০৫. মতি মিস্ত্রি লেনে

॥ ৫ ॥

মতি মিস্ত্রি লেনে তিনজনের বেশি লোক পাশাপাশি হাঁটতে পারে না। আমরা গাড়ি বড় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গলির দিকে এগোলাম। মোড়ে একটা পান বিড়ির দোকান। মালিককে জিগ্যেস করতে বলে দিল শশধর চাটুজ্যে তিন নম্বর বাড়িতে থাকেন।

তিন নম্বরের দরজায় টোকা মারতে একজন ভদ্রলোক দরজাটা খুললেন।

‘কাকে চাই?’

‘আমরা শশধর চাটুজ্যের খোঁজ করছিলাম।’

‘আমিই সেই লোক। আপনাদের প্রয়োজন?’

লালমোহনবাবু একটা কার্ড বার করে দিতে ভদ্রলোকের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। ‘আপনিই কি সেই বিখ্যাত রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীর লেখক?’

লালমোহনবাবু একটু বিনয় করলেন।

‘বিখ্যাত কিনা জানি না, তবে আমিই সেই লোক।’

‘আরে বাবা! আপনার সব বই যে আমার পড়া। তা হঠাৎ এ গরিবের বাড়িতে কী মনে করে?’

‘আমি এসেছি আমার বন্ধু গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্রের তরফ থেকে।’

‘তাঁর নামও ত শুনিচি! আপনারা ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন।’

এতক্ষণে ঘরের ভিতর ঢুকলাম আমরা। একটা তক্তপোষেই প্রায় ঘরটা ভরে আছে, তবে তার সঙ্গে দুটো কাঠের চেয়ার রয়েছে।

লালমোহনবাবু চেয়ারে বসে বললেন, ‘আপনার বন্ধুর খুনের ব্যাপারে আমরা তদন্ত করছি। সে সম্বন্ধে আপনি যদি কিছু বলেন।’

‘আমি আর কী বলব। সে আমার বাড়িতে ঢোকার আগেই খুন হয়। পাড়ার একটি ছেলে আমাকে খবর দেয়। বাইশ বছর হল আমাদের বন্ধুত্ব, যদিও রাইভ্যাল থিয়েটারে আমরা অভিনয় করতাম।’

‘ওঁর কোনো শত্রু ছিল বলে জানেন?’

‘নেপালের শত্রু থাকবে না? সে এত বড় একটা হিরো—অন্য সব অভিনেতার সে ঈর্ষার পাত্র। তার ত শত্রু থাকবেই।’

‘বিশেষ কারুর নাম মনে পড়ছে না?’

‘না। তা পড়ছে না। সেরকম কোনো নাম নেপাল করেনি আমার কাছে। সে কাউকে বিশেষ তোয়াক্কা করত না। একটু বেপরোয়া গোছের লোক ছিল। তার পেশায় তার সমকক্ষ খুব কমই ছিল। অন্য বহু থিয়েটার তাকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়েছে। কিন্তু অপ্সরায় তার অভিনয় জীবনের শুরু বলে সে আর কোথাও যায়নি।’

‘তিনি যে হুম্‌কি চিঠি পাচ্ছিলেন সে কথা আপনাকে বলেছিলেন?’

‘বলেছিল বৈ কি, কিন্তু সে পাত্তাই দেয়নি। এক নাম করা জ্যোতিষী তাকে বলেছিল সে বিরাশি বছর বাঁচবে। সেটা সে বিশ্বাস করত। বলত ওই বয়স অবধি সে অভিনয় চালিয়ে যাবে, আর মঞ্চের উপর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে।’

শশধরবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

‘এর বেশি আমার আর কিছু বলার নেই, জানেন। আর আমার মন মেজাজও ভালো নেই। আপনারা বরং আসুন।’

আমরা উঠে পড়লাম।

এক সকালের পক্ষে অনেক কাজ হয়েছে মনে করে আমরা বাড়ির দিকেই রওনা দিলাম। ফেলুদাকে সব রিপোর্ট করতে হবে।

ফেলুদা সব শুনেটুনে লালমোহনবাবুর খুব তারিফ করল। বলল, ‘আপনি ত একেবারে পেশাদারী গোয়েন্দার মতো কাজ করেছেন। যেটা বাকি রইল সেটা হচ্ছে অপ্সরা থিয়েটারের অন্য প্রধান অভিনেতাদের জেরা করা। বিশেষ করে টপ অভিনেতা—যাদের সঙ্গে নেপাল লাহিড়ীর হৃদ্যতাও ছিল, রেষারেষিও ছিল।’

‘তোমার পা কী বলে?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘এখনো নট নড়ন-চড়ন। আরো দুদিন অন্তত লাগবে সারতে। ভালো কথা অভিনেতাদের সঙ্গে যখন কথা বলবেন তখন নতুনটিকেও বাদ দেবেন না।’

‘না না, তা ত নয়ই।’

লালমোহনবাবু ফেলুদার কাজটা করে খুব খোশমেজাজে ছিলেন। বললেন, ‘এ এক নতুন অভিজ্ঞতা হল। আসলে আপনার কাজটা যত কঠিন বলে মনে হয় তত কঠিন নয়।’

‘কঠিন কেবল রহস্যোদ্ঘাটন।’

‘তা বটে, তা বটে। সেটা এখনও পারব না নিশ্চয়ই। আর সেরকম দাবীও করছি না। তবে একটা কথা বলতে পারি—আজ ওখানে আমাকে দেখলে আপনি চিনতেই পারতেন না।’

‘বটে?’

‘সেন্ট পারসেন্ট।’

‘ওখানে কি মহড়া চলছে?’

আমি বললাম, ‘চলছে বোধ হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই ত আলমগীর শুরু হবে।’

‘তাহলে ম্যানেজারকে টেলিফোন করে কোন সময় গেলে সকলের সঙ্গে দেখা হবে আর কথা বলা যাবে সেটা জেনে নিবি।’

‘ভেরি গুড।’

‘পুলিশ দেখলি?’

‘কই, না ত।’

‘আছে নিশ্চয়ই! কাগজে ত লিখেছে তারা তদন্ত চালাচ্ছে। একবার ইন্‌সপেক্টর ভৌমিককে ফোন করব। তার আণ্ডারেই কেসটা পড়বে বলে মনে হচ্ছে।’