০৪. মহাসমুদ্রে ছোট্ট চর : আমাদের গ্রাম

মহাসমুদ্রে ছোট্ট চর : আমাদের গ্রাম

বিশ্বাসকে আলো ব’লে শেখানোর একটি রীতি রয়েছে, ছেলেবেলায় আমিও তাই শিখেছিলাম; পরে দেখেছি বিশ্বাস আলো নয়, অন্ধকার; আর বিশ্বাসের অন্ধকারে ঢেকে আছে মহাজগত। যদিও মহাজগতের অধিকাংশ এলাকাই অন্ধকার, মহাজাগতিক অনন্ত দূরত্বব্যাপী কোনো নক্ষত্রের আলো নেই, তবু তার কোনো কোনো এলাকা অসংখ্য নক্ষত্রে আলোকিত। কিন্তু বিশ্বাসের জগতটি পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন। বিশ্বাসের বইগুলো অন্ধকারের বই, ওগুলোর কাজ মানুষের মনকে গভীর অন্ধকারে আবৃত করা। মহাজগত সম্পর্কে খুবই কম জানি আমরা, আর যতোটুকুও জানি, তাও জানতে দেয়া হয় না। গত তিনশো বছরে পশ্চিমে বিজ্ঞান বেশ এগিয়েছে, বের করেছে মহাজগতের অনেক শৃঙ্খলা; তবু অধিকাংশ মানুষ আজো আছে আদিম পর্যায়েই—তারা মানসিকভাবে আদিম। যুক্তির থেকে অন্ধতার বেশি অনুরাগী তারা, সত্যের থেকে তাদের বেশি প্রিয় মিথ্যে। এটা অবশ্য সাধারণ মানুষদের অপরাধ নয়, অপরাধটি অসাধারণদের। ওই অসাধারণ মানুষেরা পাচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধ’রে দখল ক’রে আছে সমাজ ও রাষ্ট্র। নিজেদের স্বার্থে তারা তৈরি করেছে শাসনব্যবস্থা, মানুষকে ভাগ করেছে নানা বর্ণে ও শ্রেণীতে, তৈরি করেছে। ধর্ম ও নানা ধরনের দেবতা ও বিধাতা, এবং দেবতা ও বিধাতাদের দিয়ে ভীত ক’রে রেখেছে মানুষদের। শাসকদের অনুগত মহাপুরুষেরাও, যাদের অমর ব’লে মান্য করি আমরা, সাহিত্য, দর্শন, ও আরো অজস্র শাস্ত্রে প্রচার করেছে শাসকদেরই বক্তব্য। রাজনীতি ও ধর্ম শুরু থেকেই মানুষের বিকাশের বিরুদ্ধে; এবং আজো তাই। প্রধানত রাজনীতি ও ধর্মের সুবিধাভোগীরা মানুষকে বুঝতে দেয় নি আমরা যেখানে আছি সেটি কী, কী সম্পর্ক আমাদের ওই আকাশ আর তারকাপুঞ্জের সাথে। তারা শুনিয়েছে কাল্পনিক গল্প, ওই গল্পগুলোকে তারা বলেছে ধর্ম, মানুষকে বাধ্য করেছে। ওই গল্পগুলো বিশ্বাস করতে ও মেনে চলতে। তাই বিশ্বাসের অন্ধকারে ঢেকে আছে অজস্র সূর্য, সংখ্যাহীন তারকাপুঞ্জ, আর মহাজগত। পবিত্ৰ ব’লে বিখ্যাত বইগুলোতে আলো বা জ্ঞান নেই, আলো আর জ্ঞান আছে সে-বইগুলোতে, বিশ্বাসীদের চোখে যেগুলো অপবিত্ৰ।

অধিকাংশ মানুষ আজো বাস করে মহাজাগতিক অন্ধকারে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা ভাবে স্বৰ্গ আর নরকের কথা; কেঁপে ওঠে নরকের ভয়ে, সুখী হয় স্বর্গের বিলাসের কথা ভেবে। এর সবটাই ঘটেছে পৃথিবী ও মহাজগত সম্পর্কে ভুল ধারণার ফলে। আমাদের গ্রামটিকে ভালোবাসি আমরা, তবে তাকে রহস্যপূর্ণ মনে করি না; কেননা আমরা তার সব কিছু জানি। কিন্তু নদীর অপর পারের গ্রামগুলোকে মনে হয় রহস্যময়, মনে হয় ওখানে এমন সুখ আর ছায়া আছে, যা নেই। আমাদের গ্রামে। তা থাকতে পারে; ওই গ্রামে থাকতে পারে অপূর্ব এক তমালতরু, যা নেই আমাদের গ্রামে; থাকতে পারে এমন স্নিগ্ধ সরোবর, যা নেই আমাদের গ্রামে; থাকতে পারে এমন একটি গর্ত, যা নেই আমাদের গ্রামে। কিন্তু ওই গ্রামেও রহস্যের কিছু নেই, ওই গ্রামীবাসীরা নিজেদের গ্রামকে রহস্যপূর্ণ মনে করে না, যদিও নদীর পারে দাড়িয়ে রহস্যপূর্ণ মনে করে আমাদের গ্রামটিকে। মহাজগতকে যদি জানতাম আমরা, তাহলে বিস্মিত হতাম, কেননা বিস্ময়কর বহু কিছু রয়েছে মহাজগত জুড়ে; কিন্তু এখন যেমন ভয়ের চোখে দেখি, নানা রকম বিধাতা দেখতে পাই দূরে, তেমন কিছু দেখতে পেতাম না। ওই তারা বা সূৰ্যই শুধু নয়, আমরাও মহাজগতের অধিবাসী, আমরাও ঘুরে চলছি মহাজাগতিক গগনে: কিন্তু আমরা কোনো দেবতা দেখি নি, বিধাতা দেখি নি, যদিও এদের কথা দিনরাত শুনতে পাই। বিশ্বাসীরা ভীত আর লোভী মানুষ; অন্ধকারে থাকতেই তাদের আনন্দ।

মহাজগত বা মহাবিশ্ব অনন্ত: আমরা তার একধারে পড়ে আছি। মহাজগতকে বোঝার জন্যে একটি রূপকের সাহায্য নিতে পারি; অনন্ত মহাজগত যেনো এক মহাসমুদ্র, আর ওই মহাসমুদ্রে আমাদের পৃথিবী একটি ছোট্ট চারের মতো। দ্বীপ না ব’লে চর বলতেই আমার ভালো লাগছে। অনন্ত মহাসমুদ্রে আমরা একটি ছোটো চরের, ছোটো গ্রামের, অধিবাসী; এই চারের, এই গ্রামের, নাম আমরা রেখেছি পৃথিবী। এটি তারা নয়, গ্রহ; এটি একটি তারাকে ঘিরে ঘুরছে, তারাটির নাম রেখেছি আমরা সূর্য। এই সূর্যকে ঘিরে যে-এলাকাটুকু, যেখানে ঘুরছে কয়েকটি গ্রহ, তার নাম সৌরজগত। এটি বিশাল এলাকা, কিন্তু মহাজগতের এটি এক ক্ষুদ্র এলাকা। মহাজগত সম্পর্কে আমরা অনেক বেশি জানি পূর্বপুরুষদের থেকে। তাঁরা আকাশ ভরে দেখেছিলেন লাখ লাখ দেবতা, মাঠে ঘাটে নদীতে দিঘিতে দেখেছিলেন দেবদেবী; দেখেছিলেন প্ৰচণ্ড শক্তিশালী বিধাতা, যার ভয়ে রক্ত জ’মে যেতো তাদের, আজো রক্ত জমে যায় অধিকাংশের। এই ভয় এবং বেশখানিক লোভকে বলা হয় ধর্ম। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছোট্ট চারের মতো পৃথিবীটিকেই বুঝে ওঠেন নি; জানেন নি। পৃথিবী কতো বড়ো, তার উত্তরে কী দক্ষিণে কী, কীভাবে আছে পৃথিবী; তাই মহাজগত সম্পর্কে তাদের পক্ষে ধারণা করাই ছিলো অসম্ভব। কিন্তু কল্পনা মানুষের সমান বয়সী। তারাও প্রচুর কল্পনা করেছিলেন যেমন আমরা করি, তাদের অনেক কল্পনা গল্প হিশেবে বেশ চমৎকার; তবে তা গল্পই। তাদের মধ্যে কল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতির বিকাশ ঘটে নি, যাকে বলা হয়।

বৈজ্ঞানিক কল্পনা। তারা মহাজাগতিক সত্য বের করেন নি, বের করার চেষ্টা করেন নি, বরং বিচিত্র রকম দেবদেবী কল্পনা ক’রে সেগুলোকেই সত্য ব’লে প্রচার করেছেন; এবং চাপিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের ওপর।

পুরোনো মানুষেরা ছিলো শিশু; অন্ধকার পৃথিবী ও সংকীর্ণ মহাজগতের অধিবাসী। সব কিছুই ছিলো তাদের কাছে রহস্যময়; এবং তারা পৃথিবীকে ভ’রে দিয়ে গেছে রহস্যে। মহাজগত বলতে যা বুঝি আমরা, তারা তা বুঝতো না; তাদের মহাজগত ছিলো খুবই ক্ষুদ্ৰজগত। গত কয়েক শতকের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে মহাজগতের রূপ আমূল বদলে গেছে মানুষের চোখে। মহাজগত বলতেই আজ অনন্ত অসীমের ধারণা জাগে আমাদের মনে, পুরোনো মানুষদের মনে এমন ধারণা জাগতো না। তাদের চোখে মহাজগত ছিলো এক ছোটো সসীম বদ্ধ এলাকা। তারা মনে করতো মহাজগতের কেন্দ্ৰ পৃথিবী, যাকে ঘিরে আছে ছোটো ছোটো সূর্য নক্ষত্র চাঁদের আকাশ। তারা পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্র আর মানুষকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মনে করলেও পৃথিবীকে মনে করতো নোংরা; তারা বিশ্বাস করতো নক্ষত্রগুলো পবিত্র, আর নক্ষত্ৰলোক, বা তার একটু পরের এলাকা থেকে তাদের সব সময় শাসন করছে দেবতারা। আরো কিছুকাল পরে যখন কোনো কোনো দেশে দেবতাদের বাদ দেয়া হয়, তখন তারা কল্পনা করে এক শক্তিশালী নিঃসঙ্গ দেবতাকে, যাকে বলা হয় বিধাতা বা ঈশ্বর বা অন্য কিছু, যে ওপর থেকে শাসন করছে মানুষকে। এর সবই কল্পনা, যদিও মানুষ এসব সত্য মনে করে। মহাজগতকে যদি পাঁচ হাজার বহচর আগের মানুষ আমাদের মতো বুঝতে পারতো তাহলে থাকতো না আজকের বিশ্বাসগুলো। মানুষ এতো ভয় পেতো না নরকের, এতো লোভী হতো না স্বর্গের। আজ থেকে দুশো বা হাজার বা এক লক্ষ বছর পর মানুষ দেবতা বিধাতা স্বর্গ নরক প্রভৃতি সম্পর্কে ভাববে না। আমাদের বিশ্বাসগুলো তাদের মনে হবে আদিম; বিশ্বাস শব্দটিই তখন থাকবে না।

মহাজগত কতো বড়ো, কতো তার বয়স, কীভাবে উৎপত্তি হয়েছে তার, এসব অবশ্য কল্পনায় ধারণ করাও অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা মহাজগতের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পেরেছেন, ভবিষ্যতে তাদের ব্যাখ্যা আরো সুষ্ঠ হবে। বিভিন্ন দেশের ধর্মের বইগুলোতে মহাজগতের উৎপত্তির যে-গল্প পাওয়া যায়, তা বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে আদিম মানুষের রূপকথা; তাতে বিশেষ বিস্ময় নেই, কেননা তাদের কল্পনারও সীমা ছিলো; কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান মহাজগতের উৎপত্তির যে-ব্যাখ্যা দেয়, তা এতো বিস্ময় ও চাঞ্চল্যকর যে তা অনেকের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের ব্যাখ্যায়ই পাই মহাজগতের অনন্ততা ও বিস্ময়করতার ঠিক পরিচয়। যদি বিধাতা সত্যিই থাকেন,-থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই-এবং কোনো দিন যদি তিনি মহাজগত সম্পর্কে ধর্মের বইগুলোর ও বৈজ্ঞানিকদের ব্যাখ্যা পড়ে ওঠেন, তাহলে বৈজ্ঞানিকদের ব্যাখ্যাই তিনি গ্ৰহণ করবেন। ধর্মের বইগুলো পড়ে তিনি হাসবেন।

মহাজগতে পৃথিবী একটি ছোট্ট সুন্দর চারের মতো, কিন্তু এখানেই উৎপত্তি ঘটেছে মহাজগতের সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারের, যা খুবই ক্ষুদ্র, কিন্তু অনেক বড়ো নক্ষত্রমণ্ডলির থেকেও। তার নাম মানুষ। মহাজাগতিক প্রক্রিয়ারই এক রূপ মানুষ; তাকে কেউ তৈরি ক’রে পাঠিয়ে দেয় নি। পৃথিবীতে, বলে নি যাও পৃথিবীতে, গিয়ে রাজনীতি করো ধর্ম করো প্রতারণা করো গান গাও; মানুষ বিকশিত হয়েছে কোটি কোটি বছর ধ’রে। মহাজগতের একটি ছোটো চরের প্রতিভাবান চাষী মানুষ, যার থেকে আর কেউ বেশি জানে না মহাজগত সম্পর্কে। এই ছোট্ট চরের পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে মহাজাগতিক সমুদ্রের ঢেউ। মানুষ এই মহাসমুদ্রকে ভয় পেয়েছে হাজার হাজার বছর, মাত্র কয়েক শো বছর আগে মানুষ বেরিয়েছে নিজের তীর ছেড়ে মহাসমুদ্রের দিকে। অনন্ত মহাসমুদ্র ডাকছে মানুষকে; মানুষ তীর থেকে আরো দূরে যাবে, ঢুকবে মহাসমুদ্রের ভেতরে, খুঁজে দেখবে কী আছে সেখানে। মহাজগত কতো বড়ো? আজো আমরা তা জানি না; কিন্তু এটুকু জানতে পেরেছি মহাজগত এতো বিশাল যে আমাদের প্রতিদিনের মানদণ্ডে, মাইল বা কিলোমিটারে, তার আয়তন মাপা সম্ভব নয়। মহাজগতকে পরিমাপ করা হয় আলোর গতির মানদণ্ডে। এক সেকেন্ডে আলো যায় ১৮৬,০০০ মাইল, বা মোটামুটি ৩০০,০০০ কিলোমিটার; এ—মানদণ্ডই ব্যবহার করা হয় মহাজগতের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকার দূরত্ব মাপার জন্যে। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে লাগে আট মিনিট সময়; তাই সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আট আলোক-মিনিট। এক বছরে আলো যায় ১X৬০X৬০X২৪X৩৬৫X১৮৬,০০০ মাইল বা ছয় ট্ৰিলি অন মাইল। ট্রিলিঅনা হচ্ছে এক লক্ষ কোটি: আলো বছরে যায় ছয় লক্ষ কোটি মাইল। এটা একটি ছোটো সংখ্যা, তবে এটা হিশেবে করতেও মগজ বিবশ হয়। আলো এক বছরে যে-দূরত্ব ভ্ৰমণ করে, সে-একককে বলা হয় আলোকবর্ষ। আলোকবর্ষের সাহায্যে, সময় নয়, মাপা হয় দূরত্ব। এই দূরত্বের কথা পুরোনো কালের মানুষ ভাবতে পারে নি। আজ আমরা জানি মহাজগত কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি আলোকবর্ষ ব্যাপী বিস্তৃত, যা পুরোনো মানুষ কল্পনাও করতে পারে নি।

পৃথিবী একটি জায়গা বা স্থান; এমন স্থানের অভাব নেই মহাজগতে। ওই স্থানগুলো ঠিক পৃথিবীর মতো নয়, তবে স্থান। মহাজগতের অধিকাংশ এলাকা জুড়েই রয়েছে। শূন্যতা। মহাজগত এক বিশাল শীতল অনন্ত মহাশূন্যতা, যার এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আরেক নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যবর্তী স্থানে বিরাজ করছে চিরআমারাত্রি, ওই শূন্যস্থলে অন্ধকার শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই। মহাজগত এমন অনন্ত শূন্যতা যে তাতে গ্রহ, নক্ষত্র, আর নক্ষত্রপুঞ্জকে দুর্লভ বস্তু ব’লেই মনে হয়। নক্ষত্রপুঞ্জ গঠিত গ্যাস, ধুলো, আর নক্ষত্র বা তারকায়। প্রতিটি নক্ষত্রপুঞ্জে রয়েছে কোটি কোটি তারকা। সূর্য একটি তারকা বা তারা বা নক্ষত্র। নক্ষত্রপুঞ্জের কোটি কোটি তারার প্রত্যেকটির থাকতে পারে গ্রহ; ওই গ্রহের কাছে প্রতিটি তারাই সূর্য। সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে কয়েকটি গ্রহ, গড়ে উঠেছে সৌরলোক; প্রতিটি নক্ষত্ৰকে বা সূর্যকে ঘিরেই গড়ে উঠতে পারে এমন সৌরলোক। কতগুলো নক্ষত্রপুঞ্জ রয়েছে মহাজগতে? মহাজগতে নক্ষত্রপুঞ্জ সংখ্যা কয়েক শো বিলিঅ’ন বা ১০^১১ বিলিঅন অর্থ হচ্ছে ১-এর পর ১১টি শূন্য, অর্থাৎ ১০০,০০০,০০০,০০০); আ র প্রত্যেক নক্ষত্রপুঞ্জে আছে গড়ে ১০০ বিলিঅন নক্ষত্র। প্রত্যেক নক্ষত্রপুঞ্জে যতোগুলো তারা আছে, অন্তত ততোগুলো গ্ৰহ থাকার কথা। মহাজগতে থাকার কথা ১০^১১X১০^১১=১০^২২, অর্থাৎ ১০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ বা ১০ বিলিঅন ট্রিলিঅন গ্ৰহ। সংখ্যাটি আমি গুণতে পারছি না। এমন অসংখ্য সৌরলোকের একটি সৌরলোকের একটি গ্রহেই শুধু রয়েছে মানুষ। আর কোথাও নেই। কেনো থাকবে না? থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি; কিন্তু যদি থাকে, তারা মানুষ হবে না, তারা হবে বুদ্ধিমান প্রাণী। মানুষ একান্তভাবেই পৃথিবীর প্রাণী। অন্য কোনো গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী থাকতে পারে, কিন্তু দেখতে তারা মানুষের মতো আকার। আমরা আছি মহাজগতের এক কোণে, সূর্য একটি ছোটো তারা, পৃথিবীও একটি ছোটো চার; কিন্তু এখানেই উৎপত্তি হয়েছে এক বুদ্ধিমান প্রাণীর, মানুষের। এটাও কোনো রহস্য নয়, এখানে ঘটেছে এমন কিছু মহাজাগতিক ঘটনা, যার। ফলে এখানেই উদ্ভূত হ’তে পেরেছে মানুষ, পশু, সরীসৃপ, গাছ। আমাদের গ্রহটির নাম পৃথিবী না হয়ে হ’তে পারতো ‘প্ৰাণ’।

নক্ষত্রপুঞ্জগুলো একই রকমের নয়, আকৃতি অনুসারে এগুলো তিন রকম : এক ধরনের নক্ষত্রপুঞ্জ কুণ্ডলপাকানো, এক ধরনের নক্ষত্রপুঞ্জ উপবৃত্তাকার, ও এক ধরনের নক্ষত্রপুঞ্জ এলোমেলো। আমরা যে-নক্ষত্রপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত তার নাম মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি। এটি এক কুণ্ডলপাকানো নক্ষত্রপুঞ্জ, যার কুণ্ডল ধীরেধীরে নড়ছে। আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আট বিলিঅ’ন আলোকবর্ষ দূরে আছে আমাদের নিকটবতী নক্ষত্রপুঞ্জগুলো। এগুলো আমাদের প্রতিবেশি নক্ষত্রপুঞ্জ। এগুলো বিশটি নক্ষত্রপুঞ্জের সমষ্টি, আর ছড়িয়ে আছে কয়েক মিলিঅন আলোকবর্ষব্যাপী। এদের একটির নাম এম৩১। আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জ কোটি কোটি তারায় তারায় খচিত। তারাগুলোর কোনো কোনোটি ছোটো, তবে কোনো কোনোটি কয়েক হাজার সূর্যের সমান। কোনো কোনোটি খুবই ছোটো, একটা শহরের মতো ছোটো, কিন্তু সেগুলো সীসার থেকেও শত ট্রিলিঅন গুণ ঘনীভূত। কোনো কোনো নক্ষত্ৰ একলা, যেমন আমাদের সূর্য, তবে অধিকাংশ নক্ষত্রই যুগলবন্দী-একটি নক্ষত্র ঘুরছে। আরেকটিকে ঘিরে। কোনো কোনো তারা, যেগুলোকে বলা হয়। সুপারনোভা, অত্যন্ত উজ্জ্বল; আবার কতকগুলো, যেগুলোকে বলা হয় ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর, সেগুলো অন্ধকার + কোনো কোনো তারা জুলে একই উজ্জ্বলতা নিয়ে, কোনো কোনোটি ঝিকিমিকি করে; কোনো কোনোটি ঘোরে ধীরশান্তভাবে, কোনো কোনোটি ঘোরে পাগলের মতো। তারাদের রঙও আছে; নীল তারা তরুণ ও গরম; হলদে তারা মাঝবয়সী; লাল তারা বুড়ো ও মুমূর্ষ; আর ছোটো শাদা আর কালো তারাগুলো শিগগিরই মরবে। আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জে ঘোরাঘুরি করছে নানা আকাশে দেখতে পায় দেবদেবী। তারা মেতে ওঠে ভুল কল্পনায়; দেবদেবীদের ওপর তারা অর্পণ করে একেক দায়িত্ব, এবং পুজো করতে থাকে অস্তিত্বহীন দেবদেবীদের। মানবিক প্রত্যেকটি ব্যাপারের জন্যে তারা কল্পনা করে একেকটি দেবদেবী, কোটি কোটি দেবদেবীতে ভ’রে ওঠে আকাশমণ্ডল। তাদের কল্পনায় দেবদেবীরা চাইলে নারীর গর্ভে আর মাঠে শস্য সোনা হয়ে ওঠে, না চাইলে নামে বন্যা, দেখা দেয় খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, গর্জন ক’রে ওঠে অগ্নিগিরি। তারা কল্পনা র যে দেবতাদের তুষ্ট করার দরকার; তখন দেখা দেয় পুরোহিত, দৈববাণী, মন্দির, পুজো ইত্যাদির আধিপত্য ও ব্যবসাবাণিজ্য। তাদের কাছে সব কিছুই হয়ে ওঠে রহস্যপূর্ণ। দিকে দিকে দেবতা তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়; তারা মহাজগতের রহস্যকে পরিণত করে শক্তি ও সম্পদের সহজ আকর্ষণীয় উৎসে। আজো সেই ধারা চলছে।

কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষ উৎপীড়িত হয়ে আসছে নানা নামের কল্পিত অতিমানবিক সত্তাদের দ্বারা। এই পীড়নে অবশ্য ভূমিকা নেই কল্পিত সত্তাদের; তারা কাউকে পীড়ন করে না, তারা জানেও না যে তারা আছে, সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের; কিন্তু তাদের নামে সুবিধাভোগী একদল মানুষ পীড়ন করে অন্য মানুষদের। তারা সবাইকে বাধ্য করে তাদের কল্পিত সত্তাদের মানতে, পুজো করতে। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসের কাছাকাছি আইওনিয়ার অ্যাজিয়ান সাগরের সামোস দ্বীপে দেখা দেয় ভিন্ন চিন্তা। সেখানকার মানুষেরা মনে করতে শুরু করে যে দেবতা নেই, সব কিছুই অণুতে গঠিত, মানুষও তাই; পৃথিবী একটি গ্রহ, যা ঘুরছে সূর্যের চারদিকে; আর নক্ষত্রেরা আছে বহু দূরে। আদিগ্রিকরা বিশ্বাস করতে যে আদিকালে ছিলো বিশৃঙ্খলা’ বা ‘গোলমাল’ নামে একটি প্রাণী, এবং সেটি মিলিত হয়েছিলো রাত্রি দেবীর সাথে। তাদের মিলনে জন্মে দেবতারা ও মানুষেরা। তাদের চোখে বিশ্ব গোলমাল থেকে উৎপন্ন ব’লে পৃথিবীর সব কিছুই পরিপূর্ণ গোলমালে; আর ওই গোলমালকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে শুধু খামখেয়ালি দেবদেবীরা। খ্রিপূ ষষ্ঠ শতকে সামোস দ্বীপে এ-চিন্তার উদ্ভব ঘটে যে বিশ্বজগত বিশৃঙ্খল নয়, এবং বিশ্বকে জানাও সম্ভব। এই চিন্তা দেখা দেয় নি ভারত, মিশর, ব্যাবিলোনিয়া, ও চিনে; কারণ এসব দেশে দেবতাদের নিয়ে এর আগেই রাজনীতির খেলা শুরু হয়ে গেছে। আইওনিয়ার প্রথম বৈজ্ঞানিক থেলেস বাদ দেন দেবতাদের; দেবতা ছাড়াই বুঝতে চেষ্টা করেন বিশ্বকে। তবে কয়েক শো বছরের মধ্যেই সমাজপ্রভুরা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে; কেননা তারা দেখতে পায় কুসংস্কারে তাদের লাভ অনেক, বিজ্ঞানে ক্ষতি প্রচুর।

প্লাতো-আরিস্ততল, যারা খুব জ্ঞানী ব’লে বিখ্যাত, কাজ করেন বিজ্ঞানের ও মানুষের বিরুদ্ধে। প্লাতো বলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রমণ্ডল সম্পর্কে ভাববেন, তবে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ ক’রে সময় নষ্ট করবেন না। ঘরে বা গুহায় ব’সে ভেবে ভেবে দেবতা বা বিধাতা সৃষ্টি সম্ভব, তাদের স্বরও শোনা যেতে পারে, আদর্শ রাষ্ট্রও পরিকল্পনা করা যায় স্পার্টার অনুকরণে, কিন্তু নক্ষত্রমণ্ডলের কার্যকলাপ বোঝা যায় না। আরিস্ততল মনে করতেন নিম্নশ্রেনীর মানুষ দাসস্বাভাবের, তাদের কোনো প্রভুর অধীনে থাকাই মঙ্গল। গ্রিসে বিজ্ঞানের মৃত্যুর এক কারণ দাসপ্রথার উদ্ভব। প্লাতো ও আরিস্ততলের কালে দাসপ্রথা বেশ শক্ত প্রথায় পরিণত হয়। ওই দার্শনিকেরা ও আরো অনেকে গণতন্ত্রের কথা বলতেন, তবে ওই গণতন্ত্ৰ সকলের জন্যে গণতন্ত্র ছিলো না, ছিলো সমাজের সুবিধাভোগী অভিজাতদের জন্যে। দাসরা করতে শারীরিক শ্রম, আর বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষাও ছিলো শারীরিক শ্রমের কাজ। প্লাতো আর আরিস্তাতল বেশ আরামে ছিলেন দাসপ্রথাভিত্তিক সমাজে; তারা স্বৈরাচারীদের সেবক ছিলেন, এবং দাসপ্রথার পক্ষে দাঁড় করিয়েছিলেন তাদের দর্শন। দাসপ্রথা যাতে ভালোভাবে চলে, তার জন্যে তারা ভাগ করেন শরীর ও আত্মাকে, পার্থক্য করেন বস্তু ও চিন্তার মধ্যে, আকাশমণ্ডল থেকে পৃথক করেন। পৃথিবীকে, যে-সমস্ত বিভাজন আজো অনেকে আঁকড়ে আছে প্ৰাণপণে। প্লাতোর বিশ্বাস ছিলো সবখানেই দেবতারা আছে, এবং তিনি নিজের রাজনীতিক বিশ্বাসকে বিশ্বজগতের সাথে জড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানবিরোধী; এবং তার পর দেখা দেয় প্লাতোনীয়রা, ও খ্রিস্টানরা, যারা বিশ্বাস করতো পৃথিবী একটি নোংরা জায়গা, আকাশমণ্ডল হচ্ছে বিশুদ্ধ ও স্বর্গীয়। এর ফলে পৃথিবী যে একটি গ্রহ, আমরা যে মহাজগতের অধিবাসী, একথাটিই ভুলে যাওয়া হয়। প্লাতোর জন্মের আগেই আইওনিয়ার আরিস্তারকাস বলেছিলেন পৃথিবী নয় সূর্যই গ্রহমণ্ডলির কেন্দ্র, গ্রহগুলো ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে; কিন্তু তার কথা। আপত্তিকর মনে হয় সকলের। প্লাতোর প্রভাবে তাঁর লেখা ভুলে যাওয়া হয়। তাঁর আঠারোশিতক পর একই কথা বলেন কোপারনিকাস; আমরা এখন মানি কোপারনিকাসকেই।

গ্রহগুলো একে অন্যের থেকে বহু দূরে; পৃথিবী থেকে ভিনাসের দূরত্ব চার কোটি কিলোমিটার, পুটোর দূরত্ব ছয় বিলিঅ’ন কিলোমিটার, মহাজগত ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি আলোকবর্ষব্যাপী; এসব আজ জানি আমরা, কিন্তু এতো দূরত্বের কথা পুরোনো কালের কেউ ভাবতেও পারতো না। স্থান ও কালের অনন্ততা অসীমতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিলো না। গ্রিকরা মনে করতো সূর্য একটা ছোটো ভূখণ্ডের সমান, বিশ্বকেও তারা বেশি বড়ো মনে করতো না। শিশুরা আকাশের দিকে তাকিয়ে যেমন মনে করে একটু দূরেই আকাশ নীল হয়ে ঘিরে আছে পৃথিবীকে, আর সূর্য চাঁদ তারাও বেশি দূরে নয়, তেমনিই মনে করতো। পুরোনো কালের মানুষ। পুরোনো মিশরিরা মনে করতো আকাশ হচ্ছে একটি তাবুর চন্দ্ৰাতপ, যেটি খাটানো হয়েছে চারটি পাহাড়ের ওপর। গ্রিকদের চোখে সূর্য ছিলো মাত্র কয়েক হাজার ফুট দূরে; এর পরিচয় পাই গ্রিক পুরাণের ইকারুসের গল্পে। ইকারুস তার বানানো ডানা দিয়ে উড়ে উড়ে ঢুকে গিয়েছিলো সূর্যে, সূর্য খুব দূরে হ’লে এটা সম্ভব হতো না। তাদের চোখে তারাগুলোও বেশি দূরে ছিলো না। পুরোনো মানুষেরা মহাজগতের আয়তন ও নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব সম্পর্কে খুবই ভুল ধারণা পোষণ করতো, তবে তারা বেশ পরিচিত ছিলো বিভিন্ন গ্রহনক্ষত্রের গতির সাথে। এসব তাদের জানতে হতো কৃষি ও অন্যান্য কাজের জন্যে। পৃথিবী আর গ্রহনক্ষত্র কী, মহাবিশ্বের রূপ কী, তারা বোঝে নি; ভাই তারা এসব সম্পর্কে করতো নানা কল্পনা, বানাতো গল্প। মহাজগত পুরাণের পর শুরু হয় মহাজগতকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা। খ্রিপূ চতুর্থ শতকে মহাজগতকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলেন এশিয়া মাইনরের ইউডোক্সাস। তিনি একটি কাঠামো তৈরি করেন সৌরজগতের, যাতে পৃথিবী একটি গোলক, যাকে ঘিরে আছে একটির পর একটি সমকেন্দ্ৰিক গোলক। তারও আগে পারমেনিদেস গোলকের পর গোলক রূপে বিশ্বের রূপ প্ৰস্তাব করেছিলেন। তার কাঠামোতে গোলকের সংখ্যা ছিলো কম। ইউডোক্সাস গোলকের সংখ্যা বাড়িয়ে করেন সাতাশ। তিনি যে-বিশ্বজগতের রূপ প্রস্তাব করেন, তা খুবই জটিল; তবে তার সাহায্যেও ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিলো না দৃশ্যমান আকাশ।

এর পর দেখা দেন সর্বজ্ঞ, বিধাতার থেকে জ্ঞানী, আরিস্ততাল। তিনি বিধাতার মতোই জ্ঞানের নামে দু-হাজার বছরের জন্যে তৈরি ক’রে যান অসংখ্য বিভ্রান্তি। বলা হয়ে থাকে তিনি সব কিছু দেখে সিদ্ধান্ত নিতেন;—তিনি ছিলেন পর্যবেক্ষণ বা উপাত্তবাদী, আসলে তিনি পর্যবেক্ষণ পছন্দ করতেন না। তিনি তার স্ত্রীদের দাঁতগুলোও গুণে দেখার আগ্রহ বোধ করেন নি, না দেখেই ব’লে গেছেন। পুরুষের থেকে নারীর দাতের সংখ্যা কম, আর দু-হাজার বছর ধ’রে অন্যরাও না দেখেই বিশ্বাস করেছে যে নারীদের দাতের সংখ্যা কম। মহাপুরুষেরা যেমন মহাউপকারী, তেমনি অনেক সময় মহাক্ষতিকরও। জানি না বলার অভ্যাস ছিলো না তার; তিনি মনে করতেন। তিনি সব জানেন। আরিস্তাতল বিশ্বের গঠন বর্ণনার জন্যে তৈরি করেন একটি কাঠামো, এতে তিনি সঙ্গে নেন কালিঙ্গুসকে। তারা দুজনে ইউডোক্সাসের বিশ্বকাঠামো ভিত্তি ক’রে তৈরি করেন এক নতুন বিশ্বকাঠামো, যা পাওয়া যায় আরিস্ততলের আকাশমণ্ডল গ্রন্থে। কাঠামোটি তার দর্শনের মতোই চমৎকার, ও শোচনীয়রূপে ভুল; আরো শোচনীয় হচ্ছে যে এ-কাঠামো দু-হাজার বছর ধ’রে বিভ্রান্ত করেছে, এবং প্যালেস্টাইন অঞ্চলের ধর্মবইগুলোর মধ্যে ঢুকে আজো বিভ্রান্ত করছে মানুষকে। এটিও গোলকের সমষ্টি; এতেও বিশ্ব হচ্ছে গোলকের পর পর গোলক, মোট পঞ্চান্নটি গোলকের সমষ্টি। আরিস্তলের মতে শেষ গোলকটির পর আর কিছুই নেই, কিছুই থাকতে পারে না। এই গোলকরাশির কেন্দ্রে রয়েছে পৃথিবী। তাদের সকলেরই বিশ্বাস ছিলো যে জগতের কেন্দ্র হচ্ছে পৃথিবী; তাই পৃথিবীকে কেন্দ্ৰ ক’রে বিশ্বের রূপ গঠন করতে গিয়ে জটিল ও জটিলতর রূপে তারা প্ৰস্তাব ক’রে চলেছিলেন গোলকের পর গোলক। গোলকের পর গোলকের বিন্যাসের মধ্যে তারা দেখেছিলেন স্বর্গীয় সুষমা। তাঁরা কল্পনা করতেন যে নক্ষত্ররাশির চলার ফলে বেজে ওঠে। স্বর্গীয় ঐকতান: তারা শুনতে পান। স্বর্গীয় গোলকের সঙ্গীত। বহু কবি গোলকের স্বৰ্গীয় সঙ্গীত নিয়ে লিখেছেন বহু কবিতা। এটা কাব্যিক কল্পনা হিশেবে সুন্দর, কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল।

গোলকবিন্যাস চূড়ান্তরূপ পায় দ্বিতীয় শতকের মিশরের নীল নদীর তীরের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লদিউস টলেমির বিশ্বকাঠামোতে। আরিস্ততলের মতো আকাশের দিকে না তাকিয়ে তিনি তার কাঠামো তৈরি করেন নি, নক্ষত্রদের চলাচল তিনি যত্বের সাথেই দেখেন, এবং একটি বই লেখেন গাণিতিক রচনা নামে। বইটি আরবিতে অনুদিত হয় আলমাজেস্ত বা ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ নামে। এটি সূর্য, নক্ষত্র, ও গ্রহগুলোর চলাচল আগের কাঠামোগুলোর থেকে ভালোভাবে নির্দেশ করে। তিনিও তার কাঠামােতে পৃথিবীকে রাখেন কেন্দ্রে, এবং রাখেন গোলকের পর গোলক, আর রাখেন এপিসাইকেল ও এক্সেট্রিক। এপিসাইকেল হচ্ছে এমন বৃত্তাকার কক্ষপথ, যা ঘোরে কোনো বিন্দুকে কেন্দ্ৰ ক’রে, যে-বিন্দু ঘোরে অন্য কোনো বিন্দুকে কেন্দ্ৰ ক’রে। এক্সেট্রিক হচ্ছে এমন গোলক, যেটি স’রে যায় বিশ্বের কেন্দ্র থেকে। এর সাথে তিনি যুক্ত আরেক ধরনের বৃত্তাকার গতি। তাঁর বিশ্বকাঠামো বেশ অসুন্দর আরিস্ততলের কাঠামোর তুলনায়, তবে এটা হয়ে ওঠে বেশ গ্রহণযোগ্য; কেননা জোড়াতালি দিয়ে এটা অনেক কিছু ঠিকঠাক মতো নির্দেশ করতে পারে। ইউরোপে রেনেসাস পর্যন্ত এটা নিজের মহিমা গৌরবের সাথেই রক্ষা করে। তবে তার বিশ্বতত্ত্ব বা বিশ্বকাঠামো বাস্তব বিশ্ব ব্যাখ্যা করে না, তিনি আকাশে যে চাকার পর চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, সে-সব চাকা আকাশে নেই। টলেমির বৃত্তের পর বৃত্ত সে-সব বস্তুর প্রাকৃতিক গতি নির্দেশ করে, যেগুলো প্রকৃতিতে নেই। কিন্তু তিনি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন ব্যাপক, ধর্মপ্রবর্তকেরা তাঁর কাঠামো বিধাতার কাঠামো হিশেবে ঢুকিয়ে দেন বিধাতার বইতে, এবং উপাসনালয়গুলো আর ধাৰ্মিকেরা সাত আকাশ দশ আকাশ ব’লে কীর্তন করে তারই বিশ্বকাঠামো। সাত আসমান দশ আসমান ব’লে কিছু নেই, ধর্মের বইগুলো বিধাতা লিখলে এমন ভুল করতেন না।

পৃথিবীকেন্দ্ৰিক যে-সব বিশ্ব বা মহাজগত কল্পনা করেছিলেন ইউডোক্সাস, আরিস্তাতল, টলেমি, সেগুলো আজকের মহাজগতের তুলনায় ছিলো খুবই ছোটো। তবে এগুলোর মধ্যে টলেমির বিশ্বই সবচেয়ে বড়ো। তাদের বিশ্ব ছোটো ছিলো, এর মূলে রয়েছে তাদের দুটি বিশ্বাস : একটি হচ্ছে যে বিশ্বের কেন্দ্র হচ্ছে পৃথিবী, অন্যটি হচ্ছে পৃথিবী স্থির। তাদের ভাবনায় পৃথিবী ছিলো অচল, আর সচল ছিলো নক্ষত্রগুলো। ওই নক্ষত্রগুলোকে একদিনে ঘুরতে হতো পৃথিবীর চারদিকে। যদি বিশ্ব খুব বড়ো হতো, তাহলে তারাগুলোকে এতো তীব্ৰ গতিতে ঘুরতে হতো, যা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না তাদের কাছে। কী ক’রে তারাগুলো এতো দ্রুত ঘুরতে পারে? তাই বিশ্বকে ছোটোরূপে কল্পনা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। পৃথিবী যে ঘুরতে পারে এটা মনেই আসে নি কারো; আপাতদৃষ্টিতে কারোই মনে হয় না। যে পৃথিবী ঘোরে। পৃথিবী কি ঘুরতে পারে? গ্রিক জ্ঞানীরা কেউ কেউ ভেবে দেখেছেন ব্যাপারট, এটা তাদের মনে হয়েছে হাস্যকর; তাদের মনে হয়েছে পৃথিবী ঘুরলে সারাক্ষণ ঝড় বইতো পৃথিবীতে, আর অলিম্পিক খেলোয়াড়রা যেখান থেকে লাফ দিতো পড়তো তার থেকে অনেক সামনে বা অনেক পেছনে, কেননা এর মাঝে পৃথিবী অনেকখানি ঘুরতো। তাই তাঁরা সিদ্ধান্তে আসেন যে পৃথিবী ঘুরতে পারে না। কিন্তু পৃথিবী ঘোরে, মহাজগত অনন্ত; তবে আজো অনেকের বিশ্বাস পৃথিবী ঘোরে না। এর মূলে আছে পৃথিবীর ধর্মের বইগুলো; এগুলোতেই বেশি বিশ্বাস করে অন্ধরা। কোপারনিকাস, কেপলার, আর গ্যালিলিওর জন্মের পরেও সাহিত্য অন্ধ থেকে গেছে। মিল্টন দেখা করেছিলেন গ্যালিলিওর সাথে, তাই তাঁর বিশ্ব বেশ বড়ো; তবু তাঁর স্বৰ্গচ্যুতি মহাকাব্যে পৃথিবীই মহাজগতের কেন্দ্র। ওই কাব্যে এক দেবদূত আদমকে উপদেশ দিয়েছে :

যা কিছু গোপন সে-সব সম্পর্কে চিন্তা কোরো না,
সব ছেড়ে দাও বিধাতার হাতে, সেবা আর ভয় করো তাকে:
…সুখে থাকো
যা কিছু তোমাকে তিনি দিয়েছেন সেই সব, এই স্বর্গ
আর রূপবতী হাওয়াকে নিয়ে; স্বৰ্গ তোমার বোঝার জন্যে অতি উচ্চ
কী ঘটে সেখানে তুমি বুঝবে না; নতভাবে হও জ্ঞানী :
ভাবে শুধু সে-সব যা কিছু প্রাসঙ্গিক তোমার জন্যে;
অন্য জগতের স্বপ্ন দেখো না।

দেবদূতরা চিরকালই অন্ধতা ও আনুগত্যের পরামর্শ দিয়েছে; কিন্তু মানুষ, অন্তত কিছু মানুষ, ওই পরামর্শ শোনে নি। আমরা সারা বিশ্ব সম্পর্কেই ভাবি, সারা মহাজগতই আমাদের জন্যে প্রাসঙ্গিক; এবং আমরা জানি ওই দেবদূত ও তার বিধাতার থেকে অনেক বেশি।

মহাজগত অনন্ত; সবচেয়ে প্রতিভাবান চিন্তাও তার সবটা এখনো বুঝে ওঠে নি, তবে বুঝেছে অনেকখানি, ভবিষ্যতে আরো বুঝবে। মহাজগতের উৎপত্তি হলো কীভাবে? যেভাবেই হোক, বিভিন্ন পুরাণ আর ধর্মের বই যেভাবে হয়েছে ব’লে প্রচার করে, সেভাবে হয় নি। বাইবেল বিশ্বসৃষ্টির যে-গল্পটি বলে, তা এমন :

আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিলো, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিতি করিতেছিলেন। পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক, তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন, এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম দিবস ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে প্রথম দিবস হইল [আদিপুস্তক : জগৎ- সৃষ্টির বিবরণ]।

বাইবেলের বিধাতা প্রথম দিনে এ-কাজটুকু করেন, আরো ছ-দিনে আরো কিছু কাজ ক’রে ক্লান্ত হয়ে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। বিধাতাও ক্লান্ত হন! এ-সৃষ্টিতত্ত্বে, কিছুটা সংশোধন ক’রে, বিশ্বাস করে অন্তত তিনটি ধর্মের লোকেরা। এটা প্যালেস্টাইন অঞ্চলের পুরাণ, লৌকিক গাথা। মহাজগতের উৎপত্তির প্রক্রিয়া এর থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর ও মহাজাগতিক।

বিশ্ব বা মহাজগত কখন সৃষ্টি হয়েছিলো? ইহুদি, খ্রিস্টান, ও ইসলাম ধর্মে বিশ্বসৃষ্টির যে-বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে বোঝা যায় তাদের বিশ্বাসে মহাজগত সৃষ্টি হয়েছিলো অতীতের এক নির্দিষ্ট সময়ে; আর সে-অতীত বেশি অতীত নয়। তাদের ভাবনায় ওই সময়টা অবশ্য অত্যন্ত দীর্ঘ, কেননা হাজার বছর তাদের চিন্তায় ছিলো মহাকালের মতো। সন্ত অগাস্টিন বাইবেলের ‘জগৎ-সৃষ্টির বিবরণ অনুসারে সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন খ্রিপূ ৫০০০ অব্দের দিকে বিধাতা সৃষ্টি করেছিলেন। বিশ্ব। সতেরোশতকে জেমস আশার হিশেব ক’রে দেখান যে বাইবেল অনুসারে বিধাতা বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন ৪০০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে; আর লাইটফুট আরো নিপুণভাবে হিশেবে ক’রে দেখান যে বিধাতা মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। ২৩ অক্টোবর ৪০০৪ খ্রিপূ, সকাল ৯:০০টায়! বাইবেলপ্রণেতাদের জন্যে চার হাজার বছর অত্যন্ত দীর্ঘ, কিন্তু আমাদের কাছে এটা অত্যন্ত তুচ্ছ সময়। আরিস্ততাল, ও অন্যান্য গ্রিক দার্শনিক, মনে করতেন বিশ্ব আর মানুষ চিরকাল ধ’রেই আছে। বিশ্ব কি সৃষ্টি হয়েছিলো এক বিশেষ সময়ে এবং বিশ্বের কি রয়েছে বিশেষ স্থানিক সীমা, এটা ভাবিয়েছিলো আঠারোশতকের দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টকে। তিনি এ-প্ৰশ্নকে মনে করেন বিশুদ্ধ যুক্তির বিরোধী; কেননা তাঁর মতে বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিলো এক বিশেষ সময়ে, অর্থাৎ বিশ্বের রয়েছে আরম্ভ, এটা যেমন যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্বাস করা যায়, তেমনিই যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্বাস করা যায় যে বিশ্ব চিরকাল ধ’রে আছে। তার যক্তি হচ্ছে যদি বিশ্বের কোনো আরম্ভ না থাকে, তাহলে যে-কোনো ঘটনার আগে আছে অনন্তকাল, যা তার কাছে অযৌক্তিক; আবার যদি বিশ্বের থাকে আরম্ভ, তাহলে তারও আগে থাকে অনন্তকাল; তাহলে বিশ্ব কেনো আরম্ভ হবে এক বিশেষ সময়ে? কান্ট গোলমালে পড়েছিলেন সময় ধারণাটি নিয়ে। হকিং মনে করেন বিশ্ব সৃষ্টির আগে সময় ধারণার কোনো অর্থ নেই; সময়ের সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ব সৃষ্টির সাথে। যদি বিশ্বসৃষ্টির আগেও সময় ছিলো মনে করি, যেমন আমাদের মনে হয়, আর মনে করি যে বিধাতা সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব, তাহলে প্রশ্ন উঠবে বিশ্ব সৃষ্টির আগে বিধাতা কী করছিলেন? এতোকাল ধ’রে মানুষ বিশ্বকে স্থির ও অপরিবর্তনীয় ব’লেই মনে করেছে; কিন্তু ১৯২৯-এ এডউইন হাবেল দেখতে পান এক অভাবিত ব্যাপার। তিনি দেখেন দূরবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জ দ্রুত স’রে যাচ্ছে আমাদের থেকে; অর্থাৎ মহাজগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই মনে করতে পারি এমন একটা সময় ছিলো যখন মহাজগতের সব কিছু ছিলো কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন আজ থেকে দশ বা বিশ হাজার মিলিঅ’ন বছর আগে মহাজগতের সব কিছু ছিলো একীভূত; তাই মহাজগতের ঘনত্ব ছিলো অসীম। হাবেল যা দেখতে পান, তাতে মনে হয় এমন একটা সময় ছিলো, যখন মহাজগত ছিলো অন্তহীন রূপে ক্ষুদ্র আর সীমাহীন রূপে ঘন। ওই অবস্থায়ই ঘটে Big Bang—মহাবিস্ফোরণ।

দশ বা বিশ বিলিঅ’ন বছর আগে ঘটে এক মহাবিস্ফোরণ,-বিগ ব্যাংমহাশব্দ; আর সূচনা হয় মহাজগতের। সময় সম্পর্কে অবশ্য হকিংয়ের ব্যাখ্যাটি মনে রাখা দরকার। হকিংয়ের মতে সময়ের সূচনা হয় বিগ ব্যাংয়ে, কেননা এর আগের সময়কে সংজ্ঞায়িত করার কোনো দরকার নেই। কেনো এটা ঘটে সেটা অবশ্য এক বিস্ময়; তবে ঘটেছিলো তাতে সন্দেহ নেই। এখন মহাজগতে যতো বস্তু ও শক্তি আছে তখন সে-সব ছিলো চরম ঘনীভূতরূপে, শূন্যরূপে, তা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। এক সময় ঘটে ওই ঘনীভূত শক্তি ও বস্তুর বিস্ফোরণ। ওই বিস্ফোরণের ফলে প্রসারিত হ’তে থাকে মহাজগত, যা আজো চলছে। মহাজগত চিরসম্প্রসারণশীল। মহাজগতের, অর্থাৎ স্থানের বিস্তারের সাথে সাথে সব দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বস্তু ও শক্তি। বিস্ফোরণের কালে মহাজগতের সব এলাকা আলোকিত হয়ে উঠেছিলো; কিন্তু সময় বইতে থাকে, মহাজগত সম্প্রসারিত হ’তে থাকে, বিকিরণ শীতল হতে থাকে, আর মহাজগত অন্ধকার হতে থাকে। আদিমহাজগত পরিপূর্ণ ছিলো হাইড্রোজেন ও হেলিয়ামে, এবং বিকিরণে। তখনই সৃষ্টি হয় নক্ষত্রমণ্ডলি। মহাবিস্ফোরণের এক বিলিঅন বছরের মতো সময়ের পর দেখা যায় কোথাও বস্তু জড়ো হয়েছে, আবার কোথাও জড়ো হয় নি। তাদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি চারপাশের গ্যাসকে আকর্ষণ করে, যার থেকে সৃষ্টি হয় নক্ষত্রমণ্ডলিপুঞ্জ। মহাজগতের সবখানে কাজ করে একই নিয়ম, তাই মহাজগতের সবখানে দেখা যায় একই রকম নক্ষত্রমণ্ডল । ওই মহাবিস্ফোরণ থেকেই দেখা দেয় নক্ষত্রমণ্ডলি, নক্ষত্র, গ্রহ, তারপর জীবন। এখন মহাজগতে রয়েছে অজস্র নক্ষত্রমণ্ডল ।

সূর্য একটি নক্ষত্র বা তারা; এটি আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। সূর্য হাইড্রোজেন ও হেলিয়াম গ্যাসের এক বিশাল গোলক, প্রচণ্ড তাপে এটি জ্বলজ্বল করছে। এর ভেতরটি প্রচণ্ডভাবে জুলছে; এর ভেতরের তাপ চার কোটি ডিগ্রি, বাইরের তাপ ছ-হাজার ডিগ্রি । কীভাবে জন্ম নেয়। তারা ও গ্রহগুলো? মহাজাগতিক গ্যাস ও ধুলোর মহামেঘের বিপর্যয়ের ফলেই জন্ম নেয় নক্ষত্র ও গ্রহ। মেঘের ভেতরের গ্যাসের অণুরাশির সংঘর্ষের ফলে তাপ বাড়ে, হাইড্রোজেন হয়ে উঠতে থাকে হেলিয়াম, এবং কোটি কোটি বছরে একেকটি তারকার জন্ম হয়। তারাদের জন্ম হয় দলে দলে, এবং ছড়িয়ে পড়ে মহাজগতের দিকে দিকে। একই মেঘ থেকে জন্ম হয়েছিলো সূর্য ও আরো কয়েকটি নক্ষত্রের, মহাজগতের কোথাও এখন আছে সূর্যের সহোদর নক্ষত্রগুলো। সূর্যের ভেতরে সারাক্ষণ চলছে বিস্ফোরণ, তার ফলে হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হচ্ছে হেলিয়ামে; এজন্যেই সূর্য এতো উজ্জ্বল। হাইড্রোজেনের বিস্ফোরণ চিরকাল চলবে না, এক সময় তা ফুরিয়ে আসবেই। সূর্য ও অন্যান্য তারা কতোকাল বাঁচবে, তা নির্ভর করে সেগুলোর উদ্ভবের সময়ের ভর বা বস্তুপরিমাণের ওপর। সূর্যের কী নিয়তি? আজ থেকে পাঁচ বা ছয় বিলিঅন বছরের মধ্যে সূর্যের ভেতরের সব হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হবে হেলিয়ামে, থাকবে না কোনো হাইড্রোজেন; তখন সূর্যের মাধ্যাকর্ষণে সূর্যের ভেতর ভাগের হেলিয়ামপূর্ণ এলাকাটি আরো ঘনীভূত হবে, সূর্যের ভেতরের তাপ বেড়ে যাবে বহুগুণে, সূর্যে দেখা দেবে তীব্র বিকিরণ। এর ফলে সূর্য আরো কিছু কাল, কয়েক লক্ষ বছর, ধ’রে জ্বলবে।

তখন একটি বড়ো পরিবর্তন ঘটবে সূর্যের। তার বাইরের দিকটা প্রসারিত হয়ে শীতল হয়ে আসতে থাকবে। সূর্য তখন হয়ে উঠবে এক বিশাল লাল দানব নক্ষত্র। তার বাইরের এলাকাটি ভেতরের এলাকা থেকে এতো দূরবর্তী হবে যে বাইরের দিকে মাধ্যাকর্ষণ অত্যন্ত ক’মে যাবে। এর ফলে বাইরের অংশটি দিকে দিকে প্লাবনের মতো বয়ে চলবে। তখন সূর্যের প্লাবনের ভেতরে হারিয়ে যাবে মারকিউরি ও ভেনাস; হয়তো পৃথিবীও। তখন সৌরজগতের শুরুর এলাকাটি ঢুকে যাবে। সূর্যের ভেতরে। আজ থেকে কয়েক বিলিঅ’ন বছর পর পৃথিবীতে দেখা দেবে শেষ বিশুদ্ধ দিন। সেদিনের পর সূর্য লাল হবে ধীরেধীরে, ফেপে কাছাকাছি এসে যাবে পৃথিবীর। মেরুর বরফ গলে পৃথিবী জুড়ে বয়ে যাবে প্রবল বন্যা। প্রচণ্ড তাপে ওই জলরাশি পরিণত হবে বাষ্পে, পৃথিবী ঘিরে দেখা দেবে ঘন মেঘমণ্ডল, যাতে বাধা পাবে সূর্যের রশ্মি। একটু বিলম্বিত হবে পৃথিবীর ধ্বংস। তবে তাপে সব জল বাম্পে পরিণত হবে এক সময়, পৃথিবীর জলবায়ু নিঃশেষিত হয়ে মিশে যাবে মহাশূন্যে, মহাপ্ৰলয় শুরু হবে পৃথিবী জুড়ে। সূর্য ও পৃথিবী ধ্বংস হবে, তবে মানুষ হয়তো ধ্বংস হবে না। তখন মানুষেরও এতো বিবর্তন ঘটবে, এতো বিকশিত হবে তাদের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা যে তারা পৃথিবী ধ্বংসের অনেক আগেই হয়তো পাড়ি জমাবে অন্য কোনো গ্রহে, বা নিজেদের জন্যে তৈরি করে নেবে কোনো মহাজাগতিক বাসভূমি। তখনো সূর্যের ভেতরে ও বাইরে ঘটে চলবে নানা বদল; থেমে যাবে তার ভেতরের পারমাণবিক বিক্রিয়া, এবং বাড়বে সূর্যের আয়তন। সূর্য তারপর কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকবে মুমূর্ষু অবস্থায়; আমাদের সূর্য পরিণত হবে সূর্যের প্ৰেতাত্মায়। সূর্য তখন হয়ে উঠবে একটি ছোটো তারা, চরমরূপে ঘনীভূত হয়ে হবে। এক হোয়াইট ডোআফ বা শাদা বামন। তবে এ-ই। তার শেষ পরিণতি নয়। সূর্য শীতল হ’তে থাকবে, ঠাণ্ডা হ’তে থাকবে, এবং শেষে পরিণত হবে এক মৃত কালো বামনে ।

ধ্বংস অনিবাৰ্য, তবে এখনো সুদূর। মহাজগতকে যদি ঠিকভাবে বুঝি আমরা, আর বুঝি মহাসমুদ্রের এক কোণে আমাদের ছোট্ট চরটিকে, তাহলে আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে দেবদেবী আর বিধাতার ভয়ে কেঁপে উঠবো না। আমরা। এখন ভয় পাই, কারণ অন্ধকারে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। মানুষের স্বভাব হওয়া উচিত অবিশ্বাস, অবিশ্বাস হচ্ছে আলো; আর বিশ্বাস মানুষকে পরিণত করে জড়বস্তুতে। তবে বিশ্বাস শুরু থেকেই রাজনীতি; সমাজপ্রভুরা বিশ্বাসকে ব্যবহার করে তাদের প্রধান কৌশল ও অস্ত্ররূপে। মহাজগতের উৎপত্তির জন্যে দরকার পড়ে না কোনো বিধাতার, ধ্বংসের জন্যেও পড়ে না; তবে সমাজরাষ্ট্রের ওপর প্রভুত্ব করার জন্যে দরকার পড়ে বিধাতার। তবে বিধাতা স’রে যাবেন, রাজনীতিবিদেরা তাকে বেশি দিন আয়ত্তে রাখতে পারবেন না ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *