২৯. ম্যাডামের অনুগত কর্মচারী

উনত্রিশ

ম্যাডামের অনুগত কর্মচারীটির মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। ভার্গিসের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘ম্যাডাম এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন, ওঁকে বিরক্ত করা নিষেধ আছে।’

মাছি গিললেন বলে মনে হল ভার্গিসের। তিনি পুলিশ কমিশনার। এখনও তিনি এই রাজ্যের পুলিশের সর্বময় কর্তা। তাঁর মুখের ওপর এভাবে কথা বলার সাহস এই লোকটা পায় কি করে? তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ম্যাডামকে খবর দিলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন না।’

লোকটি বলল, ‘আপনি টেলিফোন করে আসুন।’

‘বেশ। সেটা আমি এখান থেকেই করছি। লাইনটা দাও।’

লোকটা আর প্রতিরোধ করতে পারল না। নিজেই রিসিভার তুলে বলল, ‘আমি অনেক আপত্তি করছি কিন্তু পুলিশ কমিশনার শুনতে চাইছেন না, উনি ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলবেন।’

লোকটি অপেক্ষা করল। বোঝা গেল ম্যাডামের সেই সহকারিণী টেলিফোন ধরেছিল। ভার্গিস ততক্ষণে চারপাশে নজর বোলাচ্ছিলেন। এই বাড়িতে ঢোকার নিশ্চয়ই অন্য পথ আছে। আকাশলালের মৃতদেহ—! সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ে গেল আকাশলালের শরীর যেদিন কবর থেকে উধাও হয়েছিল সেইদিন যে অ্যাম্বুলেন্সটিকে সন্দেহবশত ধরা হয় তাকে এইসব বাগানওয়ালা বাড়ির কাছে ঘুরতে দেখা গিয়েছে। ওর ড্রাইভার একটা অজুহাত দেখানোয় ওকে আর চাপ দেওয়া হয়নি। তাছাড়া নিজে এমন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন যে ওর ব্যাপারটা খেয়ালেও ছিল না ভার্গিসের। এখন মনে হচ্ছে তিনি চমৎকার ক্লু পেয়ে গেছেন। যা করার আজ রাত্রেই করতে হবে।

টেলিফোনের রিসিভার তাঁর হাতে দেওয়া হলে ভার্গিস বললেন, ‘হ্যালো।’

‘মিস্টার ভার্গিস? পুলিশ কি কোনও সম্ভ্রান্ত মহিলাকে তাঁর বিশ্রামের সময় বিনা কারণে বিরক্ত করতে পারে, বিশেষ করে যখন তাঁর শরীরে কোনও সুতো নেই?’

‘না মানে, ম্যাডাম, আমি— ।’ ভার্গিস হকচকিয়ে গেলেন।

‘আমার কর্মচারী কি বলেনি আমি বিশ্রাম করছি। সে যদি না বলে থাকে তাহলে এখনই তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেব। বলুন।’

‘ইয়েস, বলেছিল। কিন্তু ব্যাপারটা এমন জরুরি— ।’

‘আমি কি এই অবস্থায় আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াব?’

‘না, না। আমি জানতাম না আপনি ওইভাবে বিশ্রাম নেন। সরি, খুব দুঃখিত।’

‘ঠিক আছে। জরুরি বলেই আপনাকে ওপরে আসার অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু আপনি আমার থেকে খানিকটা দূরেই থাকবেন। বুঝতেই পারছেন।’ রিসিভার নামিয়ে রাখলেন ম্যাডাম। ভার্গিস নিঃশ্বাস নিলেন। তাঁর চোখের সামনে ম্যাডামের মুখ ভেসে উঠল। এই বয়সেও ম্যাডাম সুন্দরী, চেহারাপওরও ভাল। কিন্তু মেয়েদের ওসব নিয়ে ভার্গিস কোনও দিন মাথা ঘামাননি। কিন্তু আজ যদি ম্যাডাম সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান? ভার্গিসের জিভ শুকিয়ে গেল। প্রাণপণে নিজেকে শক্ত করতে লাগলেন তিনি।

ভার্গিসকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হলে ম্যাডামের সেক্রেটারি মহিলা বেরিয়ে এল বারান্দায়। এখানে তিনি এর আগে এসেছেন, আজও কোনও পরিবর্তন দেখলেন না।

তাঁর মনে হল বিশাল এই বাড়িটির অন্য অংশটি একটু বেশি রকমের থমথমে।

‘ইয়েস মিস্টার ভার্গিস!’

ভার্গিসের খেয়াল হল। তিনি ইতিমধ্যে সেক্রেটারির সঙ্গে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছেন। খুব হালকা নীল আলো জ্বলছে ঘরে। সেক্রেটারি বেরিয়ে যেতেই তিনি ম্যাডামকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। একটা লম্বা ডিভানে ম্যাডাম শুয়ে আছেন। তাঁর সমস্ত শরীর ধবধবে সাদা মখমল জাতীয় কাপড়ে ঢাকা। ডিভানটির একটা দিক উঁচু বলেই ম্যাডামের শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে ওপরে তোলা। তাতে তাঁর আরাম হচ্ছে।

বসুন।

যে চেয়ারটিতে ভার্গিস বসলেন সেটি ম্যাডামের ডিভান থেকে অন্তত দশ হাত দূরে রাখা ছিল। ভার্গিস চেয়ারটিতে বসামাত্র বুঝতে পারলেন তাঁর শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত।

‘আপনার জরুরি বিষয়টি বলতে পারেন।’

‘আমি আবার দুঃখ প্রকাশ করছি— ।’

‘দ্যাটস অল। আপনি যত তাড়াতাড়ি কথা শেষ করবেন, তত আমার উপকার করবেন কারণ আমি শরীরে এই চাদরটা রাখতে পারছি না। শুরু করুন।’

‘ম্যাডাম।’ ভার্গিস সোজা হয়ে বসলেন, ‘বোর্ড আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন। না হলে আমাকে সরে যেতে হবে। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ওঁরা করেছেন, তাতে আমাকে গ্রেফতারও করা যেতে পারে। আপনি আমাকে সাহায্য করুন।’

‘কি ভাবে?’

‘সেটা আপনি জানেন। আপনার প্রসঙ্গ আমি বোর্ডের কাছে তুলিনি।’

‘আমি এর মধ্যে কোত্থেকে এলাম?’

‘বাবু বসন্তলালের বাংলোতে আপনার ড্রাইভার কি করে গেল বলতে হলে আপনার কথাও বলতে হয়। আপনার নির্দেশে আমি লোকটাকে গুলি করতে বাধ্য হই। রিপোর্টে লেখা হয়েছে সে সশস্ত্র ছিল না। কিন্তু আপনি যে ওর অস্ত্র নিয়ে গিয়েছিলেন এটাও আমি বলতে পারিনি। ডেভিড পালাচ্ছিল এবং আপনি আমাকে গুলি করতে বলেছিলেন।

‘কক্ষনো নয়। আমি আপনাকে বলিনি ডেভিডকে গুলি করে মেরে ফেলুন।’

‘উত্তেজনার সময় সামান্য— ।’

‘মিস্টার ভার্গিস, আপনি বোর্ডের সামনে এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মিনিস্টার আপনাকে সেটা করতে দেননি, তাই না?’

ভার্গিস চমকে উঠলেন। কতক্ষণ আগে তিনি বোর্ডের মিটিঙে ছিলেন? এর মধ্যেই এখানে খবর পৌঁছে গেছে। তাঁর মনে হল ম্যাডামের নেটওয়ার্ক পুলিশ বাহিনীর থেকেও শক্তিশালী।

‘আমি আপনাকে সবার সামনে ছোট করতে চাই না ম্যাডাম।’

‘আপনি কি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছেন?’

‘না। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আমাকে সাহায্য করার জন্য।’

‘যেমন?’

‘আপনি জানেন সন্ত্রাসবাদীরা কোথায় আকাশলালের শরীর নিয়ে গেছে।’

‘তাই? আমি জানি? আপনি কি বলতে চাইছেন ভার্গিস সাহেব? আমি জানি অথচ উকে জানাচ্ছি না, তার মানে আমি বোর্ডের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছি?’

‘হ্যাঁ। ব্যাপারটাকে ঘুরিয়ে দেখলে সেই রকমই দাঁড়াবে।’

‘মিস্টার ভার্গিস, এই অভিযোগ প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনার!’

আপনি জানতে পেরেছিলেন বাবু বসন্তলালকে যাকে দিয়ে আপনি খুন করিয়েছিলেন সেই লোকটি অর্ধ উন্মাদ অবস্থায় আমার হাতে পড়েছে। আমি জানতাম খবর পাওয়ামাত্র আপনি তাকে সরিয়ে ফেলবেন। তাই আপনার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে আমি একজন সার্জেন্টকে পাঠিয়ে ওর পাহারার ব্যবস্থা করে বাবু বসন্তলালের বাংলোতেই রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি একটা বোকামি করেছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার বাহিনীর যে কোনও অফিসার আপনাকে দেখে সম্মান জানাবেই। তারা সবাই জানে এ রাজ্যের সর্বময় কর্তাদের আপনি আঙুলের টানে নাচান। তাই ড্রাইভার নিয়ে যখন আপনি বাংলোর ভেতরে যান তখন সার্জেন্ট আত্মপ্রকাশ করেছিল আপনাকে খুশি করতে। আপনার ড্রাইভার সম্ভবত তাকে নীচের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুন করে। করে কফিনে তুলে দেয়। আধ-পাগল চৌকিদারকে গাছে ঝুলিয়ে দিতে ব্ল্যাকবেল্টধারী ড্রাইভারের একটুও কষ্ট হয়নি। আর দু দুটো খুনের পর আপনি আমাকে টেলিফোনে ওখানে যেতে বলেন। ঠাণ্ডা মাথায় লনে বসে থাকেন। এবং হয়তো ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে। ওই ড্রাইভারকে সরিয়ে না দিলে একটি সাক্ষী থেকে যেত যে আপনার বিরুদ্ধে পরে মুখ খুলতে পারে। তাই আমাকে দিয়ে তাকে খুন করালেন। এর একটা কথাও আপনি অস্বীকার করতে পারেন?

ম্যাডাম একদৃষ্টিতে ভার্গিসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার বললেন ‘প্রমান কি?’

‘তার মানে?’

‘আপনার ওই কথাগুলোকে সমর্থন করার মতো কোনও সাক্ষী আছে?’

‘ম্যাডাম। সাক্ষীদের আপনি মেরে ফেলেছেন।’

‘মিস্টার ভার্গিস। এসব বাগানওয়ালা বাড়িতে দু-একটা সাপ থাকে যাদের বাস্তুু সাপ বলা হয়। তারা তাদের মতো থাকে, বিরক্ত করে না, বাড়ির কেউ তাদের ঘাঁটায় না। কিন্তু কখনও ভুল করে কেউ যদি তাদের লেজে পা দেয় তাহলে সেই সাপ সঙ্গে সঙ্গে ছোবল মারে। আর সেই ছোবলের বিষ থেকে পরিত্রাণ নেই। আপনি লেজে পা দিয়েছেন, যেচে, ইচ্ছে করে। আপনি আমার সাহায্য চাইতে এসেছেন, এটা একটা ভানমাত্র। আপনাকে আমি দুটো প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি এখান থেকে ফিরে গিয়ে পদত্যাগপত্র দাখিল করে সীমানা পেরিয়ে চলে যান। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না। আপনার পেছনে কোনও পুলিশ ছুটবে না।’

ভার্গিস জিজ্ঞাসা করলেন, দ্বিতীয় প্রস্তাব?’

‘এখন থেকে আমি যা বলব তার বাইরে আপনি কোনও কাজ করবেন না। যে কোনও সিদ্ধান্ত নেবার আগে মিনিস্টার নয় আমার অনুমতি দেবেন।’

ভার্গিস হতভম্ব। নিজেকে কিছুটা সামলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিন্তু বোর্ড তো আর তেইশ ঘণ্টা পরে আমাকে স্যাক্, করবে? তার কি করবেন?’

তেইশ ঘণ্টা মানে অনেক সময়। ওয়ান থাউজেন্ড থ্রি হান্ড্রেড এইট্টি মিনিটস। তাই না?’

‘ধরে নিন আপনার দ্বিতীয় প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম— ।’

‘তাহলে আমি যা বলব তাই করতে হবে আপনাকে।’

‘বেশ। রাজি আছি।’

‘গুড। তাহলে এগিয়ে আসুন।’

‘মানে?’

‘আপনাকে আমি কাছে আসতে বলছি।’

ভার্গিস এগিয়ে গেলেন। হাতদুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে ম্যাডামকে দেখলেন। সমস্ত শরীর সাদা মখমলে ঢাকা সত্ত্বেও আদলটি প্রকাশিত।

‘আমার পায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান। হ্যাঁ। এবার হাঁটু মুড়ে বসুন মিস্টার ভার্গিস।’

‘কেন?’

‘প্রশ্ন করবেন না। আপনার কর্তব্য আদেশ মান্য করা।’

ভার্গিস হাঁটু মুড়ে বসলেন। ভারী শরীর নিয়ে একটু অসুবিধে হল। এখন তাঁর সামনে দুটো ধবধবে পা। শাঁখের মত সাদা।

চোখ ওপরে উঠতেই ভার্গিস পাথর হয়ে গেলেন। মখমলের চাদরের পাশ থেকে ম্যাডামের ডান হাত বেরিয়ে এসেছে। এবং সেই হাতের মুঠোয় চকচকে কালো ছোট্ট পিস্তল ধরা। পিস্তলের মুখ তাঁর মাথার দিকে তাক করা।

‘আমার মনে হচ্ছিল আপনি প্রমাণের সন্ধানে এসেছেন। আপনার পকেটে কি টেপরেকর্ডার আছে মিস্টার ভার্গিস? থাকলে ওটা আমার পায়ের কাছে রেখে দিন।’

ভার্গিস আদেশ অমান্য করতে পারলেন না।

টেপ রেকর্ডারটা হাতে নিয়ে ম্যাডাম শায়িত অবস্থাতেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন, ‘আচ্ছা, মিস্টার কমিশনার, আপনার মাথায় কবে একটু বুদ্ধি আসবে? আমাকে এমন নির্বোধ ভাবলেন কি করে? এবার উঠে দাঁড়ান। হ্যাঁ। ওই চেয়ারটার কাছে চলে যান। বসুন। গুড। আবার বলুন, আমার ওই দুটো প্রস্তাবের কোনটা আপনি গ্রহণ করছেন?’

রাগে অপমানে দুঃখে মাথা নিচু করে বসেছিলেন ভার্গিস। তিনি জানেন ম্যাডামের হাতের আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে হঠকারিতা করে কোনও লাভ নেই। এই অপমান তাঁকে হজম করতেই হবে। তিনি মাথা তুললেন, ‘কোনওটাই নয়।’

‘আচ্ছা!’

‘কাল সকালে আমাকে বরখাস্ত করা হবে আমি জানি। কিন্তু তার আগে আমি দেশের মানুষের কাছে বলে যাব কে দেশদ্রোহী কে নয়!’

‘আবার বোকামি। পুলিশের কথা সাধারণ মানুষ কখনও বিশ্বাস করে না। তাহলে আপনি আমার সাহায্য চান না। আপনি এখন স্বচ্ছন্দে আসতে পারেন।’

মিনিট দশেক পরে বড় রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়েছিল ভার্গিসের জিপ। একটু আগে তিনি ওয়ারলেসে হুকুম পাঠিয়েছেন হেড কোয়ার্টার্সে পুরো একটা ব্যাটিলিয়ন ফোর্স পাঠানোর জন্যে। তারা চলে আসতেই ভার্গিসের জিপ ম্যাডামের বাড়ি ঘিরে ফেলল। ওই বিশাল বাগানওয়ালা বাড়ি থেকে যাতে কেউ বেরিয়ে যেতে না পারে তার সবরকম ব্যবস্থা করে ভার্গিস গন্ডি ছোট করে বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলেন। যে কাজটা তিনি করছেন তার জন্যে অনেক জবাবদিহি দিতে হবে তাঁকে, হয়তো চব্বিশ ঘণ্টা নয়, ফিরে যাওয়ামাত্র তাঁর চাকরি শেষ হয়ে যাবে, তবু নিজের কাছে বাকি জীবন স্বাভাবিক থাকতে এটা তাঁকে করতেই হবে।

বাড়িটাকে ঘিরে পুলিশবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে অথচ সদর দরজা বন্ধ, একটিও মানুষ এগিয়ে আসছে না। অথচ মিনিট পঁচিশেক আগে যখন তিনি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তখন কর্মচারীরা এখানেই ছিল। ভার্গিস নিজেই বেল বাজালেন। তৃতীয় বারে একজন লোক বেরিয়ে এল। এই লোকটাকে ভার্গিস আগে দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। দরজা খুলে বিনীত ভঙ্গিতে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি করতে পারি, স্যার?’

‘ম্যাডামকে খবর দাও।’

‘ম্যাডাম বলেছেন, আপনি স্বচ্ছন্দে সমস্ত বাড়ি সার্চ করতে পারেন। একটু আগে আপনি ওঁকে যে ঘরে দেখে গেছেন সেখানেই বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি। আপনার কাজ হয়ে গেলে ওঁর সঙ্গে কি আপনি দেখা করে যাবেন?

ভার্গিসের সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গেল। তিনি বুঝে গেলেন এ বাড়িতে সার্চ করে কিছুই পাওয়া যাবে না। যদি কিছু অথবা কেউ থেকেও থাকে তাহলে তিনি চলে যাওয়ামাত্র তাদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ তিনি এ বাড়ির সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন। বাইরে কারফিউ চলছে। ম্যাডাম কোন পথে তাদের সরালেন। কিন্তু এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে তিনি আর পিছিয়ে যেতে পারেন না। পরক্ষণেই তাঁর মাথায় অন্য পরিকল্পনা এল। তিনি মুখে একবারও বলেননি যে বাড়ি সার্চ করবেন অথচ এই লোকটি সেটা উচ্চারণ করেছে। ম্যাডাম জানতেন তিনি এটা করতে যাচ্ছেন? হেড কোয়ার্টার্স থেকে ব্যাটিলিয়ন রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো খবর পেয়ে গেছেন।

ভার্গিস লোকটিকে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। নীচে, সিঁড়িতে কর্মচারীরা সারি দিয়ে অপেক্ষা করছিল। তাদের ভ্রূক্ষেপ না করে ভার্গিস সোজা দোতলায় উঠে এসে দেখলেন সেই সেক্রেটারি মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। ভার্গিস যে গতিতে উঠে এসেছিলেন তাতে তাঁকে আটকানো সম্ভব ছিল না মহিলার। তিনি ‘স্যার’ ‘স্যার’ করে বাধা দেবার আগেই ভার্গিস ম্যাডামের দরজার সামনে পৌঁছে বললেন, ‘মে আই কাম ইন ম্যাডাম?’

ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, ‘ইয়েস!’

পর্দা সরিয়ে ভার্গিস ভেতরে ঢুকলেন। ম্যাডাম এখনও সেই একই ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। চেয়ারের পাশে পৌঁছে ভার্গিস বললেন, ‘আপনার কর্মচারী ভুল বুঝেছে ম্যাডাম। আমি এ বাড়িতে তল্লাসির জন্যে আসিনি।’

‘তাহলে?’

‘আমি আপনার দ্বিতীয় প্রস্তাব গ্রহণ করছি!’

‘তাহলে পুরো একটা ব্যাটিলিয়ন সঙ্গে কেন?’

‘এরা আমার অনুগত। যদি আপনি এখন আর রাজি না হন তাহলে আমার মতো এরাও পদত্যাগ করবে, একসঙ্গে।’ ভার্গিস হাসলেন।

‘এই প্রথম আপনাকে বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছে। বসুন।’

ভার্গিস বসলেন। এখন তাঁর আর কিছুই করণীয় নেই।

রাত তখন সাড়ে বারো। একেই পাহাড়ি শহর তার ওপর কারফিউ চলছে, মনে হচ্ছে, বাতাস ছাড়া পৃথিবীতে কোনও শব্দ নেই, কোনও জীবন নেই। দুটো গাড়ি দাঁড়িয়েছিল লেডি প্রধানের বাড়ির সামনে। দুটোতেই লেডি প্রধানের গাড়ির নাম্বার লাগানো। পরলোকগতা লেডির শেষ কাজ সম্পন্ন করার জন্যে যে কারফিউ পাশ ইসু করা হয়েছিল তা আজ রাতের পর কার্যকর থাকবে না। এখন সেই কাগজগুলো দুজন ড্রাইভারের পকেটে আছে। একটু আগে অত্যন্ত সাবধানে আকাশলালের শরীর নামানো হয়েছে স্ট্রেচারে শুইয়ে। ভ্যানের পেছনে বিশেষ ব্যবস্থা করা বিছানায় তাকে তুলে দেওয়া হয়েছে।

এ বাড়ির কোথাও আলো জ্বলছে না। যেসব সদস্য আজ রাত্রের অভিযানে সামিল হচ্ছে না তাদের উদ্দেশে হায়দার একটা ছোট্ট বক্তৃতা এইমাত্র শেষ করল। সমস্ত দেশ একদিন নিশ্চয়ই এই দেশপ্রেমের স্বীকৃতি দেবে। নেতা সুস্থ হয়ে ওঠামাত্র আবার যখন ডাক দেবেন তখন যে যেখানেই ছড়িয়ে থাকুন ছুটে আসবেনই একথা হায়দার বিশ্বাস করে। সেইসঙ্গে সে মনে করিয়ে দিয়েছে কোনওভাবেই যেন আজকের রাত্রের বিবরণ শত্রু-পক্ষ জানতে না পারে। তাঁরা সবাই ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছেন নেতাকে রক্ষা করতে। যদি বাকিদের এখানে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তারাও ইন্ডিয়ায় চলে যেতে পারে। আর তারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ামাত্র সবাইকে বেরিয়ে যেতে হবে। বারোটা পয়তাল্লিশ থেকে একটা পর্যন্ত, সামনের রাস্তায় কোনও পুলিশ পেট্রল থাকবে না এমন ব্যবস্থা করা আছে।

ঠিক তখনই ত্রিভুবন বেরিয়ে এল। হায়দারকে আলিঙ্গন করল সে। নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা সবাই ইন্ডিয়ায় যাচ্ছি তাই বলেছ তো?’

‘হ্যাঁ। এবার রওনা হতে হবে। পথে অন্তত এই রাস্তা যেখানে শেষ হচ্ছে সেই পর্যন্ত কোনও বাধা পাবে না। তারপর বড় রাস্তা এড়াতে চেষ্টা করবে। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে তাহলে কারফিউ পাশ দেখিয়ে বলবে লেডির শেষকাজে যাঁরা এসেছিলেন তাদের পৌঁছাতে যাচ্ছ। উইশ ইউ গুড লাক।’

‘সেম টু ইউ। আমি যোগাযোগ করব।’

প্রথমে ভ্যানটা রওনা হল, পেছনে জিপ। ওরা রওনা হওয়ামাত্র বাকিরা ছুটে গেল বাড়ির ভেতরে। নিজেদের জিনিসপত্র সামান্যই ছিল কিন্তু লেডি প্রধানের মূল্যবান জিনিস ওদের ভাবনায় ফেলল। ওদের মনে হতে লাগল কিছুদিন ব্যবহার করার সুবাদে এগুলোর ওপর অধিকার জন্মে গিয়েছে। ওরা যে যা পারে সংগ্রহ করে নিয়ে বিপাকে পড়ল। এসব জিনিস একসঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। এদিকে রাত বাড়ছে। ওরা এক জায়গায় বসে ঠিক করল ইতিমধ্যে যখন হায়দারের দেওয়া সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে তখন বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে এখানেই থেকে গেলে ভাল হয়। আগামী কাল দিনের আলোয় জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া অনেক সহজ হবে।

ঠিক দুটোর সময় লেডি প্রধানের বাড়ি এবং বাগান ভার্গিসের পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলল। হায়দার এবং ত্রিভুবনের ফেলে-যাওয়া সঙ্গীরা প্রায় বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করল পুলিশের কাছে। সমস্ত বাড়ি চষে ফেললেন ভার্গিস। না, কোথাও মৃতদেহ অথবা আকাশলালের প্রধান দুই সঙ্গী নেই। ধৃতদের জেরা শুরু করে দিয়েছিল তাঁর অফিসাররা। সমস্ত বাড়ি ঘুরে একটি ঘরে ঢুকে ভার্গিস হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যে কোনও বড় নার্সিং হোমের অপারেশন থিয়েটার প্রায় এই রকমই হয়। ওষুধের গন্ধে বাতাস ভারী। এখানে কি কারও অপারেশন হয়েছিল? কার? সঙ্গে সঙ্গে ভার্গিসের পেটের ভেতর চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। মৃতদেহে কি অপারেশন করা যায়? করলে যদি মানুষ আবার বেঁচে যেত তাহলে পৃথিবীতে তো সোরগোল পড়ে যেত। কিন্তু অন্য কেউ যদি অসুস্থ হয়ে থাকে তাহলে সে গেল কোথায়? তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন পাখিরা পালিয়ে গিয়েছে। এখানে আসতে তিনি দেরি করেছেন। ম্যাডামের বাড়িতে ব্যাটিলিয়ন নিয়ে না গিয়ে সেই সময় সোজা যদি এখানে চলে আসতেন তাহলে কাজের কাজ হত। তিনি টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন। এত রাত্রে মিনিস্টারের টেলিফোন বেজে যাচ্ছে। এই নাম্বার মিনিসটারের শোওয়ার ঘরে। লোকটা গেল কোথায়। এতক্ষণ টেলিফোন বাজলে কেউ জেগে থাকতে পারে না। রিসিভার নামিয়ে রেখে ভার্গিস একটু ইতস্তত করে ম্যাডামের বাড়িতে ফোন করলেন। এখন রাত সওয়া তিনটে।

একবার রিং হতেই ওপাশে রিসিভার উঠল, ‘হ্যালো।’

ম্যাডামের গলা। এত রাত্রে মহিলা জেগে আছেন?

ভার্গিস ধীরে ধীরে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

দ্রুত গতিতে জিপটা এগিয়ে যাচ্ছিল। লেডি প্রধানের বাড়ি থেকে বের হওয়ামাত্র ভ্যানটির সঙ্গ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। যতটা সম্ভব বেশি স্পিড তুলেছিল ড্রাইভার। জিপের পেছনে তিনজন মানুষ বসে আছে চুপচাপ। তিন সাক্ষী। নির্জন রাতের রাজপথে কোনও বাধা নেই। ব্যবস্থা অনুযায়ী থাকার কথাও নয়। ত্রিভুবনের কোলের ওপর যে আগ্নেয়াস্ত্রটি তৈরি তাতে অনেক বুলেট প্রস্তুত। রাস্তাটি শেষ হয়ে গেলে তার নির্দেশে ড্রাইভার বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে পড়ল। পথ এবার সরু বলে গতি কমাতে হচ্ছে।

হঠাৎ পেছন থেকে স্বজন বলে উঠল, ‘এভাবে চালালে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে।’

ত্রিভূবন জবাব দিল না। তিনটে মানুষকে তার বোবা বলে মনে হচ্ছিল।

বৃদ্ধ ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘যাওয়ার পর বুঝতে পারবেন।’ ত্রিভুবন জবাব দিল।

‘এভাবে যেতে আমি রাজি নই।’

‘কিভাবে আপনাকে নিয়ে গেলে রাজি হবেন?’

‘আমাকে ছেড়ে দিন। আমি এখান থেকেই বাড়ি ফিরে যাব।’

‘কারফিউ চলছে। আপনাকে ওরা গুলি করে মারবে।’

‘আমাকে বলা হয়েছিল কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারব?’

‘কে কি বলেছিল জানি না, আমার ওপর দায়িত্ব আপনাকে বর্ডার পার করে দেওয়া। দয়া করে আর বকবক করবেন না। মনে রাখবেন পুলিশের চোখে আপনি একজন ক্রিমিন্যাল।’

‘ক্রিমিন্যাল? আমি?’

‘হ্যাঁ। আপনি আকাশলালের শরীরে অপারেশন করে পুলিশকে ধোঁকা দিয়েছেন?’

এইসময় ড্রাইভার একটা অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করল। ত্রিভুবন দেখল দূরে রাস্তার বাঁকে একটি টহলদারি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানের সামনে দুজন অফিসার। ত্রিভুবন চাপা গলায় বলল, ‘আপনারা কেউ কোনও কথা বলবেন না। যদি কেউ কথা বলার চেষ্টা করেন তাহলে আগে আমি তাকে গুলি করব। আমি সুইসাইড করতে রাজি কিন্তু ধরা দিতে নয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *