০৬. অঙ্গিরা (স্থান: গান্ধার (তক্ষশিলা) ।। কাল ১৮০০ খৃষ্টপূর্ব)

অঙ্গিরা (স্থান: গান্ধার (তক্ষশিলা) ।। কাল ১৮০০ খৃষ্টপূর্ব)

(১)

“এই সুতি কাপড় একেবারেই অকেজো এতে না আটকায় শীত, না রোখে বর্ষা!” নিজের গা থেকে ভিজে কাপড়টি খুলতে খুলতে যুবকটি বালল।

দ্বিতীয় তরুণটি তার আপন পরিধেয় দরজার কপটে মেলে দিতে দিতে বলল, “কিন্তু যাই বল, গ্রীষ্মকালের পক্ষে এগুলো ভালো”- সন্ধ্যা হতে তভনও দেরি কিন্তু ইতিমধ্যেই অগ্নিকুণ্ডের কিনারায় লোক জুটতে শুরু করেছিল। তরুণদ্বয় ধোঁয়া-ভরা অগ্নিকুণ্ডের পাশে না বসে জানালার ধারে গিয়ে বসল, ঠান্ডা হাওয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্যে দুটো কম্বল নিজেদের গায়ে জড়িয়ে নিল।

প্রথম তরুণটি বলল, “আমরা এখনো এক যোজন পথ হাঁটতে পারতাম, তা’হলে কাল ভোরে গান্ধারনগর (তক্ষশিলায়) পৌছতে পারতাম, কিন্তু এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পথ চলা বড় কষ্টকর।”

দ্বিতীয় তরুণ বলল, “শীতের আগমনকালীন ঋতুর এই পরির্বতন খুবই খারাপ লাগে – এখন বর্ষায় চারিদিক ছেয়ে যাবে। অথচ এই বৃষ্টি না হলে কৃষকেরা ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করবে — পশুপালকেরা করবে কান্নাকাটি।”

প্রথম জন উত্তর দিল, “মিত্র, ঠিকই বলেছ। একমাত্র আমাদের মতো পথিকরাই এই বৃষ্টি পছন্দ করে না। আর সকলে তো সর্বদা পথে থাকে না!” এমন সময় তার সঙ্গীটির গলায় ক্ষতচিহের প্রতি নজর পড়ায় সে প্রশ্ন করল, “তোমার নাম কি বন্ধু ?”

“পাল মাদ্র। আর তোমার?”
“বরুণ সৌবীর।”
“তাহলে তুমি পূর্বদিক থেকেই আসছ?”
“হ্যাঁ মাদ্রদেশ থেকে। আর তুমি দক্ষিণ থেকে তো? আচ্ছা বন্ধু বল তো আমরা যে শুনেছি অসুররা না-কি এখনো আর্যভাষীদের সঙ্গে লড়াই করছে?”
“একমাত্র সমুদ্রতটে একটি শহরকে কেন্দ্র করে এই লড়াই চলছে। আমাদের মঘবা ইন্দ্র কিভাবে অসুরদের একশ’ নগর দুর্গ ধ্বংস করেছিল – তার কথা কি জান,বন্ধু?”
“শুনেছি, অসুরদের নগর-দুর্গ তাম্র নির্মিত ছিল।”                                                                                                                                                                                                                                         “অসুরদের এত তামা নেই যে তা দিয়ে তারা দুর্গ বানাবে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়ল কি করে তা অবশ্য জানি না। তাদের বাড়ি-ঘর ইট দিয়ে বানানো শহরের চারপাশেৱ মোটা দেওয়ালও ইঁটের। মাটি আগুনে পুড়িয়ে লালচে রঙ-এর ইট হয়। কিন্তু তা মাটির চেয়ে চারগুণ শক্ত – তামার মাতো মজবুদ। তবু ইট আর তামার তফাৎ অনেক। অনেকে ভুল করে ইটকে হয়ত তামা মনে করে।”
“তুমি যাই বল বরুণ, আমরা কিন্তু তাম্রদুর্গের কথাই শুনেছি।”
“আমাদের ইন্দ্রকে দুর্গ ধ্বংস করতে অনেক কষ্ট ও শক্তিক্ষয় করতে হয়েছে—তাই বোধহয় এ দুর্গ তাম্রনির্মিত বলে কথিত হয়েছে।”
“তা ছাড়া সম্বরের শৌর্যবীর্যের কত না কাহিনী আমাদের কানে এসেছে। সমূদ্রের মধ্যে তার নাকি ঘর, আকাশ পথে তার রথ উড়ে চলত।”

“রথের কথা ডাহা মিথ্যা, একেবারেই আজগুবি। তা’ছাড়া অশ্বারোহী যোদ্ধা হিসাবে অসুরেরা দুর্বল। এখনও, তাদের উৎসবের সময় অশ্বরথের জায়গায় বৃষরথ নিয়ে আসে। আমরা যুদ্ধে জিতেছি। ঘোড়ার জোরে – ভালো ঘোড়সওয়ার হতে না পারলে যুদ্ধে আমরা অসুরদের হারাতে পারতাম না। সম্বর প্রায় দুশো বছর হল মারা গেছে। আকাশপথে উড়ে যাওয়া দূরের কথা, তার কাছে অশ্বরখ পর্যন্ত ছিল না।”
“সম্বর যদি এতই সাধারণ মানুষ ছিল, তবে ওই অসুর শক্ৰকে পরাজিত করায় আমাদের ইন্দ্রের এত নামডাক কেন?”
“কারণ, সম্বর ছিল খুব বড় বীর। সৌবীর নগরে আমি তার স্বর্ণখচিত তাম্রকবচ, (বর্ম) দেখেছি – সেটা যেমন দৃঢ়, তেমনিই বিশাল। অসুররা সাধারণভাবে বেঁটে গড়নের কিন্তু সম্বর ছিল বিরাটাকায়, খুবই বলিষ্ঠ। আর আমাদের মঘবা ইন্দ্র ছিল পাতলা ছিপছিয়ে জোয়ান মানুষ। সিন্ধু নদের তীরে এখনো দেখতে পাবে পুরনো দিনের অসুর নগরীর অবশেষ। মনে কর সেইসব দিনের কথা, দুর্গের মধ্যে থেকে কিছু তীরন্দাজ হাজার হাজার আক্রমণকারীকে হটিয়ে দিত। ওই দুর্গগুলো ছিল দুর্ভেদ্য – আর এই অপরাজেয় পুরীকে ধ্বংস করেছিল আমাদের মঘবা ইন্দ্ৰ।”
“আচ্ছা বরুণ, দক্ষিণে কি অসুরদের শক্তি অটুট আছে?”
“তোমাকে কি বলিনি, সমুদ্রতটর শেষ দুর্গাও অসুরেরা হারিয়েছে। আমরা তা ধ্বংস করেছি। ওই যুদ্ধে আমিও যোগ দিয়েছিলাম।” কথা বলতে বলতে বরণের মুখমণ্ডলে রক্তিমাভা ফুটে উঠল। সে তার দীর্ঘ সোনালী চুলের গোছা হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, “অসুরদের সর্বশেষ দুর্গের পতন ঘটে গেছে।”
“এই যুদ্ধে আমাদের ইন্দ্র কে ছিল?”
“ইঞ্জের পদ আমরা বিলোপ করেছি।”
“বিলোপ করেছ?”
“হা, আমরা দক্ষিণের আর্যভাষীরা ক্ৰমেই শঙ্কিত হচ্ছিলাম।” “শঙ্কিত হচ্ছিল! কেন ?”
“আর্যভাষীরা সেনানায়ককে সর্বেসর্বা বলে মেনে চলতে রাজী নয়। যুদ্ধের সময় সেনানায়কের আদেশ যতই শিরোধার্য হোক না কেন, আর্যভাষীরা সব সময় তাদের জন-পরিষদকে সর্বোচ্চ স্থান দেয় যেখানে স্বাধীনভাবে প্রত্যেকে নিজের চিন্তাধারা উত্থাপন করবার অধিকারী।”
“হ্যাঁ, ঠিকই তো, এ অধিকার আছে।”
“কিন্তু অসুরদের প্রথা অন্য রকম। তার ইন্দ্রকে রাজা বলে মনে করে। আর এই রাজা নিজেকেই সব কিছু মনে করে – নিজের ওপরে জন-পরিষদকে স্থান দেয় না।অসুররাজের মুখ দিয়ে একবার যা বেরিয়ে গেল তা সমস্ত অসুরের অবশ্য পালনীয়, আর সেটা পালন না করলে মৃত্যুবরণ করতে হবে।”
“না, এ ধরনের ইন্দ্ৰকে আমরা কখনও স্বীকার করতে পারি না।”
“কিন্তু অসুরেরা এই ধরনের ইন্দ্রকেই বারবার মেনে এসেছে। তারা তাদের রাজাকে মানুষের ঊর্ধ্বে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। জীবিত মানুষ রাজাকে পূজো পর্যন্ত করত। আর এই পূজার অনুষ্ঠানের কথা বললে তুমি তা বিশ্বাসই করবে না।”

“হ্যাঁ, আমি নিজেই দেখেছি অসুর পুরোহিতরা মানুষকে গাধা বানিয়ে ছাড়ে।”

“তারা জনসাধারণকে গাধার চেয়েও ছোট মনে করে। তুমি বোধহয় শুনেছ তারা লিঙ্গপূজা করে। শরীরের এই প্রভঙ্গ দুটি নর-নারীর সুখ-সম্ভোগের এবং ভবিষ্যবংশ সৃষ্টির কারণ বটে, কিন্তু তাকে পূজা করা আহম্মুকি নয়? অনেক জায়গায় আবার মাটির লিঙ্গ গড়ে পূজা করা হয়।”
“আহম্মুকি তো বটেই।”
“আর অসুররাজারা এই ধরনের পূজায় বিশেষ আসক্ত। আমার মনে হয়, এর মধ্যে একটা মস্ত চালাকী আছে, বিশেষত অসুররাজারা আর তাদের পুরোহিতরা মুর্থ হয় না, তারা আমাদের আর্যভাষীদের চেয়ে চতুর। তাদের মতো নগর বা দুর্গ বানাতে আমাদের অনেক শিখতে হয়েছে। তাদের দোকান-পাট, পুষ্করিনী, প্রাসাদ, রাজপথ- এ সমস্ত জিনিস তুমি আমাসের এই ভূখণ্ডে দেখতে পেতে না। আমি উত্তর সৌবিরের পরিত্যক্ত অসুর নগরী ও অধুনা বিজিত অসুর নগরটি দেখেছি। আমরা তাদের পুরনো নগরগুলি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হইনি – বিশেষ করে এই নতুন নগর, যা সম্বর প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে প্রবাদ আছে তা তো দেবপুরীর সমতুল্য।”

“বল কি, দেবপুরী?” “সত্যি বলছি। পৃথিবীর কোনো জিনিসের সঙ্গেই এর তুলনা হয় না। একটি পরিবারের বাসোপযোগী থাকবার গৃহের কথাই ধর না কেন। তাতে আছে – সুসজ্জিত বৈঠকখানা, চুন্নী সমেত রান্নাঘর, তার ধোঁয়া বেরবার আলাদা ব্যবস্থা, চত্বরে বাঁধানো কূপ, স্নানের ঘর, শোবার ঘর আর তা’ছাড়া আছে আলাদা গোলাঘর। দু-তিন তলার বাড়ি দেখেছি — সেখানে সাধারণ লোকেরাই থাকত। এর সঠিক বর্ণনা দেওয়া শক্ত, তুলনা করতে হয়।”

“পূব দেশেও অসুর নগরী আছে, সেগুলো আমাদের মাদ্রদেশ (বর্তমানে শিয়ালকোট) থেকে অনেক দূরে।”
“আমি তাও দেখেছি বন্ধু। এ রকম নগর যারা নির্মাণ করেছে, যারা পরিচালনা করেছে – তারা যে আমাদের থেকে অনেক বুদ্ধিমান ও চতুর। এটা স্বীকার করতেই হবে। তুমি সমুদ্রের কথা শুনেছি কখনো?”

“নাম শুনেছি।”
“নাম শুনে বা বর্ণনা শুনে তুমি মহাসাগর সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারবে না। সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে যখন তুমি দেখবে তার নীল জলরাশি আকাশ স্পর্শ করেছে— তখন তোমার চেতনায় আসবে – কিছুটা অনুমান করবে।”

“আকাশ পর্যন্ত কি সাগর পৌছাতে পারে, বরুণ?” “হাঁ, তাই হয়। তোমার দৃষ্টি যতদূর যাবে – তুমি দেখবে বিশাল জলরাশি, তরঙ্গের পর তরঙ্গে ক্রমেই ওপরে উঠছে – ফেনিল জলরাশি ক্রমেই আঞ্চাশ স্পর্শ করছে। উভয়ের বর্ণও এক, সমুদ্র নীলাকাশের মতোই নীল। আর দিগন্তহীন সাগরে অসুররা তাদের বড় বড় নৌকা নির্ভয়ে ভাসিয়ে দেয়- মাস, বছর অতিক্রম করে সমুদ্রপথে ঘুরে বেড়ায়, আর সমুদ্র পার থেকে রত্ন-ভাণ্ডার সংগ্রহ করে। অসুরদের সাহস ও কুশলতার এও একটা নজির। এছাড়াও আর একটি ব্যাপার আছে যা তুমি কোনোদিন শোননি। অসুররা মুখ ছাড়াই কথা বলতে পারে।”
“এ্যাঁ! শব্দ না করে? কি বলছ বন্ধু?”
“হ্যাঁ বিনা শব্দে। মাটি ও পাথর দিয়ে চামড়া বা কাপড়ের ওপর দাগ কেটে যাবে।
– অন্য অসুররা একটা শব্দ না শুনে বা মুখের দিকে না তাকিয়েই ওই সমস্ত সঙ্কেত বুঝতে পারবে। আমরা যা দু’ঘন্টা কথা বলে বোঝাতে পারব না, তা তারা পাঁচ দশটা সঙ্কেতে বুঝিয়ে দেবে। আর্যরা এ বিদ্যা জানত না। এখন তারা এইসব সক্ষেত বুঝতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে শিখেও কায়দা করতে পারছে না।”
“এ কথা নিঃসন্দেহ যে, অসুররা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান।”
“দেখ না কেন! এখন আমরা তাদের সর্বত্রই কারিগর, মৃৎশিল্পী, তন্তুবায়, রথ প্রস্তুতকারক ও কর্মকার হিসাবে দেখতে পাই। তারা যে আমাদের চেয়ে গুণী তাতে আর সন্দেহ কি?”

“আর তুমিই তো বলছ অসুরা বীরও বটে।”
হ্যাঁ বীর তো বটেই। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। আর্যভাষীদের মতো ওদের বাচ্চারা মায়ের পেট থেকে পড়েই তরবারি নিয়ে খেলতে শেখে না। ওদের মধ্যে আছে কারিগর, বণিক, দাস প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী। তেমনি সেনানী বা যোদ্ধা হচ্ছে আলাদা শ্ৰেণী। যোদ্ধাশ্রেণী ছাড়া আর কেউ অস্ত্রবিদ্যা শেখে না। যারা যুদ্ধবিদ্যা শেখে না, যোদ্ধারা তাদের হেয় জ্ঞান করে। আর দাসদাসীরা পশু অপেক্ষা হীন জীবন যাপন করে। অসুররা শুধু এদের বেচাকেনাই করত না, তারা এদের দেহ এবং জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলত।”
‘তাদের যোদ্ধা কত?”
“শতকরা একজনও হয়ত তাদের সৈন্য নয়, কিন্তু দাসের সংখ্যা অনেক বেশী – শতকরা চল্লিশ জন। আর তাদের শিল্পী এবং কৃষকরাও অর্থ-দাস, শতকরা দশ জন হবে ব্যবসায়ী আর বাকীরা বৃত্তিধারী।”

“তাই তো অসুররা আর্যভাষীদের কাছে হেরে গেল।” “হ্যাঁ, ওদের হেরে যাওয়ার এটা একটা প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, তারা রাজাকে দেবতা বলে মানত, তাকে জনসাধারণের চেয়ে অনেক ওপরে স্থান দিয়েছিল।”
“আমরা এ ব্যবস্থা কখনই মানব না।”
“এইজন্যেই তো আমাদের ইন্দ্রের পদ বিলোপ করতে হল। মঘবার পর এক ইন্দ্র অসুর রাজার মতো হতে চেয়েছিল। আর সে কি একা, তারপর আরও অনেকে ইন্দ্র হবার চেষ্টা করেছিল। আর কয়েকজন আর্যভাষীও তাদের সাহায্য করতে গিয়ে ধরা পড়ল।”
“সাহায্য করতে গেল!”
“হ্যাঁ, তাই সমগ্র জন-পরিবারের স্বার্থবিবেচনা করে সৌবীর-জন সিদ্ধান্ত নিল যে, এরপর আর কাউকে ইন্দ্র করা হবে না। বজ্ৰ ধারণ করে যে দেবতা তার নামের সঙ্গে মিশে এই নামের মোহ মানুষকে বিভ্রান্ত করছিল –ইন্দ্ৰপদ তুলে দেওয়ার সেটাও কারণ বটে।”
“বন্ধু, সৌবীর-জন ভালো কাজই করেছে।”
“কিন্তু আর্যভাষীদের সুনামে কলঙ্ক আরোপ করার জন্যে কিছু লোক আছে যারা অসুরদের সবকিছুকেই প্রশংসা করতে ক্লান্তিবোধ করেনা। তাদের অনেক কিছুই প্রশংসনীয়, আমি নিজেও তার সমাদর করি। আমরা তাদের হাতিয়ার দেখেই আমাদের অস্তু বানিয়েছি, তাদের বৃষভ-রথ দেখেই তো আমাদের মঘবা ইন্দ্র তার অশ্বরথ নির্মাণ করেছিল। একজন তীরন্দাজের পক্ষে ঘোড়ার চেয়ে রথে বসে যুদ্ধ করা অনেক বেশী সুবিধাজনক। রথে বেশী তৃণ রাখতে পারে, শক্রর তীর থেকে আত্মরক্ষার জন্য আবরণও রাখতে পারে। আর্যরা অসুরদের বর্শা, গদা, শক্তি প্রভৃতি অস্ত্রাদি সম্পর্কে অনেক শিক্ষা নিয়েছে। অসুরদের নগরপরিকল্পনা থেকে আমরা অনেক কিছু গ্ৰহণ করেছি। তাদের কাছ থেকে সমুদ্রযাত্রা আমাদের শিখতে হবে, কারণ তামা ও অন্যান্য ধাতুরত্ন সাগরতীর থেকে আসে; এখনো এই ব্যবসা অসুর ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া। আমরা যদি তাদের থেকে স্বতন্ত্র হতে চাই তা’হলে সাগরে নৌ-চালনা শিক্ষা করতেই হবে। তবু এমন অনেক বিষয় আছে যা অসুরসের কাছ থেকে নেওয়া বিপদজনক -যেমন লিঙ্গপূজা।”
“কিন্তু লিঙ্গপূজা কোন আর্যভাষী স্বীকার করে নেবে।”
“আর বলো না বন্ধু! আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা বলছে অসুরদের মতো আমাসেরও পূরেহিত দরকার। আমাদের এখানে অসুরদের মতো পুরোহিত, ব্যবসায়ী, কৃষক ও শিল্পীদের মধ্যে কোনো প্ৰভেদ নেই, সবাই সব কাজ খুশীমতো করতে পারে। কিন্তু অসুররা আলাদা আলাদা শ্রেণীবিভাগ করেছে। এখন একবার যদি আমাদের মধ্যে পুরোহিত সৃষ্টি করতে দাও তো দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই লিঙ্গপূজাও শুরু হয়ে যাবে। লাভ ও লোভের জন্যে আর্যভাষী পুরোহিতদেরও ওই কাজই শুরু করতে হবে।”
“এ তো অত্যন্ত খারাপ হবে, তা’হলে বরুণ!”
“গত দু’শো বছর অসুরদের সংস্পর্শে এসে আর্যদের মধ্যে কতই না পাপ প্রবেশ করেছে। আর তাই দেখে বৃদ্ধরা ক্রমেই হতাশ হচ্ছে। আমি অবশ্য নিরাশ হইনি। আমি বিশ্বাস করি, যদি অতীতের মহান দিনগুলির কথা আর্যভাষী জনদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, যদি তাদের ভালো করে বোঝানো যায় – তবে তারা পথভ্রষ্ট হবে না। শুনেছি তক্ষশিলায় অঙ্গিরা নামে এক ঋষি আর্যভাষীদের প্রাচীন বিদ্যা জানেন। তিনি আর্যমার্গে চলবার শিক্ষা দেন। আমি আর্ভাষীদের বিজয়ের জন্য তরবারি ধরেছি। এখন আর্য রীতি-নীতি রক্ষার জন্যে কিছু শিক্ষার প্রয়োজন।”
“কি আশ্চর্য! আমিও তো চলেছি ঋষি অঙ্গিরার কাছে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে।”
“খুব ভালো, কিন্তু তুমি তো পূর্বদিকের আর্যভাষী জনদের কথা কিছুই বলনি।”
“পুবদেশের আর্যভাষী জন দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। গান্ধারের পরের ভূখন্ড আমাদের মাদ্ররা দখল করেছে। তারপরের অঞ্চল দখল করেছে মল্লরা, এবং ক্রমশ কুরু, পঞ্চাল প্রভৃতি জন বড় বড় প্রদেশ আপন করতলগত করেছে।”
“তা’হলে আর্যভাষীরা ওখানে সংখ্যায় অনেক বেশী।” “খুব বেশী নয়। তবে যতই তারা এগিয়ে চলেছে ততই অসুর ও অন্যান্য জাতির সম্মুখীন হচ্ছে।”
“অন্যরা আবার কারা।”
“অসুরদের গায়ের রঙ তামাটে। কিন্তু পূর্বদিকে এক রকম লোক আছে — তাদের কোল বলা হয় – তারা কয়লার মতো কালো। এই কোলেরা গ্রামেও থাকে, জঙ্গলেও আছে। বন্য কোলেরা নানা রকমের পাথরের অস্ত্র তৈরী করে।”
“তা’হলে তো মনে হয় এই অনার্যদের সঙ্গে খুবই লড়াই করতে হচ্ছে।”
“বড় ধরনের সামনা-সামনি যুদ্ধ খুব কম হয়। আর্যভাষীদের ঘোড়া দেখলেই অনার্যরা পালিয়ে যায়। কিন্তু রাতে আমাদের আক্রমণ করে। এর প্রতিশোধ নেবার জন্যে অনেক সময় ক্রুর ব্যবহার করতে হয়। ফলে অসুর এবং কোলদের গ্রাম প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে। এখন তারা ক্ৰমেই পূবদিকে পালিয়ে যাচ্ছে।”

“তা’হলে, তোমাদের ওখানে অসুরদের রীতি-নীতির প্রভাবের কোনো ভয় নেই?”

“মাদ্র-জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় নেই, মল্লদের বেলাও এ কথা বলা যায়। আরও আগের কথা বলতে পারি না, আমাদের ওখানের অনার্যরা জঙ্গলের বাসিন্দাই রয়ে গেল।”
দুই বন্ধু এইভাবে রাত্রি পর্যন্ত তাদের পরস্পরের খবরাখবর ও গল্পে মশগুল ছিল। অতিথিশালার পরিচারিকা এসে খাওয়া-দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস না করলে তাদের কথা হয়ত শেষই হত না। এই অতিথিশালাটি নির্মিত হয়েছিল গ্রামবাসীদের খরচে – পথিকদের বিশেষ করে শ্বেতজাতির পথিকদের বিশ্রামের জন্য নির্মিত এ কথা অবশ্য বলার কোনো দরকার হয় না। যাদের কাছে আহার্য কিছু থাকত না, তাদের জন্য চাল-ভাজা ও গোমাংসের সুরুয়ার ব্যবস্থা হত। কোনো পথিকের কাছে খাদ্যবস্তু থাকলে তা সে অতিথিশালার রক্ষকের কাছে দিলে সে রান্না করে দিত, আর তা না থাকলে সমতুল্য কিছু দিতে হত। এই অতিথিশালাটি সোমরসের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। দুই বন্ধু গো-মাংস এবং মদ্য একত্রে পানাহার করে তাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় করে নিল।

(২)

ঋষি অঙ্গিরা সিন্ধুনদের পূর্ব-পারের এই গান্ধারের জন-এর শ্ৰেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী হয়েছিল, সে একদা জন-পতি পর্যন্ত ছিল। পুষ্কলাবতীর (চরসদ্দা) প্রথম যুদ্ধের পর অসুররা পিছু হটতে শুরু করে। পরবর্তী পুরুষে গান্ধার জনের একটি শাখা কুনার তীর থেকে এসে পশ্চিম গান্ধার অঞ্চল অধিকার করল। তাই অসুররা পশ্চিম গান্ধার দেশ দ্রুত ত্যাগ করতে লাগল। মাত্র তিরিশ বছর যেতে না যেতেই গান্ধার ও মাদ্ররা সিন্ধু নদের পূর্বপারের ভূ-খণ্ড জয় করল। বিজিত দেশ তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল; বিতস্তা থেকে সিন্ধুর মধ্যকার ভূমি পেল গাদ্ধার জন আর বিতস্তা থেকে ইরাবতীর মধ্যকার ভূখণ্ড দখল করল মাদ্র-জন। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ দুটি অঞ্চলই দখলকারীদের নামানুসারে পূর্ব গান্ধার ও মাদ্র জনপদ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করল। এই প্রারম্ভিক দেবাসুর যুদ্ধে উভয় জাতিই অমানুষিক নৃশংসতার পাল্লা দিয়েছিল, যার পরিণামে গান্ধারভূমিতে একটি অসুরও অবশিষ্ট ছিল না। মাদ্রদের ভূখণ্ডেও খুব অল্পসংখ্যক অসুর অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধেরও আস্তে আস্তে ভঁটা পড়তে লাগল। পীতকেশীরাও তাদের যুদ্ধের সময়কার নিষ্ঠুরতা কমিয়ে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বরুণ সৌবীরের বর্ণনা অনুযায়ী গীতকেশীদের ওপর অসুরদের নানা প্রকার প্রভাব পড়তে লাগল। ঋষি অঙ্গিরা বক্ষু উপত্যকা থেকে আগত আৰ্য্যদের অতীত ঐতিহ্যের শুধুমাত্র বড় পণ্ডিতই ছিল না, সে চাইত আর্যভাষীরা তাদের রক্ত ও আচার-ব্যবহারের বিশুদ্ধতা বজায় রাখুক। এই কারণেই পূর্বগান্ধার দেশে অশ্ব-মাংস খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে আবার সেখানে অশ্বপালন প্রথা পুনরায় চালু করল। ঋষি অঙ্গিরার এ আর্যপ্রীতি, আর্য ঐতিহ্য ও আর্য শিক্ষায় তার অনুরক্তি এবং যুদ্ধবিদ্যায় অসাধারণ কুশলতার খ্যাতি, তাকে এমনি প্রথিতযশা করে তুলেছিল যে, সুদূর জনপদ থেকে আর্য কুমারগণ তার কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসত। কিন্তু সেদিন কে জানত যে, অঙ্গিরা রোপিত গান্ধারপুরের এই বিদ্যা-অঙ্কুর ভাবীকালে একদিন তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়-রূপ বিশাল মহীরূপে পরিণতি লাভ করবে। কে জানত, এই মহীরূহের ছায়ায় সুমিস্ট ফললাভের প্রয়াসে সহস্ৰ যোজন পথ দূর থেকে আর্যগাথার ভক্তরা ছুটে আসবে।
ঋষি অঙ্গিরার বয়স ৬৫ বছর। পলিত কেশ, কটি বিলম্বিত শ্বেত উজ্জ্বল শ্মশ্রু এবং সৌম্য মুখমণ্ডল ঋষির আকৃতিকে আকৰ্ষণীয় করে তুলেছে। সেদিন থেকে কয়েক শতাব্দী পরে কালি-কলম ও ভূৰ্জপত্রে লেখার রীতি মানুষের আয়ত্তে এসেছিল। তখন ছিল শ্রুতি ও স্মৃতির যুগ, তাই সব শিক্ষাই প্রদও হত মৌখিকভাবে, বিদ্যাধীরা পুরাতন সংগীত ও কাহিনী বার বাৱ আবৃত্তি করে – স্মরণে রাখত। দূর দেশ হতে আগত বিদ্যার্থীরা দীর্ঘদিনের উপযোগী নিজেদের খাদ্য-বস্ত্র আনতে পারে না। ঋষি অঙ্গিরাকেই খাদ্য বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হত। এর জন্যে তার নিজের জমি চাষ করার পরও বিদ্যার্থীদের দিয়ে জংলা জমি চাষ করে নতুন আবাদ করেছিল। তাইতেই সারা বছরের উপযোগী যথেষ্ট গম উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছিল। তখনো পর্যন্ত পুষ্প উদ্যান করার রেওয়াজ হয়নি। কিন্তু বনের জংলী ফলমূল যখন পাকবার সময় হত তখন সে নিজের শিষ্যমণ্ডলী নিয়ে সেখানে তা আহরণে যেত, তখন তারা ফুলও সংগ্রহ করত। চাষের কাজে, বীজ বপন, ফসল কাটা অথবা ফুল ফল জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের সময় বিদ্যার্থীরা বক্ষুর তীরে সুবাস্তুর তটভূমিতে রচিত গানগুলি পরম আদরে উচ্চ রাগিণীতে সমবেতভাবে গাইত। অঙ্গিরার অশ্বশালাও ছিল গান্ধারের মধ্যে সবচেয়ে বড়। দূর-দূরান্তের শিষ্য বা পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে অনুরোধ পাঠাত ভালো জাতের ঘোড়া ভেট আনবার জন্য, উচ্চশ্রেণীর ঘোটক-ঘোটকী সংগ্রহ করে ভালো জাতের ঘোড়ার বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা করত। পরবর্তীকালের বিখ্যাত সিন্ধী-ঘোটক সৃষ্টি হয়েছিল তারই অশ্বশালা থেকে। এ ছাড়া তার হাজার হাজার গরু ও ভেড়া ছিল। শিষ্যদের বিদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমের কাজও করতে হত। অঙ্গিরা নিজেও কাজ করত কারণ কায়িক পরিশ্রম না করলে সকলের খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান হতে পারে না।
তক্ষশিলার পূর্বদিকের অধিকাংশ পাহাড় ছিল সুজলা সুফলা। একদিন বরুণ ও পাল একদল বিদ্যার্থীর সঙ্গে পশুচারণ ভূমিতে কাজে লিপ্ত ছিল। তাঁবু থেকে অনতিদূরে শ্বেত ও লোহিতাভ বর্ণের গো-বৎস খেলে বেড়াচ্ছিল। ঋষি অঙ্গির শিষ্যদের মাঝে বসে তকলি কাটছিল আর অতীত ও বর্তমানের আর্য ও অনার্যের রীতি, নীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের মধ্যে কোনটা গ্রহণীয় আর কোনটা বর্জনীয় – তার ব্যাখ্যা করছিল।

“বৎস! যা কিছু নতুন তা সবই পরিত্যাগ করতে হবে, অথবা প্রাচীন হলেই তা গ্ৰহণযোগ্য – এই ধরনের কথা খুবই ভুল। আর এই আপ্তবাক্যকে কাজে লাগানো তো একেবারেই অসম্ভব। কক্ষু নদীর তটভূমিতে আর্যরা যেদিন পাথরের অস্ত্রাদি ছেড়ে উন্নত ধরনের তামার অস্ত্র ব্যবহার করতে শিখল সেদিন কত লোকই না নতুন হাতিয়ারের বিরুদ্ধতা করেছিল।”
শিষ্য বরুণ প্রশ্ন করল, “পাথরের অস্ত্রাদি দিয়ে কিভাবে কাজ চলত?”
“বৎস, আজ তামার প্রচলন হয়েছে তাই তামার হাতিয়ার খুবই তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর চেয়েও তীক্ষ্ণ কোনো ধাতুর হাতিয়ার গড়া হবে তখন আবার মানুষ হয়ত তোমার মতো প্রশ্ন করবে তামার হাতিয়ার দিয়ে কিভাবে কাজ চালাত।মানুষ যখন যে হাতিয়ার সংগ্রহ করতে পারে, তখন তাই দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয় — সেইভাবেই তারা অভ্যস্ত হয়। যখন পাথরের কুড়ুল দিয়ে যুদ্ধ করত, তখন উভয় পক্ষের যোদ্ধাদের পাথরের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু যে-ই একপক্ষ তামার তরবারির ব্যবহার শিখল তখনই অপর পক্ষের কাছে পাথরের কুড়ুল ত্যাগ করে তামার তরবারি ব্যবহার করা অপরিহার্য হয়ে উঠল। আর তারা যদি তা না করত, এ দুনিয়াতে তাসের কোনো চিহ্ন থাকত না। তাই আমি বলছিলাম, সমস্ত নতুন চিন্তাধারা পরিত্যাজ্য এ কথা খুবই ভুল। আমি নতুনদের বিরোধী হলে এত সুন্দর সুন্দর ঘোড়া, গরু প্রতিপালন করতে পারতাম না। আমি জেনেছিলাম যে, ভালো ঘোড়ার বাচ্চা পেতে হলে ভালো জাতের ঘোটক ঘোটকীর মিলন চাই। তাই আজ পঁয়ত্রিশ বছর পরে এ-জাতীয় শ্রেষ্ঠ ঘোটক-ঘোটকী দেখতে পাচ্ছ।

“অসুররা ক্ষেতের জমি ভালোভাবেই দেখা-শোনা করত, তাতে ভালো সার দিত। তারা পাহাড়ী নদী থেকে খাল কেটে সেচের যে ব্যবস্থা করত – তা যে খুব উঁচু ধরনের এ কথা আমরা স্বীকার করি। তাদের শহর গড়ার কায়দা ও চিকিৎসার নানা রকম ভালো ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করেছি। এ কথা ভাবলে চলবে না যে, এটা নুতন না পুরনো, এটা আৰ্য না অনার্য – খাওয়া-পরা ও জীবনধারণের মানকে উন্নত ও সহজ করার জন্যে যত রকম জিনিস পাওয়া যায়, তাকে স্বীকার করে কাজে প্রয়োগ করতে হবে। আগে আর্যরা কার্পাস তুলার ব্যবহার জানত না, সূতী বস্ত্রের নাম পর্যন্ত শোনেনি। কিন্তু এখন আমরা শ্ৰীষ্মকালে সূতী বস্ত্র পরি, গরমের দিনে এই কাপড় খুবই আরামদায়ক। এইভাবে নতুন জিনিস আমরা যেমন গ্রহণ করেছি তেমনি অনেক কিছু বর্জনও করেছি। এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলো বিষের ন্যায় পরিত্যাগ করা উচিত। অসুরদের লিঙ্গপূজা, তাদের ধর্ম অনুসরণ করা যেমন আমাদের পক্ষে নিন্দনীয়, তেমনি তাদের জাতি-বিভাগও বর্জনীয়। জাতি-বিভাগের জন্যেই মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে অস্ত্ৰধারণ করে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।এতে শুধু নিজেদের মধ্যে ছোট ও বড়, উঁচু-নীচু এই চিন্তার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ কথাও ঠিক যে, অসুরসের সঙ্গে আমাদের রক্তের মিশ্রণ হওয়া উচিত নয়, কেন না, তাতে আমাদের অসুরবৃত্তি গ্রহণেরই পথ উন্মুক্ত হবে। আর এর ফলে আর্যভাষীদের মধ্যেও নানা শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ছোট ও বড় জাতিবিভাগ দেখা দেবে।”
পাল প্রশ্ন করল, “রক্তের সংমিশ্রণকে প্রত্যেকটি আর্যভাষী খুব অনুচিত কাজ বলে মনে করে কি?”
জবাবে ঋষি,“ হ্যা, তবে এর জন্যে তারা ততো বেশী মনোযোগ দিতে রাজী নয়। আর্যভাষীরা অসুর কিম্বা কোল স্ত্রীসের সঙ্গে সমাগম করে।”
বরুণ, “সীমান্তের লোকেরা এ কথা বলেই থাকে যে, আমাদের যোদ্ধারা অসুরপুরীর বারাঙ্গনাদের কাছে হামেশাই যাতায়াত করে।”
ঋষি বলল, কথাটা ঠিক। কিন্তু, এর পরিণাম কি? এর ফলে বাড়বে বর্ণ-সঙ্করতা।

অসুরদের মধ্যেও পীতকেশ বালক-বালিকা জন্ম নেবে। ভ্রমবশত আর্যরা এদের নিয়ে আসবে নিজেদের পরিবার পরিজনদের মধ্যে, তখন আর্য-রক্তের বিশুদ্ধতা কোথায় থাকবে? আর এই রক্ত-শুদ্ধতার জন্য চাই সমস্ত আর্য স্ত্রী-পুরুষের জাতীয় সচেতনতা। আর এর জন্য চাই, আর্যদের মধ্যে দাসপ্রথা কিছুতে প্রবেশ করতে না পারে, তার ব্যবস্থা। কারণ, এর মতো রক্তের শুদ্ধতা নষ্টকারী সর্বনাশা জিনিস আর কিছুই নেই। আর্য জনপদে অনার্যরা যাতে কিছুতেই প্রবেশ করতে না পারে তারও ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। সবচেয়ে বিপদজনক ও সকল মন্দের মূলে আছে অসুরদের রাজ-প্ৰথা, আর এরই অপর অঙ্গ হচ্ছে পুরোহিত প্রথা। অসুর-জন তাদের সমস্ত অধিকার হারিয়ে বসে আছে। অসুর জনের কোনো স্বাধীনতা নেই, অসুর-রাজা যা বলবে সেই মতো কাজ করা অসুররা ধর্ম বলে মনে করে। অসুরদের পুরোহিতরা শেখায় যে, জনগণের ভালো-মন্দের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। ওপরে ভগবান, আর নীচে তার প্রতিনিধি রাজা। এই ধর্মমত অনুসারে সাধারণের কিছু বলবার বা করবার নেই। ধরিত্রীতে স্বয়ং রাজাই হচ্ছে দেবতা। তাই আমি যখন শুনলাম, শিবি-সৌবীররা ইন্দ্ৰ পদ তুলে দিয়েছে তখন খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। যদিও এ কথা ঠিকই যে অসুর-রাজের স্থান ইন্দ্র কোনোদিনই অধিকার করতে পারেনি। আর্যদের মধ্যে ইন্দ্রের স্থান হচ্ছে – জন কর্তৃক নির্বাচিত একজন বড় যোদ্ধা বা সেনাপতি মাত্র। জনের ওপর শাসন করার কোনো অধিকার তার নেই। তবুও ওই পদ থেকে ভবিষ্যতে বিপদের আশঙ্কা ছিল এবং কিছু লোক ওই পদের আড়াল থেকে আর্যভামীদের মধ্যে রাজ-প্রথা কায়েমের চেষ্টাও করেছিল।আর্যভাষীরা যদি নিজেদের আর্যত্ব বজায় রাখতে চায় তা’হলে কাউকেই রাজ-অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না, আর উচিতও হবে না।  কিন্তু যেদিন অসুরদের মতো রাজপদের সৃষ্টি হবে সেই দিনই অসুরদের মতোই পুরোহিতদেরও আবির্ভাব ঘটবে। আর এ-সব হলেই বুঝবে যে, আর্যভাষীদের আর্যত্ব নষ্ট হয়েছে। সমগ্র জন পরিশ্রম করবে, আর সেই আর সেই পুরশ্রমের ফলভোগ করবে রাপদে আসীন একজন ব্যক্তি। এর ওপর আছে পুরোহিত, পুরোহিতকে উৎকোচ দিতে পারলে ভগবানের আশীর্বাণী পাওয়া যাবে। এইভাবে রাজা ও পুরোহিতে মিলে সমগ্ৰ জনকে তাদের দাস করে ছাড়বে। আমাদের আর্যভাষীদের প্রাচীন রীতি-নীতিকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আঁকড়ে থাকতে হবে। এবং যেখানেই কোনো আর্যজন ব্যতিক্রম ঘটাবে — তাদের আর্য-শ্রেণী থেকে দূর করে দিতে হবে।”

(৩)

সৌবীরের (তৎকালীন সৌবীর দেশ বর্তমান করাচীর কাছে) দক্ষিণ অঞ্চল থেকে এখানে নানা রকমের দুঃসংবাদ আসতে থাকায় বরুণ ক্রমেই চিন্তান্বিত হয়ে পড়ছিল। সে বুঝতে পারছিল যে, অসুরদের শেষ দুর্গের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আর্যদের নিজেদের মধ্যে এক ভয়ংকর আত্মকলহের ঝড় আসন্ন।বরুণ কয়েকবারই সৌবীরেরে সমস্যা নিয়ে গুরুর সঙ্গে আলোচনা করেছিল। ঋষি অঙ্গিরার বক্তব্য ছিল যে, হতে পারে এই ঝগড়ার সূত্রপাত সৌবীরের মধ্যেই শুরু হয়েছে, কিন্তু এ কথা ঠিকই যে, এই বিরোধ একদিন সারা আর্য

জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আর্যভাষীরা চিরকাল জনের (সমষ্টির) অধিকারকে ব্যক্তির অধিকারের ওপর স্থান দিয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি অসুরদের রাজসত্তার এই নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচারিতা ও ভোগবিলাসিতার নিদর্শন অনেক আর্যভাষী নেতাকে ক্ষমতালোভী ও আত্মসর্বস্ব করে তুলবার আশঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই দুই মনোবৃত্তির সংঘাতও ছিল অবশ্যম্ভাবী, আর যে জনপদে অসুররা সংখ্যায় বেশী – সংঘর্ষের সম্ভাবনাও সেখানে বেশী; কারণ পরাজিত অসুররা আর্যদের এই আত্মঘাতী সংঘর্ষ থেকে লাভবান হতে চেষ্টা করবে এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক।

সৌবীরপুর থেকে দুঃসংবাদ আসতে থাকায় বরুণ আট বছরের আবাসন্থল গান্ধারপুর  ছেড়ে দেশে ফিরতে মনস্থ করল। এখানে আসার পথে ঋষি শিষ্যদের মধ্যে প্রথম যাকে পথ-চলা সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিল সেই পুরাতন বন্ধু পাল মাদ্র তার সহযাত্রী হল। গান্ধারপুরের সীমানা অতিক্রম করে তারা লবণ-পাহাড়ের পথ ধরে সিন্ধু জনপদে প্রবেশ করল। লবণের খনিতে কর্মরত ব্যাপারী ও শ্রমিকদের মধ্যে অসুরদের সংখ্যা বেশী, আর এদের প্রভাব গীতকেশী আর্যভাষীদের ওপর পড়েছিল। আর্যরা ইতিমধ্যেই অলস ও আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদের কাজগুলো অনার্য কারিগর দিয়ে করিয়ে নিত। তারা ভাৰত তরবারি নিয়ে অস্ত্রচালনা করা বা অশ্বারোহণ করাই তাদের একমাত্র উপযুক্ত কাজ। অসুর-রাজ যেমন অন্যের ওপর নিজে প্রতিপত্তি দেখাত তেমনি একইভাবে অনার্যদের ওপর ছোট ছোট প্রতিপত্তি খাটাতে গিয়ে আর্দের মনে রাজসত্তার অঙ্কুর উদগমের ভূমি প্রস্তুত হতে লাগল। দুই বন্ধু ধীর পদে লবণ-পাহাড় অতিক্রম করে এসে পৌঁছাল সৌবীর সীমান্তে (এই স্থানকে বর্তমানে মূলতান বলা হয়), এখানকার অবস্থা কিছুটা উন্নত মনে হল।এখানকার সমস্ত অধিবাসী আর্য আর জনের পক্ষে সেটা ছিল খুবই গর্বের ব্যাপার। এখানকার ভীষণ গরম সহ্য করে জনপদকে এরা পুরোপুরি আর্যভাষী জনপদে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বরুণ ও পাল সিন্ধু নদের ওপর দিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছিল, তাই সময়টা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি হলেও পুরো কষ্টটা তারা পায়নি। তবু সৌবীর নগরের আবহাওয়া ছিল অত্যাধিক গরম, তার প্রভাব অবশ্যই কিছুটা পড়েছে।

আর্যরা তখন পর্যন্ত অক্ষর আবিষ্কার করতে পারেনি। তখন এদের মধ্যে লেখার সঙ্কেত (লিপি)প্রচলিত হয়নি।তারই বরুণ মাঝে মাঝে সৌবীরের পখথকদের মারফতে তার মিত্রদের কাছে যে সমস্ত সংবাদ পাঠাত তা পুরোপুরি কোনোদিনই পৌঁছাত না। এই সময় অসুরদের মধ্যে প্রচলিত লিপির কথা তার মনে আসত।

সৌবীরপুরে পৌঁছে সে বুঝতে পারল যে, অবস্থা অনেক দূর গড়িয়েছে। খাস সৌবীরপুরে সুমিত্রের সমর্থক কম ছিল; কিন্তু দক্ষিণ সৌবীরপুরে অসুরদের শেষ দুর্গ ধ্বংসকারীদের মধ্যে বহু আৰ্য সুমিত্রের পক্ষ গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত ছিল। এই শেষ দুর্গটির পতনের পর সেনাপতি সুমিত্র অসুর নাগরিকদের প্রতি অতিরিক্ত অনুকম্পা দেখিয়েছিল বলে বরুণ সেই সময় তার খুব প্রশংসা করেছিল। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারল যে, সেটা ছিল সুমিত্রের একটি চালমাত্র। সুমিত্র জানত যে, অসুররা আর কোনোদিনই আর্যদের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারবে না। তাই তাদের ওপর এই অনুকম্পা দেখিয়ে সাগরপারের সার্থবাহ অসুরদের সম্পত্তি ও তাদের শক্তির সাহায্যে নিজের ব্যক্তিগত লোভ চরিতার্থ করতে পারবে৷

সুমিত্র তখনো সমুদ্রতীরের অসুরপুরী আপন সৈন্য দিয়ে দখল করে রেখেছিল আর কাল্পনিক যুদ্ধ পরিচালনার অজুহাত সৃষ্টি করে সেখান থেকে ফেরবার নাম পর্যন্ত করত না।সাধারণ দলপতিদের সঙ্গে দেখা করে বরুণ বুঝতে পারল যে, তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, তারা ভাবত ব্যক্তিগত আক্রোশের ফলে কোনো কোনো জন-নায়ক সুমিত্রের বিরোধিতা করছে। বরুণ যখন জনের শাসনভারপ্রাপ্ত প্রধান জন-নায়কের সঙ্গে দেখা করল। তখন সে বরুণকে সমস্ত কথা বুঝিয়ে বলল এবং বলল যে, সুমিত্রের উদ্দেশ্য যদিও তার কাছে খুবই স্পষ্ট, তবু এ কথা ঠিকই যে, জনের সাধারণ মানুষ এখনো সুমিত্রের আসল মতলবের কথা জানে না, তারা তাকে অন্যভাবেই দেখে।

অসুরপুরী আক্রমণের সময় বরুণ ছিল সুমিত্রের সাহসেনাপতি। ইতিমধ্যে যদিও ন’টা বছর কেটে গেছে; তবু আজও তার তরবারি চালনার প্রশংসা থেমে যায়নি। জনকে বোঝাবার আগে নিজেই অসুরপুরীতে গিয়ে সুমিত্র সম্পর্কে সঠিক সংবাদ নিয়ে আসা মনস্থ করল। এই উদ্দেশ্যে দুই বন্ধু একদিন দক্ষিণ সৌবীর যাত্রী একটি নৌকায় আরোহণ করল। তারা নিজেদের গাদ্ধারদেশীয় বণিকের বেশে সুসজ্জিত করেছিল। অসুরপুরী দেখে তাকে কিছুতেই আর্যভাষীদের নগরী বলে মনে হয় না – তা সত্যি সত্যি অসুরদের পুরী ছিল। তখনো তা আৰ্যনগরী হয়নি। শহরের পণ্যবীথি প্রাসাদমালায় পূর্ণ ছিল, ছিল সমুদ্রযাত্রী অসুর বণিকদের নিয়ে আসা নানা দেশের বাণিজ্য সম্ভার। বহু সামন্ত অসুর-পরিবার তাদের আপন আপনি পল্লীতে আগের মতোই বসবাস করছিল, তাদের গৃহে পূর্ণের মতো শৃঙ্খলিত বন্দী দাস-দাসী অপেক্ষা করছে বিক্রি হওয়ার জন্যে। এইসব দেখতে দেখতে ওদের মনে প্রশ্ন উঠল, এই পরিবেশে বিজয়ী আর্যরা কোথায়? সুমিত্র নিজেও অসুর-রাজের পুরাতন ব্রাজপ্রাসাদে বাস করে।

একদিন বরুণ, পাল মাদ্রকে সুমিত্রের কাছে পাঠাল — গান্ধার বণিকের কাছ থেকে উপঢৌকন নিয়ে যাবার ছিল করে। পাল ফিরে এসে বলল, পীতকেশ ও গৌরবর্ণ বাদ দিলে সুমিত্ৰ এখন পুরোপুরি একটি অসুর-রাজ বনে গেছে। তার প্রাসাদ আর আর্যভাষী সেনাপতির সরল অনাড়ম্বর বাসস্থান নয়, রৌপ্য অলঙ্কারে ঝলমল অসুর- রাজের প্রাসাদকক্ষের মতোই সুসজ্জিত। তার পার্শ্বচর সৈনিকদের মধ্যেও অনাড়ম্বরতার কোনো চিহ্ন নেই। সপ্তাহ যেতে না যেতেই তারা ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করে বুঝল – এখন আর্যভাষী সেনানায়কদের খবর নিতে হলে অসুর কন্যাদের নৃত্য ও সূরাপানের আড্ডাগুলিতে সন্ধান করতে হবে। বহু আর্যভাষী রমণী তাঁদের স্বামীদের কাছে এসে গৃহসংসার পাততে চায়, কিন্তু নানা অজুহাত দেখিয়ে তাদের আসতে মানা করা হচ্ছে। সুমিত্র তার স্ত্রীর কাছ থেকে বহু অনুরোধ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে আসতে নিষেধ করেছে, এদিকে সে নিজে অসুর পুরোহিতের কন্যাকে প্রেম সমর্পণ করছে। শুধু তাই নয়, এ নগরীর বহু অসুর-সুন্দরী তার অন্তঃপুরচারিণী। নিজের পার্শ্বচর আর্য সৈনিকদের জন্যে এ ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ শিথিলতা ছিল। কিন্তু অন্য আর্যভাষীরা যদি এখানে যাতায়াত শুরু করত তাহলে অনার্থ দাসদের দিয়ে দাঙ্গা বধিয়ে দিত ফলে বাইরের আর্যভাষীরা এখানে আসা বন্ধ করেছে।

বরুণ পুরোপুরি খবরাখবর নিয়ে তার বন্ধুর সঙ্গে চুপচাপ সৌবীরপুরে ফিরে এল। সৌবীরপুরে এসে জন-নায়কদের বলল যে, সুমিত্র ইতিমধ্যে তার শক্তি যথেষ্ট দৃঢ় করেছে। অসুরপুরের শুধু আৰ্যশক্তিই নয় – অসুরদের বিরুদ্ধেও আমাদের যুদ্ধ করতে হবে, আর এ জন্যে তৈরী হয়েই সমস্ত কথা সাধারণ মানুষকে বলতে হবে।

বরুণ ছিল নাচের আসরের প্রিয় পাত্র। বছরের পর বছর যে সমস্ত স্ত্রীরা স্বামীদের জন্যে বৃথাই অপেক্ষা করে বিরহ সহ্য করছে তারা যখন এই সুন্দর নর্তকের মুখে তাদের স্বামীদের কীর্তিকলাপ শুনল তখন তা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করল। ক্ৰমেই এক থেকে অপর কান খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কথাটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। বরুণ নিজে ছিল  একজন কবি, পতি-বিরহিনী আর্য রমনীদের জীবনীতে অসুর কন্যাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ উপলক্ষে সুমিত্রের বিলাসপূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ-সর্বস্ব জীবনের আলেখ্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর গান রচনা করল। এই গান ক্রমেই দাবানলের মতো সারা সৌবীরের আর্য গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে গেল —মুখে মুখে গীত হতে লাগল। কিছু কিছু আর্য স্ত্রীরা যাতে তাদের স্বামীর কাছে যায় তার ব্যবস্থা করা হল। স্বামীদের কাছে তিরস্কৃত হয়ে তাদের ফিরে আসার পরিণাম আরও খারাপ হল। এবার সুমিত্ৰকে সৌবীরপুরে ফিরে আসতে বলা হল এবং সে ফিরে আসতে অস্বীকার করায় তার স্থলে বরুণকে সেনানায়ক নিযুক্ত করে বৃহৎ আর্যবাহিনীর সেনাপতি হিসাবে বরুণকে পুরোভাগে রেখে অসুরপুরীতে অভিযান শুরু হল। বরুণের আগমন বার্তায় সুমিত্রের সৈন্যদের মধ্যে ভাঙন ধরুল এবং অনেকেই নিজেদের অনার্য ব্যবহারের জন্যে অনুতপ্ত হল। অবশিষ্ট সৈন্যদের সাহায্যে সুমিত্রর জিতবার আশা ছিল না, তাই সে বরুণের হাতে নগর সমর্পণ করে সৌবীরপুরে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। এইভাবে আর্য-জন প্রথমবারের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। বরুণ অসুরদের প্রতি কোনো প্রকারের দয়া প্রদর্শন করল না। অসুরদের কাছে কোনো অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও এবং তারা কোনো যুদ্ধ না করলেও বরুণ তাদের রেহাই দিল না। আর্যরা যাতে অসুরদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে পারে তার জন্যে এক আলাদা আর্যনগরী নির্মাণ করে ঋর্ষি অঙ্গিরা বর্ণিত – শিক্ষাকে কাজে লাগানো হল।*

[*প্রায় দেড়শত পুরুষ আগেকার কাহিনী।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *