০৪. কুমারসাহেবের রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখ

কিরীটী কুমারসাহেবের রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখের দিকে চেয়ে বললে, এ সময় আপনি নিজে এত নার্ভাস হয়ে পড়লে তো চলবে না। কমুরসাহেব, বুকে সাহস আনুন।

আর সাহস! কুমারসাহেব ক্লান্ত অবসন্ন স্বরে বললেন, আমার হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, মিঃ রায়। একি সাংঘাতিক ব্যাপার বলুন তো! উৎসব বাড়ি

কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, সুব্রত তুমি বাইরে গিয়ে ডাঃ চট্টরাজকে সঙ্গে নিয়ে এ বাড়ি থেকে বাইরে যাবার সমস্ত দরজা এখুনি বন্ধ করে দাও। ওপরের কিংবা নীচের হলঘরের কেউ যেন এ ব্যাপারের একটুকুও না টের পায়। তারা গান-বাজনা স্ফূর্তি করছে তাই করুক।

আমি তখনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।

সমস্ত বন্দোবস্ত করে ফিরে আসছি, হলঘরে কুমারসাহেবের ম্যানেজার পঞ্চাননবাবুর সঙ্গে দেখা।

তিনিও আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এলেন। ম্যানেজারবাবু ঘরে ঢুকে প্রথমেই বেয়ারাটাকে ভাঙা কাচের টুকরোগুলো নিয়ে যেতে বললেন। এ ঘর থেকে ভয় পেয়ে ছুটে বাইরে যাবার সময় চাকরিটার হাত থেকে পড়ে ভেঙে ছড়িয়েছিল। চাকরিটা আদেশ পালন করে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা থেকে পুলিসের লোক এসে উপস্থিত হল। কিরীটী সংবাদ পেয়ে বাইরে গিয়ে তাঁদের যথোপযুক্ত নির্দেশ দিয়ে আবার ঘরে ফিরে এল। তারপর আবার চুপচাপ সকলে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

কিরীটী এতক্ষণ পরে একটু একটু করে মৃতদেহটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কাটা মুণ্ডুটার দিকে চেয়ে বুকটার মধ্যে যেন কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলাম। দেহের গর্দানের ঠিক কাছেই, মৃতদেহের বাঁ-হাতে একটা তীক্ষ তরবারি ধরা আছে। তলোয়ারটা দেখতে অনেকটা দেওয়ালে টাঙানো তরবারিগুলোর মতই। মনে হয় যেন দেওয়াল থেকেই একটা নেওয়া হয়েছে, কেননা দেওয়ালের গায়ে এক-একটি ঢালের দুদিকে আড়াআড়ি ভাবে দুটি করে তলোয়ার টাঙানো আছে। দেখলাম কেবল ঠিক টেবিলের সামনে উপিরভাগের দেওয়ালে ঢালের সঙ্গে মাত্র একটি তলোয়ার দেখা যাচ্ছে। মৃতদেহের হাতে ধরা তরবারিটাতে রক্ত মাখা।

উঃ, ভদ্রলোককে কসাইয়ের মত জবাই করা হয়েছে! কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, একেবারে পাশবিক হত্যা! দেখ দেখ সু, তরবারিটায় বোধ হয় খুব শীঘ্রই শান দেওয়া হয়েছিল। বলতে বলতে কিরীটি ঘরের একটিমাত্র জানালার দিকে এগিয়ে জানালাটিকে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে বাইরের দিকে ঝুকে দেখেশুনে বললে, প্রায় চল্লিশ ফিট নীচে ট্রাম রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে কারও লাফিয়ে নীচে যাওয়া বা প্রবেশ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কিরীটী কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে হাত দুটো ‘মুষ্টিবদ্ধ করে পায়চারি করতে লাগল, তারপর সহসা এক সময় কার্পেটের রক্ত এড়িয়ে মৃতদেহের কাছে হ্যাঁটু গেড়ে বসে ভাল করে কুঁকে কি যেন পরীক্ষা করতে লাগল। এমন সময় ওপাশের দরজাটা খুলে গেল। একটা লোকের মাথা দেখা গেল।

ম্যানেজারবাবু যেন কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিরীটী বাধা দিল, ও আমার লোক-হরিচরণ। কী খবর হরিচরণ? ঐ পথ দিয়ে কেউ বেরিয়েছে?

আজ্ঞে না।

বেশ। নজর রাখ।

মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

ঐ দরজা দিয়ে এ-ঘর থেকে। হলঘরে যাওয়া যায়, না ম্যানেজারবাবু?

আজ্ঞে হ্যাঁ। ম্যানেজারবাবু মৃদুস্বরে জবাব দিলেন। জানালায় একটা লাল রংয়ের সিস্কের পর্দা টাঙানো ছিল, হাওয়ায় সেটা পতপত করে শব্দ করছিল।

আসুন ডাক্তার, মাথাটা একটু পরীক্ষা করা যাক। বলতে বলতে কিরীটী চুলের গোছা ধরে কাটা মুণ্ডটা তুলে ধরল। তারপরে দুজনে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা পরীক্ষা করল। এটা এখানেই থাক। বলে আবার মুণ্ডুটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখল।

কুমারসাহেব একপাশে ভূতের মত নির্বক নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন; কিরীটী তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, দেখুন তো কুমারসাহেব, ঐ তরবারিখানা এই ঘরেরই একখানা কিনা?

কুমারসাহেব মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।

মজার ব্যাপার, কিরীটী বলতে লাগল, এইরকম ধারালো চকচকে তলোয়ারগুলো দিয়ে ঘর সাজিয়ে রেখেছেন—এইভাবে খুনের সাহায্য করতেই নাকি কুমারসাহেব?

জবাবটা দিলেন ম্যানেজারবাবু, আজ্ঞে, উনি একজন উঁচুদরের আর্টিস্ট। পিতামহ ও প্রপিতামহের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিটা উনি এমনি ভাবে সাজিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

চমৎকার যুক্তি, একেবারে অকাট্য! মৃদুস্বরে কিরীটী শুধু বললে, কিন্তু সে যাক গে, এই হতভাগ্য মৃত ব্যক্তিকে চেনেন। আপনি?

আজ্ঞে হ্যাঁ ইনি আমাদের কুমারসাহেবের নবনিযুক্ত সেক্রেটারি মিঃ শুভঙ্কর মিত্র। ম্যানেজারবাবু জবাব দিলেন।

আজ রাত্রে আপনি একে এই ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন?

আজ্ঞে না, সন্ধ্যার পরে ওঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল, তারপর আর হয়নি।

কোথায় দেখা হয়েছিল?

কাছাকাছি অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

ওঁর সঙ্গে আর কে কে ছিল?

প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা আর দীনতারণবাবু। দীনতারণবাবু তার একটু পরেই চলে যান।

বেশ, এবারে আপনি দয়া করে বাইরে গিয়ে প্রফেসার কালিদাস শর্মাকে একটু ডেকে আনুন। তিনি কিছু জানেন না, কোন কথা তাকে বলবেন না, শুধু বলবেন কুমারসাহেব একটিবার তাকে ডাকছেন।

ম্যানেজার ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।

তারপর ডক্তার, আপনার এ ব্যাপারটাকে কী মনে হয়? কিরীটী প্রশ্ন করল।

ডাঃ চট্টরাজ বললেন, দেখ রায়, এ ধরনের হত্যা করাটা এমন কিছু আশ্চর্য ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, হত্যাকারীর খুন করবার ইচ্ছা ছিল এবং ধারালো অস্ত্ৰ হাতের কাছে পেয়ে সেই ইচ্ছাই এই ভয়ঙ্কর হত্যায় পরিণত হয়েছে। কে বলতে পারে, হয়তো খুনীর মনে রক্ত দেখবার পিপাসা জেগেছিল! তারপরই এই খুন।

দয়া করে একটু ভেবে দেখুন ডাক্তার, যতদূর সব দেখেশুনে মনে হয়, এক্ষেত্রে খুনটা হঠাৎ একটা ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে হয়নি। খুব সাবধানের সঙ্গে এবং আগে থেকে ভেবেচিন্তেই এই খুন করা হয়েছে। চেয়ে দেখুন, মৃতদেহের positionটা দেখেও কি আপনার মনে কোন কিছুই আসছে না?

মৃত্যুদেহ দেখে এইটুকু কেবল বোঝা যায়, খুনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির মধ্যে পরস্পরের কোন রকম হাতাহাতি বা ঝটাপটি হয়নি!

নিশ্চয়ই না, মৃতদেহের position থেকে স্পষ্টই মনে হয়। পিছন থেকে আচমকা কেউ ওঁকে ধারালো অস্ত্ৰ দিয়ে আঘাত করেছে, যে সময় হয়তো বেচারী কোন কারণে টেবিলটার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু করতে যাচ্ছিল। তাছাড়া এক্ষেত্রে আর একটা জিনিস বিশেষ করে লক্ষ্য করবার আছে। টেবিলের ঠিক ওপরে দেওয়ালে ঝুলানো যে ঢাল-তলোয়ার আছে, মেঝে থেকে ওর উচ্চতা প্রায় আট-ন ফিট হবে এবং একথা যদি ধরে নেওয়াই হয় মৃতদেহের হাতে ধরা ঐ ধারালো তলোয়ারটা সামনের ঐ দেওয়ালে টাঙানো ঢালের অন্য পাশ থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই টেবিলের ওপরে উঠে দাঁড়াতে হয়েছিল দেওয়ালে টাঙানো তলোয়ারটা হত্যাকারীকে নামাতে, কেননা অতখানি লম্বা কোন মানুষ হতে পারে না। শুধু তলোয়ারটা নামাতেই নয়, সেই তলোয়ার দিয়ে মিঃ মিত্ৰকে খুন করতে হলে মিঃ মিত্রকে নিশ্চয়ই সুবোধ শিশুটির মত গলাটা বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। আর তা যদি না হয়ে থাকে, অর্থাৎ মিঃ মিত্রের অজান্তেই যদি তাঁকে খুন করা হয়ে থাকে, তবে বলতে হয় মিঃ মিত্র অন্ধ ও কালা, চোখেও তিনি কোন কিছু দেখতে পাননি, কানেও কোন শব্দ শুনতে পাননি। কিন্তু কুমারসাহেবের মত একজন ধনী গণ্যমান্য লোকের প্রাইভেট সেক্রেটারী যে কালা ছিলেন এ কথাই বা বলা যায় কী করে? বলতে বলতে কিরীটী সহসা কুমারসাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কী কুমারসাহেব, আপনিই বলুন না, আপনার সেক্রেটারি কি সত্যিসত্যিই অন্ধ আর কালা ছিলেন নাকি?

না। মৃদুস্বরে কুমারসাহেব জবাব দিলেন।

যাই হোক, বেচারীর যে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে, এ একেবারে অবধারিত। ডাঃ চট্টরাজ বললেন।

আরো দেখুন, কিরীটী ডাঃ চট্টরাজকে আহ্বান করলেন, এই টেবিলের পাশের সোফাটার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখুন। সোফার ওপরে এই বড় বড় বালিশগুলো দেখেছেন? এগুলো তুলে ধরছি দেখুন—এগুলোর গায়ে এখনো একটা লম্বালম্বি সরু চাপের দাগ রয়েছে। একটু ভাল করে পরীক্ষা করলেই বুঝতে কষ্ট হবে না যে এর তলাতেই তলোয়ারটা লুকানো ছিল। খুনী আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রেখেছিল এবং মনে হয়। মিঃ মিত্র এ ঘরে ঢুকবার আগেই খুনী এখানে এসে অপেক্ষা করছিল। মনে হয় সে জানত মিঃ মিত্ৰ নিশ্চয়ই এ-ঘরে আসবেন। আর এমন লোক খুন করেছে যে মিঃ মিত্রের বেশ পরিচিত। তাহলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আপনার সন্দেহ অমূলক, স্যার দিগেন্দ্র মিঃ মিত্রের একেবারেই অপরিচিত, তা ছাড়া যে খুনী, তার এ-বাড়ীতে এবং কুমারসাহেবের এই প্রাইভেট রুমে বিশেষ রকম যাতায়াত আছে এবং সে এ ঘরে এলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না—এক কথায় খুনী কোন অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি নয়। জানাশোনার বা পরিচিতের মধ্যেই কেউ, যার পক্ষে অনায়াসেই, মিঃ মিত্র যখন কোন কারণে দেয়ালের এদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, সেই অবসরে বালিশের তলা থেকে লুকানো তলোয়ারটা টেনে বার করে মিঃ মিত্রের গলাটা এক কোপে দেহ থেকে আলাদা করে ফেলতে এতটুকুও বেগ পেতে হয়নি।

কিন্তু বন্ধু, তুমি একটা কথা ভুলে যােচ্ছ, ডাক্তার বললেন, মৃতদেহের position দেখে মনে হয় না কি যে মিঃ মিত্ৰ যেন কেপটা ঘাড়ে নেবার জন্যে ঝুঁকে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন?

হ্যাঁ, সেই তো হচ্ছে কথা, কিরীটী বলতে লাগল, এবং ঐ পয়েন্ট থেকেই ধরতে হবে খুনীকে। খুনী এখনও এই বাড়িতেই আছে। সে এখনো পর্যন্ত এ-বাড়ী ছেড়ে চলে যায় নি, যদি অন্ততঃ আমার সহকারীরা সজাগ থেকে থাকে।

হলঘরে যাবার ঐ দরজাটা খুলে যদি কেউ এ-ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে থাকে ইতিমধ্যেই? আমি প্রশ্ন করলাম।

অসম্ভব। হরিচরণ সাড়ে নটা থেকেই হলঘরে আছে, যদি কেউ গিয়ে থাকতই তার দৃষ্টিকে কোনমতেই ফাঁকি দিতে পারত না। জািন কটার সময় আন্দাজ মিঃ মিত্র এই ঘরে এসে ঢুকেছিলেন?

এবারে জবাব দিলাম। আমিই, হ্যাঁ, আমার মনে আছে, রাত্রি তখন ঠিক সাড়ে নটা হবে, কেননা তখন আমি আমার হাতঘড়িটায় সময় দেখেছিলাম। কিরীটী এবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাল, ঠিক রাত্রি দশটা এখন। ঠিক যে সময় খুন হয়েছিল, অপরাধী সেই সময়টা যে অন্য জায়গায় উপস্থিত ছিল, এ কথাটা প্রমাণ করবার জন্য যদি সব কিছু আগে থেকেই বন্দোবস্ত করে থেকে থাকে, তা হলেও সে এই ফাকি দিতে পারত না। কিরীটী একটা সিগার বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। একগাল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিম্নস্বরে বলতে লাগল, আশ্চর্য, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। যতটুকু বুঝতে পারছি, কোন স্থিরমস্তিক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই এই কাজ করেছে, কিন্তু মাথাটা দেহ থেকে পৃথক হয়ে মেঝের ঠিক মধ্যিখানেই বা এল কি করে? আর ঐভাবেই বা ঠিক ঘাড়ের ওপর বসে ছিল কি করে?

বাইরের হলঘর থেকে একটা মৃদু গানের সুরের রেশ তখনও ভেসে আসছিল। কিরীটী কুমারসাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ও-ঘরে যান কুমারসাহেব, অতিথিরা বেশীক্ষণ আপনাকে না দেখলে একটা গোলমালের সৃষ্টি হতে পারে।

আর গোলমাল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুমারসাহেব বললেন, আমার মানসন্ত্রম, ইজণ্ডত সব গেল মিঃ রায়; উঃ, কী দুৰ্দৈব!..ভগবান, এ কি করলে প্ৰভু!

এমন অধীর হলে তো চলবে না। কুমারসাহেব। ডাঃ চট্টরাজ বললেন।

উঃ, কাল সকালে আমি মুখ দেখাব কী করে? কী লজ্জা!..চাঁপা স্বরে বলতে বলতে কুমারসাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।