০৭. জেরা শেষ

॥ ৭ ॥

পরদিন সকালে সাড়ে নটায় পুলক ঘোষাল আমাদের হোটেলে এলেন। ‘আপনাদের জেরা শেষ?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল ভদ্রলোককে।

‘তা শেষ,’ বললেন পুলক ঘোষাল। ‘কাল রাত সাড়ে নটায় ছাড়া পেয়েছি। কিন্তু কী ঝঞ্ঝাটে পড়া গেল দেখুন ত! যদ্দিন না তদন্ত শেষ হচ্ছে তদ্দিন ত ও-বাড়িতে শুটিং বন্ধ। অবিশ্যি সমীরণবাবু বলেছেন যে সব মিটে গেলে ওঁদের বাড়িতে আবার কাজ করতে দেবেন, কিন্তু সেটা কবে তা কে বলতে পারে? কত টাকা লস্ হল আমাদের ভাবতে পারেন?’

লালমোহনবাবু চুকচুক করে সহানুভূতি জানালেন।

‘তবে এটা ঠিক,’ বললেন পুলকবাবু, ‘একটা প্রোডাকশনে বাধা পড়লে সচরাচর সে ছবি হিট হয়। আর, একটা কথা আপনি জানবেন লালুদা—আপনার গপ্পের মার নেই।’

পুলকবাবু চলে যাবার আধ ঘণ্টার মধ্যেই ইন্‌স্পেক্টর যতীশ সাহা এলেন। বললেন, ‘নো পাত্তা অফ লোকনাথ বেয়ারা। আমরা শিলিগুড়িতে পর্যন্ত লোক লাগিয়ে দিয়েছি। তবে আমার মনে হয় ইট্‌স এ ম্যাটার অফ টাইম। এখন হয়ত কোনো ভুটিয়া বস্তিতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে; সুনার অর লেটার ধরা পড়তে বাধ্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস লোকটা কলকাতায় যাবার তাল করছে; সেইখানে ও মূর্তিটা পাচার করবে। আশ্চর্য—সিধে মানুষও লোভে পড়লে কিরকম বেঁকে যায়!’

‘আপনার জেরা ত হয়ে গেছে শুনলাম,’ বলল ফেলুদা।

‘তা হয়েছে,’ বললেন সাহা। ‘এতে একটা জিনিস প্রমাণ হল যে ফিল্ম শুটিং-এর ব্যাপারে মানুষের কৌতূহলের সীমা নেই। বাড়ির প্রত্যেকটি লোক বেশ কিছুটা করে সময় কাটিয়েছে শুটিং দেখে। মিঃ মজুমদার তাঁর রুটিং ব্রেক করলেন—ভাবতে পারেন? অথচ ওঁর জীবনটা চলত ঘড়ির কাঁটার মতো!’

ফেলুদা বলল, ‘সুযোগের ব্যাপারটা কী মনে হল? মোটিভটা এখন থাক।’

‘এখানে অবিশ্যি দুটো ব্যাপার দেখতে হবে,’ বললেন সাহা। ‘এক, দুধে বড়ি মেশানো, আর দুই, ছোরা মেরে মূর্তি চুরি। দেড়টা নাগাত লোকনাথ দুধ রেডি করে মজুমদারকে খবর দিতে গেস্‌ল। সে নিজেই ত্রিশটা বড়ি মেশাতে পারে। অথবা, সে যখন ছিল না তখন অন্য লোক কাজটা করতে পারে। রজতবাবু বললেন তখন উনি নিজের ঘরে শুয়ে বই পড়ছিলেন। সমীরণবাবুও বললেন তিনি নিজের ঘরে ছিলেন। এসবের অবিশ্যি কোনো প্রমাণ নেই। চাকর বাহাদুর আর রান্নার লোক জগদীশ শুটিং দেখছিল। দিস ইজ এ ফ্যাক্ট।’

‘আপনাদের ডাক্তার খুনের টাইম সম্বন্ধে কী বলেন?’

‘বলছেন আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে স্ট্যাবিংটা হয়েছে। ছুরিকাঘাতেই যে মৃত্যু হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তা না হলে এতো ব্লীডিং হত না।’

‘লোকনাথ সম্বন্ধে কেউ কিছু বলতে পারল?’

‘কেউ না। আসলে সকলের মনই শুটিং-এর দিকে পড়ে ছিল।’

লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উস্‌খুস করছিলেন; এবার বললেন, ‘আমার জেরাটা এখন সেরে নিলেই ভাল হত না?’

‘নিয়মমতো কালকেই সেরে নেওয়া উচিত ছিল।’ বললেন ইন্সপেক্টর সাহা, ‘কিন্তু আপনি মিঃ মিত্তিরের বন্ধু বলে আর ইনসিস্ট করিনি। যাই হোক, এবার আপনি বলুন গতকালের ঘটনাগুলো।’

‘আমি পৌঁছেছি নটায়,’ বললেন লালমোহনবাবু। ‘তারপর মেক-কাপ করতে লেগেছে এক ঘণ্টা। যে ঘরে শুটিং তার পাশেই দক্ষিণের বারান্দা; আমরা অভিনেতারা আমাদের ডাকের অপেক্ষায় সেখানেই বসেছিলাম। সেখানে একটা ব্যাপার হয়। মিঃ মজুমদার সাড়ে দশটা নাগাত একবার এসে রায়না আর ভার্মাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে যান মিনিট পাঁচেকের জন্য। পরে রায়না আমাকে বলে যে মজুমদার তাঁদের একটা মূল্যবান পৈতৃক সম্পত্তি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন দুজনকে। এখন বুঝতে পারছি সেটা ছিল ওই বালগোপালটা।’

‘তারপর?’ প্রশ্ন করলেন সাহা।

‘তারপর এগারোটার সময় আমার আর ভার্মার ডাক পড়ে। আমরা দুজনে শুটিং-এর ঘরে গিয়ে হাজির হই। দশ মিনিটের মধ্যেই শট্‌ আরম্ভ হয়। লাঞ্চের আগে চারটে শট্‌ হয়। তার মধ্যে দ্বিতীয় শটের পর সাড়ে বারোটা নাগাত আমি একবার বাথরুম যাই।’

‘তখন আর কাউকে দেখেছিলেন কি?’

‘না। বাথরুম থেকে ফেরার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাকে রিহার্সালের জন্য ডাকা হয়। আধ ঘণ্টার মধ্যেই তিন নম্বর শট্‌ হয়। তারপর আমার বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম ছিল। সেই সময়টা আমি দক্ষিণের বারান্দায় বসেছিলাম।’

‘একা?’

‘আমার সঙ্গে রায়না আর ভার্মা ছিল, আর মিঃ মজুমদার এসেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। ওঁকে লোকনাথ খবর দিতে আসে ওঁর দুধ রেডি আছে বলে। তার পাঁচ-সাত মিনিট পরে মজুমদার চলে যান। পৌনে দুটোর সময় আমার ডাক পড়ে চার নম্বর শটের জন্য। এটা ছিল শুধু আমার একার শট। এর পরেই আড়াইটায় লাঞ্চ ব্রেক হয়। তখন আমি একবার বাথরুম যাই হাত ধুতে। আমার সঙ্গে রায়না আর ভার্মাও গিয়েছিল।’

‘কে প্রথমে হাত ধোয়?’

‘আমি। তারপর আমি চলে আসি। খেতে সবশুদ্ধ মিনিট কুড়ি লাগে। তারপর আমি বারান্দাতেই বসেছিলাম। তপেশ ছিল আমার সঙ্গে।’

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

লালমোহনবাবু বলে চললেন, ‘এই সময়টা রায়না আর ভার্মা কোথায় ছিল লক্ষ করিনি। তিনটের সময় আবার কাজ শুরু হয়। আমার পাঁচ নম্বর শট শেষ হয় সাড়ে তিনটেয়। তারপর আলো চেঞ্জ করার জন্য প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিটের একটা বিরতি ছিল।’

‘তখন আপনি কী করছিলেন?’

‘আমি, রায়না আর ভার্মা দক্ষিণের বারান্দায় বসে গল্প করছিলাম। তপেশও ছিল কাছাকাছি বসে।’

আমি আবার সায় দিলাম।

‘ভার্মা ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় ঘুরেছে। ওঁর অভিজ্ঞতা বলছিলেন আমাদের।’

‘এই পুরো সময়টাই কি আপনারা তিনজনে একসঙ্গে ছিলেন?’

লালমোহনবাবু একটু ভুরু কুঁচকে ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘ভার্মা বোধ হয় একবার উঠে গিয়েছিল মিনিট পাঁচেকের জন্য। তখন রায়না বোম্বাই ফিল্ম জগতের গসিপ্‌ শোনাচ্ছিলেন। তারপর—’

‘আর দরকার নেই, এতেই হবে,’ বললেন ইন্সপেক্টর সাহা। ‘তবে লোকনাথকে যে বিকেলের দিকে আর দেখেননি সেটা আপনার মনে আছে?’

‘লোকনাথ…লোকনাথ…উঁহু, লোকনাথকে আর দেখিনি।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার,’ বলে সাহা উঠে পড়লেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমিও ত ছিলে ওখানে?’

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

‘তোমার কিছু বলার আছে?’

‘লালমোহনবাবু যা বলেছেন সবই ঠিক বলেছেন। আমি শুধু একবার আড়াইটের সময় পিছনে ঝাউবনে যাই বাথরুম সারতে। তখন রজতবাবুকে দেখি উনি বাড়ির দিকে ফিরছেন। দেখে মনে হল যেন একটু হাঁপাচ্ছেন।’

সাহা বললেন, ‘ভদ্রলোক জেরাতেও বলেছিলেন যে মাঝে মাঝে দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম করে উনি ঝাউবনে বেড়িয়ে আসেন। গতকালও গেছেন বলে বলছিলেন। ভালো কথা, দুপুরে যে লাঞ্চটা হত তাতে কি শুধু ফিল্মে যারা কাজ করছে তারাই অংশগ্রহণ করত?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ,’ বললেন লালমোহনবাবু। ‘পুলক সমীরণবাবু আর রজতবাবুকেও অফার করেছিল, কিন্তু ওঁরা রাজি হননি।’

‘ভালো কথা,’ বললেন সাহা। ‘ভূজালির হাতলে কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি।’

ফেলুদা বলল, ‘সেটা বোধহয় আশাও করা যায়নি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন ছিল আপনাকে।’

‘কী প্রশ্ন?’

‘খুনের টাইমটা সাড়ে চারটা হওয়ার চেয়ে আড়াইটা হওয়াই বেশি স্বাভাবিক বলে মনে হয় না কি?’

‘কেন বলুন ত?’

‘ধরুন যদি লোকনাথই অপরাধী হয়, সে স্বভাবতই যত তাড়াতাড়ি পারে তার কাজ সেরে ফেলবে। দেড়টায় সে বড়ি মিশিয়েছে দুধে—আটাশখানা—তারপর তিন ঘণ্টা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবে কেন? যদি মূর্তিটা নেবার সময়ই সে ছোরা মেরে থাকে—যেটা স্বাভাবিক—তাহলে সেটা এত পরে করবে কেন?’

‘গুড পয়েন্ট,’ বললেন সাহা। ‘অবিশ্যি আড়াইটায় খুনটা হলে সেটা ডাক্তারের রিপোর্টের বিরুদ্ধে যায় না।’

ইনস্পেক্টর সাহা উঠে পড়লেন। বললেন তাঁকে একবার নয়নপুর ভিলায় যেতে হবে। ঘর থেকে বেরোবার সময় ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনার চোখ থেকে ভ্রূকুটি যাচ্ছে না কেন বলুন ত?’

ফেলুদা বলল, ‘ওটা কিছু না। আসলে আমি খুব জটিল কেস হ্যাণ্ডেল করে অভ্যস্ত। এটা কেমন যেন বেশি সরল বলে মনে হচ্ছে। এটা আমার কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা, তাই সেটাকে সহজে গ্রহণ করতে পারছি না।’

‘এ আবার আপনার বাড়াবাড়ি মশাই,’ বললেন সাহা। ‘আমরা সহজ কেস হলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি, আর আপনি দেখছি তার ঠিক উল্টো। এইখানে পুলিশ আর শখের গোয়েন্দার তফাত।’

সাহা চলে গেলেন, কিন্তু ফেলুদার কপালে দুশ্চিন্তার রেখা রয়েই গেল। ও শেষে বলল, ‘একটা সামান্য সহজ জিনিস নিয়ে এত ভাবার কোনো মানেই হয় না। লোকনাথকে খুঁজে বার করবে পুলিশ; সেখানে আমার কিছু করারই নেই। চল, একটু বেড়িয়ে আসি ম্যালে।’

আজকের দিনটা কুয়াশাচ্ছন্ন, তার ফলে শীতটাও একটু বেশি, তাই বোধহয় ম্যালে বেশি লোক নেই। আমরা তিনজন এগিয়ে একটা খালি বেঞ্চিতে বসলাম।

ভারী অদ্ভুত লাগছে কুয়াশার মধ্যে ম্যালটাকে। এতই কুয়াশা যে দশ হাত দূরের লোককে দেখা যায় না। কাছে এলে মনে হয় হঠাৎ যেন শূন্য থেকে বেরিয়ে এল। সেই ভাবেই বেরিয়ে এলেন একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, আর তিনি এগিয়ে এলেন আমাদের দিকেই। তারপর ফেলুদার দিকে চেয়ে হাত দুটো জোড় করে বললেন, ‘নমস্কার!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *