১০. চক্রবর্তী সাহেব

চক্রবর্তী সাহেব ছাড়া আর কে এসেছিল আজ রাণীমার কাছে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

বড়দাদাবাবু এসেছিলেন দুপুরে—খাওয়ার পর রাণীমা যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বড়দাদাবাবুর সঙ্গে রাণীমার কি কথা হচ্ছিল জানি না, তবে মনে হয়েছিল।রাণীমা বড়দাদাবাবুকে খুব বকাবিকি করছেন, দাদাবাবু একসময় ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

আর কেউ আসেনি?

ওই সময় জয়ন্ত চৌধুরী এসে ঘরে ঢুকল। মিস্টার চৌবেকে ফোন করে এলাম, তিনি এখুনি আসবেন বললেন।

কিরীটী সুরতিয়ার দিকে আবার তাকাল, আর কে এসেছিল?

মেজদাদাবাবু আর জয়ন্তদাদাবাবু।

আর কেউ আসেনি?

ঠিক করে মনে করে দেখ!

না-আর কেউ আসেনি।

দিদিমণি!

হ্যাঁ, দিদিমণি আসেননি?

না তো!

হুঁ, আচ্ছা, মণিদাদাবাবুর সঙ্গে রাণীমার কি কথা হয়েছিল, কিছু শুনেছিলে?

না। তবে–

কি?

একটা কথা কানে এসেছিল। রাণীমা চিৎকার করে মেজদাদাবাবুকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছিলেন।

আর কেউ আসেনি রাণীমার সঙ্গে দেখা করতে, তোমার ঠিক মনে আছে?

কিরীটী আবার প্রশ্নটা করে।

ঠিক মনে আছে। তবে—

কি?

আসর থেকে রাণীমা ফেরবার পর আমি যখন গণেশকে ডেকে বাগানে যাচ্ছি, তখন সিঁড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছিল কে যেন ওপরে ম্যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে।

মনে হয়েছিল কেন, দেখনি?

দেখছি।

তবে?

পিছন থেকে দেখেছি। ঠিক চিনতে পারিনি। পুরুষ, না স্ত্রীলোক? পুরুষই —গায়ে একটা কালো রঙের ওভারকেট ছিল। আর—

আর?

লম্বা লম্বা পা ফেলে একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি টপকে টপকে যেন লোকটা ওপরে চলে গেল।

তুমি দেখলে না কেন, কে ওপরে যাচ্ছে?

না, দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম

কি-কি ভেবেছিলে? সুরতিয়া জয়ন্তর মুখের দিকে তাকাল, যেন ইতস্তত করছে একটু— কি, বল! কি ভেবেছিলে?

ভেবেছিলাম বুঝি জয়ন্তদাদাবাবুই ওপরে যাচ্ছেন! জয়ন্তবাবু! কিরীটীর মুখ থেকে কথাটা উচ্চারিত হয়। জয়ন্তও সবিস্ময়ে বলে ওঠে, আমি!

হ্যাঁ। আশ্চর্য! তা হঠাৎ তোমার মনে হল কেন যে সে আমিই? জয়ন্তই আবার প্রশ্ন করে সুরতিয়াকে।

আপনার ছাড়া তো কালো ওভারকেট এ বাড়িতে কারো নেই! তাই মনে হয়েছিল।

কিরীটী এবার জয়ন্তর মুখের দিকে তাকাল। জিজ্ঞাসা করল, আপনার কালো রঙের ওভারকেট আছে নাকি সত্যিই মিস্টার চৌধুরী?

হ্যাঁ। গ্রেট কোট আমি একটা বড় ব্যবহার করি না, তবে এখানে এ সময় খুব শীত বলে কোটটা সঙ্গে এনেছিলাম। কিন্তু একদিনও এসে পর্যন্ত ব্যবহার করিনি—হুকে দেওয়ালে ঝোলানোই রয়েছে।

হুঁ। কি যেন এক মুহুর্তে ভাবল কিরীটী তারপর জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললে, যান, দেখে আসুন তো কোটটা আছে কিনা?

এখুনি দেখে আসছি।

জয়ন্ত দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সুরতিয়া!

বাবুজী!

য়ন্তবাবুর সঙ্গে তোমাদের রাণীমার কি কথা হয়েছিল, জান?

শুনিনি। তবে একটা কথা কানে এসেছিল।রাণীমার।

কি কথা?

জয়ন্ত, আমি তোমাকেও এখন যেন বিশ্বাস করতে পারছি না!

বলেছিল ওই কথা রাণীমা?

হ্যাঁ আরো বলেছিল।রাণীমা, মনে হচ্ছে—এখন মনে হচ্ছে, তোমরা সবাই আমাকে মারতে পার। মারবার জন্য সবাই তোমরা আমাকে ওৎ পেতে বসে আছে।

জয়ন্তবাবু তার কি জবাব দিলেন?

জয়ন্তদাদাবাবু বললেন, তোমাকে দেখছি সত্যিসত্যিই মৃত্যু-বিভীষিকায় পেয়েছে বড়মা। তোমার মাথা সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গেল বলে আমার মনে হচ্ছে।

জয়ন্ত ওই সময় হস্তদন্ত হয়ে ফিরে এল, আশ্চর্য—strange—

কি হল?

কোটটা ঘরে নেই!

নেই?

না।

সারাদিন কোটটা ছিল। কিনা মনে আছে আপনার?

মনে আছে স্পষ্ট, দিনের বেলায় দেখেছি। তরে সন্ধ্যার পর বড়মার ঘর থেকে ফিরে এসে মনে পড়ছে না দেখেছি কিনা।

কিরীটী কেটটা সম্পর্কে আর কোন কৌতূহল প্রকাশ করে না বা কোন প্রশ্ন করে না। মনের মধ্যে তখন তার অন্য একটা চিন্তা ক্রমশ যেন একটা নির্দিষ্ট রূপ নেবার চেষ্টা করছে।

রাত সোয়া দশটা নাগাদ চিত্রাঙ্গদা দেবী গানের আসর থেকে উঠে ভেতরে চলে আসেন। তারপর চিত্রাঙ্গদা দেবী তাঁর খাস দাসী সুরতিয়াকে বলেন গণেশকে ডেকে দিতে। গণেশ সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় রাণীমার এই ঘরে যদি এসে থাকে, তাহলে সেটা দশটা কুড়ি-পঁচিশ খুব জোর হবে। চিত্রাঙ্গদা দেবী তখনো বেঁচে ছিলেন। কারণ গণেশ এসে এই ঘরে ঢুকবার পর তাকে চিত্রাঙ্গদা দেবী বলেন, জয়ন্তকে গানের আসর থেকে ডেকে আনবার জন্য। গণেশ বের হয়ে যায়। ধরা যাক সময় তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা মত হবে।

গণেশ প্রথমে জয়ন্তবাবুকে ডাকতে গানের আসরে যায়—সেখানে খোঁজ না পেয়ে ফিরে আসে আবার বাড়ির মধ্যে। জয়ন্ত চৌধুরীর ঘরে যায়, তাকে ডাকাডাকি করে তোলে— যেহেতু জয়ন্ত চৌধুরী তখন ঘুমোচ্ছিল।

জয়ন্ত চৌধুরী এসে মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যেই এই ঘরে ঢেকে এবং ঢুকে দেখতে পায়-চিত্রাঙ্গদা দেবী মৃত।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটা-ওই পনেরো মিনিট সময়ের মধ্যেই কোন একসময় হত্যাকারী এই ঘরে ঢুকে তার কাজ শেষ করে চলে গিয়েছে।

রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটা!

শেষের কথাটা কিরীটী মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করে কতকটা বুঝি স্বগতোক্তির মতই।

কিছু বলছেন মিস্টার রায়? জয়ন্ত চৌধুরী প্রশ্ন করে।

বলছি চিত্রাঙ্গদা দেবীকে সম্ভবত রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটার মধ্যে কোন এক সময় হত্যাকারী পিছন দিক থেকে অতর্কিতে ছোরার দ্বারা আঘাত করে সরে পড়েছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। অর্থাৎ সে সময় দোতলায় একমাত্র চিত্রাঙ্গদা দেবী তার ঘরে ও আপনি আপনার ঘরে ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তি ছিল না বাড়ির মধ্যে। কাজেই—

কি?

যদি অতর্কিতে আঘাত পেয়ে একটা চিৎকার করেও উঠে থাকেন সেই মুহূর্তে চিত্রাঙ্গদা দেবী, একমাত্র আপনি ছাড়া আর কারো কানে পৌঁছবার কথা নয়-কিন্তু আপনিও ঘুমিয়ে ছিলেন।

জয়ন্ত কোন জবাব দেয় না।

নিঃশব্দে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কিরীটী কি তাকে সন্দেহ করছে নাকি! কিরীটী আবার বলে, গণেশ গানের আসরে আপনাকে খুঁজে না পেয়ে যখন ওপরে এসেছে, তখন আততায়ী তার কাজ শেষ করে চলে গিয়েছে। গণেশ কি চিত্রাঙ্গদার এই ঘরে আর ঢোকেনি? হয়েতো ঢুকেছিল-চুকে এই দৃশ্য দেখে ভয়ে তাড়াতাড়ি আপনার কাছে ছুটে যায়।

কিন্তু গণেশ তো—

বলেনি সে ধরণের কোন কথা জানি। আমিও সেই রকমই যে কিছু ঘটেছে তা বলছি না। আমি বলছি, ওই রকমও কিছু হয়ে থাকতে পারে মাত্র।

বাইরে দালানে ওই সময় ঘড়িতে ঢং করে রাত সাড়ে বারোটা ঘোষণা করল।

গানের আসর। তখনো পুরোদমে চলেছে। মধ্যরাত্রির স্তব্ধতায় এতদূর থেকেও গানের লাইনগুলো যেন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

কিরীটীর মনে হয়, কি বিচিত্র পরিবেশ!

বাড়ির একাংশে যখন সঙ্গীতের সুধা ঝরে পড়ছে, অন্য অংশে তখন বাড়ির কর্ত্রী নিহত হয়ে রক্তস্রোতে ভাসছেন!

জীবন ও মৃত্যু!