২৮. বাঁচালে প্রদ্যোত ডাক্তার

বাঁচালে। তাই বাঁচালে প্রদ্যোত ডাক্তার। ধীর অথচ সাহসী, নিজের শাস্ত্রে বিশ্বাসী নির্ভীক তরুণ চিকিৎসক।

তখন বেলা দুটো। মশায় খাওয়াদাওয়া সেরে সবে উপরের ঘরে এসে গড়িয়েছেন, অহীন সরকার ছুটে এল—মশায়কাকা! কাকা!

কে? অহীন? গলা শুনেই চিনেছিলেন মশায়। ঝড় তা হলে এসেছে! শায়িত অবস্থাতেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি। পারলেন না কিছু করতে প্রদ্যোত? নতুন ওষুধ, যার এত। নাম—কিছু হল না তাতে?

—একবার আসুন কাকা!

–কী হল?

–বুঝতে পারছি না। প্রবল জ্বর। ফোলা এমন বেড়েছে যে দেখে ভয় লাগছে। ছেলের সাড়া নাই। বেঘোর। আপনি একবার আসুন!

—উনি গিয়ে কী করবেন বাবা? পাস-করা ডাক্তারও নয়, আজকালকার চিকিৎসাও জানেন না! হাতুড়ে। তার ওপর উনি গেলে তোমাদের নতুন ডাক্তার যদি বলে-হাত ধরব না, দেখব না? মধুর অথচ তীক্ষকণ্ঠে কথাগুলি বলতে বলতেই বেরিয়ে এলেন আতর-বউ। তার ওপর তোমার জামাই হালফ্যাশানে লেখাপড়া-জানা ছেলে!

—চুপ কর আতর-বউ। ছিঃ! চল—আমি যাই অহীন।

–চুপ করব? ছিঃ! আতর-বউ বিস্মিত হয়ে রইলেন স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে।

–হ্যাঁ, চুপ করবে বৈকি।

বলতে বলতেই বেরিয়ে গেলেন মশায়। আতর-বউয়ের কথার দিকে কান দিলে চলবে না এখন।

 

স্তব্ধ উৎকণ্ঠায় ঘরখানা যেন নিশীথ রাত্রির মত গাঢ় হয়ে উঠেছে। ব্যাধির প্রবল আক্রমণে শিশু চৈতন্যহীন-স্তিমিত দৃষ্টি, নিথর হয়ে পড়ে আছে। শুধু জ্বরজর্জর ঘন শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ছেলেটির বুক পেট উঠছে নামছে; যেন হাঁফাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে অস্ফুট কাতর শব্দ নিশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে। মুখের ফোলার অবস্থা দেখে চমকে উঠলেন মশায়। এদিকে বুকের উপর পর্যন্ত চলে এসেছে, ওদিকে দুই কৰ্ণমূল পার হয়ে পিছনের দিকে ঘাড় লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছে। চামড়ার নিচেটা যেন রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে।

ঘরের লোকগুলির মুখে ভাষা নাই, উৎকণ্ঠায় ভয়ে ভাষা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, নিম্পলক আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। নিশীথ আকাশের তারার মত জেগে রয়েছে। অসহায় গ্ৰহউপগ্রহ সব-অসহায়; তারা তাকিয়ে দেখছে একটি নবজাত গ্ৰহ বিচিত্র কারণে নিভে যাচ্ছে।

মশায় এসে দাঁড়ালেন বিছানার পাশে। সন্তৰ্পণে বসে হাতখানি তুলে দিলেন। অহীন বললেচার। আপনাকে ডাকতে যাবার আগে দেখেছি। প্রদ্যোত ডাক্তারের বন্ধু অরুণবাবু যখন। রক্ত নিয়ে গেলেন তখন ছিল তিন, তিনের কিছু কম ছিল। তারপর দেড়টার সময় বেশডাকে। সাড়া দেয় না দেখে জ্বর লেখা হল—একশো তিন পয়েন্ট দুই। দুটোর সময় প্রায় চার। দুপয়েন্ট কম। তারপর চার দেখে আপনার কাছে গিয়েছিলাম।

হাতখানি নামিয়ে দিলেন মশায়, বললেন– ডাক্তারের কাছে কাউকে পাঠিয়েছ?

—জামাই নিজে ছুটে গিয়েছে।

–তিনি আসুন। তিনি ওষুধ দেবেন।

–আপনি কিছু মুষ্টিযোগ

–আমার মুষ্টিযোগ কাজ করতে করতে রোগ হাতের বাইরে চলে যাবে বাবা। রোগ রক্তে। ইনজেকশন রক্তে কাজ করবে। তিনি আসুন।

—মশায়দাদু, আমার খোকন–?

–ভয় কী ভাই? ডাক্তার আসুন। ওষুধ দেবেন। এখন ঝড় উঠেছে দিদি। শক্ত হয়ে হাল ধরে বোসো। ভয় কী? নিম্পাপ শিশু, বালাধাত; ওষুধ পড়বামাত্র ধরবে। বাইরে বেরিয়ে এসে মশায় বললেন– জর আরও বেড়েছে অহীনচারের ওপর। এখনও বাড়বে।

–বাড়বে?

–বাড়বে—এই যে ডাক্তারবাবু এসে গিয়েছেন।

প্রদ্যোতকে নিয়ে এসে পৌঁছল অহীনের জামাই। অহীন বলে উঠল, জ্বর আরও বেড়েছে। বাবা। কাকা বলছেন–হাত দেখেছেন–

ডাক্তার ভিতরে চলে গেল বিনা বাক্যব্যয়ে। মশায়ের হাত দেখায় সে অসন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে হল।

মশায় ক্ষুণ্ণ হলেন না। ভিতরেও গেলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। রোগী এখানে শিশু। তার জীবনের কোনো ত্রুটিতে মৃত্যুকে নিমন্ত্ৰণ নাই। এই মৃত্যুই অকালমৃত্যু। এমন মৃত্যু দেখেছেন অনেক। কিন্তু সেখানে যুদ্ধ করেছেন প্ৰতিপক্ষ হিসেবে। আজ দেখছেন। ব্যাধির সঙ্গে নয়, এ যুদ্ধ মৃত্যুর সঙ্গে, রোগীর খুব কাছে এসে সে দাঁড়িয়েছে, শিয়রে নয়তো পাশে, নয়তো পায়ের তলায়, হয়ত মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধ, বধির, পিঙ্গলকেশী।

ব্যস্তভাবে কে বেরিয়ে এল। কে? অহি সরকারের ছেলে। একখানা বাইসিকেল টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পিছনে এল ডাক্তার নিজে—চিৎকার করে বললে–বলবে, আমি বসে রয়েছি। এক্ষুনি আসেন যেন!

—ডাক্তারবাবু? মশায় ডাকলেন।

–বলুন।

–কেমন দেখলেন? আমি ছেলেটিকে ভালবাসি ডাক্তারবাবু।

—আপনি তো নিজে দেখেছেন। প্রদ্যোত একটু হাসলে।—আপনি যা দেখেছেন ঠিকই দেখেছেন, জ্বর বেড়েছে। সাড়ে চারের কাছে।

—কী বুঝছেন?

একটু চুপ করে থেকে প্রদ্যোত বললেচারুবাবুকে কল দিয়ে পাঠালাম। ওঁর সঙ্গে একটু পরামর্শ করব। আমার একটু বাঁধা লাগছে। স্ট্রেপ্টোকাসে তো সাধারণত এমনভাবে ফোলে না! এত জ্বরঃ ভাবছি মামস্ নয় তো?

–মামস্ নয় ডাক্তারবাবু। সেটা আমি আপনাকে বলছি। রোগীর রক্ত বিষাক্ত হয়েছে। বেশি সময় নেই ডাক্তারবাবু, যা করবার এখুনি করুন।

—তা হলে কী বলছেন? সেলুলাইটিস? ইরিসিপ্লাস? বাঁচবে না বলছেন?

–নিদান হাঁকার দুর্নাম আমার আছে। হাসলেন মশায়—কিন্তু না। সে কথা বলছি না আমি। নাড়িতে এখনও পাই নি। রোগ কখনও গোড়া থেকেই আসে মৃত্যুকে নিয়ে। কখনও রোগ বিস্তার লাভ করে মৃত্যু ঘটায়। আপনি আপনার ওষুধ দিন, মাত্রা দ্বিগুণ করুন। রোগ হু-হু করে বাড়ছে।

–বলছেন দেব পেনিসিলিন? আট ঘণ্টা অবশ্য পার হয়ে গেছে। চিন্তিত মুখে ঘরের মধ্যে চলে গেল প্রদ্যোত ডাক্তার। আবার বেরিয়ে এল। নিজের সাইকেলটা তুলে নিয়ে চলে গেল। বলে গেল—আসছি। পেনিসিলিন নিয়ে আসছি আমি। পাঁচ লাখ চাই। আড়াই লাখ আছে আমার কাছে।

বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে মশায় প্রদ্যোতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

চারুবাবু আসবার আগেই প্রদ্যোত পাঁচ লাখ পেনিসিলিন দিয়ে বেরিয়ে এল। খাবার ওষুধ তৈরি করতে লাগল। বসে রইল স্তব্ধ হয়ে রোগীর দিকে চেয়ে।

চারুবাবু এলেন। তখন জ্বর একশো চার পয়েন্ট ছয়—বললেন–তাই তো! মাম্স্ বলছেন?

–না—সেলুলাইটিস কি—

চোখ বিস্ফারিত করে তাকালেন চারুবাবু। বুঝেছেন তিনি। মশায় দেখেছেন নাকি?

–দেখেছেন। আমি পাঁচ লাখ পেনিসিলিন দিয়েছি।

–দিয়েছেন? তাই দিন। থাকলে ওতেই থাকবে। মশায় কই?

মশায় গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ বসে আবার নাড়িটা ধরলেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখলেন। ঝড়ের শেষের কিছু পূর্বে যেমন আলোর আভা ফুটে ওঠে বর্ষামুখর ছায়াচ্ছন্নতার মধ্যে-তেমনি যেন মনে হচ্ছে ঝড়ের ঊর্ধ্বগতিতে এখনকার মত ছেদ পড়ল। জ্বর কমবে এবার। মৃত্যু সরে যাচ্ছে—পায়ে পায়ে পিছনে হটে গেল খানিকটা। আবার রাত্রি তিনটেচারটের সময় একবার আসবে।

বেরিয়ে এলেন মশায়। চারুবাবু চলে গিয়েছিলেন। প্রদ্যোত ব্যাগ গোছাচ্ছে! মশায় বললেন––জ্বর বাঁধ মেনেছে ডাক্তারবাবু। এবার কমবে।

–কমবে?

–হ্যাঁ। নাড়ি দেখে এলাম।

–থার্মোমিটার দিয়েছিলেন?

–না। আরও আধঘণ্টা পর দেখবেন। এখন থার্মোমিটারে ধরা যাবে না।

তাই কমল। পাঁচটার সময় জ্বর উঠল তিন পয়েন্ট ছয়। রোগী চোখ মেলে। কথা কইলে। রোগীর চোখে পলক পড়ল, ভাষার মুখরতা ফুটল দৃষ্টিতে।

জীবনমশায় তাকিলে রইলেন–রক্তাভ স্ফীতির পরিধির দিকে। পুঞ্জীভূত মেঘের মত ব্যাধির বিষজর্জরতা জমে রয়েছে, জ্বরের বায়ুবেগ সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়েছে। মৃত্যু এখনও ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত ওই কোণে। শিশুটির দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন—ভয় নাই। চৈতন্য ফিরেছে—কথা বলছে, হাসছে কখনও কখনও, চৈতন্য স্তিমিত হলে আচ্ছনের মত পড়ে থাকবে। বাঁচাও বলে চেঁচাবে না, কাঁদবে না। শেষ মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যাবে, নিস্তরঙ্গ, স্থির হয়ে যাবে প্রশান্তির মধ্যে।

 

একটা ভারী গলার আহ্বানে মশায়ের চমক ভাঙল।—মশায় আছেন? মশায়! ভারী দরাজ গলা, কিন্তু ক্লান্ত। ও, রানা পাঠক! রানার টি-বি হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে নয় তাই-ই বটে। সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন। আজ এই রাত্রে? বেরিয়ে এলেন মশায়। রানীই বটে।

—কী বাবা রানা? এত রাত্রে?

–আর পারছি না মশায়। অনেক জায়গা ফিরে এলাম। আপনি বলেছিলেন পারুলেতে কবরেজদের কাছে যেতে, তাও গিয়েছিলাম। কিন্তু পোষাল না। কোথাও টাকা, কোথাও কিছু। মন লাগল না। শেষে আপনার কাছেই ফিরলাম।

আরোগ্য-নিকেতনের ভিতরে আলো জ্বলছিল। সেতাব বসেছিল আপন মনে ছকে খুঁটি সাজিয়ে, একাই দু পক্ষের হয়ে চাল চালছিল। ঘরে ঢুকে রানা একখানা পুরনো চেয়ারে বসতে গিয়ে নেড়ে দেখে বললে–ভাঙবে না তো? যক্ষ্মা রোগে ধরলেও আমি তো রানা পাঠক! ওজন

আড়ই মন! হাসলে সে।

–ওটাও শালবৃক্ষের সার বাবা রানা।

কপালে হাত দিয়ে রানা বললে—আমি রানা পাঠক, আমিও নিজেকে দৈত্যি মনে করতাম গো! বুক ঠুকে চেঁচিয়ে বলেছি, আশি বছরেও পাকা তাল কাঠের মত সোজা থাকব, হাতির মত গণ্ডারের মত হাটব। সোজা চলে যাব দশ-বিশ ক্রোশ! তা—হুঁ। হতাশার হাসি ফুটে উঠল মুখে, ঘাড় নেড়ে আক্ষেপ করে বললে–পাকা তালেও ঘুণ ধরে, পচ ধরে মশায়!

আশ্বাস দিয়ে বললেন––চিকিৎসা করাও বাবা, নিয়ম কর, ভাল হয়ে যাবে, ভয় কী!

–ভয়! হতাশার হাসির একটি বিশীর্ণ রেখা রানার মুখে লেগেই ছিল, সেই হাসির চেহারাটা পালটে গেল মুহূর্তে। এ হাসি সাধারণ লোকে হাসতে পারে না। এ রানারাই পারে। অনেককাল আগে—এক ভালুকওয়ালা এসেছিল প্রকাণ্ড বড় ভালুক নিয়ে, সে নিজে ভালুকের সঙ্গে কুস্তি করত। রানা তখন বছর বিশেকের জোয়ান। সে বলেছিল–আমি লড়ব তোমরা ভাকাকা সাথ। মারেগা, কামড়ায়ে গা-অ্যাঁচড়ায়ে রক্তারক্তি করে গা তো তোমারা কুছ দায় নেহি। এবং মালসাট মেরে এই হাসি হেসে বলেছিল—আওরে বেটা বনকা ভালকা, আও; চলে আও জঙ্গি জোয়ান! এবং দন্তী ও নখী বিপুলকায় জানোয়ারটাকে পরাভূত করেছিল সে। নিজেও জখম। হয়েছিল কিন্তু তাতে তার এ হাসি মিলিয়ে যায় নি।

ভয়? রানা বললে—না–না না মশায়, ভয় নয়।

বাইরে বাইসিকেলের ঘণ্টা বেজে উঠল। কে? মশায় চকিত হলেন। আবার প্রদ্যোত ডাক্তার এল? কেন? এখন তো আসবার কথা নয়?

রানা বলে গেল—ভয় নয় মশায়। ছেলেগুলা ছোট। অসময়ে যাব? বহুরঙ্গের বহুরসের সংসারে এলাম-রঙ্গরস ভোগ করতে পেলাম না! আর যাব যাব-একটা পাপ করে তারই ফলে পাপীর মত যাব? এই আর কি! এখুনি পথে মতে কামারের দরজায় মতের মা-বুড়িকে তাই বললাম।

—মতির মা ফিরে এল? মশায় ঈষৎ চকিত হয়ে উঠলেন।

পথের দিকে নিবদ্ধ তার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি রানার মুখের উপর ফিরল। একটা যেন ঝুঁকি খেলেন তিনি। ঘরে ঢুকল বিনয়; বললে–হ্যাঁ এল। দেখে এলাম।

রানা বললে—একটা পা সাদামতো কী দিয়ে ব্যান্ডেজের কাপড় লেপন দিয়ে বেঁধে রেখেছে। গরুর গাড়ি থেকে মতি আর মতের বেটা ধরাধরি করে নামাচ্ছে। আমি মশায় দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বললাম তা তুই একটা রঙ্গ দেখালি মতির মা! তা ভাল। বুড়ি বললে—তা রঙ্গ বটে ঠাকুর। সে কী কাণ্ডকারখানা। কী ঘর-দুয়োর, কী আলো, কী ব্যবস্থা, কী চিকিচ্ছে। কাটলে কুটলে—তো জানতে নারলাম। তাপরেতে, দিন কতক কষ্ট বটে। শুয়ে শুয়ে মল-মূত্র। ত্যাগ। তবে যত্ন বটে, ফুটফুটে টুকটুকে ভদ্রঘরের মেয়ে ধবধবে পোশাক পরে, মাথায় টুপি দিয়েওষুধ খাইয়ে দেওয়া, পথ্যি দেওয়া, মুখ মুছিয়ে নেওয়া-বাবা, বলব কী ময়লা মাটির পিত্তর সরানোসব করছে! আর ডাক্তার কী সব? মশায় তো আমার নিদেন হেঁকে দিয়েছিল তা দেখ বাবা ফিরে এসেছি। বলেছে মাস তিনেক পরে এইসব খুলে দেবে তার পরে এক মাস মালিসতার পরে পা ফিরে পাব। আমি বললাম আর কী পেলি মতির মা? অমর বর। পেলি না? তা মতে কামার রেগে উঠল, বললে—যাও ঠাকুর যাও। নিজে তো বাঁচবার জন্যে পথে পথে এর কাছে ওর কাছে ঘুরছ—এ দেবতা ও দেবতার পায়ে মাথা খুঁড়ছ! বললাম—মতে, তোর মায়ের বয়েস হলে কি রানা বাঁচতে চাইত রে? আমার ছেলে দুটো নেহাত নাবালক, একটা কন্যে আছে, আর আমার দাদা রাঘব বোয়াল, আমি না থাকলে সব গিলে খেয়ে দেবে। বুঝলি? নইলে রানার মরতে ভয় নাই। কতবার মরণের সঙ্গে পড়েছি। বন্যেতে ভেসে যাওয়া লোক মরণের মুখ থেকে এনেছি। জিতেছি। একবার না হয় হারব। তাতে কী?

জীবনমশায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন, কথাগুলি শুনছেন বলেও মনে হল না। মাটির মূর্তির মত নিথর নিস্পন্দ হয়ে গেছেন তিনি।

তার মনে পড়ে গেল প্রদ্যোত ডাক্তারের আজকের চেহারা। ধীর নির্ভীক চিন্তাকুল দৃষ্টি, তাতে ইনজেকশনের সিরিঞ্জে স্পিরিট ভরে ধুচ্ছেন। মধ্যে মধ্যে রোগীর দিকে তাকিয়ে দেখছেন। চিবুক, ঠোঁটের রেখায় দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ফুটে রয়েছে।

বিনয় বললে—দাঁড়ান, তিন মাস কেটেছে, এখনও তিনি মাস বাকি। ছ মাসের মেয়াদ দিয়েছিলেন মশায়।

–না। ঘাড় নেড়ে মশায় বললেন–মতির মা বাঁচবে।

–তা বাঁচুক। রাবণের মা নিকষা হয়ে বেঁচে থাকুক।

নারায়ণ! নারায়ণ! বলে উঠলেন মশায়। যেন সমস্ত পরিবেশটা অশুচি অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে।–থাক ও কথা।

—থাকুক। কিন্তু আপনি আমার চিকিৎসা করুন। বাঁচি বাঁচি, না বাঁচি না বাঁচি। মরণে আমার ভয় নাই। নিন্দেও আমি করব না। বিনয় আমাকে দয়া করেছে, বলেছে ওষুধ যা লাগে ও দেবে; আপনি চিকিৎসা করুন। আমি শুনলাম, বিনয় আজই বললে—হাকুড়ো কাহারের ছেলে পরানের মুখ দিয়ে ঝলক ঝলক রক্ত উঠত, আপনি তাকে সারিয়েছিলেন।

মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, তিনি সারিয়েছিলেন কিন্তু সে এ কালরোগ নয়।

বিনয় বললে—আপনি দেখুন মশায়। ব্রাহ্মণকে বাঁচান।

–ওষুধই যখন তুই দিবি তখন প্রদ্যোত ডাক্তারকে দেখানো ভাল। ভাল চিকিৎসক, ধীর চিকিৎসক; আজও আমি দেখলাম।

–উঁহুঁ আপনি দেখুন। আপনি বাঁচান রানা ঠাকুরকে। রামহরিকে বাঁচিয়েছেন। আর একটা চিকিৎসা দেখিয়ে দেন। শুধু তাই নয় মশায়, সকালবেলা আপনি শোনেন নি আমার কথা। বলেছিলেন-কাল। তা রাবণ ঠাকুর আমাকে আজই আবার নিয়ে এল আপনার কাছে। আপনাকে আমার ডাক্তারখানায় একবেলা করে বসতে হবে। ডাক্তারেরা নতুন ডাক্তারখানা করে আমাকে মারবার চেষ্টা করছে। আপনি আমাকে বাঁচান।

মশায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন বিনয়ের মুখের দিকে।

—মশায়!

—কাল। কাল বলব। আজ নয়। কাল। রানা তোমাকেও কাল বলব। আজ নয়। অহি সরকারের নাতিই আজ সব ভাবনা জুড়ে রয়েছে। কাল এসো।

–দেখছে তো প্রদ্যোত ডাক্তার। বার লাখ পেনিসিলিন দিয়েছে আজ। বাঁচাবই বলে খুব হক মেরেছে বুঝি?

–বিনয়, কাল। কাল। আজ আর কথা বলিস নে বাবা। মশায় উঠে পড়লেন। এরা কি সবাই ভাবে মশায় মৃত্যুঘোষণা ছাড়া আর কিছু করে না! ওতেই তার আনন্দ?

সেতাব আপন মনে একলাই দাবা খেলে যাচ্ছিল, সে সব গুটিয়ে নিয়ে উঠল। আমিও আজ চললাম রে।

—যা। মন আজ আমার ওইখানে পড়ে আছে। খেলায় বসবে না। লড়াই চলছে, বুঝছিস না?

সত্যই লড়াই। মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই। তিনিও জীবনে বহুবার করেছেন। হারলে অগৌরব নাই। কিন্তু বেদনা আছে। বিশেষ করে অতসীর ছেলেটির মত ক্ষেত্রে। ইং শব্দে ক্লক ঘড়িতে একটা বাজল। প্রদ্যোত ডাক্তার সিরিঞ্জ পূর্ণ করে ঠিক করে রেখেছে। সে উঠে দাঁড়াল। ঠিক সাড়ে বারটায় সে এসেছে। ইনজেকশন শেষ করে সিরিঞ্জ ধুয়ে মুখ তুলে চাইলে। মশায় নাড়ি ধরে বসেছেন তখন। চোখ বুজে বসে রয়েছেন।

প্রদ্যোত বললে—আমার যা করবার করে গেলাম। সকালে ঠিক সময়ে আসব আমি। রোগীকে কিন্তু ঘুমুতে দিন। নাড়াচাড়া করবেন না।

চলে গেল সে। মশায় আরও কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে চাইলেন, চাইলেন দরজার দিকে। সরে যাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বললেন–ভাল আছে।

কীর্তিমান যোদ্ধা প্রদ্যোত ডাক্তার। এ যুগের আবিষ্কার বিচিত্র বিস্ময়কর! আর না। তাঁর কাল গত হয়েছে। আর না। কালকের সংকল্পটা মনে মনে দৃঢ় করলেন তিনি। আর না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *