০৩. অধ্যবসায়, পরিশ্রম, বিশ্বাস ও সহিষ্ণুতা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অধ্যবসায়, পরিশ্রম, বিশ্বাস ও সহিষ্ণুতা

যে কাজই কর, প্রথম বারেই যে কৃতকার্য হবে তা নয়। চেষ্টার দ্বারা ব্যর্থতা জয় করতে হবে। চেষ্টা কর, বারে বারে আঘাত কর, তোমার চেষ্টা ফলবতী হবে।

কে কবে ভাগ্যবলে বড় হয়েছে? সাধনা ও পরিশ্রম ব্যতীত কে অর্থ ও সম্মান লাভ করেছে?

বড় মানুষ যারা তাদেরও গৌরব-সম্মানের মূলে অনেক বছরের ধৈর্য ও সাধনা আছে; যে সমস্ত মানুষ ব্যর্থতাকে ভয় করে না–জয়ী হবে, এ বিশ্বাসে যারা কাজ করে তারাই জয়ী হয়। লেখাপড়া তুমি জান না, তোমার মধ্যে যদি শুধু এই দুটি গুণ থাকে, তাহলে তুমি বড় হতে পার! সে দুটি গুণ, অধ্যবসায় ও বিশ্বাস।

প্রতিভাবলে অনেক মানুষ অসাধারণ কাজ করে, কিন্তু বহু বছরের সহিষ্ণু সাধনার কাছে প্রতিভার কোন মূল্য নাই। কাজ কর, ধীর শান্ত হয়ে তুমি তোমার কর্তব্য করে যাও, প্ৰতিভা তোমাকে দেখে সঙ্কোচ বোধ করবে।

জগতে বহু মানুষ জন্মেছেন। তাদের মধ্যে প্রতিভাবান অপেক্ষা পরিশ্রমী মানুষই অধিক। এক লেখক বলেছেন-প্রতিভার অর্থধৈর্য ও পরিশ্রম।

নিউটন বলেছেন—আমার আবিষ্কারের কারণ আমার প্রতিভা নয়। বহু বছরের পরিশ্রম ও নিরবচ্ছিন্ন চিত্তার ফলেই আমি আমাকে সার্থক করেছি; যা যখন আমার মনের সামনে এসেছে, শুধু তারই মীমাংসায় আমি ব্যস্ত থাকতাম। অস্পষ্টতা হতে ধীরে ধীরে স্পষ্টতার মধ্যে উপস্থিত হয়েছি।

ডাক্তার বেনটলেকে তিনি একবার বলেছিলেন-মানব সাধারণের যদি কোন কল্যাণ আমার দ্বারা হয়ে থাকে, তবে তা আমার অনেক বছরের সহিষ্ণু সাধনার দ্বারাই হয়েছে।

ভলটেয়ার বলেছেন—প্ৰতিভা বলে কোন জিনিস নাই। পরিশ্রম কর, সাধনা কর-প্রতিভাকে গ্রাহ্য করতে পারবে।

লোকে বলে সব মানুষ কবি হতে পারে না। বক্তা হওয়াও ঈশ্বরের দেওয়া গুণ, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।

ডালটনকে লোকে প্ৰতিভাবান বলতো। তিনি অস্বীকার করে বলতেন– পরিশ্রম ছাড়া আমি কিছু জানি না।

পরিশ্রম, পর্যবেক্ষণ ও সহিষ্ণু সাধনার সম্মুখে কিছু অসম্ভব নয়।

জগৎ ও সমাজ যারা গড়ে তুলেছেন, তারা যে সব প্ৰতিভাবান অসাধারণ, বিশিষ্ট-ক্ষমতায় ভাগ্যবান ছিলেন তা নয়। তারা ছিলেন পরিশ্রমী এবং সহিষ্ণু সাধক।

প্ৰতিভাকেও যদি সাধনা বা পরিশ্রম দ্বারা উজ্জ্বল করে না তোলা যায়, তবে তার আদর হয় না। জগতের কল্যাণে তা বড় আসে না।

স্যার রবার্ট পিল যখন বালক, তখন তার বাপ তাকে একখানা ছোট টেবিলের উপর তুলে দিয়ে বক্তৃতা দিতে বলতেন। প্রথম প্রথম কিছু হতো না। কিন্তু বারে বারে চেষ্টা করার ফলে বালকের শক্তি জেগে উঠল। শেষ বয়সে তিনি বলতেন তার অসাধারণ বাগিতা ও তর্ক করার ক্ষমতা সেই ছেলে বয়সের সাধনার মধ্যেই ছিল।

ধীর হয়ে লেগে থাক, তোমাকে দুঃখ করতে হবে না। ধীরভাবে লেগে থাকাই হচ্ছে কৃতকার্য হবার পথ। হাল কখনও ছেড়ে না। তরী জেগে উঠবে।

ভাল রকম কাজ করতে হলে তোমাকে অসহিষ্ণু হলে চলবে না। সে যে কাজই হোক না। এক বাদককে এক যুবক জিজ্ঞাসা করেছিল–বাজনা শিখতে আমার কত দিন লাগবে? তিনি বলেছিলেন–প্ৰত্যহ ১২ ঘণ্টা করে যদি পরিশ্রম কর, তাহলে বিশ বছর লাগবে।

এক পণ্ডিত বলেছেন-যে ব্যক্তি ধীরভাবে অপেক্ষা করে, সে-ই সফল হতে পারে। বস্তুত কত কাল অপেক্ষা করতে হবে, তা কে জানে? আশায় বুক বেঁধে খোদাকে ভরসা করে কাজ করতে থাক, তুমি সফল হবে।

সাধনাকে আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করে তোল। কবে তুমি কৃতকার্য হবে, সে কথা ভেবো না। তাহলে সাধনায় ক্লান্তি আসবে। ব্যর্থতা তোমাকে ভেঙ্গে দেবে, আনন্দ ভরা, সাধনা-নিয়ত ফল সম্বন্ধে উদাসীন তোমার মন ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে তোমার গন্তব্য স্থানে নিয়ে যাবে। শুভ প্ৰভাতে দেখতে পাবে, তোমার মাথা বিজয়-মুকুট শোভিত হয়েছে। তুমি নিজেই জয়ে বিস্মিত হবে।

আশাশূন্য ও নিরানন্দ মনে কোন কাজ করো না। পাদরী উইলিয়ম ক্যারি যেমন উদ্যমশীল কমী পুরুষ ছিলেন, তেমনি তিনি তার কর্ম সম্বন্ধে আশা ও বিশ্বাস পোষণ করতেন। শ্ৰীীরামপুর কলেজ তাঁরই চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

এক সময় এই বরেণ্য পুরুষকে এক ব্যক্তি মুচির ছেলে বলে উপহাস করেছিল। ক্যারি কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে উত্তর করলেন–এতে আমার একটু লজা নেই।

ছোটকালে একবার তিনি এক গাছে উঠতে যেয়ে পা ফসকে পড়ে যান। ফলে একখানা পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। কয়েক মাস পরে বিছানা থেকে উঠে পুনরায় সেই গাছে উঠলেন, তবে ছাড়লেন। এইখানেই মহাপুরুষদের জীবনের বিশেষত্ব!

দার্শনিক ইয়ং বলতেন, মানুষ যা করেছে, মানুষ তা পারবে। এর সম্বন্ধে একটা মজার গল্প আছে। একবার তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। এর আগে তিনি কখনো ঘোড়ায় চড়েননি, সেইবার প্রথম। বন্ধু খুব ভাল ঘোড়সোয়ার, তিনি অবাধে একটি উচু বেড়া পার হয়ে গেলেন। ইয়ং-এরও ইচ্ছা! হলো, বেড়া টপকে যান। যে কোনকালে ঘোড়ায় চড়েনি, তার পক্ষে কাজটা সহজ নয়। লাফ দিতে গিয়ে ঘোড়া হতে পড়ে গেলেন। ক্ষুন্ন না হয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করলেন। এবারে ঘোড়া থেকে পড়লেন না ঠিক, কিন্তু ঘোড়ার গলা জড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আবার চেষ্টা। এবার কৃতকার্য হলেন।

বিশ বছর পরিশ্রম করে নিউটন একখানি বই লেখেন। তাঁর প্রিয় কুকুর একটা জ্বলন্ত বাতি ফেলে এই বইখানি মুহুর্তের মধ্যে ছাই করে দিয়েছিল। বিশ বছরের পরিশ্রমজাত-চিন্তা হঠাৎ সর্বনাশ হয়ে গেল। নিউটনের খুব দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য সহিষ্ণুতা! তিনি দমলেন না। আবার সেই বই লেখা আরম্ভ করলেন এবং শেষ করলেন।

কারলাইল ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস লিখে এক প্রতিবেশী সাহিত্যিককে পড়তে দেন। বন্ধু মহোদয় বইখানি ভুলবশত বাইরেই ফেলে রাখেন। ফলে বইখানি হারিয়ে গেল। অনুসন্ধানে জানা গেল বাড়ীর চাকরাণী বাজে কাগজ মনে করে সেই মূল্যবান গ্ৰন্থখানি পুড়িয়ে ফেলেছে।

কারলাইল যখন এই ভয়ানক সংবাদ শুনলেন, তখন তার মানসিক অবস্থা কি তা অনুমানসাপেক্ষ।

এই পুস্তক নতুন করে লিখতে কারলাইলকে কত কষ্ট পেতে হয়েছিল, তা বলা যায় না। না লিখে উপায় ছিল না। কঠিন অধ্যবসায়, ধীরতা এবং মনের বলে তিনি আবার সেই বই লিখলেন। কারলাইলের এই ধীরতা ও মনের বল যারপরনাই বিস্ময়াবহ। জর্জ স্টিফেনসন তাঁর ছেলেদিগকে বলতেন– তোমাদিগকে কি বলবো–আমাকে অনুসরণ করো-আঘাতের পর আঘাত করো!

ওয়াট ত্ৰিশ বছর ধরে পরিশ্রম করে জগৎকে ঋণী করে গিয়েছেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সাধনা-কম নয়! কমতি-দি-বাফুন দেখিয়েছেন, ধীরভাবে পরিশ্রম করলে আমরা কত বড় হতে পারি। তিনি বলতেন-প্ৰতিভা মানে ধৈর্য ও পরিশ্রম। বাফুনের স্মরণশক্তি ছিল না, কিন্তু সাংসারিক অবস্থা ছিল খুব ভাল। ফলে স্বভাবে কুড়েমি ঢুকেছিল। অনেক বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকা তার একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক চিন্তা করেও তিনি এই রোগ হতে অব্যাহতি না পেয়ে, শেষকালে উপায়ান্তর না দেখে ভৃত্য যোসেফকে বলেন-কাল হতে সকাল সকাল তুমি আমায় উঠিয়ে দেবে। প্রত্যেক দিনের জন্য পুরস্কার এক টাকা। পরদিন বেচারা যোসেফ প্রভুকে উঠাতে গিয়ে কিল-ঘুষি খেয়ে ফিরে এল। বাফুন যখন দুপুর বেলা যোসেফসে তার কর্তব্য কাজের অবহেলার জন্য খুব তিরস্কার করলেন, তখন মনে মনে পণ করলো, পরের দিন প্রভুকে যেমন করেই হোক উঠবে। সকাল বেলা বিছানার কাছে যেয়ে যোসেফ আগের দিনের মত প্ৰভুকে উঠাতে চেষ্টা করলো, ঘুমের ঘোরে। প্ৰভু ভৃত্যকে গালি দিলেন। বললেন—আমার অসুখ হয়েছে। রাত্রিতে ভাল ঘুম হয়নি—যাও, বিরক্ত করো না। প্রভুর কথা অমান্য করলে চাকরি থাকবে না-ইত্যাদি। যোসেফ ফিরে গেল।

পরদিন প্রভুকে উঠাতে যেয়ে যোসেফ কোন কথাই শুনলো না। প্ৰভু কিছুতেই ঘুম থেকে উঠবেন না-যোসেফও নাছোড়বান্দা। বালতি ভরা ঠাণ্ডা পানি প্রভুর বিছানার উপর সে যখন ঢেলে দিল, তখন বাফুনকে বাধ্য হয়ে আরাম ছেড়ে উঠতে হলো। যোসেফ পুরস্কার লাভ করলো!

প্রত্যহ নয় ঘণ্টা করে চল্লিশ বছর ধরে বাফুন পরিশ্রম করেন। পরিশ্রম না করে তিনি থাকতে পারতেন না। সেটা তাঁর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তাঁর জীবনচরিত রচয়িতা লিখেছেন—খেলার চেয়ে কাজই তার আমোদের জিনিস বেশী ছিল। অনবরত পড়তে তাঁর কোন কষ্ট হতো না।

এক একখানা বই তিনি কতবার করে বদলিয়েছেন–লিখেছেন। পুস্তক প্রণয়নে কোন সাহিত্যিক বোধ হয় বাফুনের মত পারেন নাই।

পঞ্চাশ বছর ভেবে তিনি একখানি বই লেখেন; আশ্চর্য!—এতেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নাই। একবার, দু’বার এমনি এগারবার তিনি সেই বইখানা লেখেন।

বাফুনের মত ধৈৰ্য আর কারও ছিল না।

পীড়ার মধ্যে থেকেও তিনি বড় বড় বই লিখেছেন। কাজে থাকাই ছিল। তাঁর আনন্দ ও শান্তি।

স্যার ওয়ালটার স্কট পরিশ্রমী ছিলেন। অফিসের কাজের সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞানালোচনা ও সাহিত্যসেবা করতেন। অফিসের কাজ কম নয়—তার উপর সাহিত্যসেবার কঠিন পরিশ্রম!

ভোর পাঁচটার সময় উঠে নিজেই চুলো ধরাতেন, একটু কিছু খেয়ে বই-এর বোঝা সামনে নিয়ে সাহিত্যসেবায় বসে যেতেন। ছেলেপিলে, বউ-ঝিরা ঘুম হতে উঠবার অনেক আগে তিনি অনেক কাজ করে ফেলতেন।

বহু বছরের পরিশ্রম ও গভীর জ্ঞানার্জন সত্ত্বেও স্কট বলতেন—আমি আমার অজ্ঞতার কথা মনে করে লজিত না হয়ে পারি না।

ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপকের কাছে যেয়ে এক ছাত্র বি. এ. উপাধি লাভ করে। বললেন—মহাশয়, আমার লেখাপড়া তো শেষ হয়েছে। কতকাল পরিশ্রম করবো-বাড়ী যেয়ে এখন আরাম করি। অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে উত্তর দিলেন— তোমার জ্ঞানার্জন শেষ হয়েছে? আমি কিন্তু মাত্র আরম্ভ করেছি।

যারা কিছু জানে না। তাদেরই কাজ শেষ হয়ে যায়। মহাপণ্ডিত নিউটন জীবন শেষে বলেছিলেন—জ্ঞানসমুদ্রের বেলায় দাঁড়িয়ে কেবল ধুলোবালি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি—অনন্ত সমুদ্রের কিছুই দেখা হয়নি।

জন ব্রিটনকে তার কাকা দোকান হতে একেবারে অসহায় করে তাড়িয়ে দেন। ব্রিটন যখন ছোট তখন তার বাপ পাগল হয়ে যান। বাপ ছিলেন রুটিওয়ালা।

ব্রিটন তার হোটেলওয়ালা কাকার কাছে থাকত এবং কাজ-কাম করে। কিছু কিছু পয়সা উপায় করতো। হঠাৎ তার অসুখ হয়ে পড়লো—এমন অসুখ যে, তাতে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেল, কাজ করার সামৰ্থ্য রইল না। নিষ্ঠুর কাকা এ ক্ষতি সহ্য করতে পারলেন না। ভাইপোর হাতে গোটা দশেক টাকা ফেলে দিয়ে বললেন— এখানে আর তোমার থাকার দরকার নেই।

এরপর সাত বছরের বালক ব্রিটনের কষ্টের অবধি ছিল না। কিন্তু কোন দিন সে পড়া ত্যাগ করে নাই। সকল অবস্থায় সে একটু-একটু করে জ্ঞানার্জন করতো। স্কুলে যাওয়া হয় নাই বলে বোকার মত চুপ করে বসে থাকত না।

জ্ঞান এবং শক্তি যার মাঝে আছে, সে কোনকিছু পাস করুক আর না করুক, তার উচ্চাসন হবেই, একথা বিলাতের সব লোকে জানে।

ব্রিটনের জীবনী পড়ে জানি, কত কষ্টের তার জীবন। যে ঘরে সে বাস করতো, সে ঘরখানি কত হীন। পায়ে কত সময় জুতো জুটতো না। দারুণ শীতে কত সময় গা খালি থাকতো। কত সময় পকেটে পয়সা থাকতো না। হাতে পয়সা নাই-না পড়লেও চলে না। খানিকক্ষণের জন্য হলেও পরের বই নিয়ে ব্রিটন তাঁর ব্যগ্ৰ মনের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করতো।

যখন তাঁর বয়স আটাশ, তখন প্রথম তিনি গ্ৰন্থকাররূপে আবির্ভূত হন। এরপর পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি সাহিত্যসেবা করেন। জন ব্রিটন মোট সাতশিখানি বই লেখেন। কোন বাধা তাঁর জীবনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে নাই।

জীবনের মালিক তুমি-দুঃখ-বেদনা ও অভাবকে বাধা না মনে করে। সেগুলিকে বরং আশীর্বাদরূপে ধরে নাও। কিছুই তোমার গতিকে রোধ করতে পারবে না। যেমন করে হোক, তুমি বড় হবেই। বুক ভেঙ্গে গেছে-ভয় নাই। ভাঙ্গা বুক নিয়ে খোদা ভরসা করে দাঁড়াও।

এডিনবাৰ্গ শহরের কাছে লাউডেন নামে এক বালক ছিল। তার বাপ ছিলেন একজন কৃষক। বাপ ইচ্ছা করলেন ছেলেকে বাগানের কাজ শিখবেন। এই কাজে লাউডেনকে দিনের বেলা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হতো। খাটুনির মধ্যে বালক লাউডেন সপ্তাহে দুইদিন সারা রাত জেগে পাঠাভ্যাস করতো।

লাউডেনের মনের দৃঢ় বাসনা ছিল, জীবনকে উন্নত ও গৌরবময় করামানুষের কল্যাণ করে জীবনকে ধন্য করা।

একজন সামান্য বালকের মনে এই উন্নত কল্পনা কত সুন্দরা অল্পকালের মধ্যে লাউডেন ফরাসী ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করলো। ফরাসী ভাষা শেখা হলে সে জার্মান ভাষা শেখার জন্য আগ্ৰহান্বিত হলো। জার্মান ভাষাও অল্পকালের মধ্যে তার আয়ত্ত হয়ে গেল।

স্যামুয়েল এবং জেবেজ বলে আরও দুইটি বালক ছিল। তাদের বাপ ছিলেন একজন মুটে। দরিদ্র পিতা দু’ভাইকে এক পাঠশালায় পাঠালেন। জেবেজের বেশ স্মরণশক্তি ছিল। কিন্তু স্যামুয়েল ছিল যেমন দুষ্ট, তেমন বোকা। লেখাপড়ায় সুবিধা হলো না দেখে কিছুদিন পরে বাপ তাকে কাজ শেখাবার জন্য এক জুতোর মিন্ত্রির কাছে দিলেন। সেখানে কাজের চাপে চােখে তার সরষে-ফুল ফুটতে লাগল।

বদমাইশী, আম চুরি এসব কাজে স্যামুয়েলের খুব উৎসাহ ছিল। একবার এক দুষ্টুমি করতে যেয়ে তাকে সমুদ্রের মাঝে নৌকা ড়ুবে প্ৰাণ হারাতে হয়েছিল আর কি। তুমি শুনে বিস্মিত হবে—দুই মাইল সাঁতরিয়ে কুলে উঠে সে প্ৰাণ বাঁচায়।

এই ঘটনার পর থেকেই দুৰ্দাত্ত স্যামুয়েলের স্বভাব বদলে গেল। এই চাের, এই বদমাইশ, এই মাথা-গরম যুবক যে একদিন তার বিদ্যা ও বুদ্ধির দ্বারা জগৎকে চমৎকৃত করবে একথা তখন কে ভেবেছিল?

তার মনের এই দুৰ্দমনীয় উগ্রতা ভাল হবার দিকে ফিরে গেল। জীবনের এই দুর্ঘটনার পর হতে তার স্বভাবে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। সে চাপল্য, সে হঠকারিতা আর রইল না। সে সময় হতে স্যামুয়েল জ্ঞানানুশীলনের দিকে মন দিলেন। যতই পড়তে লাগলেন, ততই নিজের অজ্ঞতা ও মূর্খতা বুঝে লজ্জিত হতে লাগলেন। মনের এই অন্ধকার দূর করবার জন্য ভিতরে এক দুৰ্দম বাসনা জেগে উঠল! এরূপ জীবিকা অর্জনে যে সময় ব্যয় হতো তা ছাড়া বাকী সময় লেখাপড়া করতে লাগলেন। এক মিনিটও তিনি বৃথা সময় নষ্ট হতে দিতেন। না। কাজের ভিড়ে পড়বার সময় যখন পেতেন না, তখন খাবার সময় সামনে একখানা বই রেখে স্যামুয়েল ভাত খেতেন।

বিশেষ একখানা বই পড়ে তার মন আরও উন্নত হয়ে গেল-নিৰ্মল চরিত্র ও আধ্যাত্তিক ভাবাপন্ন হয়ে পড়লেন।

কিছুদিন পরে তিনি স্বাধীন ব্যবসা আরম্ভ করলেন। ধার হবে এই ভয়ে অনেক সময়ে রাতের বেলা না খেয়েই শুয়ে থাকতেন।

ব্যবসা, সাহিত্যসেবা ও জ্ঞানালোচনা করে যে সময বাঁচত, সে সময় তিনি জনসাধারণের সম্মুখে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন।

ঘর-সংসার হলে, ছেলেদের কাই-মই হৈ-চৈয়ের ভিতর, এমনকি রান্নাঘরে বসে তিনি লিখতেন। আর পড়তেন।

শেষ বয়সে তিনি বলতেন-নিতান্ত জঘন্য অবস্থা হতে আমি নিজেকে টেনে তুলেছি। আমার এই সাধনার সঙ্গী ছিল পরিশ্রম, চরিত্র এবং মিতব্যয়িতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *