রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

২৫. বিশ্লেষণের শেষ

বিশ্লেষণের শেষ

দুপুরের দিকে খাওয়া দাওয়ার পর সকলে এসে কিরীটীর ড্রইং রুমে একত্রিত হলো।

একটা সিগারেট ধরিয়ে কিরীটী বলতে লাগল :

হ্যাঁ, তারপর রাজু ভিক্ষুককে অনুসরণ করে বরাবর এসে পাথুরেঘাটার এক আড্ডায় উঠলো। পথিমধ্যে ভিক্ষুক এক জায়গায় সেই কাপড়ের খুঁটি থেকে খানিকটা কাপড় ছিঁড়ে জমার নীচে গুজে রেখেছিল। তাতে রাজুর সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়।

পাথুরেঘাটার আড়ায় দরজার আড়াল থেকে সবই রাজু কান পেতে শুনল। এবং শুনে মনে মনে এক মতলব এটে দাঁড়িয়ে রইল।

লোকগুলি যখন বের হলো, সে কথাবার্তায় সহজেই দলের মধ্যে সোনাকে চিনে নিল। তারপর বরাবর নিজের পুরানো আড়ায় গিয়ে অনেকটা সোনার মতই দেখতে একজনকে সোনা সাজিয়ে এনে গভীর রাত্রে সর্দারের ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত সর্দারের ট্যাক থেকে কাগজটা চুরি করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিল।

চিঠি–

সেই চিঠি পেয়েই তো আমার মুখ সেইদিন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু চিঠিতে কি ছিল—

ছিল দুটো কথা। প্রথমতঃ—ষড়যন্ত্র টের পাওয়া গেল এবং দ্বিতীয় মৃগাঙ্কমোহনই যে দোষী, তাও একেবারে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল হাতে লেখা দেখে সেই চিঠি থেকেই। এই সেই চিঠি, দেখ।

বলতে বলতে কিরীটী একটা ভাঁজকরা কাগজ টেনে বের করল। কাগজটায় পেন্সিল দিয়ে লেখা : শুক্রবার রাত্রি দেড়টায় সবুজ আলোর নিশানা পাবে। এই চিঠির হাতের লেখা থেকে আরো একটা জিনিস বুঝলাম; লক্ষ্য করে দেখ, তোমরাও হয়ত বুঝতে পারবে, লেখাগুলি কাগজের উপর একটু যেন জোরে জোরে বসেছে. অনেক জায়গায় দুপিঠ কাগজের গা ফুটো হয়ে গেছে।

এর থেকে বুঝতে পারা যায়, যে চিঠি লিখেছে সে কোন কারণে জোরে চাপ দিয়ে লেখে।…তোমরা লক্ষ্য করেছে। কিনা জানিনা মৃগাঙ্কর ডান হাতের প্রথম আঙ্গুলটা নেই। ভেবে দেখা পেন্সিল তাহলে দ্বিতীয় আঙ্গুলোর উপর চেপে লিখতে হবে, যদি লিখতে হয়। তাহলে চিঠিটা যে মৃগাঙ্কর হাতের লেখা সে বিষয়েও কোন সন্দেহ আর থাকে না।

অবিশ্যি আমি বুঝেছিলাম। এ সুযোগ মৃগাঙ্ক ভালভাবেই নেবে। তাই আমি আগে থাকতেই রাজুর সাহায্যে পানুকে অন্য ঘরে শুতে বলি শুক্রবার রাত্রে এবং তার বিছানা পেতে বালিশ দিয়ে মশারি ফেলে রাখতে বলি। আততায়ীরা এসে আলোর নিশানা পেয়ে আঁধারে পানু ভেবে বালিশের উপরেই ছোরা বসিয়ে চলে যায়।

কিন্তু শশাঙ্কমোহনকে সে ঘরে আমরা দেখলাম কেন? শশাঙ্কমোহনের মনেও হয়ত সন্দেহ হয়েছিল; শশাঙ্কমোহন গুপ্ত দ্বারপথে ছেলের খবর নিতে এসে আমাদের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। পরদিন আমার অনুরোধে আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপার খুলে বললেন। ওভার কোটের কথা জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, বোতামটা তারই একটা ওভার কোটের। মৃগাঙ্ক দাদার কোট গায়ে দিয়ে মুখোশ এঁটে করালীর সঙ্গে দেখা করতে যায়, এই ভেবে, যদি ধরাই পড়ে তবে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। আর কোটটা থেকে যদি কোন কিছু ধরা পড়ে তবে সেটাও দাদার ঘাড়েই পড়বে। আমরা যখন ছাদে গেলাম। সেই রাত্ৰে মৃগাঙ্ক তার আগেই গা ঢাকা দিয়েছিল। কিন্তু টর্চের আলোয় একগাদা পোড়া কাপসটেন সিগারেটের টুকরো ছাদে পাওয়া গেল।

মৃগাঙ্ক যে ভীষণ সিগারেট খায়, তা আমি প্রথম দিনই মৃগাঙ্কর হাতে নিকোটিনের দাগ দেখেই বুঝেছিলাম।

এখন সব মিলিয়ে দেখা। ধাঁধার উত্তর মিলে কি না?

১নং বোতাম : ম + অর্থাৎ ‘ম’ র মৃগাঙ্কর পরে সন্দেহ জাগে।

২ নং ছয় বৎসর :–শ + ছয় বৎসরের আগেকার ব্যাপারও শশাঙ্ক জানত। কিন্তু মুগাঙ্ক জানত না।

৩নং চিঠি ও ফটো :–শ + যার দ্বারা মৃগাঙ্ক সব জানতে পারে।

৪নং চিঠি : — শ+ শশাঙ্কর নয় মৃগাঙ্করই লেখা।

৫নং কাঁটা আঙ্গুল :–ম + যার জন্য প্রমাণ চিঠি। মৃগাঙ্করই হাতের লেখা।

৬নং পোড়া সিগারেট :–ম + মৃগাঙ্করই হাতে নিকোটিনের দাগ ছিল। অতএব বোঝা যাচ্ছে করালীকে হত্যা করে মৃগাঙ্কই। ছেলে চুরি করে শশাঙ্ক, মৃগাঙ্ক নয়। করালী ডাঃ মল্লিকার সহায়তায়। যাক, শ্ৰীপুর রহস্যের সমাধান হয়েছে তো।

ক্রিং, ক্রিং টেলিফোন বেজে উঠল, কিরীটী ফোন ধরল, হ্যালো।

হ্যাঁ, আমি কিরীটী। কী বল্লেন, নিমন্ত্রণ? বেশ, বেশ, যাবো নিশ্চয়ই যাবো।

ফোনটা নামিয়ে রেখে কিরীটী ওদের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ওহে আজ রাত্রে শ্ৰীপুরে সকলের নিমন্ত্রণ।

সুব্ৰত চেচিয়ে উঠল-হিপ হিপ হুররে।

হতভাগ্য মৃগাঙ্কমোহন—শেষ পর্যন্ত বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলা লজ্জায় অপমানে পরের দিনই রাত্রে।

 

পানু কিন্তু নতুন এই আবেষ্টনীতে হাঁপিয়ে উঠতে লাগল। যে স্নেহ থেকে সে তার জীবনের প্রথম মুহূর্তেই বঞ্চিত হয়েছিল, আজ সেই স্নেহই যখন অপৰ্যাপ্তভাবে বন্যাস্রোতের মত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে–ও অন্তর থেকে তাকে কোন মতেই যেন গ্ৰহণ করতে পারে না।

‘হরমোহিনী আশ্রমে’ আসবার আগে যে মেহের আস্বাদ সে দুচার বছরের জন্য পেয়েছিল সেটা তার মনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি। কেননা সে বয়সে কোন একটা কিছুকে সহজভাবে একান্ত করে নেওয়া ও আবার একান্ত করে ভুলে যাওয়াটাই হচ্ছে ধর্ম এবং তারপর “হরমোহিনী আশ্রমে’ তার জীবনের যে কাঁটা দিন কেটেছে সেটা সহজ স্মৃর্তির মধ্যে দিয়ে নয়—তাই একদিন রাত্রে অত্যন্ত দুঃসাহসিক ভাবেই সে আশ্রমের গেট ডিঙ্গিয়ে সে চলে এসেছিল—তাকে সে অতি সহজেই ভুলতে পেরেছিল।

তারপর এলো এক নতুন মা-পরমেশবাবুর মেয়ে রমা ওর জীবন পথে। পরিপূর্ণ স্নেহ ও ভালবাসা নিয়ে যেন মুহুর্তে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আপন করে নিয়েছিল রমা।

পানুর চিরশুষ্ক স্নেহ-ব্যাকুল সমগ্র অন্তর সে স্নেহের ধারায় গেল জুড়িয়ে। সে নিঃস্ব হয়ে আপনার অতীত ও ভবিষ্যতকে ভুলে আপনাকে বর্তমানের মধ্যে বিলিয়ে দিল। আজ তাই এই ঐশ্বর্যের চাকচিক্যের মধ্যে এসেও সেই মা’র কথাই বার বার তার অন্তরকে কাঁদিয়ে ফিরতে লাগল।

মাঝে মাঝে শ্ৰীলেখা এসে জিজ্ঞাসা করে : কী হয়েছে দাদা?

কে শ্ৰী? আয় বোস। পানু ওর দিকে ফিরে বলে, কই কিছু তো ভাবছি না?

দিনরাত ঘরের মধ্যে বসে থাক কেন দাদা? তার চাইতে চল বাগানে ঘুরে আসি। না হয় মোটরে করে খানিকটা ঘুরে আসি।-চল পানসীতে করে না হয়। গঙ্গায় বেরিয়ে আসি।

যায় বটে। শ্ৰীলেখার ডাকে বাইরে পানু। কিন্তু মন তার যেন ভরে না। একটা শূন্যতা যেন মনের মধ্যে কেঁদে কেঁদে মরে। মধ্যে মধ্যে মনে পড়ে দাদা সুনীলের কথা।

সেই চির দুর্দান্ত …পথহারা অফুরন্ত সুনীল। কে জানে এখন সে কোথায়?

বিভাবতী এসে বলেন : এদিক ওদিক একটু ঘুরে আয় দুজনে। এমনি করে দিবারাত্র ঘরের মধ্যে বসে থাকলে যে অসুখ হয়ে যাবে।

দিনরাত পানু স্বপ্ন দেখে, শ্ৰীরামপুরের মা যেন দিবারাত্র তারই জন্য কাঁদছেন।

পানু ফিরে আয় বাবা, সুনু আমায় ছেড়ে চলে গেল, তুইও যাসনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *