গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯)

উপদ্রুত উপকূল (কাব্যগ্রন্থ) – রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

উৎসর্গ
থামাও, থামাও এই মর্মঘাতী করুন বিনাশ
এই ঘোর অপচয় রোধ করো হত্যার প্লাবন
শিরাজ শিকদার
শেখ মুজিবুর রহমান
আবু তাহের

প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯
প্রকাশক : আহমদ ছফা, বুক সোসাইটি, ঢাকা

অভিমানের খেয়া

এতোদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই,
পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।

প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,
নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-
এই খেলা আর কতোকাল আর কতোটা জীবন!
কিছুটাতো চাই— হোক ভুল, হোক মিথ্যে প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন— আর কতোদিন?
ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতোটা বিলাবে?
কতো আর এই রক্ত-তিলকে তপ্ত প্রনাম!
জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারনাময়?

এতো ক্ষয়, এতো ভুল জ’মে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরন
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়।

তুমি জানো নাই— আমি তো জানি,
কতোটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে
নিশ্চুপ হয়ে থাকি

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন,
এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত!

তুমি জানো নাই— আমি তো জানি।
মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে,
মাংশের ঘরে আগুন পুষেছে,
যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু,
করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।

পরাজয় এসে কন্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা,
চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক।
তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,
পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।

বৈশাখি মেঘ ঢেকেছে আকাশ,
পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়
ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন?
নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতোটা জীবন?
কতোটা জীবন!!

৩১.০৫.৭৬ কাঁঠালবাগান ঢাকা

আজীবন জন্মের ঘ্রানে

পোড়া তুষের গন্ধে একদিন জননীর দেহ
তোলপাড় কোরে ওঠা এতোটুকু ভ্রূন— এতোটুকু বীজ,
আকাংখার অবয়ব নিয়ে রক্তোচ্ছাসে বেরিয়ে এসেছিলাম…

তখন আকাশে শেষ জিজ্ঞাসার মতো বাঁকা চাঁদ
হয়তো ছিলো— হয়তো ছিলো না। পাশের মাঠ থেকে
কালো সব বাতাসের অলস শরীর কেঁপে কেঁপে
শীতের অসুখে ম্লান রোগীদের মতো এসেছিলো,
আঙিনার চারপাশে হয়তো তখনো কুয়াশারা
প্রেম এনে দিতেছিলো রাত জাগা মানুষের মনে।

মা-কেই ঈশ্বর ভেবে হয়তো দারুন প্রতিজ্ঞায়
অবুঝ হাত-পা ছুঁড়ে তীব্র প্রতিশোধ জ্বেলে আমি
তছনছ কোরে ফেলেছিলাম ডেটল— শাদা তুলো
অথবা ধাত্রির শুভ্র ধবলিমা বসন।

মনে নেই— হয়তোবা আমি তার বুকের গম্বুজে
প্রেমিকার ঠোঁট ভেবে প্রথম চুম্বন এঁকেছিলাম।
মনে নেই, মনে নেই— পৃথিবীর জল— ধুলোবালি,
কালো রাত, জননীর রক্তমাখা এটুকু দেহকে
কারা সব কতোটুকু বিস্ময়ে পাহারা দিয়েছিলো!

জন্মের গন্ধের কথা মনে হলে শরীরে তাকাই,
আজো এক ঘ্রান আছে- আজো এক অক্ষম বিক্ষোভ
শোনিতের অভ্যন্তরে, জন্মের প্রথম চিৎকারের মতো
অক্ষম হাত-পা ছুঁড়ে আজো সে তছনছ করে শুধু নিজের বাসনাগুলো,
ডেটলের শিশি— শাদাতুলো— পৃথিবীর রক্তমাখা করুন কাপড় ॥

০৭.০৭.৭৬ মিঠেখালি মোংলা

বাতাসে লাশের গন্ধ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এ-দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো,
জীর্ন জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা— একি তবে নষ্ট জন্ম?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?

জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন।

বাতাসে লাশের গন্ধ—
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংশের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ—
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়

এ-চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না—
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুন চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে— আমি ঘুমুতে পারি না, আমি
ঘুমুতে পারি না…

রক্তের কাফনে মোড়া— কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে,
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা— সে-আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন,
স্বাধীনতা— সে-আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা ॥

০৩.১২.৭৭ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

আধখানা বেলা

হরিতকি— হেমলক, বারুদের পিপাসা,
কারে তুমি বেছে নিলে হৃদয়ের নিবিড়ে?
হে পথিক, কারে তুমি বেছে নিলে পাথেয়,
নির্মান, নচিকেতা, বিনাশ, না, স্বাস্থ্য?

সারারাত কাঠ কাটে ঘুনপোকা গোপনে,
সারারাত ধ’রে তরু বোনে কিছু ফুলকে,
বোনে কিছু সকালের কুসুমের তনিমা—
হে পথিক, কারে তুমি বেছে নিলে পাথেয়?

আধখানা বেলা আছে, আর বাকি কুয়াশা…

তাঁতকল কেঁদে ওঠে ক্লান্তির আঘাতে,
রাজপথ বুকে নিয়ে জেগে থাকে একাকি
বান্ধবহীন এক ইস্পাত শহর—
হে পথিক, জানো তুমি? জেনেছো কি কখনো?
ওই কারা সারারাত শিশিরের মতোন
নিশব্দে চোখ থেকে খুলে রাখে কান্না!

চেয়ে দ্যাখো, আধখানা বেলা আছে সূর্যে,
হে পথিক মনে রেখো, আর সব কুয়াশা—
সব শেষে কারে তুমি বেছে নিলে পাথেয়
হেমলক, হরিতকি, মানুষ, না, মনসা?

১০.০১.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

মুখরিত মর্মমূল

এ কোন কথা চিৎকার কোরে ওঠে বুকের ভেতরে,
চোখের ভেতরে খুলে দিয়ে চোখ অতন্দ্রা আসে!
এ কোন কথার আগুনে পুড়ে কেটে যায় বেলা!
রক্তে জ্ব’লে ওঠে ধবল কনিকারাশি। কী কথা পোড়ায়
মেধা ও মাধবী— আমি তাকে বলতে জানি না।

প্রিয় মুখ, প্রিয় চোখের চন্দ্রকলায় মেঘের কালিমা মেখে
প্রিয় পরিচিত পথ ভুলে নেমে যায় ভিন্ন ভূগোলে।
ঠোঁটের বন্ধনে ভুল ফসলের সঞ্চয় নিয়ে ফিরে যায় পাখি,
কী এক কথার কান্না তখন কেঁদে ওঠে বুকের বিজনে—
আমি তাকে বলতে বুঝি না।

যে-কথা চিৎকার করে, বুকের সভ্যতায় ভাঙে শিল্পের
কারুকাজ, আমি তাকে বলতে জানি না, বলতে বুঝি না—
শুধু চিতার তরঙ্গে জ্ব’লে যাই দ্বিধাহত মৰ্মমূল।

দ্বিমুখি সত্যের নিকটে খন্ডিত তরুন তাপস,
আর কতো মৃত্যু মথিত হবো, মর্মস্থলে পোড়াবো নিজেকে!
আপন কথার কাছে আপনার না-বোঝা গ্লানির ক্লান্তিতে
কতো আর নিরুক্ত নিশ্বাস বুকের ভেতরে রেখে বাড়াবো দীর্ঘশ্বাস!

প্রিয়মুখ— প্রিয় পাখি— প্রিয় পাওয়া ফিরে যাবে
ভেজাচোখ করুন কাতর!!

১৮.০৩.৭৬ মিঠেখালি মোংলা

বিমানবালা

কক্‌পিটে রোদের নাগরদোলা দুলছে বিরামবিহীন,
প্রপেলারে মত্ত বিংশ শতক— যেন রকেন রোলে দোলে
প্রিলির স্বর।
উইন্ডোস্ক্রীনে মুখ রেখে চেয়ে থাকা বিদায়ের বিষণ্ন মুখ-

এইবার উড়ে যাও, যাও পাখি পরবাসে যাও…

ওইখানে কেউ থাকে? মাখে তুষারের শিহরন বুকে ও মুখে?
ক্রিসেনথিমাম হাতে কেউ এসে দাঁড়াবে কি সুহাস,
উন্নত বাহুতে সম্ভাষন, নড়বে আঙুল তার সোনালিমা নোখ?

হয়তোবা ভ্রুর নিচে তার অনিদ্রা-হলুদ চোখে
আঁকাবাঁকা সাপের মতো শুয়ে থাকা নদী— পদ্মা, নীল, হোয়াংহো।

তোমার চোখেও কি নদী নয় ভীষন জমাট জল, বরফিত দীর্ঘশ্বাস?

বিশ্রামের রাতে নিসঙ্গ ক্লান্তিতে রানওয়ে যেমন
আঁধারের আলিঙ্গনে কাঁপে থরো থরো হিমেল ব্যথায়,
তেম্নি তোমারো চোখের খুব গভীরে এক বর্নহীন দাহ—
হৃদয়ের ক্ষতের মতো তুমি তাকে গোপনে লুকিয়ে রেখে
মুখে শুধু এঁকেছো এক সুদূরের অচেনা হাসি।

গন্ধহীন, স্পর্শহীন শাদা রাত পোড়ায় স্বদেশে,
বুকের ভেতরে জানি গর্জে ওঠে এক লাখ ক্ষুধিত এঞ্জিন
এক লাখ মত্ত প্রপেলার ঘোরে ওই মাথার ভেতরে।

তবু
পৃথিবীতে রাত নামে নিবিড় তুষারের মতো,
তুমি শুধু উড়ে চলো ক্লান্তিহীন, তন্দ্রাহীন
অন্য এক সকালের দিকে।

২৩.০২.৭৬ লালমাটিয়া ঢাকা

নষ্ট অন্ধকারে

শোনিতে বিক্ষোভ নিয়ে তোমার নিকটে যাই,
লালিত হত্যার হাত বুকের ভেতরে কাঁপে উষ্ণতায়।
যদি নতজানু হোই, যদি দ্বিধায় থমকে যেতে থাকি,
যদি ফুলের মমতা এসে মুগ্ধতা বাড়ায়— এই বুকে
করাঘাত কোরো, আমি ঠিকই ফিরে যাবো, ঠিকই চিনে নেবো পথ।

শংখ-শরীরের সুখে একদিন কিছু ভুল ভালোবেসে,
রুগ্ন তরুদের মতো আমিও স্খলন হয়ে
পচা আঙুরের নীল অন্ধকারে সারারাত,
আমিও সারারাত মৃত মানুষের শীতে
শীতার্দ্র হয়েছিলাম-

বহুদূরে— একখানা হাত,
একখানা আঙুলের হাত প্রত্যাশার মতো
জেগে থেকে একা শুধু শুনিয়েছে গাঢ় স্বরে :
এই মাঠে, এই বুকে ফসল ফলাবে দেখো নোতুন কিষান,
তাদের আশ্বাস পেয়ে অবশেষে কেটে যাবে কুয়াশার দিন।

মাটি জানে, বৃক্ষ জানে, আমি ভুল ভালোবেসে
অন্ধকারে নষ্ট ফলের মতো ঘুনপোকা পুষেছি বুকের ভেতর।
শোনিতে বিক্ষোভ ছিলো, প্রতিজ্ঞায় গাঢ় ছিলো হৃদপিন্ডের সাহস,
শুধু কিছুদিন এক মাংশে মোহে আবরিত ছিলাম কলুষ পাখি।

এইবার ফিরে যাবো— যদি নতজানু হোই, যদি দ্বিধায় থমকে থাকি,
ঘৃনা কোরো, গ্লানি ছুঁড়ে দিও কঠিন আঘাত জন্মে জীবনে বোধে—
ললাটের মাঝখানে লিখে দিও— পরাজয়, দূষিত মৃত্যু ॥

০৬.০৭.৭৬ মিঠেখালি মোংলা

স্মৃতি বন্টন

এই সব ব্যর্থতা, গ্লানির দহন,
এগুলো আমার থাক
তুমি শুধু শুভ্রতাটুকু নিয়ে যাও
প্রত্যাশার শেফালিকা পারাবত।

বিনিদ্র রাতের বাতাসে দ্বিধায় ভাসমান
আত্মবিনাশী সন্ধানে দুলে ওঠা নিরুদ্দেশ খেয়া,
ক্লান্তির কাছে নুয়ে আসা একাকি নির্জন পাখি,
এসব আমার থাক।

তুমি এই বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া স্বচ্ছ চোখ,
হালকা হিমেল হাওয়ায় খোলা চৈত্রের সকাল
নিয়ে যাও।

দহন আমার থাক, তোমার থাকুক শুধু বহন।
গহন রাত্রির শোক চোখের কিনারে জ্বলুক,
তুমি শুধু চোখের চাঁদে থেকে যাও নিসঙ্গতা।

জন্মের ক্লেদে ভেসে যাওয়া জননী-বাহুখান
আমার সংসারে থাকুক লোকের ঘৃনায়,
তুমি শুধু ফসলে সাজিয়ে বুক ফিরে এসো
প্রাপ্যের উল্লাসে।

পথ-চলা আমার থাক, তোমার থাকুক শুধু পথ।

আকন্ঠ গ্লানিরা আমার বেড়ে উঠুক প্রিয়তম ক্ষত,
তোমার থাকুক শুধু শেফালি-সকাল,
বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া ফসলিম চোখের সংসার।

২৬.০৩.৭৬ রামপাল বাগেরহাট

ইচ্ছের দরোজায়

সব কথা হয়ে গেলে শেষ
শব্দের প্লাবনে একা জেগে রবো নির্জন ঢেউ,
ভেসে ভেসে জড়াবো নিজেকে।
শরীরের সকল নগ্নতায় আমি খেলা কোরে যাবো,
তীর ভেবে ভেঙে পড়বো আমার যৌবনে।

কথা কি শেষ হয়ে যায়— সব কথা?
নাকি বুকের ভেতরে সব অসমাপ্ত ইচ্ছের মতো
দ্বিধাগ্রস্ত জেগে থাকে বুকে নিয়ে বিনিদ্র রাত,
জেগে জেগে নিজেকে দ্যাখে ভীষন উৎসাহে?

সব কথা শেষ হলে দরোজায় করাঘাত রেখে যাবো,
উৎকণ্ঠার ধ্বনিরা বিলীন হবে ইথারের স্বাস্থ্যে—
দ্যাখা হবে না।

শিথানের জানালা খুলে রেখে যাবো একটি চোখ,
শিশির চুমু খাবে চোখের উত্তাপে— চুমু খাবে।
জানালায় রেখে যাবো একটি বিনিদ্র চোখ,
যে-চোখ আকাশ দ্যাখে, মানুষের স্বভাব দ্যাখে,
যে-চোখ স্বাতির মগ্নতা দেখে প্রেমার্দ্র বুকে
অনুভব জ্বেলে রাখে অশেষ বাসনা।

সব কথা শেষ হলে ফিরে যাবো,
একটি চোখ রেখে যাবো শিথানের জানালায়।
সব কথা শেষ হলে করাঘাত জাগাবে তোমায়,
তুমি এসে খুলবে দুয়োর— দ্যাখা হবে না ॥

১৭.০৩.৭৫ লালবাগ ঢাকা

শব্দ-শ্রমিক

আমি কবি নই— শব্দ-শ্রমিক।
শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়,
হৃদয়ের কালো বেদনায়।
করি পাথরের মতো চূৰ্ণ,
ছিঁড়ি পরান সে ভুলে পূর্ন।
রক্তের পথে রক্ত বিছিয়ে প্রতিরোধ করি পরাজয়,
হাতুড়ি পেটাই চেতনায়।

ভাষা-সৈনিক আমি জানি শুধু যুদ্ধ,
আমার সমুখে আলোর দরোজা রুদ্ধ—
তাই বারুদে সাজাই কোমল বর্নমালা,
তাই শব্দে শানিত আনবিক বিষ-জ্বালা।
ধূর্জটি-জটা পেতে রোধ করি অবক্ষয়ের সংশয়,
আমার এ-হাতে শব্দ-কাস্তে ঝলসায়।

ভাষার কিষান চোখ মেলে চেয়ে দেখি,
চারিপাশে ঘোর অসম জীবন,
সভ্য পোশাকে পাশবিক বন।
সমতার নামে ক্ষমতাকে কোরে রপ্ত,
আমি জানি কারা জীবনে ছড়ায় পুঁজ, পোকা, বিষ তপ্ত—
জানি আমাদের কারা ধুতুরার ফুলে অন্ধ করেছে অবেলায়,
ছুঁড়ে দিয়ে গেছে নষ্ট নগ্ন বেদনায়।

আমি সেই পোড়া ভিত ভেঙে জেগে উঠেছি জীবনে,
আমি সেই কালো ঘোড়ার লাগাম ধ’রে আছি টেনে।
বুকের ভাষাকে সাজিয়ে রনের সজ্জায়,
আমি বুনে দিই শব্দ-প্রেরনা মানুষের লোহু মজ্জায় ॥

২৫.০৩.৭৭ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

এ কেমন ভ্রান্তি আমার

এ কেমন ভ্রান্তি আমার!
এলে মনে হয় দূরে স’রে আছো, বহুদূরে,
দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে আকাশ।
এলে মনে হয় অন্য রকম জল হাওয়া, প্রকৃতি,
অন্য ভূগোল, বিষুব রেখারা সব অন্য অর্থবহ-
তুমি এলে মনে হয় আকাশে জলের ঘ্রান।

হাত রাখলেই মনে হয় স্পর্শহীন করতল রেখেছো চুলে,
স্নেহপলাতক দারুন রুক্ষ আঙুল।
তাকালেই মনে হয় বিপরীত চোখে চেয়ে আছো,
সমর্পন ফিরে যাচ্ছে নগ্ন পায়ে একাকি বিষাদ-ক্লান্ত
করুন ছায়ার মতো ছায়া থেকে প্রতিচ্ছায়ে।
এলে মনে হয় তুমি কোনোদিন আসতে পারোনি….

কুশল শুধোলে মনে হয় তুমি আসোনি,
পাশে বসলেই মনে হয় তুমি আসোনি।
করাঘাত শুনে মনে হয় তুমি এসেছো,
দুয়োর খুল্লেই মনে হয় তুমি আসোনি।
আসবে বোল্লে মনে হয় অগ্রিম বিপদবার্তা,
আবহাওয়া সংকেত- আট, নয়, নিম্নচাপ, উত্তর, পশ্চিম—
এলে মনে হয় তুমি কোনোদিন আসতে পারোনি।

চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,
চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভুবনে আছো।

০২.০৮.৭৫ লালবাগ ঢাকা

মাংশভুক পাখি

ফুলের পোশাকে ঢাকা শরীর, দারুন মাংশভুক পাখি,
ওই শকুন, ওই হিংস্র গোপন নোখ জুড়ে থাকা শত্রু-স্বভাব,
আমাদের দিন থেকে খেয়ে যাবে প্রিয়তম রোদের মাংশ।

ওই নষ্ট চোখ
ওই চতুর ঘাতক
ওই ফুলাবৃত শকুন
খেয়ে যাবে, খেয়ে যায় মানুষের শুভ্র ধান, পলিমাটি, নীড়,
জোস্নার ধমনী থেকে খেয়ে যায় সৌরভ-কনিকাগুলো।

ঋতু বদলের ভোরে
আমাদের শাখা থেকে তরুন কৃষ্ণচূড়া,
আমাদের ভালোবাসা থেকে সুনীল সবুজ বিক্ষোভগুলো
ছিঁড়ে নিয়ে গেছে ওইসব নষ্ট শকুন। ওইসব মাংশভুক পাখিরা
আমাদের চোখ থেকে খেয়ে গেছে দৃষ্টির স্বাধীন বসবাস।

আমাদের বুক থেকে
আমাদের প্রান থেকে
ভাষার ভুবন থেকে
শোভন শব্দগুলো কেড়ে নিয়ে গেছে ওরা আমাদের প্রিয়তম আকাশটুকু।

সূর্যহীন, জোস্নাহীন, এই কালো অন্ধকারে
দুর্ভিক্ষের মতো
ফুলের পোশাকে ঢাকা ওই হিংস্র গোপন নোখ,
ওই মাংশভুক পাখি, ডানা থেকে ফুলের পালক খুলে ফেলে
উড়ে এসে বসবে সব শহরে— গ্রামে— জীবনের সবুজাভ নিসর্গে,
পান্ডুর দেহ থেকে ছিঁড়ে খাবে রক্ত মাংশ, প্রিয়ফুল। আমাদের
রাত থেকে নিদ্রাগুলো
লাল নক্ষত্রগুলো
স্বাধীনতাগুলো
কেড়ে নিয়ে গেছে ওরা। কেড়ে নিয়ে যাবে চিরকাল?

প্রেমের নিকটে গিয়ে ফিরে আসি— বুকে ভালোবাসা নেই
জোস্নার নিকটে গিয়ে ফিরে আসি— চোখে স্বাধীনতা নেই
শ্রমের নিকটে গিয়ে ফিরে আসি— বাহুতে বিশ্বাস নেই
মানুষের কাছে গিয়ে ফিরে আসি— দেহে মমতারা নেই
নেই, নেই, ফুল নেই, পাখি নেই, রোদ নেই, স্নেহ নেই,
খেয়ে গেছে গোপন ঘাতক-

শুধু হাড়,
শুধু এক ভয়ানক গ্লানিমাখা আকাংখা নিয়ে
প’ড়ে আছে কলুষিত করুন কংকাল, মৃত কিছু পুষ্টিহীন
হলুদ করোটি।
বোধি নেই, স্থিতি নেই, অনাহারে নক্ষত্রের মতো জেগে আছি,
করতলে শেষ বিশ্বাসের শিকড়ে এসে থেমে আছে দূষিত ক্ষরন।

তবুতো আকাংখারা মাঝে মাঝে চিৎকার কোরে ওঠে সফেন সাগর,
তবুতো কোনোদিন একদিন বৈশাখি রাতে জীবন এসে বলেছিলো :
হাড়ের খুলির মাটি কোনো এক বর্ষার পর ঠিকই পাললিক হবে,
খরার মাঠের বুকে দেখো ঠিক মেলে দেবে ফসলের সোনালি পালক ॥

১৪.০৭.৭৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

আমি সেই অভিমান

আমি সেই অবহেলা, আমি সেই নতমুখ,
নিরবে ফিরে যাওয়া অভিমান-ভেজা চোখ,
আমাকে গ্রহন করো।

উৎসব থেকে ফিরে যাওয়া আমি সেই প্ৰত্যাখ্যান,
আমি সেই অনিচ্ছা নির্বাসন বুকে নেয়া ঘোলাটে চাঁদ।
আমাকে আর কী বেদনা দেখাবে?

তপ্ত সীসার মতো পুড়ে পুড়ে একদিন
কঠিন হয়েছি শেষে, হয়েছি জমাট শিলা।
তবু সেই পাথরের অন্তর থেকে
কেঁদে ওঠে একরাশ জলের আকুতি,
ঝর্নার মতো তারা নেমে যেতে চায় কিছু মাটির শরীরে—

আমি সেই নতমুখ, পাথরের নিচের করুন বেদনার জল,
আমি সেই অভিমান— আমাকে গ্রহন করো।

১১.০১.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

বিশ্বাসে বিষের বকুল

যদি সব নদী ফিরে আসে নীড়ে, জন্মের নিকটে,
তবু শরীরে ঘামের গন্ধ আমি তো ফিরিনি আজো
লাঙলের ফলায় মেখে ক্লান্ত-বিশ্রাম,
চুলে নোখে অসভ্যতা, আমি তো ফিরিনি গৃহে বনবাস বিরাগী বাউল।

নদীও নদীর ভেতরে মেলে আছে অনন্ত ঋনী,
প্রাপ্যের কাছে যতো পাওয়া ছিলো, যতো চাওয়া ছিলো,
তারও কি অধিক তুমি দিয়েছিলে ভুলে
আমার জন্মের কাছে নিবেদিত বিষের বকুল?

স্টেশন জেগেছিলো— হুইসেলে কেঁপেছিলো রাত,
তবুতো একটি মানুষ নির্ধারিত আসনে এসে বসেনি।
লোহার সাঁকো বেয়ে নেমে যাওয়া ডাউন-ট্রেন,
তবুতো একটি মানুষ জানালায় রাখেনি মাথা, রাতজাগা চুল।

যদি সব পাখি ফিরে যায় নীড়ে মমতা-কাতর,
যদি সব নদী অধিক প্রাপ্যের লোভে নেমে আসে
পুরাতন জন্মের ঋনে,
তবু বিশ্বাসে ঘামের গন্ধ আমি তো ফিরিনি আজো—
হেঁসেলে পোড়া ভাত, নিদ্রা-নিহত সেই পোয়াতি কুকুর,
দুধের ফেনার ভেতরে মৃত শিশুদের শীর্ন শরীর,
বিষের বকুল, গোলাপের লাশ—
সেখানেই আমার কিছু প্রয়োজন ছিলো,
সেখানেই আমার শুধু পিছুডাক ছিলো ॥

২৫.০৩.৭৬ রামপাল বাগেরহাট

অমলিন পরিচয়

সেই থেকে মনে আছে—
কপালের ডান পাশে কালো জন্ম-জরুল,
চুলের গন্ধে নেমে আসা দেবদারু-রাতে
কতোটা বিভোর হতে পারে উদাস আঙুল,
সেই প্রথম অভিজ্ঞতা, সেই প্রথম ভুল।

অথবা ভুলের নামে বেড়ে ওঠা সেই প্রেম,
সেই পরিচয়, আমি তাকে নিসঙ্গতা বলি।
তুমি কি পাখির মতো আজো সেই স্মৃতিদের খড় চঞ্চুতে তুলে
আর কোনো পৃথক নীড়ের তৃষ্ণায় করতলে লিখে রাখো দাহ?

তবে কি এই শেষ, সেই থেকে হয়েছে শুরু?
তবে কি সেই প্রেম, সেই অভিজ্ঞতাটুকু,
আমাদের সমস্ত নিসঙ্গতা জুড়ে আছে আজো এক অধিকারে?
আজো এক অমলিন বেদনার সাম্পান বিশ্বাসে ভেসে যায়…
ভেসে যায়… ভেসে যায়…

দূরত্ব জানে শুধু একদিন খুব বেশি নিকটে ছিলাম,
একদিন শরীরের ঘ্রান শুঁকে তুমি বোলে দিতে : অমিতাভ
আজ সমুদ্রে যেও না, আজ খুব ঝড় হবে—

৩১.০৭.৭৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

শ্যামল পালক

একটি পালক তার খ’সে পড়েছিলো
দখিনের হাওয়া লেগে ঘাসের উপর,
আহা সেই লাজুক শ্যামল পাখি!

ঝরা সে-পালক তার প’ড়ে র’লো ঘাসে,
বিকেলের ভেজারোদ অবাক দুচোখে
চমকে থমকে যেন দাঁড়ালো খানিক,
আহা, সেই ঘাসে প’ড়ে থাকা শ্যামল পালক।

মাঠের বাতাস তার ছুঁয়ে গেল চুল,
শিহরিত দেহখানি লজ্জায় কেঁপে
থরো থরো হলো যেন প্রথম কুমারী—
আহা সেই বিকেলের ভেজা রোদে শুয়ে থাকা কুমারী পালক।

কোন সেই তুষারের দেশ থেকে
ব’য়ে আনা উত্তাপ পালকের প্রতি রোমে রোমে,
আহা, কোন সেই কোন অচেনা দেশের ধুলো
মাখা ওই পালকের নরোম শরীরে!

মনে হলো একবার
তুলে এনে তারে রাখি বুকের নিকটে।
হয়তো কখনো একদিন কোনো এক নারী,
কোনো এক অচেনা নরোম হাত ছুঁয়েছিলো তারে,
কোনো এক অচেনা বাতাস তারে বেসেছিলো ভালো
হয়তো কখনো— কোনো একদিন…

০৫.০১.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

মাতালের মধ্যরাত্রি

এ-ও এক কন্ঠলগ্ন প্রেম রক্তের গহনে,
মারমুখি জনতার মতো ভীষন বিক্ষুব্ধ।
যেন সমুদ্রের ঝড়,
সহজে উড়িয়ে নেবে মাস্তুল, মাল্লার মুগ্ধ-চিত্ত মোহন রমনী।

রক্তলগ্ন নগ্ন ক্ষোভে কাঁপে বিষণ্ন বন্দর,
সফেদ জলকপোত যেন তার দীর্ঘশ্বাস
আকাশে ইথারে ঝরে-
মাঝরাতে পুলিশের বাঁশি শুনে জেগে ওঠে ক্লান্ত করুন মাতাল।

মনে পড়ে, একদিন অরক্ষিত জীবনকে পাহারা দিয়েছে সে-ও,
দস্যুর সন্ত্রাসে ভীত সে-ও একদিন মারনাস্ত্রে সাজিয়েছে তাকে।
তবু তার লুট হয়ে গেছে ঘর—
তবু তার বাসনার সিন্দুক ভেঙে দুরূহ ডাকাত
ছিনিয়ে নিয়েছে সব গান, স্বস্তির সোনালি ফসল।

মাঝরাতে পুলিশের বাঁশি শুনে মনে পড়ে—
তারও শহর ছিলো, ডাকাতের ভয় ছিলো,
একদিন তারও মাংশের পৌর জনপদে
নিরাপত্তায় নিয়োজিত তীব্র প্রহরী ছিলো।

আজ সব পোড়োবাড়ি— ধংশের কালো কফিন পাহারা দিয়ে
আজো তার কন্ঠলগ্ন মগ্ন প্রেম ভালোবেসে পোড়ায় তনু।
মাঝরাতে পুলিশের বাঁশি শুনে জেগে ওঠে করুন মাতাল,
আকাশের মতো তার চোখ থেকে ঝরে ম্লান ব্যথার শিশির-
নগ্ন অন্ধকারে ভাসমান ওই যে-বিষণ্ন মানুষ, ব্যথিত মানুষ
অস্থির মাতাল ওই হাতে ওর তুলে দাও রাত্রির সমস্ত পাপ,
ওকে আরো মাতাল হতে দাও, ওকে আরো ব্যথিত হতে দাও ॥

২৪.০৮.৭৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

প্রিয় দংশন বিষ

দংশন করো একাধিক বার দংশন চাই বিষ,
শোনিতে শীতল নীল প্রদাহের তীব্র প্রবাহনতা।
দ্বিমুখি সাপের দ্বৈত ছোবলে ক্ষত বিক্ষত বোধ,
বিরোধিতা চাই চুম্বনে নত ইচ্ছে মাখানো ঠোঁটে।

বিরোধিতা চাই স্বপ্নের ঘ্রানে মধু ও মধুরিমায়,
সারা পথে চাই উষ্ণ মাটির ললাটে ছড়ানো দ্বন্দ্ব।
দংশন চাই বৈরী বিরোধ, দংশন চাই বিষ,  
তন্ত্রে তনুতে বিষমাখা দাঁত দংশন করো প্রেমে।

যতোবার আসি উপেক্ষা পেয়ে শংকিত ভীরু পায়
প্রেমে নত সেই মুখটির কাছে যতোবার আসি ফিরে
অবয়বে তার কাঁপে আশ্রয় গ্রহনের পেলবতা—
সে-মুখেও চাই বিরোধিতা বিষ উপেক্ষা সন্নত।

ভালোবেসে পাওয়া প্রিয় বেদনার নগ্ন দুখানি ঠোঁটে,
চুম্বন রেখে সারারাত কাটে চিতা-বহ্নির বিষে।
তবু প্রিয়তম বেদনাকে চাই ব্যথিত বিনিদ্ৰতা
সংশয়-ভরা চলা-পথ চাই তুষারিত দিন রাত্রি।

দংশন চাই বৈরী বিরোধ অবহেলামাখা বিষ,
দংশন করো রক্তে ও বুকে, দংশনে পাবো তুমি—
দংশনে পাবো বেদনায় ধোয়া তোমার পৃথিবীটাকে।।

১৭.১০.৭৫ লালবাগ ঢাকা

বাঁকা ব্যবধান

পাতক বোলে কি ফুলকে ছোঁবো না,
জোস্না রবে না বুকে?

যতোটুকখানি বুঝেছি তোমার না-বোঝার ছল কোরে,
তার আধখানা যদি বা সাজাই হৃদয়ের নির্জনে।
তা-ও কি পাতকী?

ঘাতকী অমন হয়েছিলে কেন কিসে?
বিষাদে বিভেদে বেড়ে যায় বেলা,
মাধবীর তলা শূন্য কি প’ড়ে রবে?
তবে, চোখে যার ছড়ায়নি রোদ
সূর্যের কিছু রেনু,
তনু ঘিরে তার জ্বলবে আঁধার, অন্ধ বন্ধ পাখা?

বাঁকা হাত পেতে ডাকিনি বোলে কি এতোটা দ্বিধা?
মেধা খুঁড়ে খুঁড়ে গড়েছি বোলে কি
রক্তের মাঝে পুষেছি বোলে কি
এতো অবহেলা!

পাতক বোলে কি ফুলকে ছোঁবো না?
আমি বোলেই কি তোমাকে পাবো না?
ব্যবধান জুড়ে রয়ে যাবে শুধু নীল শূন্যতা বাঁকা??

২৬.০৩.৭৬ রামপাল বাগেরহাট

অপর বেলায়

বড়ো বেশি সংসার এসে গেছে শরীরে স্বভাবে—
এতোটা কি উচিত ছিলো!
এতোটা মেঘহীন, ঝড়ের শর্তবিহীন বাতাসে
খুলে ফেলেছি শার্টের সবগুলো সোনালি বোতাম —
এতোটা কি উচিত ছিলো!

প্রথম বন্ধন এসে কেঁপেছিলো বেতসের লতা,
দ্বিতীয়তে মৃত্যু ছিলো দ্বিধাহীন সখাত সলিলে
তবুতো তার কাছে স্বপ্নের শেষ কানাকড়ি,
শেষ পরাজয় তুলে দিয়ে বলেছি সিঁদুর-আশ্রয়-
এতোটা কি উচিত ছিলো?

জানি না কি মোহ ছিলো এতো মোহময়
জানি না কি দাহ প্রান এতোটা পোড়ায়!
তবুতো মুগ্ধ মন পুড়েছি একাকি এই দ্বিধাহীন বিশ্বাসে—

দারুন নির্জনে নেমে বেঁধেছি একখানা রঙিন নৌকো,
আমি তো পারাপার জানি না, জানি না বৈঠার ভাষা।
কোনখানে কূল নাই তার কোথায় কিনারা নাই,
কতোখানি সাবধানে ভাসাতে হয় ভাঙা তরীখানি
জানি না-

তবু, এই অপর বেলায় অনিকেত নবীন মাঝি
পরবাসি বন্ধুর খবর নিয়ে ফিরে যাই দেশে।
ফিরে যাই বিনিদ্র চোখের কাছে একখানা চিঠি,
বকুলের খামে মোড়া শুভ্র সকাল।

২১.০৩.৭৬ রামপাল বাগেরহাট

মনে পড়ে সুদূরের মাস্তুল

পেছনে তাকালে কেন মূক হয়ে আসে ভাষা!
মনে পড়ে সেই সব দুপুরের জলাভূমি,
সেই সব বেতফল, বকুল কুড়োনো ভোর,
আহা সেই রাঙাদি-র আঁচল তলের উত্তাপ,
মনে পড়ে

মনে পড়ে, বন্দরে সেই সব কালোরাত,
ঈগলের মতো ডানা সেই বিশাল গভীর রাতে,
একটি কিশোর এসে চুপি চুপি সাগরের কূলে
দাঁড়াতো একাকি
তন্ময় চোখে তার রাশি রাশি বিস্ময় নিয়ে।

কবে তারে ডাক দিয়ে নিয়ে গেল যৌবন সুচতুর,
কবে তারে ডেকে নিলো মলিন ইটের কালো সভ্যতা!

সবুজ ছায়ার নিচে ঘুমে চোখ ঢুলে এলে
মা যাকে শোনাতো সেই তুষার দেশের কথা,
তার চোখে আজ এতো রাতজাগা ক্লান্তির শোক!

পেছনে তাকালে কেন নিরবতা আসে চোখে!
মনে পড়ে— জোস্নায় ঝলোমলো বালুচর,
একটি কিশোর তার তন্ময় দুটি চোখে
রাশি রাশি কালো জল— সুদূরের মাস্তুল
মনে পড়ে…

০৩.০১.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

প্রজ্জ্বলন্ত লোকালয়

‘আগুন লেগেছে পালা—’
শালা সব শুয়োরের জাত, কুত্তার লেজুড়,
ঘর ভরা বীজধান, গর্ভবতী নারী তোর দুধের সন্তান,
সব ফেলে একা-একা পালাবি কোথায়?

‘ওই গাঁয়ে মহাজন, ভাত মাছ শস্তায় সকলি মেলে,
খানকি মাগিরা আছে বুক পাছা উরু ঠোঁট রসে থলো-থলো,
ওদের গোলাম হবো, মহাজন খুশি হলে মিলবে এনাম—’।

আগুন লেগেছে দেশে, গ্রামগঞ্জ, নগরে নিভৃতে
পুড়ে যায় দুধভাত, রাইশস্য, নবান্ন, নলেন গুড়,
দুগ্ধবতী গাভিদের ভরাট ওলান চোষে অজন্মার দুধরাজ সাপ।

একা একা ওই দ্যাখো পালায় ভীরুরা,
স্বজনের দগ্ধ দেহ নির্বিকার দুপায়ে মাড়ায়ে যায়,
বৃদ্ধ জননীর লাশ ঠেলে ওই দ্যাখো কাপুরুষ কিভাবে পালায়।

শালা সব বেজন্মার জাত,
অভাবি মায়ের মুখে থুতু দিয়ে ওরা যায় গনিকার ঘরে।
ওদের চিহ্নিত করো, খুলে দাও মুখোশের বিচিত্র লেবাস,
নাড়ার বোলেন জ্বেলে ওই সব ভীরু মুখ পোড়াও আগুনে।

কাপুরুষ বিনাশিত হলে,
ওদের কবরে জন্ম নেবে আগামীর গুচ্ছ গুচ্ছ সাহসী সন্তান।

৩০.০৮.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

পাঁজরে পুষ্পের ঘ্রান

তোমাকে বলবো বোলে তারকাটা, পাথুরে জলের হিম,
মৃত্যু. রক্ত. লাশ. এই ধংশের শ্মশান ডিঙিয়ে এলাম,
তোমাকে বলবো বোলে।

পাঁজরে পুষ্পের ঘ্রান জ্ব’লে আছে ক্ষুধার মতোন,
ক্ষুধা তো বেঁচে থাকার অন্য নাম।
তোমার আমার এই দূরত্বের মাঝে সেই ক্ষুধার পাথর-
তুমি তাকে প্রেম বলো, স্বপ্ন বলো, লোকে বলে মলিন বিরহ।

তোমাকে বলবো বোলে জলকষ্ট, নিদ্রাহীন রাত
মানুষের শ্বাপদ-স্বভাব মাখা লোভাতুর দাঁতের কৌশল,
আমি তৃষ্ণার অপূর্ন ওষ্ঠ থুয়ে এসেছি পেছনে।

জীবনের তিন ভাগ অনাহার নিয়ে একটি জঠরে
যে-মানুষ পাঁজরে পুষ্পের ঘ্রান পুষে রাখে প্রেমের মতোন
আমি তার স্বপ্নের শিয়র থেকে উঠে এখানে এসেছি
তোমাকে বলবো বোলে।

তোমাকে বলবো বোলে কষ্ট. ধংশ. ক্ষয়. লেলিহান ক্রোধ
তামাটে মাটির গন্ধ বুকে এই ধংশের কবর ডিঙিয়ে এলাম
শুধু তোমাকে বলবো বোলে, ভালোবাসা প্রিয়মুখ
তোমাকে বলবো বোলে।

২০.১১.৭৭ মোংলা বন্দর

পথের পৃথিবী

গোপনে ছিলাম নিজের মধ্যে একা
তুমি এসে কেন হঠাৎ ডাকলে করাঘাতে!
আত্মমগ্ন কুয়াশার মোহ ছিঁড়ে
দূরে তাকাতেই দেখলাম ঘন বনভূমি,
তুমি ডাকলেই মনে হলো আমি একাকি ছিলাম।

ইতিহাস থেকে জেগে ওঠা এক শব
যেন এ-প্রথম দেখলো নোতুন পৃথিবীকে,
যেন তার দেশে ছিলো না আকাশ মাটি
ছিলো না এমন রুপোলি রোদের কারুকাজ—
আজ তাই তার পায়ের নিচের ধুলোমাখা ঘাসগুলো
মনে হলো তা-ও কতো সুন্দর আহা!

মগ্ন ছিলাম নিজের মধ্যে একা
তুমি এসে টেনে নামালে পথের পৃথিবীতে,
হাতছানি দিলো জীবনের সাইমুম-
মত্ত জলের করতালি শুনে বিশ্বাসে
বাঁধলাম এই সাহসে শোভিত মাস্তুল আমাদের।

তুমি ডাকলেই মনে হলো আমি একাকি ছিলাম,
তুমি ডাকলেই প্রিয়ময় হলো আমার নির্জনতা।

২৪.১২.৭৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

স্বজনের শুভ্র হাড়

বুকের তিমির ঠেলে জেগে উঠেছে যে-দ্বীপ
সে-আমার ভালোবাসা,
ব্যথার প্রবাল জ’মে তিলে তিলে গ’ড়ে ওঠা বাসনার ভূমি।

হননের রক্তপাত শেষে
বিনাশের ধংশযজ্ঞ শেষে
নীলিমার মতো শুভ্র স্নিগ্ধ তনু যে-দ্বীপ উঠেছে জেগে
সে-আমার রক্ত. মাংশ. হাড়. করোটির কষ্ট দিয়ে বোনা
একখানি স্বপ্ন-ধোয়া হৃদয়ের তাঁত।

সে-আমার নোতুন বসতভূমি সাগরের চর,
আমার গৃহের সুখ, জীবনের নিশ্চিত প্রহর।

এইখানে আবার সাজাবো নীড় সোনালি সময়,
এইখানে অঘ্রানের চাঁদ সমস্ত বছর দেবে নির্ভার পূর্নিমা-

বেদনার দীর্ঘ রাত্রি শেষে
বিনাশের রক্তপাত শেষে
আমাদের দ্যাখা হলো,
ব্যথার প্রবাল দ্বীপে পুনরায় দ্যাখা হলো তোমার আমার।
রক্তে ধোয়া মমতার মাটি—
স্বজনের শুভ্র হাড় চারিপাশে ফুটে আছে অপরূপ উজ্জ্বল ফুল,
আমাদের সম্মুখে দিগন্তের মতো প্রসন্ন ভবিষ্যৎ…
ব্যথার প্রবাল দ্বীপে পুনরায় দ্যাখা হলো তোমার আমার।

রক্তের নিবিড় স্রোতে করাঘাত কোরে যায় স্মৃতি,
বুকের বাঁ-পাশে কার অস্ফুট কান্নার মতো ব্যথা এসে বাজে!
স্বজনের রক্তে ধোয়া এই প্রিয় মাটির সিঁথানে
আমাদের ব্যথিত প্রনাম এসো জ্বেলে দিই ধুপের মতোন।

কোনোদিন এই সব মানুষেরা ফিরবে না আর…
যে-রাখাল উদাস দুপুরে তার বাঁশির সুবাস ছড়াতো বাতাসে
সে আর ফিরবে না।
যে-নারী সিঁথায় লাল সিঁদুরের স্নিগ্ধ প্রেমে এঁকেছিলো মুগ্ধ নীড়
সে আর ফিরবে না।
যে-যুবক রাইফেলে ক্ষুব্ধ হাত বারুদের মতো বিস্ফোরন
বুকে নিয়ে ছুটেছে মাতাল— সে আর ফিরবে না, সে আর ফিরবে না…

স্বজনের শুভ্র হাড় চারিপাশে ফুটে আছে ফুলের মতোন।
বিজয়ের ব্যথিত মিছিল তবু কেন চলে ভুলের ভুবনে
কেন তবু ভুল জীবনের পায়ে রেখে আসে পুষ্পের প্রনাম?

বুকের তিমির ভেঙে সুপ্রভাতে আমাদের দ্যাখা হয়েছিলো,
সুরম্য আলোর নিচে জেগে ওঠা আমাদের স্বপ্ন-ধোয়া দ্বীপ—
তবু সেই নিশ্চিত প্রহর আজো আসেনি এখানে,
তবু সেই অঘনের পূর্ন চাঁদ ছড়ায়নি জোস্নার আরক।

আমার ভাষার কন্ঠ রোধ কোরে আছে আজো চতুর শ্বাপদ,
আজো শুধু স্বজনের শুভ্র হাড় চারিপাশে ফুটে আছে
উজ্জ্বল বিষণ্ন ফুল।

১৩.০২.৭৮ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

পরাজিত নই পলাতক নই

আর যাই হোক পলাতক নই
হয়তো পারিনি জীবনের সব প্রাপ্য মেটাতে
হয়তো অনেক অনিয়ম এনে গড়েছি নিয়ম,
হয়তো স্বজন প্রিয় মানুষের নিষেধ মানিনি
বন্ধন ছিঁড়ে ব্যবধানকেই আপন ভেবেছি বেশি।

অনাহার কতো এসেছে করাল
বন্যায় ঝড়ে ভেসে গেছে কতো নীড়ের জোস্না,
কতোবার আশা ঢেকেছে করুন বেওয়ারিশ লাশে
কতোবার প্রেম বারুদের বিষে হয়েছে কাতর
নির্মমতার নিচে একশত জ্বলন্ত নাগাসাকি—

তবু উন্নত সবল করোটি
তবু দুই হাতে পাথর কাটার প্রাচীন গন্ধ,
তবু বেদনাকে শোনিতে সাজিয়ে বলি প্রিয়তম
বলি সভ্যতা অপরূপ, সারা শরীরে আমার
লেগে আছে আজো আদিম জীবন, বিশ শতকের ধুলো।

আর যাই হোক পরাজিত নই –
শত শতাব্দী হেঁটে আসা দেহ হয়তো ক্লান্ত
কিছুটা হয়তো বিশ্রাম চায় অনু পরমানু,
কিংবা হয়তো আরো দূর পথ যেতে হবে জেনে
ছুটবার আগে একটু সময় পেছনের দিকে ফেরা
একটু সময় সময়ের দিকে ফেরা।

১৬.১১.৭৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

কার্পাশ মেঘের ছায়া

শিমুল শাখারা তবু এতো লাল হয়ে ওঠে আজো,
আজো এতো রক্তময় হৃদয়ের মতো শুষ্ক বাতাসে ছড়ায়
লোহিত সুঘ্রান।

সেই শৈশবে উড়ন্ত কার্পাশ মেঘের দিকে
ছুটতে ছুটতে একদিন নদীর কিনারে এসে মন্ত্রমুগ্ধ
জলের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকা চোখ সেই প্রথম দেখেছিলো
আপন প্রতিকৃতি—

জীবনে সেই প্রথম নিজেকে দ্যাখা, নিজের শরীরের দিকে
দৃষ্টি ফেরানো— তখনো জননী মানেই অভিমানে ভেজা চোখ
আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেড়ে নেয়া স্নেহ-সিক্ত হাতের পরশ
তখনো জননী মানে শুধুই মা।

জলের আর্শিতে দ্যাখা সেই বিভোর বিস্মিত কিশোরের ছায়া
আজো সে তেম্নি স্থির থমকে দাঁড়ায় এসে নদীর কিনারে,
মৌশুমে সব শিমুল ফুটে ওঠে গাঢ় লাল
বাতাসে কার্পাশ ফাটে—
দুরন্ত কৈশোর আজো ঠিক তেমনি ছুটে যায় তুলোর মেঘের পেছনে

শুধু রক্তাক্ত হৃদয়খানা বুকের ভেতরে লুকিয়ে তন্ময় আমি
গোপনে নিজেকে বলি : তুমি খুব বড়ো হয়ে গেছো, খোকা
তুমি খুব বড়ো…

২০.০৮.৭৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

পশ্চাতে হলুদ বাড়ি পঞ্চাশ লালবাগ

এটা প্রস্থান নয়, বিচ্ছেদ নয়— শুধু এক শব্দহীন সবল অস্বীকার
পরিকল্পিত প্রত্যাখ্যান, এ-কোনো অভিমান নয়— ব্যর্থতা নয়।

বিরহে কাতর হবে, কাতরতা বাড়াবে স্বাধীন স্বদেশ, জানতাম
আমার শূন্য চেয়ারে হাত রেখে তাকাবে রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিচিহ্ন
বকুলের দিকে,
প্রতিদিন ঘরে ফেরার পদশব্দ শুনতে চেয়ে অপেক্ষা সাজাবে ভেতরে,
জানতাম, আমার না-থাকা শরীর করতলে প্রদীপের মতো
জ্বলতে-জ্বলতে জ্বালাবে নদী, পাখি, ফুল. সংসারে সাজানো সবুজ—
তবু এ-কোনো প্রস্থান নয়, এ-কোনো বিচ্ছেদ নয়।

এখন যেখানে যতোদূরে থাকি দ্যাখা না হওয়াই ভালো।

তোমার দেয়ালের পলেস্তারে ভেসে উঠুক যৌবন-হন্তা-শ্বাপদ
উঠোনে কৃষ্ণচুড়ায় মৌশুমি ফুলের উল্লাস ঝ’রে যাক হলুদ মাটিতে
অথবা আরো কিছু নোতুন বৃক্ষের ছায়ায় ধ্বনিময় হোক জীবন যাপন,
আরো কিছু হোক, আরো বেশি কিছু— পাওয়া বা পতন
তবু দ্যাখা না হওয়াই ভালো।

চ’লে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়— বিচ্ছেদ নয়,
চ’লে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী।

চ’লে গেলে আমারো অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।

১০.০২.৭৬ কাঁঠালবাগান ঢাকা

নিবেদিত বকুল-বেদনা

একখানা বকুল মালা রেখে গেছি শুধু আমার না-থাকায়
আর কিছু না।
শুধু এক মৌন ফুলের মোম যেন নিশব্দ আলোর গন্ধ
চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, যেন আলোকিত হয়ে আছে নিজে।

আমার অস্তিত্বকে প্রমানিত কোরে গর্বিত বুক
ঝুলে আছে মৃত বাসি বকুলের হার. পুষ্প পালক,
আমি নেই—

আমি নেই তাই বকুল হয়েছে প্রিয়, দুখের কারন
আমি নেই বোলে বকুল বলছে কথা স্মৃতির ভাষায়।

যেন আমি নই, এই বাসি বকুল ভালোবেসে একদিন
অভিমানী রাতে তুমি বেদনার জোস্না মেখেছিলে বুকে,
যেন এই বকুলের জন্যে এতো পথ হেঁটে আসা
এতো রাত জেগে থাকা অপেক্ষার সাথে একাকি।

সুবোধ সাপের মতো নিবেদিত নিবিড় ভঙ্গিতে
মৃত বাসি শুকনো বকুল ঝুলে আছে হলুদ দেয়ালে,
যেন অহংকারের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিনীত বেদনা
স্নেহময় হাতে যাকে স্পর্শ করলে ভেঙে পড়বে প্রবল বন্যায়।

ইচ্ছাকৃত ভুলে ফেলে রেখে গেছি আমার বকুল
ভুলে ফেলে গেছি ভেবে ফিরিয়ে দিও না।

২১.০১.৭৬ লালবাগ ঢাকা

নিরাপদ দেশলাই

সঞ্চিত বারুদ বক্ষে তবু প্রয়োজন ছাড়া জ্বলি না কখনো।

জ্ব’লে ওঠা বারুদের নিজস্ব স্বভাব,
স্বভাবের দোষে তাকে দূরে রাখে সতর্ক মানুষ।
বিস্ফোরন বুকে আছে, আমি তার নিয়ন্ত্রন জানি,
আমাকে নিকটে রাখো, বুকে রাখো শীতার্ত কুমারী-
প্রয়োজন ছাড়া আমি জ্বলি না কখনো।

এই শীতে জীবনের কষ্ট হবে খুব—
গৃহহীন অরন্যের পথে যেতে করাল কুয়াশা
শরীরের রক্ত মাংশ কেটে নেবে শীতের হাঙর,
বসতি বিরল সেই প্রান্তরের গহন বিপদে
আমাকে নিকটে রাখো, বুকে রাখো শীতার্দ্র মানুষ –
প্রয়োজন ছাড়া আমি জ্বলি না কখনো।

জ্ব’লে ওঠা জীবনের দ্বিতীয় স্বভাব
জন্মদোষে আমি শুধু সেটুকু পেয়েছি,
অস্থিতে মেধায় তাই সেই বোধ খেলা করে সমস্ত প্রহর।

বিপ্লবের স্বপ্ন বুকে মানুষেরা যেভাবে ঘুমোয়,
যেভাবে তোমার চোখে মিশে থাকে বেদনার লাভা
বিস্ফোরন বুকে নিয়ে আমিও তেমনি আছি।
আমাকে নিকটে রাখো, বুকে রাখো শীতার্ত স্বদেশ—
প্রয়োজন ছাড়া আমি জ্বলি না কখনো।

০৪.০৯.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

অপরূপ ধংশ

একটি পাতার পতনেই যদি
শুভ সুষমায় শুভ্র
একটি ফুলের ফুটে ওঠা হয় সুস্থ,
আমি তবে পাতা ঝরালাম ঝরা বাসনায়।

একটি রাতের মৃত্যুতে যদি
আঁধারের এই রাজ্যে
ফিরে আসে রোদ. বিশ্বাস. শুভ-সূর্য,
আমি তবে সেই শেষ রাত্রির বরাভয়।

প্রাপ্য না হয় হবে না কিছুই
রবে না বিজয় মাল্য
গহন দহন জড়িয়ে থাকবে মর্মে,
আমি তবু এই চির-না-পাওয়ায় উজ্জ্বল।

একটি-আমার ধংশেও যদি
অমলিন অনবদ্য
একটি-তোমার বেঁচে থাকা হয় সত্য,
আমি তবে হবো সেই ধংশেই অপরূপ।

০৪.০১.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

সভ্যতার সরঞ্জাম

রক্তে আগুন তোর, তুই এতো নমনীয় হোলি
চন্দনে সিক্ত কপাল হোলি তুই বিনম্র মাধবী!
প্রাচীন পিঁচুটি চোখে তোর এতো দীর্ঘ হলো ঘুম
তুই কোনো রাত্রি দেখলি না, কোনো সকালের সূর্য দেখলি না।

রক্তে তোর হত্যার উৎসব
তবু তুই পৃথিবীর যে কোনো রক্তপাতে এতো বেশি কাতর হোলি
প্রমানিত কয়েদির মতো হোলি এতো অসহায়, এতো নতমুখী তরু!
ভেতরে এতো বিক্ষোভ, তবু তুই বিক্ষুব্ধ হোলি কৈ!

রৌদ্রে ফাটা মাটি তোকে ঢেকে নিলো গভীর তুষার,
সুঠাম ইটের মতো দহনের ক্ষতচিহ্ন দেহে নিয়ে তোর মাটি
সভ্যতার সরঞ্জাম হলো—

দাহ তোকে টেনে নিলো
অপরূপ মধ্যরাতে ছিঁড়ে পড়া আকাশের সেই সব তারা
সেই সব বৃন্তচ্যুত তরুন নক্ষত্রের ব্যথা তোকে কী ভীষন
টেনে নিলো বুকে।

তুই কতো শিশু ছিলি এতোকাল অবাধ্য বালক
আদিম পিতার চে’ও তুই ছিলি বেশি নগ্ন তনু
ছিলি খুব অনাবৃত অপরূপ স্বভাবে বিশ্বাসে,
তবু তুই আবরিত হোলি শেষে ঘোলাটে তুষারে, হোলি তুই
বাধ্য বিনয়ী বকুল।
রক্তে প্রেম তোর, তবু তুই হোলি এতো বেশি নিসঙ্গ মানুষ!

১৭.০৯.৭৬ সাহেবের মাঠ মোংলা

অবরোধ চারিদিকে

কোথায় পালিয়ে যাবে তুমি!
অনুশোচনার কালো এক কুকুর তোমায়
সারাক্ষন তাড়িয়ে ফিরবে।

সৌখিন শিখরে চ’ড়ে তুমি দেখছো মাটি
মলিন ধুলোর উপর শুয়ে থাকা ঘাস,
তুমি ইচ্ছের ঠোঁটে রঙিন সিগারেট গুঁজে বোসে আছো
অর্থহীন কোমল কাৰ্পাশে।

অজান্তেই নেমে যাবে শিখর পাহাড়ের ধসে,
তুমি আহত নীলকণ্ঠ পাখির পালকে খুঁজবে স্মৃতি—
কিছুই পাবে না। তোমাকে তাড়িয়ে ফিরবে এক
কালো কুকুর— অনুশোচনা।
তুমি কোথায় পালিয়ে যাবে?

যে-হাতে ফুল ছুঁয়েছিলে তুমি সে-হাতেই
ছুঁয়েছো পাপের পাখা, রাত্রির নির্মোক।
ফুলের কাছে একদিন তোমাকে আসতেই হবে
যন্ত্রনায় পূর্ন কোরে চোখের সকেট
নতজানু ক্ষমাপ্রার্থীর মতো

তুমি কোথায় পালিয়ে যাবে?
সারাক্ষন ছায়ার মতো সাথে সাথে ঘুরবে ঘাতক,
অনুশোচনার কালো এক কুকুর
তোমায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে ফিরবে—
তুমি কোথায় পালিয়ে যাবে!

১১.০২.৭৫ লালবাগ ঢাকা

প্রথম পথিক

বলো এই হাত কতোটুকু হিংস্র-সুঠাম হবে!
এই মাধবীলতার মতো নমনীয় আঙুলগুলো
এই চোখ, এ-চিবুক কতোখানি সর্বগ্রাসী হবে
বলো আমি কতোটুকু মানুষ হবো, কতোটুকু পশু!

হাড়ের ভেতরে আছে এক লুকোনো অনাহার
আছে ঋন— আছে গত মানুষের অসহায় পচন।
জীবিত খুলির মধ্যে বিক্ষোভে ন’ড়ে ওঠে এক লাখ তীব্র করতল
এক লাখ পুষ্টিহীন শিশুর ক্ষয়মান দেহ।
কালো ফুল, কালো হৃদপিন্ডের শেষতম খেয়া বলো, বলো আমি
কতোখানি বিক্ষোভ হবো, কতোখানি রক্ত হবো?

নিসর্গে নতজানু মন তবুতো তরুতল দেখে
শৈশবে শীতের ঝরাপাতাদের লাশ কুড়োনোর দিনে
ফিরে ফিরে খুলে দেয় বুকের দরোজাখানা,
হিরন্ময় রুটি— ভাত— বিক্ষোভ— বিশ্বাস বলো
আমি কতোজন শ্রমিক হবো, কতোজন দুর্বিনীত ঘাতক!
বলো আমি কতোখানি প্রেম হবো, কতোখানি বিনিদ্র রাত
সাপের দাঁতের মতো কতোটুকু বিষাক্ত হবো স্বভাবে শরীরে,
বলো, বলো আমি কতোখানি হিংস্র পাশবিক হবো, কতোখানি
নিসঙ্গ ঈশ্বর!

২০.০৭.৭৬ নীলক্ষেত ঢাকা

ফসলের কাফন

ভরা ফসলের মাঠে যদি মৃত্যু হয়
ভরা জোয়ারের জলে যদি মৃত্যু হয়,
আমার স্বপ্নের দায়ভার আমি তবে তোমাকেই দেবো।

মুছবো না দেহ থেকে মাছের ঘ্রানের মতো ভেজা ঘাম,
বসন্ত আসার আগে এই মৃত্যু, তবু তাকে বলবো না অসময়
যদি দেখি আমাদের অমিত সন্তান তারা লাঙল নিয়েছে হাতে
চাষাবাদে নেমে গেছে অনাবাদি বেদনার কঠিন মাটিতে সব।

ভরা ফসলের মাঠে যদি মৃত্যু হয় তবু দুঃখ নেই—
সূর্য ওঠার আগেই যদি মৃত্যু হয় তবু কোনো দুঃখ নেই,
জেনে যাবো, ভোর হবে— আমাদের সন্তানেরা পাবে মুগ্ধ আলো,
শীতার্ত আঁধারে আর পুষ্টিহীন শিশুদের কান্নার বিষাদ
কোনোদিন শুনবে না কেউ।
জেনে যাবো ঋনমুক্ত, আমাদের কাংখিত পৃথিবী এলো।

ভরা শস্যের প্রান্তরে যদি মৃত্যু হয় তবে আর দুঃখ কিসে!
জেনে যাবো শেষ হলো বেদনার দিন— ফসল ফলেছে মাঠে,
আমাদের রক্তে শ্রমে পুষ্ট হয়েছে ওই শস্যের প্রতিটি সবুজ কনা।

০৩.০৯.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

অনন্ত স্বভাব

একদিন নারী-প্রেম ডেকেছে আমাকে,
আমি খুব সাড়াহীন নিশব্দে ছিলাম
আমি যাইনি।

নিসঙ্গ বসন্তে আমার
বন্ধ দরোজায় করাঘাত করেছিলে তুমি প্ৰেম
আমি দোর খুলিনি— আমি যাইনি।

উন্মুল বাসনাবিদ্ধ রক্তাক্ত যৌবন
আমাকেও ডেকেছিলো অভিসারে
আমি যাইনি।

নদীদের রোমন্থনে ভাষা আছে
ঢেউয়ের মুকুটে জীবনের প্রতিবিম্ব
এ-কথাও বলেছিলে একদিন-
তবু আমি যাইনি নদীর কাছে,
সাগর আমাকে ডেকেছিলো
আমি যাইনি।

সৌন্দর্য আমাকে ডেকেছিলো
প্রাচুর্য আমাকে ডেকেছিলো
আমি যাইনি—

তুমি আমাকে ডাকোনি কখনো
আমি শুধু তোমারই কাছে যাবো।

০৪.০৫.৭৪ লালবাগ ঢাকা

প্রত্যাশার প্রতিশ্রুতি

হাত ধরো
আমি হিংসার পৃথিবীতে এনে দেবো সুগভীর প্রেম
কবিতার অহিংস স্বভাব।
হাত ধরো, হাত ধরো— আমি তোমাদের আরাধ্য ভুবনে
এনে দেবো ব্যতিক্রম অভিধান,
তোমাদের তমসা-সকালে আমি পৌঁছে দেবো
সমস্যাহীন এক সূর্যময় রোদ্দুর।

গভীর নিকটে বোসে আমি উষ্ণ করতলে
অনর্গল ছড়াচ্ছি আগুনের পুষ্টিকর ওষুধ।
রাতের দরোজা খুলে রাস্তায় বেরোলেই
সে-রোগনাশক এসে ধুয়ে দেবে জটিল স্বভাব।

হাত ধরো, আমি একটি সঠিক নিশ্চয়তা
এনে দেবো সন্ত্রাসের দৈনন্দিন উঠোনে।

হাত ধরো— আমি সমস্ত হতাশাকে
মন্ত্রবলে নিমেষে মুছে দেবো এক সৌম যাদুকর,
ভরাট অঘ্রান এসে চেতনায় গৃহস্থালিতে
ছড়াবে আশংকাহীন স্বপ্নের ঘ্রান—

দিঘল রাত্রি কারো শরীরে দেবে না মৃত্যুর ছোঁয়া
চোখের সকেটে কারো স্বপ্নভুক মাছি ফেলবে না শ্বাস।
হাত ধরো, আমি বেদনার দীর্ঘ রজনী থেকে
অনিদ্রা তুলে নিয়ে এনে দেবো নিশ্চিন্ত ঘুম।

হাত ধরো, হাত ধরো—
আমি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিবর্তে
এনে দেবো তৃতীয় পৃথিবীর শ্রেনীহীন কবিতার ভুবন।

০৫.০২.৭৫ লালবাগ ঢাকা

জানালায় জেগে আছি

জেগে আছি, তুমি ভুল বুঝো না—
এতো নিরবে এতো নিশব্দে খুলেছি নিদ্রার রেনু
স্পর্শকাতর বাতাসেরও কাঁপেনি শিথিল কুন্তল।
জেগে আছি— তুমি নিদ্রা ভেবে ভুল কোরো না।

চোখের কার্নিশে জমেছে অযত্ন অবহেলা,
উদাসি উর্ননাভ
কখন বুনে গেছে সংসার নিজের চতুর্পাশে জানি না,
আসাতে বিভোর ছিলাম তার চ’লে যাওয়া মনে নেই…

এতোটা বিভোরতা ছিলো, এতোটা পাওয়ার পুলক
এতোখানি বসবাস ছিলো তার আমার গভীরে!
কোনো কথাহীন নিশব্দে এসে করতলপটে লিখেছিলো
একখানি কথা— আমি।

একখানি কথার ভেতরে এতো কথা ছিলো, এতো মোহ ছিলো
একখানি বাঁকা চাঁদে ছিলো এতোটা স্নিগ্ধ পূর্নিমা!

জেগে আছি, জেগে আছি— যতো দূরে যাও
জেনো রাত্রির ঘরে আমারো একখানা জানালা আছে,
চৈত্রের সব পাখি— সব ফুল— সব প্রতীক্ষারৱা
এই নিশব্দ জানালার কাছে নত হয়ে আসে
অঙ্গের সুষমা খুলে যায় সৌরভরাশি।

এতোটা নিশব্দে জেগে থাকা যায় না, তবু জেগে আছি…
আরো কতো শব্দহীন হাঁটবে তুমি, আরো কতো নিভৃত চরনে
আমি কি কিছুই শুনবো না— আমি কি কিছুই জানবো না!

১৯.০৩.৭৬ মিঠেখালি মোংলা

অশোভন তনু

তবে কি শরীরে কোনো অন্যায় ছিলো
অন্তসত্ত্বার লজ্জার মতো ফুটে ওঠা স্ফীত উদর
কোনো পোশাক যাকে ঢাকতে পারেনি!
জন্মের পূর্বাভাসে বেড়ে ওঠা সেই অশোভন সত্য
কোথাও কি মাখা ছিলো অবয়বে, দেহে!

তবে কি শরীরে ছিলো কোনো উদ্ধত অশোভন
কোনো অপঘাত, প্রত্যাখ্যানে পুষ্ট কোনো মৃত্যুর স্মৃতি
তাজা কিছু ধংশের ক্ষতচিহ্ন
কোনো প্রসাধন যাকে আগলে রাখতে পারেনি!
অন্তরাল ছিন্ন কোরে জেগে ওঠা সেই ভয়ানক ক্ষতি
কোথাও কি পষ্ট হয়ে উঠেছিলো ললাটে, মুখে?

গৃহ ডাকে না—
মানুষ গুটিয়ে নেয় তার সবগুলো ডাকার হাত।
শিকড় বিশ্বাসী মানুষ এতোটা তরু-ঘাতক হতে পারে
এতোটা হিংস্র হাত ছিঁড়ে নিতে পারে মমতার সকল লতা!
মানুষ কি পাখি, পাখায় লেখা এক যাযাবর পথ?

সংসার রচনায় তবে ফুলের এতো উপেক্ষা কেন
এ-বুকে আগুন দেখে মানুষের এতো ভয় কেন!
তবে কি তনুতে আমার কোনো ধংশের ক্ষতচিহ্ন ছিলো?
তবে কি চোখে মুখে আমার ভিন্ন কোনো পূর্বাভাস ছিলো?

০৭.০৪.৭৬ মিঠেখালি মোংলা

শ্যামলিম নির্বাসন

এ-আমার নির্বাসনে থাকা
না-যুদ্ধ না-প্রেম তবু এ-আমার সবচেয়ে বেশি কোলাহল।

এখানে আমার মাঠ শ্যামলিম তূনের তুষারে আঁকা,
স্বাধীন মানচিত্রের পাশে শুনে উদাসিন আকাশের গান
নিসঙ্গ-গহন জলে সারাদিন ছিন্নমূল নিজেকে ভাসাই—
না-যুদ্ধ না-প্রেম তবু এ-আমার সবচেয়ে বেশি মুখরতা।

এ-আমার রথ ছেড়ে অন্তর্গত পথে নেমে আসা,
যে-পথে ধুলোর নাম ভালোবাসা. মাটির পরাগ
বাতাসের অন্য নাম পাখি,
যে-পথের সারাপথে আলোর পালক খুলে ফেলে গেছে রোদ
এ-আমার রথ ছেড়ে সেই পথে নেমে আসা, সেই নির্বাসনে…
না-যুদ্ধ না-প্রেম তবু এ-আমার সবচেয়ে অধিক ভ্রমন।

পৃথিবীর শুরু থেকে সহবাস শিখেছে মানুষ।
আমি তবু স্বভাবে সংসারহীন— এ-আমার প্রিয় নির্বাসন,
এ-আমার তৃষ্ণার মৌনতা ছুঁয়ে জেগে থাকা নিবিড় পৃথিবী
শব্দের ভেতরে থেকে শব্দহীন কলরবে বিচিত্র নির্মান।

নিরবতা-মুগ্ধতনু সারাদিন ছিন্নমূল নিজেকে ভাসায়
না-যুদ্ধ না-প্রেম তবু এই আমি সবচেয়ে বেশি নিমগন।

১৯.০৯.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

গোপন ইঁদুর

এক ইঁদুর আসে রাতে আমার ঘরে,
চিকোন দাঁতে কাটে দেয়াল মেঝে
কাটে সকল প্রয়োজনীয় জিনিশপাতি কাটে,
এক ইঁদুর আসে ঘরে।

তার ছয়টি দাঁতে কাটে মাথার স্নায়ু,
বুকে আমার নোখের কটু ঘায়ে
ছেঁড়ে রুপোল স্বপ্ন, শুভ স্মৃতির বসবাস
তার বিষের নোখে দাঁতে।

এক সুশ্রী তনু ইঁদুর আসে দেহে
টের পাই না কোনো কিছুই তার,
দেহে আমার সিঁদ কেটে যায় গোপনে সেই চোর
তার টের পাই না কিছু।

এই ইঁদুর-কাটা দেহের বাড়ি ঘর,
বাইরে থেকে যায় না বোঝা কিছু
ভেতরে সেই ইঁদুর বোসে ছয়টি দাঁতে কাটে
হায়, বোধি আমার মেধা!

সেই সুশ্রী তনু ইঁদুর এসে দেহে
কাটে জীবন— স্বপ্ন— শুভ-তরু,
বাইরে থেকে যায় না বোঝা, মৃত্যু বাড়ে ঘরে
হায়, টের পাই না কিছু!

৩১.০১.৭৭ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

বিষবৃক্ষ ভালোবাসা

তোমার না-থাকা ভালোবেসে কিছু ভুলকে বেঁধেছি বক্ষে,
কিছু বলো নাই— ভুল বৃক্ষকে অবাধে দিয়েছো বাড়তে।

তুমি কি জানতে
ওই তরু নয় স্বাস্থ্যোপযোগী, ওতো সেই বিষবৃক্ষ।
তুমি কি জানতে ওই ভুল-বোধ কতোখানি ক্ষতি নষ্ট!
তাহলে আমার ভুল-নির্মান করোনি তা কেন ধংশ?

এটুকু জীবনে এই অপচয়, ভুল পথে এই যাত্রা—
মিছে কষ্টকে ভালোবেসে এই আত্মহনন যজ্ঞে
কেন জল ঢেলে নেভাওনি এর হোমানল-বিষ-অগ্নি?

পাওয়াকে যদি পেয়ে যাই তবে না-পাওয়াই হয় সত্য,
গুটিকয় হাতে পাওয়ার নীড়টি থাকে ক্রীতদাস-বন্দি—
আমার প্রাপ্য ওই ধোঁয়া-জালে চিরদিন হলো ভ্রষ্ট।

তুমি বলো নাই এই ত্যাগ হবে কারো স্বার্থের টেক্কা
সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে একজন রবে ব্যর্থ
তুমি বলো নাই— তুমি বলো নাই অমোঘ নিয়তি মিথ্যে।

পেতে চাই গ্রাস অঞ্জলি ভ’রে যা-কিছু আমার প্রাপ্য,
তোমার থাকাকে বুক ভ’রে চাই, না-থাকা কিছুকে চাই না।

০১.০৯.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

ধাবমান ট্রেনের গল্প

তখন সন্ধার পর আমাদের সব কথা বলা হয়ে গেছে।
মুখোমুখি বোসে থাকা কথাহীন ক্লান্ত চোখ, নোখ খুঁটে খুঁটে
যে যার স্মৃতির কাছে ফিরে এসে হয়েছি নিরব কোলাহল—
সব কথা বলা হয়ে গেছে।

তখন স্তব্ধতা জুড়ে শুধু মেঘ— শুধু ঘাম— শুধু যন্ত্রের চিৎকার
স্মৃতি আর আকাংখার সব গল্প বলা হয়ে গেছে।
জীবনের কথাগুলো এরকম মুহূর্তে ফুরায়
স্পর্শ করার আগেই ভালোবাসা গৃহ ছেড়ে এভাবে পালায় দূরে।

ধাবমান ট্রেন তার ছুটে চলা ধাতব জীবন,
আমাদের সবুজ কম্পার্টমেন্টে তবু শব্দহীনতা— মৃত্যুর মতো—
যেন ফসল উঠে যাওয়া নিস্ব ক্ষেত— ভেঙেচুরে প’ড়ে আছে
তার মাঝে শীতের বিষণ্ন রোদ, নিরুত্তাপ— অসুখে মোড়ানো।

আমাদের সব গল্প, সব কথা, সব স্মৃতি বলা হয়ে গেছে,
টের পেয়ে আকাশের দেহ থেকে ঝ’রে পড়ে সন্ধার তমসা
আমাদের নিশব্দের ‘পরে, আমাদের জীবনের ‘পরে।

আমরা কি কোনোদিন আর কোনো কথা বলবো না?
এরকম পরস্পর মুখোমুখি বোসে থেকে থেকে
ছুটে চলা সময়ের ট্রেনে কোনোদিন আবার হবো না মুখরিত?
কোনো কথা বলবো না!

আমরা কি কিছুই কবো না আর?
আকাশের দেহ থেকে ঝ’রে পড়ে সন্ধার আঁধার-
এসো কথা বোলে উঠি, আমরা ভালোবাসার কথা বলি,
এই নিশব্দের দেয়াল ভেঙে এসো আজ স্বপ্নের কথা বলি।

আমাদের প্রিয় কথাগুলো, গল্পগুলো, প্রিয় স্বপ্নগুলো
সেই শৈশবের মতো কতোদিন প্রান খুলে বলিনি কোথাও!
আহা, কতোদিন আমরা আমাদের ভালোবাসার কথা বলিনি!

২৫.০৯.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

বিশ্বাসী বৃক্ষের ছায়া

ওই তরুতলে বিশ্বাসী ছায়া, ওই ছায়াটুকু অনুকূল,
রোদে পোড়া মন চায় গৃহ-ছায়া, চায় নির্জন বসবাস-
অবরোধ খোলো, ওই ছায়াতলে যাই।

সারা প্রান্তরে ঘামের গন্ধে বাতাস যখন ম্রিয়মান
যখন শরীরে ক্লান্তির গানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অবসাদ,
তখন তোমার গৃহ-ছায়াখানি খোলো।

গৃহ-ছায়া তলে যে-বৃক্ষতল, যে-তরুর ছায়া অপরূপ
ফিরে এলে তুমি সেই ছায়াটুকু খুলে দিও দিন অবসানে।

বেদনাকে চিনি, রোদ্দুর চিনি তৃষ্ণা. তুমুল বিষফল,
দুর্যোগ-দিনে দেখেছি পীড়িত অসহায় একা গাঙচিল-
দুটো চোখ তার নিরাপদ নীড় খোঁজে কি ভীষন তৃষ্ণায়।

গৃহখানি দাও, রোদে পোড়া মন চায় নির্জন অধিবাস…

ওই তরুতলে বিশ্বাসী ছায়া, ওই গৃহ-ছায়া অবিনাশ,
শরীর এখন ক্লান্তির কাছে নুয়ে আসে ঘোর অবসাদে—
অবরোধ খোলো, আমাকে তোমার ওই ছায়াটুকু দাও।

১১.০৯.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

ফুলের কৃষ্ণপক্ষ

আমি যার হাতে ফুল তুলে দিই
সে-ই প্রথম ভুল বোঝে আমাকে।

আমি যাকে বিশ্বাসযোগ্য ভেবে
মনে-মনে এক নির্জন স্বপ্নকে স্বাস্থ্যবান কোরে তুলি,
আমার বিশ্বাস নিয়ে সুবর্ন চোর
শুধু সে-ই পালিয়ে যায়।

আমি যাকে ফুল দিই সে-ই ভুল বোঝে,
চিরদিন এরকম বিপরীত হয়।

আমি যার শিয়রে রোদ্দুর এনে দেবো বোলে
কথা দিয়েছিলাম
সে আঁধার ভালোবেসে রাত্রি হয়েছে।
এখন তার কৃষ্ণপক্ষে ইচ্ছের মেঘ
জোনাকির আলোতে স্নান করে,
অথচ আমি তাকে তাজা রোদ্দুর দিতে চেয়েছিলাম।

বয়সে মাথা রেখে জেগে আছে একজন
তাকে তো দিইনি কিছুই
অথবা যে ফুলের মৌলিক অর্থ কখনো শেখেনি–
ভালোবেসে রাত্রি জাগরন,
চোখের নিচে অনিদ্রার শোকচিহ্ন রাখেনি সাজিয়ে….

আমি যার হাতে ফুল তুলে দিই
সে-ই প্রথম ভুল বোঝে আমাকে।
আমি ভুল বুঝলে কে আমার হাতে তুলে দেবে ফুলের স্বপ্ন?

২৬.০১.৭৫ লালবাগ ঢাকা

অনিদ্রার শোকচিহ্ন

বুকের ভেতরে এই ঝড় তুমি জানবে না,
নিরুপায় ধংশের মাঝে কেন এই স্বেচ্ছাদহনে
অনায়াসে স্বপ্নের সরল সংসারখানা ভেঙে ফেলি!
তুমি জানবে না, একখন্ড মেঘের জন্যে কী বিশাল মরুভূমি
অভ্যন্তরে তুমুল সাইমুমে বিশটি চৈত্রের নিচে পুড়ে যায়
অক্ষম ক্ষোভে!

এই চোখ দেখে তুমি বুঝবে না, কতোটা ভাঙনের চিহ্ন
জীবনের কতোটা পরাজয় ছুঁয়ে তার বেড়েছে বয়সের মেধা।
অভিমানে কন্ঠ বুঝে আসে, নিরপরাধ বাসনার চোখে
স্বচ্ছ কাচের মতো জ’মে থাকে জল, টলমল— তবু ঝরে না কখনো…

শরীরে ঘামের ঘ্রানে শুধু কেটে যায় বেলা,
ক্লান্তিগুলো খুলে-খুলে আগামীকে বলি :
জননীর অপেক্ষা নিয়ে কতোটুকু রেখেছো আমার
পৌষে নবান্নের মতো কতোটুকু সুস্থির নিশ্চয়তা?

পরাজয় ক্ষত বুকে উবু হয়ে প’ড়ে থাকা রাতের শরীরে
গ্লানির ক্ষরনে ভেসে যায় চাঁদের করুন অবয়ব
তবু তুমি কিছুই জানো না—

এশিয়ার রাত জানে কতোটুকু অনিদ্রার শোক
জীবনের দুইচোখে বেড়ে ওঠে ভয়ানক কঠিন আক্রোশে!

০৯.০৮.৭৬ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

ফাঁসির মঞ্চ থেকে

ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমাদের যাত্রার শুরু।

এক একটি জন্মের সমান মেধাবী মৃত্যু
এক একটি প্রতিজ্ঞা-পুষ্ট মৃত্যুর সোপান
দুর্যোগ-অন্ধকারে তুলে রাখে সূর্যময় হাত—
তুমুল তিমিরে তবু শুরু হয় আমাদের সঠিক সংগ্রাম।

মৃত্যুর মঞ্চ থেকে
মৃত্যুর ভূমি থেকে
আমাদের প্রথম উত্থান।
যাকে তুমি মৃত্যু বলো, যাকে তুমি বলো শেষ সমূল পতন
আমি তার গভীরে লুকোনো বিশ্বাসী বারুদের চোখ দেখে বলি
এইসব মৃত্যু কোনো শেষ নয়, কোনো বিনাশ পতন নয়…

এইসব মৃত্যু থেকে শুরু হয় আমাদের সূর্যময় পথ,
এই ফাঁসির মঞ্চ থেকেই আমাদের যাত্রার শুরু।

১০.০৭.৭৭ নীলক্ষেত ঢাকা

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর

সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখি
যে-রকম আকাশ পৃথিবী দ্যাখে পৃথিবী আকাশ,
একবার অন্ধকারে, একবার আলোর ছায়ায়
একবার কুয়াশা-কাতর চোখে, একবার গোধুলির ক্লান্ত রোদে-
সারারাত স্বপ্ন দেখি— সারাদিন স্বপ্ন দেখি।

একখানি সুদূরের মুখ জ্ব’লে থাকে চেতনার নীলে,
কে যেন বাদক সেই স্বপ্নের ভেতরে তোলে বিষাদের ধ্বনি
আঁকে সেই প্রিয়মুখে— সুদূরের মুখে
বর্নময় রঙিন বিষাদ।

ফিরে আয় বোলে ডাকি— সে বাদক উদাসিন থামে না তবুও…

সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখি—
স্বপ্নের ভেতরে তুমি হে আমার বিষণ্ন সুন্দর
চোখের সমুখে আজ কেন এসে দাঁড়ালে নিঠুর!
কেন ওই রক্তে মাংশে, কেন ওই নশ্বর ত্বকের আবরনে
এসে আজ শুধোলে কুশল?

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর
হৃদয়ের কূল ভেঙে কেন আজ এতো জল ছড়ালো শরীরে
কেন আজ বাতাসে বসন্ত দিন ফিরে এলো কুয়াশার শীতে!

কে সেই বংশীবাদক স্বপ্নের শিয়রে বোসে বাজাতেন বাঁশি
বেদনার ধ্বনি তুলে রাত্রি দিন, সে আজ হারালো কোথায়?

বেদনার রঙ দিয়ে আমি যারে আঁকি
হৃদয়ের রক্ত দিয়ে আমি যারে আঁকি
আমার কষ্ট দিয়ে, আমার স্বপ্ন দিয়ে যে আমার নিভৃত নির্মান
সেই তুমি, হে আমার বিষণ্ন সুন্দর

মর্মমূল ছিঁড়ে এসে ঠাঁই নিলে কেন এই মাংশের বুকে!
কেন ওই বৃক্ষতলে, কেন ওই নদীর নিকটে এসে বোলে গেলে
তোমার ঠিকানা!

আমি তো প্রার্থনাগুলো শস্যের বীজের মতো দিয়েছি ছড়িয়ে,
জল তাকে পুষ্টি দেবে, মাটি তাকে ভূমি দেবে, তুমি তার গভীর ফসল—
বাতাসে তুলোর মতো তুমি তবে উড়ে এলে কেন!

কেন আজ পোড়া তুষের গন্ধে শুধু জন্মের কথা মনে পড়ে!
শৈশব কৈশোর এসে মিশে থাকে ফাল্গুনের তুমুল হাওয়ায়
একটি রাত্রি কেন হয়ে ওঠে এতো দীর্ঘ দীর্ঘ রাত?

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর
দুচোখে ভাঙন নিয়ে কেন এই রুক্ষ দুঃসময়ে এলে
কেন সমস্ত আরতির শেষে আজ এলে শূন্য দুখানি হাত!
কেন এলে, বিষণ্ন সুন্দর, তুমি কেন এলে?

০২.০২.৭৮ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

নক্ষত্রের ধুলো

মারী ও মড়ক নাচে পান্ডুর মানুষের বুকের প্রদেশে,
ধূসর-পালক-রাতে পলাতক সব পাখি— পাখিদের গান—
যেন এই মাঠে আর উৎসব হবে না কোনোদিন— কোনো শীতে
ফসলিম জমি শস্য-পার্বন নিয়ে জোস্নার রাত্রিগুলোকে
ছোঁবে না কখনো আর।

প্রৌঢ় পৃথিবীর নগ্ন খুলিতে পা রেখে এক অঘ্রানি যুবক
করতলে মাটি ছুঁয়ে রক্তে মাংশে পেতে চায় শানিত আগুন,
বন্ধা অন্ধকার তবু মৃত মানুষের মতো ব’য়ে আনে শীত
ব’য়ে আনে কবরের হলুদ কাফনে বাঁধা একরাশ স্মৃতি।

পান্ডুর রমনী দেহে— কালো কৃষকের বুকে
শস্যের সম্পাত নিয়ে একফালি মুগ্ধ চাঁদ
কাস্তের চিৎকারে দুলে তুলে দেবে নাকি কিছু ফেলে আসা শ্রম,
শ্রমের ক্ষমতা।

ক্ষুধার শয্যা পেতে এক মন্বন্তরের ক্ষুধিত শকুন
মননের হাড় থেকে ছিঁড়ে খায় বোধি, প্রেম. সুস্থতার মাংশ,
মানুষ জানে না তবু কতো হাড় করোটির ধুলো জ’মে জ’মে
একটি নক্ষত্রের বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে সেই রাতে—

সেই রাতে সমুদ্রের সফেদ ফেনার মতো একখানা হাত
মৃত্যুর গভীর থেকে তুলে এনেছিলো এক শস্যার্দ্র জন্ম,
সেই রাতে, সেই রাতে— সূর্যহীন জোস্নাহীন সেই অন্ধকারে
আমাদের প্রতিজ্ঞারা মেঘের মুখোশ ছিঁড়ে নক্ষত্রের দিকে
উঠে গিয়েছিলো এক ফেনিল প্রত্যাশায়!

০৫.০৭.৭৬ মিঠেখালি মোংলা

কৃষ্ণপক্ষে ফেরা

অন্ধকারেও চিনে নেবো সঠিক— ভেতরে আগুন আছে।
আত্মঘাতী আগুনের খেলায়
যদিও পুড়েছে বনভূমি, বকুলের কিশোরী নিশ্বাস
প্রিয় অগ্নিকে তবু পুষেছি ঘাতক নির্জন উৎসাহে।

কতোটুকু মোহাচ্ছন্ন হবে পথ
কতোটুকু অন্ধকার হতে পারে আঁধারের তনু!
ঠিকই চিনে নেবো আগুনের অন্য ব্যবহারে,
জীবনে জন্ম ঘ’ষে জ্বালানো আগুন— ঠিকই চিনে নেবো।

দুচোখে মৃত্যু মেখে যতোই অচেনা হও
কথার কৌশলে সাজিয়ে রাখো অপরিচিত অভ্যেস
তবু কতোটুকু অচেনা হবে!
অধরের তীরে কালো তিল নয় বোধের উৎসভূমিতে
শনাক্তকরন চিহ্নের মতো জ্ব’লে আছো অবিনশ্বর কাংখায়
জন্মে জন্মে জ্ব’লে আছো অনল-জাহ্নবী।

চিনে নেবো— আকাশ. নদী. নক্ষত্র. শহর. সংসারে
ধারালো রোদের স্বভাবে কেটে-কেটে সকল অগম্যতা,
দুচোখে আঁধারের শোকচিহ্ন নিয়ে কৃষ্ণকণ্ঠ
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের গোপন অভিসারী সাহস
দরোজায় মৃদু আঙুল ছুঁয়ে ডাক দেবো— এসেছি।

২৩.০৩.৭৬ রামপাল বাগেরহাট

সাহস

প্রয়োজন এসেছে আজ জ্ব’লে ওঠো আর্ত মানুষ,
জ্ব’লে ওঠো বৃক্ষ. গ্রাম. জনপদ. শ্রমিক শহর
অবরুদ্ধ লোকালয়।

হত্যা আর সন্ত্রাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ব্যথিত জীবন,
আজ বড়ো দুঃসময়— ইটের দেয়ালে বন্দি ফুলের চিৎকার
ওই শোনো কাতর কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে নিষিদ্ধ বাতাসে।

কথা বলো, কথা বলো অমিতাভ।
শানিত শোনিতে জ্বেলে প্রতিবাদী আগুনের লাভা
একবার বোলে ওঠো : দুঃশাসন আমি মানি না তোমাকে,
একবার বোলে ওঠো : ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই।

পৃথিবীতে তিন ভাগ জল-
ওদের জানিয়ে দাও— প্লাবনে পাহাড় ধসে, ধ’সে যায় মাটি
শিলার বিপুল মাংশ খ’সে পড়ে দুর্বিনীত জলের আঘাতে।

অমীমাংসিত ক্ষোভ যার মিশে আছে অস্থি শোনিতে
রক্তাক্ত হয়েছে বুক— নতজানু সে-মানুষ হয়নি কখনো ॥

১১.১২.৭৭ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

করাঘাত

অতোটা হৃদয় প্রয়োজন নেই,
কিছুটা শরীর কিছুটা মাংশ. মাধবীও চাই।
এতোটা গ্রহন এতো প্রশংসা প্রয়োজন নেই
কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখ্যান।

সাহস আমাকে প্ররোচনা দেয়
জীবন কিছুটা যাতনা শেখায়,
ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায়
অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই।

বুকে ঘৃনা নিয়ে নীলিমার কথা
অনাহারে ভোগা মানুষের ব্যথা
প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই—
করুনা-কাতর বিনীত বাহুরা ফিরে যাও ঘরে।

নষ্ট যুবক ভ্রষ্ট আঁধারে কাঁদো কিছুদিন
কিছুদিন বিষে দহনে দ্বিধায় নিজেকে পোড়াও
না হলে মাটির মমতা তোমাতে হবে না সুঠাম,
 হলে আঁধার আরো কিছুদিন ভাসাবে তোমাকে।

অতোটা প্রেমের প্রয়োজন নেই
ভাষাহীন মুখ নিরীহ জীবন
প্রয়োজন নেই— প্ৰয়োজন নেই

কিছুটা হিংস্র বিদ্রোহ চাই কিছুটা আঘাত
রক্তে কিছুটা উত্তাপ চাই, উষ্ণতা চাই
চাই কিছু লাল তীব্র আগুন।

২৯.০৭.৭৬ নীলক্ষেত ঢাকা

পৃথিবীর প্রৌঢ় স্তন

স্ত্রীর অবাধ দুধ পান কোরে
একদিন আমিও চেয়েছি হতে শৈশব— শিশুকাল
আমিও চেয়েছি হতে শিশু।

মাথার খুলির ‘পরে, মগজের তলদেশে
সারারাত সারাদিন সাড়ে তিন শত কোটি কাক
ঠোকরায় বিরতিবিহীন,
অভাব— অভাব আসে ঝাঁক-ঝাঁক বুনো শুয়োরের মতো।

কী করুন কাটে রাত— ঘুম নেই চিন্তার চোখে,
সরল শিশুর মতো খুলে ফেলি শরীরের
যাবতীয় সভ্যতাগুলো,
নত হই—
স্ত্রীর স্তন্যে রাখি ঠোঁট আদিম মানুষ আমি এই বিংশ শতকে।

একটি মানুষ পারে কতোটুকু সরাতে অভাব!
সে আরো অভাব খুঁড়ে টেনে তোলে অনন্ত শূন্যতা,
অনন্ত হাহাকার আরো বেড়ে ওঠে তার বাইরে ভেতরে।
ঘুম নেই জীবনের চোখে—
শত শত উলঙ্গ মানুষ ছুটে এসে শিশুর মতো
মাঝরাতে কামড়ায় পৃথিবীর প্রৌঢ় স্তন
নিরুপায় ব্যর্থ ক্রোধে।

১৫.০১.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

ক্লান্ত ইতিহাস

যে-পথে ফিরেছে সব, সেই পথে আমার হবে না ফেরা,
ভাঙনের রুগ্ন গান শুনতে শুনতে, বৃষ্টিতে আমুন্ডু ভিজে
বেহুলার ভাঙা ভেলা ফিরে যাবে জন্মের বিশ্বাসে!

সাথে আমি কি কি নেবো?
বিলাসী নগর থেকে তীক্ষ্ণ রমনীর প্রেম
মদ. মাংশ. কৃত্রিম হাসির ঠোঁট. শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভালোবাসা?
আমি কি কি নেবো!
ইটের নিসর্গ থেকে জংধরা মানুষের শব. কালো টাকা
জালিয়াতি, আলুর গুদাম. আর এই ন-পুংশক রাজনীতি?

সেলফে বন্দি রবীন্দ্রনাথ, ড্রয়িংরুমে ঝুলে থাকা ধানশীষ
আহা বাংলাদেশ তুমি ঝুলে আছো— আমার সোনার বাংলা…
কতিপয় হিজড়া-পন্ডিত আর মূর্খ নেতাদের ডিনার টেবিলে
মুখ থুবড়ে প’ড়ে আছে বিষন্ন বাংলাদেশ উচ্ছিষ্ট হাড়ের মতো।

আমি জানি এই ঋন আমাকেই শোধ দিতে হবে,
এই ধংশস্তুপ কাঁধে নিয়ে আমাকেই যেতে হবে সহস্র মাইল।

ফিরে যাবো।
যে-পথে সবাই ফেরে, হাসি খুশি মুখে গান. প্রিয়জন সাথে
সেই পথে আমার হবে না ফেরা, সেই পথ আমার হবে না-
রক্ত. ঘাম আর ধংশস্তুপ কাঁধে নিয়ে আমাকে ফিরতে হবে

ট্রেনের জানালা দিয়ে ধানক্ষেত দেখতে দেখতে আমার ফেরা হবে না।
চেঞ্জারে ভাটিয়ালি, লালন শুনতে শুনতে আমার ফেরা হবে না,
বুক ভরা ভালোবাসা মৌন মুগ্ধ গান আমার হবে না ফেরা—

আমাকে ফিরতে হবে ঘাম. রক্ত আর সময়ের ধংশস্তুপ কাঁধে
শেষতম সৈনিকের মতো একা একা ক্লান্ত ইতিহাস।

০৪.১১.৭৭ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

বিশ্বাসের হাতিয়ার

নষ্ট সময়— নষ্ট প্রহর
নষ্ট শশার পচনের মতো গলিত জীবন।
মাজরা পোকায় খেয়ে যাওয়া ধান তরুন শস্য
নমস্য কিছু প্রবীন পথিক
আজো বোসে আছে পচা পুরাতন বটের শিকড়ে।

মৌশুম যায়— অনাবাদি জমি প’ড়ে থাকে চাষহীন,
লাঙল আসে না, আসে নর্তকী খেমটা নাচনে ধেয়ে।
ধেনোমদ চায় বিদেশি বনিক, ধান চায় স্বদেশিরা—

শিরা উপশিরা ধমনী-রক্তে কারা বুনে যায় রোগ
কারা লালনের বাউল কন্ঠে সোনালি শিকল বাঁধে?
কারা সেই প্রতারক!
কারা এ-মাটির পুষ্পকে বলে পাপ?

কোটি কোটি বুক এক বুকে মিশে আছে,
জয়ন্তিয়ায়— খাশিয়া পাহাড়ে— পদ্মার ভাঙা পাড়ে
হাজার বছর যে-মানুষ শুধু লড়েছে কঠিন প্ৰানে
যে-মানুষ হাড়ে লবনের ঘ্রান, বুকে সমুদ্র-ঝড়
রোদ্দুরে পোড়া চামড়ায় যারা মেখেছে পলির কাদা,
আজ তারা আসে গর্জনে ঘন বর্ষনে, কাঁপে মাটি।

বাজ-পোড়া তরু ঘরের দুয়োরে,
কুকুরে শকুনে টেনে ছিঁড়ে খায় মায়ের শরীর এই জনপদে,
ঠেকাতে পারি না— কণ্ঠে বাহুতে ঝুলে আছে তালা রাজার এনাম।

আমার পরান প্রিয় এই চর, এই শস্যের মাটি,
ওরা চায় তাকে মরুভূমি আর শ্মশান বানাতে,
তমাল শিরীষ কেটে তাই ওরা বুনেছে খোরমা তরু
এই পলিমাটি চরে।

কোটি কোটি বুক এক বুকে আছে মিশে,
অস্থিতে মাখা তিতুমীর আর সূর্যসেনের লোহু,
অশোকের ঘন ছায়ার মতোন মায়ের প্রেরনা বুকে
কারে তোর এতো ডর?
কার ডরে তোর পাথর-কঠিন সিনা হয়ে আছে নত?

গেরামের পর গেরাম উঠছে জেগে
শস্যের মাঠে লাঙলের কোলাহল,
খুনীর অঙনে বাজে প্রতিশোধ-মত্ত মাদল
জাগে সমতার পূর্ব লড়াই, পূর্বাভাসের বাঁশি।

কোথায় পালাবে?
মানুষ চিনেছে মুখোশের মুখ, মানুষ চিনেছে শত্ৰু,
হাতে হাতিয়ার বুকে বিশ্বাস ওই দ্যাখো ওরা আসছে।

২৬.০২.৭৭ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

নিশব্দ থামাও

থামাও, থামাও এই মর্মঘাতী করুন বিনাশ,
এই ঘোর অপচয় রোধ করো হত্যার প্লাবন।

লোকালয়ে ভোর আসে তবু সব পাখিরা নিখোঁজ—
শস্যের প্রান্তর খুলে ডাকি আয়, আয় প্রিয় পাখি,
একবার ডেকে ওঠ মুখরতা, মৃত্যুর সকালে
বাজুক উজ্জ্বল গান— জনপদ নিসর্গ জানুক
এখনো পাখিরা আছে, গান আছে জীবনের ভোরে।

থামাও মৃত্যুর এই অপচয়, অসহ্য প্রহর।
স্বস্তির অস্থিতে জ্বলে মহামারী. বিষণ্ন অসুখ,
থামাও, থামাও এই জংধরা হৃদয়ের ক্ষতি।

ইটের দেয়াল ভেঙে যে-ভাষার সদর্প উত্থান
যে-ভাষার নিত্য জন্ম মানুষের জ্বলন্ত শিখায়,
আজ কেন সে-ভাষার কলরব শুনি না জীবনে?

কারা তবে সুখি হয়, নীলিমায় ওড়ায় ফানুস!
কারা এই দুঃসময়ে চ’ড়ে ফেরে অলীক জাহাজ?

ঘর ভরা মৃত্যুহিম, লোকালয় ভয়ার্ত শ্মশান।
গান নেই, পাখি নেই, শব্দ নেই— নিশব্দ থামাও
এ ভীষন বেদনার রক্তচোখ, ডাকাত নৈশব্দ…

মৃত্যুকে থামাও, বলো, আয় পাখি, আয় মুখরতা,
একবার ডেকে ওঠ এই কালো নির্মম সকালে।
লোকালয়ে গান হোক— জনপদ, নিসর্গ জানুক
এখনো পাখিরা আছে, গান আছে জীবনের ভোরে।

০৩.০৯.৭৭ মিঠেখালি মোংলা

বেলা যায় বোধিদ্রুমে

এখনো কি হয়নি সময়, বোধিদ্রুম
এখনো কি আসেনি প্রত্যর্পনের রাত!

ছায়াতলে বোসে আছি দীর্ঘ সময়
দ্রাক্ষাহীন লতার নিবিড় আস্তিনের ভেতর,
সমুখে সময়ের বাঁকা জল সবল শারীরিক
বেহুলা বেহুলা ভেলায় বিশ্বাস নিরাকার ভাসে—

দ্রাক্ষাহীন জেগে আছি মৃত্তিকার হলুদ শিকড়ে
বোধিদ্রুম, এখনো কি হয়নি সময়!

জোস্নায় দাঁড়ায় কালো বিরোধী ঘাতক
হননের রুক্ষ বসন মাথা তার তন্ত্রে তনুতে,
মৃগহীন, দ্রাক্ষাহীন আমি জাগি সাবুজিক কোলাহলে
বোধিদ্রুম, এখনো কি আসেনি সময়!

লক্ষী লক্ষীমন্ত ফসল তুলেছে ঘরে
তাই সারারাত তার নহলি ঘ্রানের পরমানু
খুঁটে খুঁটে ওরা সাজিয়েছে ইচ্ছের রুপোলি থালায়।

আমি ভিন্ন ফসলের চাষ বুনেছি তরুতে,
পুষ্পে মুকুলে দেখে সম্ভাবনার পাঁচটি গভীর রেনু
বিশ্বাস নিরাকার ভাসিয়েছি বেহুলা বেহুলা ভেলা…

বেলা যায় দ্রাক্ষাহীন, বেলা যায় অতন্দ্রায়
বোধিদ্রুম, এখনো কি হয়নি সঠিক সময়
এখনো কি আসেনি প্রত্যর্পনের রাত!

০৬.০৯.৭৫ লালবাগ ঢাকা

Leave a Reply to মোঃ সাইফুল ইসলাম রনি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *