২১. সর্বজয়া ঘাটে গিয়া

কথাটা সর্বজয়া ঘাটে গিয়া পাড়ার মেয়েদের মুখে শুনিল।

আজ কয়েকদিন হইতে নীরেনের সঙ্গে অন্নদা রায়ের, বিশেষ করিয়া তাঁহার ছেলে গোকুলের মনান্তর চলিতেছিল। কাল দুপুর বেলা নাকি খুব ঝগড়া ও চেঁচামেচি বাধে। ফলে কাল রাত্রেই নীরেন জিনিসপত্র লইয়া এখান হইতে চলিয়া গিয়াছে। অন্নদা রায়ের প্রতিবেশী যজ্ঞেশ্বর দীঘড়ীর স্বী হরিমতি বলিতেছিলেন–সত্যি মিথ্যে জানিনে, ক’দিন থেকে তো নানারকম কথা শুনতে পাচ্ছি-আমি বাপু বিশ্বোস করিনে, বেঁটে তেমন নয়। আবার নাকি শুনলাম নীরেন লুকিয়ে টাকা দিয়েছে, বৌ নাকি টাকা কোথায় পাঠিয়েছিল, নীরেনের হাতের লেখা রসিদ ফিরে এসে গোকুলের হাতে পড়েচে এই সব।—যাক বাপু, সে সব পরের কুচ্ছ শুনে কি হবে? নীরেন শুনলাম বলচে-আপনারা সকলে মিলে একজনের ওপর অত্যাচার কর্তে পারেন। তাতে দোষ হয় না?–আপনারা যা ভাবেন ভাবুন, বৌ-ঠাকরুন। একবার হুকুম করুন, আমি ওঁকে এই দণ্ডে আমার হারানো মায়ের মতো মাথায় করে নিয়ে যাবো।–তারপর আপনারা যা করবার করবেন। তারপর খুব হৈ চৈ খানিকক্ষণ হল-সন্দের আগেই সে গয়লাপাড়া থেকে একখানা গাড়ি ডেকে আনলে, জিনিসপত্তর নিয়ে চলে গেল।

সর্বজয়া কথাটা শুনিয়া বড় দমিয়া গেল। ইতিমধ্যে স্বামীকে দিয়া অন্নদা রায়কে নীচেরনের পিতার নিকট এ বিবাহ সম্বন্ধে পত্র লিখিতে অনুরোধ করিয়াছে। নীরেনকে আরও দুইবার বাড়িতে নিমন্ত্ৰণ করিয়াছিল–ছেলেটিকে তাহার অত্যন্ত পছন্দ হইয়াছে। হরিহর তাহাকে অনেকবার বুঝাইয়াছে, নীরেনের পিতা বড়লোক-তাহদের ঘরে তিনি কি আর পুত্রের বিবাহ দিবেন? সর্বজয়া কিন্তু আশা ছাড়ে নাই, তাহার মনের মধ্যে কোথায় যেন সাহস পাইয়াছে-এ বিবাহের যোগাযোগ যেন দুরাশা নয়, ইহা ঘটিবে। হরিহর মনে মনে বিশ্বাস না করিলেও স্ত্রীর অনুরোধে অন্নদা রায়কে কয়েকবার তাগিদ দিয়াছিল বটে। কিন্তু এখন যে বড় বিপদ ঘটিল!

ইতিমধ্যে একদিন পথে দুর্গার সঙ্গে গোকুলের বউয়ের দেখা হইল। সে চুপি চুপি দুৰ্গাকে অনেক কথা বলিল, নীরেন কোন চলিয়া গেল তাহারই ইতিহাস। বলিতে বলিতে তাহার চোখ ছাপাইয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল।

-এই রকম বঁটালাথি খেয়েই দিন যাবে-কেউ নেই দুগগা—তাই কি ভাইটা মানুষ? কোথাও যে দুদিন জুড়ুবো সে জায়গা নেই–

সহানুভূতিতে দুর্গার বুক ভরিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে খুড়িমার কলঙ্কের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও তাহার দুঃখে সাত্মনাসূচক নানা কথা অস্পষ্টভাবে তাহার মনের মধ্যে জোট পাকাইয়া উঠিল। সব কথা গুছাইয়া বলিতে না পারিয়া শুধু বলিল, ওই সখী ঠাকুরমা যা লোক! বলুক গে না, সে করবে: কি? কেঁদো না খুড়িমা লক্ষ্মীটি, আমি রোজ যাবো তোমার কাছে—

সর্বজয়া শুনিয়া আগ্রহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল—বৌমা কি বল্পে-টল্পে দুৰ্গা?…তা নীরেনের কথা কিছু হল নাকি?

দুৰ্গা লজ্জিত সুরে বলিল-তুমি কাল জিজ্ঞেস কোরো না ঘটে? আমি জানি নে—

অপু একবার জিজ্ঞাসা করিল,-খুড়িমার কাছে কি শূনলি, মাস্টার মশায় আর আসবেন না?

দুৰ্গা ধমক দিয়া কহিল—তা আমি কি জানি-যাঃ-

পড়ন্ত রোদে ছায়াভরা পথটি কেমন যেন মন-কেমন-করা-করা। সে তাহার ভাই-এর জন্য। এ-রকম তাহার হয়, কতবার হইয়াছে, বেশিক্ষণ ধরিয়া যদি সে বাড়ি না থাকে, কি ভাইকে না দেখে, ভাইয়ের রাশি রাশি কাল্পনিক দুঃখের কথা মনে হইয়া মনের মধ্যে কেমন করে।

তাহার আমন দুধে-আলতা রং-এর সোনার পুতুলের মতো ভাইটা ময়লা আধাছেড়া মতো একখানা কাপড় পরিয়া বাড়ির দরজার সামনে আপনমনে একা একা কড়ি চালিয়া বেগুন-বীচি খেলিতেছে। তাহার কাছে পয়সা চায় এটা-ওটা কিনিতে, সে দিতে পারে না-ভারি কষ্ট হয় মনে—

 

দিন কয়েক পরে। ভুবন মুখুজ্যের বাড়ি রানুর দিদির বিবাহ শেষ হইয়া গিয়াছে বটে। কিন্তু এখনও কুটুম্ব-কুটুম্বিনীরা সকলে যান নাই। ছেলেমেয়েও অনেক। একটি ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে দুর্গােব বেশ আলাপ হইয়াছে, তাহার নাম টুনি। তাহার বাপিও আসিয়াছিলেন। আজ দুপুরের পর স্ত্রী ও কন্যাকে কিছুদিনের জন্য এখানে রাখিয়া কর্মস্থানে গিয়াছেন। ঘণ্টা খানেক পরে, সেজ ঠাকরুন। এ ঘরে কি কাজ করিতেছিলেন, টুনির মায়ের গলা তাহার কানে গেল। সেজ ঠাকরুন দালানে আসিয়া বলিলেন–কি রে হাসি কি? টুনির মা উত্তেজিতভাবে ও ব্যস্তভাবে বিছানাপত্র, বালিশের তলা হাতড়াইতেছে, উঁকি মারিতেছে, তোশক উলটাইয়া ফেলিয়াছে; বলিল-এই একটু আগে আমার সেই সোনার সিঁদুরের কৌটোটা এই বিছানার পাশে এইখানটায় রেখেছি, খোকা দোলায় চেচিয়ে উঠল, উনি বাড়ি থেকে এলেন–আর তুলতে মনে নেই- কোথায় গেল আর তো পাচ্ছি নে?–

সেজ ঠাকরুন বলিলেন-ওমা সে কি? হাতে করে নিয়ে যাস নি তো?

–না দিদিমা, এইখানে রেখে গেলুম। বেশ মনে আছে, ঠিক এইখানে

সকলে মিলিয়া খানিকক্ষণ চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করা হইল, কৌটার সন্ধান নাই। সেজ ঠাকরুন জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, দালানে প্রথমটা এ বাড়ির ছেলেমেয়ে ছিল, তারপর খাওয়ার ডাক পড়িলে ছেলেমেয়েরা সব খাবার খাইতে যায়, তখন বাহিরের লোকের মধ্যে ছিল দুৰ্গা। সেজ ঠাকরুনের ছোট মেয়ে টেঁপি চুপি চুপি বলিল-আমরা যেই খাবার খেতে এলাম দুগগাদি তখন দেখি যে খিড়কির দোর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, এই মাত্তর আবার এসেছে–

সেজ ঠাকুবুন চুপি চুপি কি পরামর্শ করিলেন, পরে বৃক্ষসুরে দুর্গাকে বলিলেন-কৌটো দিয়ে দে দুগগা, কোথায় রেখেচিস বল-বার কর এখখুনি বলচি–

দুর্গার মুখ শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গিয়াছিল, সেজ ঠাকরুনের ভাবভঙ্গিতে তাহার জিব যেন মুখের মধ্যে জড়াইয়া গেল। অস্পষ্টভাবে কি বলিল ভালো বোঝা গেল না।

টুনির মা এতক্ষণ কোনো কথা বলে নাই-একজন ভদ্রঘরের মেয়েকে সকলে মিলিয়া চোর বলিয়া ধরাতে সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছিল, বিশেষত দুৰ্গাকে সে কয়েকদিন এখানে দেখিতেছে, দেখিতে বেশ চেহারা বলিয়া দুৰ্গাকে পছন্দ করে-সে চুরি করিবে ইহা কি সম্ভব? সে বলিল-ও নেয় নি বোধ হয়। সেজদি-ও কেন–

সেজ ঠাকরুন বলিলেন—তুমি চুপ করে থাকো না! তুমি ওর কি জানো, নিয়োচে কি না। নিয়েচে আমি জানি ভালো করে–

একজন বলিলেন—তা নিয়ে থাকিস বের করে দে, নয়তো কোথায় আছে বল-আপদ চুকে গেল। দিয়ে দে লক্ষ্মীটি, কেন মিথ্যে–

দুর্গা যেন কেমন হইয়া গিয়াছিল—তাহার পা ঠক ঠক করিয়া কাঁপিতেছিল-সে দেওয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া বলিল-আমি তো জানিনে কাকিম-আমি তো—

সেজ ঠাকরুন বলিলেন-বল্পেই আমি শুনবো? ঠিক ও নিয়েচে-ওর ভাব দেখে আমি বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, ভালো কথায় বলচি কোথায় রেখেচিস দিয়ে দে, জিনিস দিয়ে দাও তো কিছু বোলবো না-আমার জিনিস পেলেই হল

পূর্বোক্ত কুটুম্বিনী বলিলেন-ভাদর লোকের মেয়ে চুরি করে কোথাও শুনিনি তো কখনও। এই পাড়াতেই বাড়ি নাকি?

সেজ ঠাকরুন বলিলেন-তুমি ভালো কথাব কেউ নও! দেখবে তুমি মজাটা একবাব, তুমি আমার বাড়ির জিনিস নিয়ে হজম কর্তে গিয়েচো—এ কি যা তা পেয়েচ বুঝি?–তোমায় আমি আজ–

পরে তিনি দুর্গার হাতখানা ধরিয়া হিড়হিড় করিয়া টানিয়া তাহাকে দালানের ঠিক মাঝখানে আনিয়া বলিলেন, দুর্গা, বল এখনও কোথায় রেখেচিস?…বলবি নে? না, তুমি জানো না, তুমি খুকি—তুমি কিছু জানো না-শিগগির বল, নৈলে দাঁতের পাটি একেবারে সব ভেঙে গুড়ো করে ফেলবো এখুনি! বল, শিগগির-বল এখনও বলচি–

টুনির মা হাত ধরিতে আগাইয়া আসিতেছিল, একজন কুটুম্বিনী বলিলেন, রোসো না, দেখচো না ও-ই ঠিক নিয়েচে। চোরের মারই ওষুধ-দিয়ে দাও এখুনি মিটে গেল,-কেন মিথ্যে–

দুর্গার মাথার মধ্যে কেমন করিতেছিল। সে অসহায়ভাবে চারিদিকে চাহিয়া অতি কষ্টে শুকনো জিবে জড়াইয়া উচ্চারণ করিল-আমি তো জানিনে কাকিম, ওরা সব চলে গেল আমিও তোকথা বলিবার সময়ে সে ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া। সেজ ঠাকরুনের দিকে চোখ রাখিয়া দেওয়ালের দিকে ঘোষিয়া যাইতে লাগিল।

পরে সকলে মিলিয়া আরও খানিকক্ষণ তাহাকে বুঝাইল। তাহার সেই এক কথা—সে জানে না।

কে একজন বলিল-পাকা চোর—

টেঁপি বলিল-বাগানের আমগুলো তলায় পড়বার জো নেই কাকিমা–

শেষোক্ত কথাতেই বোধ হয় সেজ ঠাকরুনের কোন ব্যথায় ঘা লাগিল। তিনি হঠাৎ বাজাখাই রকমের আওয়াজ ছাড়িয়া বলিয়া উঠিলেন—তবে রে পাজি, নচ্ছার চোরের ঝাড়, তুমি জিনিস দেবে না? দেখি তুমি দেও কি না দেও! কথা শেষ না করিয়াই তিনি দুর্গার উপর ঝাপাইয়া পড়িয়া তাহার মাথাটা লইয়া সজোরে দেওয়ালে ঠুকিতে লাগিলেন। বল কোথায় রেখেচিস-বল, এখুনি–বল শিগগির—বল–

টুনির মা তাড়াতাড়ি ছুটিয়া আসিয়া সেজ ঠাকরুনের হাত ধরিয়া বলিল, করেন কি-করেন কি সেজদি-থাকগে আমার কৌটো-ওরকম করে মারেন কেন?–ছেড়ে দিন-থাক, হয়েছে, ছাড়ন, ছিঃ!

টুনি মারা দেখিয়া কঁদিয়া উঠিল। পূর্বোক্ত কুটুম্বিনী বলিলেন-এঃ, রক্ত পড়ছে যে…

দুৰ্গার নাক দিয়া ঝরঝর করিয়া রক্ত পড়িতেছে কেহ লক্ষ করে নাই। বুকের কাপড়ের খানিকটা রক্তরাঙা হইয়া উঠিয়াছে।

টুনির মা বলিলেন,-শিগগির একটু জল নিয়ে আয় টেঁপি-রোয়াকের বালতিতে আছে দ্যাখ–

চেঁচামিচি ও হৈ চৈ শুনিয়া পাশের বাড়ির কামারের বিস্তু-বৌরা ব্যাপার কি দেখিতে আসিল। রানুর মা এতক্ষণ ছিলেন না-দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে কামার-বাড়ি বসিয়া গল্প করিতেছিলেন–তিনিও আসিলেন।

মারের চোটে দুর্গার মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করিতেছিল, সে দিশহারা ভাবে ভিড়ের মধ্যে একবার চাহিয়া কি দেখিল।

জল আসিলে রানুর মা তাহার চোখে মুখে জল দিয়া তাহাকে ধরিয়া বসাইলেন। তাহার মাথার মধ্যে কেন বিমঝিম করিতেছিল, সে দিশহারা ভাবে বসিয়া পড়িল। রানুর মা বলিলেন-আমন করে কি মারে সেজদি?…রোগা মেয়েটা-ছিঃ-

—তোমরা ওকে চেনো নি এখনও। চোরের মার ছাড়া ওষুধ নেই এই বলে দিলুম-মারের এখনও হয়েছে কি-না পাওয়া গেলে ছাড়বো নাকি? হরি রায় আমায় যেন শূলে ফাঁসে দেয় এরপর–

রানুর মা বলিলেন-হয়েচে, এখন একটু সামলাতে দেও সেজদি-যে কাণ্ড করেচো—

টুনির মা বলিল-ওমা, এত হবে জানলে কে কৌটোর কথা বলতো?…চাইনে আমার কৌটো-ওকে ছেড়ে দাও সেজদি—

সেজ ঠাকরুন। এত সহজে ছাড়িতেন। কিনা বলা যায় না, কিন্তু জনমত তাঁহার বিরুদ্ধে রায দিতে লাগিল।. কাজেই তিনি আসামীকে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইলেন।

রানুর মা তাহাকে ধরিয়া ওদিকের দরজা খুলিয়া খিড়কিব উঠানে বাহির করিষা দিলেন। বলিলেন—খুব ক্ষণে আজ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলি যা হোক! যা, আস্তে আস্তে যা-টেঁপি খিড়কিটা ভালো করে খুলে দে

দুৰ্গা দিশহারা ভাবে খিড়কি দিয়া বাহির হইয়া গেল, মেয়েছেলে ও যাহারা উপস্থিত ছিলসকলে চাহিয়া দেখিতে লাগিল।

একজন বলিল—তবুও তো স্বীকার কন্নে না-কি রকম দেখচো একবার?…চোখ দিয়ে কিন্তু এক ফোটা জল পড়লো না

রানুর মা বলিলেন-জল পড়বে কি, ভয়েই শুকিয়ে গিয়েচে। চোখে কি আর জল আছে? ওইরকম করে মারে সেজাদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *