০৯. কিরীটী ডাকল

গণেশ! কিরীটী ডাকল।

বাবুজী–

সব কথা আমাকে বল গণেশ, তোমাকে তোমার রাণীমা কেন জয়ন্তবাবুকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন এবং কখন?

গণেশ কঁদতে কাঁদতে ধরা গলায় যা বললে, তার সারার্থ হচ্ছে ঃ গানের আসর থেকে আধঘণ্টাটাক আগে রাণীমা উঠে আসেন। এসে সুরতিয়াকে দিয়ে গণেশকে ডেকে পাঠান নীচের থেকে। গণেশ এলে তাকে বলেন জয়ন্তকে ডেকে আনতে। গণেশ প্রথমে ভেবেছিল, জয়ন্ত দাদাবাবু বুঝি নীচে গান শুনছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে খোঁজ করে না পেয়ে তাঁর ঘরে এসে তাকে ডাকে।

তুমি এই ঘরে এসেছিলে?

হ্যাঁ, ঘরে ঢুকে দেখি,-গণেশ বলে, রাণীমা জানলার কাছে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন।

তারপর?

রাণীমা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলেন জয়ন্ত দাদাবাবুকে ডেকে দিতে।

সুরতিয়া কোথায়? তাকে দেখছি না কেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।

কেন, সে তো রাণীমার কাছেই ছিল!

কোথায় গেল সুরতিয়া-দেখ তো। ডেকে আনো তাকে।

তাহলে বোধ হয় নীচে গেছে গান শুনতে। রাণীমা ফিরে এলে তো সে নীচে যেত। গান শুনতে।

যাও, দেখ-তাকে ডেকে আনো জলসা থেকে।

গণেশ চলে গেল।

মৃদু কণ্ঠে জয়ন্ত বলে, শেষ পর্যন্ত বড়মার আশঙ্কটাই সত্যি হল।

কিরীটী জয়ন্তর কথায় কোন জবাব দেয় না। সে তখন আবার নীচু হয়ে মৃতদেহটা পরীক্ষা করছিল।

পিঠের বঁদিকে একটা গভীর ক্ষত। বোঝা যায় কোন ধারাল তীক্ষু অস্ত্র দ্বারা অতর্কিতে পিছল দিক থেকে আঘাত করা হয়েছে। মনে হয় ছোরা জাতীয় কোন ধারাল তীক্ষ অস্ত্ৰ।

মিস্টার রায়!

উঁ!

এখন কি করা যায় বলুন তো?

কিরীটী সে কথার জবাব না দিয়ে কতকটা যেন আপন মনেই বলে, মনে হচ্ছে অতর্কিতে পিছন দিক থেকে কেউ ছোরা জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করেছে—

আপনার তাই মনে হয়?

হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে আবার কিরীটী বলে, রাত তখন কত হবে? যদি এখন থেকে আধাঘন্টা আগে গানের আসর থেকে চিত্রাঙ্গদা দেবী উঠে এসে থাকেন, তাহলে রাত সোয়া দশটা মত হবে।–

কিরীটী কথাগুলো কতকটা যেন আপন মনেই উচ্চারণ করে কি যেন চিন্তা করতে থাকে।

মিস্টার চৌধুরী?

বলুন।

কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল জয়ন্ত।

আজ। আপনার সঙ্গে শেষবার কখন ওঁর দেখা হয়েছিল?

সন্ধ্যার সময়।

আন্দাজ কটা হবে তখন?

বোধ হয় ছটা—আমাকে ডেকে পাঠান সুরতিয়াকে দিয়ে।

তারপর? ঘরে ঢুকে দেখি বড়মা যেন অত্যন্ত উত্তেজিত-বিচলিত—

কেন?

তা তো জানিনা, তবে আমাকে বললেন, মণিদা-মানে মেজ জেঠামশাইয়ের মেজ ছেলেকে তিনি এক কপর্দকও দেবেন না ঠিক করেছেন এবং তাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে। যেতে বলেছেন।

কেন?

তা জানি না। আরো বললেন, আমি যেন আপনাকে বলে দিই তার ওপর একটু নজর রাখতে

আর কিছু?

না। এ কথাটা বলার জন্যই বোধ হয় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

কিন্তু গতকাল তো আপনি বলছিলেন, ওই মণীন্দ্রবাবুকেই চিত্রাঙ্গদা দেবী চার ভাইয়ের মধ্যে একটু বেশী পছন্দ করতেন ও স্নেহ করতেন!

আমার ধারণা তো তাই ছিল। হঠাৎ যে কেন মণিদার ওপর চটে গেলেন জানি না।

ঘরে সেই সময় আর কেউ ছিল?

সুরতিয়া ছাড়া আর কেউ ছিল না।

ওই সময় কে যেন মনে হল দরজাপথে উঁকি দিয়েই সরে গেল। কিরীটী চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, কে—কে ওখানে?

কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না, শোনা গেল একটা দ্রুতপায়ের শব্দ। কিরীটী ক্ষিপ্ৰপদে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় পড়ে।

কে যেন সিঁড়ির দিকে দ্রুত চলে যাচ্ছে।

এ কি সুধন্যবাবু!

ছেড়ে দিন-ছেড়ে দিন আমাকে। সুধন্য কিরীটীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না।

দাঁড়ান। আসুন আমার সঙ্গে ঘরে।

ঘরে?

হ্যাঁ-চিত্রাঙ্গদা দেবীর শোবার ঘরে।

জয়ন্ত চৌধুরীও ততক্ষণে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল বারান্দায়।

কি ব্যাপার! কে ও-এ। কি, সুধন্য না?

হ্যাঁ। চলুন-ঘরে চলুন।

না না, ও-ঘরে আমি যাব না। ছেড়ে দিন-ছেড়ে দিন আমাকে।

চলুন।

কিরীটী একপ্রকার জোর করেই টানতে টানতে যেন সুধন্যকে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল। এবং সুধন্য ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর রক্তস্রোতের মধ্যে শায়িত চিত্রাঙ্গদা দেবীর মৃতদেহটা দেখে আস্ফুট। চিৎকার করে ওঠে।

কিরীটীর হাত থেকে মোচড় দিয়ে নিজেকে ছাড়াবার আবার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ श्श।

ছেড়ে দিন—ছেড়ে দিন আমাকে—যেতে দিন।

আর ঠিক সেই মুহুর্তে গণেশের সঙ্গে সুরতিয়া এসে ঘরে পা দিল। সেও সঙ্গে সঙ্গে চিত্রাঙ্গদা দেবীর রক্তাঞ্ছত মৃতদেহটা দেখে অস্ফুষ্ট ভয়ার্ত কণ্ঠে একটা চিৎকার করে ওঠে।

সুধন্য তখনো নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে।

দাঁড়ান। পালাবার চেষ্টা করলে এখুনি আপনাকে পুলিসে খবর দিয়ে,ধরিয়ে দেব। কিরীটী কঠিন কণ্ঠে বলে।–

কেন, কেন—পুলিসে ধরিয়ে দেবেন কেন আমাকে? আমি তো খুন করিনি ওঁকে।

সুরতিয়া হঠাৎ ওই সময় বলে ওঠে, না না, ও খুন করেনি। ওকে ছেড়ে দিন আপনারা, ওকে ছেড়ে দিন।

কিরীটী ফিরে তোকাল সুরতিয়ার মুখের দিকে তার কণ্ঠস্বরে। সুরতিয়ার সমস্ত মুখটা যেন রক্তশূন্য-ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে আতঙ্কে।

কি করে তুমি জানলে যে ও খুন করেনি?

ও তো নীচে গান শুনছিল।

একটু আগে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

তারপরই সুধন্যর দিকে তাকিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করে, কেন একটু আগে ঘরে উঁকি দিচ্ছিলে?

আমি-আমি–

বল-কেন এসেছিলে?

আমি রাণীমার কাছে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।

এত রাত্রে কথা বলতে এসেছিলো! সত্যি বল, কেন এসেছিলে?

টাকা–

টাকা!

হ্যাঁ-টাকা চাইতে এসেছিলাম রাণীমার কাছে।

এত রাত্রে টাকা চাইতে এসেছিলে?

হ্যাঁ সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন, কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাব বলে টাকা চাইতে এসেছিলাম।

তাই যদি হবে তো, টাকা না চেয়ে ঘরের দরজা থেকে আমন করে উঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলে কেন?

ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সুধন্য মেঝেতে পড়ে থাকা চিত্রাঙ্গদা দেবীর রক্তাক্ত মৃতদেহটার দিকে তাকাল।

বল?

ভয় পেয়ে। আমি-আমি জানতাম না—

মিস্টার চৌধুরী! কিরীটী জয়ন্তর মুখের দিকে তাকাল।

বলুন।

এ বাড়িতে ফোন আছে তো?

হ্যাঁ-পাশের ঘরেই আছে।

যান, থানায় একটা ফোন করে দিন।

জয়ন্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

শোন সুধন্য, তুমি পাশের ঘরে গিয়ে বসে থাক, পালাবার চেষ্টা কোরো না।

আমাকে ছেড়ে দিন—সত্যি বলছি, আমি কিছু জানি না। স্যার।

যাও। যা বললাম পাশের ঘরে গিয়ে বসে থাক। পালাবার চেষ্টা করো না-কারণ পালিয়ে তুমি বাঁচতে পারবে না জেনো। তাহলে পুলিস তোমাকে ঠিক খুঁজে বের করে এনে একেবারে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেবে মনে রেখো।

ফাঁসি!

হ্যাঁ, মনে থাকে যেন! যাও, পাশের ঘরে গিয়ে বসে।–

সত্যিই ফাঁসি দেবে?

যদি পালাও বা পালাবার চেষ্টা কর।

সুধন্য আর কোন কথা বলে না, নিঃশব্দে পাশের ঘরে চলে যায়। দু-ঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে ধীরে ধীরে ভূপতিত দেহটার দিকে তাকাতে তাকাতে।

কিরীটী এবার ফিরে তাকাল সুরতিয়ার দিকে, সুরতিয়া!

বাবুজী!

তুমিই তো বরাবর রাণীমার খাস দাসী ছিলে?

জী।

সব সময় তার কাছে কাছেই থাকতে?

তবে আজ থাকিনি কেন?

রাণীমা বলল, গণেশকে ডেকে দিয়ে নীচে গিয়ে গান শুনতে। তাই গণেশকে ডেকে দিয়ে গান শুনতে গিয়েছিলাম।

তার আগে পর্যন্ত তো তুমি রাণীমার কাছো-কাছেই ছিলে?

জী।

আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কে কে রাণীমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল মনে করে বলতে পার?

কোন পারব না!

বল কে কে এসেছিল?

সকাল নটায় প্রথম আসেন। এখানকার অফিসের ম্যানেজারবাবু-চক্রবর্তী সাহেব।

কে, অনিন্দ্য চক্রবর্তী?

নাম তো জানি না। তাঁর—সবাই বলে তাকে চক্রবর্তী সাহেব-আমিও তাই বলি।

তারপর কতক্ষণ ছিলেন চক্রবর্তী সাহেব রাণীমার ঘরে?

তা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক।

অফিসের কাজে এসেছিলেন বোধ হয় চক্রবর্তী সাহেব?

না।

তবে?

তিনি আর চাকরি করবেন না, তাই বলতে এসেছিলেন।

তাতে রাণীমা কি বললেন?

তাদের সব কথাবার্তা তো শুনিনি। তবে একবার রাণীমাকে বলতে শুনেছিলাম, চাকরি ছেড়ে দিলেও দিদিমণির সঙ্গে তাঁর বিয়ের কোন আশা নেই।

তাতে চক্রবর্তী সাহেব কি জবাব দিলেন?

বলেছিলেন, বিয়ে তাদের হবেই-রাণীমার সাধ্য নেই তাদের বিয়ে আটকান

বলতে বলতে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।