• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০১-৫. দিনের শেষ গাড়ি

লাইব্রেরি » বুদ্ধদেব গুহ » একটু উষ্ণতার জন্য » ০১-৫. দিনের শেষ গাড়ি

একটু উষ্ণতার জন্যে – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

দিনের শেষ গাড়ি মরা বিকেলের হলুদ অন্ধকারে একটু আগে চলে গেছে।

এখন প্লাটফর্মটা ফাঁকা।

এখানে ওখানে দু-একজন ওঁরাও মেয়ে-পুরুষ ছড়িয়ে আছে। কার্নি মেমসাহেবের চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। আসন্ন সন্ধ্যার অস্তমিত আলোয় প্লাটফর্মের ওপারের শালবনকে এক অদ্ভুত রহস্যময় রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। চারদিক থেকে বেলাশেষের গান শোনা যাচ্ছে।

স্টেশানের মাস্টারমশাই বললেন, আপনাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমি বললাম, কি দরকার?

আরে তাতে কি? আপনি এখানের বাসিন্দা ত নন, নতুন এসেছেন–জঙ্গলের পথঘাট ভাল জানা নেই। চলুন, চলুন, আমার কোনো কষ্ট হবে না, তাছাড়া আমি ত হাঁটতে বেরোতামই–এ বয়সে একটু হাঁটা দরকার।

বললাম, বেশ, চলুন তাহলে।

স্টেশান থেকে বেরিয়ে শেঠ মুঙ্গালালের দোকান পেরিয়ে হালুইকরের দোকানের সামনে দিয়ে পোস্টাফিসের গা-ঘেঁষে পেছনের মাঠটায় এসে পড়লাম আমরা।

মাঠের ওপারে দীপচাঁদের দোকানের আলো জ্বলে উঠেছে।

বেশ অনেকখানি হাঁটতে হবে।

মাস্টারমশাই বললেন, শরীর কেমন বোধ করছেন আজকাল? এইসব পাকদণ্ডী পথ দিয়ে যাওয়া আসা করা কি আপনার উচিত হচ্ছে?

আমি হাসলাম, বললাম, মান্দারের হাসপাতালের সাহেব ডাক্তার ত বললেন, যতখানি পারি হেঁটে বেড়াতে, শরীর যে খারাপ হয়েছিল, কখনো বড় অসুখে পড়েছিলাম, এসব কথা একেবারে ভুলে যেতে।

ওঃ-। তাই বুঝি। তাহলে ভাল। তারপর আবার বললেন, এখানে সব উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তা ত, তাই-ই বলছিলাম।

দেখতে দেখতে আমরা দীপচাঁদের দোকানের সামনে এসে পড়লাম, তারপর একটা ছোট বস্তী পেরিয়ে মোড়ের পোড়ো বাড়ির পাশ কাটিয়ে গ্রামের পাকদণ্ডীতে এলাম।

সামনে একটা বড় ঝাঁকড়া মহুয়াগাছ। মাঝে মাঝে পিটিস্ এবং ঝাঁটি জঙ্গল। পশ্চিমের পাহাড়ের কাঁধ বরাবর সন্ধ্যাতারাটা উঠেছে। সমস্ত আকাশ সেই একটি তারার আলোয় উজ্জ্বল।

হাতের লাঠি ঠকঠক করতে করতে আগে আগে চলতে চলতে মাস্টারমশাই বললেন, আপনি তখন নিশ্চয়ই কিছু মনে করলেন না? কি বলেন?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কই? কখন?

ঐ যখন ঘোষকে ধমক লাগালাম আমি।

 আমি বললাম, ঘোষ মানে? শৈলেন ঘোষ?

 উনি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ।

আমি বললাম, না, না, মনে করব কেন? তাছাড়া আপনাদের নিজেদের মধ্যের কথায় আমার মনে করার কি আছে?

মাস্টারমশাই উত্তপ্ত গলায় বললেন, নাঃ এ ছাওয়াল-পাওয়ালগুলোকে শুধরানো যাইব না–যা মাইনা পাইতাছে তা এই জাগায় খাইয়া পইড়া থাকার পক্ষে যথেষ্ট। অথচ এই চেঞ্জারদের দেইখ্যা দেইখ্যা ওদেরও কমপিটিশনে নামন লাগব। জব্বর জব্বর জামাকাপড়, লটর-পটর জুতা, কান ঝালাপালা ট্রানজিস্টর সবই ওদেরও চাই। কিছুই না অইলে নয়। নাই, নাই কইরাই এগো পরানডা গেল।

আমি জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলাম।

মাস্টারমশাই ফরিদপুরের লোক। কালীভক্ত, হোমিওপ্যাথী করেন; ব্যাচেলর।

চেঞ্জারদের উপর ওঁর খুব রাগ। এখানের এই নির্লিপ্ত খুশি জীবনে, চেঞ্জাররা এসে চাহিদার জ্বালা জুগিয়ে যায়। একথা তিনি প্রায়ই বলেন।

এবার সামনে সেই নালাটা এসে গেল। নালাটা পেরিয়ে অনেকখানি খাড়া উঠতে হয়। ও জায়গাটাতে এসে এখনও বুকে বেশ হাঁপ ধরে। এখানে এলে বুঝতে পাই যে, এখনো পুরোপুরি ভাল হইনি আমি, এখনও রাজরোগের রেশ ছাড়েনি আমাকে।

চড়াইটা উঠে এসেই সেই সাদা পোড়ো বাড়িটা। সন্ধ্যার অন্ধকারে দারুণ দেখায়। এখানের অনেকে বলেন যে, এটা ভূতের বাড়ি। মাস্টারমশাই হাতের লাঠিটা উঁচু করে ওদিকে দেখিয়ে বললেন, এই যে সেই বাড়ি।

মাস্টারমশাইকে শুধোলাম, এখান দিয়ে রাতে একা যেতে আপনার ভয় করে না মাস্টারমশাই?

মাস্টারমশাই সায়ান্ধকারে কাঁচা-পাকা চুলেভরা প্রকাণ্ড মাথাটা আমার দিকে ঘুরিয়ে জোরে হেসে উঠলেন, বললেন, বুঝলেন কিনা ভাই, আমি হইলাম গিয়া কালীভক্ত লোক মায়ের পূজা করি–ভূতপেত্নী লইয়াই আমাগো কারবার।

সাদা পোড়োবাড়ি পেরুনোর পর পথটা সোজা চলে গেছে খোয়াই-ভরা টীড়ের মধ্যে দিয়ে। বাঁদিকে অনেকগুলো বড় বড় মহুয়া গাছ। সামনেতে এখন সর্ষে বুনেছে ওঁরাওরা। অন্ধকারে সব সমান মাঠ বলে মনে হচ্ছে।

পথের ডানদিকে চার-পাঁচ ঘর লোকের বাস। ওরাও সকলে ওঁরাও। ওদের পোষা শুয়োর বাড়ির সামনের গোবর লেপা উঠোনে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! ফারিয়া কুকুরের বাচ্চা হয়েছে, বারান্দার খড়ের মধ্যে শুয়ে বাচ্চাগুলো কুঁই কুঁই করে ডাকছে। অন্ধকারে সর্ষে ক্ষেতের গন্ধ আর এই টুকরো টুকরো শব্দসমষ্টি দারুণ লাগছে।

সর্ষে ক্ষেত পেরিয়ে, অন্ধ জারু ওঁরাও-এর ঘরের পাশ দিয়ে আবার ঝটি জঙ্গল ভেদ করে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে এসে উঠলাম। মাস্টারমশাই চা না খেয়েই ফিরে যাচ্ছিলেন, আমি জোর করে ধরে আনলাম, বললাম, চা না খেয়ে যাওয়া চলবে না।

তারপর কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে মাস্টারমশাই উঠে পড়লেন। লাঠি ঠঠকিয়ে জঙ্গলের পথে মিলিয়ে গেলেন। চলতে চলতে, মাঝে মাঝে বলতে লাগলেন, জয়, তোর জয়।

এখানে সন্ধ্যে হয়ে গেলে আর কিছুই করার নেই। আমার প্রতিবেশী যাঁরা, তাঁরা সকলেই বেশী বয়সী। মানে নিকট প্রতিবেশীরা। তাঁরা প্রায় সকলেই হয় এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, নয় বিদেশী। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে সাপার খেয়ে শুয়ে পড়েন।

লালি রেঁধেবেড়ে দেয়। আমিও সকাল সকাল খেয়েদেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ি। বইপত্র এখানে পাওয়ার উপায় নেই। কর্নেল ম্যাকফারসনের লাইব্রেরী আছে, খুবই ভালো। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আলাপ এমন ঘনিষ্ঠ হয়নি যে বই চেয়ে পড়ি। কলকাতা থেকে যেগুলো এনেছিলাম সেগুলো বহুবার পড়া হয়ে গেছে। এখন সন্ধ্যে হলেই নিজেকে অভিশপ্ত বলে মনে হয়। যার শরীর অসুস্থ, অসুস্থ মানে বহু দিন ধরে অসুস্থ, যার মনে কোনো আনন্দের আভাস মাত্র অবশিষ্ট নেই, তার পক্ষে এরকম নির্জন জায়গায় একা একা সন্ধ্যে কাটানো শাস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

মাঝে মাঝে ভাবি, ভাল হয়ে গিয়েই বা কি করব। ভাল হয়ে কোলকাতায় ফিরে আবার ত সেই জীবনেই প্রবেশ করব। যাদের সঙ্গে আমার কোনো আত্মিক যোগ নেই, কোনো সত্যিকারের সখ্যতা নেই, তাদের মধ্যে থেকে, তাদের জন্যে আবার সেই দাসত্ব করব, করব রোজগার, রোজকার দস্তুরের দাগা বুলোব। সেও ত আরেক মৃত্যু। আমার সামনে বোধহয় শুধু বহু মৃত্যুর দ্বারই খোলা আছে। আমার শুধু এখন পথ বেছে নিতে হবে কোন্ মৃত্যু আমার পক্ষে সহনীয় এবং বরণীয়।

.

০২.

 এ জায়গাটায় সকাল হয় না, সকাল আসে। অনেক শিশিরঝরানো ঘাসে ভেজা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে অনেক শঙ্খিনী নদী পেরিয়ে সোনা-গলানো পোশাক পরে সকাল আসে এখানে।

কম্বলের নীচে শুয়ে আমার ঘরের টালির ছাদের ফাঁকে ফাঁকে আলোর আভাস দেখা যায়। চতুর্দিক থেকে পাখি ডেকে ওঠে। বাড়ির পেছনের পিটিস্ ঝোপে ভরা টাঁড়ে তিতিরের আড্ডা। ঝগড়াটি তিতিরগুলোর গলা সবচেয়ে আগে শোনা যায়। তারপর টিয়া, ঘুঘু, বুলবুলি, টুনটুনি, মৌটুসী আরো কত রকম পাখি এসে পেয়ারা গাছে, আতা গাছে, ফলসা গাছে, চেরী গাছে এমন কি বাবুর্চিখানার পাশের কারিপাতা গাছে বসেও ঝাঁপাঝাঁপি করে।

সেই প্রচণ্ড সুস্থ ও আনন্দিত প্রাণতরঙ্গের মধ্যে, দিগ্বিদিকে শিহরিত ও আলোকিত শব্দলহরীর মধ্যে এই অসুস্থ আমি চোখ মেলি। শাল গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে রোদে দাঁড়াই।

ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রতিটি সকাল আমার জন্যে যেন কী এক আনন্দের পসরা সাজিয়ে আনে। প্রতিদিন এই ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে পুবের ও পশ্চিমের পাহাড়ের রোঁয়া-রোঁয়া সবুজের দিকে তাকিয়ে আমি বারে বারে নিজেকে ভুলে যাই।

রোজ প্রাতঃকৃত্য সেরে এসে পেয়ারাতলায় বেতের চেয়ারে বসি। মালি ঐখানেই চা এনে দেয়। রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকি। রোদটা একটু চড়লে, গ্রীবায় রোদ পড়লে আরামে চোখ বুজে আসে–তখন ইচ্ছে করে আরেকবার ঘুমাই।

মালু মালির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গাছগাছালির তদারকি করি। বাড়ির সবুজ হাতার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মনে হয় পৃথিবীতে এই একমাত্র জায়গা–। এই গাছগুলি, এই পুরানো, খসে-পড়া টালির ছাদের ভাড়া বাড়ি, এই পাখিদের জমিদারী এইটুকুই একান্ত করে আমার। আমার ক্ষণকালের একার। এছাড়া আমার জীবনে নিজের বলতে কিছুই নেই; না কোনো জিনিস, না কোনো জন।

আমগাছগুলোর তলায় একটা দোলনা টাঙানো আছে। কখনো কখনো সেখানে গিয়ে বসি একা একা। এই দোলনায় যে বা যারা এসে বসলে আমি ভীষণ খুশি হতাম তারা কেউ আসেনি এখানে। হয়ত আসবেও না। তাদের ভালো লাগে না জঙ্গল। ভালো লাগে না এই জংলী পরিবেশ, আরো বেশি করে ভালো লাগে না হয়ত আমার সঙ্গ।

দোলনায় বসে হল্যান্ড সাহেবের কাছ থেকে চেয়ে-আনা বাসি খবরের কাগজ পড়ছি,  এমন সময় কুয়োতলার দিক থেকে কাদের যেন একটা গরু ঢুকলো হাতার মধ্যে।

ওদিকে মালু বেগুন আর টোম্যাটো লাগিয়েছিল। মালুকে ডাকতেই, মালু দৌড়ে গিয়ে তাড়িয়ে দিল গরুটাকে।

গরুটা কাঁটাতারের বেড়া পেরুনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তারের পাশে একটি ছোট ছেলে এসে দাঁড়াল।

মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, চিরুনি ও তেল পড়েনি বহু বছর প্রায়–পরনে ছেঁড়া জামা–কোনো প্রমাণ সাইজের ফুলপ্যান্ট গুটিয়ে পরেছে। সমস্ত চেহারার মধ্যে এমন একটা রুক্ষতা যে কি বলব।

মালুকে শুধোলাম, এ ছেলেটি কে?

মালু বলল, লাবুবাবু।

লাবুবাবু কে?

 লাবুবাবু, ডাবুবাবুর ভাই।

মালুর উত্তরে কিছুই পরিষ্কার হলো না, বললাম, ডাকো ত লাবুবাবুকে।

প্রথমে লাবুবাবু আসতে চাইল না, শেষকালে যখন এসে আমার সামনে দাঁড়াল তখন দেখলাম তার দু চোখে ভয়ের ছায়া।

বয়স দশ-এগারো হবে, হাতে গরু তাড়াবার ছোট একটি লাঠি। নীচের ঠোঁটটি ফেটে দু-ফাঁক হয়ে গেছে। রক্তাক্ত দেখাচ্ছে ঠোঁটটা। চোখ দুটো কটা কটা। সমস্ত শরীর এখানের প্রচণ্ড শীতে শীতার্ত।

শুধোলাম, তোমার নাম কি?

লাবু।

কোথায় থাক?

 ঐখানে। কর্নেল সাহেবের বাড়ির পাশে।

 বাড়িতে কে কে আছেন?

মা, আর দাদা।

বাবা নেই?

 না। বাবা অনেক দিন আগে মারা গেছেন।

লাবু ভাঙা ভাঙা বাংলা বলছিল। বাংলা শুনে মনে হয় না যে বাঙালি। লাবু বলল, ওর ভার গরু চরানো, গরমের সময় মহুয়াও কুড়োয়। ওদের অনেক জমি আছে। নিজেরা লাঙল দেয়, নিজেরাই গরু দোয়ায়, চাষ করে। লাবুর দাদা ডাবু খিলারির স্কুলে পড়ে। লাবু চুরি করে একদিন আচার খেয়েছিল, তাই তার দাদা তাকে শানবাঁধানো বারান্দায় আছাড় দেওয়াতে তার ঠোঁট কেটে যায়। ঠাণ্ডায় তাই ঠোঁটখানির অমন বীভৎস অবস্থা।

লাবুকে শুধোলাম, তুমি আসছিলে না কেন? তোমাকে যখন ডাকছিলাম?

লাবু স্বীকারোক্তি করল, গরু ঢুকেছে বলে আমি যদি মারধোর করি সেই ভয়ে ও আসতে চাইছিল না। গরুগুলো ধরে খোঁয়াড়ে দিলেও বিপদ হত।

লাবুকে বিস্কিট খাওয়ালাম। বললাম, তুমি কি কি খেতে ভালোবাস?

ও বলল, কিছু না। তারপর অনেক পীড়াপীড়ি করাতে বলল, ছোলার ডাল আর রসগোল্লা।

আমি হেসে বললাম, আচ্ছা তোমাকে আমি ছোলার ডাল আর রসগোল্লা খাওয়াব।

লাবুকে বললাম, আমি তোমার দাদার মত। যখনি ইচ্ছে করে চলে এসো, তোমার সঙ্গে গল্প করব, আমাকে ভয় পেও না, বুঝলে?

লাবুর কথাটা বিশ্বাস হলো না। দুই ছেঁড়া পকেটে দুহাত গলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, আমার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তারপর বলল, আসি, কেমন?

লাবু চলে যাওয়ার পর দুখন মাহাতো কঙ্কা বস্তী থেকে মাটির হাঁড়িতে দুধ নিয়ে এল। কার্নি মেমসাহেবের লোক কালো টিনের বাক্স মাথায় করে পাঁউরুটি আর খাস্তা বিস্কুট দিয়ে গেল। কসাই হানিফ; সব্জীওয়ালা রহমান এল। রহমান পাকদণ্ডী পথে এগারো মাইল পায়ে হেঁটে প্রতি সোমবার সঁসের হাটে যায়, সেখান থেকে সব্জী কিনে বাঁকে করে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বাড়ি বাড়ি সব্জী বিক্রি করে।

ম্যাকলাস্কিতেও হাট বসে–শুক্রবারে, হেসালঙে।

হেসালঙ, লাপরা এবং কঙ্কা এই তিনটি বস্তী নিয়ে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। আমি যে অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নিয়েছি, সে অঞ্চলের নাম কঙ্কা।

স্টেশান, বেশির ভাগ দোকানপাট যেখানে সেদিকটার নাম লাপরা। আর খিলাড়ির দিকের রাস্তার গাঁয়ের নাম হেসালঙ।

হেসালঙের বসতির দিকটা ফাঁকা ফাঁকা–জঙ্গল ওদিকে গভীর নয়। লাপরার দিকে ত জঙ্গল নেই বললেই চলে।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লালমাটি ও পাথর ভরা যে অসমান পথটা চামার দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার দুপাশে লাল টালির ছাদওয়ালা সব বাংলো। এ বাড়িতে আসতে সেই কাঁচা রাস্তা ছেড়ে আরো ভিতরে ঢুকতে হয়।

চতুর্দিকে শাল সেগুনের জঙ্গল। আর পিটিস এবং নানারকম জংলী ফুল। এখানে এখন একরকম জংলী হলুদ ফুল হয়, সানফ্লাওয়ারের মত। বাড়ির পেছনদিকটা সেই ফুলে ছেয়ে গেছে। হাজার হাজার ফুল পাকদণ্ডী পথটার দুপাশে ভরে আছে। চোখ চাইলে চোখে হলুদ নেশা ধরে।

পৃথিবীতে এখনো যে এমন জায়গা আছে, যেখানে স্টেশানে নেমে, নিজের মাল হাতে করে যার যার বাড়ি হেঁটে আসতে হয়–সে ছ মাইলই হোক কি চার মাইলই হোক, তা ভাবা যায় না। এখানে ভাড়ার জন্যে কোনো ট্যাকসি, রিক্সা, গরুগাড়ি অথবা ঘোড়াগাড়িও নেই।

লালি পেয়ারাতলায় বেতের চেয়ার-টেবল পেতে নাস্তা লাগিয়ে দিয়েছিল। নাস্তা শেষ করে বাড়ির পিছনটা ঘুরে দেখছি। ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কা লাগানো হয়েছে। এদিকে–আদাও আছে কুয়োতলার পাশে পাশে পুদিনার ঝাড় লেগেছে। ধান লাগাতে দেরি হয়ে গেছিল, নীচু জমিতে–তাই ধান ভাল হয়নি এবার। বৃষ্টিও এবারে খুব কম হয়েছে।

কুয়োতলার পাশ দিয়ে পাহাড়ি নালাটা গেছে এঁকেবেঁকে। বাড়ির এই-ই সীমানা। বাড়ির তিন পাশ দিয়ে নালাটা ঘুরে গেছে।

আজ থেকে দশ বছর আগে এ নালা দিয়ে প্রতিরাতে বড় বাঘ যাওয়া-আসা করত।

এখনো হায়না যায়, গরমের দিনে মহুয়ালোভী একলা ভালুক। আর চুপি চুপি আসে লুমরীরা। পা টিপে টিপে আসে, পা টিপে টিপে শুকনো পাতা মচমচিয়ে পালিয়ে যায়।

রাতে শুয়ে শুয়ে তাদের আসা-যাওয়ার শব্দ শুনি। কখনো কখনো নেকড়ে বাঘ আসে মুরগী ও ছাগল ধরতে। দেঁহাতীরা বলে রাতেরবেলা এই নালা দিয়ে ভূতেরাও যাওয়া-আসা করে। নানারকম ভূত।

মাঝে লালির অসুখ করেছিল; একটি ছেলেকে পেয়েছিলাম রান্না করার জন্যে। তাকে শুতে বলা হয়েছিল রান্নাঘরে;–শীতের রাতে উনুনের গরমে আরামে শোবে বলে।

প্রথম দিন কাজ করল, তারপর প্রথম রাত পোয়ালে দেখি সে আর ওঠে না।

সকাল আটটা বাজল, চা দেওয়ার নাম নেই। দরজা ধাক্কিয়ে তাকে জাগাতেই সে কাঁদতে আরম্ভ করল, বলল, আমাকে এক্ষুনি ছুটি দিন বাবু, আমি এখানে এই জঙ্গলে কাজ করতে পারব না।

কি হয়েছে শুধোতে সে বলল, সারা রাত ভূতেরা এই নালায় ধমর-ধামর করে শুকনো পাতায় নেচেছে, নানা রকম আওয়াজ করেছে, একশ টাকা মাইনে দিলেও সে এখানে চাকরি করবে না।

অতএব তাকে তক্ষুনি ছুটি দিতে হয়েছিল।

কুয়োর পাশে পাশে অনেকগুলো জংলী জাম এবং আমলকিগাছ গজিয়েছে। একদল টিয়া এসে তাতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। আমলকির ডালে-বসা টিয়ার ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় মালু বলল, বাবু খত আয়া।

মালু পোস্টাফিসে গেছিল খত্ আনতে। এখানে ডাকপিওন নেই। সকাল এগারোটায় যখন গাড়ি আসে আপ-ডাউনের, তখন প্রত্যেককে যেতে হয় পোস্টাফিসে।

পোস্টমাস্টার একে একে নাম পড়ে যান–যে যার চিঠি নিয়ে বাড়ি ফেরে। এখানের হাট এবং পোস্টাফিস হচ্ছে ক্লাবের মত–সকলের দেখা-হওয়ার জায়গা।

খামের চিঠি, হাতের লেখাটা দেখেই অবাক হলাম। অবাক নয়, বলা উচিত উত্তেজিত হলাম। এ চিঠি এমন একজন লিখেছে যার কাছ থেকে চিঠি এলে আমার স্বাভাবিক কারণেই উত্তেজিত হবার কথা।

চেয়ারে বসে চিঠিটা খুললাম। ছুটি লিখেছে। রাঁচী থেকে।

রাঁচী
১০/১১/৭২
সুকুদা,

আপনি নিশ্চয়ই আমার চিঠি পেয়ে অবাক হয়ে যাবেন, কিন্তু অবাক হওয়ার মত কিছু আছে বলে আমি ত জানি না।
বহু দিন হল আপনার কোনো চিঠি পাই না। কিছু দিন আগে কোলকাতায় গেছিলাম।
অনেকদিন আপনাকে দেখিনি–তাই খুব দেখতে ইচ্ছে হওয়ায় সমস্ত ঝুঁকি নিয়েই আপনাদের কেয়াতলার বাড়িতে গেছিলাম। বৌদি ছিলেন না।
অবশ্য না-দেখা হয়ে ভালই হয়েছে, দেখা হলে আমি খুবই এমবারাসড ফিল করতাম। যে দোষে আমি দোষী নই, দোষী ছিলাম না কোনো দিনও, সেই দোষের জন্যে মনে মনে উনি আমাকে অনেক শাস্তি দিয়েছেন। অবশ্য একথাও জানি যে, সেই শাস্তির বোঝা বইতে হয়েছে আপনাকে, কখনো প্রতিবাদের সঙ্গে, কখনো বিনা প্রতিবাদে।
এমন অসুখ কি করে বাধিয়েছিলেন জানি না।
ভগবানের দয়ায় আপনার কোনো কিছুরই অভাব ছিল না, নিজেকে সুখী করার সমস্ত রকম উপাদান আপনার মধ্যে ছিল, একজন পুরুষমানুষ জীবনে যা চাইতে পারে তার সব কিছুই আপনি পেয়েছিলেন অথচ তবু সব জেনে-শুনে আপনি এমন নিজেকে নির্দয়ভাবে নিপীড়নের পথ বেছে নিলেন।
কার উপর অভিমানে আপনি এমন করে নিজের প্রতি অযত্ন করে এই অসুখ বাধালেন?
আপনার সঙ্গে দেখা হলে খুব ঝগড়া করব।
 আপনাদের বাড়িতে শুনলাম আপনি আরো মাস ছয়েক ওখানে থাকবেন। আপনার উপর কতখানি রাগ করে আছি তা আমার সঙ্গে দেখা হলে বুঝবেন। আপনি রাঁচী হয়ে গেলেন, অথচ আমাকে একটা খবর পর্যন্ত দিলেন না। ওখানে এত দিন হল আছেন, রাঁচী থেকে মাত্র পঁয়ত্রিশ মাইল পথ, অথচ আমাকে ওখান থেকেও জানালেন না যাতে একদিন আপনার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারি।
আপনি নিজেকে কি ভাবেন জানি না। আপনি আমাকেও কি ভাবেন তাও জানি না। আপনাকে কি আজ মনে করিয়ে দিতে হবে যে, আপনার অশান্তি যাতে না বাড়ে, আপনি যাতে বেশি করে দুঃখ না পান, শুধু সেই জন্যেই কোলকাতার বন্ধু বান্ধবী, আত্মীয়স্বজন সব ছেড়ে একজন সদ্য এম-এ পাশ-করা অল্পবয়সী অবিবাহিতা মেয়ে একা এখানে চলে এসেছিলো?
এক সময় আপনি আমাকে একদিন না দেখতে পেলে পাগলের মত করতেন, অথচ আমাকে শুধু একবার চোখের-দেখা দেখার জন্যে আপনাকে যে কষ্ট ও অনেক সময় অপমানও সহ্য করতে হত তা আর কেউই না জানুক, আমি জানতাম।
সে কষ্ট আমার পক্ষে অসহ্য ছিল। আমার প্রতি আপনার এক অদ্ভুত আচ্ছন্ন, আবেগময় এবং মাঝে মাঝে এখন মনে হয়, হয়ত অন্তঃসারশূন্য ভালোবাসার দাম দিতে গিয়ে আমার সমস্ত সখের জীবনটাই প্রায় দিতে বসেছি–অথচ আপনি এমন নিষ্ঠুর যে আমার এত কাছে থেকেও আজ আমাকে একবার দেখতেও ইচ্ছে করল না আপনার। একবার দেখা দিতেও না।
আপনি বলতেন, মেয়েরা ভালোবাসার কিছু বোঝে না। এমন ভাব করতেন, যেন পৃথিবীতে কাউকে ভালোবাসার মানে কি তা একমাত্র আপনিই বুঝতেন।
অন্য পুরুষদের কথা জানি না, কিন্তু আপনাকে দেখে যদি ছেলেদের ভালোবাসার সংজ্ঞা স্থির করতে হয় তবে তা সমস্ত পুরুষ জাতির পক্ষে বড় কলঙ্কের হবে।
রাঁচীর রাতু বাস স্ট্যান্ডে আমি খোঁজ নিয়েছি–বিকেলে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বাস ছাড়ে এখান থেকে। সন্ধ্যের পর সেখানে পৌঁছয়। আপনার বাড়ি আমি চিনি না, শুনেছি খুব জংলী জায়গা।
এ পর্যন্ত অনেক কিছুই একা একা খুঁজে নিয়েছি, চিনে নিয়েছি, তাই চিনে নিতে পারব না এমন ভয় নেই। একদিন লক্ষ লোকের মাঝ থেকে আপনাকে চিনতে যখন ভুল হয়নি, আজ অন্ধকার জঙ্গলে আপনার বাড়ি চিনতেও কষ্ট হবে না আশা করি।
আপনি কেমন আছেন? এখনো কতখানি অসুস্থ আছেন জানতে ভীষণ ইচ্ছা করে। এখনো কি সত্যিই অসুস্থ আছেন?
আমি আগামী শনিবার আপনার ওখানে যাচ্ছি। শনিবার রাত ও রবিবার আপনার ওখানে থেকে সোমবার ভোরের বাসে রাঁচী ফিরে আসব।
আমাকে আটকে রাখার চেষ্টা করবেন না। সময়ের আগে যেন তাড়িয়েও দেবেন।
আপনাকে বহু দিন বলেছি, যা দিতে পারি, সেটুকু দেওয়ার আনন্দ থেকে আমাকে বঞ্চিত করে, যা দিতে পারি না তা না-দেওয়ার বেদনাকে আরো তীব্র করবেন না।
আশা করি, আপনি আমাকে বুঝবেন।
আপনার চোখে আমি কি এবং কতখানি শুধু এ কথাই আপনি বারবার জানিয়েছেন, আপনি কোনোদিন সত্যিকারের আমার চোখে আপনি কি এবং কতখানি তা বোঝেননি এবং বুঝতে চাননি।
আপনার হয়ত অনেক আছে, অনেকে আছে, কিন্তু আমার আপনি ছাড়া আর কেউ নেই এত বড় পৃথিবীতে। আপনার মত করে এই অল্পবয়সের জীবনে আমাকে কেউ ভালোবাসেনি; অমন করে কেউ ভালোবাসতে জানে না।
আমার জীবন থেকে আপনি কিছু দিনের জন্যে হারিয়ে গেছিলেন, স্বল্পদিনের জন্যে। যার সামান্যই থাকে, সেই অসামান্যটুকু হারানোর দুঃখ যে কি, তা আমার মত করে আর কেউই জানেনি।
সোমবারে আমি ক্যাজুয়াল লিভ নেব। ধীরে সুস্থে রাঁচী ফিরলেই হবে।
আমি আসছি এ খবর শুনে আপনার শরীর নিশ্চয়ই বেশি অসুস্থ হবে না। অসুস্থ হলেও আমার কিছু করার নেই। আপনি বরাবরই স্বার্থপর। নিজের সুখের জন্যে চিরদিন আপনি অন্যকে দুঃখী করেছেন অথচ কোনোদিন অন্য কারো দুঃখের খোঁজ রাখেননি।
আমি জানি, আপনি নিশ্চয়ই এখন ভালো আছেন। আপনাকে ভালো থাকতেই হবে। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, যতদিন আমার নিঃশ্বাস পড়বে, ততদিন আপনার কোনো রকম ক্ষতি হতে দেব না। পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যা আপনার ক্ষতি করে।
ইতি–আপনার অনাদরের ভুলে-যাওয়া ছুটি।

চিঠিটা পড়া শেষ করে ভাঁজ করে রাখলাম, বার বার পড়লাম। চোখের কোণা দুটো কেন যেন ভিজে এল। বোধহয় অসুস্থ শরীরের জন্যে। এ শরীর এই আবেগ সহ্য করার শক্তি রাখে না।

এ রকমই কি হয়? যেদিন আমি একজনকে ভীষণভাবে চেয়েছিলাম, তার শরীর, তার মন, তার সবকিছু, তার সমস্ত; সেদিন সে লজ্জাভরে নুইয়ে ছিল, ভালো-লাগায় লজ্জাবতী লতার মত কেঁপেছিল শুধু, আমার বেহিসাবী পৌরুষের কোনো দানই গ্রহণ করার জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না।

সব সময় সে ভয়ে মরত, এই বুঝি অন্যায় করে ফেলল নিজের কাছে, নিজের বিবেকের কাছে, নিজের পরিবারের মর্যাদার কাছে; রমার কাছে।

পাছে সে কাউকে ঠকায়, অনুক্ষণ সেই আশঙ্কায় সে চুপ করে থাকত। মুখে বলত, না, না, না, চোখে বলত, না, না, না, আমার সমস্ত উদ্দাম অবুঝ আবেগের উত্তরে তখন সব সময় সে নিজেকে নিজের সংস্কারের মধ্যে লুকিয়ে রাখত। সামাজিক অনুশাসনের বোরখা পরে দূর থেকে সে চোখের ঘুলঘুলি দিয়ে আমাকে দেখত, আমার সত্যিকারের রূপ জানতে চাইত। আমার সমস্ত চাওয়া শুধু তার শরীরকে পাওয়ার মধ্যেই কেন্দ্রীভূত, না তার চেয়েও বড় কোনো চাওয়া এ পৃথিবীতে আছে, যে চাওয়ায় শুকিয়ে-যাওয়া মনও পুষ্পিত হয়ে ওঠে, তা ও সমস্ত অন্তর দিয়ে বুঝতে চাইত।

এতদিন পরে, এত বছর পরে আজ বুঝি আমার ছুটি, আমার অনেক দিনের ছুটি, আমার মত করেই বুঝেছে যে জীবনে কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না, কেউ কাউকে কিছু দিতেও পারে না। যা পাবার, যা দেবার, তা একমাত্র নিজেকেই পেয়ে ও দিয়ে ধন্য বা অধন্য হতে হয়। সে আনন্দ বা দুঃখ শুধু তারই। তার একার। সেই ন্যায় বা অন্যায়ের পাওনা এবং প্রায়শ্চিত্ত শুধু তার নিজেরই। তা যদি নাই-ই হবে তবে আজ ছুটি কেন এমন করে চিঠি লেখে?

যে মুহূর্তে আমার সমস্ত মন নিজেকে নিঃশেষে এ পৃথিবী থেকে ছুটি দিতে চায়, যে মুহূর্তে বেঁচে থাকার মত কোনো রকম অনুপ্রেরণাই আর আমার অবশিষ্ট নেই; ঠিক সেই মুহূর্তে কেন সে এমন করে আগল খুলে চিঠি লেখে?

কোনো আশ্চর্য শক্তিতে ও কি বুঝতে পেরেছে এখন আমার মনে কি হয়? আমার মন যে চিরদিনের মত আজ ছুটি চায় সকলের কাছ থেকে, এমন কি ছুটির কাছ থেকেও; তা কি ও বুঝতে পেরেছে?

.

০৩.

 কাল রাতে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছিল।

রাত কত তা মনে পড়ে না, বোধহয় বারোটা-টারোটা হবে–শীতের রাতে এই জঙ্গলে তা অনেক রাত হঠাৎ আমার ঘরের পাশে কার পায়ের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। কান খাড়া করে শুনলাম–শিশির-ভেজা পাতার উপরে কোনো লোকের অসাবধানী পায়ের শব্দ।

বিছানা ছেড়ে উঠে যথাসম্ভব কম শব্দ করে দরজা খুলে বাইরে টর্চ ফেললাম শব্দ লক্ষ্য করে-দেখলাম একজন অসম্ভব লম্বা কালো কুচকুচে লোক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে বুট জুতো, খাকি হাফ-প্যান্ট, গায়ে গরম কালো কোট।

লোকটা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে, দুহাত বুকের উপর আড়াআড়ি করে রেখে।

লোকটার কাছে গিয়ে মুখে টর্চ ফেলে শুধোলাম, তু কওন হো?

সে বলল, ফরেস্টের লোক।

এত রাতে এখানে কি করছ?

 মালুকে ডাকতে এসেছিলাম।

এত রাতে?

দরকার ছিল।

লোকটার কাছে যেতেই বুঝতে পেলাম লোকটা নেশা করেছে। মুখ দিয়ে মহুয়ার উৎকট গন্ধ বেরুচ্ছে।

আমার রাগ হয়ে গেল, বললাম, এ বাড়ির হাতার মধ্যে রাতে আর কোনোদিন তোমাকে ঢুকতে দেখলে গুলি করে মাথার খুপরি উড়িয়ে দেব মনে থাকে যেন।

লোকটি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, জী হুজৌর। বলে পিছনের গেটের দিকে যেতে লাগল।

একটু পরই, আমি গিয়ে শুয়ে পড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে চুড়ি ঝমঝমিয়ে কে যেন আমার জানালার পাশ দিয়ে ছুটে গেল বাইরে। তাড়াতাড়িতে জানালা খুলে টর্চ জ্বেলে বুধাই-এর লাল ফুল শাড়ির পেছনটা দেখতে পেলাম। বুধাই মালুদের ঘরের দিক থেকে দৌড়ে যাচ্ছিল, বাইরের দিকে।

দেখতে পাচ্ছি এতদিন অনেকের কানাঘুষায় যা শুনেছি, তা সত্যি। লালির বড় মেয়ে বুধাইকে তার বর নেয় না। ও এখানেই থাকে।

মেয়েটার বয়স উনিশ-কুড়ি হবে। সারা গায়ে যৌবন উপছে পড়ছে–তবে চোখমুখ থ্যাবড়া থ্যাবড়া–খুব ভালো স্বাস্থ্য। মেয়েটা এমনিতে খুব হাসিখুশি–যখনি রেজার কাজ করে অথবা যখনি হাটের দিনে হাটে যায়–দেখি রঙিন চুড়ি পরে, রুপোর গয়নায় সাজে, মুখে চুলে তেল চুঁইয়ে পড়ে।

মেয়েটা ধীরে ধীরে কিছু করতে পারে না–হাঁটতে বললে দৌড়ে যায়; দৌড়তে বললে ওড়ে। প্রাণ উপছে পড়ে সব সময় ওর শরীর থেকে।

সেই মেয়েটার নাকি স্বভাব ভালো নয়।

এখানের সাহেব প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে আগে থাকতে সাবধান করে দিয়েছিলেন; বলেছিলেন, চোখ রাখতে।

আমার নিজের চোখ নিজের যা একান্ত সব জিনিস বা জন ছিল, তাদেরই পারল না চোখে চোখে রাখতে, তাই এত দূরের ও পরের জিনিসে চোখ রাখার প্রয়োজন মনে করিনি। এখন দেখছি, নিজের বাড়ির হাতায় আসর বসিয়েছে এরা।

ঘুম চটে গেল। ভাবতে লাগলাম মা-বাবাই বা কেমন? চোখের সামনে মেয়েটাকে যা খুশি তাই করতে দিচ্ছে? মা-বাবার মত ছাড়া এমন হয়?

মালুটা বোকা–ওকে লালিই চালায়। লালির বয়স পঁয়তাল্লিশ মত-মুখ মিষ্টি-ধূর্ত মেয়ে। যৌবনে নিজেও কি করেছে বলা মুশকিল। তবে মালু আমার দেবতা। দোষের মধ্যে হাটের দিনে একটু নেশা করে ফেলে। এ ছাড়া মালুর কোনো দোষ নেই। মালু একজন খাঁটি, সৎ ও সরল ওঁরাও। সংসারের মারপ্যাঁচ ঘোঁৎঘাঁত ও বোঝে না। ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায় ও অনেক মার খেয়েছে এতাবৎ সংসারের কাছে।

আজ এত রাতে আর কিছু করার নেই। কাল সকালে এ ব্যাপারের একটা ফয়সালা করতে হবে।

কোনো আদিমতম জানোয়ারের কামড় খেয়ে এই শীতের রাতে ফরেস্ট অফিসের বেয়ারা মৌসুমী কুকুরের মত পাকদণ্ডী বেয়ে মহুয়া খেয়ে অন্ধকার সাঁতরে চলে আসে কেন তা বুঝতে পারি। কিন্তু এ অঞ্চলে শুনতে পাই অনেক চেঞ্জার বাবুরাও নাকি এমনিভাবে মৌসুমী কুকুরের মত ঘোরেন-ফেরেন।

জানি না তাঁরা কী পান? একটা অচেনা, অজানা মনহীন শরীর ঘেঁটে ঘেঁটে ওঁরা কি খোঁজেন?

এপাশ-ওপাশ করি, কিছুতেই আর ঘুম আসতে চায় না।

বস্তীতে কারা যেন মাদল বাজিয়ে একটানা দোলানী সুরের ঘুমপাড়ানী গান গেয়ে চলেছে।

মাঝে মাঝে অনেক দূরের রেললাইন থেকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শীতের রাতের ডিজেল ইঞ্জিন একটানা ভারী আওয়াজ তুলে, সে আওয়াজ অন্ধকার পাহাড়ে-বনে প্রতিধ্বনিত করে চলে যাচ্ছে।

আবার সব আওয়াজ থেমে গেলে চারিদিক থেকে শুধু ঝিঁঝির একটানা ঝিঁ ঝিঁ রব এবং পাতা থেকে শিশির পড়ার ফিসফিসানিতে সমস্ত রাত ভরে যাচ্ছে।

ফাদার মার্টিনের বাড়ির জোড়া-অ্যালসেশিয়ান ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে। দূর থেকে সে ডাক ভেসে আসে।

নালার দিক থেকে একটা খাপু পাখি হঠাৎ ডাকতে শুরু করল, খাপু-খাপু-খাপু-খাপু। খাপু পাখির ডাক শেষ হলে মিসেস ডাগানের বাড়ির দিক থেকে (যেখানে প্যাট গ্ল্যাসকিন থাকে) একটা টিটি পাখি, টিটির-টি-টিট্রি-টি-টি করতে করতে এ বাড়ির দিকে উড়ে আসতে লাগল।

টিটি পাখিটা কি কিছু দেখেছে? কোনো জানোয়ার? কোনো লোককে এই রাতের পথে চলাফেরা করতে? নাকি সেই লোকটিকে দেখেছে, যাকে এখানের অনেক লোকই দেখেছেন? লোকটির পরনে কালো ট্রাউজার এবং কালো শার্ট-দূর থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে লোকটিকে আসতে দেখা যায়, তারপর কাছে এলেই সে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। মিস্টার পটার দেখেছেন তাকে, একদিন মিস্টার এন্ড মিসেস এ্যালেনও দেখেছেন।

এই পরিবেশে, নির্জনতায়, এখানে সব কিছুই থাকা ও দেখা সম্ভব।

 চামার মোড়ে কিছুদিন আগে কারা যেন অত্যাচারী সুদখোর ব্যবসায়ীকে খুন করে তার মৃতদেহ গাছ থেকে ঝুলিয়ে রেখেছিল–সেই বীভৎস মৃতদেহের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, গভীর রাতে একলা-চলা ডুলি রেঞ্জের বড় বাঘের কথা। সে পথে এখন গেলে তাকে দেখা যেতে পারে। শিশিরের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সে হয়ত পথের উপর নরম ধুলোয় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। অথবা সেই হাতীর দলের কথা–যারা পালামৌর স্যাংচুয়ারী থেকে মাঝে মাঝে চলে এসে এই চামার রাস্তায় শুঁড় উঁচিয়ে পথ জুড়ে দাঁড়ায়।

মনে পড়ে যায় টি-বি হসপিটালে আমার পাশের বেডের সতেরো বছরের ছেলেটির জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করার কথা। পুরো হাসপাতালের কেউ জানলে না, কেন অমন ফুটফুটে ছেলেটা আত্মহত্যা করলো। অথচ সে নিজেকে এমন হঠাৎ করে নিবিয়ে দিল অসময়ে ফুঁ দিয়ে তার কারণ একটা নিশ্চয়ই ছিল। অথচ কারণটা কেউই জানলো না। জানতে চাইলোও না পর্যন্ত।

এমন এমন সব হঠাৎ ঘুম-ভাঙা রাতে পিস্তলের নলটা কপালের কাছে লাগিয়ে আমিও ভাবি–যখন অমনি করে হঠাৎ হাওয়ার মত কোনো সুন্দর চাঁদনী রাতে, ফুলের গন্ধের মধ্যে, রাতচরা পাখির ডাকের মধ্যে, রুপোলী রাতের ঝুমঝুমিয়ে বেজে-ওঠা সমস্ত শব্দতরঙ্গের মধ্যে এখানে একদিন নিজেকে নিবিয়ে দেব–সেদিন এবং তারপর একজনও কি জানবে, জানতে চাইবে, কেন হঠাৎ নিবে গেলাম আমি?

আসলে কেউই জানবে না, কেউই কাঁদবে না, কেউই ভাববে না।

 হাসপাতালের সেই অখ্যাত তরুণের জন্যে, রোজ সকালে গোলাপের পাপড়ি থেকে ঝরে-পড়া শান্ত শীতল শবনমের জন্যে, কে-ই বা কোনদিন কেঁদেছে?

তবুও যেতে হবে, চলে যেতে হবে, আজ কিংবা কাল; নিজের হাতে নিজেকে খেয়া-পার করাতে হবে।

যে-হাতে পিস্তল ধরা থাকবে সেই হাতেই একজনের নরম হাত ধরার স্বপ্ন নিয়ে দুটি চোখ বুজে আসবে।

এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জে পাখি ডাকবে, ফুল ঝরে পড়বে, শুকনো পাতা উড়বে চৈতী হাওয়ায়, মহুয়া আর করৌঞ্জের গন্ধে ভারী হয়ে থাকবে সমস্ত প্রকৃতি–আর এই দ্বন্দ্ব ও দ্বিধায় ক্লিষ্ট বঞ্চিত ও ব্যথিত হৃদয়ের একজন চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকবে।

ঘুমিয়েই কি থাকবে? না আমাকেও সেই কালো ট্রাউজার ও কালো শার্ট পরা অশরীরী লোকটির মত দেখা যাবে এই জঙ্গলের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে?

.

০৪.

কাল এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল দুপুরের দিকে। তারপর থেকে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে। আজ আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবার পরই ঠাণ্ডার প্রকোপ বেড়েছে। কনকনে একটা হাওয়া বইছে উত্তর থেকে।

মান্দারের সাহেব ডাক্তার সকাল-বিকেল দুবেলা নিয়ম করে হাঁটতে বলেছেন। এখন ওষুধ খাওয়ার বিরাম নেই। ঘড়ি ধরে এখনো নানা রকম ক্যাপসুল খেতে হচ্ছে। তার সঙ্গে একাধিক টনিক।

লোকে বলে, আজকাল যক্ষা হলে কেউ মরে না। কথাটা হয়ত সত্যি, সময়মত ধরা পড়লে কেউ মরে না। কিন্তু প্রাণে না মরলেও যে প্রাণান্তকর পরিস্থিতিতে রোগীকে পড়তে হয়, তা এ রোগের রোগী মাত্রই জানেন।

একটা লাংস আমার চিরদিনের মত অকেজো হয়ে গেছে। অন্যটা নিয়ে যতদিন বাঁচি ততদিন সাবধানে বাঁচতে হবে। এ ভাবে বাঁচার কোনো মানে নেই। আমি এমন কোনো লোক নই যে আমার বেঁচে থাকার জন্যে যে কোনো মূল্য দিয়ে বাঁচতে হবে। এমন কিছু মহৎ কর্ম আমার করণীয় নেই; আমি মরলে কোলকাতার ময়দানে আমার স্ট্যাচু হবে না, কেউই আমাকে মিস্ করবে না–তাই যেমনভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম তেমনভাবে বাঁচতে না পারলে আমার কাছে বেঁচে থাকাটা সম্পূর্ণ নিরর্থক।

 বিকেলে ফুল-স্লিভস সোয়েটার চাপিয়ে মাথায় গরম টুপি দিয়ে হাঁটতে বেরোচ্ছি, এমন সময় দেখি দূর থেকে প্যাট আসছে।

প্যাটের একটা পা নেই। থাইয়ের কাছ থেকে কাটা ডান পাটা। ও যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সিঙ্গাপুরে ছিল তখন বোমার টুকরোয় ওর পা জখম হয়েছিল।

প্যাটের বয়স হবে পঁয়তাল্লিশ। আমার চেয়ে অনেক বড়। কিন্তু দেখলে পঁয়ত্রিশ বলে মনে হয়। ক্রাচে ভর করে ও সারা ম্যাকলাস্কি ঘুরে বেড়ায়। সমস্ত সময় মুখে হাসি লেগে আছে। প্যাট বিয়ে-থা করেনি। মিসেস ডাগানের বাড়ি ও দেখাশোনা করে মাসে একশ টাকার বিনিময়ে।

ছোট শোবার ঘরটা দেওয়ালময় পিন-আপ ছবিতে মুড়ে রেখেছে। ও হেসে বলে, ইউ সী, আই ফিল ভেরী সোনলি ইন উইনটার নাইটস, দ্যাটস হোয়াই দে কীপ মি কোম্পানি, দে গিভ মি আ লিটল ওয়ার্মর্থ।

প্যাট দূর থেকে বলল, গুড আফটারনুন মিঃ বোস।

আমি হেসে বললাম, গুড আফটারনুন।

ও আবার আসতে আসতে বলল, গোয়িং ফর আ স্ট্রল?

আমি বললাম, ইয়া।

 ও বলল, কাম, আই উইল এ্যাকম্পানি ইউ।

লালি এসে শুধোলো এখন দুধ খাব কি না, না ল্যাংড়া লাসকিনের সঙ্গে বেড়িয়ে এসে খাব।

আমি বললাম, বেড়িয়ে এসে খাব।

এখানের দেঁহাতীরা লোকের নামকরণে বড় পটু কিন্তু বড় ক্রুড। প্যাট গ্লাসকিনের যেহেতু একটি পা নেই, ওকে এখানে সকলে বলে ল্যাংড়া লাসকিন। হল্যান্ড সাহেব এদের উচ্চারণে :হলান্ডুয়া।

এখানের লোকজন, অদ্ভুত প্রাগৈতিহাসিক সব প্রথা, মধ্যযুগীয় আবহাওয়া এবং নীরব নিরবচ্ছিন্ন শান্তি সব মিলিয়ে বড় ভালোবেসে ফেলেছি এ জায়গাটা। এখানের সব কিছু আমার মনোমত। এই শান্ত ঢিলে-ঢালা জীবন, যেখানে একশ টাকা মাইনে-পাওয়া লোককে সবাই মিলিয়নীয়র ভাবে, যেখানে জীবন ধারণের জন্য প্রতি মুহূর্তে দৌড়াদৌড়ি নেই, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই, কনফারেন্স নেই, যেখানে পথ চলতে ডিজেলের ধোঁয়া বুকের মধ্যে অবধি নিষ্পাপ শিশুদের বিষাক্ত করে না, যেখানে চাওয়া অল্প আর প্রাপ্তির আনন্দ অনেক, এমনি জায়গায় কার না ভালো লাগে?

দুঃখের বিষয় এই যে এখানে চিরদিন থাকা যায় না। যে পরিবেশে, যেভাবে আমরা মানুষ : খ্যাতি, টাকা-পয়সা, প্রতিপত্তির ম্যারাথন দৌড়ে যাদের ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তাদের উঁচুগ্রামে বাঁধা মন ও শরীরের তার এখানে এলে ঢিলে হয়ে পড়ে। ভয় হয়, মরচে ধরে যাবে। আতঙ্ক হয়, এখানে বেশি দিন থাকলে কোলকাতায় ফিরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের আর জয় করতে পারব না। তারা শিরস্ত্রাণ ছাড়াই তাদের তরোয়ালের এক এক কোপে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে শেষ করে দেবে। তাই সুপ্রাচীন সভ্যতার অভিশাপে অভিশপ্ত আমি আবার এক সময় ফিরে যাব সেই ধূলিমলিন নোংরা আবহাওয়ায়। চোগা-চাপকান পরে কোর্টে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা সওয়াল করব, মোটা অঙ্কের চেক পুরবো পকেটে এবং সলিসিটার এবং মক্কেলদের সঙ্গে বাধ্য বেড়ালের মত হেসে হেসে কথা বলব।

ইচ্ছে করুক কি না করুক।

বাড়ির গেট ছাড়িয়ে এসে নালা পেরোলাম। পেরুতেই, চামার দিকের লাল মাটির অসমান, পাথর-ছড়ানো ধূলি-ধূসরিত রাস্তা।

একটু এগিয়ে যেতেই বাড়ি-ঘর সব পেছনে পড়ে রইল। বাঁদিকে শেষ বাড়ি মিঃ এ্যালেনের। ডানদিকে শেষ বাড়ি মিস্টার কিং-এর। তারপর কোনো বাড়িঘর নেই। সোজা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে উঁচু-নীচু পথটা চলে গেছে ডুলির দিকে। সেখানে একটি ফরেস্ট বাংলো আছে। ডুলির পরে আরো মাইল দুয়েক গিয়ে রামদাগা গ্রাম। মাঝে আরো একটা গ্রাম আছে ডানদিকের উপত্যকা পেরিয়ে তার পরের পাহাড়চূড়ায়। এই কাঁচা রাস্তাটা চামা অবধি প্রায় আট মাইল মত রাস্তা খুবই খারাপ–পায়ে হেঁটে যেতেও কষ্ট–এত পাথর ছড়ানো ও অসমান।

দুদিক থেকে তিতির ডাকছিলো ক্রমাগত চিঁহা চিঁহা চিঁহা করে। নাকটা পাহাড়ের আড়ালে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। লাল, বিধুর আভা ছড়িয়ে ছিল আকাশময়। একটা শুকনো ঠাণ্ডা ভাব উঠছিল চারদিক থেকে। পিটিস ঝোপ থেকে ভেজা উগ্র গন্ধ বেরুচ্ছিল।

মাঝে মাঝে চষা জমি। কিতারি লাগিয়েছে, মকাই লাগিয়েছে, কোথাও বা মিষ্টি আলু। ঢালে ঢালে সর্ষে লাগিয়েছে। হলুদ আঁচলে শেষ বেলার লাল লেগেছে।

তিতিরের চিৎকার ও দূরের ক্কচিৎ ঘরে-ফেরা পাখির ক্ষীণ স্বর ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। প্যাটের ক্রাচের শব্দ হচ্ছে শুধু পাথুরে মাটিতে। দূরের ঝোপে একদল ছাতারে ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করেছে।

একটু এগিয়ে যেতেই সে আওয়াজ মিলিয়ে গেল।

মনে হচ্ছে, ঘাড়ের কাছে কার দুখানি ঠাণ্ডা হাত এসে চেপে বসেছে। রোদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডাটা ঝুপ করে নেমে আসে, যেন মন্ত্রবলে।

একটা পাহাড়ি বাজ উঁচু শিশুগাছের মগডালে বসে ডানা ঝাপটিয়ে দিনশেষের খবর জানালো।

প্যাট আস্তে আস্তে বলল, সেদিন রিডারস্ ডাইজেস্টে পড়ছিলাম একটা লেখা।

আমি বললাম, কি লেখা?

হাউ ইভনিং কামস। আমাদের সকলের সামনেই সন্ধ্যে হয় রোজ কিন্তু আমরা কজন সেদিকে চোখ তুলে তাকাই? দিনের শেষ এবং রাতের শুরুর মধ্যে এই যে গোধূলি লগন, এই লগনকে আমরা কজন উপলব্ধি করি?

প্যাটের কথায় একটা চমক লাগল মনে। আর কেউ করুক আর না করুক, ভগবানের দিব্যি; আমি করি। জঙ্গল পাহাড়ের পরিবেশে সন্ধ্যালগ্নে দাঁড়িয়ে নাক ভরে আসন্ন হিমের রাতের গন্ধ নিতে নিতে, পশ্চিমাকাশের শেষ ফিকে গোলাপি রঙের আভার দিকে চোখ মেলে আমার বারে বারে মনে হয় যে আমি যেন এখানেই জন্মেছিলাম। কোনো কালে। মনে হয় প্রকৃতিই আমার আসল মা, আমার আসল, প্রথম এবং সর্বশেষ প্রেমিকা। হয়ত অনেক নারী এসেছে, চলে গেছে, অথবা আছে এখনো আমার জীবনে, তারা সকলেই জংলী হলুদ সানফ্লাওয়ারের মত, বেগনেরঙা প্রজাপতির মত, ঘুঘুর কবোষ্ণ বুকের মত, কিন্তু তারা এই প্রকৃতিরই টুকরো মাত্র। তারা খণ্ড এবং প্রকৃতি তাদের সমষ্টি।

প্যাট আগে আগে হাঁটছিল।

প্রথম প্রথম প্যাটের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওর জন্যে সহানুভূতি হত, অনুকম্পা হত, কিন্তু আলাপ ঘনিষ্ঠ হবার পর দেখছি ও কারো সহানুভূতির অপেক্ষা করে না। ইংরেজি চরিত্রের এই পুরুষালি দিকটা ও পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে রক্তস্রোতে পেয়েছে। ও শুঁড়িখানা থেকে এক টাকা বোতলের পাঁচাশী মদ কেনে, তারপর তাকে ওর স্পেশাল ট্রিটমেন্টে ঠিক করে নেয়। একটি টিনের কৌটোয় এক চামচ চিনি ও দু আনা লবঙ্গ দিয়ে পুড়িয়ে নিয়ে চিনিটুকু তারপর বোতলে ঢেলে মিশিয়ে নিয়ে ঝাঁকিয়ে নেয়–তখন সেই সাদা তরলিমার রঙ বদলে গিয়ে ঘন বাদামী হয়ে যায়। দেখতে রাম-এর মত মনে হয়। সেই নিজে বানানো রাম খায় মাঝে মধ্যে। নেশায় একা ঘরে বুঁদ হয়ে থাকে।

ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেল।

শীতকালে জোনাকি জ্বলে না, সন্ধ্যাতারাটা দপদপ করে দিগন্তে; কোনো সুন্দরী মেয়ের কপালের নীল টিপের মত।

আমরা কেউই কথা বলছিলাম না।

অন্ধকারে প্যাটের ক্র্যাচের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে শুধু। চারিদিকে শিশিরের ফিসফিসে স্তব্ধতায় ঝিঁঝিদের ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিলো না।

.

০৫.

দেখতে দেখতে শনিবার এসে গেল।

কাল হেসালঙের হাট ছিল। হাট থেকে মুরগী কিনে মুরগীর ঘরে রেখেছিলাম। মিসেস কিং-এর কাছে বলে পাঠিয়েছিলাম এক ডজন কেকের জন্যে। আগে অর্ডার না দিলে কেক পাওয়া যায় না।

কার্নি মেমসাহেব রুটি ত রোজ দিচ্ছেনই, কাল যাতে ছুটির জন্যে বাদ দেন সে কথা বলে পাঠালাম। ভোরবেলা হানিফ এসে মেটে দিয়ে যাবে যাতে ব্রেকফাস্টে ও খেতে পারে।

লালিকে বলে হাসানকে খবর দিয়ে পাঠালাম। হাসান বাবুর্চি। এ বাড়িতে সম্মানিত অতিথিরা কখনো কেউ এলেই হাসানের ডাক পড়ে।

ভাবতেই যে কি ভালো লাগছে। আজ ছুটি আসছে আমার কাছে। বিনা নিমন্ত্রণে, নিজে যেচে; নিজের সঙ্গত অধিকারে সে আসছে আজকে।

অধিকার আমাদের অনেকেরই অনেক ব্যাপারে থাকে হয়ত অনেকের কাছে, কিন্তু সে অধিকারের তাৎপর্য ও তার সীমা আমরা অনেকেই সঠিক বুঝতে পারি না।

এতদিনে, এতদিনে যে ছুটি আমার এই ভাড়া-নেওয়া পর্ণকুটিরে, আমার এই শূন্য জীবনে তার নিজের ভূমিকা এবং অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে, এ কথা মনে করেই মন খুশিতে ভরে যাচ্ছে।

আমি বাইরের দিকের একটা ছোট ঘরে থাকি, সেখানেই আমার লেখার টেবল, টানা সব। তার পাশে একটা বড় ঘর–অন্য পাশেও বড় ঘর আছে। ছুটি কোন্ ঘর পছন্দ করবে, কোন্ ঘরে সে থাকবে জানি না। তাই দু ঘরেই বিছানা পাতিয়ে রাখলাম বিকেলে। ঘরে ধূপ জ্বালিয়ে রাখলাম।

ছুটি সুপ খেতে ভালোবাসে। হাসানকে সুপ, চিকেন রোস্ট, পুডিং সব বানাতে বলে দিলাম।

পত্রাতু থেকে ম্যাকলাস্কির বিজলী আসে। মাঝে মাঝে হঠাৎ আলো নিভে যায়। নিভিয়ে দেওয়া হয় সেখান থেকে। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলে ছুটি ভয় পেতে পারে, তাই সব ঘরে ঘরে বড় মোমবাতি লাগিয়ে দিলাম, তার পাশে রাখলাম দেশলাই।

গঙ্গা বাস চামার রাস্তা দিয়ে যখন প্রতিদিন যায় তখন সন্ধ্যে হয়ে যায়। চারধারে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে।

সব বন্দোবস্ত শেষ করে, লণ্ঠন হাতে মালুকে নিয়ে, ভালো করে গরম জামা-কাপড় পরে আমি বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।

এখানে এই-ই নিয়ম। যে যখন ফেরে, তার বাড়ির মালি (সাহেবরা বলে, কুলি) বাড়ির সামনে আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

গিরধারী ড্রাইভার বাস থামায়। যার যার বাড়ির পথের সামনে সে সে নেমে যায়, মালি মাল বয়ে নিয়ে বাড়ি যায়।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরই দূর থেকে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় গোঙানি তুলে ফাস্ট গিয়ার সেকেন্ড গিয়ারে আসতে শোনা গেল গিরধারী ড্রাইভারের গঙ্গা বাসকে।

দেখতে দেখতে হেড-লাইটের আলো দেখা যেতে লাগল। হেলতে দুলতে এগিয়ে আসতে লাগল বাসটা।

আমি একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়েছিলাম।

মালু এগিয়ে গিয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়ে লণ্ঠন উঁচু করে ধরলো। বাসটা থামলো। ভিতর থেকে মেয়েলি গলায় কে যেন হিন্দীতে বলল, মুঝকো হিয়াই উতারনা?

গিরধারী বলল, জী, মাইজী।

 বাসটা দাঁড়িয়ে একটা অতিকায় জানোয়ারের মত ঘড় ঘড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। একজস্ট পাইপের ধোঁয়ার গন্ধে, পিটিস ফুলের গন্ধ মুছে গেল। পেছনের দরজা দিয়ে ছুটি নামল।

কতদিন পরে ছুটিকে দেখলাম। ক–ত্ব—দিন—ন পরে।

একটা হালকা সবুজ সিল্কের শাড়ি পরেছে, গায়ে সাদা বুটিতোলা শাল, পায়ে চটি।

কনডাক্টর একটা ছোট স্যুটকেস হাত বাড়িয়ে দিল–মালু সেটাকে নিতে নিতেই ছুটি বলল, তুমি কে?

বাংলায় বলাতে, মালু বুঝলো না, মালু আঙুল তুলে বলল, বাবু ইয়েপর হ্যায়।

ছুটি অবাক গলায় ওকে বলল, বাবু হিয়া তক্‌ আয়া?

 তারপর ওরা দুজন তাড়াতাড়ি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

 বাসটা চলে গেছিল।

লণ্ঠনের আলোয় চারিদিকের অন্ধকার আরো ভারী হয়ে ছিল। ছুটি আমার কাছে এসে, একেবারে আমার সামনে দাঁড়াল–অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে সেই লালচে অন্ধকারে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, প্রায় ফিসফিস করে ওর বুকের মধ্যে থেকে বলল, কেমন আছেন? আপনি এখন কেমন আছেন?

কাউকে দেখলেই যে কারো এত ভালো লাগতে পারে, সমস্ত সত্তা হাওয়া-লাগা সজনে ফুলের ডালের মত দুলে উঠতে পারে, তা ছুটিকে দেখতে পেয়েই নতুন করে মনে হল।

ছুটির গলা শুনলে, ওর চোখে তাকালে, ওর কাছে দাঁড়ালে কেন আমি এতখানি খুশি হই? কেন হই আমি কিছুতে বুঝতে পারিনি কোনোদিনও।

আজকে আমি কত যে খুশি, কী যে সুখী; আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমার স্বপ্নের, আমার দুঃখের, আমার আনন্দের, আমার দুখজাগানীয়া, ঘুমভাঙানীয়া ছুটি আজ কতদিন পরে আবার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মালুকে বললাম-লণ্ঠনটা আমার হাতে দিয়ে এগিয়ে যেতে, গিয়ে লালিকে কফির জল চড়াতে বলতে।

মালু এগিয়ে গেলে, আমি বললাম, তুমি কেমন আছ? তুমি কেমন আছ বল?

ছুটি হঠাৎ আমার হাত থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে আমার মুখের কাছে তুলে ধরল, বলল,কতদিন আপনাকে ভালো করে দেখিনি, কই টুপিটা খুলুন একটু; খুলুন না।

টুপিটা খুলতে খুলতে আমি বললাম, তোমার স্বভাব একটুও বদলায়নি চাকরি-বাকরি করেও।

ছুটি অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, আপনি কিন্তু অনেক বদলে গেছেন।

টুপিটা পরতে পরতে আমি বললাম, তা ত যাবই। তোমার চেয়ে বয়সে আমি অনেক বড়, বদলে যাওয়াই ত স্বাভাবিক। বয়সে এবং চেহারায়ও।

বয়সের জন্যে বদলাননি। নিজেকে বদলে ফেলতে চেয়েছিলেন তাই বদলে গেছেন। কিন্তু এভাবে নিজেকে..লাভ কি?

আমি বললাম, তোমার অফিসে তোমার কাজটা কি? বক্তৃতা দেওয়া? তোমার বক্তৃতা দেওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে দেখছি। এখন চলো। বাড়ি পৌঁছে–তারপর যা বলার আছে শোনা যাবে।

বাড়ি কি অনেকদূর? বলে শালটাকে ভালো করে টেনেটুনে নিল ছুটি।

বললাম, এই এক ফার্লং মত। তোমার খুব শীত করছে, না?

মুখ ফিরিয়ে ছুটি বলল, এখানে বেশ শীত বাবা, রাঁচীর চেয়ে বেশি শীত–হাত দুটো শীতে কুঁকড়ে গেছে।

চলতে চলতে আমি আমার ডান হাতটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমার হাতে তোমার হাত রাখ, হাত গরম হয়ে যাবে।

ছুটি গ্রীবা ঘুরিয়ে এক চমক তাকাল। তারপর বলল, না।

একটু পরে আস্তে আস্তে বলল, সুকুদা, আমার সমস্ত শীতের দিনে আপনিই আমার দিকে আপনার উষ্ণতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন; চিরদিন। আপনাকে নানাভাবে, নানা জনের মারফত দুঃখী করা ছাড়া আর কিছু আপনার জন্যে করতে পারিনি। এখন বোধহয় আপনার ঠাণ্ডা হাতের দিকে আমার হাত বাড়ানোর সময় এসেছে–আমার হাতে আপনি হাত রাখুন, বলে ছুটি ওর হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।

বাঁ-হাতে লণ্ঠন নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছুটির বাঁ হাতে আমার ডান হাত রাখলাম। অনেক অনেকদিন পরে ছুটির হাতে হাত রাখলাম।

ভালোবাসা বলতে কি বোঝায় আমি জানি না, উষ্ণতা কথাটার মানে কি আমি জানতে চাইনি, কিন্তু বহুদিন পরে একজনের হাতে হাত রাখতেই আমার সমস্ত শরীর কেন যে এমন করে ভালো লাগায় শিউরে উঠল তাও কি আমি জানি? এই উষ্ণতা, এই আশ্লেষ, এই ভরন্ত ভালোলাগা, এর কি কোনো নাম নেই।

ছুটি আমার হাতখানি ওর সুন্দর নরম আঙুলে ও তালুতে দৃঢ় অথচ হালকা করে ধরে রইল। আমাদের দুজনের হাতের উষ্ণতা দুজনের হাতে ছড়িয়ে গেল। কারো হাতই আর ঠাণ্ডা রইল না।

আমার হঠাৎ মনে হল, আমি কোনো বিরহী ঘুঘুর বুকে হাত রেখেছি।

 বাড়ির কাছাকাছি এসে ছুটি বলল, আপনার বাড়ির চারপাশটা কেমন তা দেখা হল না। বিজুপাড়া পেরুতে না পেরুতেই ত অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। রাঁচীতে আমার এক বন্ধু বলছিল, জায়গাটা সুন্দর, সত্যিই সুন্দর?

বললাম, সকলের সৌন্দর্যজ্ঞান ত সমান নয়, তবে তোমার চোখে হয়ত অসুন্দর লাগবে না। কাল তোমাকে সব দেখাব।

দূর থেকে বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছিল।

ছুটি বলল, ওমা, এই জঙ্গলে ইলেকট্রিসিটি আছে? ভাবা যায় না এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গায় ছবির মত ছোট ছোট টালির বাংলোয় ইলেকট্রিক আলো জ্বলবে। তাই না?

জবাব দিলাম না কোনো। আমার সদ্যরোগমুক্ত শরীরাশ্রিত ক্লান্ত মনটা এমন ভালোলাগার আমেজে বুঁদ হয়ে ছিল যে, কোনো তুচ্ছ কথা বলেই সে আমেজ আমি নষ্ট করতে রাজি ছিলাম না।

বাড়িতে ঢুকে ছুটি সব ঘুরে ঘুরে দেখল–ওর চোখ বারবার দেওয়ালের বড় বড় ফাটল ও মেঝের লম্বা লম্বা ফাটার দাগ দেখতে লাগল। একটু পরে ও বলল, বাড়িটা এমন কেন? চতুর্দিক ফাটা, জরাজীর্ণ?

বললাম, বাড়িতে যে-থাকে তার মতই ত বাড়ি হবে? বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক যে-দামে এ বাড়ি কিনেছিলেন তাতে একটা মোটর সাইকেলও কেনা যায় না। সাহেব চলে যাচ্ছিলেন অস্ট্রেলিয়া। সুবিধামত দাম পেয়ে কিনে নিয়েছিলেন। কাল সকালে তোমার এতটা খারাপ লাগবে না, দেখো। এ বাড়িটা বাড়ি হিসেবে ভালো নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু বাড়ির পরিবেশটার জন্যেই শুধু ভালো লাগে।

ছুটি এসে ভিতরের বসবার ঘরের বেতের চেয়ারে বসল।

লালি বলল, বাথরুমে গরম জল দেওয়া হয়েছে।

 ছুটি উঠে হাত মুখ ধুতে বাথরুমে গেল।

ও আমার পাশের ঘরেই থাকবে বলেছে–বলেছে ওর ভয় করবে ওপাশের দূরের ঘরে শুতে।

বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ছুটি কফি ঢালতে লাগল, বলল, আপনি এক চামচ চিনি খেতেন, এখন কি বেশি খান?

হাসলাম, বললাম, আমি কফি খাবো না ছুটি, আমার খাওয়া-দাওয়া এখনো নিয়মমত করতে হয়। বাড়তি কোনো কিছু খাওয়া বারণ।

ছুটি কফি ঢালা বন্ধ করে কফির ছোট পটটা শূন্যে ধরেই বলল, কে এসব বলেছে? কোন্ ডাক্তার?

মান্দারের সাহেব ডাক্তার। যিনি এখন আমাকে দেখছেন।

ছুটি চোখ নামিয়ে আমার জন্যে একটি কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলল, তাঁকে বলবেন যে রাঁচীর লেডি ডাক্তার অন্যরকম প্রেসক্রিপশান করেছেন। কফি আপনার খেতেই হবে।

আমি যে দুদিন থাকব, আমি যা খাব, যা রাঁধব সবই আপনার খেতে হবে। তারপর একটু থেমে বলল, আজকালকার ডাক্তাররা খালি শরীরের চিকিৎসা করেন, যেন শরীর একটা লোহার জিনিস–তার সঙ্গে মনের কোনো সম্পর্ক নেই।

কফির কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে খুব অভিমানী গলায় বলল, সত্যি। আজ এত বড় একটা অসুখ হল, আমাকে একবার মনে পড়লো না আপনার, আমাকে একটা খবরও পাঠালেন না। আপনাকে কিছু বলার নেই আমার।

কফির কাপটা তুলতে তুলতে আমি বললাম, কেন খবর পাঠাব? তোমার মনে আছে? তুমি রাঁচী আসার আগে আমার একবার ভীষণ চোখের অসুখ হয়েছিল। আমি দিন-রাত চোখের কাজ করি, তাই যখন সাত দিন চোখ বুজে পড়ে থাকতে হয়েছিল তখন কি যে অবিশ্বাস্য অসহায়তা আর যন্ত্রণা ভোগ করেছি, তা কি বলব। চোখ বুজলেই একজনের মুখ দেখতে পেতাম। সত্যিই বলছি, একজনের চোখ দেখতে পেতাম।

প্রায় পাঁচ দিনের দিনে তোমাকে নিজে ডায়াল হাতড়ে-হাতড়ে ফোন করেছিলাম, বলেছিলাম, একবার এসো, তুমি দেখতে এলে আমার ভালো লাগবে।

তুমি বিদ্রুপের গলা বলেছিলে, আপনার কি দেখার লোকের অভাব। তারপর, মনে আছে কি না জানি না, আরো অনেক কথা বলেছিলে।

আমার মনে সেদিন সত্যিই সন্দেহ হয়েছিল যে, আমার প্রতি তোমার ভালো ব্যবহারটুকু কতখানি দেখানো এবং কতখানি সত্যি। তোমার উপর আমার জোর কিছু আদৌ আছে কি নেই, সেদিন ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর অপমানিত মনে বসে বসে শুধু তাই ভেবেছিলাম। আসলে আমার এ অসুখের কথা তাই জানাইনি।

ছুটি বলল, ভালোই করেছেন।

তারপর একটু থেমে বলল, আমি ত ভাবছি, কাল ভোরের বাসেই রাঁচী চলে যাব। যে ভদ্রলোকের নিজের অধিকার এবং নিজের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, তাঁর সঙ্গে ফাঁকা বাড়িতে একজন অবিবাহিতা মেয়ের থাকাটাও ভালো দেখায় না। আমাদের দুজনের মধ্যের সম্পর্ক যদি এতই পলকা হয়, যে অভিমানের বশে কেউ কাউকে কোনো কথা বললে তাতেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যেতে বসে, তাহলে জানতে হবে সম্পর্কটা এখনো যথেষ্ট পাকা হয়নি।

জবাব দিলাম না আমি, পেয়ালা-ধরা ওর হাতের উপর আমার হাত রাখলাম। ও কোনো কথা বলল না, দুঃখিত মুখে বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে রইল।

কফি খাওয়া শেষ করে ছুটি বলল, ওঃ ভুলেই গেছিলাম, আপনার জন্যে একটা জিনিস এনেছি, বলে ওর ঘরে গেল।

ফিরে এল একটি পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে, ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বলল, দেখুন ত, এই পুলোভারটা আপনার গায়ে হয় কি না।

একটা সুন্দর ফুল-স্লিভস্ পুলোভার বুনেছে ছুটি। ছাই-রঙা। বুকের ও হাতের কাছে সাদায় কাজ করা। আর দুটো ছাই-রঙা বড় মোজা।

ভাবলাম, এই ঠাণ্ডায় আপনার কাজে লাগবে। অনেক দিন আপনাকে কিছু দিইনি। পছন্দ হয়েছে আপনার?

আমি চুপ করে রইলাম। চুপ করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।

মাঝে মাঝে আমাদের চোখ এত কথা বলে, চুপ করে কারো দিকে চেয়ে থাকলে চোখ অনর্গল এত বলে যে, সে সময়ে মুখে কিছু বলতে ইচ্ছা হয় না।

আমাদের কলমের বা মুখের ভাষা কোনো দিনও বোধহয় চোখের ভাষার সমকক্ষ হতে পারবে না। আমার ছুটির চোখের দিকে চেয়ে আমি বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারি, হাজার বছর।

চোখে কিছু বললে, বলার কিছু বাকি থাকে, যা অন্য জনে কল্পনা দিয়ে ভরিয়ে নিতে পারে। মুখে বা লিখে বললে সব নিঃশেষে বলা হয়ে যায়; নিজের হৃদয়ে গোপন ও অব্যক্ত কথার আনন্দময় বেদনা তখন হারিয়ে যায়। সে এক দারুণ নিঃস্বতা।

আমার ফুসফুস হয়ত ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, কিন্তু আমার হৃদয় এখনো তেমনি আছে, আমার হৃদয় ঠিক যেমনটি ছিল। আমার ছুটি আমার চোখের সামনে থাকলে আমার হৃদয় এখনো তেমন ঝুমঝুমিয়ে বাজে। তখন আমার একটুও মরতে ইচ্ছে করে না।

যেদিন নিশ্চিতভাবে জানব যে ও আমার কাছে নেই, এমন কি আমার হৃদয়ের কাছেও নেই, এবং থাকবে না; জানব ও অন্য-কারো হয়ে গেছে অথবা অন্য কারোরই না হয়ে ও কেবল ওর নিজেরই হয়ে গেছে, সেদিন আমার বাঁচার আর কোনো তাগিদ থাকবে না।

হঠাৎ ছুটি বলল, এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি সত্যিই ভাবতে পারছি যে আপনি আমাকে একটা খবর দিলেন না কেন?

কি লাভ হত বল জানিয়ে? আমি বললাম, সকলের সব অশান্তি দূর করতে তুমি নিজেকে কোলকাতা থেকে দূরে নির্বাসিত করলে। তোমার কাছে আমি কত ছোট হয়ে থাকি, তা তুমি জানো না। তাছাড়া এ এমন একটা অসুখ, যে-অসুখে তোমার করার কি ছিল? হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম, ডাক্তার ছিলেন, নার্সরা ছিলেন। রুগীকে ত এরকমভাবেই থাকতে হয়। তুমি এলে তোমার কষ্ট হত শুধু।

চিকিৎসা নাই-ই বা করলাম, সেবা নাই-ই বা করলাম, আপনার কাছে ত থাকতে পারতাম।

তোমার কি ধারণা তুমি কখনও আমার থেকে দূরে থাকো? আমার সঙ্গে তুমি ত সব সময়েই থাকো। সমস্ত সময়। এতগুলো বছরে মনে পড়ে না কখনো যে তোমার কথা একবার না ভেবে একদিনও ঘুম এসেছে আমার, অথবা তোমার মুখ না মনে পড়ে ঘুম ভেঙেছে। তুমি কি কখনোও জানোনি যে, তুমি সব সময়ই আমার সঙ্গে থাক?

ছুটি ওর বড় বড় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি তুলে আমার দিকে চাইল। কোনো জবাব দিল না কথার।

লালি খাবার লাগিয়ে দিয়েছিল।

খাওয়ার ঘরে যেতে যেতে বললাম, তুমি কিন্তু খাওয়ার সময় দূরে বসে খাবে। আমার গ্লাস, আমার কাপ সব আলাদা করে রাখবে–আমার ঘরেও মোটে ঢুকবে না। তুমি ভালো করেই জান, এ রোগের বিশ্বাস নেই। যতখানি পারো আমার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলবে।

ছুটি অবাক হয়ে আমার দিকে চাইল, বলল, বুঝেছি আপনি যেমন সব সময় আমার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলছেন?

আমরা গিয়ে খাওয়ার টেবলে বসলাম।

 সস্তা লোহার ফোল্ডিং টেবিল, ফোল্ডিং চেয়ার, ফাটা দেওয়াল, ফাটা মেঝে।

এ ঘরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। খাওয়ার ঘরের পাশে রান্নাঘর–মধ্যে এক ফালি ঢাকা বারান্দা–কিন্তু দুপাশ খোলা। রান্নাঘরটা উত্তরে। এমন হাওয়া আসে যে, বলার নয়। হাওয়া আসুক আর নাই-ই আসুক, এ ঘরটা বড়ই ঠাণ্ডা হয়ে থাকে সব সময়। দিনের কোনো সময়েই এ ঘরে রোদ ঢোকে না।

শালটা ভালো করে মুড়ে বসল ছুটি…ঠাণ্ডায় ওর ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কিন্তু ছুটি আমার মুখোমুখি বসেছে, তাই আমার মনে হচ্ছে এই ফাটা-ফুটো ঘর, এই সামান্য আসবাবের দৈন্য, সবকিছুই ছুটি এসেছে বলে অসামান্য হয়ে উঠেছে।

হাসান এসে খুব গরম স্যুপ দিয়ে গেল। আমি বললাম, শীগগিরি খাও, নইলে দু মিনিটের মধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

ছুটি বলল, আমার ভীষণ শীত করছে, বলে টেবলের নীচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার হাঁটুতে রাখল। আমার হাত ওর হাতে নিয়ে ওর হাত গরম করে দিলাম।

লালি ভাঁড়ার থেকে আচারের টিনটা বের করে আনল।

ছুটি দেখে প্রায় চিৎকার করে উঠল, বলল, এ কি? এ আচার আপনি এখানে কোথায় পেলেন! আশ্চর্য। কবে কোলকাতায় বলেছিলাম, ভালোবাসি, আর আপনি সে কথা মনে করে রেখেছেন? বলুন না কোথায় পেলেন?

আমি হাসলাম, বললাম, খিলাড়ি থেকে আনিয়েছি।

ছুটি অবাক গলায় বলল, আপনার মনেও থাকে, আশ্চর্য। সব খুঁটিনাটি কথা।

বললাম, থাকে; সমস্ত খুঁটিনাটি কথা। যা মনে রাখতে ইচ্ছা হয়, সেগুলো সবই মনে থাকে।

এ আচার তবে রাঁচীতেও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আশ্চর্য। এত ভালোবাসি অথচ আমার নিজের একবারও মনে হয়নি যে রাঁচীতে খোঁজ করি।

তা ত হল। এখন আচার খাবে কি দিয়ে? আজ ত তোমার জন্যে একেবারে সাহেবী রান্না হয়েছে।

কাল খাব। কাল আর কিছুই খাব না। শুধু আচার দিয়ে এক থালা ভাত খাব।

বললাম, পাগলি।

 খাওয়া-দাওয়ার পর মধ্যের ছোট ড্রইংরুমে চেয়ারের উপর পা তুলে শাল মুড়ে শাড়ি টেনে বসল ছুটি। বলল, মশলা খাবেন? বলে ওর ব্যাগ থেকে একটি কৌটো বের করে একটু মশলা দিল। তারপর বলল, কটা বাজে?

দশটা। আজ আর গল্প নয়। এতখানি বাসে এসেছ। আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। আজকাল ভোরে কখন ওঠো তুমি? নটা না দশটা?

ও হাসল। বলল, আজ্ঞে না স্যার। নিজের অনেক কাজ করতে হয় ভোরে উঠে। আমি কি আর সেই আরামী, আদুরে মেয়েটি আছি?, এখন অনেক শক্ত হয়েছি আমি, অনেক কিছু করতে হয় আমাকে নিজের জন্যে। কাল দেখতেই পাবেন, কখন উঠি।

বললাম, কাল কোন্ সময় কি খাবে এখনি বলে রাখ। হাসানকে আমি সব বুঝিয়ে রাখছি।

ছুটি চলে গেল, বলল, দেখুন, আপনার বাবুর্চি-ফাবুর্চি ভালো রাঁধতে হয়ত পারে, কিন্তু আমার দরকার নেই কোনো। তাছাড়া আপনাকে পরিষ্কার বলে রাখি, কালকে আমিই সব রাঁধব–আমি আমার যা-খুশি আপনাকে বেঁধে খাওয়াব।

তাতে আমি খুশি যে হব তাতে সন্দেহ নেই–কিন্তু চারদিকে এত সুন্দর জায়গা আছে তোমাকে দেখাবার, তোমাকে নিয়ে যাবার যে, তুমি একদিনের জন্যে এসে হেঁসেলে ঢুকবে এটা মোটেই ভালো হবে না।

আহা। যে রাঁধে, সে যেন চুল বাঁধে না।

তা হয়ত বাঁধে, কিন্তু তুমি এমনিতেই রোজ  অনেক কষ্ট করো–আমার কাছে যখনি আসবে, যখনি থাকবে, তখন অন্তত তোমাকে একটু আরামে রাখতে দিও। তুমি এখানে সুন্দর করে সাজবে, সকাল বিকেল চারিদিকে বেড়িয়ে বেড়াবে, ক্ষিদের সময় এসে খাবে ব্যস–এখানে তোমাকে আর কিছুই করতে হবে না।

না। তা বললে হবে না।

 জেদী মেয়ের মত বলল ছুটি।

তাহলে একটা রফা হোক। হাসানই রাঁধবে, কিন্তু তুমি শুধু একটি পদ রেঁধো। কেমন?

কি ভাবল যেন ও। তারপর বলল, বেশ, তাই-ই হবে।

একটু পরে ও বলল, চলুন শুয়ে পড়া যাক।

ওর সঙ্গে আমি ঘরে গেলাম। বললাম, রাতে ভয় পাবে না তো? ভয় পেলে আমাকে ডেকো। আমি পাশেই থাকব। তোমার বালিশের নীচে টর্চ রইল, বোতলে খাবার জল, গ্লাস রইল। বাথরুমের আলোটা জ্বালিয়ে রাখতে পারো, ভয় করলে।

ভোরে আমার জন্যে তোমার তাড়াতাড়ি ওঠার দরকার নেই। ওদিকের ঘরের বাথরুম ব্যবহার করব আমি। যতক্ষণ ভালো লাগে ঘুমিও। মধ্যের দরজাটা ভেজিয়ে রেখো। ভয় নেই কোনো।

ছুটি এতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, এবার বলল, বুঝলাম।

 তারপর বলল, আপনার ঘরে চলুন দেখি।

আমার ঘরে এসে ও বলল, শুয়ে পড়ুন, আপনার মশারি গুঁজে দিচ্ছি।

বললাম, তুমি আগে শোও। আমার এখন অনেক কাজ বাকি। সব ঘরের দরজা বন্ধ করতে হবে, বাতি নেবাতে হবে। তুমি আগে শুয়ে পড়ো।

ও বলল, তাহলে মশারিটা ফেলে, গুঁজে দিয়ে যাই অন্ততঃ-। বলেই, মশারিটা ফেলে খুঁজতে লাগল।

টেবলের উপর লেখার কাগজগুলো ছিল, ও শুধোলো, এখন কি লিখছেন?

 বললাম, এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জের পটভূমিতে একটা উপন্যাস আরম্ভ করেছি। কি লিখছি তা জেনে তোমার লাভ কি? তোমার কি আমার লেখা পড়ার অবকাশ হয় এখন?

চোখে খুব রাগ ঝরিয়ে ছুটি বলল, তা ত বলবেনই, আপনি ত আর বলেন না, কোথায় লিখছেন–কি করে যে এখানে আপনার সব লেখা খুঁজে বের করি, তা আমিই জানি।

এটুকু বলেই, ওর চোখ দুটি বড় নরম হয়ে এল, ও স্বগতোক্তির মত বলল, খুব ভালো লাগে, জানেন…।

বলেই, থেমে গেল।

আমি বললাম, কি ভালো লাগে?

 খুব ভালো লাগে, যখন কেউ আপনার লেখার প্রশংসা করে। বলেই, আমার দিকে তাকাল।

আমি ওর চোখে চাইলাম।

 ও কথা না বলে মশারি খুঁজতে লাগল।

মশারি গোঁজা শেষ হলে ও বলল, শুতে যাচ্ছি।

পরক্ষণেই বলল, এই রে! একদম ভুলে গেছিলাম, বিজয়ার পরে দেখা, আপনাকে প্রণাম করতেই মনে ছিল না। বলেই নীচু হয়ে আমাকে প্রণাম করল।

আমি ওকে দুহাত ধরে টেনে তুললাম, টেনে তুলে ওর চওড়া সাদা পরিচ্ছন্ন সিঁথিতে একটা চুমু খেলাম। ও ছটফট করে উঠল। তারপর ওর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

আমি দুষ্টুমী করে বললাম, তোমাকে একবার আদর করতে খুব ইচ্ছা করছে, কিন্তু আমার ঠোঁটে এখন রাজরোগের বীজাণু! তোমার মুখের কাছে মুখ নেওয়াও সম্ভব নয়।

ও আদুরে গলায় বলল, থাক, অত আদর করে কাজ নেই। ছুটি গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনলাম।

আমি একে একে খাওয়ার ঘর, বাইরের ঘর, সব ঘরের দরজা বন্ধ করে, আলো নিবিয়ে ভিতরের বসবার ঘরে এলাম।

বৃষ্টির সময় ফায়ারপ্লেসের চুল্লী দিয়ে জল গড়িয়ে এসেছে ভিতরে। দেওয়ালে তার দাগ হয়ে গেছে। কিছু নোংরাও এসে জমেছে ভিতরে জলের সঙ্গে। কাল এগুলো পরিষ্কার করে, ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালাবার বন্দোবস্ত করতে হবে, ছুটিটার নইলে বড় কষ্ট হচ্ছে ঠাণ্ডায়।

ফায়ারপ্লেসের কাছ থেকে সরে এসে আলো নিভাতে যাব বসবার ঘরের, এমন সময় ছুটির ঘরের দরজা খুলে গেল খুট করে। দেখি, ছুটি দাঁড়িয়ে আছে, একটা কমলা রঙ কটসউলের নাইটি পরে! মুখে ক্রীম লাগিয়েছে। দু বিনুনী করে চুল বেঁধেছে।

ওকে ভীষণ বাচ্চা বাচ্চা লাগছে–ওর লালচে ফর্সা রঙে ওকে মনে হচ্ছে, কোনো রেডইন্ডিয়ান মেয়ে।

শুধোলাম, কি হল? ঘুমোওনি?

ও দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, না।

ওর চোখ দেখে মনে হল ও চাইছে, ভীষণ চাইছে, এই দারুণ শীতের কুঁকড়ে যাওয়া রাতে আমি একটু ওর কাছে যাই।

ওর সঙ্গে আমি ওর ঘরে গেলাম। ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। নাইটিতে ঢাকা ওর বুকে আমার বুক রাখলাম।

ও ভালো লাগায় শিউরে শিউরে উঠতে লাগল, আর মুখে বলতে লাগল, অসভ্য; আপনি একটা অসভ্য।

আমি ওকে ডাকলাম, ছুটি; আমার সোনা।

ছুটি যেন কোন ঘোরের মধ্যে, কত দূরের জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে, কত শিশিরভেজা উপত্যকার ওপাশ থেকে আমার ডাকে সাড়া দিল, অস্ফুটে বলল, উঁ, আরামে বলল উঁ–উষ্ণতার আবেশে বলল, উঁ…।

আর কোনো কথা হলো না। ও আমাকে আশ্রয় করে, আমাতে নির্ভর করে, আমার শক্ত বুকে ওর নরম, লাজুক, উষ্ণ বুকের ভার লাঘব করে আমার সারা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে রইল।

আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, সোনা, আমার ছুটি, এবার ঘুমোতে যাও। ছুটি অস্ফুটে বলল, না।

বললাম, ছুটি, তুমি এরকম করলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব। আমার খুব খারাপ অসুখ ছুটি, এমন করে না।

ছুটি তবুও বলল, না।

তারপর বলল, আপনাকে যদি আর কখনো এমন করে না পাই? এত বছর ত সকলে মিথ্যামিথ্যি দোষী করল আমাকে; আপনাকে। অপবাদ যখন মাথা পেতে সহ্যই করব, তবে নিজেদের ঠকাব কেন? কার জন্যে ঠকাব? আমাদের সকলে ঠকাবে আর আমরা কেন অন্যদের ঠকাবার আগে এতবার ভাবব?

আমি ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে তোমাকে ঠকায় এমন কোনো শক্তি ত নেই পৃথিবীতে। তোমার শরীরটাকে এই মুহূর্তে পেলেই কি ওদের উপর আমার জয় হবে ছুটি? এই যে তুমি আমার সামনে বসে আছ, এই তোমার সমস্ত তুমি, তোমার মন, তোমার সুগন্ধি শরীরের তুমি, এই সমস্ত তুমিই ত আমার, চিরদিনের। যে চিরদিনের, যা বরাবরের তাকে অত তাড়াতাড়ি পেতে নেই। তোমার শরীর ত আমারই–যখনই আমি পেতে চাইব তখনি পাব–এর জন্যে এ অধীরতা কেন তোমার? আমি ত এই মুহূর্তে তোমাকে বুকে জড়িয়েই খুশি। তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন আমার অসুখ এখনো সারেনি। আমি ত জেনেশুনে তোমার প্রতি অবিচার করতে পারি না।

ছুটি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, সুকুদা, আমার মন হয়ত আপনার, কিন্তু শরীরটা সম্বন্ধে অত নিঃসন্দেহ হবেন না। আমার শরীর আমারই, আমার একার, এ শরীর অন্য কারো নয়। আমি জানি, আমার মন, আপনার ডাকে চিরদিন সাড়া দেবে। ভয় হবে, যদি শরীর না দেয়। আমার ভারী ভয় হয় যদি কখনো এমন হয় যে, আপনি কিছু চাইলেন আমার কাছে কিন্তু আমি তা দিতে পারলাম না।

তারপর একটু থেমে বলল, জানি না, আবার কবে কতদিন পরে আপনাকে এমন ভাবে, এমন নির্জনতায়, এরকম আপনার নিজের কাছে পাব। পরে আমাকে কিন্তু দোষ দেবেন না। বলতে পারবেন না, আপনার ছুটির কিছুমাত্র অদেয় ছিল আপনাকে।

আমি ওর গালের সঙ্গে গাল ছুঁইয়ে বললাম, কখনো বলব না ছুটি; এ কথা কখনো বলব না। তুমি দেখো, কোনোদিনও বলব না।

Category: একটু উষ্ণতার জন্য
পরবর্তী:
০৬-৮. শেষ রাতে আমি »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑