তুমি সব বোঝ বলেই না আজ তোমাকে এত আদর করলাম। আসবে না কাল?

টেলিফোন আপনার খারাপ ছিল না।

তুমি রিং করেছিলে নাকি?

না।

তাহলে কী করে বুঝলে?

হ্যাঁ, করেছিলাম।

আমি বাসায় ছিলাম না। এই তো? বাইরে আটকে গিয়েছিলাম। চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে সাহেব এসেছেন তার সঙ্গে কিছু আলোচনা ছিল। উনি কালকেই ইয়োরোপ যাচ্ছেন। আবার দশদিন পর ঢাকায় আসবেন। তোমার জন্যে একটা মজার জিনিস আনতে দিয়েছি তার কাছে।

চাই না। আমি আপনার জিনিস।

কেন? এত রাগ করলে আমি কোথায় যাব বলতে পার?

যেখানে আপনার খুশি। আপনার কত জায়গা।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। কিন্তু তারা আমার আপন নয়।

আমিও আপনার কেউ না।

তুমি আমাকে টেলিফোন না করার জন্যে যে শাস্তি দেবে তাই নেব।

আমি আপনাকে টেলিফোন করতে বলিনি।

আচ্ছা শোন, এসব টেলিফোনে হয় না। কাল তুমি এসে আমাকে খুব করে বকে দিয়ে যাও। আসবে না?

কোনোদিন আর আসব না।

কেন?

জাহেদার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

কবে?

আজ।

আমার এখান থেকে যাবার পর?

হ্যাঁ।

কেমন আছে ও?

মিথ্যেবাদী। আপনার সঙ্গে ওর সোমবারেও দেখা হয়েছে।

তাই বলে কেমন আছে জিগ্যেস করতে নেই আজ?

আপনার চিঠি দেখলাম।

হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার কাছে উঠে এলো বাবরের। বলল, দেখলে?

হ্যাঁ।

ও দেখাল?

জাহেদা তোমাকে দেখাল?

যে ভাবেই হোক, আমি দেখেছি।

তারপর?

ঘটনার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে বাবর বলল, তারপর কী?

আবার কী? আপনি কোনোদিন আমাদের বাসায় আসবেন না। যদি আসেন ভাইয়াকে সব বলে দেব।

বেশ, আসব না।

আপনি, আপনি একটা ইতর। আপনি মানুষ না। আপনি সব পারেন। টেলিফোন রাখার শব্দ শুনল বাবর।

বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে। তাকিয়ে রইল বাতির দিকে। কেমন একটা অস্পষ্ট রামধনু বাতিটা ঘিরে স্থির হয়ে আছে। কোথায় যেন সে শুনেছিল, এটা একটা ব্যাধিবাতির চারদিকে এই রামধনু দেখাটা। কালকেই একবার চোখের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এই যে মাঝে মাঝে মাথাটা একটু টিপ টিপ করে এটাও বোধহয় এই চোখেরই জন্যে। কিন্তু সে তো সব কিছুই পরিষ্কার দেখতে পায়। পড়তে পারে। নাকি, বর্ণকানা হয়ে যাচ্ছে?

বাবর হাসল। বর্ণকানা? মন্দ কী? লালকে বেগুনি দেখবে। সবুজকে নীল। আমরা কি বর্ণের সম্পূর্ণ ব্যঞ্জনা এই দুটো চোখ দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি? আমি একটা গাছের পাতাকে যতটুকু সবুজ দেখি, যে সবুজ দেখি, আরেকজন কি ঠিক তাই দেখে?

আজ হুইঙ্কিটা একটু বেশি হয়ে গেছে।

আশ্চর্য, পরপর দুদিন দুটো মেয়ে প্রায় একই কথা বলল। বাবর কোনো কারণ খুঁজে পায় না, কেন লতিফা তাকে ঐ কথাগুলো বলেছে। কেন সে লেখাপড়া ছেড়ে বিয়ের কনে হতে চলেছে? আর জাহেদাই বা কী রকম? চিঠিটা বাবলি দেখল কী করে? কী লিখেছিল। সে চিঠিতে? কথাগুলো মনে আছে? না। বক্তব্যটা মনে পড়ছে, শব্দগুলো মনে নেই। বাবলি দেখেছে চিঠিটা। দেখেছে? না, জাহেদা দেখিয়েছে? জাহেদা কেন হঠাৎ দেখাতে যাবে? তাহলে জাহেদা কি তার সাথে যাবে না? জাহেদা তো বলেছিল, যাবে। তারা দুজন এক সঙ্গে উত্তর বাংলা যাবে।

খেলারাম, খেলে যা। বাবলি জেনেছে, জানুক। কাল যদি বাবলি তার বাসায় আসে তাতেও আশ্চর্যের কিছু নেই। ঐ বয়সের মেয়েরা বরং আসব না বলেই আসে। না বলে হ্যাঁ করে। বাবলি এলে, কাল তাকে আর সে ছাড়বে না। শুধু আদর নয়, চুমো নয়, কথা নয়। বাবলিকে সে কাল সোজা বিছানায় নিয়ে যাবে।

বাবর শুধু এই কথাটা ভুলে গেছে, বাবলি স্পষ্ট বলে দিয়েছে, সে আসবে না। বোধহয় হুইঙ্কির জন্যে তার এখন বিশ্বাস করতে কোনো বাধা হচ্ছে না যে বাবলি কাল আসবে।

বাবর টের পায় আবার তার দুপায়ের মাঝখানে উত্তাপ বাড়ছে। বড় হচ্ছে। তার দেহকে ছাপিয়ে উঠছে আয়তনে। বাবর উপুড় হয়ে শুল। শাসন মানল না। তবু বড় হতে লাগল। উত্তাপে উত্তেজনায় যেন সেখানে ছোট ছোট ড্রাম বাজানোর কাঠিতে বাড়ি পড়তে লাগল। সৃষ্টি হতে লাগল একটা দ্রুত লয় ছন্দের। লয়টা দ্রুত থেকে আরো দ্রুত হতে লাগল। চোখের ভেতরে বাবলিকে সে দেখতে পেল স্পষ্ট। নির্বাক। নগ্ন। কাছে, আরো কাছে। সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে তাকে অনুভব করতে লাগল বাবর।

আরো কাছে।

বাবলি এখন তার দেহের সঙ্গে এক। আর যুগলে যেন বাজছে সেই ছোট ছোট ড্রাম। দোকানে দেখা খেলনা ড্রাম। নীল রং চারদিকে। মাঝখানে একটা উজ্জ্বল লাল রেখা। বৃত্তাকারে ঘুরছে নীল, লাল, নীল। আবার নীল, আবার লাল, আবার নীল। ঘুরতে ঘুরতে রং দুটো একাকার হয়ে গেল। বাজনার দ্রুত লয় যেন বাবরের অস্তিত্বকে অতিক্রম করে এখন হঠাৎ শেকলকাটা পাখিব মত উড়ে গেল উর্ধে আকাশে, শূন্যে। উজ্জ্বল রোদে পুড়ে যেতে লাগল বাবরের চোখ। সে দুহাতে সজোরে চেপে ধরল। তার উত্তপ্ত অধীর দ্রুত স্পন্দিত শিশ্ন। এবং তৎক্ষণাৎ এক বহু আকাঙ্গিক্ষত, মন্ত্ৰোচ্চারিত, খরচৈত্রের বৃষ্টির আবেগে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে নেবে এলো অন্ধ, অজস্র শাস্ত্রে বর্ণিত চল্লিশ দিন-রাত্রির প্রান্তর পাহাড় ডোবান মুখর জলধারা। বাবর ভেসে যেতে লাগল স্থলিত একটা সবুজ পাতার মত।

দিনের প্রথম কাজ ব্যাংকে যাওয়া। হতরন সাহেবের মেয়ের গহনার দরুন সাড়ে ন হাজার তুলতে হবে। চেক কাটতে ভুলে সাড়ে দশ হাজার লিখে ফেলল বাবর। ভুলটা আর সংশোধন করল না। সাড়ে দশ হাজারই তুলল। এক হাজার নিজের কাছে থাকবে। এত টাকা এক সঙ্গে সাধারণত নিজের জন্যে রাখে না, আজ রাখল। বাবর ঘটনাচক্ৰে বিশ্বাস করে। কে জানে, কখন কী হয়, কোন কাজে লাগে। নোট নেবার সময় বাবর পুরনো নোটই পছন্দ করল। কিন্তু এমনভাবে পুরনো নোট সে চাইল যেন কারো সন্দেহ না হয়। হতরন সাহেবকে পুরনো নোট দেয়া তার জন্যে, বাবরের জন্যে, উভয়ের জন্যেই নিরাপদ। কেবল নিজের নোটগুলো নতুন দশ টাকায় নিল সে। ম্যানেজার সাহেব জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার বাবর সাহেব। এক সঙ্গে হঠাৎ এত টাকা ক্যাশ দরকার পড়ল?

একটা জমি কিনব। আজ বায়না হচ্ছে।

তাই নাকি? কোথায়?

বনানীতে।

মোনায়েম খাঁর বাড়ির পাশেই নাকি? বলে ম্যানেজার খ্যা খ্যা করে হাসলেন, উচ্চাঙ্গের একটি রসিকতা করছেন। বাবরও তার জবাবে তারই মত খ্যা খ্যা করে হাসল ইচ্ছে করে। ম্যানেজার তা দেখে আরো সুধা ঢেলে উচ্চগ্রামে। এবার খ্যা খ্যা করে উঠলেন। বাবর ব্যাংক থেকে বেরুল।

হঠাৎ মনে হলো, খবরের কাগজে কি হতরন সাহেবের নাম বেরিয়েছে? মোড় থেকে কাগজ কিনে তন্নতন্ন করে দেখল সে। তা, সাসপেণ্ড অফিসারদের নামের লিস্ট আজও বেরোয়নি। তার মানে আর একটা দিন ভদ্রলোক এই রোজার দিনে দারুণ উৎকণ্ঠায় ভুগবেন। এ হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বরের নাটক। বাবর হাসল।

হতরনের বাড়ির সামনে এসে তাকিয়ে দেখল। চারদিক। না, সন্দেহজনক কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। টাকাটা খবরের কাগজে মুড়ে সে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে কলিং বেল টিপল। অপেক্ষা করল। কেউ সাড়া দিল না। আবার বেল বাজাল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত দরজা খুলল না কেউ। বেলটা আবার টিপতে যাবে দরজা ফাঁক হলো। দেখা গেল হতরন সাহেবের নিশিজাগা চেহারা।

বাবর বলল, এই যে। এবং খবরের কাগজের মোটা মোড়কটা হাতে তুলে দিল তাঁর। বলল, এতে আছে।

উত্তরের অপেক্ষা না করে সে ফিরে এলো গাড়িতে। আবার চারদিকে দেখল। একটা লোক গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে দূরে। আই বি-র লোক? আচ্ছা, দেখাই যাক। বাবর একটা সিগারেট বের করে। এ-পকেট ও-পকেট হাতড়াবার ভাণ করল। তারপর লোকটার কাছে গিয়ে বলল, দেশলাই আছে?

লোকটা যেন কৃতাৰ্থ হয়ে গেল। দেশলাই বার করে দিল বাবরের হাতে। না, গোয়েন্দা হলে এতটা কৃতাৰ্থ হতো না। বাবর সিগারেট ধরিয়ে গাড়িতে ফিরে গেল, আয়নাটা একটু ঘুরিয়ে দিল যাতে লোকটাকে দেখা যায়। খুব ধীরে গাড়ি চালাল সে। কিছু দূর গেল। দেখল লোকটা এবার চারদিক দেখে গাছতলায় বসল প্রস্রাব করতে।

যাঃ বাবা। এই ব্যাপার? সেই জন্যে লোকটাকে আমন উসখুস করতে দেখা গিয়েছিল? বাবর গাড়ির গতি বাড়িয়ে পলকে বড় রাস্তায় গিয়ে পড়ল তখন।

ঘড়ি বলছে, দশটা দশ। জাহেদা নিশ্চয়ই এখন হোস্টেলে নেই। ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার। প্রথমত, বাবলি কী করে তার চিঠি দেখল। দ্বিতীয়ত, উত্তর বাংলায় জাহেদা যেতে রাজি কি-না। এই দুটো ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার।

হোস্টেলের দারোয়ানকে সে জিগ্যেস করল জাহেদার কথা।

আচ্ছা দাঁড়ান, দেখে আসি।

শিগগির।

আরেকটা সিগারেট ধরাল বাবর। পায়চারি করল খুব ছোট পরিসরে। গাছপালার মাথায় আলোর নাচন দেখল। তখন ফিরে এলো দারোয়ান।

রুমে নেই।

ও। আচ্ছা। এলে তাকে বলবে–না থাক, আমি আবার আসব। বাবর এয়ারপোর্টে এলো। সকালে ঘুম থেকে এত দেরি করে উঠেছিল যে, নাশতা খাবার সময় ছিল না। খিদেও ছিল না তেমন। এখন প্ৰচণ্ড খিদে করে উঠল। সে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসল। আলতাফের প্লেন সকাল পৌনে আটটায় ছেড়ে গেছে। আলতাফ কি কাজগুলো ঠিক মত গুছিয়ে আসতে পারবে? ভ্ৰকুঞ্চিত করে ভাবল খানিক বাবর। এখন সময় খুব সুবিধে যাচ্ছে না। হতরন সাহেব কাজটা দেবেন বলেছিলেন, তিনি নিজেই এখন কাৎ। এর আগে একটা কাজে বিশেষ কিছু থাকেনি। আজ সাড়ে নহাজার টাকা অমনিই চলে গেল। না দিলেও পারত। আলতাফ না দিতেই বলেছে। কিন্তু তার যে কী হলো, হঠাৎ মনে হয়েছিল টাকাটা না দেয়া খুব বড় রকমের অন্যায় হবে।

অনুতাপ বাবরের স্বভাববিরুদ্ধ। যারা অনুতাপ করে তারা এগোয় না। অনুতাপ একটি শিকলের নাম। কী করলাম সেটা বড় নয়, কী করছি সেটাই বিবেচ্য। বিলেতে থাকতে একটা নাটক দেখেছিল বাবর। তার একটা কথা এখনো মনে আছে তার। মেয়েটি জিগ্যেস করেছিল, আমি কোথায়? ছেলেটি তার উত্তরে বলেছিল, অতীত এবং ভবিষ্যতের মাঝখানে, যেখানে তুমি আগেও ছিলে, এখন আছ এবং পরেও থাকবে। অসংখ্য বর্তমানের গ্রন্থনা আমাদের জীবন।

রুটির ওপর পুরু করে মাখন লাগাল বাবর। আবার সন্তৰ্পণে সমস্ত মাখন চেছে তুলে ফেলল। এমনিতেই মোটা হয়ে যাচ্ছে সে। এত মাখন খাওয়া কাজের কথা নয়। পোচ করা ডিম দুটিকে মনে হলো যেন কোনো সৰ্পনারীর স্তনযুগল। বাবর কাটার আঘাতে তা ভাঙলো। গড়িয়ে পড়ল গাঢ় হলুদ রস, যেন এক জণ্ডিস রোগাক্রান্ত মানুষের বীর্য যা শীতল রক্ত মানুষের জন্ম দেবে।

এই উপমাটা আলতাফকে একদিন সে নাশতা খেতে খেতে বলেছিল। তারপর থেকে সপ্তাহখানেক নাকি আর আলতাফ ডিমের পোচ মুখে তুলতে পারেনি।

আলতাফ বলেছিল, তোমার একটা বড় দোষ কি জান? তুমি সেক্স ছাড়া কিছুই ভাবতে পার না। সৰ্বক্ষণ ঐ এক কথা ভাবছি, সব কিছুতেই ঐ এক জিনিস দেখছ।

কেন নয়? মানুষের জীবনে বড় সত্য কী বল?

আলতাফ বলেছিল, তুমি বল।

আসলে আলতাফ অতশত বোঝে না। হিসেবটা বোঝে। আসবাব-পত্রের শখ আছে। আর মা বলতে অজ্ঞান।

বাবর বলেছিল জীবনে একটা ঘটনাই সত্য। তা হচ্ছে মৃত্যু।

বলে যাও।

মৃত্যু কীসে সম্ভব?

সব কিছুতেই। অসুখে-বিসুখে, ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে আত্মহত্যায়, আর কত কিছুতে।

আমি তা বলছি না। মূলত মৃত্যু দুপ্রকারে আসতে পারে। এক ক্ষুধায়। আর এই কাজটা যাকে ভাল বাংলায় যৌনসঙ্গম বলে, তার অভাবে।

ক্ষুধায় না হয় মানুষ মরে স্বীকার করি, কিন্তু ঐ কাজ না করলে মানুষ মরবো কেন? বহু চিরকুমার আছে। পথে ঘাটে।

আমি ব্যক্তিবিশেষের কথা বলছি না। মনে কর যদি কোনোক্রমে আজ গোটা মানুষের মধ্যে যৌনসঙ্গম বন্ধ করে দেয়া যায়, তাহলে? নতুন মানুষ জন্মাবে না। এক পুরুষ পরে পৃথিবীতে মানুষ নামে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব থাকবে না।

তোমার সব অদ্ভুত কথা।

অদ্ভুত শোনালেও অবাস্তব নয়। আমি বলছিলাম ক্ষুধা আর যৌনজীবন মানুষকে যুগ থেকে যুগ বংশ থেকে বংশ আবিষ্কার থেকে আবিষ্কারে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার দুটি শক্তির নাম। এ ছাড়া তৃতীয় কোনো শক্তি নেই। আমি যেমন ক্ষুধাকে জয় করবার জন্যে কাজ করছি, তেমনি ঐ দ্বিতীয়টার জন্যেও সময় দিচ্ছি।

বাবর পয়সা দিয়ে বেরিয়ে এলো।

আহার্যে সে আজকাল আর আগের মত স্বাদ পায় না। ক্ষুধা হয়। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করে না। খেতে বসে কিন্তু ডিশ পছন্দ হয় না। আগে কত অল্প সময়ে মেনু দেখে বলে দিতে পারতএইটে খাবে। এখন মেনু নিয়ে দীর্ঘ সময় কেটে যায়, মনস্থির করা যায় না। আগে এমন হতো ক্ষুধা বোধ হবার মুহূর্ত থেকে স্পষ্ট দেখতে পেত, চোখের সমুখে খাদ্যের ছবি। কল্পনায় উত্তপ্ত সুঘ্রাণ এসে নাকে লগত তার। এমনকি পরিবেশটাও ভেসে উঠত চোখেটেবিল, সাদা চাদর, সবুজ ন্যাপকিন, ঝকঝকে প্লেট, বুদবুদ জড়ান ঠাণ্ডা পানি। এখন সেই প্রখর মনটা আর নেই। কোনো রেস্তোরাঁই পছন্দ হয় না তার। কোনো সার্ভিসই যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক বলে মনে হয় না। বকশিস দেয়াটা বাহুল্য বোধ হয়। এখন সে মাত্র একটি সিকি বকশিস করেছে।

আবার সে এলো জাহেদার হোস্টেলে। দারোয়ান তাকে দেখে এগিয়ে এলো। বলল, আপা এখনো ফেরেনি।

আমি জানি।

হোস্টেলের সঙ্গেই কলেজ। বাবর গাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে কলেজের মাঠে গিয়ে থামল। এই কাঠবাদাম গাছটা তার ভারি পছন্দ। কেমন শান্ত, সহনশীল, শীতল, ছেলেবেলার বন্ধুর মত। বাবর একটা সিগারেট ধরাল। তাকিয়ে রইল অজস্র সচ্ছল ডালপালার দিকে। আলতাফ রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত কোনো কাজ নেই। পিণ্ডি থেকে কাজ ঠিক মত গুছিয়ে আনতে পারবে কি-না ও, তাই বাঁ কে জানে। বরং সে নিজে গেলেই পারত। কিন্তু যাতায়াতটা বেশি পছন্দ করে আলতাফ, হোটেলে থাকা, ট্যাকসিতে করে ছুটোছুটি করা ফেরার সময় বাড়ির জন্যে জিনিসপত্র কেনা। বাবরের জন্য গতবার ও সুন্দর একটা স্কাফ এনেছিল। লাল জমিনের ওপর সবুজ কলকে তোলা। ঠিক এই বাদাম গাছটার মত সবুজ। আর সবচে বিস্ময়কর যে, কোনো গাছে এক মাত্রার সবুজ থাকে না, অসংখ্য মাত্রার সবুজ মিলে একটা বর্ণের সৃষ্টি হয়। কাছে এলে, একটা একটা করে পাতা লক্ষ করলে তবে বোঝা যায় প্রকৃতির এই কারিগরিটা। এদিক থেকে মানুষের সঙ্গে একটা আশ্চর্য মিল আছে। অমিলও কি নেই? কাছে এলেও মানুষের সব রং তো চোখে পড়ে না।

আমাকে কে কতটুকু জানে? বাবর ভাবল এবং হাসল। বাবর কি সেই জন্যেই এমন একেকটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় যাতে আরো অচেনা হয়ে যায় অপরের কাছে? এতে সে মজা পায়। মনে মনে হাসার সুযোগ হয় আরো। নিজেকে এক নির্বোধের পৃথিবীতে চতুর কোনো যাদুকর বলে মনে হয় তার।

আমি জীবনের যাদুকর এক নির্বোধ পৃথিবীতে।

বাক্যটা নিজের কাছেই খুব চমকপ্ৰদ মনে হলো বাবরের। তার কবরের ওপর লিখে দিলে হয়। বাবর যেন চোখেই এখন দেখতে পেল তার কবর, তার মাথার মার্বেলে লেখা ঐ পরিচিতি, ঐ ঘোষণা, ঐ শব্দ সমূহের অন্তরালে প্রবহমান অট্টহাসি।

আরেকটা সিগারেট ধরাল সে। সিগারেটেও আজকাল আর তেমন স্বাদ নেই। কত রকম ব্ৰাণ্ড বদলেছে, দেশী, বিদেশী, কিন্তু কোনোটাই তাকে তার ক্রীতদাস করতে পারেনি। এখন সে যে সিগারেট খাচ্ছে তার নাম একজন জলদস্যুর নামে রাখা, যে নিউইয়র্ক শহরের পত্তন করেছিল বলে জানা যায়।

কোথায় একটা ঘণ্টা বাজল। নড়েচড়ে বসল বাবর। চোখে কালো চশমা পরে নিল। হাত দুটো জড় করে রাখল স্টিয়ারিংয়ের ওপর।

না, জাহেদাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বাতাসে টুপটাপ করে পড়তে থাকা ফুলের মত মেয়েরা সবুজ মাঠটাকে ভরে ফেলল। কেউ দাঁড়াল। কেউ হাসল। কেউ কেউ একজোট হবার জন্যে হাত টানাটানি করতে লাগল। কেউ অন্য ক্লাশে ঢুকল। এর মধ্যে জাহেদা কই? বাবরের চোখের সমুখে লাল নীল সবুজ হলুদ বেগুনি সাদা কালোর নৃত্য চলছে অত্যন্ত মন্থর তালে। জাহেদা আজ কী রংয়ের জামা পরেছে কে জানে? জাহেদার একটা নীল জামা আছে তার ভারি পছন্দ। আজ যদি সেই নীল জামায় তাকে দেখা যায়, বাবর নিজেকেই একটা শর্ত দিল, আজ তাহলে সে ঠিক এগারটায় জাহেদার কথা মনে করতে করতে ঘুমুতে যাবে।

আবার সব ফাঁকা হয়ে গেল। মেয়েরা আবার তাদের পরের ক্লাশে গিয়ে বসল। আবার শুধু রইল সে। তার সিগারেট আর কাঠবাদাম গাছটা। ছেলেবেলার মত আবার একা হয়ে গেল সে।

সে না হয় জাহেদাকে দেখতে পায়নি। জাহেদাও কি তাকে দেখেনি? দেখে এগিয়ে এলো না কেন? রাগ হলো তার। ক্রমশ এই বিশ্বাসটা হতে লাগল যে, জাহেদা তাকে দেখেও কাছে আসেনি।

তখন আর বসে থাকা গেল না। চাপা আক্রেনশটাকে প্ৰচণ্ড গতিতে রূপান্তরিত করে সে বেরিয়ে গোল কলেজ থেকে। শুনুক জাহেদা তার গাড়ির শব্দ, শুনুক ক্লাশে বসে থেকে। জাহেদা তার গাড়ির শব্দ চেনে। কতদিন এমন হয়েছে হোস্টেলে গাড়ি রাখতে না রাখতেই ছুটে এসেছে সে।

আপনার গাড়ির আওয়াজ পেলাম।

পৃথিবীর সমস্ত শব্দ শহরের এই বিভিন্ন গ্রামের কোলাহল সমুহ এখন ছাপিয়ে উঠুক। তার গাড়ির শব্দ, বধির করে দিক যে দেখেও কাছে আসে না, বইয়ের পাতায় চোখ রেখে যে নিস্তব্ধ ক্লাশে বসে থাকে এবং নীল জামা পরে চিত্ত হরণ করে।

খেলে যা, খেলারাম খেলে যা।

আপিসে এলো বাবর। এয়ারকন্ডিশন করা নিজের কামরায় ঢুকতেই শরীরটা যেন স্বচ্ছন্দ ঝরঝরে হয়ে গেল, তার ভারি আরাম বোধ হলো। চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ। তারপর কফি বানাতে বলল।

কোনো টেলিফোন?

না।

কেউ এসেছিল?

না।

ডকুমেন্টগুলো সব ফটোস্ট্যাট করা হয়ে গেছে?

জি।

একতাড়া ডকুমেন্টের ফটো-নকল নিয়ে এলো রহমান। প্রত্যেকটা ভাল করে দেখল। তারপর নিজ হাতে আলমারিতে বন্ধ করে রাখল। জিগ্যেস করল, আলতাফ একটা করে কপি নিয়ে গেছে তো?

হ্যাঁ স্যার, আমি নিজে অ্যাটাচিতে তুলে দিয়েছি।

আজকের কাগজগুলো দিন।

কফি খেতে খেতে প্ৰত্যেকটা কাগজ দেখল বাবর। কাগজ দেখা মানে দেশ বিদেশের খবর দেখা। ওটা দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় পর্যায়ের জিনিস। প্রথমে সে দেখে দুয়ের পাতায় টেন্ডারের বিজ্ঞাপন। কোথায় সরকারি বেসরকারি কে কোন কাজ করতে চাইছে, কোন যন্ত্র চাইছে, কোন নির্মাণের জন্যে আহবান জানিয়েছে।

না, আজ কিছু নেই। কাগজগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝের ওপর। পিয়নকে ডেকে বলল, টেবল এত এলোমেলো থাকে কেন? লাল নীল পেন্সিল নেই কেন? পেন্সিল কাটা হয়নি। কেন? পেপার ওয়েট উপুড় হয়ে আছে কেন? কেন? কেন? কেন?

নিঃশব্দে বেয়ারা সব ঠিক করতে থাকে, ত্ৰস্ত হাতে সাজায় গোছায়, পেন্সিলগুলো সরু করতে নিয়ে যায় কম্পিত হাতে।

বাবর উঠে পায়চারি করে। একবার জানালার কাছে। স্বচ্ছ শাদা পর্দার ভেতর দিয়ে নিচে রাজপথ দেখা যাচ্ছে। হারমোনিয়ামের চাবির মত দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গাড়ি। এত ওপর থেকে পেট্রল পাম্পটাকে মনে হচ্ছে অতিকায় একটা লিপস্টিক। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলে বাবর।

জাহেদা কি তাকে দেখেনি। কাঠবাদামের গাছটার নিচে দাঁড়ালে কলেজের যে কোনো কোণ থেকেই চোখে পড়ার কথা। কিম্বা নাও পড়তে পারে। হয়ত জাহেদা লাইব্রেরীতে গেছে। কমনরুমে আছে। অথবা বান্ধবীদের সাথে টুক করে বেরিয়ে চীনে দোকানে এসেছে খাবার খেতে। চায়নিজ খেতে ভারি ভালবাসে জাহেদা।

কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল একটা তাগিদ অনুভব করল বাবর সেই রেস্তোরাঁয় যাবার জন্যে। বেরুতে যাবে এমন সময় বেজে উঠল টেলিফোন।

হ্যালো।

বাবার সাহেব?

বিরক্ত হলো বাবর। ব্যাটা হতরন আবার টেলিফোন করতে গেল কেন? তাকে তো তার মেয়ের গহনার দরুন টাকা দেওয়াই হয়েছে।

সরি, বাবার সাহেব নেই।

তবে যে এর আগে যিনি ধরছিলেন তিনি বললেন আছেন।

ছিলেন, বেরিয়ে গেছেন।

কখন আসবেন?

জানি না।

বাসার নম্বর কত?

বাবর ঠাস করে টেলিফোন রেখে দিল। কামরার বাইরে এসে রহমানকে বলল, লাইন দেবার আগে শুনে নিতে পারেন না আমার কাছে?

সারা উনি তো—

আমি জানি উনি কে। উনি হলেই লাইন দিতে হবে কোনো মানে নেই।

আচ্ছা স্যার।

বাবর বেরিয়ে গেল। রহমান কী করে জানবে ভেতরে কত কী হয়ে গেছে। হতরন এখন আর তাদের কোনো কাজেই আসবে না।

লিফটে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে ভাল করে দেখে নিল বাবর। মাথার বাঁ পাশে চুল সরে গিয়ে এক চিলতে টাকি বেরিয়ে পড়েছে। হাত দিয়ে টেনে দেবার চেষ্টা করল। ফলে আরো ফাঁক হয়ে গেল। হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করার দোষই এই। চুল ভারি হয়ে যায়। কবার ফাটল ধরলে আর রোধ করা যায় না। ক্রমশ বাড়তেই থাকে। আর স্প্রে না দেয়া পর্যন্ত এই অবস্থা। বাসায় যাবে? কিন্তু জাহেদা যদি চায়নিজ থেকেও বেরিয়ে যায়?

বাবর উর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি চালিয়ে রেস্তোরাঁয় এসে ঢুকল। না, নেই। ফ্যামিলি রুমে উঁকি দিয়েই বুকটা হিম হয়ে গেল তার। নীল কামিজ পরে জাহেদা বসে আছে। এক পা এগুল। তখন পেছন ফিরে দেখল মেয়েটা। উঃ, কী বীভৎস চেহারা। ঈশ্বর তুমি এখনো আছ স্বীকার করি। পেছনটা অবিকল জাহেদার মত দেখতে।

যাবার উদ্যোগ করতেই বাটলার সসম্ভমে জিগ্যেস করল, বসবেন না স্যার?

না। পরে কখনো।

একবার ভাবল তাকে জিগ্যেস করে, এই রকম বর্ণনার কোনো মেয়ে আরো কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে এসেছিল কি-না। পরে অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে আর থামল না। সোজা গাড়িতে বসে দম নিল। সিগারেটও ফুরিয়ে গেছে।

কন্টিনেন্টালে সিগারেট কিনতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা বই। এর আগেও বহুদিন চোখে পড়েছে। আজ যেন বিশেষভাবে পড়ল। বইটার নাম যুদ্ধ নয় প্ৰেম : জ্বলন্ত ভিয়েতনাম। ঘন কালো চকচকে প্রচ্ছদে গাঢ় লাল রংয়ে লেখা MAKE LOVE NOT WAR–শেষ শব্দটা অজস্র খণ্ডে খণ্ডিত। হাসল বাবর, যেমন সে মাঝে মাঝেই হাসে, একা হাসে।

মিসেস নাফিস তাকে বলেছিল, আপনি ও রকম হাসেন কেন?

কই, নাতো।

আপনি হয়ত লক্ষ করেননি। ভালই দেখায়।

কথাটা শোনার পর থেকে কয়েকদিন চেষ্টা করেছিল বাবর হাসিটাকে সংযত করতে। বদলে আরো বেড়েছে। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে সে। আবার হাসল। কিনল বইটা। বলল সুন্দর একটা প্যাকেট করে দিন।

উপহার দেবেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু ব্ৰাউন প্যাকেট ছাড়া যে নেই। সরি স্যার।

ঠিক আছে। খোলা থাক।

বইটা নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল।

সুলতানা বলল, আরে আপনি? কী মনে করে? হঠাৎ?

এই এলাম।

ও তো অফিসে গেছে।

জানি। বাবলিও তো কলেজে?

হ্যাঁ। বসবেন না?

না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিন বাবলি বলছিল ভিয়েতনাম সম্পর্কে খুব ইন্টারেস্টেড। জানতে চায়। এই বইটা ওকে দেবেন।

আচ্ছা।

আর বলবেন, ফেরত দিতে হবে না। ওকে দিলাম।

পেলে খুব খুশি হবে। এক কাপ চা দিই?

না দিলেই বাধিত করবেন।

সুলতানা ভেঙ্গে পড়ল। হাসিতে। বলল, কথা শিখেছেন বটে! আচ্ছা বাবলি এলেই বইটা দেব।

দেবেন। চলি। আবার আসব। এসে অনেকক্ষণ গল্প করব। চলি তাহলে।

গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বাবর তাকিয়ে দেখল পর্দা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সুলতানা। গালের এক পাশে রোদ এসে পড়েছে ছোট্ট একটা চৌকো বিস্কুটের মত। তেমনি সুস্বাদু দেখাচ্ছে। সুলতানা মন্দ নয় দেখতে। আরেকবার তাকে দেখল বাবর এবং চোখে পড়তে পড়তে বিদায়ের হাসি ফুটিয়ে তুলল। যেতে যেতে মনে পড়ল বাবলিদের ঘরে একটা বড় ছবি আছে। সেখানে গালে গাল ঠেকিয়ে হাসছে সুলতানা আর বাবলি। বাবলিকে যদি চুমো দিয়ে থাকি তাহলে তা সুলতানার গালেই দেয়া হলো। ল্যাজে ল্যাজে জোড়া দিয়ে বর্ধমান যাওয়া আর কী? না, হাসি নয়। ল্যাজে ল্যাজে জোড়া দিয়েই কত কী হয়ে গেল। লতিফাকে চিনল তো ঐ করে। জাহেদাকেও। ম্যাজিকের বাক্সের মত। একটার পেট থেকে আরেকটা। শেষ নেই। অনন্ত। এক মেয়ের মারফত আরেক মেয়ে। এক মেয়ে থেকে আরেক মেয়েতে।

একেক সময় বাবরের মনে হয় আসলে ওদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। জাহেদা, বাবলি, লতিফা, টুনি, রিক্তা, জলি, পপি, সুষমা, মমতাজ, আয়েশা, ডেইজি-সব এক। এক মাপে এক ছাচে, এক রংয়ে বানানো। পেছন থেকে কতদিন সে একজনকে আরেকজন মনে করেছে। চুলের সেই একই বিন্যাস, কাপড়ের সেই একই নকশা, কথার সেই একই ঢং। এমনকি যাদের সঙ্গে তার কখনও আলাপ হয়নি, পথে ঘাটে ভিড়ে, বাজারে দেখা, তারাও ঐ ওদের মত। ওদের ভাবনাগুলোও যেন এক। এক তাদের প্রতিক্রিয়া। এক তাদের পছন্দ।

কেবল একটা তফাৎ আছে। খোলা গায়ের গন্ধটা। কারো গায়ে লেবুর গন্ধ। কারো গায়ে দৈয়ের। খবর কাগজের। বন্ধ সবুজ পানির। মিষ্টি কফি-সিরাপের। পনিরের। কী করে যে ঐ বিচিত্র বিভিন্ন বস্তুর গন্ধ যে ওরা সংগ্রহ করেছে কে জানে। রিক্তার পিঠে মুখ রাখলেই তার মনে হতো। সদ্য খোলা খবরের কাগজে সকাল বেলা নাক ড়ুবিয়ে আছে সে। জিগ্যেসও করেছিল, কাগজে গড়াগড়ি দিয়ে এসেছ নাকি?

না, নাতো। কেন বল তো।

এমনি।

কী যে সব অদ্ভুত কথা। খবর কাগজ! হি হি হি।

আয়েশাকে সে বলেছিল, আজ নিশ্চয়ই দৈ খেয়েছ।

কী যে বলেন। দৈ আমি কবে খাই? দৈ খেলেই আমার গায়ে চাকা চাকা দাগ হয়।

কিন্তু দৈায়ের গন্ধ পাচ্ছি যে।

তাহলে আপনি খেয়েছেন।

আজ অন্তত বছরখানেক দৈ খাওয়া দূরে থাক, চোখে দেখিনি। সত্যি দৈায়ের গন্ধ পাচ্ছি।

যান ঠাট্টা ভাল লাগে না।

আয়েশা খুব রাগ করেছিল। আয়েশা এখন কোথায়? গেল বছর খুলনা থেকে একটা চিঠি দিয়েছিল, তারপর চুপ? একবার গেলে হতো খুলনায়। নিশ্চয়ই জাঁদরেল একটা গিনী হয়েছে আয়েশা। স্বামীকে একেবারে নখে করে রেখেছে। মেয়েদের এক উচ্চাশা স্বামীকে নখের ডগায় রাখা আর পরপুরুষকে পায়ের তলায়।

যা খেলে যা।

আরেক বার যাবে জাহেদার কলেজে?

এবার কেমন যেন একটু সংকোচ হতে লাগল তার। ব্যাটা দারোয়ানটা লম্বা লম্বা সালাম দেয়। ঘুঘুর মত চোখ রাখে। গলায় আবার একটা রূপের ক্রুশ। যিশু হে, তোমার দুঃখ আমি অঙ্গে ধারণ করে এই পাপের পৃথিবীতে মৃত্যুর আশায় বসে আছি–এই রকম একটা নির্মীলিত ভাব।

আচ্ছা, এই শেষবার যাওয়া যাক। না পেলে তখন আবার ভাবা যাবে। বাবর উলটো দিকে গাড়ি ঘোরাল কলেজের উদ্দেশে।

দারোয়ান নেই। গাড়িটা পথের উপর রাখল বাবর। তারপর ধীরে ধীরে ফটকের কাছে গেল। ফটকটাও বন্ধ। শুধু পেটের কাছে চোরদরোজার পাল্লাটা কুকুরের জিভের মত ঝুলে আছে। ঢুকবে?

বাবর অতি কষ্টে চোর-দরোজার ভেতর দিয়ে নিজেকে চালান করে ওপারে নিয়ে গেল। মেরুদণ্ড খাড়া করতেই মুখোমুখি হয়ে গেল এক সহাস্য শুভ্ৰবসনা সিসটারের।

ইয়েস? কী প্রয়োজন?

মাননীয় ভদ্র মহিলা কী এক কৌশলে চোখে ভ্রুকুটি এবং ঠোঁটে হাসি একই সঙ্গে সৃষ্টি করে জিগ্যেস করলেন। এঁরা আবার কিছু কিছু বাংলাও জানেন। বাবর এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল–বাংলায় জবাব দেবে না।

সে তার সবচে মার্জিত ইংরেজি বের করে বলল, প্রয়োজন খুবই সামান্য। আমি আপনারই একজন ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

সিসটারও এবার ইংরেজিতে শুরু করলেন।

কে সে?

নাম বললে চিনবেন?

এখানে আমাদের সব মেয়েকেই চিনি। চোর-দরোজা দিয়ে ঢুকে এখন পিঠটা টনটন করছে। বাবর বাঁ হাতে একবার বহু সহস্র বছর আগে খোয়ান ল্যাজের শূন্যস্থলে টিপে ধরে বলল, জাহেদা।

ও জাহেদা? বি.এ সেকেন্ড ইয়ার? হোস্টেলে থাকে?

হ্যাঁ। সেই বটে।

আপনি তার কে হন জানতে পারি?

অবলীলাক্রমে বাবর বলল, আংকল।

মায়ের দিক থেকে না বাবার দিক থেকে?

মায়ের দিকে। বাংলা আমরা বলি মামা। বলে বাবর একটা বিগলিত বিশুদ্ধ হাসি দান করল সিসটারকে।

তিনি আবার জিগ্যেস করলেন, ভিজিটার্স বুকে আপনার নাম আছে?

কী বিটকেল সিসটার রে বাবা। একেবারে শকুন মার্কা। বাবর হাসির নির্মলতা আরো কয়েকমাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে জবাব দিল, বুকে নাম না থাকবারই কথা ম্যাডাম। আসলে আমি কয়েক মাস হলো ঢাকায় এসেছি। এর আগে করাচিতে থাকতাম। জাহেদার মা আমি পিঠেপিঠি ভাই বোন। অনেকদিন জাহেদাকে দেখি না। কেমন আছে ও?

তাল আছে। আমাদের এখানে কেউ খারাপ থাকে না।

তা বটে। তা বটে।

কিন্তু আপনার চেহারা খুব চেনা ঠেকছে।

এই রে সেরেছে। নিশ্চয়ই বুড়ি তাকে আগেও এখানে আসতে দেখেছে। করাচি থেকে সদ্য আসার মিথ্যেটা ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু বাবর জানে কী করে ফাঁদ থেকে বেরুতে হয়। সে মাথা ঝাঁকিয়ে স্বীকার করল অনেকেই এই কথা বলেন। আসলে ব্যাপার কী জানেন, আমি টেলিভিশনে কাজ করি তো তাই।

ও আপনি টিভিতে কাজ করেন? কী আনন্দজনক সাক্ষাৎ। খুব প্রীত হলাম। জাহেদা তো কোনোদিন বলেনি। তার মামা টিভিতে আছে।

কী জানি। দেখা পাব ওর?

ওর বলা উচিত ছিল।

সিসটার হাঁটতে শুরু করলেন শান বাঁধান লন চেরা পথ দিয়ে। বাবর পিছনে হাত যুক্ত করে বিনীত ভঙ্গিতে হাটতে লাগল তার পাশে।

ওর অবশ্যই বলা উচিত ছিল। আপনি হয়ত জানেন না, আমরা আমাদের কলেজে প্রতি মাসের শেষ শনিবার একটি করে সভার আয়োজন করি।

উত্তম করেন।

সে সভায় বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় একজন করে নিমন্ত্রিত হন। তিনি মেয়েদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। এতে বাইরের জগৎ সম্পর্কে মেয়েদের একটা প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়। তাদের নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ সঞ্চার হয়।

অবশ্যই। এ এক চমৎকার ব্যবস্থা।

জাহেদা যদি বলত, আপনাকেও একদিন ডাকতাম বক্তৃতা করতে।

আপনি আমাকে এখনো বাধিত করতে পারেন।

বাবর সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইল না, শিকারী কুকুরের মত পেট সরু করে সে তাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। কে জানে কী থেকে কী হয়।

ঐ যে, ল্যাজে ল্যাজে জোড়া দিয়ে বর্ধমান যাওয়া।

সিসটার ঘুরে দাঁড়ালেন।

দয়া করে একটা বক্তৃতা দেবেন?

আপনাদের আদেশের শুধু অপেক্ষা।

আমি চাই আপনার কাছ থেকে মেয়েরা জানুক, কীভাবে জনতার সামনে দাঁড়াতে হয়, কথা বলতে হয়, টিভি মাধ্যম হিসেবে কতটুকু উপযোগী, এই সব। সানন্দে তা জানাতে চেষ্টা করব।

আপনার ঠিকানা?

এই যে।

বাবর পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল। বলল, এটা আমার ব্যবসার কাজে লাগে। বেঁচে থাকার, এই মর দেহটার সামান্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে ব্যবসা করতে হয়। ব্যবসা আমার মৃত্যু, শিল্প আমার জীবন।

কী সুন্দর কথা। সামনের মাসের পরের মাসেই হয়ত আমরা আপনাকে ডাকতে পারি।

আমি অবশ্যই সময় করব।

আপনি জাহেদার সঙ্গে দেখা করতে চান?

একবার দেখা হলে ভাল হতো। দরকার ছিল।

আসলে আমাদের নিয়ম কী জানেন? বুকে নাম না থাকলে এবং নিকট আত্মীয় যদি না হন তাহলে প্রিন্সিপ্যালের কাছে দরখাস্ত করতে হয়। তিনি সন্তুষ্ট হলে কেবলমাত্র একবার সাক্ষাতের অনুমতি দিতে পারেন। তবে আপনার জন্যে—

না থাক। আমার জন্যে আপনাদের প্রতিষ্ঠানের নিয়ম ভাঙ্গা হোক চাই না। এটি শিক্ষামন্দির। এর নিয়ম কানুন বড়রাই যদি না মানি কোমলমতি শিক্ষার্থীরাই বা কেন মানবে?

এক জাহেদার জন্যে বক্তৃতার সুযোগ নষ্ট করতে চায় না বাবর। বক্তৃতায় আরো কত নতুন জাহেদার সঙ্গে আলাপ হবে। এখন বরং নিয়মনিষ্ঠ তরুণদের জন্যে উৎকণ্ঠিত একজন প্রৌঢ়ের অভিনয় করাই সুবিবেচনার কাজ। এতে মানমীয়া ভদ্রমহিলার চোখে তার মর্যাদা বাড়বে। চাই কী হয়ত সামনের মাসেই তাকে বক্তৃতা করতে ডাকবেন।

বাবর আরো যোগ করল, আমাদের পয়গম্বর বলেছেন, যা নিজে করতে পার না, তা অপরকে উপদেশ করবে না।

মূল্যবান কথা।

অতএব থাক। আপনি জাহেদাকে বলবেন, আমি এসেছিলাম। পরে একদিন দরখাস্ত করেই দেখা করব। বিদায় দিন।

চোর-দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো বাবর। হাসল। সিসটার জানে না, দরখাস্ত ছাড়াই তার মেয়েরা কত দেখা করছে। সে নিজেও কতবার এসেছে। আজ প্রথম মুখোমুখি হয়ে গোল বলে! তবে শিক্ষা-মন্দির কথাটা বলেছে। যুৎসই। নিজেকেই বড় রকমের প্রশংসা করতে ইচ্ছে করল তার। বক্তৃতা দেবার জন্যে এখনিই তার জিভে চুলচুল করতে শুরু করে দিয়েছে।

সেই ঝোঁকে বেশ কিছুদূর হাওয়ায় ভেসে গেল বাবর। পাক মোটর্সের ক্রসিংয়ে দপ করে লাল বাতি জ্বলে উঠল। যেন হোঁচট খেল সে। হঠাৎ মনে হলো সিসটারের সঙ্গে আলাপ করতে করতে কলেজের ভেতরে অনেক দূর চলে গিয়েছিল, অনেকক্ষণ ছিল। জাহেদা কি একবারও তাকে দেখেনি? দেখতে পায়নি? কোনো ক্লাশ, কোনো কামরা, কোনো বারান্দা থেকে? আর তার নিজেরও যে কী হয়েছিল, চারদিকে একবারও সে তাকিয়ে দেখেনি। আসলে ঐ বক্তৃতার প্রস্তাবটাই সব মাটি করেছে।

বোধ হয় জাহেদা ইচ্ছে করেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। হয়ত বাবলিকে সে-ই চিঠিটা দেখিয়েছে। কেন এড়িয়ে যাচ্ছে? কেন দেখিয়েছে? দেখিয়েছে? জাহেদাকে তো আজ পর্যন্ত সে ছুঁয়েও দেখেনি। শুধু কথা বলেছে। তাও শুধু সিনেমা, ফ্যাশন আর চেনা মানুষদের নিয়ে। কোনো ইঙ্গিত নয়, কোনো আমন্ত্রণ নয়, কিছু নয়। আর জাহেদার বয়স এমন কিছু নয় যে বাবরের মনে কী আছে তা বোঝার ক্ষমতা তার হয়েছে। চিঠিতে কিছু ছিল? বাবলি কেন চিঠিটা পড়ে এমন হিংসুটে হয়ে উঠল?

নাহ কিছু বুঝা যাচ্ছে না। চিঠির প্রত্যেকটি কথা মনে আছে তার। সে লিখেছিল হুবহু এই রকম, ইংরেজি থেকে বাংলায় তরজমা করলে দাঁড়ায়–প্ৰিয় জাহেদা, কয়েকদিন দেখা হয় না। এর মধ্যে এক কাণ্ড হয়েছে। সেদিন টুরিজম ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। সেখানে রাস্তার মানচিত্র দেখে মনটা উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল। ভাবছি উত্তর বাংলায় গাড়ি করে বেড়াতে গেলে কেমন হয়? তুমি যদি যেতে চাও তাই লিখলাম। পরে যে বলবে, আগে জানলে যেতাম, কেন তোমাকে নিলাম না ইত্যাদি, সে সুযোগ দিতে আমি রাজি নই। তাড়াহুড়া নেই, যখন খুশি জানিও। ভাল থেকো। মন দিয়ে পড়াশুনা কোরো। আমি মেধাবী ছাত্রীদের পছন্দ করি। পরীক্ষার ফল ভাল করে আমাকে সে আনন্দ দিও। ইতি বাবর।

ইতির পরে তোমারই লিখতে গিয়েও লেখেনি। কেবল জাহেদাই যে যাবে আর কেউ যাবে না, তেমন কোনো অঙ্গীকারও কোনো শব্দে নেই। তবু এ রকম হলো কেন?

চমকে উঠল বাবর। পেছনে কয়েকটি অধীর হর্ণ বেজে চলেছে। কখন সবুজ হয়ে গেছে বাতি। আটকে রেখেছে। সবার পথ সে। রাগ হলো বাবরের। দেবে না সে পথ। ভাণ করল তার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। বনাত খুলে মিছেমিছি দেখল। আর আড়াচোখে পেছনে সবার বিরক্তি আর পাশ কাটিয়ে বেরুবার পরিশ্রম লক্ষ করল— করে তৃপ্তি পেল সে। বোঝ, বোঝ। তারপর বাতি আবার লাল হবার আগেই লাফ দিয়ে গাড়িতে বসে বেরিয়ে গেল সমুখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *