০৪. পৌষের শীত

পৌষের শীত। প্ৰান্তর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে হাড় কঁপায়। গভীর রাতে রহীমা আর হাসুনির মা ধান সিদ্ধ করে। খড়কুটো দিয়ে আগুন জালিয়েছে, আলোকিত হয়ে উঠেছে। সারা উঠানটা; ওপরে আকাশ অন্ধকার। গানগনে আগুনের শিখা যেন সেই কালো আকাশ গিয়ে ছোয়। ওধারে ধোঁয়া হয়, শব্দ হয় ভাপের। যেন শতসহস্ৰ সাপ শিস দেয়।

শেষ-রাতের দিকে মজিদ ঘর থেকে একবার বেরিয়ে আসে। খড়ের আগুনের উজ্জল আলো লেপা জোকা সাদা উঠানটায় ঈষৎ লালচে হয়ে প্ৰতিফলিত হয়ে ঝকঝাক করে। সেই ঈষৎ লালচে উঠানের পশ্চাতে দেখে হাসুনির মাকে, তার পরনে বেগুনি শাড়িটা। যে-আলো সাদা মসূণ উঠানটাকে শুভ্ৰাতায় উজ্জল করে তুলেছে, সে আলোই তেমনি তার উন্মুক্ত গলা-কাঁধের খানিকটা অংশ আর বাহু উজ্জ্বল করে তুলেছে। দেখে মজিদের চোখ এখানে অন্ধকারে চকচক করে।

কিছুক্ষণ পর ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে মজিদ। আশপাশ করে। উঠান থেকে শিসের আওয়াজ এসে বেড়ার গায়ে সিরসির করে। তাই শোনে আর আশপাশ করে মজিদ। তারই মধ্যে কখন দ্রুততর, ঘনতর। হয়ে ওঠে মুহুর্তগুলি।

এক সময়ে মজিদ আবার বেরিয়ে আসে। এসে কিছুক্ষণ আগে হাসুনির মায়ের উজ্জল বাহু-কাঁধ-গলার জন্য যে-রহীমাকে সে লক্ষ্য করেনি, সে-রহীমাকেই ডাকে। ডাকের স্বরে প্রভুত্ব! দুনিয়ায় তার চাইতে এই মুহুর্তে অধিকতর শক্তিশালী, অধিকতর ক্ষমতাবান আর কেউ নেই যেন। খড়কুটোর আলোর জন্য ওপরে আকাশ তেমনি অন্ধকার। সীমাহীন সে-আকাশ এখন কালো আবরণে সীমাবদ্ধ। মানুষের দুনিয়া আর খোদার দুনিয়া আলাদা হয়ে গেছে।

রহীমা ঘরে এলে মজিদ বলে,–পাটা একটু টিপা দিবা?

এ-গলার স্বর রহীমা চেনে। অন্ধকার ঘরের মধ্যে মূর্তির মতো কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে বলে,—ওইধারে এত কাম, ফজরের আগে শেষ করন লাগবো।

–থোও তোমার কাজ। মজিদ গর্জে ওঠে। গর্জাবে না কেন। যে-ধান সিদ্ধ হচ্ছে সে-ধান তো তারই। এখানে সে মালিক। সে মালিকানায় এক আনারও অংশীদার নেই কেউ।

রহীমার দেহভরা ধানের গন্ধ। যেন জমি ফসল ধরেছে। ঝুঁকে ঝুঁকে সে পা টেপে। ওকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মজিদ, আর ধানের গন্ধ শোকে। শীতের রাতে ভারী হয়ে নাকে লাগে সে-গন্ধ।

অন্ধকারে সাপের মতো চকচক করে তার চোখ। মনের অস্থিরতা কাটে না। কাউকে সে জানাতে চায় কী কোনো কথা? তারই দেওয়া বেগুনি রঙের শাড়ি-পরা মেয়েলোকটিকে–খড়কুটোর আলোতে তখন যার দেহের কতক অংশ জ্বলজ্বল করছিল। লালিত্যে—তাকে একটা কথা জানাতে চায় যেন। তবে জানানোর পথে বৃহৎ বাধার দেয়াল বলে রাত্রির এই মুহুর্তে অন্ধকার আকাশের তলে অসীম ক্ষমতাশীল প্ৰভুত্ব অস্থির অস্থির করে, দেয়াল ভেদ করার সূক্ষ্ম, ঘোরালো পস্থার সন্ধান করতে গিয়ে অধীর হয়ে পড়ে।

 

তখন পশ্চিম আকাশে শুকতারা জ্বলজ্বল করছে। উঠানে আগুন নিভে এসেছে, উত্তর থেকে জোর ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রহীমা ফিরে এসে মুখ তুলে চায় না। হাসুনির মা দাঁতে চিবিয়ে দেখছিল, ধান সিদ্ধ হয়েছে কি-না। সেও তাকায় না রহীমার পানে। কথা বলতে গিয়ে মুখে কথা বাধে।

তারপর পূর্ব আকাশ হতে স্বপ্নের মতো ক্ষীণ, শ্লথগতি আলো এসে রাতের অন্ধকার যখন কাটিয়ে দেয় তখন হঠাৎ ওরা দুজনে চমকে উঠে। মজিদ। কখন উঠে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়তে শুরু করেছে। হালকা মধুর কণ্ঠ গ্ৰীষ্ম প্ৰত্যুষের ঝিরঝির হাওয়ার মতো ভেসে আসে!

ওরা তাকায় পরস্পরের পানে। নোতুন। এক দিন শুরু হয়েছে খোদার নাম নিয়ে। তার নামোচ্চারণে সংকোচ কাটে।

 

লোকদের সে যাই বলুক, বতোর দিনে মজিদ। কিন্তু ভুলে যায় গ্রামের অভিনয়ে তার কোন পালা। মাজারের পাশে গত বছরে ওঠানো টিন আর বেড়ার ঘর মগরার পর মগরা ধানে ভরে উঠে। মাজার জেয়ারত করতে এসে লোকেরা চেয়ে চেয়ে দেখে তার ধান। গভীর বিস্ময়ে তারা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে, মজিদকে অভিনন্দিত করে। শুনে মজিদ মুখ গম্ভীর করে। দাড়িতে হাত বুলিয়ে আকাশের পানে তাকায়। বলে, খোদার রহমত। খোদাই রিজিক দেনেওয়ালা। তারপর ইঙ্গিতে মাজারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বলে আর তানার দোয়া।

শুনে কারো কারো চোখ ছলছল করে ওঠে, আর আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠ। কেন আসবে না। ধান হয়েছে এবার। মজিদের ঘরে যেমন মগরাগুলো উপচে পড়ছে ধানের প্রাচুর্যে, তেমনি ঘরো-ঘরে ধানের বন্যা। তবে জীবনে যারা অনেক দেখেছে, যারা সমঝদার, তারা অহঙ্কার দাবিয়ে রাখে। ধানের প্রাচুর্যে কারো কারো বুকে আশঙ্কাও জাগে।

বস্তুত, মজিদকে দেখে তাদের আসল কথা স্মরণ হয়। খোদার রহমত না হলে মাঠে মাঠে ধান হতে পারে না। তাঁর রহমত যদি শুকিয়ে যায়–বষিত না হয়, তবে খামার শূন্য হয়ে খাঁ খাঁ করে। বিশেষ দিনে সে-কথাটা স্মরণ করবার জন্য মজিদের মতো লোকের সাহায্য নেয়। তার কাছেই শোকর গুজার করবার ভাষা শিখতে আসে।

অপূর্ব দীনতায় চোখ তুলে মজিদ বলে, দুনিয়াদারী কী তার কাজ? খোদাতালা অবশ্য দুনিয়ার কাজকামকে অবহেলা করতে বলেননি, কিন্তু যার অন্তরে খোদা-রাসুলের স্পর্শ লাগে, তার কী আর দুনিয়াদারী ভালো লাগে?

—বলে মজিদ চোখ পিট পিট করে–যেন তার চোখ ছলছল করে উঠেছে। যে শোনে সে মাথা নাড়ে ঘন ঘন। অস্পষ্ট গলায় সে আবার বলে, –খোদার রহমত সব।

আরো বলে যে, সে-রহমতের জন্যে সে খোদার কাছে হাজারবার শোেকর গুজার করে। কিন্তু আবার দু-মুঠো ভাত খেতে না পেলেও তার চিন্তা নেই। খোদার ওপর যারা প্ৰাণ-মন-দেহ ন্যস্ত এবং খোদার ওপর যে তোয়াক্কল কবে, তার আবার এসব তুচ্ছ কথা নিয়ে ভাবনা! বলতে বলতে এবার একটা বিচিত্ৰ হাসি ফুটে ওঠে মজিদের মুখে, কোটরাগত চোেখ ঝাপসা হয়ে পরে দিগন্তপ্রসারী দূরত্বে।

কিন্তু আজ সকালে মজিদের সে-চোখে একটা জ্বালাময় ছবি ভেসে ওঠে থেকে থেকে। গনগনে আগুনের পাশে বেগুনি রঙের শাড়ি পর একটি অস্পষ্ট নারীকে দেখে। স্মৃতিতে তার উলঙ্গ বাহু ও কাঁধ আরো শুভ্ৰ হয়ে ওঠে। তার যে-চোখে দিগন্তপ্রসারী দূরত্ব জেগে ওঠে, সে-চোখ ক্রমশ সূক্ষ্ম ও সূচাগ্র তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।

হঠাৎ সচেতন হয়ে মজিদ প্রশ্ন করে,—তোমার কেমন ধান হইল মিঞা?

তুমি বলুক আপনি বলুক সকলকে মিঞা বলে সম্বোধন করার অভ্যাস মজিদের। লোকটি ঘাড় চুলকে নিতিবিতি করে বলে–যা-ই হইছে তাই যথেষ্ট। ছেলেপুলে লইয়া দুই বেলা খাইবার পারুম।

আসলে এদের বড়াই করাই অভ্যাস। পঞ্চাশ মণ। ধান হলে অন্তত একশো মণ বলা চাই। বতোর দিন উঁচিয়ে উঁচিয়ে রাখা ধানের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করানো চাই। লোকটির ধান ভালোই হয়েছে, বলতে গেলে গত দশ বছরে এমন ফসল হয়নি। কিন্তু মজিদের সামনে বড়াই করা তো দূরের কথা, ন্যায্য কথাটা বলতেই তার মুখে কেমন বাধে। তাছাড়া, খোদার কালাম জানা লোকের সামনে ভাবনা কেমন যেন গুলিয়ে যায়। কী কথা বললে কী হবে বুঝে না উঠে সতর্কতা অবলম্বন করে।

কথার কথা বলে মজিদ, তাই উত্তরের প্রতি লক্ষ্য থাকে না। তার অন্তরে ক্রমশ যে-আগুন জ্বলে উঠছে তারই শিখার উত্তাপ অনুভব করে। সে-উত্তাপ ভালোই লাগে।

লোকটি অবশেষে উঠে দাঁড়ায়। তবে যাবার আগে হঠাৎ এমন একটা কথা বলে যে, মজিদ যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। এবং যে-আগুন জ্বলে উঠছিল অন্তরে, তা মুহূর্তে নির্বাপিত হয়।

সংক্ষেপে ব্যাপারটি হলো এই।–গৃহস্থদের গোলায় যখন ধান ভরে ওঠে তখন দেশময় আবার পীরদের সফর শুরু হয়। এই সময়. খাতির-যত্নটা হয়, মানুষের মেজাজটাও খোলসা থাকে। যেবার আকাল পড়ে সেবার অতি ভক্ত মুরিদের ঘরেও দু’দিন গা ঢেলে থাকতে ভরসা। হয় না পীর সাহেবদের।

দিন কয়েক হলো, তিন গ্ৰাম পরে এক পীর সাহেব এসেছেন। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মতলুব খাঁ তাঁর পুরানো মুরিদ। তিনি সেখানেই উঠেছেন।

প্ৰচণ্ড পথশ্ৰম স্বীকার করে এই দূর দেশে আসেন। সে কতদিন আগে তা পীর সাহেবও সঠিকভাবে জানেন না। কিন্তু এ-অজ্ঞতা স্বীকাৰ্য নয় বলে কোনো এক পাঠান বাদশাহের মৃত্যুর সঙ্গে হিসাব মিলিয়ে সে স্মরণীয় আগমনকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ণীত করা হয়। যে দেশ ছেড়ে এসেছেন, সে-দেশের সঙ্গে আজ অবশ্য কোনো সম্বন্ধ নেইকেবল বৃহৎ খড়গনাসা গৌরবর্ণ চেহারাটি ছাড়া। ময়মনসিংহ জেলার কোনো এক অঞ্চলে বংশানুক্ৰমে বসবাস করছেন বলে তাঁদের ভাষাটাও এমন বিশুদ্ধভাবে স্থানীয় রূপ লাভ করেছে যে, মুরিদানির কাজ করবার প্রাক্কালে উত্তরভারতে কোনো এক স্থানে গিয়ে তাঁকে উর্দু জবান এস্তেমাল করে আসতে হয়েছিল।

পীর সাহেবের খ্যাতির শেষ নেই, তার সম্বন্ধে গল্পেরও শেষ নেই। সে-গল্প তাঁর রূহানি তাকত ও কাশফ নিয়ে। মাজারের ছায়ার তলে আছে বলে সমাজে জানাজা-পড়ানো খোনকার-মোল্লার চেয়ে মজিদের স্থান অনেক উচুতে, কিন্তু রূহানি তাকত তার নেই বলে অন্তরে অন্তরে দীনতা বোধ করে। কখনো কখনো খোলাখুলিভাবে লোকসমক্ষে সে-দীনতা ব্যক্তি করে। কিন্তু এমন ভাষায় ও ভঙ্গিতে যে তা মহৎ ব্যক্তির দীনতা প্ৰকাশের পর্যায়ে গিয়ে পড়ে এবং প্ৰতিক্রিয়া লক্ষ্য করে মজিদ নিশ্চিন্ত থাকে।

কিন্তু জাঁদরেল পীররা যখন আশেপাশে এসে আস্তানা গাড়েন তখন কিন্তু মজিদ শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ভয় হয়, তার বিস্তৃত প্ৰভাব কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতো মিলিয়ে যাবে, অন্য এক ব্যক্তি এসে যে বৃহৎ মায়াজাল বিস্তার করবে তাতে সবাই একে একে জড়িয়ে পড়বে।

অন্যের আত্মার শক্তিতে অবশ্য মজিদের খাঁটি বিশ্বাস নেই। আপন হাতে সৃষ্ট মাজারের পাশে বসে দুনিয়ার অনেক কিছুতেই তার বিশ্বাস হয় না। তবে এসব তার অন্তরের কথা, প্ৰকাশের কথা নয়। অতএব কিছুমাত্র বিশ্বাস ছাড়াও সে আশ্চৰ্য ধৈর্যসহকারে অন্যের ক্ষমতার ভূয়সী। প্ৰশংসা করে। বলে, খোদাতালার ভেদ বোঝা কী সহজ কথা? কার মধ্যে তিনি কী বস্তু দিয়েছেন সে কেবল তিনিই বলতে পারেন।

এবার মজিদের মন কিন্তু কদিন ধরে। থমথম করে। সব সময়েই হাওয়ায় ভেসে আসে পীর সাহেবের কার্যকলাপের কথা। এ-দিকে মাজারে লোকদের আসা-যাওয়াও প্ৰায় থেমে যায়। বতোর দিনে মানুষের কাজের অন্ত নেই ঠিক। কিন্তু যে-টুকু অবসর পায় তা তারা ব্যয় করতে থাকে পীর সাহেবের বাতরস-স্ফীত পদযুগলে একবার চুমু দেবার আশায়। পদচুম্বন অবশ্য সবার ভাগ্যে ঘটে না। দিনের পর দিন ভিড় ঠেলে অতি নিকটে পৌঁছেও অনেক সময় বাসনা চরিতার্থ হয় না। সন্নিকটে গিয়ে তার নূরানি চেহারার দীপ্তি দেখে কারো চোেখ ঝলসে যায়, কারো এমন চোখ-ভাসানো কান্না পায় যে, আর এগোবার আশা ত্যাগ করতে হয়। ভাগ্যবান যারা, তারা পীর সাহেবের হাতের স্পর্শ হতে শুরু করে দু-এক শব্দ আদেশ-উপদেশ বা তামাক-গন্ধ-ভারী বুকের হাওয়াও লাভ করে।

রাত্ৰে বিছানায় শুয়ে মজিদ গম্ভীর হয়ে থাকে। রহীমা গা টেপে, কিন্তু টেপে যেন আস্ত পাথর। অবশেষে মজিদকে সে প্রশ্ন করে, —আপনার কী হইছে?

মজিদ কিছু বলে না।

উত্তরের জন্যে কতক্ষণ অপেক্ষা করে রহীমা হঠাৎ বলে,–এক পীর সাহেব আইছেন না হেই গোরামে, তানি নাকি মরা মাইনষেরে জিন্দা কইরা দেন?

পাথর এবার হঠাৎ নড়ে। আবছা অন্ধকারে মজিদের চোখ জ্বলে ওঠে। ক্ষণকাল নীরব থেকে হঠাৎ কটমট করে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে,—মরা মানুষ জিন্দা হয় ক্যামনে?

প্রশ্নটা কৌতুহলের নয় দেখে রহীমা দমে গেলো। তারপর আর কোনো কথা হয় না। এক সময় রহীমা পাশে শুয়ে আলগোছে ঘুমিয়ে পড়ে।

মজিদ ঘুমোয় না। সে বুঝেছে, ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে, এবার কিছু একটা না করলে নয়। আজও অপরাহ্নে সে দেখেছে, মতিগঞ্জের সড়কটা দিয়ে দলে দলে লোক চলছে উত্তর দিকে।

মজিদ ভাবে আর ভাবে। রাত যত গভীর হয় তত আগুন হয়ে ওঠে মাথা। মানুষের নিৰ্বোধি বোকামির জন্যে আর তার অকৃতজ্ঞতার জন্যে একটা মারাত্মক ক্রোধ ও ঘূণা, উষ্ণ রক্তের মধ্যে টগবগ করতে থাকে। সে ছটফট করে একটা নিস্ফল ক্ৰোধে।

এক সময় ভাবে, ঝালার-দেওয়া সালু কাপড়ে আবৃত৷ নকল মাজারটিই এদের উপযুক্ত শিক্ষা, তাদের নিমকহারামির যথার্থ প্রতিদান। ভাবে, একদিন মাথায় খুন চড়ে গেলে সে তাদের বলেই দেবে আসল কথা। বলে দিয়ে হাসবে হা-হা করে গগন বিদীর্ণ করে। শুনে যদি তাদের বুক ভেঙে যায়। তবেই তৃপ্ত হবে তার রিক্ত মন। মজিদ তার ঘরবাড়ি বিক্ৰী করে সরে পড়বে দুনিয়ার অন্য পথে-ঘাটে। এ-বিচিত্র বিশাল দুনিয়ায় কী যাবার জায়গার কোনো অভাব আছে?

অবশ্য এ-ভাবনা গভীর রাতে নিজের বিছানায় শুয়েই সে ভাবে। যখন মাথা শীতল হয়, নিম্বফল ক্ৰোধ হতাশায় গলে যায়, তখন সে আবার গুম হয়ে থাকে। তারপর শ্ৰান্ত, বিক্ষুব্ধ মনে হঠাৎ একটি চিকন বুদ্ধিরশ্মি প্ৰতিফলিত হয়।

শীঘ্ৰ তার চোখ দুটি চকচক করে ওঠে, শ্বাস দ্রুততর হয়। উত্তেজনায় আধা উঠে বসে অন্ধকার ভেদ করে রহীমার পানে তাকায়। পাশে সে অঘোর ঘুমে বেচাইন। একটি হাঁটু উলঙ্গ হয়ে মজিদের দেহ ঘেঁষে আছে।

তাকেই অকারণে কয়েক মুহুর্ত চেয়ে চেয়ে দেখে মজিদ, তারপর আবার চিৎ হয়ে শুয়ে চোখখোলা মৃতের মতো পড়ে থাকে।

 

মজিদ যখন আওয়ালপুর গ্রামে পৌঁছলো তখন সূৰ্য হেলে পড়েছে। মতলুব মিঞার বাড়ির সাননেকার মাঠ লোকে-লোকারণ্য। তারই মধ্যে কোথায় যে পীর সাহেব বসে আছেন বোঝা মুশকিল। মজিদ বেঁট মানুষ। পায়ের আঙলে দাঁড়িয়ে বকের মতো গলা বাড়িয়ে পীর সাহেবকে একবার দেখবার চেষ্টা করে। কিন্তু কালো মাথার সমুদ্রে দৃষ্টি কেবল ব্যাহত হয়ে ফিরে আসে।

একজন বললে যে, বটগাছটার তলে তিনি বসে আছেন। তখন মাঘের শেষাশেষি। তবু জন-সমুদ্রের উত্তাপে পীর সাহেবের গরম লেগেছে বলে তাঁর গায়ে হাতীর কানের মতো মস্ত ঝালরওয়ালা পাখা নিয়ে হাওয়া করছে একটি লোক; কেবল সেই পাখাটা থেকে থেকে নজরে পড়ে।

মূখ তুলে রেখে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগল মজিদ। সামনে শত শত লোক সব বিভোর হয়ে বসে আছে, কেউ কাউকে লক্ষ্য করবার কথা নয়। মজিদকে চেনে এমন লোক ভিড়ের মধ্যে অনেক আছে বটে, কিন্তু তারা কেউ আজ তাকে চেনে না। যেন বিশাল সূর্যোদয় হয়েছে, আর সে-আলোয় প্ৰদীপের আলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

পীর সাহেব আজ দফায় দফায় ওয়াজ করেছেন। যখন ওয়াজ শেষ করে তিনি বসে পড়েন তখন অনেকক্ষণ ধরে তাঁর বিশাল বাপু দ্রুত শ্বাসের তালে তালে ওঠা-নমা করে, আর শুভ্র চওড়া কপালে জমে ওঠা বিন্দু-বিন্দু ঘাম খোলা মাঠের উজ্জল আলোয় চকচক করে। পাখা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি জোরে হাত চালায়।

এ-সময় পীর সাহেবের প্রধান মুরিদ মতলুব মিঞা হুজুরের গুণাগুণ সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করে বলে। এ-কথা সর্বজনবিদিত যে, সে বলে, পীর সাহেব সূৰ্যকে ধরে রাখবার ক্ষমতা রাখেন। উদাহরণ দিয়ে বলে হয়তো তিনি এমন এক জরুরী কাজে আটকে আছেন যে, ওধারে জোহরের নামাজের সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা হলে কী হবে, তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত না হুকুম দেবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত সূৰ্য এক আঙলি নড়তে পারে না! শুনে কেউ আহা-আহা বলে, কারো-বা। আবার ডুকরে। কান্না আসে। কেবল মজিদের চেহারা কঠিন হয়ে ওঠে। সজোরে নড়তে থাকা পাখাটার পানে তাকিয়ে সে মূর্তিবৎ বসে থাকে।

আধা ঘণ্টা পরে শীতল দ্বিপ্ৰাহরিক আমেজে জনতা ঈষৎ ঝিমিয়ে এসেছে, এমনি সময়ে হঠাৎ জমায়েতের নানাস্থান থেকে রব উঠল। একটা ঘোষণা মুখে মুখে সারা ময়দানে ছড়িয়ে পড়ল।—গীর সাহেব আবার ওয়াজ করবেন।

পীর সাহেবের আর সে-গলা নেই। সূক্ষ্ম তারের কম্পনের মতো হাওয়ায় বাজে তাঁর গলা। জমায়েতের কেউ প্ৰতি মুহুর্তে হা-হা করে উঠেছে বলে সে-ক্ষীণ আওয়াজও সব প্ৰান্তে শোনা যায় না। কিন্তু, মজিদ কান খাড়া করে শোনে, এবং শোনবার প্রচেষ্টার ফলে চোখ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।

পীর সাহেবের গলার কম্পমান সূক্ষ্ম তারের মতো ক্ষীণ আওয়াজই আধা ঘণ্টা ধরে বাজে। তারপর বিচিত্র সুর করে তিনি একটা ফারসি বায়েত বলে ওয়াজ ক্ষান্ত করেন।

বলেন, সোহবতে সোয়ালে তুরা সোয়ালে কুনাদ (সুসঙ্গ মানুষকে ভালো করে)। শুনে জমায়েতের অর্ধেক লোক কেঁদে ওঠে। তারপর তিনি যখন বাকীটা বলেন–সোেহবতে তোয়ালে তুরা তোয়ালে কুন্নাদ (কুসঙ্গ তেমনি তাকে আবার খারাপ করে।)–তখন গোটা জমায়েতেরই সমস্ত সংযমের বাঁধ ভেঙে যায়, সকলে হাউ-হাউ করে কেঁদে ওঠে।

বসে পড়ে পীর সাহেব পাখাওয়ালার পানে লাল হয়ে ওঠা চোখে তাকিয়ে পাখ-সঞ্চালন দ্রুততর করবার জন্য ইশারা করছেন এমন সময়ে সামনের লোকেরা সব ছুটে গিয়ে পীর সাহেবকে ঘেরাও করে ফেলল। হঠাৎ পাগল হয়ে উঠেছে তারা। যে যা পারল ধরলকেউ পা, কেউ হাত, কেউ আস্তিনের অংশ।

তারপর এক কাণ্ড ঘটল। মানুষের ভাবমত্ততা দেখে পীর সাহেব অভ্যস্ত। কিন্তু আজকের ক্ৰন্দনরত জমায়েতের নিকটবতী লোকগুলোর সহসা এই আক্রমণ তাঁর বোধ হয় সন্থ হলো না। তিনি হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যুবকের সাবলীল সহজ ভঙ্গিতে মাথার ওপরে গাছটার ডালে উঠে গেলেন। দেখে হায় হায় করে উঠল। পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গরা আর তা শুনে জমায়েতও হায় হায় করে উঠল। সাঙ্গপাঙ্গরা তখন সুর করে গীত ধরলে এই মর্মে যে, তাদের পীর সাহেব তো শূন্যে উঠে গেছেন, এবার কী উপায়?

পীর সাহেব অবশ্য ডালে বসে তখন দিব্যি বাতরস-ভারী পা দোলাচ্ছেন। ফাগুনের আগুনের দ্রুত বিস্তারের মতো পীর সাহেবের শূন্যে ওঠার কথা দেখতে না দেখতে ছড়িয়ে গেলো। যারা তখন ফারসি বয়েতের অর্থ না বুঝে কেবল সুর শুনেই কেঁদে উঠেছিল, এবার তারা মড়া-কান্না জুড়ে বসল। পীর সাহেব কী তাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছেন? কিন্তু গেলে, অজ্ঞ মুর্থ তারা পথ দেখবে কী করে?

জোয়ারী ঢেউ-এর মতো সম্মুখে ভেসে এল জনস্রোত। অনেক মড়া-কান্না ও আকুতি-বিকুতির পর পীর সাহেব বৃক্ষডাল হতে অবশেষে অবতরণ করলেন।

বেলা তখন বেশ গড়িয়ে এসেছে, আর মাঠের ধারে গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘতর হয়ে সে মাঠেরই বুক পর্যন্ত পৌঁছেছে, এমন সময় পীর সাহেবের নির্দেশে একজন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, —ভাই সকল, আপনার সব কাতারে দাঁড়াইয়া যান।

কয়েক মুহুর্তের মধ্যে নামাজ শুরু হয়ে গেলো।

নামাজ কিছুটা অগ্রসর হয়েছে এমন সময় হঠাৎ সাবা মাঠটা যেন কেঁপে উঠল। শতশত নামাজ-রত মানুষের নীরবতার মধ্যে খ্যাপা কুকুরের তীক্ষ্মতায় নিঃসঙ্গ একটা গল আর্তনাদ করে উঠল।

সে-কণ্ঠ মজিদের।

—যতসব শয়তানি, বেদাতি কাজকারবার। খোদার সঙ্গে মস্কারা! নামাজ ভেঙে কেউ কথা কইতে পারে না। তাই তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাই নীরবে মজিদের অশ্রাব্য গালাগালি শুনলে।

মোনাজাত হয়ে গেলে সাঙ্গাপাঙ্গদের তিনজন এগিয়ে এল। একজন কঠিন গলায় প্রশ্ন করল, –চাঁচামিচি করত কিছকা ওয়াস্তে?

লোকটি আবার পশ্চিমে এলেম শিখে এসে অবধি বাংলা জবানে কথা কয় না।

মজিদ বললে,–কোন নামাজ হইলো এটা?

—কাহে? জোহরকা নামাজ হুয়া।

উত্তর শুনে আবার চীৎকার করে গালাগাল শুরু করল মজিদ। বললে, এ কেমন বেশরিয়তি কারবার, আছরের সময় জোহরের নামাজ পড়া?

সাঙ্গাপাঙ্গরা প্ৰথমে ভালোভাবেই বোঝাতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা। তারা বললে যে, মজিদ তো জানেই পীর সাহেবের হুকুম ব্যতীত জোহরের নামাজের সময় যেতে পারে না। পশ্চিম থেকে এলেম শিখে এসেছে, সে বোঝানোর পস্থাটা প্ৰায় বৈজ্ঞানিক করে তোলে। সে বলে যে, যেহেতু, ভাদ্রমাস থেকে ছায়া আসলী এক-এক কদম করে বেড়ে যায়, সেহেতু, দুকদমের ওপর দুই লাঠি হিসেব করে চমৎকার জোহরের নামাজের সময়ে আছে।

মজিদ বলে, মাপো। এবং পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গরা যতদূর সম্ভব দীর্ঘ দীর্ঘ ছয় কদম ফেলে তার সঙ্গে দুই লাঠি যোগ করেও যখন ছায়ার নাগাল পেল না। তখন বললে, তর্ক যখন শুরু হয়েছিল তখন ছায়া ঠিক নাগালের মধ্যেই ছিল।

শুনে মজিদ কুৎসিততমভাবে মুখ বিকৃত করে। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকবার মুখ খিস্তি করে বললে,–কেন, তখন তোগো পীর ধইরা রাখবার পারল না সুরুযটারে?

তারপর সরে গিয়ে সে বজ্ৰকণ্ঠে ডাকলে,–মহব্বতনগর যাইবেন কে কে?

মহব্বতনগর গ্রামের লোকেরা এতক্ষণ বিমূঢ় হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল। কারো মনে ভয়ও হয়েছিল।–এই বুঝি পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গরা ঠেঙিয়ে দেয় মজিদকে! এবার তার ডাক শুনে একে একে তারা ভিড় থেকে খসে এল।

মতিগঞ্জের সড়কে উঠে ফিরতিমুখো পথ ধরে মজিদ একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে থুথু ফেলে, তওবা কেটে, নিশ্বাসের নীচে শয়তানকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করল, তারপর দ্রুতপায়ে হাঁটিতে লাগল। সঙ্গের লোকেরা কিন্তু কিছু বললে না। তারা যদিও মজিদকে অনুসরণ করে বাড়ি ফিরে চলেছে কিন্তু মন তাদের দোটানার দ্বন্দ্বে দোল খায়। চোখে তাদের এখনো অশ্রদ্ধর শুষ্ক রেখা।

সে-রাত্রে ব্যাপারীকে নিয়ে এক জরুরী বৈঠক বসল। সবাই এসে জমলে, মজিদ সকলের পানে কয়েকবার তাকাল। তার চোখ জ্বলছে একটা জ্বালাময়ী অথচ পবিত্র ক্ৰোধে। শয়তানকে ধ্বংস করে মুখ, বিপথচালিত মানুষদের রক্ষা করার কল্যাণকর বাসনায় সমস্ত সত্তা সমুজ্জল হয়ে উঠেছে।

মজিদ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য পেশ করল।–ভাই সকলরা, সকলে অবগত আছেন যে, বেদাতি কোনো কিছু খোদাতালার অপ্রিয়, এবং সেই থেকে সত্যিকার মানুষ যারা তাদেরকে তিনি দূরে থাকতে বলেছেন। এ-কথাও তারা জানে যে, শয়তান মানুষকে প্ৰলুব্ধ করবার জন্যে মনোমুগ্ধকর রূপ ধারণ করে তার সামনে উপস্থিত হয় এবং অত্যন্ত কৌশল সহকারে তাকে বিপথে চালিত করবার প্রয়াস পায়। শয়তানের সে-রূপ যতই মনোমুগ্ধকর হোক না কেন, খোদার পথে যারা চলাচল করে তাদের পক্ষে সে-মুখোশ চিনে ফেলতে বিন্দুমাত্র দেরী হয় না। তাছাড়া শয়তানের প্রচেষ্টা যতই নিপুণ হোক না কেন, একটি দুর্বলতার জন্যে তার সমস্ত কারসাজি ভণ্ডুল হয়ে যায়। তা হলো বেদাঁতি কাজকারবারের প্রতি শয়তানের প্রচণ্ড লোভ। এখানে এ-কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, শয়তান যদি মানুষকে খোদার পথেই নিয়ে গেলো, তাহলে তার শয়তানি রইল কোথায়।

ভনিতার পর মজিদ আসল কথায় আসে। একটু দম নিয়ে সে আবার তার বক্তব্য শুরু করে।—আউয়ালপুরে তথাকথিত যে-গীর সাহেবের আগমন ঘটেছে তার কার্যকলাপ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে উক্ত মন্তব্যের যথার্থতা প্ৰমাণিত হয়। মুখোশ তার ঠিকই আছে— যে মুখোশকে ভুল করে মানুষ তাঁর কবলে গিয়ে পড়বে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য মানুষকে বিপথে নেয়া, খোদার পথ থেকে সরিয়ে জাহান্নামের দিকে চালিত করা। সেই উদ্দেশ্যই তথাকথিত পীরটি কৌশলে চরিতার্থ করবার চেষ্টায় আছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য খোদা সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু একটা ভুয়ো কথা বলে তিনি এতগুলো ভালো মানুষের নামাজ প্ৰতিদিন মকরূহ করে দিচ্ছেন। তাঁর চক্রান্তে পড়ে কত মুসল্লি ইমানদার মানুষ–যাঁরা জীবনে একটিবার নামাজ কাজ করেননি তাঁরা খোদার কাছে গুণাহ্‌ করছেন।

এই পর্যন্ত বলে বিস্ময়াহত স্তব্ধ লোকগুলোর পানে মজিদ। কতক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর আরো কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাড়িতে হাত বুলায়।

গলা কেশে এবার খালেক ব্যাপারী বৈঠকের পানে তাকিয়ে বাজাখাই গলায় প্রশ্ন করে, হুনলেন তো ভাই সকল?

সাব্যস্ত হলো, অন্তত, এ-গ্রামের কোনো মানুষ পীর সাহেবের ক্রিসীমানায় ঘেঁষবে না।

এরপর মহব্বতনগরের লোক আওয়ালপুরে একেবারে গেলো যে না, তা নয়। কিন্তু গেলো অন্য মতলবে। পরদিন দুপুরেই একদল যুবক মজিদকে না জানিয়ে একটা জেহাদী জোশে বলীয়ান হয়ে পীর সাহেবের সভায় গিয়ে উপস্থিত হলো। এবং পরে তারা বড় সড়কটার উত্তর দিকে না গিয়ে গেলো দক্ষিণ দিকে করিমগঞ্জে। করিমগঞ্জে একটি হাসপাতাল আছে।

অপরাহ্নে সংবাদ পেয়ে মজিদ ক্যানভাসের জুতো পরে ছাতা বগলে করিমগঞ্জ গেলো। হাসপাতালে। আহত ব্যক্তিদের পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরে শয়তান ও খোদার কাজের তারতম্য আরো বিষদভাবে বুঝিয়ে বলল, বেহেস্ত ও দোজখের জলজ্যান্ত বৰ্ণনাও করল। কতক্ষণ।

কালু মিঞা গোঙায়। চোখে তার বেদনার পানি। সে বলে শয়তানের চেলারা তার মাথাটা ফাটিয়ে দুফাঁক করে দিয়েছে। মজিদ তাকিয়ে দেখে, মস্ত ব্যাণ্ডেজ তার মাথায়। দেখে সে মাথা নাড়ে, দাড়িতে হাত বুলায়, তারপর দুনিয়া যে মস্ত বড় পরীক্ষা-ক্ষেত্র তা মধুর সুললিত কণ্ঠে বুঝিয়ে বলে। কালু মিঞা শোনে কি-না কে জানে, একঘেয়ে সুরে গোঙাতে থাকে।

রাতে এশার নামাজ পড়ে বিদায় নিতে মজিদ হঠাৎ অন্তরে কেমন বিস্ময়কর ভাব বোধ করে। কম্পাউণ্ডারকে ডাক্তার মনে করে বলে,—পোলাগুলিরে একটু দেখবেন। ওরা বড় ছোয়াবের কাম করছে! ওদের যত্ন নিলে আপনারও ছোয়াব হইবো।

ভাঙ-গাঁজা খাওয়া রসকষশূন্য হাড়গিলে চেহারা কম্পাউণ্ডারের। প্ৰথমে দুটো পয়সার লোভে তার চোখ চকচক করে উঠেছিল, কিন্তু ছোয়াবের কথা শুনে একবার আপাদমস্তক মজিদকে দেখে নেয়। তারপর নিরুত্তরে হাতের শিশিটা ঝাকাতে ঝাকাতে অন্যত্র চলে যায়।

গ্রামে ফিরে মজিদ কালু মিঞার বাপের সঙ্গে দুচারটি কথা কম। বুড়ো এক ছিলিম তামাক এনে দেয়। মজিদ নিজে গিয়ে ছেলেকে দেখে এসেছে বলে কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ছলছল করে। হুক তুলে নেবার আগে মজিদ বলে,–কোনো চিন্তা করবান মিঞা, খোদা ভরসা। তারপর বলে যে, হাসপাতালের বড় ডাক্তারকে সে নিজেই বলে এসেছে, ওদের ষেন আদর ষত্ন হয়। ডাক্তারকে অবশ্য কথাটা বলার কোনো প্ৰয়োজন ছিল না, কারণ, গিয়ে দেখে, এমনিতেই শাহী কাণ্ডকারখানা। ওষুধপত্র বা লেবা শুশ্ৰষার শেষ নেই।

খুব জোরে দম কষে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে আরো শোনায় যে, তবু তার কথা শুনে ডাক্তার বললেন, তিনি দেখবেন ওদের যেন অযত্ন বা তকলিফ না হয়। তারপর আরেকটা কথার লেজুড় লাগায়। কথাটা অবশ্য মিথ্যে; এবং সজ্ঞানে সুস্থ দেহে মিথ্যে কথা কয় বলে মনে মনে তাওবা কাটে। কিন্তু কী করা যায়; দুনিয়াটা বড় বিচিত্র জায়গা। সময়-অসময়ে মিথ্যে কথা না বললে নয়।

বলে, ডাক্তার সাহেব তার মুরিদ কি-না তাই সেখানে মজিদের বড় খাতির।

 

বাইরে নিরুদ্বিগ্ন ও স্বচ্ছন্দ থাকলেও ভেতরে ভেতরে মজিদের মন ক-দিন ধরে চিন্তায় ঘুরপাক খায়। আওয়ালপুরে যে-গীর সাহেব আস্তানা গেড়েছে তিনি সোজা লোক নন। বহু পুরুষ আগে দীর্ঘ পথশ্ৰম স্বীকার করে আবক্ষ দাড়ি নিয়ে শানদার জোব্ববাজুব্বা পরে যে লোকটি এ-দেশে আসেন, তাঁর রক্ত ভাটির দেশের মেঘ পানিতেও একেবারে আ-নোনা হয়ে যায়নি। পানসা হয়ে গিয়ে থাকলেও পীর সাহেবের শরীরে সে-ভাগ্যান্বেষী দুঃসাহসী ব্যক্তিরই রক্ত। কাজেই একটা পাল্টা জবাবের অস্বস্তিকর প্ৰত্যাশায় থাকে৷ মজিদ। মহকবতনগরের লোকেরা আর ওদিকে যায় না। কাজেই, আক্রমণ যদি একান্ত আসেই, আগেভাগে তার হদিশ পাবার জো নেই। সে-জন্যে মজিদের মনে অস্বস্তিটা রাতদিন আরো খচখচ করে।

মজিদ ও তরফ থেকে কিছু একটা আশা করলে কী হবে, তিনগ্রাম ডিঙিয়ে মহকবতনগরে এসে হামলা করার কোনো খেয়াল পীর সাহেবের মনে ছিল না। তার প্রধান কারণ তাঁর জঙ্গীফ অবস্থা। এ-বয়সে দাঙ্গাবাজি হৈ হাঙ্গামা আর ভালো লাগে না। সকরোদদের মধ্যে কেউ কেউ, বিশেষ করে প্রধান মুরিদ মতলুব খাঁ একটা জঙ্গী ভাব দেখালেও হুজুরের নিস্পৃহতা দেখে শেষ পর্যন্ত তারা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পীর সাহেব অপরিসীম উদারতা দেখিয়ে বলেন, কুত্তা তোমাকে কামড়ালে তুমিও কী উলটে তাকে কামড়ে দেবে? যুক্তি উপলব্ধি করে সাকরেদর নিরস্ত হয়। তবু স্থির করে যে, মজিদ কিংবা তার চেলারা যদি কেউ এধারে আসে। তবে একহাত দেখে নেওয়া যাবে। সে-দিন কালুদের কল্লা যে ধড় থেকে আলাদা করতে পারেনি, সে-জন্যে মনে প্ৰবল আফসোস হয়।

গ্রামের একটি প্রাণী। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ করে না। সে অন্দরের লোক, আর তার তাগিদটা প্ৰায় বাঁচা-মিরার মতো জোরাল। পীর সাহেবের সাহায্যের তার একান্ত প্রয়োজন। না হলে জীবন শেষ পৰ্যন্ত বিফলে যায়।

সে হলো খালেক ব্যাপারীর প্রথম বিবি আমেনা। নিঃসন্তান মানুষ। তেরো বছর বয়সে বিয়ে করেছিল, আজ তিরিশ পেরিয়ে গেছে। শূন্য কোল নিয়ে হা-হুতাশের সঙ্গে বুক বেঁধে তবু থাকা যেত, কিন্তু চোখের সামনে সতীন তনু বিবিকে ফি-বৎসর আস্ত আস্ত সন্তানের জন্ম দিতে দেখে বড় বিবির আর সন্থ হয় না। দেখা সওয়ার একটা সীমা আছে, যা পেরিয়ে গেলে তার একটা বিহিত করা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আওয়ালপুরে পীর সাহেবের আগমন সংবাদ পাওয়া অবধি আমেনা বিবি মনে একটা আশা পোষণ করছিল যে, এবার হয়তো বা একটা বিহিত করা যাবে। আগামী বছর তনু বিবির কোলে যখন নোতুন। এক আগন্তুক ট্যা-ট্যা করে উঠবে তখন সেও কণ্ঠ কাতর করে বলতে পারবে, তার গাটা কেমন-কেমন করছে, বুক ঠেলে কেবল যেন বমি আসতে চায়। তখন নানিবুড়ীর ডাক পড়বে। শেষে নানিবুড়ী মাথা নেড়ে হেসে রসিকতা করে বলবে, ওস্তাদের মীর শেষ কাটালে। কারণ যৌবনের দিক থেকে সে তানু বিবির মতো জোয়ার-লাগা ভরাগাঙ না হলেও একেবারে টসকোনো নয়, বোঁচা-চ্যাবকা কালো মানুষও নয়। রঙে ছাতা পড়বার উপক্রম করলেও এখনো সে-রঙ ধবধব করে, নাকে সতীনের মতো জ্বলজ্বলে নাকছবি না থাকলেও তা খাড়া, টিকালে। তার সন্তান আকাশের চাঁদের মতো সুন্দর হবেই।

কিন্তু মুশকিল হলো কথাটা পাড়া নিয়ে। প্রথমত, ব্যাপারীকে নিরালা পাওয়া দুষ্কর। দ্বিতীয়ত, চোখের পলকের জন্যে পেলেও তখন আবার জিহবা নড়ে না। ফিকির ফন্দি করতে করতে এ-দিকে মজিদ কাণ্ডটা করে বসল। কিন্তু আমেনা বিবি মরিয়া হয়ে উঠেছে। সুযোগটা ছাড়া যায় না। সারা জীবন যে মেয়েলোকের সন্তান হয়নি, পীর সাহেবের পানিপড়া খেয়ে সে-ও কোলে ছেলে পেয়েছে।

একদিন লজ-শরমের বালাই ছেড়ে আমেনা বিবি বলেই বসে, পীর সাবের থিক একটু পানিপড়া আইনা দেন না।

শুনে অবাক হয় ব্যাপারী। নিটোল স্বাস্থ্য বিবির, কোনোদিন জ্বরজারি, পেট-কামড়ানি পর্যন্ত হয় না।

—পানিপড়া ক্যান? আমেনা বিবি লজ্জা পেয়ে আলগোছে ঘোমটা টেনে সেটি আরো দীর্ঘতর করে, আর তার মনের কথা ব্যাপারী যেন বিনা উত্তরেই বোঝে।— তাই দোয়া করে মনে মনে।

উত্তর পায় না বলেই ব্যাপারী বোঝে। তারপর বলে,-আইচ্ছা। কিন্তু পরীক্ষণেই মনে পড়ে যে, পীর সাহেবের ত্ৰিসীমায় আর তো ঘোষা যায় না, অবশ্য পীর সাহেবকে মজিদ খোদ ইবলিশ শয়তান বলে ঘোষণা করলেও তবু বউ-এর খাতিরে পানিপড়ার জন্যে তাঁর কাছে যেতে বাধত না, কারণ পীর নামের এমন মাহাত্ম্য যে, শয়তান ডেকেও সে নামকে অন্তরে অন্তরে লেবাস-মুক্ত করা যায় না। গাভুরি-চাষী-মাঠাইলারা পারলেও অন্তত বিস্তর জমিজমার মালিক খালেক ব্যাপারী তা পারে না। কিন্তু সাধারণ লোকে যেটা স্বচ্ছন্দে করতে পারে সেটা আবার তার দ্বারা সম্ভব নয়। তা হলো শয়তানকে শয়তান ডেকে সমাজের সামনে ভরদুপুরে তাকে আবার পীর ডাকা। এবং সমাজের মূল হলো একটি লোক–যার আঙুলের ইশারায় গ্রাম ওঠে বসে, সাদাকে কালো বলে, আসমানকে জমিন বলে। সে হলো মজিদ। জীবনস্রোতে মজিদ আর খালেক ব্যাপারী কী করে এমন খাপে খাপে মিলে গেছে যে, অজান্তে অনিচ্ছায়ও দুজনের পক্ষে উলটো পথে যাওয়া সম্ভব নয়। একজনের আছে মাজার, আরেক জনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না। জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক।

সে জন্যে সে ভাবিত হয়, দু’দিন আমেনা বিবির কান্নাসজল কণ্ঠের আকুতি মিনতি উপেক্ষা করে। অবশেষে বিবির কাতর দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরেই হয়তো একটা উপায় ঠাহর করে ব্যাপারী।

ঘরে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর এক ভাই থাকে। নাম ধলামিঞা। বোকা কিছিমের মানুষ, পরের বাড়িতে নির্বিবাদে খায় দায় ঘুমায়, আর বোন জামাইয়ের ভাত এতই মিঠা লাগে যে, নড়ার নাম করে না বছরান্তেও। আড়ালে আড়ালে থাকে। কাচিৎ কখনো দেখা হয়ে গেলে দুটি কথা হয় কি হয় না, কোনোদিন মেজাজ ভালো থাকলে ব্যাপারী হয়তো-বা শালার সঙ্গে খানিক মস্করাও করে।

তাকে ডেকে ব্যাপারী বললে : একটা কাম করেন। ধলামিঞা?

ব্যাপারীর সামনে বসে কথা কইতে হলে চরম অস্বস্তি বোধ করে সে। কেমন একটা পালাই-পালাই ভাব তাকে অস্থির করে রাখে। কোনোমতে বলে, –কী কন দুলামিঞা?

কী তার কাজ ব্যাপারী। আগাগোড়া বুঝিয়ে বলে। আগে প্রথম বিবির দিলের খায়েশের কথা দীর্ঘ ভনিতাসহকারে বর্ণনা করে। তারপর বলে, ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়, এবং আওয়ালপুর তাকে রওয়ানা হতে হবে শেষরাতের অন্ধকারে, যাতে কাকপক্ষীও খবর না পায়। আর সেখানে গিয়ে তাকে প্রচুর সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ গ্রাম থেকে গেছে। এ-কথা ঘূণাক্ষরেও বলতে পারবে না। বলবে যে, করিমগঞ্জের ওপারে তার বাড়ি। বড় বিপদে পড়ে এসেছে পীর সাহেবের দোয়াপানির জন্যে। তার এক নিকটতম নিঃসন্তান আত্মীয়ার একটা ছেলের জন্যে বড় সখা হয়েছে। সখের চেয়েও যেটা বড় কথা, সেটা হলো এই যে, শেষ পর্যন্ত কোনো ছেলেপুলে যদি না-ই হয় তবে বংশে বাতি জ্বালাবার আর কেউ থাকবে না। মোট কথা, ব্যাপারটা এমন করুণভাবে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, শুনে পীর সাহেবের মন গলে যেন পানি হয়ে যায়।

বিবির বড় ভাই, কাজেই রেস্তায় মুরুবিবা। তবু ধমকে ধামকে কথা বলে ব্যাপারী। পরগাছা মুরুবিকে আবার সম্মান, তার সঙ্গে আবার কেতাদুরন্ত কথা।

—কি গো ধলামিঞা, বুঝলান নি। আমার কথাডা?

–জি, বুঝছি। কাঁধ পর্যন্ত ঘাড় কাৎ করে ধলামিঞা জবাব দেয়। প্ৰস্তাব শুনে মনে মনে কিন্তু ভাবিত হয়। ভাবনার মধ্যে এই যে, আওয়ালপুর ও মহব্বতনগরের মাঝপথে একটা মস্ত তেঁতুল গাছ পড়ে, এবং সবাই জানে যে, সেটা সাধারণ গাছ নয়, দস্তুরমতে দেবংশি।

কাকপক্ষী যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন অনেক রাত। অত রাতে কী একাকী ঐ তেঁতুল গাছের সন্নিকটে ঘোষা যায়? ভাবনার মধ্যে এও ছিল যে, যে-সব দাঙ্গাহাঙ্গামার কথা শুনেছে, তারপর কোন সাহসে পা দেয় মতলুব খাঁর গ্রামে। তেঁতুল গাছের ফাঁড়িটা কাটলেও ঐখানে গিয়ে পীর সাহেবের দজলা সাঙ্গাপাঙ্গদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া নেহাত সহজ হবে না। নিজের পরিচয় নিশ্চয়ই সে লুকোবার চেষ্টা করবে, কিন্তু ধরা পড়ে যাবে না, কী বিশ্বাস! কে কখন চিনে ফেলে কিছু ঠিক নেই। যে ঢেঙা লম্বা, ধলামিঞা।

–ভাবেন কী? হুমকি দিয়ে ব্যাপারী প্রশ্ন করে।

–জি, কিছু না! তবু কয়েক মুহুর্ত তার পানে চেয়ে থেকে ব্যাপারী বলে,–আরেক কথা। কথাডা যানি আপনার বইনে না। হুনে। আপনারে আমি বিশ্বাস করলাম।

–তা করবার পারেন।

সারাদিন ধলামিঞা ভাবে, ভাবে। ভাবতে ভাবতে ধলামিঞার কালামিঞা বনে যাবার যোগাড়। বিকেলের দিকে কিন্তু একটা বুদ্ধি গজায়। ব্যাপারীর অনুপস্থিতির সুযোগে বাইরের ঘরে বসে। নলের হুঁকায় টান দিচ্ছিল, হঠাৎ সেটা নামিয়ে রেখে সে সরাসরি বাইরে চলে যায়। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ পা ফেলে। হাঁটিতে থাকে মোদাচ্ছের পীরের মাজারের দিকে। হাঁটার ঢঙে দেখে পথে দুচারজন লোক থ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।—তারা ভ্ৰক্ষেপ নেই।

বাইরেই দেখা হয় মজিদের সঙ্গে। গাছতলায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা কইছে। কাছে গিয়ে গলা নীচু করে সে বললে,–আপনার লগে একটু কথা আছিল।

গলাটা বিনয়ে নম্র হলেও উত্তেজনায় কাঁপছে।

খালেক ব্যাপারী তখন যে-দীর্ঘ ভনিতা সহকারে আমেনা বিবির মনের ইচ্ছার কথা প্ৰকাশ করেছিল, তারই ওপর রঙ ফেনিয়ে, এখানে-সেখানে দরদের ফোটা ছিটিয়ে, এবং ফেনিয়ে-ফুলিয়ে দীর্ঘতর কোরে ধলামিঞা কথা পাড়ে। বলে, মেয়েমানুষের মন, বড় অবুঝ। নইলে সাক্ষাৎ ইবলিশ শয়তান জেনেও তারই পানিপীড়া খাবার সাধ জাগবে কেন আমেনা বিবির? কিন্তু মেয়েমানুষ যখন পুরুষের গলা জড়িয়ে ধরে তখন আর নিস্তার থাকে না। খালেক ব্যাপারী আর কী করে। ধলামিঞাকে ডেকে বলে দিলো, আওয়ালপুরে গিয়ে পীর সাহেবটির কাছ থেকে সে যেন পানিপড়া নিয়ে আসে।

মজিদ। নীরবে শোনে। হঠাৎ তার মুখে ছায়া পড়ে। কিন্তু ক্ষণকালের জন্যে। তারপর সহজ গলায় প্রশ্ন করে,—তা কখন যাইবেন আওয়ালপুর?

ধলামিঞা হঠাৎ ফিচকি দিয়ে হাসে।

–আওয়ালপুর গেলে কি আর আপনার কাছে আহি? কী কেলা পানি-পড়াডা দিব হে লোকটা? বেচারীর মনে মনে যখন একটা ইচ্ছা! ধরছে তখন ফকির কাম কি ঠিক হইব?–আমি কই, আপনেই দেন পানিপড়াডা আর কথাডা একদিন চাইপা যান।

অনেকক্ষণ মজিদ চুপ হয়ে থাকে। এর মধ্যে মুখে ছায়া আসে, যায়। তার পানে চেয়ে আর তার দীর্ঘ নীরবতা দেখে ধলামিঞার সব উত্তেজনা শীতল হয়ে আসে। অবশেষে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে সে প্ৰশ্ন করে,–কী কন?

–কী আর কমু। এই সব কাম কী চাপাচাপি দিয়া হয়। এ কী আইন-আদালত না মামলা-মকদ্দমা? দলিল দস্তাবেজ জাল হয়, কিন্তু খোদাতালার কালাম জাল হয় না। আপনে আওয়ালপুরেই যান।

মুহুর্তে ধলামিঞার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে ভয়ে। রাতের অন্ধকারে দেবংশি তেঁতুল গাছটা কী যে ভয়াবহ ৰূপ ধারণ করে, ভাবতেই বুকের রক্ত শীতল হয়ে আসে। তাছাড়া পীর সাহেবের ডাণ্ডাবাজ চেলাদের কথা ভাবলেও গলা শুকিয়ে আসে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে হয়তো ভয়টাকে হজম করে নিয়ে ভগ্নগলায় ধলামিঞা বলে,–আপনে না দিলে না দিলেন। কিন্তু হেই পীরের কাছে আমি যামু না।

—যাইবেন না। ক্যান? এবার একটু রুষ্ট স্বরে মজিদ বলে, ব্যাপারী মিঞা। যখন পাঠাইতেছেন তখন যাইবেন না ক্যান?

উক্তিটা দুইদিকে কাটে। কোনটা নিয়ে কোনটা ফেলে ঠিক করতে না পেরে ধলামিঞা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। অবশেষে কথাটার সঠিক মৰ্মাৰ্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা ছেড়ে সরাসরি বলে,–হেই কথা আমি বুঝি না। কাইল সকালে এক বোতল পানি দিয়া যামুনে, আপনি পইড়া দিবেন।

ধলামিঞার মতলব, শেষরাতে উঠে গ্রামের বাইরে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে, দুপুরের দিকে ফিরে এসে মজিদের কাছ থেকে বোতলটা নিয়ে যাবে। আর পীর সাহেবের খেদমতে পৌছে দেবার জন্যে ব্যাপারী যে-টাকা দেবে তার অর্ধেক বেমালুম পকেটস্থ করে বাকিটা মজিদকে দেবে। মজিদ প্ৰায় ঘরের লোক। ব্যাপারীর কাছে তার দাবী-দাওয়া নেই। দিলেও চলে, না দিলেও চলে। তবু কথাটা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে হলে মজিদের মুখকেও চাপা দিতে হয়।

–তাইলে পাকাপাকি কথা হইল। ভরদুপুরে আমি আসুম নে পানিপড়া নিবার জন্য।

তারপর তাড়াতাড়ি বলে, ঠাগের পিছনে বেহুদা টাকা ঢালন কী বিবেক-বিবেচনার কাম? টাকার ইঙ্গিতটা স্পষ্ট এবং লোভনীয় বটে। কিন্তু তবুও মজিদ তার কথায় অটল থাকে। নিমরাজিও হয় না। কঠিন গলায় বলে,—না, আপনে আওয়ালপুরেই যান।

এতক্ষণ পর ধলামিঞা বোঝে যে, মজিদের কথাটা রাগের। বিবির খাতিরে ব্যাপারী মজিদের নির্দেশের বরখেলাফ কোরে সেই ঠগ-পীরের কাছেই লোক পাঠাবে পড়াপানি আনবার জন্যে।—সেটা তার পছন্দসই নয়। না হবারই কথা। ব্যাপারটা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার মতো। ধলামিঞা ভারী মুখ নিয়ে প্ৰস্থান করে। ঘরে ফিরে আবার ভাবতে শুরু করে। কিন্তু কোনো বুদ্ধি ঠাহর করবার আগেই মজিদ এসে উপস্থিত হয় ব্যাপারীর বৈঠকখানায়।

যতক্ষণ নোতুন। এক ছিলিম তামাক সাজানো হয় কোন্ধিতে, ততক্ষণ দুজনে গরু ছাগলের কথা কয়। দু’এক বাড়িতে গরুর ব্যারামের কথা শোনা যাচ্ছে! মজিদের ধামড়া গাইটা পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। রহীমা কত চেষ্টা করছে কিন্তু গাইটা দানা-পানি নিচ্ছে না মুখে। খাচ্ছেও না কিছু, দুধও দিচ্ছে না এক ফোঁটা।

তামাক এলে কতক্ষণ নীরবে ধূমপান করে মজিদ। তারপর এক সময় মুখ তুলে প্রশ্ন করে,—হেই পীরের বাচ্চ পীর শয়তানের খবর কী? এহনো ঈমানদার মানুষের সর্বনাশ করতাছে না সট্‌কাইছে?

প্রশ্ন শুনে খালেক ব্যাপারী ঈষৎ চমকে ওঠে, তারপর তার চোখের পাতায় নাচুনি ধরে। চোখ অনেক কারণেই নাচে। তাই শুধু নাচলেই ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু ব্যাপারীর মনে হয়, তামাকের ধোয়ার পশ্চাতে মজিদের চোখ হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে এবং সে-চোখ দিয়ে সে তার মনের কথা কেতাবের অক্ষরগুলোর মতো আগাগোড়া অনায়াসে পড়ে ফেলছে।

-কী জানি, কাইবার পারি না। অবশেষে ব্যাপারী উত্তর দেয়। কিন্তু আওয়াজ শুনে মনে হয় গলাটা যেন ধ্বসে গেছে হঠাৎ। সজোরে একবার কেশে নিয়ে বলে, হয়তো গেছে গিয়া।

মজিদ আস্তে বলে,—তাইলে আর তানার কাছে লোক পঠাইয়া কী করবেন?

–লোক পাঠামুতানার কাছে! বিস্ময়ে ব্যাপারী ফেটে পড়ে। কিন্তু মজিদের শীতল চোখ দুটোর পানে তাকিয়ে হঠাৎ সে বোঝে যে, মিথ্যা কথা বলা বৃথা। শুধু বৃথা নয়, চেষ্টা করলে ব্যাপারটা বড় বিসদৃশও দেখাবে। যে করেই হোক, মজিদ খবরটা জেনেছে।

একবার সজোরে কেশে বসে যাওয়া গলাকে অপেক্ষাকৃত চাঙ্গা করে তুলে ব্যাপারী বলে,–হেই কথা আমিও ভাবতাছি। আছে কী না আছে–হুদাহুদি পাঠান। তবু মেয়েমানুষের মন। সতীন আছে। ঘরে। ক্যামনে কখন দিলে চোট পায় ডর লাগে। তা যাক। পাইলে পাইল, না পাইলে নাই। আসলে মন বোঝান আর কী। ঠগ পীরের পানিপড়ায় কী কোনো কাম হয়?

ধাক্কাটা সামলে নিয়ে ব্যাপারী ধীরে ধীরে সব বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করে। বলে, মজিদকে সে বলে বলে করেও বলতে পারেনি। আসল কথা তার সাহস হয়নি, পাছে মজিদ মনে ধরে কিছু।

কথাটা মজিদের যে পছন্দ হয় তা স্পষ্ট বোঝা যায়। সে হুঁকায় জোর টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে চোখ। গম্ভীর করে তোলে।

ব্যাপারীর মতো বিস্তর জমিজমার মালিক ও প্ৰতিপত্তিশালী লোক তাকে ভয় পায়–শুনে পুলকিত হবারই কথা। ব্যাপারী আরো বলে যে, ধলামিঞাকে বিস্তারিত নির্দেশ দিয়েছে–ঘূণাক্ষরেও কেউ যেন বুঝতে না পারে সে মহব্বতনগরের লোক। তাছাড়া, এ-গ্রামে কেউ যেন তাকে আওয়ালপুর যেতে না দেখে। কারণ, তাহলে মজিদের নির্দেশের বরখেলাপ করা হয় খোলাখুলিভাবে।

-ধলামিঞাকে যতটা বেকুফ ভাবছিলাম, ব্যাপারী বলে, ততটা বেকুফ হে না। হে ভাবছে ভূয়া পানি আইনা ফায়দা কী। তানার যখন একটা ছেলের সখ হইছেই…

মজিদ বাধা দেয়। ধলামিঞার গুণচর্চায় তার আকর্ষণ নেই। হঠাৎ মধুর হাসি হেসে বলে,–খালি আমার দুঃখডা এই যে, আপনার বিবি আমারে একবার কইয়াও দেখলেন না। আমার থিক ঠগ-পীর বেশী হইল? আমার মুখে কী জোর নাই?

—আহা-হা, মনে নিবেন না কিছু। মেয়েমানুষের মন। দূৱ থিকা যা হোনে তাতেই ঢলে।

–কথাডা ঠিক কইছেন। মজিদ মাথা নেড়ে স্বীকার করে। তারপর বলে, তয় কথা কি, তাগো কথা হুনলে পুরুষমানুষ আর পুরুষ থাকে না, মেয়েমানুষেরও অধম হয়। তাগো কথা হুনলে কি দুনিয়া চলে?

ব্যাপারীর মস্ত গোফে আর ঘন দাড়িতে পাক ধরেছে। মজিদের কথায় সে গভীরভাবে লজ পায়। তখনকার মতো মজিদের ভঙ্গিতেই বলে,—ঠিকই কইছেন কথাডা। কিন্তু কি করি। এহন। কাইন্দাকাইটা ধরছে বিবি।

–তানারে কন, পেটে যে বেড়ি পড়ছে হে বেড়ি না খোলন পর্যন্ত পোলাপাইনের আশা নাই। শয়তানের পানিপড়া খাইয়া কি হে বেড়ি খুলবো?

পেটে বেড়ি পড়ার কথা সম্পূর্ণ নোতুন শোনায়। শুনে ব্যাপারীর চোখ হঠাৎ কৌতুহলে ভরে ওঠে। সে ভাবে, বেড়ি, কিসের বেড়ি?

মজিদ হাসে। ব্যাপারীর অজ্ঞতা দেখেই তার হাসি পায়। তারপর বলে,–পেটে বেড়ি পড়ে বইলাই তো স্ত্রীলোকের সন্তানাদি হয় না। কারো পড়ে সাত প্যাঁচ, কারো চোদ্দ। একুশ বেড়িও দেখেছি। একটা। তয় সাতের উপরে হইলে ছাড়ান যায় না। আমার তো চোদ্দ প্যাঁচ।

ব্যাপারী উৎকষ্ঠিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,–আমার বিবিরড ছাড়ান যায় না?

–ক্যান ছাড়ান যায় না। তয় কথা হইতেছে, আগে দেখন লাগবে। কয় প্যাঁচ তানার। কথাটা শুনে ব্যাপারী আবার না ভাবে যে, মজিদ তার স্ত্রীর উদরাঞ্চল নগ্নদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে দেখবে–তাই তাড়াতাড়ি বলে, এর একটা উপায় আছে।

উপায়টা কী, বলে মজিদ। একদিন সেহরী না খেয়ে আমেনা বিবিকে রোজা রাখতে হবে। সেদিন কারে সঙ্গে কথা কইতে পারবে না এবং শুদ্ধচিত্তে সারাদিন কোরান শরীফ পড়তে হবে। সন্ধ্যার দিকে এফতার না করে মাজার শরীফে আসতে হবে। সেখানে মজিদ বিশেষ ধরনের দোয়া-দরূদ পড়ে একটা পড়াপানি তৈরী করে তাকে পান করতে দেবে। তারপর আমেনা বিবিকে মাজারের চারপাশে সাতবার ঘুরতে হবে।

যদি সাত প্যাঁচ হয় তবে সাত পাঁক দেবার পরই হঠাৎ তার পেট ব্যথায় টনটন করে উঠবে। ব্যথাটা এমন হবে যে, মনে হবে প্রসববেদনা উপস্থিত হয়েছে।

ব্যাপারী উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করে,—আর সাত পাকে যদি ব্যথা না ওঠে?

–তয় বুঝতে হইব যে, তানার চোদ্দ প্যাঁচ কি আরো বেশী। সাত প্যাঁচ হইলে দুশ্চিন্তার কারণ নাই।

তারপর মজিদ আবার গরু ছাগলের কথা পাড়ে। এক সময় আড়চোখে ব্যাপারীর পানে তাকিয়ে দেখে, গৃহপালিত জীবজন্তুর ব্যারামের কথায় তেমন মনোযোগ যেন নেই তার। আরো দুচারটে অসংলগ্ন কথার পর মজিদ উঠে পড়ে।

ফেরবার পথে মোল্লা শেখের বাড়ির কাছে কঁঠাল গাছের তলে একটা মূর্তি নজরে পড়ে। মূর্তি ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল না, তাকে আসতে দেখে দাঁড়িয়েছে। মগরেবের কিছু দেরী আছে, কিন্তু শীতসন্ধ্যা ধোঁয়াটে বলে দূর থেকে অস্পষ্ট দেখায় সে-মূর্তি। তবু তাকে চিনতে মজিদের এক পলক দেরী হয় না। সে হাসুনির মা। মুখটা ওপাশে ঘুরিয়ে আলতভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

নিকটবর্তী হতেই হাসুনির মা কেমন এক কান্নার ভঙ্গিতে মুখ হাতে ঢাকে। আরো কাছে গিয়ে মজিদ থমকে দাঁড়ায়, দাড়িতে হাত সঞ্চালন করে কয়েক মুহুর্ত তাকে চেয়ে দেখে। তারপর বলে, -কী গো হাসুনির মা?

যে-কান্নার ভঙ্গিতে তখন হাতে মুখ ঢেকেছিল, সে এবার মজিদের প্রশ্নে আস্তে নাকিসুরে কেঁদে ওঠে। কান্নাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, আসল উদ্দেশ্য এই বলা যে, যা ঘটছে তা হাসবার নয়, কান্নার ব্যাপার।

আকস্মিক উদ্বেগ বোধ করে মজিদ। মেয়েটার চলন-বিলন কেমন যেন নম্র। বয়স হলেও আনাড়ী বেঠিকপানী ভাব। হাতে নিলে যেন গলে যাবে। মাসখানেক আগে একদিন শেষরাতে খড়কুটোর উজ্জল আলোয় যার নগ্ন বাহু-পিঠ-কাঁধ দেখেছিল মজিদ, সে যেন ভিন্ন কোনো মানুষ। এখন তাকে দেখে শ্বসন দ্রুততর হয় না।

কণ্ঠে দরদ মাখিয়ে মজিদ প্রশ্ন করে,–কী হইছে তোমার বিটি?

এবার নাক ফ্যাৎ ফ্যাৎ করে হাসুনির মা অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে,–মা মরছে!

বজ্রাহত হবার ভান করে মজিদ। আর তার মুখ দিয়ে অভ্যাসবশত সে-কথাটাই নিঃসৃত হয়, যা আজ কতশত বছর যাবৎ কোটি কোটি খোদার বান্দারা অন্যের মৃত্যু সংবাদ শুনে উচ্চারণ করে আসছে। তারপর বলে,–আহা ক্যামনে মরলে গো বেটি?

–এ্যামনে।

এমনি মারা গেছে কথাটা কেমন যেন শোনায়। পলকের মধ্যে মজিদের স্মরণ হয় তাহেরের বৃদ্ধ ঢেঙা বাপের বিচারের দৃশ্য। তার জন্য অবশ্য অনুতাপ বোধ কবে না। মজিদ। কেবল মনে হয় কথাটা। থেমে আবার প্রশ্ন করে,–ছ্যামরারা কই?

–আছে! ধান বিক্রি কইরা ঠ্যাঙের উপর ঠাঙ তুইলা আছে। ছোটডি কয় কেরায়া নায়ের মাঝি হইবো।

–দাফন কাফনের যোগাড়িযন্ত্র করতাছে নি?

—করতাছে। মোল্লা শেখে জানাজা পড়বে।

খেলাল তুলে হঠাৎ দাঁত খোঁচাতে থাকে৷ মজিদ, কপালে ক-টা রেখা ফোটে। তারপর চিন্তিত গলায় বলে,—মওতের আগে খোদার কাছে মাফ চাইছিল নি তহুর মা?

ধাঁ করে হাসুনির মা মুখ ঘুরিয়ে তাকায় মজিদের পানে। দেখতে না দেখতে চোখে ভয় ঘনিয়ে ওঠে।

–মাফ চাইছিল কিনা কেইবার পারি না!

কয়েক মুহুর্ত মজিদ। নীরব থাকে। এ-সময়ে কপালে আরো কয়েকটি রেখা ফুটে ওঠে। কিছু না বললেও হাসুনির মা বোঝে, মজিদ তার মায়ের কবরের আজাবের কথা ভাবে। মায়ের মৃত্যুতে সে তেমন কিছু শোক পেয়েছে বলা যায় না। বার্ধক্যের শেষ স্তরে কারো মৃত্যু ঘটলে দুঃখটা তেমন জোরালভাবে বুকে লাগে না। তবে মায়ের কেঁকড়ানো রাগ-ঝোলা যে মৃত দেহটি এখনো ঘরের কোণে নিম্পন্দভাবে পড়ে আছে সে-দেহটিকে নিয়ে যখন পেছনের জঙ্গলের ধারে কদম গাছের তলে কবর দেওয়া হবে, তখন হয়তো দমকা হাওয়ার মতো বুকে সহসা হাহাকার জগবে। তারপর শীঘ্ৰ আবার মিলিয়ে যাবে সে হাহাকার। কিন্তু তার মা নিঃসঙ্গ সে-কবরে লোক চোখের অন্তরালে অকথ্য যন্ত্রণাভোগ করবে–এ-কথা ভাবতেই মেয়ের মন ভয়ে ও বেদনায় নীল হয়ে ওঠে। কলাপাতার মতো কেঁপে উঠে সে প্রশ্ন করে,

–মায়ের কবরে আজব হইবো?

সরাসরি কথাটার উত্তর দিতে মজিদের মুখে বাঁধে। থেমে বলে,—খোদা তারে বেহেস্তে-নাছিব করো, আহা!

একবার আড়াচোখে তাকায় হাসুনির মা-র দিকে। চোখে মরণভীতির মতো গাঢ় ছায়া দেখে হয়তো বা একটু দুঃখও হয়। ভাবে, তার জন্যে লোকটি নিজেই দায়ী। আর যাই হোক, মজিদের কথাকে। যে অবহেলা করে খাড়া হয়ে দাড়াতে চায় তাকে সে মাফ করতে পারে না।

তারপর দ্রুতপায়ে হাঁটিতে শুরু করে মজিদ। বা ধারে মাঠ। দিগন্তের কাছে ধূসর ছায়া দেখে মনে ভয় হয়। নামাজ কাজ হবে না তো?

 

পরের শুক্রবার আমেনা বিবি রোজা রাখে। পীর সাহেবের পানিপড়া পাবে না জেনে প্ৰথমে নিরাশ হয়েছিল, কিন্তু পেট বেড়ির কথা শুনে এবং প্যাঁচ যদি সাতটির বেশী না হয় তবে মজিদ তার একটা বিহিত কমতে পারবে শুনে শীঘ্ৰ মন থেকে নিরাশা কেটে গিয়ে আশার সঞ্চার হলো। আস্তে আস্তে একটা ভয়ও এল মনে। প্যাঁচ যদি সাতের বেশী হয়, চোদ্দ কিংবা একুশ? মজিদের নিজের বউ-এর তো সাতের বেশী। সে নাকি একুশও দেখেছে।

ব্যাপারটা গোপন রাখবে স্থির করেছিল আমেনা বিবি; কিন্তু এ-সব কথা হলে বাতাসে কথা হতে শুরু করে। তানু বিবিই গল্প ছড়ায় এবং শুক্রবার সকাল থেকে নানা মেয়েলোক আসতে থাকে দেখা করতে। আমেনা বিবি করে সঙ্গে কথা কয় না। ঘরের কোণে আবছায়ার মধ্যে মাদুরে বসে গুনগুনিয়ে কোরান শরীফ পড়ে। মাথায় ঘোমটা, মুখটা ইতিমধ্যে দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে উঠেছে। পাড়াপাড়শীরা এসে দেখে দেখে যায়, তারপর আড়ালে তনু বিবির সঙ্গে নীচু গলায় কথা কয়। তানু বিবি অবিশ্রান্ত পান বানায় আর মেহমানদের খাওয়ায়।

দুপুরের কিছু আগে মজিদের বাড়ি থেকে রহীমা আসে। হাতে ঘষা-মাজা তামার গ্লাসে পানি। এমনি পানি নয়–পড়াপানি। মজিদ বলে পাঠিয়েছে গোসল করার আগে আমেনা বিবি পেটে পানিটা যেন ঘষে। দোয়া-দরূদ পড়া পানি, তার প্রতিটি ফোটা পবিত্র। কাজেই মাখবার সময় পুকুরের পানিতে দাঁড়িয়েই যেন মাখে।

রহীমা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যায় না। পান-সাদা খায়, তানু বিবির সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা কয়। এক সময় তানু বিবি প্রশ্ন করে, -বইন, আপনেও তো মাজারের পাশে সাত পাক দিছেন না?

–আমি দেই নাই।

–দেন নাই? বিস্মিত হয়ে তা নু বিবি বলে।—তায় তানি ক্যামনে জানলেন। আপনার চোদ্দ প্যাঁচ?

রহীমা লজ্জার হাসি হেসে বলে,—তানি যে আমার স্বামী। স্বামী হইলে এ্যামনেই বোঝে।

–তয় তানি বোঝেন না। ক্যান? তানু বিবির তানি মানে খালেক ব্যাপারী।

রহীমা মুশকিলে পড়ে। দুই তানিতে যে প্রচুর তফাৎ আছে সে কথা কী করে বোঝায়! তানু বিবি একটু বোকা অথচ আবার দেমাকি কিছিমের মানুষ। স্বামী বিস্তর জমিজমার মালিক বলে ভাবে, তার তুলনায় আর কেউ নেই। শেষে রহীমা আস্তে বলে,–তানি যে খোদার মানুষ।

আমেনা বিবিকে গোসল করিয়ে বাড়িতে ফেরে রহীমা। মজিদ উৎকষ্ঠিত স্বরে বলে,—পড়াপানিডা নাপাক জাগায় পড়ে নাই তো?

–না। যা পড়েছে তালাবের মধ্যেই পড়েছে।

সূৰ্য যখন দিগন্ত সীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন জোয়ান-মদ দু’জন বেহারা পাল্কি এনে লাগাল অন্দর ঘরের বেড়ার পাশে।

এক টিলের পথ, কিন্তু ব্যাপারীর বউ হেঁটে যেতে পারে না।

ব্যাপারী হাঁকে,–কই তৈয়ার হইছেন নি?

আমেনা বিবি। আবছায়ার মধ্যে তখনো গুনগুনিয়ে কোরান শরীফ পড়ছে। দুপুরের দিকে চেহারায় তবু কিছু জৌলুষ ছিল, এখন বেলা শেষের মান আলোয় একেবারে ফ্যাকাশে ঠেকে। তার চোখের সামনে আর্কাকাঁকা প্যাচানো অক্ষরগুলো নাচে, আবছা হয়ে গিয়ে আবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ছোট হয়ে আবার হঠাৎ বড় হয়ে যায়। আর শুষ্ক ঠোঁট দুটো থেকে থেকে থারথারিয়ে কেঁপে ওঠে।

তানু বিবি গিয়ে ডাকে,–ওঠ বুকু সময় হইছে।

ডাক শুনে ফাঁসির আসামীর মতো আমেনা বিবি চমকে উঠে৷ ভীতবিহবল দৃষ্টিতে একবার তাকায় সতীনের পানে। তারপর ছুরা শেষ করে কোরান শরীফ বন্ধ করে, গেলাফে ভরে, শেষে পালকম্পর্শের মতো আলগোছে তাতে চুমু খায়। সেটা ও রেহেলা নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ তার মাথা ঘুরে চোখ অন্ধকার হয়ে যায়, আর শরীরটা টাল খেয়ে প্ৰায় পড়ে যাবার উপক্রম করে। তনু বিবি ধরে ফেলে তাকে। তারপর একটু আদা-নুন মুখে দিয়ে ঘরের কোণেই মগরেবের নামাজটা আমেনা বিবি সেরে নেয়।

উঠানের পথটুকু অতিক্রম করতে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত বোধ করে আমেনা বিবি। পুরা ত্রিশ দিন রোজা রেখেও যে বিন্দুমাত্ৰ কাহিল হয় না সে একদিনের রোজাতেই একেবারে যেন ভেঙে গেছে। গায়ে মাথায় বুটিদার হলুদ রংঙের একটা চাদর দিয়েছে। সেটা বুকের কাছে চেপে ধরে গুটি গুটি পায়ে হাঁটে। কিসের এত ভয় তাকে পিষে ধরেছেকঘণ্টায় যে-ভয় দীর্ঘ রোগভোগ করা মানুষের মতো তাকে দুর্বল করে ফেলেছে? এক যুগেরও ওপরে যে নিঃসন্তান থাকতে পারল সে যদি জানে যে, ভবিষ্যতেও সে তেমনি নিঃসন্তান থাকবে, তবে এমন মুষড়ে যাবার কী আছে? এ প্রশ্ন আমেনা বিবি তার নিজের মনকেই জিজ্ঞাসা করে।

তবে কথা হচ্ছে কি, তেরো বছরের কথা একদিনে জানেনি, জেনেছে ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে, প্ৰতি বৎসরের শূন্যতা থেকে। সে শূন্যতাও আবার পরবর্তী বছরের আশায় শীঘ্ৰ ক্ষয়ে তেজশূন্য হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ জীবনের শূন্যতার কথা তেমনি বছরে বছরে যদি জানে তবে আঘাতটা দীর্ঘকালব্যাপী সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়ে তীব্রতায় হ্রাস পাবে, মনে কিছু-বা লাগলেও গায়ে লাগবে না। কিন্তু এক মুহুর্তে সে-কথা জানলে বুক ভেঙে যাবে না, বেঁচে থাকবার তাগিদ কি হঠাৎ ফুরিয়ে যাবে না?

সে-ভয়েই দুকদমের পথ ঘাস শুন্য মসৃণ ক্ষুদ্র উঠানটা পেরুতে গিয়ে আমেনা বিবির পা চলে না; সে-ভয়ের জন্যেই জোর পায় না কোমরে, চোখে ঝাপসা দেখে। একবার ভাবে, ফিরে যায় ঘরে। কাজ কী জেনে ভবিষ্যতের কথা। যাই হোক, দয়ালুদের মধ্যে সেরা দয়ালু। সে খোদার ইচ্ছাই তো অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হবে।

কিন্তু গুটি গুটি করে চলেও পা এগিয়ে চলে। মনের ইচ্ছায় না। হলেও চলে লোকদের খাতিরে। ঢাকঢোল বাজিয়ে যোগাড়যন্ত্র করিয়ে এখন পিছিয়ে যেতে পারে না। পুরুষ হলে হয়তো বা পারত, মেয়েলোক হয়ে পারে না। সমাজ যাকেই ক্ষমা করুক না কেন, বিরুদ্ধ ইচ্ছা দ্বারা চালিত, দো-মনা খুশির বশের মানুষের আয়োজন ভঙ্গ করা নারীকে ক্ষমা করে না। এ-সমাজে কোনো মেয়ে আত্মহত্যা করবে: বলে একবার ঘোষণা কোরে সে মনের ভয়ে আবার বিপরীত কথা বলতে পারে না। সমাজই আত্মহত্যার মাল-মশলা জুগিয়ে দেবে, সর্বতোভাবে সাহায্য করবে যাতে তার নিয়ত হাসিল হয়, কিন্তু ফাঁকি দিয়ে তাকে আবার বাঁচতে দেবে না। মেয়েলোকের মনের মস্করা সহ্য করতে অতটা দুর্বল নয় সমাজ। এখানে তাদের বেহুদীপনার জায়গা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *