০৩. নাইটিংগেলের প্রতি

নাইটিংগেলের প্রতি

যা কিছু প্রিয় আমার, যা কিছুর জন্যে নিরর্থক জীবনধারণকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় অনেকখানি, বেঁচে থাকাকে সুখকর মনে হয়, তা রাষ্ট্র নয় সংঘ নয়। সুধীদের কর্মীদের রাজনীতিবিদদের বিবর্ণিতা নয়, সেগুলো খুবই সামান্য ব্যাপার, আর সেগুলোর শুরুতেই রয়েছে কবিতা। সমাজ, বিশেষ ক’রে রাষ্ট্রের কবিতার দরকার নেই; কোনো রাষ্ট্রই মনে করে না যে তার সুঠু পরিচলনের জন্যে কবিতা দরকার, দরকার কবি। ১০০০ মানুষের জন্যে আমাদের ৫০ জন চিকিৎসক দরকার, এক জেলার জন্যে দরকার ১০০ প্রকৌশলী, ৩০০ নির্বাহী কর্মকর্তা, ৪টি নির্বাচিত ১টি মনোনীত প্রতিনিধি, এবং ১৫০০ পতিতা, কিন্তু কোনো কবির দরকার নেই। তবে ব্যক্তির দরকার কবিতা, সমাজের দরকার কবিতা, সভ্যতার দরকার কবিতা। মানুষ সৃষ্টিশীল, তার সম্ভাবনা অশেষ, কবিতা মানুষের সৃষ্টিশীলতার এক শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। কবিতার বিচিত্ররূপে মুগ্ধ হই আমি, যদিও সব কবিতাকে সমান মূল্য দিই না, যা কিছু দেখতে কবিতার মতো তাকেই কবিতা মনে করি না, কিন্তু যা কবিতা হয়ে উঠেছে, যা আমার ভেতরে ঘণ্টা বাজায়, তার জন্যে আমার ভালোবাসা অন্তহীন। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাকে বাঁকে’র সরল বর্ণনা যেমন সুখ দেয় আমাকে, বর্ষার উৎসবে পাড়া জেগে ওঠার উল্লাস যেমন চমকে দেয়, তেমনি সুখী করে আমাকে ‘হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে’, বা ‘জাতিভেদে বিবিক্তি মানুষ; নিরঙ্কুশ একমাত্র একনায়কেরা’। আমি তেমনি সুখী হই, দেখতে পাই অরণ্যের সামনে সন্ধ্যায় এসে পৌচেছে সে, তাকে মাইল মাইল যেতে হবে মাইল মাইল যেতে হবে ঘুমোনোর আগে, দেখতে পাই সেই ব্ল্যাকবার্ডের চোখ, সমগ্র পর্বতমালার মধ্যে একমাত্র যা-ই শুধু অভিভূতকর, দেখতে পাই সেই পাখিটিকে মৃত্যুর জন্য যার জন্ম হয় নি, বা কোনো লাল চুলের ভিখিরিমেয়েকে, দুটি চোখের মতো যার বুক দীপ্তিময় লাবণ্যের চাপে, দেখতে পাই আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভ’রে গেছে, যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ-কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে। অজস্র দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখতে পাই, শুনতে পাই ধ্বনির পর ধ্বনি, আর অনুভব করি এমন কিছু যার দৃশ্য নেই গন্ধ নেই ধ্বনি নেই রঙ নেই, রয়েছে অপার গভীর বিপুল বিস্তার।

কীভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা? কী থাকে কবিতায়? কবিতায় কী থাকে, তা খুঁজে খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়, মানবিক-অমানবিক সব কিছুই তো থাকে কবিতায়, থাকে ভাষার ইন্দ্রজাল, অপরিসীম কল্পনা; কিন্তু কীভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা, তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারি না। কোনো শিল্পকলা সম্পর্কেই ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব নয়; আগে থেকেই একটি মহৎ বা চমৎকার কবিতা লেখার ছক কেউ তৈরি ক’রে দিতে পারে না। কেউ আগে থেকে ব’লে দিতে পারে না। কী বিষয় কীভাবে লিখলে লেখাটি হয়ে উঠবে অসাধারণ কবিতা। কবিতার কাঠামো, তার ছন্দ ও মিল বা অমিল সম্পর্কে কিছুটা শিক্ষা দেয়া সম্ভব, কিন্তু প্রতিটি প্রকৃত কবিতাই অভূতপূর্ব, রচিত হওয়ার আগে তাঁর রচয়িতাও সেটি সম্পর্কে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারেন না। কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পরই শুধু উপলব্ধি বা অনুভব বা বিচার ক’রে দেখা সম্ভব সেটি কবিতা হয়েছে কিনা, বা হয়েছে কতোটা অসাধারণ। বিজ্ঞানের একটি মূলকথা ভবিষ্যদ্বাণী, কোনো সূত্র যদি নির্ভুল হয়, তবে তা সম্ভাব্য ব্যাপারগুলো সম্পর্কে করতে পারে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী; শিল্পকলায় এটা অসম্ভব। প্রতিটি শিল্পসৃষ্টিই অনন্য, সৃষ্টি হওয়ার আগে সেটি সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারে না। বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো অবধারিত; পূর্ব আবিষ্কারগুলো বিজ্ঞানীদের অবধারিতভাবে পৌঁছে দেয়। পরবর্তী আবিষ্কারগুলোতে। আইনস্টাইনের আবিষ্কারের জন্যে একান্তভাবে আইনস্টাইন জরুরি নন; তিনি ওই তত্ত্ব আবিষ্কার না করলে অবধারিতভাবে অন্য কেউ তা আবিষ্কার করতেন, হয়তো কিছুটা সময় লাগতো; কিন্তু শেক্সপিয়র হ্যামলেট বা রবীন্দ্রনাথ ‘নিরুদ্দেশ যাত্ৰা’ না লিখলে তা চিরকাল অরচিত থেকে যেতো। কোনো শিল্পসৃষ্টিই অবধারিত নয়, প্রতিটি শিল্পসৃষ্টিই ব্যক্তিগত প্ৰতিভার প্রকাশ। ‘নিরুদেশ যাত্ৰা’ কোনো ইঙ্গিত করে না। ভবিষ্যতে অবসরের গান’ রচিত হবে; কিন্তু নিউটনের সূত্রগুলো ইঙ্গিত করে যে একসময় অবধারিতভাবে প্রস্তাবিত হবে আইস্টাইনীয় আপেক্ষিকতত্ত্ব। শিল্পসৃষ্টি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব নয়, কিন্তু তার চরিত্র ও সৃষ্টিপ্রক্রিয়া অনেকটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। শিল্পভ্রষ্টাদের মধ্যে কবিদেরই রয়েছে প্রবল সমালোচক সত্তা; অন্যরা সাধারণত চুপ থাকেন শিল্পকলায় নিজেদের শাখা সম্পর্কে, কিন্তু কবিরা চিরকালই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন কবিতা, উদঘাটন করতে চেয়েছেন কবিতার উৎসারণ প্রক্রিয়া। তাই কবিরাই হয়ে উঠেছেন শ্রেষ্ঠ মৌলিক সমালোচক। আধুনিক কালের পশ্চিম ও পুবের প্রধান কবিরাই কবিতা ও সাহিত্যের প্রধান সমালোচক; তাঁরা মূল্যায়ন করেছেন কবিতা, ব্যাখ্যা করেছেন শিল্পকলা, বিশেষ করে, কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া।

কবি কি কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যার শ্রেষ্ঠ পুরুষ? কবিরা তাই দাবি করেন, যেমন দাবি করেছেন অনেকের মতো এজরা পাউন্ড। পাউন্ড বলেছেন :

গাড়ি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে কি আপনি যাবেন তাঁর কাছে, যিনি গাড়ি তৈরি করেছেনএবং চালিয়েছেন, নাকি যাবেন তার কাছে, যিনি শুধু শুনেছেন গাড়ির কথা?
আর দুজন মানুষ যারা গাড়ি বানিয়েছেন, তাদের মধ্যে আপনি কার কাছে যাবেন, যিনি ভালো গাড়ি বানিয়েছেন তার কাছে, নাকি তার কাছে যিনি বানিয়েছেন জোড়াতালি দেয়া একটা বস্তু?

প্রশ্নের ভেতরেই রয়ে গেছে উত্তরটি যে আমরা ভালো গাড়ি প্রস্তুতকারকের কাছেই যাবো, যেমন যাবো ভালো কবিতা লেখকের কাছে। কিন্তু অসুবিধা রয়েছে গাড়ি ও কবিতাকে এক ক’রে দেখার; তার মধ্যে প্রধানটি হচ্ছে গাড়ি উৎপাদিত হয় প্রস্তুতকারকের সুনিশ্চিত পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে, তাঁর সুনিশ্চিত পরিকল্পনার বাস্তররূপ তার যানটি। প্রস্তুতকারককে আগে থেকেই জানতে হয় তিনি কী করতে যাচ্ছেন; কোন প্রস্তুতকারকই একটু একটু ক’রে তৈরি ও সংশোধন ও তৈরি ক’রে শেষে দেখেন না। তিনি কী তৈরি করলেন। তৈরি করার পর তিনি দেখেন না তার উৎপাদিত বস্তুটি গাড়ি হলো কিনা? কবিতা গাড়ির মতো উৎপাদিত হয় না, রচিত হওয়ার পর বিবেচিত হয় তা কবিতা হয়েছে কি হয় নি। তাই গাড়ি হচ্ছে উ ৎপাদন, কবিতা হচ্ছে সৃষ্টি। ভালো গাড়ি-উৎপাদক গাড়ি উৎপাদিত হওয়ার আগেই চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন তাঁর গাড়ির ক্রিয়াকলাপ, উপযোগিতা, ও অন্যান্য সব কিছু; কিন্তু কবিতা সৃষ্টির সমস্যা হচ্ছে ভালো বা মহৎ কবিও তাঁর কবিতার সব কিছু বুঝিয়ে দিতে পারেন না, নিজেও বোঝেন না; কেননা কবিতার মধ্যে রহস্যের ভাগ অনেক বেশি। গাড়িতে কোনো রহস্য নেই, কবিতা ভ’রেই রয়েছে রহস্য। অনেক ভালো কবি যেভাবে কবিতা লিখতে চান বা অন্যদের লেখার পরামর্শ দেন, নিজেরা সেভাবে লেখেন না, বা পারেন না; তাই ভালো কবিও সব সময় নির্ভরযোগ্য নন। তবে কবির, ভালো বা প্রধান কবির, কবিতাবিষয়ক কথা মূল্যবান; তা জানিয়ে দেয় তাদের কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া, অন্যদের বা সব কবিতার নয়, তাঁদের কবিতার।

কোনো কবি যখন ব্যাখ্যা করেন। কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া, তখন কবিতা বলতে তিনি কোনো বিমূর্ত শাশ্বত বিশ্বজনীন ব্যাপার বোঝেন না, বোঝেন নিজের কবিতা। তিনি বলেন নিজের কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়ার কথা, যেভাবে তিনি নিজে কবিতা সৃষ্টি করেন বা করতে চান, তা বোঝার চেষ্টা করেন তিনি ওই ব্যাখ্যায়, তবে সব সময় বুঝে ওঠেন না। ওঅর্ডসওঅৰ্থ বলেন ও অর্ডসওঅৰ্থ নিজে কীভাবে কবিতা লেখেন বা লেখার কথা ভাবেন, রবীন্দ্রনাথও বলেন নিজেরই কথা; কীভাবে অন্যরা লেখেন বা ভবিষ্যৎ কবিরা লিখবেন, সেকথা বলেন না, যদিও আমরা কখনো কখনো মনে করি কবিতা লিখতে হবে ওই মহৎদের পরামর্শ অনুসারে। শিল্পকলা এমন এলাকা যেখানে, শুধু নিজের অন্তরের পরামর্শ ছাড়া, কারো পরামর্শই গ্রহণযোগ্য নয়; মহৎ কবির পরামর্শও নিরর্থক গৌণ কবির কাছে। কবিতায় রবীন্দ্রনাথ শুধু পরামর্শ দিতে পারেন রবীন্দ্রনাথকে, এলিঅট পারেন। এলি আটকে; আর কাউকে নয়। শিল্পকলায় অন্যের পরামর্শ গ্রহণ হচ্ছে আত্মহত্যা। তবে অন্যের পরামর্শ গ্রহণযোগ্য না হ’লেও শোনার মতো, অন্যের অভিজ্ঞতা সাহায্য করতে পারে নিজের শিল্পকলার পথ তৈরিতে। কবিরা নিজেদের কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়া বলে যা রটনা করেন পদ্যে বা গদ্যে, তা তারা যে সব সময় মানেন বা মেনে চলতে পারেন, তা নয়; কারণ সৃষ্টি আর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যা ভিন্ন ব্যাপার। শিল্পসৃষ্টিতে অসচেতন প্রক্রিয়ার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কবি জানেন না কখন কোন শব্দ বা চিত্ৰকল্প এসে জুড়ে বসবে তার পংক্তি বা স্তবকে।

কবিতা চিরকাল এক থাকে না। ভাষা ও ব্যক্তিগত মানবিক বোধের উৎকৃষ্ট সমন্বয়ই কবিতা; আর যুগে যুগে ভাষা ও মানবিক বোধের বিভিন্ন প্রান্তের ওপর পড়ে জোর, এবং কবিতা হয়ে ওঠে। ভিন্ন। পশ্চিমের আধুনিক কবিরা, যাদের প্রভাব খুবই ব্যাপক আধুনিক বাঙলা কবিতার ওপর, কবিতা সম্পর্কে পেশ করেছেন বহু ব্যক্তিগত তত্ত্ব; সেগুলোর মধ্যে সাড়াজাগানো একটি হচ্ছে কবিতার নৈর্ব্যক্তিকতা ও বিজ্ঞানধর্মিতা, কিন্তু খুব বেশি কবি তা মেনে চলতে পারেন নি। বিজ্ঞান এক শতকেরও বেশি সময় ধ’রে প্রলুব্ধ করে আসছে সাহিত্যকে, ওই প্রলোভনে প্রথম ধরা দিয়েছিলেন প্রাকৃতবাদী ঔপন্যাসিকেরা। জেলা উপন্যাসকে ক’রে তুলতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞান, কিন্তু শেষে দেখা গেছে বিজ্ঞানের থেকে মানবিক উপাদানের জন্যেই তার, ও প্রাকৃতবাদীদের, উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কবিদের অনেকেই বিজ্ঞানকে ঈর্ষা করেছেন, ভুলভাবে কবিতাকে সম্রান্ত ক’রে তুলতে চেয়েছেন; কবিতায় আয়ত্ত করতে চেয়েছেন বিজ্ঞানের অবথা, চেয়েছেন কবিতার নৈর্ব্যক্তিকীকরণ। এর প্রধান প্ৰবক্তা টি এস এলিঅট। তার মতে শিল্পীর অগ্রগতি হচ্ছে ধারাবাহিক আত্মবিসর্জন, ধারাবাহিক ব্যক্তিত্ব নির্বাপণ। তার মতে এ-নৈর্ব্যক্তিকীকরণ প্রক্রিয়াই শিল্পকলা অর্জন করে বিজ্ঞানের অবস্থা। সৃষ্টির এ-প্রক্রিয়াকে তিনি তুলনা করেছেন গবেষণাগারের একটি নিরীক্ষাপ্রক্রিয়ার সাথে, কবির মন তার কাছে হয়ে উঠেছে প্ল্যাটিনাম টুকরোর মতো অনুঘটক। রোম্যান্টিকের কাছে কবির মনই ছিলো বিধাতা, মন যা সৃষ্টি করে তা-ই শুধু সত্য; আর তার কাছে মন হয়ে ওঠে অনুঘটকমাত্র, যার কাজ নিজে অপরিবর্তিত থেকে বিভিন্ন আবেগের বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। এলিঅট নিজে খুব বিজ্ঞানপ্রবণ ছিলেন না, বরং ধর্মের মতো অপবিশ্বাসের প্রতিই ঝোঁক ছিলো তার বেশি; আর এখানে তিনি যে-বিজ্ঞানটুকু চর্চা করেছেন, তাও খুব উচ্চতর রসায়ন নয়, একেবারেই প্রাথমিক রসায়নশাস্ত্র। মন প্র্যাটিনামের মতো নিস্ক্রিয় পদাৰ্থ নয়। এলিঅট পরে অবশ্য এমন কথা বলেছেন, যাতে বাতিল হয়ে যায়। তাঁর নৈর্ব্যক্তিকীকরণতত্ত্ব। তিনি বলেছেন যাদের রয়েছে ব্যক্তিত্ব ও আবেগ, শুধু তারাই জানেন ওই ব্যক্তিত্ব ও আবেগ থেকে মুক্তির কী অর্থ। তবে নৈর্ব্যক্তিক কবিতাও কবিতা, তা লিখেছেন অনেকেই, এলিআটও; তার অসাধারণ রূপও অসাধারণ, কিন্তু কবিতাকে নৈর্ব্যক্তিক হ’তেই হবে, তা নয়। তাঁর একটি উক্তি-ভালো কবিতা বোঝার অনেক আগেই ংক্রামিত হয়—একসময় খুবই গৃহীত ছিলো; কিন্তু এখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে ওটি সম্পর্কে। সত্যিই কি ভালো কবিতা বোঝার অনেক আগেই ভেতরে ঢোকে, মনে বা হৃদয়ে? অনেক বাজে জিনিশও কি ঢুকে যায় না। আমাদের মনে, এবং অনেক ভালো জিনিশাও কি বুঝতে অনেক সময় লাগে না আমাদের, বা কখনোই বুঝে উঠি না। আমরা? ভালোর থেকে খারাপই তো মানুষের মনে বেশি ঢোকে; আমরা কি দেখতে পাই না উৎকৃষ্ট কবি ও কবিতা উপেক্ষিত আর নন্দিত নিকৃষ্ট কবি ও কবিতা? সুধীন্দ্রনাথের যযাতি’ বাঙলার অনেক কবিরও মনে এখনো ঢোকে নি, অনেকের মনে কখনোই ঢুকবে না; কিন্তু বিজ্ঞাপনের বা হিন্দি গানের বহু নিকৃষ্ট ধ্বনিপুঞ্জ ঢুকেছে তাদের মনে। আমরা কি মনে করবো যযাতি’র থেকে ওগুলো উৎকৃষ্ট কবিতা?

ইয়েট্‌স্‌ যখন কবি, এমনকি অপবিশ্বাসী কবি, তখন তিনি অসাধারণ; তবে অপবিশ্বাস ব্যাখ্যা করার সময় তিনি হাস্যকর; কিন্তু যখন কবিতা লেখার কথা বলেন, তখন বলেন কবিতা লেখারই কথা। অডেন চমৎকার কথা বলেছেন যে আজকাল সব ধরনের যোগ্যতাহীন হ’লেই তরুণতরুণীরা মনে করে তাদের রয়েছে কবিপ্রতিভা। কিন্তু তরুণতরুণীদের যোগ্য বা প্রতিভাবান ক’রে তোলার জন্যে তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন কবি হওয়ার যে-পাঠক্রম, তা কোনোক্রমেই কাউকে কবি হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। কবি যে অশিক্ষিত হবেন, বা অশিক্ষিত হ’লেই কেউ কবি হবেন, তা নয়; কবি অবশ্যই শিক্ষিত হবেন, তবে শিক্ষা কাউকে কবি হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অডেনের পাঠক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন করার পর ভালো প্রশংসাপত্ৰ পাবে অনেকেই, কিন্তু তাদের অনেকেরই কবি না হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। সম্পূর্ণ বাজে কথা হয়েও কোনো লেখা হ’তে পারে, হাউজম্যানের ভাষায়, ‘র্যাভিশিং পোয়েটি’; কবিতার জন্যে শিক্ষা দরকারী নয়; কিন্তু আধুনিক কালে শিক্ষা কবিতার সঙ্গে শত্ৰুতা না ক’রে মিত্ৰতাই করেছে বেশি। শিক্ষা ছাড়া জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথকে পেতাম না। আমরা, পেতাম। এমন অনেককে যেমন পেয়েছি অনেককে। অডেনের পাঠক্রম হাস্যকর, কিন্তু আমি অশিক্ষিত কবি চাই না; কবিতা চাই, কবি শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যা-ই হোক। তবে একালে অশিক্ষিত কবি হওয়ার বিপদ খুবই বেশি, বাঙলায় তা এখন বেশ চোখে পড়ে। অশিক্ষিত হওয়ার একটি সুবিধা হচ্ছে তাতে প্ৰলাপ বিকা বা মাতলামো বা ফাজলামো করা যায় দ্বিধাহীনভাবে, এবং তাকে কবিতা ব’লে মনে করতে লজ্জা তো লাগেই না, বরং তাতেই অশিক্ষিতারা গৌরব বোধ করে।

পশ্চিমের কয়েকজন আধুনিক কবি কবিতা সম্পর্কে কী বলেন, তা দেখতে পারি। কয়েকজনের কবিতা সম্পর্কে কথা এমন :

ডব্লিউ বি ইএটস

কবি সব সময় লেখেন তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে, জীবনের ট্র্যাজেডি থেকে জন্ম নিতে পারে তার উৎকৃষ্টতম রচনা, তা যা-ই হোক, অনুশোচনা, ব্যর্থ প্রেম, বা নিতান্ত নিঃসঙ্গত; যেমন হয় প্রাতঃরাশ টেবিলে তেমন সরাসরি কারো সাথে তিনি কথা বলেন না, সব সময়ই থাকে এক অলীক ছায়ামূর্তিপরম্পরা। দান্তে ও মিল্টনের ছিলো পুরাণ, শেক্সপিয়রের ছিলো ইংরেজি ইতিহাস বা প্রথাগত রোমান্সের চরিত্র; এমনকি যখন কবি বেশিরভাগই প্রতিভাত হন নিজে, যখন তিনি রেলি এবং ক্ষমতাবানদের দেন। মিথ্যা, অথবা শেলি ‘এমন স্নায়ু যার ওপর লতিয়ে চলে অননুভূত পার্থিব পীড়ন, অথবা বায়রন যখন আত্মা ক্ষয় করে বক্ষকে যেমন তলোয়ার ক্ষয় করে তার খাপকে, তিনি কখনোই সে-আকস্মিকতা ও অসামঞ্জস্যের সমষ্টি নন যা বসে প্রাতঃরাশের জন্যে; তিনি পুনর্জন্ম নিয়েছেন এমন এক ভাবরূপে, যা অভিপ্রেত, সম্পূর্ণ।
শৈলি প্রায় সবখানিই অসচেতন। আমি যা করতে চেয়েছি তা আমি জানি, আমি যা করেছি তাসমান্যই জানি।… আমি পরিকল্পনা নিই ছোটো ছোটো লিরিক বা কাব্যনাটক লেখার যাতে প্রতিটি উক্তি হবে সংক্ষিপ্ত ও সংহত, বোনা হবে নাট্যিক উদ্বেগো, এবং আমি তা করেছি। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের সাথে কেননা তখনকার তরুণ ইংরেজ কবিরা সংকটমুহূর্তে লিখছিলেন আবেগে, যদিও তাদের ধীর-অগ্রসর ধ্যান ফিরে আসতো অনতিবিলম্বে। তখন, এবং এ-ইংরেজি কবিতা আমার নেতৃত্বই মেনে নিয়েছে, আমি ইংরেজি কবি তার ভাষা, ও সংরক্ত স্বাভাবিক উক্তির ভাষাকে অভিন্ন ক’রে তোলার চেষ্টা করেছি। স্বগতভাস্কণের সময় যে-ভাষা সবচেয়ে স্বাভাবিকভাবে আসে। আমি তাতেই লেখার চেষ্টা করেছি, যেমন আমি প্রাত্যহিক জীবনে সারাদিন ক’রে থাকি. বছর বিশেক আগে আমি আবিষ্কার করি যে আমাকে খুঁজতে হবে, ওয়ার্ডসওঅৰ্থ যেমন মনে করেছিলেন, প্রাত্যহিক ব্যবহৃত শব্দ, তা নয়; আমাকে খুঁজতে হবে একটি শক্তিশালী ও সংরক্ত বাক্যসংগঠন, এবং যতি ও স্তবকের মধ্যে সম্পর্ণ অভিন্নতা। যেহেতু সংরক্ত বিষয়বস্তুর জন্যে আমার দরকার সংরক্ত বাক্যসংগঠন, তাই আমি নিজেকে বাধ্য করেছি। প্রথাগত ছন্দোরীতি গ্রহণ করতে যা বিকশিত হয়েছে ইংরেজি ভাষার সাথে। এজরা পাউন্ড, টার্নার, লরেন্স প্রশংসনীয় মুক্তছন্দ লিখেছেন, আমি পারি নি।

এজরা পাউন্ড

তাই হচ্ছে ‘চিত্রকল্প’ যা বিশেষ মুহুর্তে তুরিত উপস্থিত করে এক মনন ও আবেগগত গূঢ়েষা। আমি ‘গূঢ়েষ’ শব্দটি ব্যবহার করছি হার্ট প্রমুখ নতুনতর মনোবিজ্ঞানীদের পারিভাষিক অর্থে, যদিও প্রয়োগের সময় আমরা পুরোপুরি একমত নাও হতে পারি।
এমন ‘গূঢ়েষা’র উপস্থাপন তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি করে এক আকস্মিক মুক্তির অভিভাব; সময় সীমা ও স্থান সীমার সেই অভিভাব; সেই আকস্মিক বিকাশের অভিভাব, যার অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করি শ্রেষ্ঠতম শিল্পকলারাশির মুখোমুখি।
বহুখণ্ড রচনাবলির থেকে সারাজীবনে একটি চিত্রকল্প উপহার দেয়াও উত্তম।…
যারা নিজেরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লেখে নি তাদের সমালোচনায় কান দিয়ে না। গ্রিক কবি ও নাট্যকারীদের লেখা, ও ছন্দ বিশ্লেষের জন্যে গ্রিসীয়-রোমীয় ব্যাকরণবিদদের বানানো তত্ত্বের মধ্যে যে গড়ামিল রয়েছে তার কথা ভেবে দেখো।
এমন কোনো অনাবশ্যক শব্দ, বিশেষণ ব্যবহার কোরো না যা কোনো কিছু প্রকাশ করে না। ‘শান্তির অস্পষ্ট এলাকা’র মতো উক্তি ব্যবহার কোরো না। এটা চিত্ৰকল্পকে ভোতা ক’রে ফেলে। এটা মূর্ত বস্তুর সাথে মিশিয়ে দেয় বিমূর্তকে। লেখক যখন বুঝতে পারে না যে স্বাভাবিক বস্তুই সব সময় উপযুক্ত প্রতীক, তখনই হয় এর উৎপত্তি।
বিমূর্তকরণ থেকে বিরত থাকো। উৎকৃষ্ট গদ্যে যা বলা হয়ে গেছে নিম্নমানের পদ্যে তা আবার বোলো না। এটা কখনো মনে কোরো না যে উৎকৃষ্ট গদ্যের অবর্ণনীয় শিল্পকলাকে এড়িয়ে তোমার রচনাকে পংক্তির পরিমাপে কেটে তুমি প্রতারণা করতে পারবে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে।
আজ বিশেষজ্ঞ যাতে ক্লান্তি বোধ করে আগামীকাল জনগণ তাতে ক্লান্তি বোধ করবে। কখনো মনে কোরো না যে কাব্যকলা কোনোভাবেই সঙ্গীতকলার থেকে সহজ, বা ভেবো না যে একজন পিয়ানোশিক্ষক সাধারণত যতোটা সময় সঙ্গীতকলা চর্চায় ব্যয় করে অন্তত ততোটা প্ৰয়াস কাব্যকলা চর্চায় ব্যয় করার আগে তুমি কোনো বিশেষজ্ঞকে খুশি করতে পারবে। যতোটা পারো মহৎ শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হও, তবে তোমার ঋণ সরাসরি স্বীকার, বা গোপন করার মতো শোভনতা থাকা দরকার।
‘প্রভাবিত’ হওয়া বলতে তোমার প্রিয় এক বা একাধিক কবির রচনা থেকে বিশেষ ধরনের অলঙ্কারধর্মী শব্দাবলি ঝেঁটিয়ে নিয়ে আসাকে বোঝে না।
কোনো অলঙ্কারই ব্যবহার কোরো না বা ভালো অলঙ্কার ব্যবহার কোরো।

টি এস এলিঅট

ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের, একমাত্র রূপ যদি হয় আমাদের অব্যবহিত পূর্ব প্রজন্মের সাফল্যের কৌশলগুলো অন্ধ বা ভীরুভাবে অনুসরণ করা, তাহলে ‘ঐতিহ্য’কে সুস্পষ্টভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে। আমরা এমন অনেক সরল স্রোতকে বালুকায় হারিয়ে যেতে দেখেছি; আর অভিনবত্ব পুনরাবৃত্তির থেকে উৎকৃষ্ট। ঐতিহ্য আরো ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। এটা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায় না, এবং আপনি যদি এটা চান তবে আপনাকে তা অর্জন করতে হবে কঠোর শ্রমে। প্রথমত এর রয়েছে ইতিহাসবোধ, যা আমরা অপরিহার্য ব’লে গণ্য করতে পারি। তার জন্যে যিনি পচিশ বছর বয়স্ক হওয়ার পরও কবিতা লিখতে চান: এবং ইতিহাসবোধের অন্তর্ভুক্ত শুধু অতীতের অতীতত্ত্ব নয়, বরং তার উপস্থিতির বোধ; ইতিহাসবোধ কাউকে শুধু তার নিজের প্রজন্মকে অস্থিতে ধারণ ক’রে লিখতে বাধ্য করে না, বরং তার মধ্যে সৃষ্টি করে এমন অনুভূতি যে হোমার থেকে শুরু ক’রে সমগ্র ইউরোপের সাহিত্য এবং তার মধ্যে তার নিজের দেশের সাহিত্যের যেনো রয়েছে এক যুগপৎ অস্তিত্ব এবং তা সৃষ্টি করে এক যুগপৎ শৃঙ্খলা। এ-ইতিহাসবোধ, যা হচ্ছে শাশ্বতের বোধ ও সমকালের বোধ, এবং একইসাথে শাশ্বত ও সমকালের বোধ, লেখককে করে। এতিহ্যমণ্ডিত। একই সাথে এটাই লেখককে তীব্রভাবে সচেতন করে কালপ্রবাহে তার নিজের স্থান সম্পর্কে, তার সমকালীনতু সম্পর্কে।
কোনো কবির, কোনো শিল্পের শিল্পীরই, একলা সম্পূর্ণ অর্থ নেই। তার তাৎপৰ্য, তার মূল্যায়ন হচ্ছে মৃত কবি ও শিল্পীদের সাথে তার সম্পর্কের মূল্যায়ন। আপনি তাকে একলা মূল্যায়ন করতে পারেন না; প্রতিতুলনা ও তুলনার জন্যে তাকে মৃতদের মধ্যে বসাতে হবে। আমি একে শুধু এতিহাসিক সমালোচনা ব’লে মনে করি না, একে মনে করি নান্দনিক সমালোচনার একটি সূত্ৰ ব’লে।
যা ঘটে তা হচ্ছে শিল্পীর আপনি সত্তা ধারাবাহিকভাবে বিসর্জন, কেননা তিনি বিশেষ মুহুর্তে এমন জিনিশের প্রতি সমৰ্পিত যা অধিকতর মূল্যবান। শিল্পীর ক্রমাগ্রসারণ হচ্ছে ধারাবাহিক আত্মোৎসৰ্গীকরণ, ব্যক্তিসত্তার ধারাবাহিক নির্বাপণ।
এ-নৈর্ব্যক্তিকীকরণ প্রক্রিয়া ও তার সাথে ঐতিহ্যের সম্পর্কের ব্যাপারটি একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। এ-নৈর্ব্যক্তিকীকরণ প্রক্রিয়ায়ই বলা যেতে পারে, শিল্পকলা বিজ্ঞানের অবস্থার দিকে এগিয়ে চলে। আমি তাই, ইঙ্গিত পূর্ণ সাদৃশ্যরূপে, আমন্ত্রণ জানাই সে-ক্রিয়া বিবেচনা করার জন্যে যা ঘটে যখন এক টুকরো প্ল্যাটিনাম ঢুকিয়ে দেয়া হয় অম্লজান ও সালফার ডাইঅক্সাইডপূর্ণ আধারে।… সাদৃশ্যটি ছিলো বিক্রিয়াসংগঠকের। পূর্বোল্লিখিত গ্যাস দুটি যখন মেশানো হয়। প্ল্যাটিনাম সূত্রের উপস্থিতিতে, তখন সেটি উৎপাদন করে সালফিউরাস অ্যাসিড। শুধু প্ল্যাটিনামের উপস্থিতিতেই ঘটে এ-মিশ্রণী; তবে এ-নবগঠিত অ্যাসিডে প্ল্যাটিনামের কোনো চিহ্নও থাকে না, এবং প্ল্যাটিনাম টুকরোটি থাকে অস্পৃষ্ট : এটা থাকে নিস্ক্রিয়, নিরপেক্ষ, এবং অপরিবর্তিত। কবির মন প্ল্যাটিনামের টুকরো। এটা লোকটির নিজের অভিজ্ঞতার ওপর আংশিক বা একচেটি ক্রিয়া করতে পারে; তবে, শিল্পী যতো বিশুদ্ধ হবেন ততোই সম্পূর্ণভাবে তার ভেতর বিচ্ছিন্নতা ঘটবে সে-লোকটির যে ফলভোগ করে আর সে-মনের যে সৃষ্টি করে; ততোই বিশুদ্ধভাবে মন। পরিপাক ও পরিবর্তিত রূপ দেবে সংরাগকে, যা তার উপাদান।
তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ, যে-আবেগ জেগেছে তার জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনার ফলে, তার জন্যে কোনোভাবেই কবি উল্লেখযোগ্য বা আকর্ষণীয় নন। তার বিশেষ আবেগ হ’তে পারে সরল, বা আকাড়া, বা একঘেয়ে। তাঁর কবিতার আবেগ হবে অত্যন্ত জটিল বস্তু, তবে তাতে থাকবে না সে-সব মানুষের আবেগের জটিলতা যাদের জীবনে রয়েছে খুবই জটিল বা অস্বাভাবিক আবেগ। আসলে কবিতায় বান্তিকগ্ৰস্ততার এক ভ্ৰান্তি হচ্ছে যে তা নতুন মানবিক আবেগ প্রকাশের খোজে থাকে; এবং ভুল জায়গায় অভিনবত্ব খোজ ক’রে আবিষ্কার করে বিকৃতিকে। নতুন আবেগ খোজা কবির কাজ নয়, তার কােজ সাধারণ আবেগগুলো ব্যবহার করা, এবং তাকে কবিতায় পরিণত করতে গিয়ে এমন অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে যা আসলেই আবেগ নয়। যে-আবেগের অভিজ্ঞতা তার নেই, আর যে-আবেগ তার পরিচিত দু-ই তার কাজে লাগে। ফলত, আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে ‘আবেগের প্রশান্ত পুনশ্চয়ন’ একটি অযথাযথ সূত্র।
শিল্পকলার আবেগ নৈর্ব্যক্তিক।
কবিতায়, সাধারণ অর্থে, ‘অর্থ’-এর প্রধান ভূমিকা হচ্ছে (আবারও আমি বিশেষ ধরনের কবিতার কথাই বলছি, সব ধরনের নয়) পাঠকের একটি অভ্যাসকে তৃপ্ত করা, তার মনকে বিনোদিত ও শান্ত রাখা, যখন কবিতা তার ভেতরে কাজ ক’রে যায় : অনেকটা তেমনভাবে যেমন কাল্পনিক চোর গৃহ-কুকুরের জন্যে রাখে এক টুকরো চমৎকার মাংস।

ডব্লিউ এইচ আডেন

এটা বিস্ময়কর যে দু-লিঙ্গেরই অসংখ্য তরুণতরুণীকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে তারা জীবনে কী হ’তে চায়, তখন তারা আমি উকিল, সরাইখানাচালক, কৃষক হ’তে চাই’র মতো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন উত্তর যেমন দেয় না, তেমনি দেয় না। ‘আমি অভিযাত্রী, গাড়িদৌড়বিদ, ধর্মপ্রচারক, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ’তে চাই’র মতো রোম্যান্টিক উত্তরও। বিস্ময়করভাবে বিপুলসংখ্যক বলে ‘আমি লেখক হ’তে চাই, এবং লেখা বলতে তারা সৃষ্টিশীল লেখা বুঝিয়ে থাকে। এমনকি যদি তারা বলে ‘আমি সাংবাদিক হ’তে চাই, তখন তারা একথা বলে এ-মোহ থেকে যেনো এ-পেশায় থেকেও তারা সৃষ্টি করতে পারবে; যদি তাদের আসল বাসনা হয় টাকা করা, তবে তারা বেছে নেবে বিজ্ঞাপনের মতো অতিবৈতনিক উপসাহিত্যিক কাজ। এ-সম্ভাব্য লেখকদের বড়ো অংশেরই কোনো লক্ষণীয় সাহিত্যপ্রতিভা নেই। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার নয়; কোনো পেশার জন্যেই লক্ষণীয় প্রতিভা খুব সুলভ নয়। যা বিস্ময়কর, তা হচ্ছে কোনো পেশার জন্যেই লক্ষণীয় কোনো প্রতিভা ছাড়াও এতো বেশি সংখ্যক তরুণতরুণী লেখাকেই সমাধান ব’লে মনে করে। কেউ কেউ হয়তো আশা করবেন যে তাদের হয়তো চিকিৎসা বা প্রকৌশল বা অন্য কিছুর প্রতিভা রয়েছে, তবে আসলে তা ঠিক নয়। আমাদের যুগে, যদি কোনো তরুণ প্রতিভাহীন হয় তাহলেই সে মনে করে যে তার রয়েছে লেখার প্রতিভা।

কবিদের জন্যে আমার দিবাস্বপ্নের মহাবিদ্যালয়ের পাঠক্রম হবে নিম্নরূপ :

১) ইংরেজি ছাড়াও কমপক্ষে একটি ধ্রুপদী ভাষা, গ্রিক বা হিব্রু, এবং দুটি আধুনিক ভাষা শিখতে হবে।

২) এসব ভাষায় লেখা কবিতার হাজার হাজার পংক্তি কণ্ঠস্থ করতে হবে।

৩) পাঠাগারে সাহিত্য সমালোচনামূলক কোনো বই থাকবে না, এবং ছাত্রদের একমাত্র সমালোচনামূলক অনুশীলনী হবে প্যারোডি লেখা।

৪) সব ছাত্রকে ছন্দ, অলঙ্কার ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পাঠ নিতে হবে, এবং প্রতিটি ছাত্রকে গণিত, প্রাকৃতিক ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, খনিবিদ্যা, প্রত্নতত্ত্ব, পুরাণ, প্রার্থনাবিদ্যা, পাকপ্ৰণালি প্রভৃতি পাঠের মধ্য থেকে তিনটি পাঠ নিতে হবে।

৫) প্রতিটি ছাত্রকে একটি গৃহপালিত পশু পালতে হবে এবং একটি বাগান রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কবিকে শুধু কবি হিশেবে নিজেকে শিক্ষিত করলেই চলবে না; সে কীভাবে জীবিকা অর্জন করবে সে-কথাও তাকে ভাবতে হবে। উৎকৃষ্টতম হচ্ছে সে এমন একটি পেশা নেবে যাতে তাকে কোনোভাবেই শব্দ ব্যবহার করতে না হয়।

ডাইল্যান টমাস

শুরুতে আমি কবিতা লিখতে চেয়েছি, কেননা আমি শব্দের প্রেমে পড়েছিলাম। আমার জানা প্রথম কবিতা হচ্ছে ছেলেভোলানো ছড়া, এবং ওগুলো আমি নিজে পড়তে শেখার আগে আমি শুধু সেগুলোর শব্দগুলোকে ভালোবেসেছি, শুধু শব্দগুলোকে। সেগুলোর অর্থ কী, সেগুলো কিসের প্রতীক, তা ছিলো গৌণ ব্যাপার।…আমি যতোই পড়তে থাকি, তার সবটা অবশ্য পদ্য ছিলো না, শব্দের প্রকৃত জীবনের প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়তে থাকে, এক সময় আমি বুঝতে পারি। আমাকে সব সময় থাকতে হবে তাদের নিয়ে ও তাদের মধ্যে। আমি জানতাম আমি হবো শব্দের লেখক, আর কিছু নয়। আমার কাছে প্রথম ব্যাপার ছিলো তাদের ধ্বনি ও অর্থ অনুভব করা ও জানা; ওই শব্দ দিয়ে আমি কী করতে যাচ্ছি, কী কাজে তাদের আমি লাগাতে যাচ্ছি, তাদের দিয়ে আমি কী বলতে যাচ্ছি, তা ছিলো পরের ব্যাপার।

 

একদিন যারা কবি হবে, তারা যে-কবিতার স্বাদ প্রথম পায়, তা চিরজীবী দাগ কাটে তাদের মনে; যেমন ডাইল্যান টমাসের মনে ও কবিতায় সব সময়ই ছিলো ছেলেভোলানো ছড়ার দাগ। পড়তে শেখার পর তারা পাঠ্যপুস্তকে প্রথম পরিচিত হয় এমন কবিতার সাথে, যার শিরোনামের নিচে বা ওপরে থাকে কবির নাম। পাঠ্যপুস্তক তাদের কবিতার সাথে ঘনিষ্ঠ ক’রে তোলে, সৃষ্টি করতে থাকে বুকের ভেতরে নতুন ধরনের আবেগ, স্বপ্ন দেখাতে থাকে, যে-স্বপ্ন দেখতে হয় জেগে জেগে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক রক্ষণশীল, তাতে চিরকালের ও সমকালের শ্রেষ্ঠ কবিতার উপস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়, খারাপ ও অকবিদের কবিতাই থাকে বেশি; এবং উচ্চতর শ্রেণীতে যাওয়ার পরও সমকালের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না পাঠ্যপুস্তকে। আমাদের অঞ্চলে পাঠ্যপুস্তক ধ’রে রাখে সরকারি রুচি, ও ওই সময়ের কিছু নিকৃষ্ট মানুষের কাব্যবোধ, যারা পদ্য বুঝলেও কখনো কবিতা দ্বারা আলোড়িত হয় না। এলিঅট যে বলেছিলেন উৎকৃষ্ট কবিতা বোঝার অনেক আগেই সংক্রামিত হয়, এটা সত্য নয় তাদের বেলা; তাই পাঠ্যপুস্তক সম্ভাব্য কবিদের উপকারে আসে না। কোনো বিশেষ সময়ে সে-ই সম্ভাব্য কবি, যে তার কবিতা লেখা শুরুর কালের আধিপত্যশীল কবিতাকে অস্বীকার করে, খোজে। নতুন কবিতা। শুরুতেই কেউ নতুন সিঁড়িতে পা রাখতে পারে না, প্রচলিত সিঁড়িতে পা রেখেই পা বাড়াতে হয়। অন্য ও নিজস্ব সিড়ির দিকে। কবিকে তৈরি করে নিতে হয় নিজের কাব্যতত্ত্ব। দশকে দশকে জন্ম নেয় না প্রধান কবি, মহৎ কবি জন্ম নেয়া অনেকটা শতাব্দীর ঘটনা। প্রধান কবি জন্ম নেয়া শুধু প্ৰতিভার নয়, কালেরও আনুকূল্যের ব্যাপার; কবিতার একটি আধিপত্যশীল ধারা যখন নিস্ফল হয়ে আসে, তখনই আসে নতুন ধারা ও প্রধান কবি বা কবিদের কাল।

কবিতার বয়স কয়েক হাজার বছর, তবে কবিতা সম্পর্কে আমরা আজো নিশ্চিত নই, হয়তো কখনোই নিশ্চিত হবো না। কবিতা সম্পর্কে নানা বাজে কথা চলে এখানে, চলে পৃথিবী জুড়েই, এগুলোর একটি হচ্ছে দর্শন; বলা হয় কবির থাকতে হবে নিজস্ব দর্শন, কবিতায় থাকতে হবে দর্শন। কবিকে কি হ’তে হবে দার্শনিক? দর্শনের কাছে কি আমরা দাবি করবো যে দর্শনে থাকতে হবে কবিতা, দার্শনিককে হ’তে হবে কবি? কবিতায় নানা চিন্তা থাকবে, আছে। শুরু থেকেই, চিন্তা কবিতায় কবিতা হয়ে আসবে, যেমন এলিঅট অতিশয়োক্তি করেছেন যে চিন্তা কবিতায় গোলাপের সুগন্ধের মতো আসবে; কিন্তু কবিতায় দর্শন থাকবে, এটা দর্শন ও কবিতা সম্পর্কে খুবই ভুল ধারণা। যারা এটায় বিশ্বাস করেন, তারা ভেতরে ভেতরে কবিতার প্রতিপক্ষ তারা কবিতা উপভোগ করেন না, কবিতাকে কবিতার জন্যে মূল্যবান মনে করেন না, এমনকি সন্দেহ পোষণ করেন। কবিতা সম্পর্কে কবিতার সৌন্দর্য তাদের তৃপ্তি দেয় না। তাই তারা মূল্যবান কিছু চান, তাদের কাছে মূল্যবান হচ্ছে ‘দর্শন’। কবিতা ও দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন জর্জ বোয়াস; তিনি খোলাখুলি বলেছেন কবিতায় যে-চিন্তা বা দর্শন মেলে। অধিকাংশ সময়ই তা অত্যন্ত পচা ও ভুল; ষোলো বছরের বেশি বয়স্ক কেউ কবিতায় কী বলা হচ্ছে তার জন্যে কবিতা পড়ে না। এলি আট বলেছেন দান্তে বা শেক্সপিয়র কেউই প্রকৃত অর্থে যাকে চিন্তা বলে, তেমন চিন্তা করেন নি। যেসব কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ দর্শন রয়েছে, রবীন্দ্রনাথের কবিতাই ধরা যাক, সেগুলো খুঁজলে কী পাই আমরা? সেগুলোতে পাই জীবন, মৃত্যু, জীবনের তাৎপৰ্য, সৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রভৃতি সম্পর্কে কতকগুলো খুবই তুচ্ছ পুরোনো কথা। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় দর্শন খুঁজলে কী পাই? তার ভালো কবিতাগুলোতে দর্শন পাই না, সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই এতো ভালো যে দর্শনের কোনো দরকার পড়ে না সেগুলোর, তার খারাপ কবিতাগুলোতেই পাই তথাকথিত দর্শন। কী পাই সেগুলোতে? পাই কতকগুলো পুরোনো প্রশ্ন আর পুরোনো উত্তর বা নিরুত্তরতা। রবীন্দ্রনাথেরই একটি কবিতা একটু বিচার করতে পারি, যেটি তাঁর ভাবুক ভক্তদের খুবই ভাবিত করে, গভীর দর্শন কবিতাটিতে লুকিয়ে আছে ভেবে তারা কবিতাটির মুখোমুখি ভয়ে ভয়ে দাঁড়ান। কবিতাটির নাম প্রথম দিনের সূর্য (শেষ লেখা), লিখেছিলেন মৃত্যুর তিন দিন আগে :

প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে–
কে তুমি?
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়–
কে তুমি?
পেল না উত্তর।।

কবিতাটির ‘প্রথম দিনের সূৰ্য’, ‘প্রশ্ন’, ‘সত্তার নূতন আবির্ভাব’, ‘কে তুমি’, ‘শেষ প্রশ্ন’, ‘মেলে নি উত্তর’, ‘পেল না উত্তর’ এগুলোকে বড়ো দার্শনিক জিজ্ঞাসা ব’লে মনে করেন ভাবুকেরা, এবং এগুলোর মধ্যে পরম উত্তরও লুকিয়ে আছে ভেবে তারা মুগ্ধ হন। কবিতাটি ভালো ক’রে পড়লে বুঝি এটি এক সুন্দর ধাঁধা:- ধাঁধার মতোই প্রথম বুঝতে একটু কষ্ট হয়, এবং ধাঁধার মতোই বুঝে ফেলার পর মনে হয় তুচ্ছ। ধাঁধার শুরু প্রথম দিনের সূর্য পদটিতেই। ‘প্রথম দিনের সূর্য পদটি শুরুতেই পাঠককে একটু চমকে দেয়, মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত সূর্যের জন্মের পর সূর্যের প্রথম দিনের কথা বলছেন, যে-সূর্য জন্মেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলো, ‘কে তুমি?’ এর ভেতরে অবশ্য সূর্যের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা লুকিয়ে আছে: মনে হয় মহজগতের সব কিছু ছিলো আগে থেকেই, হঠাৎ দার্শনিক সূর্য জন্ম নিয়ে নিজের সম্পর্কে তুললো এক দার্শনিক প্রশ্ন। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রথম দিনের সূর্য ব’লে কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের এক স্বভাব ছিলো পরিচিতের অপরিচিতীকরণ ও রহস্যীকরণ। ‘সত্তা’ শব্দটি সে-কাজই করছে: যদি তিনি স্পষ্ট ব’লে দিতেন এই সত্তা কোনো রহস্যমণ্ডিত বস্তু নয়, সত্তা বলতে তিনি নিজেকেই বোঝাচ্ছেন, ‘সত্তার শব্দের বদলে ব্যবহার করতেন যদি আমার সর্বনামটি, তাহলে ধাঁধা কেটে যেতো। কবিতাটির সারকথা হচ্ছে জন্মের মুহুর্তে সূর্য তাকে প্রশ্ন করেছিলো ‘কে তুমি’, আর মৃত্যুর আগেও সূর্য একই প্রশ্ন করছে তাকে, কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যায় নি। তিনি জানেন না। তিনি কে। কবিতাটি দর্শন নয়, একটি ছোট্ট ধাঁধা, এমন প্রশ্ন মানুষ সহস্রবার করেছে। কবিতাটি দর্শন নয়, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু দুঃখ হচ্ছে কবিতাও নয়। এটি এর থেকে অনেক ভালো কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’ বা তালগাছ’। তরুণ যৌবনে যেদিন তার প্রাণের ভেতরে পশেছিলো রবির কর, তখন উৎসারিত হয়েছিলো নিৰ্ব্বর, কবিতার ঝর্নধারা; কিন্তু মৃত্যুর আগের স্নান সূর্য জন্ম দিলো কবিতা নয়, ধাঁধা। দর্শন ও ছেলেমানুষের মধ্যে ব্যবধান লোপ পেয়ে যায়। কখনো কখনো, যার পরিচয় পাই শেষ সপ্তক-এর নবম কবিতাটির এ-স্তবকে :

এই অপরিণত অপ্রকাশিত আমি,
এ কার জন্যে, এ কিসের জন্যে।
যা নিয়ে এল। কত সূচনা, কত ব্যঞ্জনা,
বহু বেদনায় বাধা হতে চলল। যার ভাষা,
পৌঁছল না। যা বাণীতে,
তার ধ্বংস হবে অকস্মাৎ নিরর্থকতার অতলে,
সইবে না। সৃষ্টির এই ছেলেমানুষি।

এর কাতরতাটুকু দাগ কাটে, তাও খুব বেশি নয়; কিন্তু এর দর্শনটুকু সম্পূর্ণ ছেলেমানুষি। রবীন্দ্রনাথের দুর্মর সমস্যা তিনি বিশ্বাস করেন বিশ্বজগতের মহৎ উদ্দেশ্যে, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই। রবীন্দ্রনাথ ‘নিরর্থকতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কবিতাটিতে, যেটি আমি আগের দু-পরিচ্ছেদে বারবার ব্যবহার করেছি, বলেছি। সব কিছুই নিরর্থক, জীবনের কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু নিরর্থকতাকে মেনে নিয়েই দাঁড়াতে হবে নিরর্থকতার বিরুদ্ধে, ঝিনুকের ব্যাধিকেই রূপান্তরিত করতে হবে মুক্তোয়। ভাববাদী রবীন্দ্রনাথ ওই নিরর্থকতাকে মেনে নিতে পারেন নি, যেমন শিশু মেনে নিতে পারে না পিতামাতার মৃত্যু। ‘সইবে না সৃষ্টির এই ছেলেমানুষ’-এটা অসহায়ের শেষ হাহাকার-দর্শন নয়। আমরা তো তাকেই ব্যবহার করতে পারি। উদাহরণ হিশেবে:-রবীন্দ্রনাথ, যিনি মানবপ্রজাতির এক শ্রেষ্ঠরূপ, তিনি কেনো ম’রে যান, এবং তখনও পৃথিবীতে বেঁচে থাকে তুচ্ছ পতঙ্গ, পশু, বর্বর মানুষ? তখন কীভাবে সহ্য করা হয় সৃষ্টির ছেলেমানুষি? তার বিশ্বাস ছিলো মরুপথে যে-নদী ধারা হারায়, আর না ফুটতে ঝ’রে পড়ে যে-ফুল, তারাও হারায় না; কোনো মহৎ উদ্দেশ্যকে সফল ক’রে তোলে। বিশ্বাস বা দর্শন হিশেবে এটা পুরোপুরি ভুল বা হাস্যকর, যদিও তাঁর কবিতাটি অসাধারণ। দর্শন বাজে হয়েও কবিতা অসাধারণ হতে পারে, আর গুরুগম্ভীর দারুণ দর্শনসম্পন্ন হয়েও কবিতা হ’তে পারে শোচনীয়রূপে নিকৃষ্ট।

বাজে দৰ্শন কোনো দর্শন নয়, যদিও বাজে দার্শনিকতার অভাব নেই; কিন্তু খারাপ কবিতাও কবিতা-খারাপ কবিতা। দর্শনের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করা, নানা দুরূহ সমস্যা সমাধান করা: কবিতার লক্ষ্য তা নয়। দর্শনের লক্ষ্য একটি, কবিতার লক্ষ্য অনেক: দর্শনের লক্ষ্য বিরহস্যীকরণ, আর কবিতা ক’রে থাকে রহস্যীকরণ। দার্শনিক নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে দর্শন চর্চা করেন না: সাহিত্যে, কবিতায়, শিল্পীর আত্মপ্রকাশই বড়ো ব্যাপার। দর্শন কঠোরভাবে নৈর্ব্যক্তিক; কবি অধিকাংশ সময়ই ব্যক্তিক। কবিতা হচ্ছে শিল্পকলা, দর্শন তা নয়; কখনো কখনো কোনো কোনো দার্শনিক রচনা শিল্পকলা হয়ে উঠতে পারে, তবে দার্শনিক রচনার লক্ষ্য শিল্পকলা হওয়া নয়। কবিতার বড়ো কাজ আবেগ জাগানো, ইন্দ্ৰিয়গুলোকে স্বাদে গন্ধে ঘাণে ভ’রে তোলা, দর্শনের কাজ তা নয়; কবিতা যদি আমাদের কোনো ইন্দ্রিয়কে অভিভূত না করে, আবেগ না জাগায়, তাহলে তা কবিতাই হয়ে ওঠে না। শিল্পকলার, কবিতার, সাথে কামের রয়েছে একটি গভীর সম্পর্ক, কোনো কিছুই উ ৎকৃষ্ট শিল্পকলা হয়ে ওঠে না। যদি না তার ভেতরে বয়ে চলে কামের উজ্জ্বল ধারা। কবিরা নানা দর্শনে যুগে যুগে অনুরাগ বোধ করেছেন, প্রভাবিত হয়েছেন নানা দর্শন দিয়ে, কিন্তু কবিতায় তারা দর্শন প্রকাশ করেছেন খুবই কম। কবিতায় দর্শন থাকে ততোখানি যতোখানি থাকে চুম্বনে।

মনে পড়ছে কীটসকে, আমার প্রিয় কবিদের একজন, যিনি দর্শন থেকে দূরে ছিলেন, ভয় পেতেন দর্শনকে। মনে পড়ে তার প্রতিবাদ :

Do not all charms fly
At the mere touch of cold philosophy?…
Philosophy will clip an Angel’s Wings.

তিনি ভয় পেতেন দর্শনের নিরাবেগ যৌক্তিক শীতলতাকে-চিন্তা নয়, তাঁর প্রিয় ছিলো ইন্দ্ৰিয়ভারাতুরতা; তবে তার কোনো কোনো উক্তি, যেমন Beauty is truth, truth beauty, নিয়ে নির্বোধ ছদ্মন্দার্শনিক মাতামাতি প্রচুর হয়েছে। উক্তিটি শাশ্বত সত্য প্রকাশ করে না; এটি আকর্ষণীয় এর অভাবিত সুন্দর অতিশয়োক্তির জন্যে, শাশ্বত সত্যের জন্যে নয়, যদিও অনেকে এটিকে শাশ্বত সত্যের প্রকাশ মনে ক’রে সুখ পান। উক্তিটিতে সত্য নয়, পাচ্ছি। তীব্র আবেগে উৎসারিত অবিস্মরণীয় অতিশয়োক্তি, তাই এটি কবিতা; দর্শন কখনোই এমন সুন্দর ও স্মরণীয় নয়। সৌন্দর্য বা সুন্দর সত্য হ’তে পারে, সত্যও হতে পারে সুন্দর; কিন্তু সৌন্দর্য ও সত্যের সমীকরণ কোনো চরম সত্য প্রকাশ করে না। সৌন্দর্যমাত্ৰই সত্য নয়, যেমন সত্যমাত্রই সুন্দর নয়। অনেক সুন্দর হতে পারে শোচনীয় মিথ্যে, যেমন এ-উক্তিটিও সত্য নয়, যদিও সুন্দর; আবার অজস্র সত্য হ’তে পারে বিবমিষাজাগানো অসুন্দর। যারা এর দার্শনিকতায় বিহবল হন, তারা কবিতা উপভোগ করেন না, কবিতায় চান কবিতার বদলে অন্য কিছু।

কীটসকে নেন নি আমাদের রোম্যান্টিকেরা, নিয়েছেন এক আধুনিক: হয়তো জীবনানন্দ হয়ে উঠতেন না জীবনানন্দ যদি না কীটস কবিতা লিখে যেতেন তার একশো বছর আগে। উনিশ শতকের শেষ দশক থেকেই তিনি প্রিয় বাঙলার কবিদের; তাকে দেখা হতো এক গ্রিক দেবতারূপে, যার যন্ত্রণা ছিলো অনন্ত মৃত্যু যাকে গ্রহণ করেছিলো তরুণ বয়সে। তাকে বাঙালি সাধারণত স্মরণ করেছে সেই কবিরূপে, যিনি উচ্চারণ করেছিলেন দুটি অমর উক্তি : Beauty is truth, truth beauty, এবং A thing of beauty is a joy for ever। এ-উক্তি দুটি এক সময় বারবার উদ্ধৃত করতেন সমালোচকেরা, এবং অনেকে যারা হয়তো তাঁর কবি তা কখনো পড়ে নি। উক্তি দুটির মধ্যে প্রথমটিই বেশি প্রিয় ছিলো বাঙালির, কে নন। তারা এতে শুধু সৌন্দর্য পেতো না, সাথে সত্য ও পেতো, যে-সত্যের জন্যে অসত্যমগ্ন বাঙালির কাতরতার শেষ নেই। অর্থাৎ কবিতাটুকু নয়, এর দর্শনঃ কু বেশি প্রিয় ছিলো তাদের; সৌন্দর্যে তাদের চরিত্রহীন হওয়ার ভয় ছিলো, তাই বেশি। ক’রে আঁকড়ে ধ’রে থাকতে চাইতো তারা সত্যকে। রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যপি নাসার শেষ ছিলো না, তবে তারও ভয় ছিলো সৌন্দর্যকে, সত্য ছাড়া সৌন্দর্যকে তিনি বেশ? ভয় পেতেন, কে জানে কখন সৌন্দর্য আবার কোন রসাতলে ড়ুবোয়। সারাজী বনে পদ্যে ও গদ্যে সত্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি বহু কথা বলেছেন, কীটসের উন্ন রেকটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের ভেবে ব্যবহার করেছেন বহু বার; কিন্তু যখনই তিনি উদ্ধৃত করেছেন উক্তিটি, তখনই ভুল উদ্ধৃত করেছেন, বা নিজের বিশ্বাস অনুসারে সাজিয়েছেন শব্দগুলোকে। কীটসের Beauty is truth, truth beauty’-কে রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই উদ্ধৃত করেছেন Truth is beauty, beauty truth-রূপে। কেনো এমন করেছেন রবীন্দ্ৰনাথ? কীটসের কাছে সৌন্দর্য আগে রবীন্দ্রনাথের কাছে সত্য আগে কেনো? সৌন্দর্যকে প্রধান মনে করতে কি কোনো অপরাধবোধে ভুগতেন রবীন্দ্ৰনাথ?

আধুনিকদের আগে কীটসের সবচেয়ে বড়ো অনুরাগী ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নয়, মোহিতলাল মজুমদার-রক্ষণশীল কবি ও সমালোচক। তাঁর ‘পান্থ’ কবিতায় ‘সত্যেরে চাহি না। তবু সুন্দরের করি আরাধনা’ প’ড়ে বুঝি কতোটা আলোড়িত আর পীড়িত ছিলেন তিনি Beauty is truth. truth beauty দিয়ে। তিনি নিজের ছদ্মনামও রেখেছিলেন সত্যসুন্দর দাস, যখন আধুনিক সাহিত্যকে প্রবলভাবে রোখার তার সাধ হয়েছিলো। শুধু কবিতা নয়, কীটসের কাব্যতত্ত্বের তিনি ছিলেন অনুরাগী। তবে জীবনানন্দই একমাত্র বাঙালি কবি, যিনি কীটস থেকে নিয়েছিলেন সৃষ্টিশীলতার সাথে, লিখেছিলেন একরাশ ইন্দ্ৰিয়-ও প্রকৃতি- ও রূপ-ভারাতুর কবিতা। সব কবিতা নয়, জীবনানন্দ ঋণ নিয়েছিলেন দুটি কবিতা— ‘Ode to a Nightingale’ এবং ‘Ode to Autumn’ থেকে; তবে প্রথমটির প্রভাবই বেশি তাঁর ওপর। ‘মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো-প্রিয়ার মতন’, ‘মৃত্যুরে ডেকেছি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধরে’ এসেছে কীটসের ‘I have been half in love with easeful death./Call’d him soft names in many a mused rhyme’ থেকে। ‘শরীরের অবসাদ-হৃদয়ের জুর ভুলে যেতে’, ‘অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়’, ‘মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়/ সকালবেলার রৌদ্রে’, ‘অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা’ প্রভৃতি জন্মেছে কীটসের ‘The weariness. the fever, and the fret’. The murmurous haunt of flies on Summer eves’, ‘O, for a draught of Vintage that hath been/Cool’d a long age in the deep-delved earth’ প্রভৃতি থেকে। কীটসের ’emperor and clown’ থেকে জন্মেছে ‘আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড়—/যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড়’, ‘Dance, and Proveneal song, and sunburnt mirth’ থেকে জন্মেছে ‘হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে/কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে’। জীবনানন্দের হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে হয়তো অনুপ্রাণিত হয়েছিলো কীটসের ‘Much have I travell’d in the realms of gold,/ And many goodly States and kingdoms Seen’ দিয়ে। কীটস আছেন বাঙলা কবিতার অন্তরেও।

কীটসের ‘Ode to a Nightingale’-এর কোনো বাঙলা অনুবাদ আমি দেখি নি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এক সময় জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু রোম্যান্টিক ছিলেন না; বাছবিচার না ক’রে তিনি যান্ত্রিকভাবে অনুবাদ করেছিলেন বিশ্বের কবিতা, যেগুলো অনুবাদ হিশেবে ব্যৰ্থ। ওগুলোর নাম দিয়েছিলেন তিনি তীর্থ-সলিল। তাতে পাই কীটসের দুটি কবিতার অনুবাদ : ‘দুখ-শব্বরী মাঘে’ ও ‘নিষ্ঠুরা সুন্দরী’। প্রথমটি অনুবাদ ‘In drear-nighted December’-এর, এবং দ্বিতীয়টি La Belle Danie Sout Merci-র একটি ব্যালাডের অনুবাদ। দুটিই বেশ খারাপ অনুবাদ; এবং আমি দুঃখ পাই যে তিনি কীটসের কোনো ঔডের অনুবাদ করেন নি; এবং সুখী বোধ করি যে তিনি কীটসের কোনো ঔডের অনুবাদ করেন নি।

আঠারো বছর বয়সে, পাঠ্যকবিতা হিশেবে, প্রথম পড়েছিলাম ‘Ode to a Nightingale’, যিনি পড়িয়েছিলেন, পুরোপুরি নষ্ট ক’রে দিয়েছিলেন তিনি কবিতাটি, কিন্তু কবিতাটি আমার ভেতরে ভেঙে ভেঙে ঢুকেছিলো; আমি কিছু বুঝেছিলাম, অনেক বুঝি নি, কিন্তু এর সুর আর রূপ আমাকে মথিত করেছিলো, যেমন করে আজো। বহু বার কবিতাটি অনুবাদের কথা ভেবেছি আমি, কিন্তু এর রূপ ও আবেগ, এবং শব্দের গুঞ্জন অনুবাদ অসাধ্য মনে হয়েছে। বাঙলায় কিছুতেই ধরা পড়ে না ‘My heart aches, and a drowsy numbness pains/My sense’-এর যন্ত্রণা, বিবশতা, ও গুঞ্জন; ধরা পড়ে না ‘Fade far away, dissolve. and quite forget/What thou among the leaves hast never known/The weariness. the fever, and the fret’-এর করুণা বিষণ্ণ নঃশব্দ হাহাকার; অনুদিত হ’তে চায় না ‘The murmurous haunt of flies on summer eves’-এর ধ্বনিগুঞ্জনাময় রূপভারাতুরতা। ইংরেজিতে যা সরল গভীর সেই ‘I have been half in love with easeful death’, ও ‘Thou wast not born for death, immortal bird’-এর সরল গভীরতা টিকে থাকে না অনুবাদে। কবিতাটি পুরোপুরি কবিতা, এর কোনো দর্শন নেই। কবিতাটি অনুবাদের চেষ্টা করছি।

নাইটিংগেলের প্রতি
জন কীটস

আমার হৃদয় ব্যথা করছে, আর নিদ্ৰাতুর এক বিবশতা পীড়ন করছে
আমার ইন্দ্ৰিয়গুলোকে, যেনো আমি পান করেছি হেমলক,
কিংবা সেবন করেছি কোনো অসহ্য আফিম
এক মুহুর্ত আগে, আর ভুলে গেছি সব :
এমন নয় যে আমি ঈর্ষা করছি তোমার সুখকে,
বরং তোমার সুখে আমি অতিশয় সুখী,-
আর তুমি, লঘু-ডানা অরণ্যের পরী,
সবুজ বিচের মধ্যে
কোনো সুরমুখরিত স্থলে, আর অসংখ্য ছায়ার তলে,
সহজিয়া পূর্ণ কণ্ঠে গেয়ে যাচ্ছে গ্ৰীষ্মের সঙ্গীত।

আহা, এক ঢোক মদের জন্যে! গভীর মাটির তলে
বহুকাল ঢাকা থেকে যেই মন্দ হয়েছে শীতল,
দেহে যার পুষ্প আর গেয়ো সবুজের স্বাদ,
নাচ, আর প্রোভোসীয় গান, আর রোদে পোড়ার উল্লাস!
আহা, উষ্ণ দক্ষিণভরা একটি পেয়ালার জন্যে,
পরিপূর্ণ খাটি, রক্তাভ হিপ্পোক্রেনে,
এবং রক্তবর্ণরাঙা মুখ;
এবং তোমার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে বনের আধারে :

মিলিয়ে যেতুম দূরে, গলতাম, এবং যেতম ভুলে
যা তুমি পত্রপল্লবের মধ্যে কখনো জানো নি,
ক্লান্তি, জ্বর, এবং যন্ত্রণা
এখানে, যেখানে মানুষেরা বসে শোনে একে অন্যের আর্তনাদ;
যেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মাথায় কাপে গুটিকয়, বিষণ্ণ অবশিষ্ট শাদা চুল,
যেখানে বিবৰ্ণ হয় যুবকেরা, আর প্রেতের মতোন কৃশ হয়ে মারা যায়:
যেখানে ভাবতে গেলেই ভরে উঠতে হয় দুঃখে।
এবং সীসাভারী চোখের হতাশায়,
যেখানে সৌন্দর্য রক্ষা করতে পারে না তার দু্যুতিময় চোখ,
অথবা আজকের প্ৰেম ক্ষয় হয় আগামীকাল আসার আগেই।

দূরে! আরো দূরে! কেননা তোমার কাছে উড়ে যাবো। আমি,
তবে বাক্কাস ও তার চিতাদের রথে চ’ড়ে নয়,
যদিও অবোধ মগজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিবশ :
এর মাঝেই তোমার সঙ্গে আমি! সুকোমল এই রাত,
এবং দৈবাৎ চন্দ্ররানী উপবিষ্ট তার সিংহাসনে,
তাকে ঘিরে আছে তার সব তারার পরীরা;
কিন্তু এখানে কোনো আলো নেই,
শুধু সেইটুকু ছাড়া যেটুকু আকাশ থেকে বাতাসে উড়াল দিয়ে
শ্যামল আধার। আর শ্যাওলার আকাবাকা পথ বেয়ে এখানে এসেছে।

দেখতে পাচ্ছি না। আমি আমার পায়ের কাছে ফুটেছে কী ফুল,
বা কোন কোমল গন্ধ ঝুলে আছে শাখায় শাখায়,
তবে, সুবাসিত অন্ধকারে, অনুমান করি প্রত্যেক মধুকে
যা দিয়ে এই কুসুমের মাস ভরে দেয়
ঘাস, ঝোপ, আর বুনো ফলের গাছকে;
শুভ্ৰ হথর্ন, আর বন্যগোলাপ;
পাতার আড়ালে দ্রুত বিবৰ্ণ ভাইওলেটরাশি;
আর মধ্য-মের জ্যেষ্ঠ সন্তান,
শিশিরের মদে পূর্ণ আসন্ন কস্তুরিগোলাপ,
গ্ৰীষ্মের সন্ধ্যায় মৌমাছির গুঞ্জরণমুখর আবাস।


অন্ধকারতলে আমি শুনি; কেননা অজস্রবার
জড়িয়ে পড়েছি আমি সহজ মৃত্যুর আধোপ্রেমে
প্রিয় নাম ধ’রে তাকে কতোবার ডেকেছি। কবিতার পংক্তিতে,
আমার নিঃশব্দ নিশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে দেয়ার জন্যে;
যে-কোনো সময়ের থেকে এখন মৃত্যুকে মনে হচ্ছে বেশি বরণীয়,
ব্যথাহীন থেমে যাওয়া এই মধ্যরাতে,
যখন তোমার আত্মা ঢেলে দিচ্ছে তুমি
এরকম তুরীয় আবেগে!
তারপরও গেয়ে যাবে তুমি, এবং আমার কানে সাড়া জাগবে না–
তুমি গাইবে প্রার্থনাসঙ্গীত আমি মিশে যাবো। তখন মাটিতে।

মৃত্যুর জন্যে তোমার জন্ম হয় নি, মৃত্যুহীন পাখি!
কোনো ক্ষুধার্তা প্রজন্ম ধ্বংস করতে পারবে না তোমাকে;
যে-সুর শুনছি। আমি ক্ষয়িষ্ণু এ-রাতে সে-সুরই
সুপ্রাচীন কালে শুনেছিলো সম্রাট ও ভাড়েরা :
হয়তো এ-একই গান ঢুকেছিলো
রুথের বিষণ্ণ হৃদয়ে, যখন, স্বদেশকাতর,
অশ্রুভারাতুর সে দাঁড়িয়েছিলো বিদেশি জমিতে;
একই গানে বারবার
মুগ্ধ হয়েছে ভয়ঙ্কর সমুদ্রের ফেনপুঞ্জের দিকে খোলা
যাদুবাতায়ণ, পরিত্যক্ত পরীদের দেশে।

পরিত্যক্ত! এ-শব্দ ঘণ্টাধ্বনির মতো আমাকে জাগিয়ে
তোমার নিকট থেকে পৌঁছে দেয় নিজেরই কাছে।
বিদায়! কল্পনাও তার খ্যাতি অনুসারে
প্রতারণা করতে পারে না, প্ৰতারক পরী।
বিদায়! বিদায়! তোমার করুণ গান মিশে যাচ্ছে
পাহাড়ের ঢালে; এবং এখন মিশে গেছে
পার্শ্ববতী উপত্যকার উন্মুক্ত ভূমিতে :
এটা কি কল্পনা ছিলো, না কি ছিলো জাগ্ৰত স্বপ্ন?
পালিয়েছে সে-সঙ্গীত:-আমি কি জেগে আছি না কি নিদ্ৰিত?

Leave a Reply to Sankar Dutta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *