রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

১৮. বিদায়

বিদায়

কত তুচ্ছ ঘটনা থেকে এক এক সময় মানুষের জীবনে আকস্মিক কত বড় পরিবর্তনই না আসে। ঠিক তেমনি–

সুধীর পরমেশবাবুর আশ্রমে এসে একেবারে হঠাৎ যেন রাতারাতি বদলে গেল।

তার সেই দুরন্ত চঞ্চল প্রকৃতি একেবারে শান্ত হয়ে গেল।

অদ্ভুত ঠাণ্ডা হয়ে গেল যেন সে।

পরমেশবাবু তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। পড়ায় মন দিল সুধীর।

গভীর মন দিল।

তবু মাঝে মাঝে মনটা যেন কেমন উতলা হয়ে যায়।

একটা শূন্যতা যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে। মনে হয় কি যেন তার ছিল—

কি যেন সে হারিয়েছে। আর মধ্যে মধ্যে মনে পড়ে সেই হামমোহিনী আশ্রমের কথা—ভিখুর কথা বিশেষ করে।

এক এক সময় কিন্তু ভাল লাগে না। পড়ার বই-পরমেশবাবুর এই গৃহ, কিছু ভাল লাগে না। চলে যায় সুধীর গঙ্গার ঘাটে।

বঁধান সিঁড়িতে চুপটি করে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার কখন কখন মনে হয় বের হয়ে পড়ে সে এখান থেকে।

এই ঘর আর স্নেহের বাঁধন তার জন্য নয়।

ভগবান শৈশব থেকেই যে ঐ বঁধন থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন।

গঙ্গার ঘাটে জোয়ারের জল এসে পুরাতন ভাঙ্গা সিঁড়িগুলো ডুবিয়ে দেয়। মৃদুমন্দ বাতাসে গঙ্গার বুকে ছোট ছোট ঢেউগুলো সিঁড়ির গায়ে আছড়ে আছড়ে এসে পড়ে। অধীর ব্যাকুল আগ্রহে বারংবার মনের কোণ ছুয়ে যেন কাদের অস্পষ্ট হাতছানি ভেসে ওঠে।

করা যেন ডাকে, আয় আয়।

সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে পড়ে মায়ের ব্যাকুল সদা শঙ্কিত মুখচ্ছবি।

অশান্ত মনও গুটিয়ে আসে।

নানারঙের পাল তুলে নৌকাগুলি জলের বুকে ভেসে চলে, দেশ দেশান্তরে। কোথায় তাদের যাত্রা শুরু কোথায় বা তার শেষ, কে জানে।

কোন হট্টমালার দেশে চলেছে তাদের তরী।

বাতাসে ঘাটের ধারে বট গাছের পাতায় সিপি সিপি করে জাগে দোলন।

পাতায় পাতায় কী যে কথার কানাকানি।

ওপারের মিলের চিমনীর ধোঁয়া আকাশের বুকে ছড়িয়ে পড়ে।

 

আজ কয়দিন থেকেই সুনীল যেন বেজায় অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

সদা চঞ্চল মন যেন তার হঠাৎ অত্যন্ত গভীর হয়ে উঠেছে।

বাইরে বাইরে কাটাবার সময়টা যেন ক্ৰমে দীর্ঘতর হয়ে উঠেছে।

সুনীলের এই পরিবর্তন কিন্তু পানুকে বিচলিত করে। এ তো স্বাভাবিক সুনীল নয়। হাসির সেই অফুরন্ত উচ্ছাসই বা কোথায়। কোথায় সেই দুর্মদ চলার বেগ।

এ বুঝি আসন্ন এক ঝড়ের অবশ্যম্ভাবী পূর্ণ সঙ্কেত। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই।

অকস্মাৎ সত্য সত্যই সুনীল একদিন কোথায় চলে গেল। মায়ের স্নেহের বঁধন, ঘরের মায়া কিছুই তাকে পিছুটান দিয়ে বেঁধে রাখতে পারলো না।

যাযাবর মন তার নীড়ের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে চলে গেল।

সকাল বেলায় ঘুম ভেঙ্গে পানুপাশের খাটের দিকে চেয়ে দেখলে বিছানার চাদরে একটি কুঞ্চন পর্যন্ত নেই। নিভাঁজ শয্যা কেউ বুঝি স্পর্শও করেনি।

একই ঘরে ওরা দুটি ভাই পাশাপাশি শয়ন করত।

বিস্মিত পানু উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ নজরে পড়ে পানুর, সুনীলের পড়বার টেবিলে মহীশূরের চন্দন কাঠের ছোট্ট হাতীটা দিয়ে চাপা সুনীলের প্যাডের সবুজ কাগজ একখানি ভাঁজ করা। উপরে বড় করে লেখা “মা”।

কম্পিত হাতে পানু ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ধরল।

ভোরের প্রথম সোনালী আলো খোলা জানালা পথে ওধারের নিমগাছটার ফাকে ফাঁকে প্রথম প্ৰণতি জানাচ্ছে।

সুনীল লিখেছে।

মা! মাগো আমার, আমার মা-মণি।

আমি চল্লাম।

এমনি করে আর আপনাকে গুটিয়ে ঘরের কোণে বসে থাকতে পারলাম না।

দেশে দেশে নগরে নগরে সমুদ্রের কুলে কুলে যে স্বপ্ন আছে ছড়িয়ে দিক দিগন্তে, ঘুমের মাঝে, জাগরণে দিবানিশি তারা হাতছানি দেয়, আয়, ওরে অশান্ত, ওরে আপনি ভোলা, ওরে খেয়ালী চঞ্চল আয়…আয়।

আপাতত বিলেত চললাম-জাহাজে খালাসীর কাজ নিয়ে।

আমার জন্য ভেবো না, দুঃখ করো না, মা-মণি।

এমনি করে ঘরের মধ্যে আমি বন্দী থাকতে পারলাম না। ঘরের বাইরে যে জীবন প্রতি মুহূর্তে সেই জীবন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

কিন্তু তুমি ভেবো না মা।

তোমার সুনীল আবার তোমার কোলে ফিরে আসবে।

তোমার চির অবাধ্য সন্তান

সুনু

পানুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে : সুনীল, সীমাহীন সমুদ্র পথে সুনীলদের জাহাজ ভেসে চলেছে।

কত দেশে-কত বন্দরে ভিড়বে হয়ত জাহাজ।

কত সমুদ্র পার হবে সে—

সেও যদি পারত আজ আমনি করে সুনীলের মত ভেসে পড়তে।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনের পাতায় ভেসে ওঠে মারি বিষণ্ণ মুখখানি—

সুনীল চলে গেছে মাকে সে কেমন করে বলবে।

কেমন করে দেবে সংবাদটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *