প্যারিস
জর্মন ভাষায় একটি গান আছে :
‘In Paris, in Paris, sind die
Maedels so suess
Wenn sie fluestern Monsieur,
ich bin Dein,-’
অর্থাৎ :
প্যারিসের মেয়েগুলো কি মিষ্টি!
যখন তারা কানের কাছে গুনগুনিয়ে বলে,
‘মসিয়ো আমি তোমারি।’
সবাই হেসে হেসে তাকায়, সবাই কথা বলবার
সময় ‘তুমি’ বলে ডাকে
আর কানে কানে বলে, ‘তোমায় ছেড়ে
আর কারো কাছে যাব না।’
কিন্তু হায়, শুধু তোমাকেই না, আরো
পাঁচজনকে তারা ঐ রকমধারাই বলে!’
ইংরেজিতে বলে, ‘কেরীং কোল টু নিউ কাসল্’, হিন্দিতে বলে, ‘বরেলীমে বাঁস লে জানা’ (বেরলীতে নাকি প্রচুর বাঁশ জন্মে), রাশানে বলে, ‘তুলা শহরে সামোভার নিয়ে যাওয়া’ (সেখানে নাকি পৃথিবীর বেশির ভাগ সামোভার তৈরি হয়), গুজরাতীতে বলে, ‘ভরা কলসি নিয়ে নদীতে যাওয়া’ এবং ফরাসিতে বলে, ‘প্যারিসে আপনি স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া!’
ফরাসি প্রবাদটিই মুখরোচক। কিন্তু প্রশ্ন, সত্যই কি প্যারিস-সুন্দরীরা বড়ই দিলাদরিয়া? উপরের গানটাতে তো খানিকটে হদিস পাওয়া গেল। তবু কেন তামাম ইয়োরোপবাসীর সুখস্বপ্ন অন্তত একবারের মত প্যারিসে যাওয়া? এমন কি যে জর্মন ফরাসি জাতটাকে দু’চোখের দুশমন বলে জানে, সেও ফরাসিনীর নাম শুনলে বে-এক্তেয়ার হয়ে পড়ে। হিন্দুর কাশী দর্শনাভিলাষ মুসলমানের মক্কা গমন তার কাছে নস্যি।
এ অধম ছেলেবেলায় এক ভশ্চায্যি বামুনের খপ্পরে পড়েছিল। তিনি তার মাথায় তখনই গবেষণার পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই প্যারিসে নেবেই ভাবলুম, সত্য কোন হিরন্ময় পাত্রে লুক্কায়িত আছেন, তার গবেষণা করতে হবে।’ এবং তার নির্যাস আজ আপনাদের কাছে নিবেদন করব। এ-নির্যাস বানাতে আমাকে বিস্তর কাঠ-খড়ি পোড়াতে হয়েছে।
প্রথমত প্যারিসের মেয়েরা সুন্দরী বটে। ইংরেজ মেয়ে বড় ব্যাটামুখো, জর্মন মেয়েরা ভোঁতা, ইতালিয়ান মেয়েরা অনেকটা ভারতবাসীর মত (তাদের জন্য ইয়োরোপে আসার কি প্রয়োজন?)। আর বলকান মেয়েদের প্রেমিকরা হরবকতই মারমুখো হয়ে আছে (প্ৰাণটা তো বাঁচিয়ে চলতে হবে)। তার উপর আরো একটা কারণ রয়েছে—ফরাসি মেয়ে সত্যি জামাকাপড় পরার কায়দা জানে–অল্প পয়সায়–অর্থাৎ তাদের রুচি উত্তম।
তা না হয় হল। কিন্তু সুন্দরীরাই যে সব সময় চিত্তাকর্ষণ করেন তা তো নয়। যে-সব দেশে কোর্টশিপ করে বিয়ে হয়, সে-সব দেশে দেখেছি, মেলা সুন্দরীর বর জোটে নি। আর এস্তার সাদামাটা মেয়ে খাপসুরৎ বর নিয়ে শহরময় দাবড়ে বেড়াচ্ছে।
তবে কি মানুষ প্রেমে পড়ার বেলা সুন্দরী খোজে, বিয়ে করার সময় অন্য বস্তু? তবে কি প্ৰেম আর বিয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরঃপীড়া? হবেও বা।
ওয়াইনে বানচাল হয় না, অপ্রিয় সত্য এড়িয়ে চলে, পলিটিকস নিয়ে মাথা ঘামায় কম এবং জাত-ফাত, সাদা কালো, দেশী-বিদেশী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সংস্কার বিবর্জিত। ভালো লেগেছে তাই, হামেশাই দেখতে পাবেন, দেবকন্যার মত সুন্দরী ফরাসিনী যমদূতের মত বিকট হাবশীর সঙ্গে সগৰ্বে সদম্ভে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করে দেখবেন, নাচে খাসা, গান গায় তোফা, ছবি দেখলেই বলতে পারে কোন নম্বরী, আর ডাক্তারি পড়ে বলে এর ব্যান্ডেজ ওর ইনজেকশন হামেশাই বিনফিতে করে দেয়।
জর্মন মেয়ে বিদেশীকে প্রচুর খাতির-যত্ন করে, প্রেমে পড়ে ফরাসিনীর চেয়েও বেশি, কিন্তু তৎসত্ত্বেও আপনি চিরদিনই তার কাছে ‘আউসল্যান্ডার’ (আউটল্যান্ডার) বা বিদেশীই থেকে যাবেন-কিন্তু ফরাসিনীর মনে অন্য ভাগাভাগি। তার কাছে পৃথিবীতে দুই রকম লোক আছে—কলচরড্ আর আনকলচরড্। ফরাসি, বিদেশী এই দুই স্পৃশ্য অস্পৃশ্য বাদ-বিচার তার মনে কখনো ঢোকে না।
আপনি দিব্য ফরাসি বলছেন, ফ্রাঁস আপনি পড়েন, রোদাকে ভক্তি করেন, শোপোর। রস চাখতে জানেন, বর্দো বগেণ্ডি সম্বন্ধে ও কীবহাল, ব্যস, তবেই হল। কোনো ইংরেজ বন্ধুকে যদি আপনি ফরাসিনীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার সময় সসন্ত্রমে ভারতীয় কায়দায় বলেন, ‘ইনি অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট’, তবে ফরাসিনী অত্যন্ত গভীর মুখে শুধাবে, ‘কোন সাবজেক্ট মহাশয়? টেনিস না ক্রিকেট?’ ফরাসিনীর বিশ্বাস অক্সফোর্ডে মাত্র ঐ দুই কর্মই হয়। ভাগ্যিস প্যারিসিনী জানে না, ভারতবর্ষে কিছুই হয় না-কাজেই আপনাকে এ রকম ধারা প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করবেন না।
কিন্তু ফরাসিনীর সব চেয়ে বড় গুণ-সে ভণ্ডামি করতে জানে না। আর সব শহরে যা হয়, প্যারিসেও তাই হয়, কিন্তু ফ্রান্সের লোক ঢেকে চেপে রাখবার চেষ্টা করে না। যদি কোনো জিনিস চেপে যায়, তবে সেটা দৃষ্টিকটু রুচিবিরুদ্ধ বলে, নিজেকে ধর্মপ্ৰাণ, নীতিবাগীশ বলে প্রচার করার জন্য নয়।
অর্থাৎ ফরাসিনীর কাছে টেস্ট্ বা রসবোধ মরাল বা নীতিবোধের চেয়ে বহুৎ বেশি বরণীয়।
Leave a Reply