১০. থ্যাঙ্কস ফর দ্য খোঁচা

॥ ১০ ॥

ফেলুদা তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একবার সকলের দিকে দেখে নিল। তারপর এক গেলাস জল ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে নিয়ে খেয়ে তার কথা শুরু করল।

‘মিঃ মল্লিক আজ আমাদের মধ্যে নেই, আমি তাঁকে দিয়েই আমার কথা আরম্ভ করছি। সিদ্ধেশ্বর মল্লিক ত্রিশ বছর জজিয়তি করে তারপর কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই রিটায়ারমেণ্টের কারণ ছিল অসুস্থতা। তাছাড়া হয়ত মিঃ মল্লিক তাঁর পেশায় কিছুটা বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। প্রাণদণ্ড নিয়ে হয়ত তাঁর মনে একটা সংশয় দেখা দিয়েছিল। আমি এই সিদ্ধান্তের সত্যতা অসত্যতার ভিতর যেতে চাইছি না। যা ঘটেছিল শুধু তাই বলছি।

‘মিঃ মল্লিক দৈনিক ডায়রি লিখতেন। এই ডায়রির একটা বিশেষত্ব ছিল। যেদিন তিনি কাউকে ফাঁসির আদেশ দিতেন, সেইদিন ডায়রিতে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিটির নাম লিখে তার পাশে লাল কালিতে একটা ক্রস দিয়ে দিতেন। আর যেদিন এই দণ্ডের যথার্থতা সম্বন্ধে তাঁর মনে একটা গভীর সন্দেহ দেখা দিত, সেদিন ক্রসের পাশে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে দিতেন।

‘আমি মিঃ মল্লিকের ডায়রিগুলি দেখেছি। সবসুদ্ধ ছ’টি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। তার মানে ছ’টি প্রাণদণ্ডের সমীচীনতা সম্পর্কে তিনি সন্দিগ্ধ ছিলেন।

‘এইবার আমি আরেক দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মিঃ মল্লিকের মনে দ্বন্দ্ব হচ্ছিল কি না হচ্ছিল সেটা সম্বন্ধে জনসাধারণ কিছুটা জানতে পারত না। কিন্তু যারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছে, তাদের আত্মীয়স্বজনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কি মিঃ মল্লিক কখনো ভেবেছিলেন? মনে ত হয় না, কারণ তাঁর ডায়রিতে এর কোনো উল্লেখ নেই। ছেলের মৃত্যুদণ্ডে বাপ-মা কী ভাবছে, বাপের মৃত্যুদণ্ডে ছেলের বা ভাইয়ের বা স্ত্রীর বা অন্য আত্মীয়স্বজনের কী মনোভাব হতে পারে, সেটা নিয়ে মিঃ মল্লিক বোধহয় কখনো চিন্তা করেননি। কিন্তু আমরা একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারব যে এইসব প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের অনেকেই নিশ্চয় গভীর বেদনা অনুভব করেছে।

‘এইটে উপলব্ধি করার পরেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে—এইরকম প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তির আত্মীয়ই কি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মিঃ মল্লিককে হত্যা করে?

‘যত ভাবি, ততই মনে হয় এটা খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে যেখানে দণ্ড সম্বন্ধে জজের মনেও সন্দেহ আছে সেখানে ত বটেই।

‘এর পরের প্রশ্ন হচ্ছে—এই ঘরে যারা উপস্থিত আছেন, তাদের মধ্যে কি এমন ব্যক্তি কেউ আছেন?’

‘এখানে প্রথমেই যাকে বাদ দেওয়া যায়, তিনি হলেন ডাঃ মজুমদার, কারণ তিনি আজ পনের বছর হল মল্লিকদের পারিবারিক চিকিৎসক।

‘বাকি থাকেন আর চারজন—বিজয় মল্লিক, সুশান্ত সোম, মিঃ সরকার আর বেয়ারা প্রয়াগ।

‘এখানে বিজয় মল্লিককে এই বিশেষ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ তাঁর কোনো আত্মীয়ের প্রাণদণ্ড হয়নি।

‘সেইরকম সুশান্ত সোমকেও এই একই মর্মে বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ তাঁরও কোনো নিকট জনের প্রাণদণ্ডের কথা আমরা ডায়রিতে পাচ্ছি না।

‘বাকি রইলেন মিঃ সরকার ও প্রয়াগ বেয়ারা।’

‘এখানে প্রয়াগকে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

প্রয়াগ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ফেলুদা বলল, ‘প্রয়াগ, সেদিন তুমি যখ নদীতে হাত ধুচ্ছিলে তখন আমি তোমাকে লক্ষ করছিলাম। তোমার ডান হাতে একটি ছোট্ট উল্‌কি আছে—দুটি ইংরিজি অক্ষর—HR। এটার মানে আমি তোমাকে জিগ্যেস করতে চাই।’

প্রয়াগ গলা খাকরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওর কোনো মানে নেই বাবু। উল্‌কি করাবার ইচ্ছা হয়েছিল তাই করিয়েছিলাম।’

‘তুমি বলতে চাও এটা তোমার নাম আর পদবীর প্রথম অক্ষর নয়?’

‘নেহি বাবু। মেরা নাম হ্যায় প্রয়াগ মিসির।’

‘আমি যদি বলি তোমার নাম প্রয়াগ নয়। কারণ প্রয়াগ বলে ডাকলে তুমি চট করে উত্তর দাও না—অথচ অন্য ব্যাপারে মোটেই তুমি কালা নও।’

‘আমার নাম প্রয়াগ মিসির, বাবু।’

‘না!’ ফেলুদা চেঁচিয়ে উঠল। ‘আমি জানতে চাই ওই R অক্ষরটা কিসের আদ্যক্ষর। কী পদবী তোমার?’

‘আমি আর কী বলব বাবু!’

‘সত্যি কথাটা বলবে। এখানে জীবন-মরণ নিয়ে খেলা হচ্ছে, এখানে মিথ্যা চলবে না।’

‘তবে আপনিই বলুন।’

‘আমি বলছি। ওই R হচ্ছে রাউত। এবার তোমার পুরো নামটা বল।’

প্রয়াগ হঠাৎ কেমন জানি ভেঙে পড়ল। তারপর কান্নার মধ্যেই বলল, ‘ও আমার একমাত্র ছেলে ছিল বাবু। আর ও খুন করেনি। ওর মামলা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে ওকে খুনী বলে মনে হয়। আমার একমাত্র ছেলে—ফাঁসি হল!’

‘তাহলে তোমার পুরো নামটা কী দাঁড়াচ্ছে?’

‘হনুমান রাউত, বাবু। কিন্তু আমি বাবুকে খুন করিনি, ওঁর আংটি আমি নিইনি!’

‘সেটা কি আমি একবারও বলেছি?’

‘তাহলে বাবু আমাকে মাপ করে দিন।’

‘পুরোপুরি মাপ কি করা চলে?’ সত্যি কথা বল ত।’

হনুমান রাউত কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে ফেলুদার দিকে চাইল। ফেলুদা বলল, ‘তুমি খুন করনি, কিন্তু খুনের চেষ্টা তুমি করেছিলে।’

‘না বাবু—’

‘আলবৎ!’ ফেলুদা গর্জিয়ে উঠল।’ তোমার নিজের ছেলের মৃত্যুর জন্য যিনি দায়ী, তুমি তাঁর ছেলেকে মারতে চেয়েছিলে যাতে তিনিও তোমার মতো পুত্রশোক ভোগ করেন। খিলেনমার্গ যাবার পথে তুমি বিজয়বাবুর ঘাড়ে ধাক্কা মারনি? ঠিক করে বল ত। বাঁ হাতে তোমার আংটি রয়েছে, আর বাঁ হাত দিয়ে তুমি ডান হাতের কাজ কর, তাই না?’

‘কিন্তু উনি ত বেঁচে আছেন বাবু: উনি ত মরেননি।’

‘খুনের অভিপ্রায়েরও শাস্তি আছে হনুমান রাউত—সে শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হবে!’

দুজন কনস্টেবল এসে বেয়ারাকে ঘর থেকে নিয়ে গেল।

ফেলুদা আরেক গেলাস জল খেয়ে নিল। তারপর আবার শুরু করল।

‘এবারে আমরা অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। এটা আরো অনেক বড় প্রসঙ্গ। এখানে একজন ব্যক্তির প্রাণ নেওয়া হয়েছে। এ হল হত্যা। আর এর জন্য আমার মতে প্রাণদণ্ড উচিত দণ্ড।’

সকলে একদৃষ্টে ফেলুদার দিকে চেয়ে আছে। তাঁবুতে পিন পড়লে তার শব্দ শোনা যেত নিশ্চয়ই যদিনা বাইরে লিদর নদীর স্রোতের অবিশ্রান্ত শব্দ থাকত।

ফেলুদা বলল, ‘আমি একজনকে এর আগেও কয়েকটা প্রশ্ন করেছি—এবার আরেকবার করতে চাই। মিঃ সরকার।’

সরকার নড়ে চড়ে বসে বললেন, ‘করুন।’

ফেলুদা বলল, ‘আপনি কবে শ্রীনগর এলেন?’

‘আপনাদের সঙ্গে একই ফ্লাইটে এলাম।’

‘আচ্ছা, আপনার আঙুলের আংটির ‘S’টা কিসের আদ্যক্ষর?’

‘আমার পদবীর অফকোর্স—সরকার।’

‘কিন্তু, মিঃ সরকার, আমি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে সেদিন যাত্রীর তালিকায় সরকার বলে কেউ ছিলেন না। সেন ছিলেন, দুজন সেনগুপ্ত ছিলেন, একজন সিং ছিলেন আর একজন সপ্রু ছিলেন।’

‘বাট—বাট—’

‘বাট হোয়াট, মিঃ সরকার? আপনার নাম বদলানোর দরকার হল কেন জানতে পারি কি?’

মিঃ সরকার চুপ।

ফেলুদা বলল, ‘আমি বলি? আমার ধারণা আপনি মনোহর সপ্রুর ছেলে। আপনার চেহারার মধ্যে একটা পরিষ্কার কাশ্মীরী ছাপ রয়েছে। মিঃ মল্লিক মনোহর সপ্রুকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। মিঃ মল্লিককে প্লেনে দেখেই আপনি নাম বদল করার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তখন থেকেই আপনার মনে প্রতিশোধের ইচ্ছা জাগে। আপনি ওই ফ্যামিলির সঙ্গে মিশে যান, এবং সুযোগ খুঁজতে থাকেন টু স্ট্রাইক। সেই সুযোগ আসে পাহালগমে।’

‘কিন্তু…কিন্তু…দিস ক্রাইম ইজ কমিটেড বাই এ লেফ্‌ট-হ্যান্ডেড পার্সন।’

‘আপনি ভুলবেন না, মিঃ সপ্রু—আমি আপনাকে তাস বাঁটতে দেখেছি। আর কেউ লক্ষ না করলেও আমি করেছি যে আপনি বাঁ হাতে তাস ডীল করেন।’

মিঃ সপ্রু হঠাৎ কেমন যেন খেপে উঠলেন।

‘বেশ, ঠিক কথা—আমি ওঁকে ছুরি মেরেছি, কিন্তু তার জন্য আমার একটুও অনুশোচনা নেই। আমার যখন মাত্র পনের বছর বয়স তখন উনি আমার বাবাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলান—অ্যাণ্ড মাই ফাদার ওয়াজ নট গিল্টি! কিন্তু…কিন্তু…’

সপ্রুর যেন হঠাৎ একটা নতুন কথা মনে পড়ল।

‘আমি ওঁর আংটি ত নিইনি! আই ওনলি কিলড্‌ হিম।’

‘না’, বলল ফেলুদা। ‘আপনি ওঁর আংটি নেননি। সেটা নিয়েছেন আরেকজন।’

ঘরে আবার সেই অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

ফেলুদার দৃষ্টি ঘুরে গেল।

‘বিজয়বাবু—জুয়াতে আপনার অনেক লোকসান হয়েছে। তাই না? আমি কলকাতায় খবর নিয়েছি। আমার লোক আছে খবর দেবার, পুলিশেও আমার বন্ধু আছে। আপনার বিস্তর দেনা হয়ে গেছে।’

বিজয়বাবু চুপ।

ফেলুদা বলে চলল, ‘আর আপনার বোধহয় সন্দেহ হয়েছিল যে বাবা আপনাকে উইলে কিছু দিয়েছেন কিনা। সেই জন্য তাঁকে মেরে তাঁর আংটিটি আপনি হাত করেছিলেন।’

‘মেরে মানে?’

‘মেরে মানে কোনো ভারী জিনিস দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত মেরে। আপনার বাবাকে আসলে দুজন খুন করে। কার দ্বারা তিনি হত হয়েছিলেন সেটা বোঝা যায় বিছানায় রক্ত দেখে। ছুরির আঘাতই আগে পড়ে, তারপর আপনি মাথায় বাড়ি মেরে হাত থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে যান। আপনি খুনী না চোর সেটা অবশ্য আইন বুঝবে, কিন্তু হাতকড়া বোধহয় তিনজনের হাতেই পড়বে।’

মল্লিকদের তাঁবু থেকে নিজেদের তাঁবুতে ফিরে এসে লালমোহনবাবু বললেন, ‘কিন্তু মশাই, আপনি একটা ব্যাপারে ত কোনো আলোকপাত করলেন না। আপনাকে দুবার মারার চেষ্টা করল কে?’

‘সে ব্যাপারে আলোকপাত করিনি কারণ আমি নিজেই ব্যাপারটা সম্বন্ধে শিওর নই। তিনজন অপরাধীর একজন করেছে তাতে সন্দেহ নেই, এবং সুযোগের দিক দিয়ে বিচার করলে প্রয়াগের কথাই মনে হয়। সপ্রু বা বিজয়বাবু দল থেকে বেরিয়ে এসে এটা করবেন বিশ্বাস করা কঠিন। যাই হোক, এর জন্য মূল রহস্যোদ্ঘাটনে কোনো এদিক ওদিক হচ্ছে না। ধরে নিন এটা ফেলু মিত্তিরের একটা অক্ষমতার পরিচয়।’

‘যাক্, বাঁচা গেল। আপনারও ভুল হতে পারে এটা জানতে পারলে একটু ভরসা পাওয়া যায়।’

‘আপনি অযথা বিনয় করছেন। আমি কিন্তু বহু চেষ্টা করলেও আপনার মতো লিখতে পারতাম না।’

‘থ্যাঙ্কস ফর দ্য খোঁচা!’

***