০১. ম্যাজিক সম্বন্ধেও ফেলুদার যথেষ্ট জ্ঞান আছে

॥ ১ ॥

অন্য অনেক জিনিসের মতো ম্যাজিক সম্বন্ধেও ফেলুদার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। এখনও ফাঁক পেলে তাসের প্যাকেট হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতসাফাই অভ্যাস করতে দেখেছি। সেইজন্যেই কলকাতায় সূর্যকুমারের ম্যাজিক হচ্ছে দেখে, আমরা তিনজনে ঠিক করলাম একদিন গিয়ে দেখে আসব। তৃতীয় ব্যক্তিটি অবশ্য আমাদের বন্ধু রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু। যারা ম্যাজিকের আয়োজন করেছে তারা ফেলুদার খুব চেনা, তাই চাইতেই তিনখানা প্রথম সারির টিকিট পাওয়া গেল।

গিয়ে দেখি হল প্রায় ছ’আনা ফাঁকা। ম্যাজিক যা দেখলাম নেহাত খারাপ নয়, কিন্তু ম্যাজিশিয়ানের ব্যক্তিত্বে কোথায় যেন ঘাটতি আছে। ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ির সঙ্গে একটা চুমকি বসানো সিল্কের পাগড়ি, কিন্তু গলার আওয়াজটা পাতলা। গোলমালটা সেখানেই। অথচ ম্যাজিশিয়ানকে অনর্গল কথা বলে যেতে হয়।

সামনের সারিতে বসার ফলে হল কী, হিপনোটিজম দেখাতে ভদ্রলোক লালমোহনবাবুকে স্টেজে ডেকে নিলেন। এ-জিনিসটা ভদ্রলোক ভালই জানেন। লালমোহনবাবুর হাতে পেনসিল দিয়ে, সেটাকে কামড়াতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চকোলেট কেমন লাগছে?’ লালমোহনবাবু সম্মোহিত অবস্থায় বললেন, ‘খাসা চমৎকার চকোলেট।’

পাঁচ মিনিট স্টেজে ছিলেন, তার মধ্যে জটায়ু একেবারে নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলেন, আর লোকেও উপভোগ করল খুব। লালমোহনবাবু জ্ঞান ফিরে পাবার পরে হাততালি আর থামে না।

পরদিন ছিল রবিবার। লালমোহনবাবু তাঁর সবুজ অ্যামবাসাডারে ঠিক ন’টার সময় চলে এসেছিলেন তাঁর গড়পারের বাড়ি থেকে আড্ডা মারতে। তখনও ম্যাজিকের কথা হচ্ছে।

ফেলুদা বলল, ‘ঠিক জমাতে পারছে না লোকটা। কালকেও সিট খালি ছিল দেখেছিলি?’

লালমোহনবাবু বললেন, ‘কিন্তু যাই বলুন মশাই, আমাকে যেভাবে বোকা বানানো, তাতে বলতেই হবে কৃতিত্ব আছে। পেনসিল চিবিয়ে চকোলেট, পাথর কামড়ে কড়াপাকের সন্দেশের স্বাদ—–—এ ভাবা যায় না।’

শ্রীনাথ সবে চা এনেছে, এমন সময় বাইরে গাড়ি থামার শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় টোকা পড়ল। অথচ কারুর আসার কথা নেই। খুলে দেখি, বছর ত্রিশেকের ভদ্রলোক। ‘এটাই প্রদোষ মিত্তিরের বাড়ি?’

ফেলুদা বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি ভেতরে আসুন।’

ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। ফরসা, রোগা, চোখে চশমা। বেশ সপ্রতিভ চেহারা। সোফার একপাশে বসে বললেন, ‘টেলিফোনে অনেক চেষ্টা করেও আপনার লাইনটা পেলাম না। তাই এমনিই চলে এলাম।’

‘ঠিক আছে।’ বলল ফেলুদা, ‘আপনার প্রয়োজনটা যদি বলেন।’

‘আমার নাম নিখিল বর্মন। আমার বাবার নাম হয়তো আপনি শুনে থাকবেন— বৰ্মন।’ -সোমেশ্বর

‘যিনি ভারতীয় জাদু দেখাতেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আজকাল তো আর নাম শুনি না। রিটায়ার করেছেন বোধহয়?’ ‘হ্যাঁ, বছর সাতেক হল আর ম্যাজিক দেখান না।’

‘উনি তো স্টেজে ম্যাজিক দেখাতেন না বোধহয়?’

‘না। এমনি ফরাসে দেখাতেন। ওঁর চারদিকে লোক ঘিরে বসত। সাধারণত নেটিভ স্টেটগুলোতে ওঁর খুব নাম ছিল। বহু রাজাদের ম্যাজিক দেখিয়েছেন। তা ছাড়া বাবা নানান দেশ ঘুরে ভারতীয় ম্যাজিক সম্বন্ধে নানান তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। সেগুলো একটা বড় খাতায় লেখা আছে। বাবা ইংরিজিতে লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ম্যাজিক’। ওটা একজন কিনতে চেয়েছেন বাবার কাছে। কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্ত অফার করেছেন। বাবা চাচ্ছিলেন আপনাকে একবার লেখাটি দেখাতে। কারণ বাবা ঠিক মনস্থির করতে পারছেন না।’

‘কুড়ি হাজার টাকা দিতে চেয়েছে কে জানতে পারি?’

‘জাদুকর সূর্যকুমার নন্দী।’

আশ্চর্য! কালই আমরা সূর্যকুমারের ম্যাজিক দেখে এসেছি! একেই ফেলুদা বলে টেলিপ্যাথি। ফেলুদা বলল, ‘বেশ, আমি লেখাটা নিশ্চয়ই দেখব। তা ছাড়া আপনার বাবার সঙ্গে আমার আলাপ করারও যথেষ্ট ইচ্ছে আছে।’

‘বাবাও আপনার খুব গুণগ্রাহী। বলেন, অমন শার্প বুদ্ধি বাঙালিদের বড়-একটা দেখা যায় না। আমার মনে হয়, এর মধ্যেই একদিন এসে পড়ুন না। বাবা সন্ধ্যায় রোজই বাড়ি থাকেন।’ ‘ঠিক আছে। আমরা আজ সন্ধ্যাতেই তা হলে আসি।’

‘বেশ তো। এই সাড়ে ছটা নাগাত?’ ‘তাই কথা রইল।’