কিরীটী
কি বিশ্ৰী বর্ষা।
ঝর-ঝর-অবিরাম ঝরিছে তো ঝরছেই-থামবার শীগগিরী কোন সম্ভাবনাই নেই।
তাই আজ কয়দিন থেকেই কিরীটীর মনটাও ঐ বর্ষার মেঘলা আকাশটার মতই যেন ভার ভার হয়ে আছে। হাতে কোন কাজকর্মও নেই। বিশ্ৰী একঘেয়ে—কারও এ ধরণের অবসর ভালো লাগে নাকি?
সারাটা দিন ধরে একটা রহস্য উপন্যাস পড়েছে কিরীটী-বিকেলের দিকে আর ভাল লাগছিল না পড়তে। বইটা মুড়ে হাতের মধ্যে নিয়ে বসবার ঘরে একটা সোফার উপর, খোলা জানােলা পথে বাইরের মেঘাচ্ছন্ন বৃষ্টি ঝরা আকাশটার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বসে ছিল।
এমন সময় টেলিফোনের বেল বেজে উঠলো, ক্রিং! ক্রিং! অনাচ্ছিার সঙ্গেই হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিলো। হ্যালো। মিঃ কিরীটী রায়? কথা বলছি—বলুন। আপনি কে? আমাকে তো আপনি চিনবেন না
কোথা থেকে কথা বলছেন? আমি শ্ৰীপুর স্টেট থেকে বলছি, জমিদার শশাঙ্ক চৌধুরীর ভাই মৃগাঙ্ক চৌধুরী।
বলুন। আমাদের বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে সেইজন্য আপনার সাহায্য চাই–
কি রকম দুর্ঘটনা?
দেখুন, আমাদের বাড়ির অনেকদিনকার পুরানো করালীচরণকে আজ সকালে হঠাৎ তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। স্থানীয় থানা থেকে দারোগীবাবু এসেছিলেন—তারা অবিশ্যি যা করবার করবেন–আর কি যে তারা করবেন তাও আমরা জানি। করালীচরণ এ বাড়ির বহুদিনকার পুরানো লোক-বলতে গেলে সে এ বাড়িরই একজন হয়ে গিয়েছিল—তাই ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুবই মর্মান্তিক হয়েছে। আমরা চাই সত্যিকারের ব্যাপারটা জানতে। তাই বলছিলাম। আপনি যদি দয়া করে আমাদের এখানে একবার আসেন। তবে বড় ভাল হয়। আমাদের মনে হয়। আপনি হয়ত এ ব্যাপারের একটা কিনারা করতে পারবেন। অবিশ্যি আপনার ফিস সম্পর্কে–
কিরীটী বলে, ফিসের কথা থাক— আমি যাবো, কিন্তু আপনাদের ওখানে কি করে যেতে হবে। যদি বলে দেন–
মৃগাঙ্কবাবু বলেন–ইচ্ছা করলে আপনি গাড়িতেও আসতে পারেন-ট্রেনেও আসা যায় এখানে তবে একটু ঘুরে আসতে হয়। তবে যদি স্টীমারে আসেন তাহলে একেবারে ঘাটে এসে নামতে পারেন।
স্টীমার!
হ্যাঁ–আহিরীটোলা ঘাট থেকে সকাল-দুপুর ও সন্ধ্যায় তিনবার স্টীমার আসে।
স্টীমারেই তাহলে যাবো।
আজই আসবেন কি?
কাল যাবো।
বেশ-কোন স্টীমারে আসবেন বলুন-ঘাটে আমাদের লোক রাখব।
আপনিই বলুন না কোন স্টীমারে যাবো—
সকাল দশটা দশের সীমারে আসতে পারেন
বেশ তাই যাবো।
জেটিতে লোক থাকবে।
আচ্ছা। আর একটা কথা।
বলুন।
মৃত দেহটা কি ময়না তদন্তের জন্য পাঠান হয়েছে?
না–
তাহলে ওটা আমি যাওয়া পর্যন্ত রাখবার ব্যবস্থা করবেন। করবো।
নমস্কার |
কিরীটী হাঁক দিল, জংলী।
ভৃত্য জংলী ঘরে প্রবেশ করল; বাবু?
দেখ, কাল সকলে আমাকে একবার শ্ৰীপুরে যেতে হচ্ছে। ফিরবো কখন ঠিক করে বলতে পারছি না। কেউ যদি আমার খোঁজ করতে আসে। তবে তাকে বলিস সন্ধ্যার পরে যেন আসে।
কিরীটী জংলীর সঙ্গে কথা বলে ফোনটা আবার তুলে নিল।
হ্যালো 3033 বড়বাজার।
হ্যালো, কে কিরীটী নাকি? রিসিভারে জবাব এল।
কে সুব্রত? হ্যারে। আমি।
কী ব্যাপার?
শ্ৰীপুর চলেছি, যাবি নাকি? —তা হলে তোকে ওখান থেকে কাল সকালে pick up করে নিই।
হঠাৎ শ্ৰীপুর–
আপাততঃ বিশেষ কিছুই জানিনা। সেখানকার জমিদার মিঃ শশাঙ্ক চৌধুরীর বাড়িতে তাদের এক পুরানো চাকর নিহত হয়েছে, তারই তদন্তের আহ্বান এসেছে। তাই ভাবলাম এক এক যাব, যদি সঙ্গে যাস।
যাবো মানে-নিশ্চয়ই যাবো।
কিরীটী হাসতে হাসতে ফোনটা নামিয়ে রাখল।
পরের দিন সকালে।
সাজপোশাক সেরে নিয়ে কিরীটী জংলীকে একটা ট্যাক্সি ডাকতে বললে। ট্যাক্সিতে চেপে কিরীটী সোজা সুব্রতদের বাড়ি আমহাস্ট স্ট্রীটের দিকে চালাতে আদেশ দিল। সুব্রত একপ্রকার প্রস্তুত হয়েই দরজার সামনে অপেক্ষা করছিল। কিরীটী যেতেই সুব্রত চায়ের আদেশ দিল। কিছুক্ষণ পরে ভূত্য চা, নিয়ে এল। চা পান করেই ওরা বের হয়ে পড়ে। এবং ওরা যখন স্টীমার ঘাটে এসে পৌঁছল, কিরীটী রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৭-১০ এর স্টীমার ছাড়তে আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকী।
ট্যাক্সিটাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওরা বুকিং অফিসের দিকে এগিয়ে চলল।
কিরীটী স্টীমারে উঠে পড়ল।
সিটি বাজিয়ে স্টীমার ছেড়ে দিল।
বর্ষার গঙ্গা। গৈরিক জলধারা তার দুকুলপ্লাবী।
ইলিশ মাছের নৌকাগুলো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে দুএকটা লঞ্চ বা ফেরী স্টীমার এদিক ওদিক যাতায়াত করছে। দুজনে এসে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াল।
এই শ্ৰীপুর স্টেটের জমিদারের সঙ্গে তোর আগে কোন আলাপ ছিল নাকি কিরীটী? সুব্রত জিজ্ঞাসা করল।
না-কিরীটী বললে, তবে এদের নাম শুনেছি। মস্ত বড় ধনী লোক, অগাধ পয়সা, দুদুটো মিলের মালিক—
ব্যাপারটা কি মনে হচ্ছে তোর?
বাড়ির পুরানো চাকর অনেকদিনকার লোক—হয়ত জমিদার বাড়ির অনেক কিছুই সে জানত, যে কারণে আকস্মিক মৃত্যুটা তার চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে–আর তাতেই আমার স্মরণাপন্ন হয়েছে
তাই তোর ধারণা?
নচেৎ জমিদার বাড়িতে সামান্য একটা চাকরের মৃত্যু এমন বিশেষ কোন important বা notice করবার মত ব্যাপার নয় যাতে করে আমার মত একজন বেসরকারী সত্যানুসন্ধানীর প্রয়োজন হতে পারে, তাদের। তাই মনে হয়। এই মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চয়ই কোন জটিলতা আছে যার জন্য হয়ত ওরা আমার সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে।
তোর তাই মনে হয়?–
হ্যাঁ–নিশ্চয়ই এই হত্যা ব্যাপারের মধ্যে-অবিশ্যি যদি হত্যাই হয়-তাহলে কোন জটিল রহস্য জট পাকিয়ে আছে
কিন্তু–
বুঝতে পারছি তুই কি বলতে চাস সুব্রত–জমিদার বাড়ি-প্রচুর অর্থ–অনেক লোকজন। আত্মীয়-স্বজন কে কোন মতলব মনে মনে পোষণ করছে কে জানে। কার interest–স্বর্থ কিসে কে বলতে পারে?
কাজেই ওখানে কেউ যদি ঐ হত্যার ব্যাপারটার মীমাংসার জন্য আগ্ৰহান্বিত হয়েই থাকে তাহলে আশ্চর্যের কিছুই নেই-বলতে বলতে কিরীটী মৃদু হাসে।
সত্যি–সুব্রত বলে, এত তলিয়েও তুই সব ব্যাপার ভাবতে পারিস কিরীটী–
জলের তলে ডুব না দিলে কি রত্ন মেলে রে?—তাছাড়া ডুব দিয়ে খুঁজে খুঁজে রত্ন তোলারও একটা বিচিত্র উত্তেজনা আছে বৈ কি-তাই এই রহস্য ভেদ করার ব্যাপারটার মধ্যে ঠিক তেমনি একটা বিচিত্র উত্তেজনা ও আনন্দের আস্বাদ আমি পাই–
কিন্তু আমি আশ্চর্য হই–
আশ্চর্য হোস-কেন?
তোর এই যুক্তি, বিশ্বাস ও বুদ্ধি দিয়ে তোকে কঠিন হতে কঠিন রহস্যও উদঘাটন করতে যখন দেখি–
কিরীটী প্ৰত্যুত্তরে মৃদু হেসে বলে, মানুষেরই রচিত রহস্য তা মানুষ ভেদ করবে। এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই সুব্রত। একটা জিনিষ ভুলিস কেন-মানুষ তো, সে তার সহজাত দুর্বলতা বাদ দেবে কি করে? তা হয় না, মানুষ মানুষের কাছে চিরদিনই হার মানতে বাধ্য হয়েছে। মানুষই জটিল প্ৰব্লেম তৈরী করে আবার মানুষই তা solve করে। এ-ই। দুনিয়ার নিয়ম। বলতে বলতে কিরীটী তার চশমাটা চোখ থেকে খুলে রুমালের মধ্যে ঘাসতে লাগল।
বেশী পথ নয়-ঘণ্টা আড়াইয়ের মধ্যেই ঘাটে স্টীমার লাগে।
জমিদার বাড়ির গাড়ি ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বেলা খুব বেশী হলে সবে সাড়ে বারোটা তারই মধ্যে মেঘের আড়াল থেকে হঠাৎ সূর্যের ঝালকানি জেগেছে।
স্টীমার ঘাট থেকে জমিদার বাড়ি প্রায় ক্রোশটাক পথ হবে। গঙ্গার কোল ঘেঁষে জমিদারের প্রকাণ্ড চক মিলান বাড়ি। ওদের স্টীমার স্টেশনে রিসিভ করতে এসেছিল, স্টেটের প্রাইভেট সেক্রেটারী অশোক সেন।
ছেলেটির বয়স অল্প। বছর তেইশ চব্বিশ হবে, হালে বি. এ. পাশ করে স্টেটের চাকুরী নিয়েছে। আলাপ পরিচয়ের পর একসময় কিরীটী জিজ্ঞাসা করল, পোস্ট মর্টেমের কোন ব্যবস্থা হয়েছে, জানেন কিছু?
আজ্ঞে যতদূর শুনেছি। মৃগাঙ্কবাবু থানা অফিসারকে আপনার কথা বলায় লাস এখনো ময়না তদন্তে পাঠান হয়নি। জমিদার বাড়িরই মালীর ঘরের পাশের ঘরে পুলিশ প্রহরায় রয়েছে। আপনার দেখা হয়ে গেলে লাস ময়না তদন্তে যাবে।
কথাটা মিথ্যে নয়-কিরীটী অনুরোধ করায় গতকাল মৃগাঙ্ক চৌধুরী ঐ ব্যবস্থাই করেছিল?
বিরাট চকমিলান জমিদার বাড়ি, প্রাসাদ বললেও বুঝি অত্যুক্তি হয় না।
গেটে প্রহরারত বন্দুকধারী শিখ দারোয়ান।
গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকে গাড়ি বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াল। অশোকই ওদের সাদর অভ্যর্থনা করে বাইরের ঘরে নিয়ে গেল।
মৃগাঙ্ক বৈঠক খানাতেই অপেক্ষা করছিল। অদূরে একটা চেয়ারে বসে পুলিশের দরোগা। মাঝে মাঝে তারা কী সব কথাবার্তা বলছে। কিরীটী আর সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করতেই মৃগাঙ্কবাবু ও দারোগ উঠে দাঁড়ালেন। অশোকই পরিচয়টা করিয়ে দিল, ইনি আমাদের ছোটবাবু মৃগাঙ্ক মোহন চৌধুরী। আর ইনি হচ্ছেন মিঃ কিরীটী রায়।
মৃগাঙ্ক মোহন হাত তুলে নমস্কার করলেন। কিরীটী লক্ষ্য করলে মৃগাঙ্ক মোহনের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের পরের আঙ্গুলটি নেই। একেবারে গোড়া থেকে কাটা।
ডান হাতের দু-আঙ্গুলের ফাঁকে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। আঙ্গুল দুটোর মাথায় নিকোটিনের হলদে ছাপা গাঢ় হয়ে উঠেছে।
চোখে এক জোড়া কালো গগলস। গগলসের কালো কাঁচের আড়াল থেকেও দু’জোড়া চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন গায়ে এসে বেঁধে।
উঁচু লম্বা গড়ন। দেখলে বেশ বলিষ্ঠ বলেই মনে হয়। আপনিই কাল সন্ধ্যায় আমায়। ring করেছিলেন? মৃগাঙ্ক মোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ–মৃগাঙ্ক জবাব দেয়। তারপর করালীচরণের মৃত্যুর ব্যাপারটা আদ্যোপােন্ত শোনে মৃগাঙ্ক মোহনেরই মুখ থেকে কিরীটী।
গতকাল প্ৰত্যুষে করালীচরণের মৃতদেহ ভৃত্যদের মহলে তার ঘরে আবিষ্কৃত হয়।
অনেক দিনকার পুরানো চাকর করালী-এ বাড়িতে তাঁর যে একটা কেবল আধিপত্যই ছিল তাই নয়-সবাই সমীহ করেও চলত। তাকে বেশ।
ভৃত্যদের মহলে একটা আলাদা ঘরে সে থাকত।
দারোগা সাহেবের ধারণা-ব্যাপারটা হত্যা।
কিন্তু মৃগাঙ্কমোহনের ধারণা অন্যরূপ।
তার ধারণা আত্মহত্যা।
কিরীটী প্রশ্ন করে, কেন হলো আপনার এ ধারণা মৃগাঙ্কবাবু?