রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

০৯. চঞ্চল সুনীল

চঞ্চল সুনীল

সুনীল আর পানুর মধ্যে রামার মেহটা পাণুকে ঘিরেই বেশী করে আবর্ত রচনা করে ফেরে। উদ্দাম ঝড়ো হাওয়ার মত সদাচঞ্চল সুনীল মাকে কাঁদায়।

রামার মনে সর্বদাই আশঙ্কা সুনীলের জন্য উদগ্ৰীব হয়ে থাকে। হাতের কােজ ফেলেই সুনীলকে বুকের মাঝে সস্নেহে টেনে নিয়ে তার রুক্ষ পশমের মতো এলোমেলো চুলগুলির উপর গভীর মমতায় হাত বুলাতে থাকে, সুনু বাবা আমার, দুদণ্ডও কী তুই সুস্থির হয়ে থাকতে পারিস না?

আমার জন্য তোমার বড় ভয় না মামণি? সুনীল তার ডাগর চোখ দুটি মায়ের ছলছল স্নেহ চঞ্চল দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে বলে, কেন মা তুমি আমায় বঁধতে চাও? এই চারিদিকে দেওয়াল ঘেরা ঘরের মধ্যে আমার মন হাঁপিয়ে ওঠে। পারি না। আমি থাকতে মামণি, বাইরে কেমন উদার উন্মুক্ত প্রকৃতি। মাথার উপরে সীমাহীন নীল আকাশ। কেমন করে থাক মা তুমি এ ঘরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, একটিবারও কী তোমার মন চায় না ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে যেতে? সুনীলের চোখ দুটো বাইরের আকাশে নিবদ্ধ।

কিসের ভাবে সে স্বপ্নাতুর।

সুনীল বলে চলে, আমাদের দেশের ছেলেগুলো চিরকালটা এমনি করেই মায়ের আঁচলের তলে ঘরের কোণে বদ্ধ রইলো, দেখলো না তার বাইরে বের হয়ে—জানলো না তারা বাইরে ঐ উদার উন্মুক্ত সীমাহীন প্রকৃতি কতবড় ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার নিয়ে আপনাকে আপনি দিকে দিকে বিলিয়ে দিয়েছে। শুনলে না তারা দিগন্ত প্লাবিত মুক্ত পাখীর গান। বাঁধন হারা সাগরের জলোচ্ছাস। জান মামণি-ওদের দেশের ছেলেরা একটু ছুটি পেলেই দল বেঁধে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে, তাইতো তাদের দেশে জন্মায় কলম্বাস, লিভিংষ্টোন।

তারপর একটু থেমে আবার হয়ত বলে, আমি ছাড়াও তো তোমার আর একটি ছেলে আছে মা। তোমার পানু, সে তো ঘর থেকে বের হয়না। লক্ষ্মী ছেলেটির মত দিবারাত্র ঘরের মধ্যে বই নিয়ে বসে কাটায়। বাইরের ঐশ্বর্য ওর কাছে অন্ধকার।

পানু এসে ঘরে ঢোকে।

এই যে মা-মণি, তোমার সোনার যাদু এল। সুনীল পানুর দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বলে।

আমার নামে বুঝি, দাদা তোমার কাছে লাগাচ্ছে মামণি? পানু বলতে বলতে এগিয়ে আসে।

মা অন্য হাত বাড়িয়ে পানুকেও বুকের কাছটিতে টেনে নেয়, না রে না, দাদা যে তোকে কত ভালবাসে তাকি তুই জানিস নে পানু?

জানি মা, দাদা আমাকে সত্যি বড় ভালবাসে।

তাহলে তুমি কচু জান। সুনীল গভীর হয়ে জবাব দেয়। তোমাকে কিসসু ভালবাসে না দাদা। দাদার বয়ে গেছে। অমন ঘর-কুণো ভাইকে ভালবাসতে।

মা প্ৰসন্ন দৃষ্টিতে দুই ছেলের ঝগড়া দেখে আর মৃদু মৃদু হাসে। ওদের দাদু, রামার বাবা, বৃদ্ধ পরমেশ বাবু ঘরে এসে ঢুকলেন। কিসের দরবার চলেছে রাম।

তুমি বল দাদু, মার মনে কষ্ট দিয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করা ভাল, না মা যাতে করে সুখী হন, তাই করা ভাল।

আমার মতে কুণো হওয়াটাও ভাল নয়-মার কথা শোনা উচিত।

এ তোমার দাদু, মন রাখা কথা হলো, সুনীল বললে, পরমেশবাবু ও রমা। চোখ চাওয়া চাওয়ি করে হাসতে থাকেন।

 

রাত্রি দশটা হবে।

সুনীল সেই দুপুরে তার বাইকে চেপে বের হয়েছে, এখনও ফেরেনি।

পড়ার ঘরে পানু একা টেবিল ল্যাম্পটি জেলে পড়ার বই খুলে পড়ছে।

ঝড়ের মতই সুনীল এসে ঘরে ঢোকে। কি, দিন নেই রাত নেই, কেবল পড়া আর পড়া।

কে দাদা? এতরাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে? পানু জিজ্ঞাসা করে। পাতা বিছানাটার উপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে সুনীল বলে, চল পানু কাল রবিবার আছে, বেরিয়ে পড়ি-হাঁটতে হাঁটতে যতদূর পারি চলে যাই।–তারপরই একটু থেমে বলে, উঃ যদি একটা আমার প্লেন থাকত।

পানু সহাস্যে বলে, তাহলে কি হতো দাদা?

ফাকে-উড়ে যেতম দূরে দূরে বহুদূরে—মাটির পৃথিবী অস্পষ্ট ছায়ার মতই-যেন আঁচল পেতে ঘুমিয়ে আছে। কেমন মজা হতো বলত-how thrilling!

সুনীলের চঞ্চল আঁখি দুটি স্বপ্নময় হয়ে ওঠে যেন। সুনীল আপন মনে বলে চলে–

“ওগো সূদুর, বিপুল, সুদূর তুমি যে,
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরী।
মোর ডানা নাই আছি এ ঠাঁই
সে কথা যে যাই পাসরি।
আমি উৎসুখ হে,
হে সুদূর আমি প্রবাসী।
তুমি দুর্লভ দুরাশার মতো
কি কথা আমায় শুনাও সতত,
তব ভাষা শুনে তোমার হাদয়
জেনেছে তাহার স্বভাষী
হে সুদূর আমি প্রবাসী।”

আমি মাঝে মাঝে কি স্বপ্ন দেখি জানিস পানু—আমি যেন উড়ে চলেছি প্লেনে —অনেক অনেক হাজার ফুট উঁচু দিয়ে-স্বপ্ন দেখি আমি যেন-গভীর রাতে ঘুমহারা তারার পাশে পাশে আমি আমার প্লেনে উড়ে চলেছি। নীচে ঘুমিয়ে আছে তুষারে আচ্ছন্ন হিমালয়। তুষারের টোপর এক পায়ে ভুতের মত রাত জাগে। পাইন গাছগুলি সবুজ পাতার টোপর মাথায় ঝিমুচ্ছে। কখনও হয়ত উড়ে চলেছি জ্যোৎস্নালোকিত আকাশ পথে, নীচে ধুধু দিগন্ত বিস্তৃত সাহারার মরুভূমি। কখনও নীচে হয়ত গর্জে উঠেছে ফেনিল উত্তাল সাগরের ঢেউ।

পানু অবাক হয়ে সুনীলের কথা শোনে।

ওর দেহের প্রতি রক্তবিন্দুতে, বিন্দুতে যেন ঘর ছাড়া দিক হারার ডাক। হয়ত ও এমনি করেই একদিন সুদূরের পথে ভেসে যাবে। হয়ত ফিরবে, হয়ত বা ফিরবে না। কে জানে? ওর ভয় করে। রীতিমত ভয়ে ভয়ে ডাকে, দাদা?

সুনীলের কিন্তু খেয়াল নেই। বলে চলে, জনিস পানু, এতদিন কবে আমি হয়ত বেরিয়ে পড়তাম। কিন্তু পারিনা, মনে পড়ে মার মুখখানি, তার ব্যথা করুণ চোখের দৃষ্টি, একদিকে দূর দুরান্তের হাতছানি, অন্যদিকে মায়ের নীরব কাকুতি।

অশান্ত চঞ্চল কল্পনা পিয়াসী সুনীল। সত্যিই দাদাকে পানুর ভারী ভাল লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *