রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

০৭. নতুন চাকর

নতুন চাকর

জমিদার শশাঙ্কমোহন চৌধুরীর সংসারে আপনার জনের মধ্যে স্ত্রী-একমাত্র মেয়ে শ্ৰীলেখা ও তীর খুল্লতাত ভাই মৃগাঙ্ক। শ্ৰীলেখার বয়স ১৬ বছর।

শ্ৰীলেখা স্কুলে পড়ে—এক বছর পরে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবে। যুঁই, হেনা, রমা, টুনি-ওর এখন কত বন্ধু। বড় লোকের মেয়ে হলে কি হয়। মনে কিন্তু ওর এতটুকু অহঙ্কার নেই।

যেমনি মিশুকে তেমনি হাসিখুশি।

সকলেই ওর ব্যবহারে ভারি সন্তুষ্ট।

ওর সব চাইতে প্রিয় বান্ধবী হচ্ছে যুঁই। যুঁই গরীবের মেয়ে, ত্রিসংসারে ওর একমাত্র বিধবা মা ছাড়া আর কেউ নেই।

ওর মা স্থানীয় মেয়ে। স্কুলে সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে যে কয়টি টাকা পান। তাইতেই ওদের সংসার, মা আর মেয়ের কোন মতে চলে যায়।

স্কুলে যেদিন শ্ৰীলেখা প্রথম যায় সেই দিনই যুঁইয়ের সঙ্গে ওর ভাব হয়।

রোগ ছিপছিপে গড়ন কালো মেয়েটি। মাথা ভর্তি চুল।

বড় বড় ভাসা ভাসা দুটো চোখ। সর্বদাই যেন তাতে জল ভরে আছে। হাতে একগাছি করে সোনার চুড়ি।

শ্ৰীলেখা নিজেই এসে ওর সঙ্গে আগে কথা বলে, কি নাম তোমার ভাই।

যুঁই তার ডাগর দুটি চোখ তুলে বিস্মিত হয়ে শ্ৰীলেখার দিকে তাকায়।

কি সুন্দর শ্ৰীলেখার চেহারা। তার উপরে দামী শাড়িতে শ্ৰীলেখাকে ভারী মানিয়েছিল। মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসিতে ঠোঁট দুটি ভরিয়ে শ্ৰীলেখা জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছো?

তোমাকে-মৃদু সঙ্কোচভরা কণ্ঠে যুঁই জবাব দেয়।

আমাকে? কেন? আমার বুঝি দুটো মাথা, চারটে চোখ?

না তা তো নয়, কিন্তু তোমার নাম কি ভাই?

শ্ৰীলেখা-তোমার নাম?

আমার নাম যুঁই।

যুঁই? বা, ভারি সুন্দর নামটি তো তোমার।

আর তোমার! যুঁই হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করল।

তোমার নামের মত তাই বলে সুন্দর নয় মিষ্টি নয়।

একদিন শ্ৰীলেখা এক প্রকার জোর করেই যুঁইকে নিজেদের বাড়ি ওদের বাড়ির গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে গেল।

ধনী গৃহে ঐশ্বর্যের অফুরন্ত সমারোহ। যুঁই বিস্ময়ে হাঁ করে চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখএত লাগল।

মস্ত বড় প্ৰকাণ্ড বাড়ি।

ঘরে ঘরে সব কাপেট পাতা। দেওয়ালে দেওয়ালে দামী দামী সব বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা সুন্দর সুন্দর ছবি।

ঘরের কোণে টিপয়ে রাখা কাশ্মীরি টবে পােমট্রি। শ্ৰীলেখার পড়বার ঘরটিই বা কি সুন্দর। একাধারে একটি দামী টেবিল, তাতে শ্ৰীলেখার পড়বার বইগুলি ইতস্ততঃ ছড়ানো, টেবিলের উপর ফুলদানীতে এক গোছারজনীগন্ধা, দেওয়াল আলমারী ঠাসা সব গল্পের বই ও ছবির বই; পাশেই শোবার ঘর। দামী পালঙ্কে দুধের মত সাদা ধবধবে পাখীর পালকের মত নরম বিছানা।

দামী শ্বেত পাথরের প্লেটে করে নানা রকমের খাবার সব সাজিয়ে নিয়ে এল। যুঁই জীবনে এমন সুস্বাদু ও সুগন্ধযুক্ত খাবার আস্বাদনের সুযোগ একেবারে পায়নি বললেও চলে।

শ্ৰীলেখার মা বিভাবতীও এসে যুঁই এর সঙ্গে আলাপ করলেন। যেমন অমায়িক তেমনি হাসিখুশি।

এরপর একদিন শ্ৰীলেখা নিজে যেচে স্কুলেব ছুটির পর যুঁইয়ের বাড়িতে গেল।

দুখানি মাত্র ঘর নিয়ে যুঁইদের সংসার।

একখানায় যুঁই ও তার মা রাত্রে শোন ও যুঁই পড়াশুনা করে। অন্যটায় ওদের গৃহস্থলী ও রান্না খাওয়া দাওয়া হয়।

গোছগাছ ফিটফাট, কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই। ছোট্ট একখানি কেরোসিন কাঠের টেবিল। তার উপরে সযত্ন পরিপটি করে যুঁইয়ের পড়বার বই ও খাতাপত্ৰ সাজান গুছান।

সামনেই যুঁইয়ের বাবার ফটো।

কী সৌম্যমূর্তি।

যুঁই হাসতে হাসতে বললে, গরীব বান্ধবী। তোমার মত বড়লোক বান্ধবীকে বসাতে পারি। এমন যোগ্য আসনই বা আমার কোথায়?

শ্রীলেখা কৃত্রিম অভিমানে মুখখানি ভারী করে বললে, বন্ধুত্বের কাছে আবার গরীব বড়লোক কি? তুমি আমার বন্ধু। আমি তোমার বন্ধু। তুমি যেমন আমায় ভালবাস। আমিও তেমনি তোমায় ভালবাসি। সেইটাই তো আমাদের একমাত্র ও সত্যিকর পরিচয়। অন্তরের মিল যেখানে আছে, বাইরের খোলসটার সেখানে কতটুকুই বা দাম।

এমনি করে উভয়ের বন্ধুত্ব দিন দিন গাঢ় হতে থাকে। ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা ওদের দিকে চেয়ে আড়ালে চোখ টিপে হাসাহসি করে।

কিন্তু ওদের যেন কোন কিছুতেই একটুকুও ক্ৰক্ষেপ নেই।

ওরা নিজেদের নিয়ে নিজেরাই বিভোর।

 

শশাঙ্কমোহন ভাইয়ের তার পেয়ে তাড়াতাড়ি শিলং থেকে ফিরে এসেছিলেন।

করালীর হত্যার ব্যাপারে সত্যই তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যেন। একটা পাখী পুষিলেও মানুষের তার উপরে মায়া পড়ে, তা এ তো মানুষ। এবং একদিন দুদিন নয় একাদিক্ৰমে ২১ বৎসর সে এ বাড়ীতে আছে।

শ্ৰীলেখা তো কেঁদেই খুন।

মৃগাঙ্ক শশাঙ্কমোহনকে বুঝিয়েছেন, করালী আত্মহত্যা করে মারা গেছে।

কিন্তু কেন? হঠাৎ সেই বা আত্মহত্যা করতে গেল কেন?

কিইবা এমন ব্যাপার ঘটতে পারে যার জন্য তাকে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিতে হলো।

 

আরো দু’চার দিন পরের কথা।

করালীর মৃত্যুর পর থেকে শশাঙ্ক চৌধুরী যেন একটু গভীর হয়ে গেছেন।

প্রায়ই দেখা যায় তিনি চুপচাপ একাকী বসে কি যেন ভাবেন।

সেদিনও বাইরের ঘরে চুপটি করে বসে আছেন, এমন সময় একজন উড়ে চাকর এসে দরজার উপরে দাঁড়াল-শরবতের গ্লাস নিয়ে।

শশাঙ্কমোহন যেন একুট বিস্মিত হয়েই নতুন চাকরিটার মুখের দিকে তাকান।

কে তুই?

আজ্ঞে, মু রঘুনাথ আছি

রঘুনাথ?

এমন সময় অশোক এসে ঘরে ঢোকে।

অশোকই বলে রঘুনাথকে দিন কয়েক হলো কাজে বহাল করা

হয়েছে— করালীর মৃত্যুর পর শশাঙ্কমোহনের নিজের কাজকর্ম করে দেবার জন্য।

Leave a Reply to Bangla Library Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *