বেণীসংহার – ৩

বেণীসংহার – ৩

ব্যোমকেশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখল, সদর দরজায় পুলিস পাহারা। কনস্টেবল ব্যোমকেশকে দেখে স্যালুট করল, বলল—‘ইন্সপেক্টর সাহেব নীচের তলায় বসবার ঘরে আছেন।’

প্রশস্ত ড্রয়িংরুমে ইন্সপেক্টর রাখাল সরকার এবং দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর উপস্থিত ছিলেন; মধ্য টেবিল ঘিরে একটা ফাইল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ব্যোমকেশ প্রবেশ করতেই রাখালবাবু তার কাছে এসে দাঁড়ালেন, করুণ হেসে বললেন—‘জড়িয়ে পড়েছি ব্যোমকেশদা। বেণীসংহার নামটা আপনি ঠিকই দিয়েছেন। বেণীসংহার শব্দের আসল মানে শুনেছি খোঁপা বাঁধা; মেয়েরা প্রথমে চুলের বিনুনি করে, তারপর বিনুনি জড়িয়ে খোঁপা বাঁধে। এ ব্যাপারও অনেকটা সেই রকম; এমন জটিল কুটিল তার বাঁধুনি যে বেণীসংহার উন্মোচন করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুনের মোটিভ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সন্দেহভাজন লোকের সংখ্যাও পাঁচজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ; তবু ঠিক কোন্‌ লোকটি এ কাজ করেছে তা ধরা যাচ্ছে না।’

‘এসো, বসা যাক।’ দু’জনে দুটো চেয়ারে ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে বসলেন—‘এবার বলো।’

রাখালবাবু কাল থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তা ব্যোমকেশকে শোনালেন, প্রশ্নোত্তরের ভিতর দিয়েও কয়েকটি তথ্য প্রকাশ পেল। ব্যোমকেশ বলল—‘মোটিভ কি?’

‘বুড়োর অগাধ টাকা। ছেলে এবং মেয়েকে মাসহারা দিত, কিন্তু তাতে তাদের মন উঠত না। ডাক্তার অবিনাশ সেন সন্দেহ করেন, মেয়ে এবং পুত্রবধূ বিষাক্ত খাবার খাইয়ে বুড়োকে মারবার চেষ্টা করছিল। তা যদি হয় তাহলে ছেলে এবং জামাইয়ের মধ্যে ষড় আছে। যা দিনকাল পড়েছে কিছুই অসম্ভব নয়।’

‘মেঘরাজকে মারবার উদ্দেশ্য কি?’

‘মেঘরাজ রাত্রে বেণীমাধবের দোরের সামনে বিছানা পেতে শুতো। দোর ভেজানো থাকত, যাতে বেণীমাধব ডাকলেই সে ঘরে ঢুকতে পারে। সুতরাং তাকে বধ না করে ঘরে ঢোকা যায় না। তাকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকতে গেলে সে জেগে উঠবে। তাই তাকে আগে মারা দরকার হয়েছিল।’

‘মারণাস্ত্রটা পাওয়া যায়নি?’

‘না। তবে ময়না তদন্ত থেকে জানা গেছে যে, অস্ত্রটা খুব ধারালো ছিল। একই অস্ত্র দিয়ে দু’জনকে মেরেছে। অস্ত্রের এক টানে গলা দু ফাঁক হয়ে গেছে।’

‘হত্যার সময়টা জানা গেছে?’

‘স্থূলভাবে রাত্রি বারোটা থেকে তিনটের মধ্যে।’

‘হুঁ। সন্দেহভাজন পাঁচজন কারা?’

‘অজয় ও তার স্ত্রী আরতি, গায়ত্রী ও তার স্বামী গঙ্গাধর। এবং অজয়ের ছেলে মকরন্দ। মকরন্দকে মেঘরাজ একদিন বেণীমাধবের হুকুমে চড় মেরেছিল। ঝিল্লীকে বাদ দেওয়া যায়, সে ছেলেমানুষ, তার কোনো মোটিভ নেই।’

‘মকরন্দ ছেলেটা করে কি?’

‘পলিটিক্সের হুজুগ করে। কলেজে নাম লেখানো আছে, এই পর্যন্ত। সে-রাত্রে আন্দাজ ন’টার সময় বাড়িতে এসেছিল, তারপর রাত্রেই কখন বেরিয়ে গেছে কেউ জানে না। সেই যে পালিয়েছে আর ফিরে আসেনি। তার নামে হুলিয়া জারি করেছি।’

‘বাড়িতে এখন কে কে আছে?’

‘অজয় আরতি গঙ্গাধর গায়ত্রী ঝিল্লী নিখিল রায় সনৎ গাঙ্গুলী আর মেঘরাজের বিধবা মেদিনী। অজয়ের মেয়ে লাবণি সে-রাত্রে তার নাচের মাস্টারের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। নিখিল আর সনৎ রাত্রে কাজে বেরিয়েছিল, তারা পরদিন ফিরে এসেছে। যারা বাড়িতে আছে তাদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’

‘সকলের আঙুলের ছাপ নিয়েছ নিশ্চয়।’

‘তা নিয়েছি।’

‘খানাতল্লাশ করে কিছু পেলে?’

‘সন্দেহজনক কিছু পাইনি।’

‘বেশ; এবার জবানবন্দীর নথিটা দেখি।’

‘এই যে।’ রাখালবাবু টেবিল থেকে ফাইল তুলে নিয়ে ব্যোমকেশকে দিলেন। এই সময় সদর দরজায় কনস্টেবল এসে জানাল যে, সলিসিটার সুধাংশু বাগচী নামে এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান। রাখালবাবু বললেন—‘নিয়ে এসো।’

সুধাংশুবাবু ঘরে প্রবেশ করলেন, হাতে পাট করা খবরের কাগজ। রাখালবাবুর পানে চেয়ে বললেন—‘আমি বেণীমাধববাবুর সলিসিটার। আজ খবরের কাগজ খুলেই দেখলাম—’

‘বসুন।’

সুধাংশুবাবু একটি চেয়ারে বসলেন। রাখালবাবু তাঁর সামনে দাঁড়ালেন, ব্যোমকেশও এগিয়ে এসে দাঁড়াল।

রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন—‘বেণীমাধববাবুর সঙ্গে কবে আপনার শেষ দেখা হয়েছিল?’

সুধাংশুবাবু বললেন—‘পরশু। আমরা অনেকদিন ধরে তাঁর বৈষয়িক কাজকর্ম দেখাশোনা করে আসছি। পরশু তিনি আমাকে ফোন করে জানালেন যে, তিনি উইল করতে চান। আমি বিকেলবেলা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উইলে কি কি শর্ত থাকবে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন। আমি উইল তৈরি করে আজ তাঁকে দলিল দেখিয়ে সহি-দস্তখত করিয়ে নেব বলে সব ঠিক করে রেখেছিলাম, তারপর আজ সকালে কাগজ খুলে এই সংবাদ পেলাম।’

রাখালবাবু চকিতে একবার ব্যোমকেশের পানে চেয়ে বললেন—‘উইলে কি কি শর্ত আছে আমাদের বলতে বাধা আছে কি?’

সুধাংশুবাবু বললেন—‘অন্য সময় বাধা নিশ্চয় থাকত, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় বাধা নেই। বরং আপনাদের সুবিধা হতে পারে।’

তিনি উইলের শর্তগুলি শোনালেন; অপঘাতে মৃত্যু হলে সমস্ত সম্পত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পাবে সে কথাও উল্লেখ করলেন।

বেলা এগারটা নাগাদ তিনি উঠলেন, বলে গেলেন—‘যদি আমার কাছ থেকে আরো কিছু জানতে চান কিংবা উইল পড়ে দেখতে চান, আমার অফিসে খবর দেবেন।’

তিনি চলে যাবার পর রাখালবাবু বললেন—‘মোটিভ আরো পাকা হলো। বুড়োকে আর দু’দিন বাঁচতে দিলেই এত বড় সম্পত্তিটা বেহাত হয়ে যেত।’

ব্যোমকেশ বলল—‘হুঁ। আমি এবার উঠব। কিন্তু আগে বেণীমাধবের ঘরটা দেখে যেতে চাই।’

‘চলুন।’

দোতলার সিঁড়ির মাথায় একজন কনস্টেবল। তেতলায় বেণীমাধবের দরজায় তালা লাগানো, উপরন্তু একজন কনস্টেবল টুলে বসে পাহারা দিচ্ছে। মেঘরাজের রক্তাক্ত বিছানা পরীক্ষার জন্য স্থানান্তরিত হয়েছে।

রাখালবাবু পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন, দু’জনে ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরের মাঝখানে খাটের ওপর বিছানা নেই, আর সব যেমন ছিল তেমনি আছে। ব্যোমকেশ দোরের কাছে দাঁড়িয়ে একবার চারিদিকে চোখ ফেরাল, তারপর অস্ফুট স্বরে বলল—‘তোমরা অবশ্য সবই দেখেছ, তবু—’

রাখালবাবু ঘাড় নাড়লেন—‘অধিকন্তু ন দোষায়।’

‘লোহার সিন্দুকের চাবি কোথায় ছিল?’

‘লোহার সিন্দুকের গায়ে লাগানো ছিল। সিন্দুকের মধ্যে তিনখানা একশো টাকার নোট ছিল, পাঁচ টাকা দশ টাকার নোট বা খুচরো টাকা পয়সা একটাও ছিল না। মনে হয় খুনী সিন্দুক খুলে টাকা পয়সা নিয়েছে কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে নম্বরী নোট নেয়নি।’

‘হুঁ। সিন্দুকে আর কী ছিল?’

‘কিছু দলিলপত্র, কিছু রসিদ, ব্যাঙ্কের খাতা ও চেকবুক। দুটো ব্যাঙ্কে টাকা আছে, সাকুল্যে প্রায় চল্লিশ হাজার। তাছাড়া শেয়ার সার্টিফিকেট ও fixed deposit আছে আন্দাজ এগারো লাখ টাকার। মালদার লোক ছিলেন। ছেলে আর মেয়েকে সাড়ে সাত শো টাকা হিসেবে মাসহারা দিতেন। তাঁর নিজের খরচ ছিল সাত শো টাকা, মেঘরাজকে মাইনে দিতেন আড়াই শো টাকা। চেকবুকের counter foil থেকে এইসব খবর জানা যায়।’

‘সিন্দুকের ভিতরে কি বাইরে বেণীমাধব ছাড়া অন্য কারুর আঙুলের ছাপ আছে?’

‘কারুর আঙুলের ছাপ নেই, একেবারে লেপা-পোঁছা।’

‘হুঁ, আততায়ী লোকটি হুঁশিয়ার।’ ব্যোমকেশ সিন্দুক খুলল না, ফ্রিজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল—‘ফ্রিজে কারুর আঙুলের ছাপ ছিল?’

‘ছিল। বেণীমাধব, মেঘরাজ এবং মেদিনী—তিনজনের আঙুলের ছাপ ছিল। আর কারুর ছাপ পাওয়া যায়নি।’

হাতল ধরে ব্যোমকেশ ফ্রিজ খুলল, ভিতরে আলো জ্বলে উঠল; ফ্রিজ চালু আছে। ভিতরে নানা জাতের ফলমূল। সারি সারি ডিম, মাছ, মাংস, দুধের বোতল রয়েছে। ব্যোমকেশ আবার দোর বন্ধ করে দিল।

ঘরের পিছন দিকের দেয়ালে একটা লম্বা ধরনের আয়না টাঙানো ছিল, তার নীচে তাকের ওপর চিরুনী বুরুশ চুলের তেল ও দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম। দাড়ি কামাবার সরঞ্জামের বিশেষত্ব এই যে, ক্ষুরটি সেফ্‌টি রেজর নয়, সাবেক কালের ভাঁজ-করা লম্বা ক্ষুর। ব্যোমকেশ সন্তর্পণে খাপসুদ্ধ ক্ষুর তুলে নিয়ে বলল—‘ক্ষুরটা বের করে দেখেছ নাকি?’

রাখালবাবু চক্ষু একটু বিস্ফারিত করলেন, বললেন—‘না। বেণীমাধব নিজের হাতে দাড়ি কামাতেন না, মেঘরাজ রোজ সকালে দাড়ি কামিয়ে দিত।’

ব্যোমকেশ সাবধানে ক্ষুরটি খাপ থেকে বের করে দু’ আঙুলে ধরে জানালার কাছে নিয়ে গিয়ে উল্‌টে-পাল্‌টে দেখতে লাগল। তারপর বিস্মিত স্বরে বলল—‘আশ্চর্য!’

ব্যোমকেশ ক্ষুরটি তাঁর হাতে দিয়ে বলল—‘দেখ, কোথাও আঙুলের ছাপ নেই।’

ক্ষুর নিয়ে রাখালবাবু পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করলেন, তারপর ক্ষুর ব্যোমকেশকে ফেরত দিয়ে তার মুখের পানে চাইলেন; দু’জনের চোখ বেশ কিছুক্ষণ পরস্পর আবদ্ধ হয়ে রইল। তারপর ব্যোমকেশ ক্ষুরটি খাপের মধ্যে পুরে নিজের পকেটে রাখল, বলল—‘এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

‘কি করবেন?’

‘দাড়ি কামাব।’

তেতলার অন্য ঘর দু’টিতে দর্শনীয় কিছু ছিল না। তবু ব্যোমকেশ ঘর দু’টিতে ঘুরে ফিরে দেখল; তারপর নীচের তলায় নেমে এসে রাখালবাবুকে বলল—‘আমি এখন চললাম। বিকেলবেলা আবার আসব। জবানবন্দীর ফাইলটা দাও, বাড়ি গিয়ে পড়ব।’

রাখালবাবু বললেন—‘আমাকে একবার থানায় যেতে হবে, চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাই। কি রকম মনে হচ্ছে?’

ব্যোমকেশ মুসকি হেসে বলল—‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া—’

রাখালবাবু জবানবন্দীর ফাইল ব্যোমকেশকে দিলেন, তাকে নিয়ে পুলিস ভ্যানে চলে গেলেন। দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর, এবং কয়েকজন নিম্নতর কর্মচারী বাড়িতে মোতায়েন রইল।

বিকেল তিনটের সময় ব্যোমকেশ ফিরে এল। রাখালবাবু আগেই ফিরেছিলেন, তাঁকে ক্ষুর আর জবানবন্দীর নথি ফেরত দিয়ে ব্যোমকেশ একটা চেয়ারে বসল। রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন—‘কেমন দাড়ি কামালেন?’

ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে বলল—‘ভাল নয়।’

‘আর জবানবন্দী?’

‘মেদিনীর জবানবন্দী সবচেয়ে তথ্যপূর্ণ। তাকে আরো কিছু প্রশ্ন করতে চাই।’

‘বেশ তো, তাকে ডেকে পাঠাচ্ছি। সে নিজের ঘরেই আছে।’

কিন্তু মেদিনীকে ডেকে পাঠাবার আগেই দু’জন সাদা পোশাকের পুলিস কর্মচারী মকরন্দকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। মকরন্দর কাপড়-জামা ছিঁড়ে গেছে, গায়ে মুখে ধুলোবালি, চোখ জবাফুলের মত লাল। বেশ বোঝা যায় সে স্বেচ্ছায় বিনা যুদ্ধে পুলিসের হাতে ধরা দেয়নি। একজন সাদা পুলিস বলল—‘মকরন্দ চক্রবর্তীকে ধরেছি স্যার।’

রাখালবাবু মকরন্দর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন—‘ইনিই মকরন্দ চক্রবর্তী! কোথায় ধরলে?’

‘ঘোড়দৌড়ের মাঠে। রেস খেলছিল স্যার। পকেটে অনেক টাকা ছিল। এই যে।’

এক তাড়া পাঁচ টাকা ও দশ টাকার নোট। রাখালবাবু গুনে দেখলেন, পৌনে দু’ শো টাকা। তিনি মকরন্দকে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করলেন—‘তোমার নাম মকরন্দ চক্রবর্তী?’

মকরন্দ রক্তরাঙা চোখে চেয়ে রইল, উত্তর দিল না। রাখালবাবু আবার প্রশ্ন করলেন—‘তুমি পৌনে দু’ শো টাকা কোথায় পেলে?’

উদ্ধত উত্তর হলো—‘বলব না।’

‘যে-রাত্রে তোমার ঠাকুরদা খুন হন সে-রাত্রে ন’টার সময় তুমি বাড়ি এসেছিলে, তারপর শেষরাত্রে চুপিচুপি দোর খুলে বেরিয়ে গিয়েছিলে—’

‘মিছে কথা। মেদিনী মিছে কথা বলেছে।’

‘মেদিনী বলেছে জানলে কি করে?’

মকরন্দ অধর দংশন করল, উত্তর দিল না। রাখালবাবু আবার প্রশ্ন করলেন—‘কত রাত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে?’

‘বলব না।’

‘তারপর আর বাড়ি ফিরে আসনি কেন?’

‘বলব না।’

রাখালবাবু তার খুব কাছে এসে বললেন—‘একদিন বেণীমাধববাবুর হুকুমে মেঘরাজ তোমার কান ধরে গালে চড় মেরেছিল, গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল।’

‘মিছে কথা।’

‘বাড়িসুদ্ধ লোক মিছে কথা বলছে?’

‘হ্যাঁ।’

রাখালবাবু ফিরে এসে ব্যোমকেশের পাশে বসলেন, গলা খাটো করে বললেন—‘এটাকে নিয়ে কী করা যায় বলুন দেখি?’

ব্যোমকেশও নীচু গলায় বলল—‘যুগধর্মের নমুনা। ওকে বাড়িতেই আটক রাখ।’

‘তাই করি।’ রাখালবাবু উঠে গিয়ে মকরন্দকে কড়া সুড়ে বললেন—‘যাও, দোতলায় নিজের ঘরে থাকো গিয়ে। বাড়ি থেকে বেরুবার চেষ্টা কোরো না, চেষ্টা করলে হাজতে গিয়ে লাপ্‌সি খেতে হবে। যাও।’

সাদা পোশাকের পুলিস দু’জন মকরন্দকে দোতলায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। রাখালবাবু বললেন—‘মেদিনীকে ডেকে পাঠাই?’

ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘না, চল আমরাই তার ঘরে যাই। এখানে অনেক বাধাবিঘ্ন।’

মেদিনীর দোরে টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল মেদিনী মেঝেয় মাদুর পেতে শুয়ে আছে। ব্যোমকেশ ও রাখালবাবুকে দেখে সে উঠে বসল। তার পরনে ধূসর রঙের একটা শাড়ি, কপালে সিঁদুর নেই, হাতে গলায় কানে গয়না নেই। মুখের ভাব একটু ফুলো ফুলো; শোকের চিহ্ন এখনো মুখ থেকে মুছে যায়নি, কিন্তু শোকের অধীরতা দূর হয়েছে। সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্নভরা চোখে দু’জনের পানে চাইল।

রাখালবাবু সদয় কণ্ঠে বললেন—‘মেদিনী, ইনি আমার বন্ধু। আমি তোমাকে যেসব প্রশ্ন করেছি তার ওপর ইনি আরো দু’-চারটে সওয়াল করতে চান।’

মেদিনী ভাঙ্গা-ভাঙ্গা গলায় বলল—‘জি।’

ব্যোমকেশ একদৃষ্টে মেদিনীর মুখের পানে চেয়ে ছিল, আরো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল—‘কতদিন আগে মেঘরাজের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিল?’

মেদিনী অস্ফুট কণ্ঠে বলল—‘পাঁচ বছর আগে।’

‘তুমিই তার প্রথম স্ত্রী?’

‘জি, না। আগে একজন ছিল, সে মারা গেছে।’

‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে চাইল। ঘরে ফার্নিচারের মধ্যে একটা তক্তপোশ, একটা কাঠের আলমারি এবং একটা খাড়া আলনা। তক্তপোশের তলায় গোটা দুই বড় তোরঙ্গ দেখা যাচ্ছে। বাইরের দিকের জানালার পাটার ওপর একটা কাঠের চ্যাপটা বাক্স। পশ্চিমা মেয়েরা প্রসাধনের জন্যে এই ধরনের বাক্স ব্যবহার করে; বাক্সের মধ্যে সিঁদুর কৌটো চিরুনী তেল কাজল প্রভৃতি থাকে, ডালা খুললে ডালার গায়ে আয়না বেরিয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে নিতান্ত মামুলি পরিবেশ।

ব্যোমকেশ এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করল—‘বাড়ির সকলকেই তুমি চেন। কে কেমন মানুষ বলতে পার?’

মেদিনী একটু চুপ করে থেকে হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল—‘বুঢ়া বাবা বড় ভাল আদমি ছিলেন, দিলদার লোক ছিলেন। তাঁর ছেলে আর দামাদও ভাল লোক। মেয়ে আর পুতহু আমাকে পছন্দ করেন না। ঝিল্লী দিদি আর লাবণি দিদি ভারি ভাল মেয়ে।’

‘আর মকরন্দ?’

মেদিনী চকিতে চোখ তুলেই আবার নীচু করল—‘উনি আমাকে দেখতে পারেন না। ভারি কড়া জবান।’

‘মেঘরাজ তাকে চড় মেরেছিল তুমি জানো?’

‘জি হাঁ, আমি তখন পাশের ঘরে ছিলুম।’

‘নিখিল আর সনৎ?’

‘নিখিলবাবু মজাদার লোক, খুব ঠাট্টা তামাসা করেন। আর সনৎবাবু গম্ভীর মেজাজের মানুষ। কিন্তু দু’জনেই খুব ভদ্র।’

‘আচ্ছা, ওকথা থাক। মেঘরাজ সৈন্যদলের সিপাহী ছিল, তার সিপাহী-জীবন সংক্রান্ত কাগজপত্র নিশ্চয় তোমার কাছে আছে?’

‘জি আছে, তার বাক্সের মধ্যে আছে।’

‘আমি একবার কাগজপত্রগুলো দেখতে চাই।’

‘এই যে বার করে দিচ্ছি।’

সে গিয়ে তক্তপোশের তলা থেকে একটা ট্রাঙ্ক টেনে বার করল, আঁচল থেকে চাবি নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ট্রাঙ্ক খুলতে লাগল। ব্যোমকেশ ইতিমধ্যে ঘরের এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জানলার ওপর প্রসাধনের বাক্সটা রাখা আছে। ব্যোমকেশ একটু ইতস্তত করে বাক্সের ডালা তুলল। বাক্সের মধ্যে মেয়েলি প্রসাধনের দ্রব্য ও টুকিটুকি; আয়নার এক কোণে মেদিনীর একটি ছবি আঁটা রয়েছে। পোস্টকার্ড আধখানা করলে যত বড় হয় তত বড় ছবি; মেদিনী খাটের ধারে বসে রয়েছে। নিতান্তই ঘরোয়া ছবি, মেদিনীর মুখের প্রাণখোলা হাসিটি ব্যোমকেশের গায়ে কাঁটার মত বিঁধল। মেদিনীর বর্তমান চেহারা দেখে ভাবা যায় না সে এমনভাবে হাসতে পারে। ব্যোমকেশ নিঃশব্দে বাক্স বন্ধ করল।

মেদিনী ট্রাঙ্ক থেকে কাগজপত্র নিয়ে যখন ফিরে এল তখন ব্যোমকেশ রাখালবাবুর কাছে ফিরে এসে নিম্নস্বরে কথা বলছে, মেদিনীর হাত থেকে কাগজপত্র নিয়ে সে মন দিয়ে পড়ল। রাখালবাবুও সঙ্গে সঙ্গে পড়লেন। তারপর কাগজ মেদিনীকে ফেরত দিয়ে ব্যোমকেশ মেদিনীকে বলল—‘এগুলো যত্ন করে রেখে দাও, হয়তো পরে দরকার হবে। চল রাখাল।’

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাখালবাবু ব্যোমকেশের দিকে চোখ বেঁকিয়ে তাকালেন—‘কি মনে হলো?’

ব্যোমকেশ বলল—‘খুব ভাল। এবার বাড়ির বাকি লোকগুলিকেও একে একে দেখতে চাই। সবাই বাড়িতে আছে তো?’

‘সবাই আছে, কেবল অজয়ের মেয়ে লাবণি ছাড়া। যে-রাত্রে খুন হয়, লাবণি সেদিন সন্ধ্যের সময় তার নাচের মাস্টারের সঙ্গে পালিয়েছে, এখনো তার সন্ধান পাইনি। অন্য যারা আছে তাদের মধ্যে আগে কাকে দেখতে চান?’

‘আমার কোনো পক্ষপাত নেই। নীচের তলা থেকেই আরম্ভ করা যাক।’

নিখিলের দোরে রাখালবাবু টোকা দিলেন, নিখিল এসে দোর খুলে দাঁড়াল। তার গালে সাবানের ফেনা, হাতে সেফ্‌টি রেজর; সে ফেনায়িত হাসি হাসল—‘আসুন দারোগাবাবু।’

রাখালবাবু ব্যোমকেশকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন, প্রশ্ন করলেন—‘বিকেলবেলা দাড়ি কামাচ্ছেন?’

নিখিল বলল—‘আমি নিশাচর কিনা তাই বিকেলবেলা দাড়ি কামাই। যারা দিনের বেলা কাজ করে তারা সকালবেলা দাড়ি কামায়।’ তারপর সে ব্যগ্রস্বরে বলল—‘দারোগাবাবু, এক ঘন্টার জন্য আমাকে ছেড়ে দিন, একবারটি অফিস ঘুরে আসি। মাইরি বলছি পালাব না। বিশ্বাস না হয় দু’জন পেয়াদা আমার সঙ্গে দিন।’

রাখালবাবু হেসে বললেন—‘অফিসে যাবার জন্যে এত ব্যস্ত কেন? বেশ তো আছেন।’

নিখিল বলল—‘না দারোগাবাবু, বেশ নেই। কাজের নেশা আমাকে অফিসের দিকে টানছে, রাত্তিরে ঘুমোতে পারি না। তা ছাড়া—’

‘তা ছাড়া আবার কি?’

নিখিল একটু সলজ্জভাবে বলল—‘অফিসে অনেকগুলো আইবুড়ো মেয়ে কাজ করে, তাদের মধ্যে একটাকে আমি খুঁজছি, পেলেই তাকে বিয়ে করব।’

‘ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যময় ঠেকছে।’

‘ঠেকবেই তো। ঘোর রহস্যময় ব্যাপার।’

‘ঘোর রহস্যময় যদি হয় তাহলে এঁর শরণাপন্ন হোন। ইনিই হলেন শ্রীব্যোমকেশ বক্সী।’

নিখিলের গালে সাবানের ফেনা শুকিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছিল, সে প্রকাণ্ড হাঁ করে ব্যোমকেশের পানে তাকাল—‘অ্যাঁ, আপনি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী! এতক্ষণ লক্ষ্যই করিনি।’ সেফ্‌টি রেজরসুদ্ধ হাত জোড় করে বলল—‘আমার রহস্যটা আপনাকে ভেদ করতেই হবে ব্যোমকেশবাবু। নইলে আমার প্রাণের আশা নেই।’

‘সব কথা খুলে বলুন।’

নিখিল তড়বড় করে এক নিশ্বাসে তার রহস্য শোনাল। শুনে ব্যোমকেশ বলল—‘চিঠিগুলো দেখি।’

নিখিল বিছানার কাছে গিয়ে বালিশের তলা থেকে কয়েকখানা খাম এনে ব্যোমকেশকে দিল। ব্যোমকেশ খামগুলি খুলে একে একে চিঠি বার করে পড়ল, তারপর আবার খামের মধ্যে পুরে নিজের পকেটে রাখল—‘এগুলো আমি রাখলাম। দেখি যদি সন্ধান পাই। আপনি আপাতত এই বাড়িতেই থাকুন, আমি আপনার অফিসে খোঁজখবর নেব। —ভাল কথা, আপনার বর্ষাতি আছে?’

‘বর্ষাতি—ওয়াটারপ্রুফ? আছে একটা। কেন বলুন তো?’

‘দেখি একবার।’

নিখিল সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে একটা পুরনো খাকি রঙের বর্ষাতি নিয়ে এল। ব্যোমকেশ সেটা রাখালবাবুর হাতে দিয়ে বলল—‘এটাও আমরা নিয়ে চললাম। এটা আপনি শেষবার কবে ব্যবহার করেছেন?’

নিখিল কিছুই বুঝতে পারেনি এমনিভাবে মাথা চুলকে বলল—‘গত বর্ষাকালে, মানে পাঁচ ছয় মাস আগে। আপনি যে ভেলকি লাগিয়ে দিলেন, ওয়াটারপ্রুফ থেকে আমার—মানে মেয়েটার ঠিকানা বার করবেন নাকি?’

ব্যোমকেশ কেবল মুখ টিপে হাসল, বলল—‘আপনি দেখছি সেফ্‌টি রেজর দিয়ে দাড়ি কামান।’

‘তবে কি দিয়ে দাড়ি কামাব?’

‘ঠিক কথা। আপনি যখন দাড়ি কামাতে আরম্ভ করেছেন তখন সাবেক ক্ষুরের রেওয়াজ উঠে গেছে। —আচ্ছা।’

ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পানে বক্র কটাক্ষপাত করল। রাখালবাবু অপ্রতিভভাবে বললেন—‘খেয়াল হয়নি। হওয়া উচিত ছিল। যে-লোক ছুরি কিংবা ক্ষুর দিয়ে গলা কাটতে যাচ্ছে, সে জানে গলা কাটলে চারদিকে রক্ত উথলে পড়বে, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে। তার নিজের গায়েও রক্ত লাগবে। তাই সে বর্ষাতি কিংবা ওই রকম একটা কিছু গায়ে দিয়ে খুন করতে যাবে, যাতে সহজে রক্ত ধুয়ে ফেলা যায়।’

এই সময় সদর দোরের কনস্টেবল এসে একখানা পোস্টকার্ড রাখালবাবুর হাতে দিয়ে বলল—‘পিওন দিয়ে গেল।’

রাখালবাবু নির্দ্বিধায় পোস্টকার্ড পড়লেন। অজয় চক্রবর্তীর নামে চিঠি, তারিখ আজ সকালের, ঠিকানা টালিগঞ্জ। চিঠিতে কয়েক ছত্র লেখা আছে—

শ্রীচরণেষু মা,

কাল রাত্তিরে আমাদের বিয়ে হয়েছে। তোমরা রাগ কোরো না। আমার শ্বশুর শাশুড়ি খুব ভালো লোক। পরশু রাত্রে আমি শাশুড়ির কাছে শুয়েছিলাম। দাদু অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিলেন তাই আমরা লুকিয়ে বিয়ে করেছি।

প্রণতা
লাবণি

চিঠিতে চোখ বুলিয়ে রাখালবাবু ব্যোমকেশের হাতে চিঠি দিলেন, ব্যোমকেশ সেটা পড়ে ফেরত দিল। বলল—‘বোধহয় ঠাকুরদার মৃত্যু-সংবাদ পায়নি। যাক, বিয়ে করেছে ভালই করেছে, নইলে—’

চিঠি পকেটে রেখে রাখালবাবু একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে ডাকলেন—‘এই বর্ষাতিটা রাখো। আরো বোধহয় জুটবে; সবগুলো জড় হলে পরীক্ষার জন্যে পাঠাতে হবে। এটাতে টিকিট সেঁটে রাখ—নিখিল হালদার।’

তারপর তিনি সনতের দোরে টোকা দিলেন। সনৎ এসে দোর খুলল; তার হাতে একটা ইংরেজি রহস্য উপন্যাস পাতা ওলটানো অবস্থায় রয়েছে। রাখালবাবুকে দেখে বলল— ‘ইন্সপেক্টরবাবু, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেছে, এক টিন আনিয়ে দেবেন? গোল্ড ফ্লেক।’

‘নিশ্চয়। টাকা দিন আনিয়ে দিচ্ছি।’

সনৎ একটা দশ টাকার নোট পকেট থেকে বার করে দিল। রাখালবাবু টাকা সাব-ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়ে বললেন—‘এক টিন গোল্ড ফ্লেক সিগারেট সামনের দোকান থেকে আনিয়ে দাও।’

তিনি ব্যোমকেশকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। সনৎ বলল—‘আর কতদিন ঘরে বন্ধ করে রাখবেন? কাজকর্ম আটকে রয়েছে। তা ছাড়া মামা মারা যাবার পর তাঁর উত্তরাধিকারী এখানে আর থাকতে দেবে না, মাথা গোঁজবার একটা জায়গা খুঁজতে হবে তো।’

‘থাকতে দেবে না কি করে জানলেন?’

‘আজ দুপুরবেলা গায়ত্রীর স্বামী গঙ্গাধর এসেছিল, বলল—এবার পাতাতাড়ি গোটাতে হবে।’

‘তাই নাকি!—বেশি দিন আপনাদের কষ্ট দেব না, দু’এক দিনের মধ্যে ছাড়া পাবেন। ইনি ব্যোমকেশ বক্সী, প্রখ্যাত সত্যান্বেষী।’

সনৎ নির্লিপ্ত চোখে ব্যোমকেশের পানে চাইল, নীরস স্বরে বলল—‘নাম শুনেছি, বই পড়িনি। বাংলা রহস্য কাহিনী আমি পড়ি না। —বসুন।’

ব্যোমকেশের চোখ ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে অলসভাবে বলল—‘আপনার বর্ষাতি আছে?’

সনৎ ভ্রূ তুলে একটু বিস্ময় প্রকাশ করল—‘আছে। এটা বর্ষাকাল নয় তাই তুলে রেখেছি। দেখতে চান?’

‘হ্যাঁ।’

সনৎ আলমারি খুলে একটা প্ল্যাস্টিকের মোড়ক বার করল। মোড়কের মধ্যে একটি শৌখিন স্বচ্ছ বর্ষাতি পাট করা রয়েছে। রাখালবাবু সেটি নিয়ে মোড়ক থেকে বার করলেন, তারপর লম্বা করে ঝুলিয়ে দেখলেন। দামী বর্ষাতি, প্রায় নতুন। তিনি সেটিকে পাট করে আবার মোড়কের মধ্যে রেখে বললেন—‘এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি, দু’ দিন পরে ফেরত পাবেন। রসিদ দিচ্ছি।’

সনৎ অপ্রসন্ন উদাস কণ্ঠে বলল—‘রসিদ কি হবে! আপনাদেরই রাজত্ব, যা ইচ্ছে করুন।’

ব্যোমকেশ হঠাৎ প্রশ্ন করল—‘আপনার জবানবন্দীতে দেখলাম যে-রাত্রে বেণীমাধববাবু খুন হন সে-রাত্রে আপনি বর্ধমানে গিয়েছিলেন। কোন ট্রেনে গিয়েছিলেন?’

সনৎ বলল—‘রাত্রি সাড়ে দশটার ট্রেনে।’

‘পরদিন ভোরের ট্রেনে না গিয়ে রাত্রির ট্রেনে গেলেন কেন?’

‘ভোরের ট্রেনে গেলে ঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারতাম না। সকালবেলা মজলিশ ছিল।’

‘বর্ধমানে আপনার কোনো আস্তানা আছে?’

‘না, স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে রাত কাটিয়েছি।’

‘চায়ের স্টলে গিয়ে চা খেয়েছিলেন নিশ্চয়?’

‘চা আমি খাই না।’

‘তাহলে আপনি যে সাড়ে দশটার গাড়িতে বর্ধমান গিয়েছিলেন তার কোনো সাক্ষী-সাবুদ নেই?’

সনতের ভুরু আবার উঁচু হলো—‘সাক্ষী-সাবুদের কী দরকার? আপনাদের কি সন্দেহ আমি মামাকে খুন করেছি?’

ব্যোমকেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল—‘তা নয়। কিন্তু সকলের সম্বন্ধেই আমাদের নিঃসংশয় হওয়া দরকার।’

সনৎ শুকনো গলায় বলল—‘মামাকে খুন করে যাদের লাভ আছে তাদের অ্যালিবাই খুঁজুন গিয়ে। তাতে কাজ হবে।’

‘তা বটে। চল রাখাল, এবার দোতলায় যাওয়া যাক।’

প্রথমে ড্রয়িংরুমে গিয়ে রাখালবাবু সনতের বর্ষাতি সাব-ইন্সপেক্টরকে সমর্পণ করে বললেন—‘টিকিট মারো—সনৎ গাঙ্গুলি।’ তারপর ব্যোমকেশকে নিয়ে দোতলায় উঠলেন।

অজয় সামনের ঘরে বসে সায়াহ্নিক চা জলখাবার খাচ্ছিল, সশঙ্ক মুখে উঠে দাঁড়াল। তার মুক্তকচ্ছ অশৌচের বেশ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে। রাখালবাবু গম্ভীর মুখে বললেন—‘আপনার একখানা চিঠি এসেছে।’ তিনি পোস্টকার্ড পকেট থেকে নিয়ে অজয়কে দিলেন।

ব্যোমকেশ নিবিষ্ট চোখে অজয়ের পানে চেয়ে ছিল; সে দেখল চিঠি পড়তে পড়তে অজয়ের মুখের ওপর দিয়ে দ্রুত পরম্পরায় বিচিত্র ভাবের অভিব্যক্তি খেলে গেল: আশঙ্কা—বিস্ময়—স্বস্তি—উৎফুল্লতা। তার মধ্যে স্বস্তির আরামই বেশি। অজয়ের মত প্রকৃতির লোকের পক্ষে এটাই বোধহয় স্বাভাবিক; বিনা খরচে বিনা ঝঞ্ঝাটে যদি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় তাহলে আনন্দ হবারই কথা।

কিন্তু সে যখন মুখ তুলল তখন তার মুখে একটি বিষণ্ণ করুণ ভাব, তাতে রঙ্গমঞ্চের আভাস পাওয়া যায়। সে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল—‘মেয়ে! দারোগাবাবু, আমার একমাত্র মেয়ে পালিয়ে গিয়ে একজনকে বিয়ে করেছে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড় নিষ্ঠুর, বড় স্বার্থপর, তারা বাপ-মায়ের কথা ভাবে না। যাক, যা করেছে ভালই করেছে। তবু যদি জাতের মধ্যে বিয়ে করত। যাক, ভাল হলেই ভাল।’ সে আবার নাটকীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

রাখালবাবু বোধকরি অভিনয়ের পালা শেষ করার জন্যেই বললেন—‘ইনি ব্যোমকেশ বক্সী। বোধহয় নাম শুনেছেন।’

অজয় তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে রইল; তার ভাবভঙ্গীতে ভয় কিংবা বিস্ময় কিংবা আনন্দ কোনটা প্রকাশিত হলো ঠিক বোঝা গেল না। তারপর সে গদ্‌গদ স্বরে বলে উঠল—‘নাম শুনিনি! বলেন কি আপনি, নাম শুনিনি! আসুন আসুন, কি সৌভাগ্য আমার। ব্যোমকেশবাবু এসেছেন, এবার বাবার মৃত্যু রহস্যের একটা কিনারা হবে।’ সে অন্দরের দরজার দিকে ফিরে গলা চড়িয়ে বলল—‘ওগো শুনছ, শীগ্‌গির দু’ পেয়ালা চা নিয়ে এসো। —বসুন বসুন, আমি নিজেই দেখছি।’ সে দ্রুত অন্দরের দিকে অন্তর্হিত হলো।

সমাদরের আতিশয্য দেখে ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পানে মুখ টিপে হাসল; দু’জনে পাশাপাশি চেয়ারে উপবিষ্ট হলেন।

কিছুক্ষণ পরে অজয় ফিরে এল, তার পিছনে মাথায় আধ-ঘোমটা দিয়ে আরতি; আরতির হাতে থালার ওপর দু’ পেয়ালা চা এবং বিস্কুট। তার মুখ ভয়ে শীর্ণ হয়ে গেছে, সে থালাটি ব্যোমকেশের সামনে রেখেই ফিরে যাচ্ছিল, অজয় বলল,—’ওকি, চলে যাচ্ছ কেন? ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গে কথা কও।’

আরতি থমকে দাঁড়িয়ে ব্যোমকেশের দিকে ফিরল, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। ব্যোমকেশ তার অবস্থা লক্ষ্য করে সদয় কণ্ঠে বলল—‘না না, উনি কাজকর্ম করুন গিয়ে, ওঁকে আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।’

আরতি চলে গেল। অজয় আমতা-আমতা করে বলল—‘আমার স্ত্রী বড় লাজুক, কিন্তু আমরা দু’জনেই আপনার ভক্ত—’ অজয় আরো অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল, ব্যোমকেশ বাধা দিয়ে বলল—‘আপনার ছেলে মকরন্দ বাড়িতেই আছে তো?’

অজয় চকিত হয়ে বলল—‘আছে বৈকি। তাকে ডাকব?’

ব্যোমকেশ বলল—‘ডাকবার বোধহয় দরকার হবে না। সে কলেজে পড়ে, বর্ষাকালে নিশ্চয় তার বর্ষাতি দরকার হয়। তার বর্ষাতিটা একবার দেখতে চাই।’

অজয় একটু চিন্তা করে বলল—‘বছর দেড়েক আগে তাকে একটা ওয়াটারপ্রুফ কিনে দিয়েছিলাম। আছে নিশ্চয়, আমি দেখছি।’

অজয় অন্দরের দিকে চলে গেল। ব্যোমকেশ ও রাখালবাবু চায়ের পেয়ালা তুলে নিলেন। মিনিট পাঁচেক পরে অজয় ফিরে এসে বিমর্ষ মুখে বলল—‘ওয়াটারপ্রুফটা খুঁজে পেলাম না। মকরন্দকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বলল—জানি না।’

ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালা রেখে মুখ মুছতে মুছতে বলল—‘আপনার নিজের ওয়াটারপ্রুফ আছে?’

‘আছে। এনে দেব?’

‘আপনার স্ত্রীর এবং মেয়ের ওয়াটারপ্রুফ?’

‘মেয়েদের জন্যে একটাই মেয়েলি ওয়াটারপ্রুফ আছে।’

‘দয়া করে ও দুটো এনে দিন, আমরা নিয়ে যাব। দু’চার দিনের মধ্যেই ফেরত পাবেন।’

‘নিয়ে যাবেন, বেশ তো, তা এনে দিচ্ছি।’

অজয় অন্দরে গিয়ে দু’হাতে দুটি ওয়াটারপ্রুফ ঝুলিয়ে নিয়ে ফিরে এল। রাখালবাবু সে দুটি পাট করে বগলে নিলেন, বললেন—‘আচ্ছা, আজ উঠি। চায়ের জন্যে ধন্যবাদ।’

অজয় কাঁচুমাচু হয়ে ব্যোমকেশকে বলল—‘চললেন? একটা অনুরোধ ছিল সাহস করে বলতে পারছি না—’

‘কি অনুরোধ?’

‘আপনার একটা ফটো তুলব। আমার ক্যামেরা আছে, যদি অনুমতি করেন একটা তুলে নিই। আপনার ছবি এনলার্জ করে ঘরে টাঙিয়ে রাখব।’

ব্যোমকেশ হেসে উঠল—‘ফটো তুলবেন! তা—আপত্তি কি। আমার ছবি এনলার্জ করে ঘরে টাঙিয়ে রাখার আগ্রহ আজ পর্যন্ত কারো দেখা যায়নি।’

অজয় দ্রুত গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে এল। সাধারণ বক্স-ক্যামেরা। সে বললে—‘এখনো যথেষ্ট আলো আছে। আপনি জানালার কাছে দাঁড়ান, আমি ছবি তুলে নিচ্ছি।’

ব্যোমকেশ জানলার পাশে পড়ন্ত আলোয় দাঁড়াল। ক্যামেরায় ক্লিক করে শব্দ হলো।

‘ধন্যবাদ! ধন্যবাদ! অশেষ ধন্যবাদ!’ শুনতে শুনতে ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল।

বাইরে এসে দু’জনের কিছুক্ষণ নিম্নস্বরে কথা হলো; তারপর ব্যোমকেশ বর্ষাতি দুটো নিয়ে নীচে নেমে গেল, রাখালবাবু তেতলায় উঠে গেলেন। ওপরে কনস্টেবল টুলের ওপর বসেছিল, উঠে দাঁড়াল।

চাবি দিয়ে ঘরের দোর খুলে রাখালবাবু ঘরে প্রবেশ করলেন, কয়েকবার এদিক ওদিক ঘুরলেন। তারপর দোরের বাইরে ফিরে এসে দেখলেন, মেদিনী ক্লান্তভাবে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন—‘মেদিনী, তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি তাই ডেকেছি।’

মেদিনী ব্যায়ত বিহ্বল চোখে চাইল, তারপর চোখের ওপর আঁচল চাপা দিল। রাখালবাবু বললেন—‘বলো দেখি সেদিন সকালে তুমি যখন তোমার স্বামীর মৃতদেহ প্রথম দেখলে তখন সে কি চিৎ হয়ে শুয়েছিল?’

অবরুদ্ধ উত্তর এল—‘জি, হাঁ।’

রাখালবাবু তাড়াতাড়ি বললেন—‘আচ্ছা আচ্ছা, ও কথা থাক। এবার একবার ঘরের মধ্যে এসো।’

মেদিনী চোখের জল মুছে থমথমে মুখ নিয়ে ঘরের মধ্যে এল। রাখালবাবু চারিদিকে হাত ঘুরিয়ে বললেন—‘ঘরটা ভাল করে দেখ। তুমি আগে অনেকবার দেখেছ। কোথাও কোনো তফাত বুঝতে পারছ?’

মেদিনী বলল—‘খাটের ওপর বিছানা নেই।’

‘তাছাড়া আর কিছু?’

মেদিনী চারিদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা নাড়ল—‘আর কোনো তফাত বুঝতে পারছি না।’

‘হুঁ। আচ্ছা হয়েছে, এবার নীচে চল।’

মেদিনীকে নিয়ে রাখালবাবু নীচে নেমে গেলেন। মেদিনী নিজের ঘরে চলে গেল। রাখালবাবু ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে দেখলেন ব্যোমকেশ একটা চেয়ারে অঙ্গ এলিয়ে দিয়ে সিগারেট টানছে। দু’জনের চোখাচোখি হলো। ব্যোমকেশ বাঁকা হেসে ঊর্ধ্বদিকে ধোঁয়া ছাড়ল, তারপর খাড়া হয়ে বসে বলল—‘শুভকার্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে। রাখাল, এবার আমি বাড়ি ফিরব। তোমার কতদূর?’

রাখাল বললেন—‘গঙ্গাধর ঘোষালকে দর্শন করবেন না?’

‘ওহো তাই তো, গঙ্গাধরকে দর্শন করা হলো না। আজ থাক, সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তিনি হয়তো ভূমানন্দে আছেন। কাল সকালে তাঁকে দর্শন করা যাবে।’ ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল, পকেট থেকে নিখিলের চিঠিগুলি নিয়ে রাখালবাবুর হাতে দিয়ে বলল—‘এগুলোতে মেয়েলি আঙুলের ছাপ আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখো। আজ চলি।’

‘চলুন, আমিও যাই। বর্ষাতিগুলো পরীক্ষা করতে হবে।’

পরদিন বেলা ন’টার সময় ব্যোমকেশ বেণীমাধবের বাড়িতে গিয়ে দেখল, রাখালবাবু সদর বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিখিল এবং সনতের সঙ্গে কথা বলছেন। ব্যোমকেশ যেতেই তিনি বললেন—‘শুনেছেন ব্যোমকেশদা, মেদিনীর ঘর থেকে একটা বাক্স চুরি গেছে, টয়লেটের বাক্স।’

ব্যোমকেশ ভুরু উঁচু করে বলল—‘টয়লেট বক্স। সে কি, কি করে চুরি গেল?’

‘তা ঠিক বলতে পারছি না। তবে কাল সন্ধ্যেবেলা মেদিনীকে আমি তেতলায় ডেকেছিলাম, ওর ঘর খোলা ছিল, সেই সময় হয়তো কেউ সরিয়েছে। তাই এঁদের জিজ্ঞেস করছিলাম এঁরা কিছু জানেন কিনা।’

সনৎ বলল—‘আমি কি করে জানব বলুন। মেদিনীর ঘরের মধ্যে কখনো পদার্পণ করিনি, কোথায় কী আছে কোত্থেকে জানব?’

নিখিল বলল—‘দোহাই দারোগাবাবু, আমি টয়লেট-বক্স চুরি করিনি। আমার ঘরে চুল বেঁধে টিপ পরার মানুষ নেই।’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে প্রশ্ন করল—‘মকরন্দকে জেরা করেছিলে?’

‘করেছিলাম। তাদের ফ্ল্যাট আবার খানাতল্লাশ করেছিলাম, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না।’

‘এঁদের ঘর?’

‘এইবার করর।’ রাখালবাবু একজন জমাদারকে এবং সাব-ইন্সপেক্টরদের ডেকে বললেন—‘তোমরা এঁদের ঘর দুটো আবার ভাল করে খানাতল্লাশ কর, মেদিনীর চুল বাঁধার বাক্সটা পাও কিনা দেখ। আমরা দোতলায় গঙ্গাধরবাবুর ফ্ল্যাটে যাচ্ছি।’

সনৎ অপ্রসন্ন মুখে বলল—‘করুন করুন, যত ইচ্ছে খানাতল্লাশ করুন, কিন্তু আমার দামী ক্যামেরাগুলো ভাঙবেন না।’

ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু ওপরে উঠে গেলেন।

দোতলায় উঠে তাঁরা দেখলেন বারান্দার অপর প্রান্তে গঙ্গাধরের ফ্ল্যাটে সদর দরজা খুলে তার মেয়ে ঝিল্লী বেরিয়ে এল, দরজা ভেজিয়ে দিয়ে দু’পা এসে তাদের দেখে সংকুচিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাখালবাবু তার কাছে এসে ব্যোমকেশকে বললেন—‘এর নাম ঝিল্লী, গঙ্গাধরবাবুর মেয়ে। —তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?’

ঝিল্লী সলজ্জ অস্ফুটস্বরে বলল—‘মামীমা ডেকে পাঠিয়েছেন।’

ব্যোমকেশ ঝিল্লীর সংকোচনম্র কমনীয় মুখের পানে চেয়ে হাসল—‘আমাদের দেখে এত লজ্জা কিসের? আমরা বাঘ-ভাল্লুক নয়, কামড়ে দেব না।’

ঝিল্লী একটু হেসে চোখ তুলল। ব্যোমকেশ দেখল চোখ দুটি সুন্দর এবং বুদ্ধিদীপ্ত। রাখালবাবু পরিচয় দিলেন—‘ইনিই ব্যোমকেশ বক্সী।’

ঝিল্লীর চোখে উৎসুক আলো ফুটে উঠল, তারপর আস্তে আস্তে তার মুখের ওপর অরুণাভা ছড়িয়ে পড়ল। সে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করছে দেখে ব্যোমকেশ বলল—‘ঝিল্লী, একটু দাঁড়াও, তোমার কাছে কিছু জানবার আছে।’

ঝিল্লী দাঁড়াল, কিন্তু ব্যোমকেশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রইল। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল—‘লাবণির সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল?’

একটু দ্বিধার পর ঝিল্লী ঘাড় নাড়ল।

‘সে তোমাকে নিজের মনের কথা বলত, তুমি তাকে নিজের মনের কথা বলতে। কেমন?’

ঝিল্লী উত্তর দিল না, সতর্কভাবে অপেক্ষা করে রইল।

‘লাবণি নিশ্চয় তোমাকে বলেছিল সে তার নাচের মাস্টার পরাগ লাহাকে ভালবাসে।’

ঝিল্লী ঘাড় নীচু করে অস্ফুটস্বরে বলল—‘বলেছিল।’

‘সে পালিয়ে গিয়ে পরাগকে বিয়ে করবে বলেছিল?’

ঝিল্লী উৎফুল্ল চোখ তুলল—‘লাবণি ওকে বিয়ে করেছে!’

‘হ্যাঁ। তুমি দেখছি জানতে না।’

‘না।’

‘কিন্তু জানতে পেরে খুব খুশি হয়েছ।’

ঝিল্লী হেসে ফেলল।

ঝিল্লীকে ছেড়ে গঙ্গাধরের দোরের দিকে যেতে যেতে রাখালবাবু খাটো গলায় বললেন—‘আপনার মন বিচিত্র কুটিল পথে চলেছে, কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি।’

ব্যোমকেশ মৃদু হাসল। রাখালবাবু গঙ্গাধরের দোরে টোকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে কড়া আওয়াজ এল—‘কে? ভেতরে এসো।’

দু’জনে ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরের মাঝখানে গোল টেবিল, তার সামনে চেয়ারে বসে গঙ্গাধর তাস নিয়ে সলিটেয়ার খেলছিল, রাখালবাবুর দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বলল—‘আবার কি চাই?’

গঙ্গাধরের ভাবভঙ্গী এখন অন্যরকম। নিজের টাকাকড়ি উড়িয়ে শ্বশুরের গলগ্রহ হবার পর সে কচ্ছপের মত হাত-পা গুটিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু শ্বশুরের মৃত্যুর পর হালের আইন অনুযায়ী সে অর্ধেক রাজত্ব পাবে এই অনিবার্য সম্ভাবনার ফলে সে আবার নিজ মূর্তি ধারণ করেছে, তার আচার-আচরণে বনেদী বড় মানুষের মজ্জাগত আত্মম্ভরিতা আবার ফুটে উঠেছে।

তার কথা বলার ভঙ্গীতে ব্যোমকেশের মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল, তারপর রাখালবাবু যখন বললেন—‘ইনি আমার সহকারী শ্রীব্যোমকেশ বক্সী’ তখন গঙ্গাধর উদ্ধতকণ্ঠে বলে উঠল—‘তাতে কী হয়েছে? So what?’

ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠল, সে গঙ্গাধরের মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল—‘আপনার নাম গঙ্গাধর ঘোষাল, কয়েক বছর আগে আপনি রেস-কোর্সের এক জকিকে ঘুষ খাওয়াবার চেষ্টা করার জন্যে আইনের হাতে পড়েছিলেন?’

গঙ্গাধর আরক্ত চোখে গর্জে উঠল—‘তাতে আপনার কি?’

ব্যোমকেশ আঙুল তুলে বলল—‘আপনি দাগী আসামী, আপনাকে খুনের সন্দেহে গ্রেপ্তার করা যায়। আপনার শ্বশুর উইল দস্তখত করার আগে রাত্রে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। কে তাঁকে খুন করেছে?’

বেগবান ঘোড়া হোঁচট লেগে যেন ডিগবাজি খেয়ে পড়ল। গঙ্গাধরের দম্ভস্ফীত মুখ তুবড়ে গেল, সে ভীতস্বরে বলল—‘আমি কি জানি! আমি কি জানি!’

ব্যোমকেশ এবার একটু ঠাণ্ডা হলো, বলল—‘বেণীমাধববাবুকে খুন করার স্বার্থ আপনারও আছে, অজয়বাবুরও আছে; কিন্তু আপনি জামাতা, দশম গ্রহ।’

উত্তরে গঙ্গাধর দু’বার কথা বলবার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। ব্যোমকেশ তখন সহজ সুরে বলল—‘আপনার মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলছে, বেশি তেজ দেখাবেন না।’

এই সময় গায়ত্রী ভিতর দিক থেকে ঘরে প্রবেশ করল। আঁচলটা কোমরে জড়ানো, চোখে তীব্র দৃষ্টি, যুদ্ধং দেহি ভাব। সে একটা চেয়ারে বসে ব্যোমকেশকে কড়া সুরে বলল—‘কি জানতে চান আমাকে বলুন।’

ব্যোমকেশ গায়ত্রীকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল—‘আপনি বেণীমাধবাবুর মেয়ে গায়ত্রী দেবী। আপনাকেও কিছু প্রশ্ন আছে। —আপনার বাবা উইল সই করবার আগেই কেউ তাঁকে খুন করেছে। কিন্তু তাঁর আগের কোনো উইল আছে কিনা আপনি জানেন?’

এতক্ষণে গঙ্গাধর কতকটা ধাতস্থ হয়েছে, সে বলে উঠল—‘আমার শ্বশুর ইন্‌টেস্‌টেট্ মারা গেছেন।’

গায়ত্রী অমনি ধমক দিয়ে উঠল—‘তুমি চুপ করো। —আমার বাবার অন্য কোনো উইল নেই। তিনি যা রেখে গেছেন নতুন আইনের জোরে তার অর্ধেক আমি পাব।’

‘বেণীমাধববাবু বিষয়ী লোক ছিলেন, এই বয়স পর্যন্ত তিনি উইল করেননি এ কি সম্ভব? হয়তো পুরনো উইল বেরুবে, যাতে তিনি অন্য কাউকে যথাসর্বস্ব দিয়ে গেছেন। হয়তো আপনার জন্য মাসহারা বরাদ্দ করে বাকি সব টাকা অজয়বাবুকে দিয়ে গেছেন।’

ক্রুদ্ধ উত্তেজনায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে গায়ত্রী প্রায় চীৎকার করে উঠল—‘না না না, বাবা কখনো আমাকে বঞ্চিত করবেন না। তিনি দাদার চেয়ে আমাকে ঢের বেশি ভালবাসতেন।’

‘বসুন বসুন। আমি বলছি না যে, বেণীমাধববাবুর অন্য উইল আছেই। কিন্তু তিনি ভাগনেদেরও ভালবাসতেন, বাড়িতে এনে রেখেছিলেন; তাদের কি কিছুই দিয়ে যাননি?’

গায়ত্রী আবার চেয়ারে বসে বলল—‘ওরা বাবার আসল ভাগনে নয়, মাসতুত বোনের ছেলে। সনতের বাপ দুশ্চরিত্র ছিল, স্ত্রীকে খুন করে ফাঁসি যায়; নিখিলের বাপ সার্কাসের পেশাদার ক্লাউন ছিল। ওদের কেন বাবা টাকা দিয়ে যাবেন?’

‘আচ্ছা, ও কথা যাক। বলুন দেখি আপনার বাড়িতে ক’টা বর্ষাতি আছে।’

গায়ত্রী হঠাৎ যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল, কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল—‘দুটো আছে। একটা ওঁর, একটা ঝিল্লীর।’

‘ও দুটো বার করে দিন, আমরা নিয়ে যাব।’

‘নিয়ে যাবেন! কেন?’

‘দরকার আছে। দু’চার দিন পরে ফেরত পাবেন।’

গায়ত্রী আবার কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ উঠে চলে গেল, বলল—‘কি দরকার জানি না। এনে দিচ্ছি।’

নীচে নেমে এসে রাখালবাবু ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করলেন—‘এবার?’

ব্যোমকেশ বলল—‘চল আমার বাড়ি। নিভৃতে পরামর্শ করা যাক। একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে।’

‘চলুন।’

বাড়িতে এসে ব্যোমকেশ চায়ের ফরমাস দিল। সত্যবতী চা এবং আলুর চপ রেখে গেল। অতঃপর পানাহার এবং সিগারেট সহযোগে পরামর্শ শুরু হলো।

এক ঘন্টা পরে রাখালবাবু বললেন—‘বেশ, এই কথা রইল। পুলিস ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনার রাহা খরচ ইত্যাদি দেওয়া হবে, আমি তার ব্যবস্থা করব। আজ বিকেলে পাকা খবর পাবেন।’

রাখালবাবু চলে যাবার পর সত্যবতী ঘরে ঢুকল, ব্যোমকেশের চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসুক স্বরে বলল—‘হ্যাঁ গা, কী তোমাদের এত ষড়যন্ত্র হচ্ছে?’

ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়িয়ে আলস্য ভাঙল। —‘আমাকে বোধহয় কয়েক দিনের জন্যে বাইরে যেতে হবে।’

‘কোথায় যাবে?’

‘তা কি জানি!’

‘তুমি জানো না তা কি কখনো হয়। নিশ্চয় জানো।’

ব্যোমকেশ সত্যবতীর কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বলল—‘বেশ, জানি কিন্তু বলব না।’

সত্যবতী রাগ করে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

বিকেল চারটের সময় রাখালবাবুর ফোন এল—‘সব ঠিক। আপনি একটা সুটকেস নিয়ে সটান থানায় চলে আসুন।’

ব্যোমকেশের অনুপস্থিতিকালে বেণীমাধবের বাড়ির কর্মসূচী আগের মতই বলবৎ রইল। কারুর বাইরে যাবার হুকুম নেই। একজন সাব-ইন্সপেক্টর, একজন জমাদার এবং চারজন কনস্টেবল হামেহাল মোতায়েন রইল। রাখালবাবু দু’বেলা এসে পরিদর্শন করে যেতে লাগলেন। বেণীমাধবের মৃত্যু সম্বন্ধে নতুন কোনো তথ্য আবিষ্কৃত হলো না। মেদিনীর সাজের বাক্সটা অদৃশ্য হয়েছিল, অদৃশ্যই রয়ে গেল।

একদিন লাবণি তার স্বামীকে নিয়ে বাপ-মা’র সঙ্গে দেখা করতে এল। রাখালবাবু তাদের দেখা করতে দিলেন। বন্ধ দরজার অন্তরালে অজয়-পরিবার কীভাবে মেয়ে-জামাইয়ের সংবর্ধনা করল তা জানা গেল না। লাবণিরা যখন বেরিয়ে এল তখন লাবণির মুখে হাসি চোখে জল। বারান্দায় ঝিল্লীর সঙ্গে লাবণির দেখা হলো; দুই বোন পরস্পর গলা জড়িয়ে চুমু খেল, তারপর হাত ধরাধরি করে নীচে নেমে এল। নীচের বারান্দায় নিখিল ছিল, সে নব দম্পতিকে দেখে হো হো করে হেসে বলল—‘এই যে পলাতক আর পলাতকা! দু’জনে মিলে খুব নাচছ তো?’

পরাগ কপট বিষণ্ণতায় ম্রিয়মাণ মুখভঙ্গী করে বলল—‘দু’জনে মিলে নাচা আর হচ্ছে কই? এখন আমি নাচছি, লাবণি নাচাচ্ছে।’

লাবণিরা চলে যাবার পর নিখিল ঝিল্লীকে বলল—‘কী, তুমি আর দেরি করছ কেন? একজন তো নাচিয়েকে নিয়ে কেটে পড়ল, এবার তুমি একটা গাইয়েকে নিয়ে কেটে পড়।’

ঝিল্লী ভুরু বেঁকিয়ে নিখিলের পানে তাকাল—‘আমি কেটে পড়ব না। কিন্তু তোমার খবর কি? যে তোমাকে চিঠি লেখে তাকে ধরতে পারলে?’

নিখিল বলল—‘ধরিনি এখনো কিন্তু আর বেশি দেরি নেই। ব্যোমকেশবাবু বলেছেন শীগ্‌গির ধরে দেবেন। যেই ধরব অমনি পটাস করে বিয়ে করে ফেলব। আমার সঙ্গে চালাকি নয়।’

‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।’ মুচকি হেসে ঝিল্লী ওপরে চলে গেল।

পাঁচ দিন পরে ব্যোমকেশ ফিরে এল, তার সঙ্গে একটি মানুষ। নিম্নশ্রেণীর পশ্চিমা যুবক। ব্যোমকেশ যুবককে নিয়ে সোজা থানায় উপস্থিত হলো, রাখালবাবুর সঙ্গে কথা বলল। তারপর যুবককে রাখালবাবুর জিম্মায় রেখে বাড়ি গেল.। রাখালবাবুকে বলে গেল—‘আজ বিকেল চারটের সময় বেণীমাধবের ড্রয়িংরুমে থিয়েটার বসবে, তুমি হবে তার স্টেজ ম্যানেজার।’

বিকেল চারটের সময় ব্যোমকেশ বেণীমাধবের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখল, ড্রয়িংরুমে বাড়ির ন’জন লোক উপস্থিত আছে; অজয় আরতি মকরন্দ একটা সোফায় বসেছে, অন্য সোফায় বসেছে গঙ্গাধর গায়ত্রী আর ঝিল্লী। সনৎ আর নিখিল দুটো চেয়ারে দূরে দূরে বসেছে; আর মেদিনী মেঝের ওপর দেয়ালে ঠেস দিয়ে উদাসভাবে বসে আছে। সকলের মুখেই বিরক্তি ও অবসাদের ব্যঞ্জনা। ড্রয়িংরুমের দোরে ও বারান্দায় পুলিস গিজগিজ করছে। রাখালবাবু একটা ছোট সুটকেস হাতে নিয়ে অধীরভাবে বারান্দায় পায়চারি করছেন।

ব্যোমকেশ পৌঁছুতেই রাখালবাবু তাকে বললেন—‘সব তৈরি, এবার তবে আরম্ভ করা যাক।’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল—‘হিম্মৎলাল?’

রাখালবাবু বললেন—‘তাকে লুকিয়ে রেখেছি। যথাসময়ে সে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করবে।’

‘বেশ, এসো তাহলে। তোমার হাতে ওটা—? ও বুঝেছি।’

রাখালবাবু ব্যোমকেশকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলেন। সকলে নড়েচড়ে বসল, মকরন্দর মুখের ভ্রূকুটি গভীরতর হলো। রাখালবাবু মাঝখানের নীচু টেবিলটাকে এক পাশে টেনে এনে দুটো হাল্কা চেয়ার তার সামনে রাখলেন; হাতের সুটকেস টেবিলের ওপর রেখে ব্যোমকেশকে বললেন—‘বসুন।’ নিজে সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ব্যোমকেশ হাসিমুখে একবার সকলের মুখের দিকে তাকাল, বলল—‘আপনারা শুনে সুখী হবেন বেণীমাধববাবুর হত্যাকারী কে তা আমরা জানতে পেরেছি, আততায়ীর বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণও পেয়েছি। আসামী এই ঘরেই আছে, এখনি তার পরিচয় পাবেন।’

সকলে সন্দেহভরা চোখে পরস্পর তাকাতে লাগল; বেশি দৃষ্টি পড়ল গঙ্গাধরের ওপর। ব্যোমকেশ শান্ত স্বরে বলে চলল—‘আমরা গোড়াতেই একটা ভুল করেছিলাম, ভেবেছিলাম বেণীমাধববাবুই আসামীর প্রধান লক্ষ্য। ভুলটা অস্বাভাবিক নয়; বেণীমাধববাবু বড় মানুষ ছিলেন, তিনি এমন উইল করতে যাচ্ছিলেন যাতে তাঁর উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা ছিল; মেঘরাজ ছিল বেণীমাধবের দ্বাররক্ষী, বেণীমাধবকে যে ব্যক্তি মারতে চায় সে মেঘরাজকে না মেরে ঘরে ঢুকতে পারবে না তাই তাকে মেরেছে। মেঘরাজের মত লোক যে হত্যাকারীর প্রধান লক্ষ্য হতে পারে তা ভাবাই যায় না।

‘আমি একদিন বেণীমাধববাবুর ঘরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম তাঁর ক্ষুর রয়েছে; সাবেক কালের লম্বা ক্ষুর, যে-ক্ষুর দিয়ে মেঘরাজ তাঁর দাড়ি কামিয়ে দিত। ক্ষুরটা খাপ থেকে বের করে পরীক্ষা করলাম, তাতে কোথাও একটিও আঙুলের ছাপ নেই; কে যেন খুব সাবধানে ক্ষুরটি মুছে খাপের মধ্যে রেখেছে। কিন্তু কেন? স্বাভাবিক অবস্থায় অন্তত মেঘরাজের আঙুলের ছাপ তাতে থাকা উচিত।

‘সন্দেহ হলো। সেই ক্ষুর দিয়ে আমি নিজে দাড়ি কামাতে গিয়ে দেখলাম ক্ষুর একেবারে ভোঁতা, তা দিয়ে দাড়ি কামানো দূরের কথা, পেন্সিল কাটাও যায় না। তখন আর সন্দেহ রইল না যে, এই ক্ষুর দিয়েই দু’জন লোকের গলা কাটা হয়েছে এবং তার ফলেই ক্ষুরটি ভোঁতা হয়ে গেছে। ডাক্তারি পরীক্ষাতেও প্রমাণ হলো যে, ওই ক্ষুর দিয়েই দু’জনের গলা কাটা হয়েছিল।

‘কিন্তু ক্ষুর ছিল ঘরের মধ্যে, আসামী এসেছিল বাইরে থেকে; ঘরে ঢোকবার আগেই সে ক্ষুর পেল কোথা থেকে? নিশ্চয় কেউ ক্ষুরটি আগেই ঘর থেকে সরিয়েছিল।

‘কে সরাতে পারে? সেদিন সকালে মেঘরাজ ওই ক্ষুর দিয়ে বেণীমাধবের দাড়ি কামিয়ে দিয়েছিল; তারপর সারা দিনে তাঁর ঘরে যারা এসেছিল তারা কেউ ক্ষুরের কাছে যায়নি। ও ঘরে নিত্য আসে যায় কেবল দু’জন: মেঘরাজ ও মেদিনী। মেঘরাজ নিজের গলা কাটবার জন্যে ক্ষুর চুরি করবে না। তাহলে বাকি রইল কে?’

সকলের দৃষ্টি মেদিনীর ওপর গিয়ে পড়ল। মেদিনী দেয়ালে ঠেস দিয়ে আগের মতই বসে আছে, মাথার ওপরকার আঁচলটা দু’ হাতে একটু তুলে ধরে নির্নিমেষ চোখে ব্যোমকেশের পানে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ সনৎ কথা বলল—‘একটা কথা বুঝতে পারছি না। হত্যাকারী মামার ক্ষুর দিয়ে গলা কাটতে গেল কেন? অন্য অস্ত্র কি ছিল না?’

ব্যোমকেশ বলল—‘আসামী লোকটা ভারি ধূর্ত। সে জানে যে-অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয় সে-অস্ত্রকে বেবাক লোপাট করে দেওয়া সহজ নয়। তাই সে মতলব করেছিল, বেণীমাধবের ক্ষুর দিয়ে গলা কাটবার পর ক্ষুরটি ভাল করে মুছে যথাস্থানে রেখে দেবে, ওই ক্ষুর দিয়ে যে খুন হয়েছে একথা কারুর মনেই আসবে না, পুলিস অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াবে। বুঝতে পেরেছেন?’

‘পেরেছি। এবার আপনার বক্তৃতা শেষ করুন।’

ব্যোমকেশ আবার নির্লিপ্ত স্বরে বলতে আরম্ভ করল—‘মেদিনী ছোট ঘরের মেয়ে, কিন্তু পুরুষের চোখ দিয়ে যারা ওর পানে তাকিয়েছে তারাই জানে কী প্রচণ্ড ওর দেহের চৌম্বক শক্তি। সে সুচরিত্রা মেয়ে কিনা তা আমরা জানি না। যদি কুচরিত্রা হয় তাহলে মনে রাখতে হবে যে, মেঘরাজ ও বৃদ্ধ বেণীমাধব ছাড়া বাড়িতে আরো পাঁচজন সমর্থ পুরুষ আছে। স্ত্রী-পুরুষের অবৈধ আসক্তির ফলে অসংখ্য ট্র্যাজেডি ঘটেছে, আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

‘আমরা মেদিনীর ঘরে গিয়ে তাকে জেরা করেছিলাম; মেঘরাজের সৈনিক জীবনের দলিলপত্র থেকে তার দিল্লীর ঠিকানা সংগ্রহ করলাম। তারপর একটা অপ্রত্যাশিত জিনিস পেলাম। মেদিনীর একটি চুল-বাঁধার কাঠের বাক্স ছিল, তার ডালা খুলে দেখলাম আয়নার ওপর একটা ফটো আঁটা রয়েছে। মেদিনীর ফটো, সাম্প্রতিক ছবি। সে খাটের ধারে বসে হাসছে। আমি আবার বাক্সের ডালা বন্ধ করে দিলাম, মেদিনী কিছু জানতে পারল না। পরদিন শুনলাম বাক্সটা চুরি গিয়েছে।’ ব্যোমকেশ ঘাড় তুলে রাখালবাবুর পানে চাইল।

রাখালবাবু টেবিলের ওপরে সুটকেসটা খুলতে খুলতে অবিচলিত মুখে বললেন—‘চুরি গিয়েছিল, আমরা খুঁজে বার করেছি।’ তিনি সুটকেস থেকে প্রসাধনের বাক্সটা বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন।

ব্যোমকেশ বলল—‘ছবিটা আছে নিশ্চয়।’

রাখালবাবু ডালা খুলে বললেন—‘আছে।’ কে চুরি করেছিল, কোথায় পাওয়া গেল এ সম্বন্ধে তিনি নীরব রইলেন। মনে হয়—চুরির ব্যাপারটা নিছক ধোঁকার টাটি।

ব্যোমকেশ বলল—‘বেশ। তারপর আমরা বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে একে একে দেখা করলাম। বাড়িতে যতগুলো বর্ষাতি ছিল সংগ্রহ করলাম; কেবল মকরন্দর বর্ষাতি পাওয়া গেল না। মকরন্দ সম্বন্ধে একটা কথা মনে রাখা দরকার—বেণীমাধবের হুকুমে মেঘরাজ তার গালে চড় মেরেছিল; অর্থাৎ দু’জনেরই ওপর তার গভীর আক্রোশ। সে-রাত্রে ন’টার সময় সে বাড়িতে এসেছিল, তারপর গভীর রাত্রে কখন চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল কেউ জানে না। সে যখন রেস-কোর্সে ধরা পড়ল তখন তার পকেটে পৌনে দুশো টাকা ছিল। কোথা থেকে সে এত টাকা পেল তা বলতে চায় না।

‘যাহোক, বর্ষাতি কেন সংগ্রহ করলাম সেই কথা বলি। যারা মতলব এঁটে ঘুমন্ত ললাকের গলা কাটতে যায় তারা জানে এই উপায়ে নিঃশব্দে খুন করা যায় বটে, কিন্তু আততায়ীর নিজের কাপড়-চোপড়ে প্রচুর রক্ত লাগার সম্ভাবনা। কাপড়-চোপড়ে রক্ত লাগ্‌লে সহজে ধোয়া যায় না, রক্তের দাগ থেকে যায়। তাই পাশ্চাত্ত্য দেশে খুন করবার সময় খুনী গায়ে বর্ষাতি চড়িয়ে নেয়; বর্ষাতির তেলা গায়ে যেটুকু রক্ত লাগে তা সহজেই ধুয়ে ফেলা যায়। পাশ্চাত্ত্য রহস্য রোমাঞ্চের বই যাঁরা পড়েছেন তাঁরাই একথা জানেন। আমরা বর্ষাতিগুলোকে মালিকের নামের টিকিট মেরে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্যে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দিলাম।

‘তারপর আমি গেলাম দিল্লী। এতক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আসামী কে, কিন্তু আরো পাকা প্রমাণের দরকার ছিল। দিল্লীতে গিয়ে যে-বস্তিতে মেঘরাজ থাকত, সেখানে খোঁজখবর নিতেই অনেক কথা বেরিয়ে পড়ল। মেদিনী মেঘরাজের স্ত্রী নয়। মেঘরাজ বিপত্নীক ছিল; বেণীমাধব যখন তাকে বললেন, স্ত্রীকে নিয়ে এসো, তখন সে দিল্লী গিয়ে মেদিনীকে স্ত্রী সাজিয়ে নিয়ে এল। মেদিনীর স্বামী আছে, কিন্তু তার চরিত্র ভাল নয়; মেঘরাজের সঙ্গে আগে থাকতেই তার ঘনিষ্ঠতা ছিল; সে মেঘরাজের সঙ্গে পালিয়ে এল। বুঝে দেখুন মেদিনী কি রকম মেয়েমানুষ।’

মেদিনীর চোখ আতঙ্কে ভরে উঠেছিল, সে হঠাৎ চীৎকার করে উঠল—‘না না, ঝুট বাত।’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পানে চোখ তুলল, তিনি দোরের দিকে চেয়ে হাঁক দিলেন—‘হিম্মৎলাল!’

যে পশ্চিমা যুবককে ব্যোমকেশ দিল্লী থেকে সঙ্গে এনেছিল সে ঘরে প্রবেশ করল; চুড়িদার পায়জামা ও শেরোয়ানি পরা ক্ষীণকায় যুবক। ব্যোমকেশ তার দিকে আঙুল দেখিয়ে মেদিনীকে জিজ্ঞেস করল—‘একে চিনতে পার?’

মেদিনী তড়িৎপৃষ্টের মত উঠে দাঁড়িয়েছিল, ভয়ার্ত চোখে হিম্মৎলালের দিকে একবার চেয়ে আবার মাটিতে আছড়ে পড়ল, মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল।

‘হিম্মৎলাল, মেদিনী তোমার কে?’

‘জি, মেদিনী আমার বিয়াহী ঔরৎ, আমাকে ছেড়ে মেঘরাজের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল।’

‘আচ্ছা, তুমি এখন বাইরে যাও।’

হিম্মৎলাল মেদিনীর পানে বিষদৃষ্টি হেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করল—‘দেখা যাচ্ছে মেদিনীই যত নষ্টের গোড়া। সে স্বামীকে ছেড়ে মেঘরাজের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল, তারপর এখানে এসে আর একজন উচ্চতর বর্গের মানুষকে তার মোহময় কুহকজালে জড়িয়ে ফেলল। কিন্তু মেঘরাজ কড়া প্রকৃতির লোক, সে জানতে পারলে মেদিনীর উচ্চাশা ধূলিসাৎ হবে; তাই তাকে সরানো দরকার হয়ে পড়ল। কিন্তু একলা মেঘরাজকে খুন করলে ধরা পড়ার ভয় আছে, তাই মেঘরাজের সঙ্গে বেণীমাধবকেও খুন করে পুলিসের চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। বেণীমাধবের সঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়েদের বিরোধ যে বেশ ঘনিয়ে উঠেছে তা মেদিনীর অজানা ছিল না।

‘কিন্তু সত্যিই কি মেদিনী নিজের হাতে দু’জনের গলা কেটেছে? ছোরা ছুরি ক্ষুর মেয়েদের অস্ত্র নয়, মেয়েদের অস্ত্র বিষ; বিষ খাওয়াবার সুযোগ থাকলে তারা ছোরা ছুরি ব্যবহার করে না। মেদিনীর বিষ খাওয়াবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল, সে বেণীমাধব ও মেঘরাজের খাবার নিজের হাতে রান্না করত।

‘দেখা যাক, মেদিনীর সহকারী কে?—মেদিনী, তোমার চুল বাঁধার বাক্সে আয়নার গায়ে একটা ফটো লাগানো আছে। কে ফটো তুলেছিল?’

মেদিনী উত্তর দিল না, মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। ব্যোমকেশ তখন সনতের দিকে ফিরে বলল—‘সনৎবাবু, আপনি ফটোগ্রাফির বিশেষজ্ঞ, দেখুন তো একবার ছবিটা।’

সনৎ ব্যোমকেশের পানে সন্দেহভরা ভ্রূকুটি করল, তারপর অনিচ্ছাভরে উঠে এল। রাখালবাবু বাক্সের ডালা খুলে ধরলেন। সনৎ সামনে ঝুঁকে ছবিটা দেখল; তার মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। সে অবরুদ্ধ স্বরে বলল—‘মেদিনীর ছবি।’

ব্যোমকেশ বলল—‘কে ছবি তুলেছে বলতে পারেন?’

‘তা কি করে বলব!’

‘ভাল করে দেখুন। মেদিনীকে খাটে বসিয়ে ছবি তোলা হয়েছে, মেদিনীর পেছনে খাটের মাথায় কারুকার্য দেখা যাচ্ছে। কার খাট চিনতে পারছেন না?’

সনতের চোখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল—‘কি বলতে চান আপনি?’

ব্যোমকেশ বলল—‘আপনি নিজের ঘরে রাত্তির বেলা ফ্ল্যাশ-লাইট দিয়ে মেদিনীর ছবি তুলেছিলেন। আপনি মেদিনীর গুপ্ত-প্রণয়ী। মেঘরাজ যখন বেণীমাধবের দোরের সামনে শুয়ে ঘুমোত তখন মেদিনী আপনার ঘরে যেত।’

সনৎ কিছুক্ষণ জবাফুলের মত লাল চোখে চেয়ে রইল, শেষে বিকৃত গলায় বলল—‘তাতে কি প্রমাণ হয় আমি মামকে খুন করেছি?’

‘সনৎবাবু, আপনি মেদিনীর মোহে পড়ে দিগ্‌বিদিক জ্ঞান হারিয়েছিলেন, মেঘরাজকে খুন করে মেদিনীর ওপর একাধিপত্য স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আপনার বোধহয় প্ল্যান ছিল খুনের মামলা মিটে গেলে মেদিনীকে নিয়ে অন্য কোথাও বাসা বাঁধবেন।’

‘আমি খুন করিনি।’

‘আপনার দেহে খুনীর রক্ত আছে, আপনার বাবা আপনার মাকে খুন করে ফাঁসি গিয়েছিলেন।’

‘আমি খুন করিনি। খুন করেছে—ওই মেদিনী।’

মেদিনী ধড়মড়িয়ে হাঁটুর ওপর উঠে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে উঠল—‘নেহি নেহি নেহি—’

ব্যোমকেশ বলল—‘ঠিক কথা। মেদিনী নিজের হাতে খুন করেনি। খুন করেছেন আপনি।’

‘প্রমাণ আছে?’

‘ছোট্ট একটা প্রমাণ আছে। খুন করার পর আপনি বর্ষাতিটাকে খুব ভাল করেই ধুয়েছিলেন, কিন্তু পকেটের মধ্যে কয়েক ফোঁটা রক্ত রয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, রক্তটা বেণীমাধববাবুর ব্লাড-গ্রুপের রক্ত।’

মেদিনী বলে উঠল—‘হাঁ হাঁ, সনৎবাবু খুন করেছে, আমি কিছু জানি না, আমি বে-কসুর।’

হঠাৎ সনৎ বুনো মোষের মত ঘাড় নীচু করে চাপা গর্জন করতে করতে মেদিনীর দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর ইতিমধ্যে সনতের দু’পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা সনতকে ধরে ফেললেন। রাখালবাবু তার হাতে হাতকড়া পরালেন। সনতের ক্ষিপ্র উন্মত্ততা হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। দুই প্রহরীর মাঝখানে সে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মেদিনী আবার বলে উঠল—‘আমি কিছু জানি না, আমি বে-কসুর।’

ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে বলল—‘না মেদিনী, তুমি বে-কসুর নও। বেণীমাধববাবুর ক্ষুর চুরি করে তুমিই সনৎবাবুকে দিয়েছিলে। তারপর সে যখন গভীর রাত্রে ফিরে এসে সদর দোরে টোকা দিয়েছিল তখন তুমি দোর খুলে তাকে ভিতরে এনেছিলে; সে কাজ সেরে চলে যাবার পর তুমি দোর বন্ধ করে দিয়েছিলে। তোমরা দু’জন সমান অপরাধী।’

মেদিনী আবার মেঝের ওপর আছড়ে পড়ল।

ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে। আসামী দু’জনকে চালান করে দিয়ে রাখালবাবু বাড়ির ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিয়েছেন। বাইরে ঘনায়মান সন্ধ্যা। রাখালবাবু সনতের ঘরে গিয়ে তার আলমারি খুলে অ্যালবামের সারি থেকে একটি একটি অ্যালবাম খুলে পাতা উল্টে দেখছিলেন। ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে সিগারেট টানতে টানতে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

রাখালবাবু অবশেষে একটি অ্যালবাম হাতে নিয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে বসলেন, নিবিষ্ট মনে অ্যালবামের ছবিগুলি দেখতে লাগলেন। প্রতি পৃষ্ঠায় একটি শিথিলবসনা তরুণীর ছবি। শিকারী যেমন বাঘ শিকার করে তার চামড়া দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে, সনৎ যেন প্রকারান্তরে তাই করেছে।

অ্যালবাম শেষ করে রাখালবাবু একটি নিশ্বাস ফেললেন, সিগারেট ধরিয়ে বললেন—‘সনৎ গাঙ্গুলির রক্তে পাগলামির বীজ অছে, কিন্তু সে যে একটি রসিক চূড়ামণি তাতে সন্দেহ নেই।’

ব্যোমকেশ কাছে এসে অ্যালবামের পাতা উলটে দেখল, তারপর বলল—‘শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য বলেছেন, নারী নরকের দ্বার। সনৎ নরকের অনেকগুলো দ্বার খুলেছিল, তাই শেষ পর্যন্ত তার নরক-প্রবেশ অনিবার্য হয়ে পড়ল।’

‘কিন্তু সনৎ মেদিনীর মত মেয়ের জন্য এমন ভয়ঙ্কর কাজ করল ভাবতে আশ্চর্য লাগে।’

‘রাখাল, মেদিনীর মত মেয়েকে তুচ্ছজ্ঞান কোরো না। যুগে যুগে এই জাতের মেয়েরা জন্মগ্রহণ করেছে—কখনো ধনীর ঘরে কখনো দরিদ্রের ঘরে—পুরুষের সর্বনাশ করার জন্যে। দ্রৌপদী এই জাতের মহিলা ছিলেন—কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মূলে আছে দ্রৌপদী। ইলিয়ডের হেলেনও তাই। এ যুগেও এই জাতের মেয়ের অভাব নেই। ওরা সকলেই যে চরিত্রহীনা তা নয়, কিন্তু ওদের এমন একটা কিছু আছে যা পুরুষকে—বিশেষত সনতের মত দুশ্চরিত্র পুরুষকে—ক্ষেপিয়ে দিতে পারে, কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্মত্ত করে তুলতে পারে। জ্যেষ্ঠ আলেকজান্ডার দুমা একটা বড় দামী কথা বলেছিলেন—cherchez la femme: যেখানে এই ধরনের ব্যাপার ঘটে সেখানে মেয়েমানুষ খুঁজবে, মূলে মেয়েমানুষ আছে।’

‘তা বটে।’ রাখালবাবু উঠলেন—‘দেখা যাচ্ছে বেণীমাধবের মেয়ে এবং পুত্রবধূ তাঁকে বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করেনি, বৃদ্ধের জীর্ণ পাকযন্ত্রই দায়ী। —চলুন, এবার যাওয়া যাক। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, এক পেয়ালা গরম চায়ের জন্যে প্রাণ কাঁদছে।’

‘চল আমার বাড়িতে, তরিবৎ করে চা খাওয়া যাবে।’

‘উত্তম প্রস্তাব।’

ঘরের বাইরে এসে রাখালবাবু দোরে তালা লাগালেন, তারপর সদর দরজার দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন ঝিল্লী সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে, তার পিছনে প্রকাণ্ড ট্রে’র ওপর চায়ের সরঞ্জাম এবং কচুরি-নিমকির প্লেট নিয়ে দাসী আসছে। ব্যোমকেশ বলল—‘রাখাল, তোমার প্রাণের কান্না ভগবান শুনতে পেয়েছেন। চল, ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসা যাক।’

রাখালবাবু সাবধানী লোক, বললেন—‘দাঁড়ান, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’

ঝিল্লী তাদের কাছে এসে সলজ্জ স্বরে বলল—‘মা আপনাদের জন্যে চা জলখাবার পাঠিয়ে দিলেন।’

‘দেখলে তো?’ সকলে ড্রয়িংরুমে গেল। ঝি টেবিলের ওপর ট্রে রেখে চলে গেল; ঝিল্লীও তার অনুগমন করছিল, ব্যোমকেশ বলল—‘ঝিল্লী, আমরা বড় ক্লান্ত; তুমি আমাদের চা ঢেলে দাও, আমরা বসে বসে খাই।’

ঝিল্লী ফিরে এসে টি-পট থেকে তাদের চা ঢেলে দিল, জলখাবারের প্লেট তাদের সামনে রাখল। ব্যোমকেশ অর্ধমুদিত চোখে কচুরি চিবোতে চিবোতে দেখল, ঝিল্লী গুটি গুটি দোরের দিকে যাচ্ছে।

‘ঝিল্লী, শোনো, চলে যেও না। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

ঝিল্লী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর আস্তে আস্তে ফিরে এসে ব্যোমকেশের পাশে দাঁড়াল। ব্যোমকেশ সংকেতভরা চোখে রাখালবাবুর পানে তাকাল; রাখালবাবু অলসভাবে চায়ের পেয়ালা শেষ করে একটি গানের কলি গুঞ্জন করতে করতে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।

ঝিল্লী ব্যোমকেশের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তার যে বুক ঢিবঢিব করছে তা তার মুখ দেখে বোঝা যায় না। ব্যোমকেশ খাটো গলায় একটু হাসল, বলল—‘সম্পর্কে নিখিল তোমার মামা হয়। বটে, কিন্তু অনেক দূরের সম্পর্ক। আইনত বিয়ে আটকায় না।’

ঘরের ছায়া-ছায়া অন্ধকারে দেখা গেল না—ঝিল্লীর মুখ রাঙা হয়ে উঠেছে। তারপর তার ক্ষীণস্বর শোনা গেল—‘কি করে জানলেন?’

ব্যোমকেশ বলল—‘বোকা মেয়ে! সবগুলো চিঠিতেই তোমার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। —আচ্ছা, তুমি এখন কোণের চেয়ারে গিয়ে বোসো। আরো কথা আছে।’

ঝিল্লী নেংটি ইঁদুরের মত ঘরের অন্ধকার কোণে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘরে যেন ব্যোমকেশ ছাড়া আর কেউ নেই।

বাইরে দু’জোড়া জুতোর শব্দ শোনা গেল। রাখালবাবু নিখিলকে নিয়ে ফিরে এলেন।

‘রাখাল, আলোটা জ্বেলে দাও।’

দোরের পাশে সুইচ। রাখালবাবু সুইচ টিপলেন, কয়েকটা উজ্জ্বল বাল্‌ব জ্বলে উঠল। নিখিল কোনোদিকে না তাকিয়ে ব্যোমকেশের পাশে গিয়ে বসল, অনুরাগপূর্ণ চোখে তার পানে চেয়ে বলল—‘ব্যোমকেশদা, আপনি ভেলকি জানেন। সনৎদা আমার মাসতুত ভাই, তাকে সারা জীবন দেখছি, কিন্তু সে যে এমন মানুষ তা ভাবতেও পারিনি।’

ব্যোমকেশ বলল—‘নিখিল, মুখ দেখে যদি মানুষের মনের কথা জানা যেত, তাহলে আইন, আদালত, পুলিস, সত্যান্বেষী কিছুই দরকার হতো না; তুমিও মুখ দেখেই বুঝতে পারতে কোন্ মেয়েটি তোমাকে বেনামী চিঠি লেখে।’

‘তা তো বটেই, তা তো বটেই।’ নিখিল ব্যোমকেশের আর একটু কাছে ঘেঁষে বসল, ষড়যন্ত্রকারীর মত ফিসফিস করে বলল—‘আপনি কিছু বুঝতে পেরেছেন নাকি?’

ব্যোমকেশ হাসল—‘আগে তুমি বলো দেখি মেয়েটির সন্ধান যদি পাওয়া যায় তুমি কি করবে?’

নিখিলের চোখ উদ্দীপনায় জ্বলজ্বল করে উঠল—‘কী করব? বিয়ে করব। কানা হোক, খোঁড়া হোক, কাফ্রি হোক, হাবসি হোক, তাকে বিয়ে করব।’

ব্যোমকেশ বলল—‘তাহলে সন্ধান পাওয়া গেছে। —ঝিল্লী, এদিকে এসো।’

নিখিল চকিত হয়ে দোরের দিকে চাইল। ওদিকে ঘরের কোণে ঝিল্লীর সাড়াশব্দ নেই, সে চেয়ারের পিছনে লুকিয়েছে। নিখিল ব্যোমকেশের দিকে ফিরে উত্তেজিত স্বরে বলল—‘কাকে ডাকলেন?’

‘এই যে দেখাচ্ছি—’ ব্যোমকেশ উঠে গিয়ে ঝিল্লীর হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল, তাকে হাত ধরে নিখিলের কাছে এনে বলল—‘এই নাও তোমার ঝিঁঝিঁ পোকা! ঝিঁঝিঁ পোকাকে চোখে দেখা যায় না, কেবল ঝংকার শোনা যায়। আমরা কিন্তু ধরেছি।’

নিখিলের মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম করল। সে দু’ হাত তুলে চীৎকার করল—‘অ্যাঁ! ঝিল্লী—ঝিল্লী আমাকে চিঠি লেখে! ঝিল্লী আমাকে ভালবাসে! কিন্তু—কিন্তু ও যে আমার ভাগনী!’

ব্যোমকেশ হেসে বলল—‘ভয় নেই, ভয় নেই। ঝিল্লী ভারি সেয়ানা মেয়ে, অপাত্রে হৃদয় সমর্পণ করেনি। তোমাদের যা সম্পর্কে তাতে বিয়ে আটকায় না।’

ঝিল্লীর মুখ অবনত, ঠোঁটের কোণে ভীরু হাসির যাতায়াত। নিখিলের মুখে ক্রমে ক্রমে একটি প্রকাণ্ড হাসি ফুটে উঠল, সে বলল—‘উঃ, কী সাংঘাতিক আজকালকার মেয়ে দেখেছেন ব্যোমকেশদা, আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছিল। আচ্ছা, আমিও দেখে নেব। বিয়েটা হয়ে যাক—’

এই সময় দোরের সামনে গঙ্গাধরকে দেখা গেল। লাঠি হাতে সে বোধহয় সায়াহ্ণিক নিত্যকর্ম করতে বেরুচ্ছিল। ঘরের মধ্যে গলার আওয়াজ শুনে ঘরে ঢুকেছে। এই অল্পক্ষণের মধ্যেই তার মেজাজ আবার সপ্তমে চড়ে গিয়েছে, সে রাখালবাবুকে লক্ষ্য করে কড়া সুরে বলল—‘এখানে আপনার কাজ শেষ হয়েছে, এখনো এখানে রয়েছেন কেন?’ রাখালবাবু উত্তর দেবার আগেই তার চোখ পড়ল ঝিল্লীর ওপর, অমনি ভয়ঙ্কর ভ্রূকুটি করে সে বলল—‘ঝিল্লী! তুই এখানে পুরুষদের মধ্যে কি করছিস?’

বাপকে দেখে ঝিল্লী একেবারে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, এখন চমকে উঠে ব্যোমকেশের পিছনে লুকোবার চেষ্টা করল। গঙ্গাধর বলল—‘ধিঙ্গি মেয়ে! পুরুষ-ঘেঁষা স্বভাব হয়েছে। চাবকে লাল করে দেব।’

নিখিল হঠাৎ যেন ক্ষেপে গেল, এক লাফে গঙ্গাধরের সামনে গিয়ে বলল—‘মুখ সামলে কথা বলুন। ঝিল্লীকে আমি বিয়ে করব।’

গঙ্গাধর প্রথমটা থতমত খেয়ে গেল, তারপর তারস্বরে চিক্কুর ছাড়ল—‘কী, আমার মেয়েকে বিয়ে করবি তুই, হতভাগা ছাপাখানার ভূত! ঠেঙিয়ে তোর হাড় ভেঙে দেব না!’ সে লাঠি আস্ফালন করতে লাগল।

এইবার গায়ত্রী ঘরে ঢুকল, উগ্র দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে বলল—‘কি হয়েছে, এত চেঁচামেচি কিসের?’

গঙ্গাধর কর্ণপাত করল না, চেঁচিয়ে বলল—‘বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। ছোট মুখে বড় কথা। আমার মেয়েকে তুই বিয়ে করবি!’

ঝিল্লী ছুটে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল, কানে কানে বলল—‘মা, তুমি যদি অমত কর আমি বিষ খেয়ে মরব।’ চরম অবস্থার সম্মুখীন হয়ে ঝিল্লীর মুখে কথা ফুটেছে।

গায়ত্রী একবার নিখিলকে ভাল করে দেখল, যেন আগে কখনো দেখেনি। নিখিল গিয়ে তার পায়ের ধুলো নিল। বলল—‘দিদি, ঝিল্লীকে আমি—মানে আমাকে ঝিল্লী বিয়ে করতে চায়। ব্যোমকেশদা বলেছেন সম্পর্কে বাধে না।’

গায়ত্রী ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করল—‘সত্যি সম্পর্কে বাধে না?’

ব্যোমকেশ বলল—‘না, ওরা first cousin নয়, সম্পর্কে বাধে না।’

গঙ্গাধর আরো গলা চড়িয়ে চীৎকার করল—‘শুনতে চাই না, কোনো কথা শুনতে চাই না। বেরিয়ে যাও তোমরা আমার বাড়ি থেকে, এই দণ্ডে বেরিয়ে যাও—’

গায়ত্রী ধমক দিয়ে উঠল—‘থামো তুমি। বাড়ি তোমার নয়, বাড়ি আমার। আমি সুধাংশুবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি; বাবা উইল করার আগেই মারা গেছেন, আইনত তাঁর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক আমার, এ বাড়িরও অর্ধেক আমার। —তুমি বাইরে যেখানে যাচ্ছিলে যাও না। যা করার আমি করব।’

গঙ্গাধর পিন ফোটানো খেলনার বেলুনের মত চুপসে গেল, তারপর ঘাড় হেঁট করে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলো।

গায়ত্রী ঝিল্লীর বাহুবন্ধন থেকে গলা ছাড়িয়ে তার হাত ধরে সোফায় বসল, নিখিলের দিকে চেয়ে হাকিমের মত হুকুম করল—‘কি কাণ্ড তোমরা বাধিয়েছ এবার বলো শুনি।’

নিখিল বলল—‘আমি কিছু জানি না দিদি, ওই ওকে জিজ্ঞেস করো। ব্যোমকেশদা, চিঠিগুলো কোথায়?’

ব্যোমকেশ পকেট থেকে চিঠি বের করে দিয়ে বলল—‘রাখাল, চল এবার আমাদের যাবার সময় হয়েছে। গায়ত্রী দেবী, চায়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। নিখিল, তুমি যে বৌ পেলে অনেক ভাগ্যে এমন বৌ পাওয়া যায়। ঝিল্লী, তুমিও কম সৌভাগ্যবতী নও। জীবনে যে-জিনিস সবচেয়ে দুর্লভ, সেই দুর্লভ হাসি তুমি পেলে। তোমাদের জীবনে হাসির ঢেউ খেলতে থাকুক। —এসো রাখাল।’