০৮. হলঘরে ঢুকেই আমরা থমকে দাঁড়ালাম

হলঘরে ঢুকেই আমরা থমকে দাঁড়ালাম।

সমগ্র হলঘরটি তখন আমন্ত্রিত অভ্যাগতের কলগুঞ্জনে মুখরিত। কিরীটী একজন পুলিস অফিসারকে ডেকে তখনি আদেশ দিল, এদের সকলকে এবার ছেড়ে দিন।

আদেশ উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্ৰ জনতা যেন বাঁধভাঙা জলস্রোতের মত উন্মুক্ত দ্বারপথের দিকে হুড়মুড় করে অগ্রসর হল। পনেরো মিনিটের মধ্যেই জনস্রোত মিলিয়ে গেল।

সিঁড়ির মুখে প্রকাণ্ড ওয়াল ক্লাকটা ঢং ঢেং করে রাত্ৰি বারোটা ঘোষণা করল। এখন হলঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি, কিরীটী, ডাক্তার চট্টরাজ, থানার পুলিস অফিসাররা, কুমারসাহেব, পুলিস সার্জেণ্ট, খানসামা ও বেয়ারা-বাবুর্চির দল।

পুলিস সার্জেণ্টই প্রথম ঘরের স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, বললেন, চলুন মিঃ রায়, মৃতদেহটা আগে দেখে আসি।

সকলে আবার এসে কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে প্রবেশ করলাম। জমাট বাঁধা রক্তস্রোতের মধ্যে একই ভাবে বীভৎস মুণ্ডহীন মৃতদেহটা তখনও পড়ে আছে। এবং পাশেই মুণ্ডুটা।।

পুলিস সার্জেণ্ট মোটামুটি সব শুনে ও মৃতদেহ পরীক্ষা করে সঙ্গে একজন কর্মচারীকে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাবার আদেশ দিলেন।

পুলিস সার্জেণ্ট বললেন, এবার মিঃ রায়, আমাকে ব্যাপারটা একটু বলুন তো?

কিরীটী তখন পুলিস সার্জেণ্টকে মোটামুটি সব ব্যাপারটাই সংক্ষেপে আবার বললে তীর জ্ঞাতার্থে।

তারপর আমার দিকে ফিরে বললে, সুব্রত, তুমি তেতলায় গিয়ে ঠিক এই ঘরের ওপরের ঘরটা একবার ভাল করে দেখে এস তো দেখি। আর হরিচরণ, তুমি এর নীচের ঘরটা পরীক্ষা করে এস। হ্যাঁ, দেখ সুব্রত, তুমি এই ঘরের ঠিক ওপরের তলার ঘরে গিয়ে ঘরের মেঝেতে কোন কিছু দিয়ে ঠুকে শব্দ করবে, তা হলেই এই ঘরে দাঁড়িয়ে সে শব্দ আমরা শুনতে পাব। আর তুমি নিজেও ঘরের মেঝেতে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করবে। আমাদের কথাবার্তা শুনতে পাও কিনা। ঘরের দেওয়ালে ঘা দিয়ে দেখবে কোথাও ফাঁপা-টাপা কিছু টের পাও কিনা। হরিচরণ, তুমিও ঐ একই ভাবে নীচের ঘরটা পরীক্ষা করে দেখবে! আমি ততক্ষণ এই ঘরটা আবার একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে সন্দেহ ভেঙে দিই। সবার। যিনি যাই বলুন, আমার নিশ্চিত ধারণা, ওঘরের মধ্যে কোথাও কোন গুপ্তদ্বার নেই। শুধুই নিম্ফল, চেষ্টা এ, তবু আর একবার দেখব। প্রত্যেকটি ঘটনা যদি ভাল করে বিচার করা যায়। তবে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, কোন বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তির দ্বারা এভাবে খুন করা সম্ভবপর নয়।

ধীরে ধীরে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম।

কুমারসাহেবের আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। এ সংসারে। তিনতলার ঘরগুলো তাই খালিই পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে কোন দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় এলে তেতলায় থাকেন। তা সেও ক্কচিৎ কখনো।

তিনতলার হলঘরে ঢোকবার মাথায়ই সিঁড়ি। সিঁড়ির দরজাটা ভেজানো! দরজার হাতল ঘুরিয়ে ঠেলতেই নিঃশব্দে দরজার কপাট দুটো ফাক হয়ে গিয়ে খানিকটা জমাট বাঁধা অন্ধকার চোখকে যেন অন্ধ করে দিল মুহুর্তের জন্য।

হাতের টর্চ জ্বালিয়ে চারদিকে একবার চেয়ে দেখলাম। এ হলঘরখানিও অবিকল নীচের হলঘরেরই অনুরূপ।

নিঃশব্দে একাকী সেই অন্ধকার নির্জন হলঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। চারদিক হতে জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন অদৃশ্য হাতে আমাকে এসে বেষ্টন করে এধরছে, অনুভব করছি। অন্ধকারের হিমশীতল স্পর্শ। আশ-পাশে কোথাও এতটুকু গোলমাল বা শব্দ পর্যন্ত নেই। যেন যুগযুগান্তরের তন্দ্রাচ্ছন্নতা এইখানে এসে জমাট বেঁধে আছে অতলান্ত অন্ধকারের মধ্যে।

নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটুকু পর্যন্ত শোনা যায়।

এরপর কতকটা আন্দাজে ভর করে, যে ঘরটা ঠিক প্রাইভেট রুমের ওপরে হবে বলে মনে হল, সেই ঘরের দরজাটার হাতল ঘুরিয়ে খুলে ফেললাম। নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল।

ভরা শীতের আকাশের একটুকরো চোখে পড়ল। যেন একটুকরো স্বপ্ন। দূরদূরান্তের মায়ায় ঘেরা। নাগালের বাইরে।

সহসা একটা মৃদু নিশ্বাসের চাপা শব্দ আমার সজাগ কানে এসে যেন আঘাত দিল। দেহের সমগ্ৰ লোমকূপ পর্যন্ত যেন অভাবনীয় একটা পরিস্থিতির জন্য হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল।

হাতে ধরা টর্চন্টার বোতাম আবার টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের বুকে সেই টর্চের আলোয় যে অভাবনীয় দৃশ্য সহসা আমার চোখে পড়ল তার জন্য ক্ষণপূর্বেও এতটুকু আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সত্যিই চমকে উঠেছিলাম।

দেখলাম ঘরের এক কোণে একটা সোফায় মুখ নীচু করে নিঃশব্দে একটি অল্পবয়সী। যুবক বসে আছে।

আমার মত সেও বোধ হয় আমার অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে চমকে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে।

কে? কে আপনি? কী চান এ ঘরে? বলতে বলতে ভীত ত্ৰস্তভাবে যুবকটি উঠে দাঁড়াল।

ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে এ ঘরে আসিনি। তা ছাড়া আমি ভাবতেও পারিনি এই নির্জন অন্ধকার ঘরে এমনি করে ভূতের মত চুপটি করে কেউ বসে থাকতে পারে। সত্যিই আমি একান্ত লজ্জিত। দুঃখিত মিঃ…। আমি কেবল এ ঘরের মেঝেটা একবার পরীক্ষা করে দেখবার জন্য শুধু এসেছিলাম। মানে…

কিন্তু কে আপনি? হঠাৎ এ ঘরের মেঝোঁটাই বা আপনি দেখতে এসেছেন কেন?

বর্তমানে আমি একজন পুলিসের সহকারী। আমি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম।

পুলিস! পুলিসের সহকারী! কিন্তু এখানে কেন? সে কি মরে গেছে নাকি।

যুবকের অসংলগ্ন কথায় মুহূর্তে সমগ্র ইন্দ্ৰিয় আমার যেন সজাগ হয়ে উঠল। কোনমতে নিজেকে সংযত করে বললাম, কার কথা বলছেন? কে মরেছে?

কে আবার, কুমারসাহেবের সেক্রেটারী মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰ! একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে কতকটা থেমে থেমে যুবক কথাগুলো বললে।

হ্যাঁ, মারা গেছেন তিনি সত্যি! কিন্ত। আপনি যখন এতটা জানেনই, আপনাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা না করে সুস্থির হতে পারছি না যে!

আমি কথাটা বলতে বলতে আলোটা আবার নিভিয়ে দিলাম। ঘর পূর্বের মত অন্ধকারে জমাট বেঁধে উঠল। অন্ধকারে সোফার ওপর নড়েচড়ে বসবার খসখস আওয়াজ কানে এল.

কী জিজ্ঞাসা করবেন শুনি? কণ্ঠস্বরে পরিষ্কার অসহিষ্ণুতার আভাস যেন ঝরে পড়ল, কে আপনাদের খুন হয়েছে বা মারা গেছে সেই সম্পর্কেই আপনি আমাকে আবোলতাবোল কতকগুলো অবান্তর প্রশ্ন করবেন তো? কিন্তু কেন বলুন তো? আমাকে একা একা এই অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে দেখে নিশ্চয়ই আপনার মনে ঐ জঘন্য ইচ্ছা জেগেছে, না?

রাগ করবেন না। যদিও আপনি রাগলেও, আমার কথার জবাব আপনাকে দিতেই হবে।

দিতেই হবে কথার জবাব? কেন শুনি? জোর নাকি?

আপনাকে তো আগেই আমি বলেছি, আমি একজন পুলিসের লোক। কাজেই…।

যুবক যেন কি ভাবলে, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললে, বেশ, জবাব দেব। করুন, কি জিজ্ঞাসা করবার আছে আপনার! চটপট জিজ্ঞাসা করে ফেলুন। তারপর আবার একটু থেমে হঠাৎ বললে, আসুন না, চলুন। ঐ জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যাক; বলতে বলতে যুবক উঠে দাঁড়ায়। একটা মৃদু অথচ মিষ্টি গন্ধ সহসা আমার ব্ৰাণেন্দ্রিয়কে যেন আলোড়িত করে তুলল। যুবক নিজেই এগিয়ে গিয়ে পথের ধারের জানলার কপাটটা খুলে দিল ধাক্কা দিয়ে।

মধ্যরাত্রির বর্ষণক্লান্ত শীতের আকাশ। অস্পষ্ট আলোছায়ার মধ্যে পাশ্বের দণ্ডায়মান যুবকের দিকে ফিরে তাকালাম। আধুনিক বেশভূষায় সজ্জিত! অত্যন্ত ফিটফট; বয়স বোধ করি বাইশ-তেইশের মধ্যে হবে।

যুবকটিই প্রথমে কথা বললে, অন্ধকার রাত্রে নির্জন ঘরে একা এক চুপ করে বসে থাকতে আমার বড় ভাল লাগে। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক পুলিসের লোকের মত লাগছে। না! পুলিস আবার এরকম ভদ্র ও সভ্য দেখতে হয় নাকি? সত্যি চমৎকার চেহারা আপনার, যেন ঠিক গ্ৰীক দেবতা অ্যাপোলোর প্রতিমূর্তি। বাঙালীদের মধ্যে এত সুন্দর চেহারা বড় একটা আমি দেখিনি। সত্যি বলুন তো কে আপনি কি আপনার সত্য পরিচয়?

বলেছি তো আমি পুলিসের লোক। কিন্তু এখন আমার চেহারার বর্ণনা স্থগিত রেখে আপনার কথাগুলো বলবেন কি? আপনি এখানে কেন বসেছিলেন এমনি করে ভূতের মত একা একা? নিশ্চয়ই কারও জন্যে বসে অপেক্ষা করছিলেন, না?

বলছি। কিন্তু সত্যি বলছেন মিঃ মিত্র মারা গেছেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, বললাম তো মারা গেছেন। মিথ্যে কথা আজ পর্যন্ত জীবনে একটাও বলিনি। মিথ্যাকে আমি আন্তরিক ঘূণা করি। এখন বলুন আপনার কথা।

আমিও জানি এবং টের পেয়েছি সে মারা গেছে। মৃদুস্বরে যুবকটি বললে।

কিন্তু তিনি যে মারা গেছেন, আপনি সেকথা জানলেন কি করে?

আমি যে অনুভব করছি সে মারা গেছে। হ্যাঁ, সমগ্র চেতনা দিয়ে অনুভব করছি সে মারা গেছে। আর তা না হলে–সি মারা না গেলে আমি পাগল হয়ে যাব। উঃ, কী ভালটাই তাকে একদিন আমি বেসেছি, নিজের ভাইয়ের মত অগাধ শ্রদ্ধা করেছি। যাক, সে মরেছে। অত বড় একজন ‘স্পোর্টসম্যান’ সে কিনা তার সব সম্মান প্রভুত্ব ছেড়ে দিয়ে শেষটায় কুমারসাহেবের মত একজন লোকের কাছে যেচে চাকরি নিল। কুমারসাহেব স্মাসকে দুচক্ষেও দেখতে পারেন না, অথচ তার কী একটা জরুরী কাজ নাকি আমার সঙ্গে আছে, তাই চুপে চুপে রাত্ৰি নটায় আমাকে এখানে আসতে বলেছিল। তাকে আমার বড় ভাল লাগত একদিন। অত চমৎকার আবৃত্তি করতে জীবনে আর কাউকে শুনিনি। বাংলা কবিতা কী চমৎকারই না আবৃত্তি করত, কিন্তু সেই সব আবৃত্তির মধ্যে সহসা যখন এক এক সময় এক একটা হিন্দি কবিতা থেকে আবার আবৃত্তি শুরু করত, শুধু তখনই আমার বিশ্ৰী লাগত। যাক সে কথা, আজ যখন সকালে আমাদের বাড়িতে সে এখানে আসবার জন্য আমাকে বলতে যায়, তার মুখের ওপরে যেন অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখেছিলাম–যেন মনে হচ্ছিল তার মুখের দিকে চেয়ে, সে বুঝি পাগল হয়ে উঠেছে। তার কথামত ঠিক রাত্ৰি নটা বাজবার কিছু আগেই এখানে এসে আমি তার অপেক্ষায় বসে আছি। এমন। সময় যেন মনে হল, আমারই ঠিক নীচের ঘরে কিসের একটা গোলমাল—

তারপর? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলাম।

তারপর-তারপর আমার ঠিক মনে নেই। এক সময় আস্তে আস্তে এই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। স্পষ্ট বুঝলাম, নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কে যেন অন্ধকারেই এই ঘরে এসে ঢুকেছে৷ একটা অজানিত ভয়ে সমস্ত শরীর আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। পদশব্দেই বুঝেছিলাম, আমি যার অপেক্ষায় এখানে বসে আছি। এ সেই শুভঙ্করদা নয়। অথচ ঘন অন্ধকারে বন্য পশুর মত আগন্তুক তখন ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। বরাবর আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই খপ করে সে আমার ডান হাতটা হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল; তারপর চাপাস্বরে উত্তেজিত ভাবে বললে, বন্ধু বৃথা এত রাত্রে এখানে এখনও বসে আছ। তোমার শুভঙ্করদার সঙ্গে আজ আর দেখা হবে না, কেননা তোমার সঙ্গে দেখা করবার চাইতেও তার ঢ়ের বড় কাজ কালো ভ্ৰমরে’র সঙ্গে আছে। তারপরই যেমন সে এসেছিল তেমনিই চলে গেল।

কী, কী বললেন? তীব্র উৎকণ্ঠায় যেন আমার কণ্ঠস্বর ভেঙে পড়ল।

হ্যাঁ, বললে কালো ভ্রমরের সঙ্গে কাজ আছে। চেনেন নাকি?

কালো ভ্রমর! কালো ভ্রমর! এ কি ভয়ানক আশ্চর্য! নিজের হাতে যার মৃতদেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম, সত্যই কি সে তাহলে সেদিন মরেনি? আমার মনের মধ্যে যেন ঝড় বইতে শুরু করল। পাঁচ-ছয় বছর আগেকার কতকগুলো ঘটনা ছায়াছবির মতই মানসপটে বার বার ভেসে উঠে মিলিয়ে যেতে লাগল পর পর।

তারপরই সে চলে গেল? আবার প্রশ্ন করলাম যুবকটিকে।

হ্যাঁ, আর দ্বিতীয় কথাটি সে বলেনি। এদিকে সে চলে যাবার পর মনে হল, যে হাতটা সে আমার চেপে ধরেছিল, সেটা যেন কেমন ভিজে-ভিজে লাগছে। ব্যাপার কী দেখবার জন্য পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালালাম। কিন্তু টর্চের আলোয় হাতের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আতঙ্কে মুহূর্তে যেন সর্ব-শরীর আমার ঝিম ঝিম করে উঠল। তাজা লাল রক্তে আমার হাতের কবজী ও জামার আস্তিনটা রাঙা টুকটুকে হয়ে গেছে। উঃ, মাথার মধ্যে এখনো আমার কেমন করছে!

বলতে বলতে সহসা মার সামনে তার হাত দুটো প্রসারিত করে বললে, এই দেখুন, এখনও সেই রক্তমাখা হাতের স্পর্শটুকু আমার জামার আস্তিনে সুস্পষ্ট ভাবেই বর্তমান।

আমি টর্চের আলো ফেলে দেখলাম, যুবকের দুধ-গরদের পাঞ্জাবির আস্তিনে রক্তের দাগ দারুণ বিভীষিকায় এখনো সুস্পষ্ট।

আচ্ছা, আপনি সেই লোকটিকে চিনতে পেরেছিলেন?

না, তাকে আমি জীবনে আর কোন দিনও দেখিনি। তাছাড়া ঘর অন্ধকার ছিল।

গলার স্বর আপনার কি পরিচিত বলে মনে হয়েছিল সেই লোকটার?

না, অমনি অস্বাভাবিক স্বর আমি জীবনেও শুনিনি। চাপা অথচ গমগম করছে, মনে ঐচ্ছিল যেন বহুদূর থেকে সমুদ্রের ক্রুদ্ধ অস্পষ্ট গর্জনের মত।

কাউকে সন্দেহও করেন না?

না, না, না। আপনাকে তো আমি বলেছি, তাকে আমি চিনি না!

এতক্ষণে আমি আমার গলার স্বর কোমল থেকে কঠিন করলাম, দৃঢ়ভাবে বললাম শুনুন, আপনার কোন ভয় নেই। আপনি যা জানেন সব কিছু কথা গোপন না করে আমাকে খুলে বলুন। আপনাকে কথা দিচ্ছি, কেউ আপনাকে আঘাত করতে পারবে না। আপনার সমস্ত বিপদে আমরা বুক পেতে দাঁড়াব। আপনার কোন ভয় নেই।

দয়া করুন। অনুগ্রহ করে আমায় যেতে দিন। রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল। এরপর মামার বাসায় গেলে যদি ঘূণাক্ষরেও তিনি জানতে পারেন যে আমি এতক্ষণ বাইরে ছিলাম, তবে জুতো মারতে মারতে আমাকে তঁর বাসা থেকে দূর করে দেবেন। চিরদিনের মত। আর তাছাড়া বর্তমানে কথা বলবার মত আমার দেহ ও মনের অবস্থা এতটুকুও নয়। এখন আমায় যেতে দিন। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আপনি যখনই ডাকবেন তখুনি আমি আপনার কাছে গিয়ে হাজির হব। আমার নাম অরুণ করা।. নং গ্রে স্ট্রীটে আমি থাকি। আমায় ছেড়ে দিন। আমি এখুনি পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাগান দিয়ে চলে যাব, কেউ দেখতে পাবে না, বাগানে আমার সাইকেল রয়েছে!

হ্যাঁ, আমি আপনাকে যেতে দিলেও পুলিস আপনাকে জেরা করতে ছাড়বে না, তারা আপনার জবানবন্দি নেবে। তবে ছাড়বে।

দুৰ্ভাগ্যক্রমে যখন এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিই, জবানবন্দি আমার পুলিসকে দিতে হবে বৈকি, আর না দিলেই বা শুনছে। কে? কিন্তু আজকে রাতের মত আমায় যেতে দিন।

বেশ, তাহলে আপনি এখন যেতে পারেন।

যুবক আমার নির্দেশ পাওয়া মাত্র নিঃশব্দে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

কতক্ষণ সেই অন্ধকার হলঘরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই, সহসা কার মৃদু স্পর্শে চমকে ফিরে চাইলাম, কে?

ভয় নেই, আমি কিরীটী। নীচে চল, রাত অনেক হয়েছে। দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম।

কিরীটী বললে, এই বুঝি তোমার কর্তব্যজ্ঞান সব্ৰত! যে কাজের জন্য তোমাকে পাঠালাম, তা একেবারে দেখতেও বেমালুম ভুলে গেলে? যাক গে, গুপ্তদ্বার যে নেই। ওঘরে সে বিষয়ে আমরা স্থিরনিশ্চিত হয়েছি। সেই ঘরটায় আপাততঃ তালা দিয়ে রাখা হয়েছে! কিন্তু যুবকটি কে?

কিরীটীর কথা শেষ হবার পূর্বেই বললাম, যুবকটিকে আমার এভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি, এই কথাই তো এখন তুমি বলবে কিরীটী?

কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু যাক, তুমি তার ঠিকানা তো রেখে দিয়েছ, সেই যথেষ্ট; যদিও ঠিকানা তার জানিবার তেমন দরকার ছিল না।

বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, তার মানে?

ছেলেটির এক সময় প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি ও নগদ টাকাকড়ি ছিল; এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দু-চারজনে যা নিয়েছে তা গিয়ে এখনও হয়তো যা ব্যাঙ্কে আছে অনেকেরই তা নেই। কিন্তু ছেলেটির এর মধ্যেই দশজনের কৃপায় জাহান্নামে গেছে। আমার চিন্তাশক্তির যদি গলদ না থাকে, তবে নিশ্চয়ই ছেলেটি আমাদের নবলব্ধ বন্ধুবর কালিদাস শর্মার বর্তমান মনিব্যাগ। অর্থাৎ ওরই ঘাড় ভেঙে বর্তমানে বেকার প্রফেসার বন্ধটির আমাদের খাওয়া থাকা ও বিলাস-ব্যসনের সমস্ত খরচ চলেছে।

অ্যা! বল কি?

তাই।

***

সে রাতের মত মার্বেল প্যালেস থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সকলে গাড়িতে এসে উঠে বসলাম।

রাত্রি শেষ হতে বড় বেশী দেরি নেই। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বিরবির করে বইছে। বর্ষণক্লান্ত মেঘমুক্ত আকাশটা যেন তারার মৃদু আলোয় ঝকঝক করছে।