রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

২৩. রাতের অভিসার

রাতের অভিসার

শ্ৰীপুরেই একটা বাড়িতে দিন কয়েক হলো কিরীটী ও সুব্ৰত আশ্রয় নিয়েছিল।

সেই বাড়ির একটি ঘরে রাত। তখন প্ৰায় এগারটা।

হঠাৎ কিরীটী উঠে পড়ে শয্যা থেকে।

সুব্রত শুধায়, উঠলি যে?

তৈরি হয়ে নে তুইও—

তৈরি হয়ে নেবো!

কিরীটী একটা কালো প্যান্টের উপর কালো সাটীনের সার্ট চাপাচ্ছিল।

সুব্রতর দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, হ্যাঁ, এখুনি চৌধুরী বাড়িতে যেতে হবে।

এই এত রাতে?

উপায় নেই।–রাঘব বোয়াল টোপ গিলেছে। দেখবি চল। ডাঙ্গায় কেমন তুলি খোলয়ে খেলিয়ে।

হেঁয়ালী রেখে কথাটা ভেঙ্গেই বল না।

আজকের রাতটা কটুক, শুভক্ষণ আসতে দে—

অল্পক্ষণের মধ্যেই কিরীটী আর সুব্রত বেরিয়ে পড়ল, প্রস্তুত হয়ে।

কিরীটীর কোমরে ঝোলান টর্চ। আর, পকেটে একটা সিল্ক কর্ড।

গভীর রাত্রি। কালো বাদুরের ডানার মত যেন নিঃশব্দে ছড়িয়ে আছে।

মাঝে মাঝে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রাতের মন্থর হাওয়া সিপি সিপ করে বয়ে যায়। মনে হয়, বুঝি রাতের অন্ধকারে কারা সব গা ঢাকা দিয়ে অশরীরী নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে বেড়ায়।

কিরীটী আর সুব্রত শ্ৰীপুরের জমিদার বাড়ির বাগানে বড় একটা বকুল গাছের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।

কিরীটী সুব্রতর গায়ে মৃদু একটা ঠেলা দিল, কটা বেজেছে? সুব্রত রেডিয়াম দেওয়া হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ঘড়িটা কিরীটীর চোখের সামনে উঁচু করে ধরল।

রাত্রি একটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী।

কিন্তু এক একটা মিনিট যেন আর কাটতে চায় না।

প্ৰকাণ্ড জমিদার বাড়িটা যেন নিঃশব্দে ভূতের মত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে।

এমন সময় সহসা একটা সবুজ আলো অন্ধকারের বুকে জেগে উঠল। জমিদার বাড়ির দোতলায়-একটা জানালা পথে।

আর দেরী নয়। ফিসফিস করে কিরীটী বলে।

কিরীটী সুব্রতর হাতে এক চাপ দিয়ে এগিয়ে চলল।

সুব্রতও তাকে অনুসরণ করল।

ওরা এসে পশ্চাতে অন্দর মহলের দরজার সামনে দাঁড়াল।

অন্দর মহলের সিঁড়ির দরজাটা খোলাই ছিল সেটা একটু ঈষৎ ঠেলা দিতেই খুলে গেল। কিরীটী আর সুব্ৰত ভিতরে ঢুকে বারান্দা অতিক্রম করে সামনেই উপরে উঠবার সিঁড়ি দেখতে পেল।

সিঁড়ির আলোটা টিম টিম করে জুলছে। সমস্ত সিঁড়িটায় একটা যেন আলো-আঁধারীর সৃষ্টি হয়েছে।

পা টিপে টিপে নিঃশব্দে কিরীটী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল।

সামনে একটা টানা বারান্দা-দোতলায়—একতলার মতই জমাট আঁধার, কিছুই দেখবার উপায় নেই।

কিরীটী পা টিপে টিপে এগিয়ে চলে।

বারান্দা যেখানে বেঁকেছে তারই সামনে যে ঘর, সেইটাতেই পানু শোয়।

মৃদু একটা ঠেলা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। ওরা ঘরে পা দেয়।

ঘরের বাগানের দিককার জানালাটা খোলা।

রাতের হাওয়ায় খাটের উপর টাঙানো নেটের মশারিটা দুলে দুলে উঠছে আবছা আবছা অন্ধকারেও দেখা যায়।

কিরীটী এগিয়ে এসে নিঃশব্দে মশারিটা তুলে হস্তধৃত টর্চের বোতামটা টিপতেই বিছানাটার উপর টর্চের আলো গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

সুব্রত সভয়ে দেখলে, একটা বাঁকানো তীক্ষ্ণ ভোজালী পাশ বালিশটার গায়ে অৰ্দ্ধেকটার বেশী ঢুকে রয়েছে, শয্যা খালি।

কিরীটী হাসতে হাসতে বালিশের গা থেকে ভেজালীটা টেনে তুলে নিল। ভোজলীটার হাতলটিা হাতীর দাঁতের নানা কারুকার্য খচিত এবং সেই হাতলের গায়ে মীনা করে লেখা ‘S.C’.

এমন সময় খুঁট করে একটা শব্দ শোনা যেতেই টুক করে কিরীটী হাতের টৰ্চটা নিভিয়ে দিল।

নিমিষে নিকষ। কালো আঁধারে ঘর গেল ভরে।

পর মুহুর্তেই মনে হলো আশে পাশেই কোথাও কোন দরজা খুলে কে বুঝি নিঃশব্দে চোরের মত চুপি চুপি ঘরে ঢুকছে।

ওরা উদগ্ৰীব হয়ে ওঠে।

সহসা এমন সময় আবার কিরীটীর হাতের টর্চ জ্বলে উঠলো।

সেই আলোয় সুব্রত ও কিরীটী দেখলে তাদেরই সামনে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে শ্ৰীপুরের জমিদার স্বয়ং শশাঙ্কমোহন চৌধুরী।

তাঁর দুই চোখ দিয়ে বিহ্বল ও আতঙ্কপূর্ণ চাউনি যেন ফুটে বের হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *