০৮. ঘণ্টা তিনেক ধরে জেরা চালাল

॥ ৮ ॥

পুলিশ ঘণ্টা তিনেক ধরে জেরা চালাল। জেরা শুরু করার আগে মিঃ সিং ফেলুদাকে দু একটা প্রশ্ন করে নিলেন। ‘আপনি কাল রাত্রে কোনো সন্দেহজনক শব্দ পাননি?’

‘না। তাছাড়া এখানে নদীর শব্দে অন্য সব শব্দ চাপা পড়ে যায়।’

‘জানি। সেটা ক্রিমিন্যালের পক্ষে একটা অ্যাডভানটেজ। ভাল কথা, আপনার বন্ধুর সঙ্গে ত আলাপ হয়নি।’

‘ইনি মিঃ গাঙ্গুলী! হি ইজ এ রাইটার।’

এর পর আমরা তিনজন শহরের দিকে গিয়ে একটা রেস্টোরান্টে বসে চা আর অমলেট খেলাম। সকালে গোলমালে আর ব্রেকফাস্ট হয়নি।

খেতে খেতে লালমোহনবাবু বললেন, ‘সবচেয়ে আশ্চর্য দেখছি যে প্রথমে ছেলেকে খুন করতে চেষ্টা করে না পেরে শেষটায় বাবাকে খুন করল।’

ফেলুদা বলল, ‘সেটা যে একই লোক করেছে তার কী গ্যারান্টি? একজনের ছেলের উপর আক্রোশ থাকতে পারে, আরেকজনের বাপের উপর। নট ভেরি সারপ্রাইজিং।’

‘আমার কিন্তু একটি লোক সম্বন্ধে কি রকম সন্দেহ হয়।’

‘কে?’

‘ডাঃ মজুমদার। এদিকে ডাক্তার, তার উপরে আবার আত্মা নামাচ্ছে। কম্বিনেশনটা অদ্ভুত লাগছে।’

‘খুন করার সুযোগ অবশ্য ডাক্তারেরই বেশি ছিল, কারণ পাশের খাটে ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু মোটিভ কী? হীরের আংটি যদি নেওয়া উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বলতে হয় ডাক্তারের খুবই আর্থিক দুরবস্থা। কিন্তু সেরকম ত কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘আর বিজয়বাবু?’

‘বিজয়বাবু অবশ্য তাঁর বাপের মৃত্যুতে খুবই লাভবান হবেন। অবিশ্যি মিঃ মল্লিক যদি উইল করে থাকেন, এবং সে উইল থেকে যদি ছেলেকে বাদ দিয়ে থাকেন, তাহলে বিজয়বাবুর কোনই লাভ নেই। তা না হলে বিজয়বাবু মোটা টাকা পাবেন, কারণ মিঃ মল্লিক নিঃসন্দেহে ধনী ব্যক্তি ছিলেন।’

‘কিন্তু বিজয়বাবু ত তাঁর অপিস থেকে রোজগার করছেনই। তাঁর হঠাৎ এতটা টাকার দরকার পড়বে কেন যে সে খুন করবে? খুন করা ত চাট্টিখানি কথা নয়।’

‘দ্যাট ইজ ট্রু।’

‘সুশান্ত সোম সম্বন্ধে কী মনে হয় আপনার?’

‘কাজের ছেলে সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই। আর বেশ কোয়ালিফাইড। মিঃ মল্লিক সুশান্তবাবুর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতেন। আর সুশান্তবাবুর কোনো খুনের মোটিভ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।’

‘আচ্ছা, মিঃ মল্লিকের উপর কি কেউ প্রতিশোধ নিয়ে থাকতে পারে?’

‘তা ত পারেই। আমি ত সেই কথাটাই বার বার ভাবছি। কতজনের প্রাণ নিয়েছেন লোকটা ভেবে দেখুন।’

‘কিন্তু বিজয়বাবুর বেলা ত প্রতিশোধ খাটে না।’

‘তা ত খাটেই না, আর সেই ব্যাপারেই বার বার ধাক্কা খেতে হচ্ছে।’

দুপুর বেলা লাঞ্চের পর ফেলুদা বলল একটু শহরের দিকে ঘুরে আসবে। একটু না হাঁটলে নাকি ওর মাথা খোলে না।

‘শহর হোক আর যাই হোক, সঙ্গে আপনার অস্ত্রটি রাখবেন’ বললেন লালমোহনবাবু।

আমরা দুজন নদীর ধারে গিয়ে বসলাম।

সুশান্তবাবু তাঁবু থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ‘বিনা মেঘে বজ্রাঘাত’, বললেন ভদ্রলোক।

আমরাও সায় দিলাম। সত্যি, এমন যে হবে তা ভাবতেও পারিনি।

‘ইনস্পেক্টর কী বলেন?’ জিগ্যেস করলেন লালমোহনবাবু।

সুশান্তবাবু বললেন, যদ্দূর মনে হল ডাকাতের সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। আংটিটার বিস্তর দাম ছিল, মাঝখানে হীরে বসানো, তাকে গোল করে পান্না দিয়ে ঘেরা। আর এখানে যে ডাকাতির কেস একেবারে হয় না তা নয়। যত টুরিস্ট বাড়ছে, তত এসবও নাকি বাড়ছে। বছর ত্রিশেক আগে পাহালগম অনেক নিরাপদ জায়গা ছিল।’

‘আপনারা কি তাঁবুতে বন্দী?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘না’, বললেন সুশান্তবাবু, ‘তবে পাহালগম ছেড়ে কোথাও যাওয়া চলবে না।’

‘মৃতদেহের সৎকার হবে কখন?’

‘বিকেলের মধ্যেই।’

*

বিকেলে জানতে পারলাম যে মল্লিকরা ব্রাহ্ম ছিলেন। তাই বিজয়বাবুকে আর অশৌচ পালন করতে হবে না।

ফেলুদা পাঁচটার মধ্যে ফিরে এল। ও যতক্ষণ না ফিরছিল ততক্ষণ আমার অসোয়াস্তি লাগছিল, কিন্তু ও বলল যারা ওর পিছনে লাগতে পারত তারা সকলেই এখন পুলিশের নজরে রয়েছে। তাই চিন্তা নেই।

‘কিন্তু এই যে ঘুরে এলেন, এর কোনো ফল পেলেন?’

‘পেয়েছি বৈকি’, বলল ফেলুদা, ‘তবে এখানে বসে থেকে সব ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হবে না। আমাকে একবার শ্রীনগর যেতে হবে।’

‘কবে যাবেন?’

‘কালই সকালে।’

‘আর আমরা?’

‘আমার দুদিন আন্দাজ লাগবে। সে দুদিন আপনারা এখানেই থাকবেন। চেঞ্জের পক্ষে এর চেয়ে ভাল জায়গা ত আর হয় না।’

‘কিছু আলো দেখতে পেলেন?’

‘তা পেয়েছি। সত্যিই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।’

‘কিন্তু এখনও কিছুটা অন্ধকার রয়েছে?’

‘সেই জন্যেই ত শ্রীনগর যাওয়া দরকার। তবে যাবার আগে আমার দিক থেকেও কয়েকজনকে একটু জেরা করা দরকার। নীচু স্তর থেকে ওপরে ওঠাই ভাল। আগে প্রয়াগকে কয়েকটা প্রশ্ন আছে।’

সুশান্তবাবুকে দিয়ে খবর পাঠাতেই প্রয়াগ তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল।

‘বোস এখানে,’ বলল ফেলুদা।

প্রয়াগ এখন আমাদের তাঁবুতে।

‘শোন প্রয়াগ’, বলল ফেলুদা, ‘তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি তার ঠিক ঠিক জবাব দেবে।’

‘পুছিয়ে বাবু।’

কথাবার্তা হিন্দিতেই চলল, আমি বাংলায় লিখছি।

‘তুমি মল্লিক সাহেবের বাড়িতে কবে থেকে আছ?’

‘পাঁচ বছর হয়েছে।’

‘তার আগে কোথায় ছিলে?’

‘জেকব সাহেবের বাড়িতে বেয়ারার কাজ করতাম। পার্ক স্ট্রীটে।’

‘মল্লিক সাহেব তোমাকে কি করে পেলেন?’

‘আমি জেকব সাহেবের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে মল্লিক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। জেকব সাহেব বিলেত চলে যাচ্ছিলেন, তাই আর আমাকে দরকার লাগছিল না।’

‘মল্লিক সাহেব জেকব সাহেবকে চিনতেন?’

‘ওরা দুজনে এক ক্লাবের মেম্বার ছিলেন।’

‘তোমার পুরো নাম কী?’

‘প্রয়াগ মিসির।’

‘তোমার সংসার নেই?’

‘বৌ মারা গেছে, মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘কাল রাত্রে তুমি কোনও রকম শব্দ পাওনি, যার জন্য তোমার ঘুম ভেঙে যেতে পারে?’

‘না বাবু।’

‘বাবুকে কে খুন করতে পারে তাই নিয়ে তোমার কোন ধারণা আছে?’

‘না বাবু।’ এরকম হবে আমি কল্পনাই করতে পারিনি।’

‘ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পার।’

এবার ফেলুদা সুশান্তবাবুকে বলল, ডাঃ মজুমদারকে খবর দিতে।

ডাঃ মজুমদার এলেন আমাদের তাঁবুতে।

ফেলুদা বলল, ‘আমি আপনাকে দু একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

‘করুন।’

‘মিঃ মল্লিক যে ভাবে প্ল্যানচেট করেছিলেন সেটা কি ডাক্তার হিসাবে আপনার কাছে খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়?’

ডাঃ মজুমদার মাথা নাড়লেন।

‘না। আমি ওঁকে অনেকবার বলেছি যে এইসব পুরোন ব্যাপার নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল। আর জজ যদি এক আধটা ভুল ভার্ডিক্ট দিয়ে থাকে তাতেই বা কী এসে গেল। ভুল ত সকলেরই হতে পারে।’

‘আপনার নিজের মধ্যে যে ক্ষমতাটা রয়েছে সেটা কবে থেকে প্রকাশ পেল?’

‘তা অনেকদিন। পঁচিশ বছর ত বটেই।’

‘ওঁকে কে খুন করতে পারে সে সম্বন্ধে আপনার কোন ধারণা আছে?’

‘একেবারেই নেই।’

‘ওঁর ছেলে সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?’

‘ছেলে এক কালে ড্রাগসের প্রভাবে খুব গোলমালের মধ্যে পড়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারিনি। কিন্তু সেই সাধুর প্রভাবেই হোক, আর অন্য কোন কারণেই হোক, ও একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।’

‘জুয়ার প্রতি ওর আসক্তি রয়েছে না?’

‘সেটা সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে পারব না, কারণ আমি ও রসে একেবারেই বঞ্চিত।’

‘ও কোন অপিসে কাজ করে?’

‘চ্যাটার্জি এন্ড কোং-ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট।’

‘কোথায় অপিস?’

‘গণেশ এভিনিউ। দশ নম্বর।’

‘ঠিক আছে। আপনি যেতে পারেন।’

ডাঃ মজুমদার চলে গেলেন। সুশান্তবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন ফেলুদার দিকে।

‘এবার মিঃ সরকারের সঙ্গে একটু কথা বলব।’

‘মিঃ সরকার?’

সুশান্তবাবু যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

ফেলুদা বলল, ‘হ্যাঁ। কেন, আপনার অবাক লাগছে?’

‘উনি ত ঠিক আমাদের দলে নন; একরকম বাইরের লোক।’

‘তাঁর যে টাকার দরকার নেই সেটা আপনি কি করে জানলেন সুশান্তবাবু? টাকার জন্য মানুষে খুন করে না?’

‘ঠিক আছে। আমি ডাকছি ওঁকে।’

মিঃ সরকার এলেন।

‘আসুন, বসুন’, বলল ফেলুদা।

‘কাশ্মীর এসেছিলাম বেড়াতে, আর কিসের থেকে কী হয়ে গেল দেখুন।’

‘কী করবেন বলুন—মানুষের কপালই ওই রকম।’

‘এখন বলুন আমাকে কী জিগ্যেস করতে চান।’

‘আপনি কত বছর পর্যন্ত শ্রীনগরে ছিলেন?’

‘বছর বারো।’

‘তারপর কলকাতায় যান?’

‘হ্যাঁ।’

‘সেইখানেই পড়াশুনা করেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনার বাবা কি কলকাতাতেও হোটেল ম্যানেজারি করতেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোন হোটেল?’

‘ক্যালকাটা হোটেল।’

‘আপনি গ্র্যাজুয়েট?’

‘বি কম।’

‘এখন কী করেন।’

‘একটা ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে আছি।’

‘কোম্পানির নাম?’

‘ইউনিভারসাল ইনসিওরেন্স।’

‘আপিস কোথায়?’

‘পাঁচ নম্বর পোলক স্ট্রীট।’

‘আপনি জজ মিঃ মল্লিকের কথা জানতেন?’

‘না। এখানে এসে আলাপ। বিজয়ের সঙ্গে অনেক ব্যাপারে মিলে গেল, তাই একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।’

‘আপনি কি জুয়ার ভক্ত?’

‘আই লাইক গ্যাম্বলিং, তবে বিজয়ের মতো না।’

‘হঠাৎ কাশ্মীর আসার ইচ্ছে হল কেন?’

‘ছেলেবেলার স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে।’

‘কদিনের জন্য এসেছেন?’

‘দশদিন—তবে এখন কী হয় জানি না। এরকমভাবে আটকে পড়ব কে জানত।’

‘আপনার হাতের আংটিটা একবার দেখতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই।’

সরকার তাঁর আংটিটা খুলে ফেলুদার হাতে দিলেন, সোনার আংটি, উপরে একটা ছ’ কোনা পাতের উপর মিনে করে নীলের উপর সাদা দিয়ে S লেখা।

ফেলুদা ধন্যবাদ দিয়ে আংটিটা ফেরত দিয়ে দিল।

‘ঠিক আছে। আপনার জেরা শেষ।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’