০৪. পুলক ঘোষালের দল

॥ ৪ ॥

পুলক ঘোষালের দল তাদের কথা সেরে শুটিং-এর তোড়জোড় করতে চলে গেল। আমাদের কফি খাওয়া শেষ, তাই আমরাও আর বসলাম না। ফেলুদাই প্রথম উঠে পড়ে বলল, ‘আজ তাহলে আসি?’

‘অ্যাঁ?’

ভদ্রলোক যেভাবে প্রশ্নটা করলেন তাতে বুঝতেই পারলাম তিনি কোনো একটা কারণে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। পরমুহূর্তেই অবিশ্যি নিজেকে সামলে নিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘উঠবেন? ঠিক আছে। রয়েছেন যখন ক’দিন তখন দেখা হবে নিশ্চয়ই।’

আমরা তিনজনে নয়নপুর ভিলা থেকে বেরিয়ে উৎরাই দিয়ে হোটেলমুখো রওনা দিলাম।

ফেলুদা পথে কিছুই বলল না। কেন জানি, ও-ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। দুপুরে লাঞ্চ খাবার সময় লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে বলল, ‘কী মশাই, আমাদের অ্যাদ্দিনের আলাপ, আর এমন একটা খবর আপনি বেমালুম চেপে গেস্‌লেন? ভূশণ্ডীর মাঠেতে নদু মল্লিক? বাংলা সাহিত্যে এমন একটি চরিত্র খুঁজে পাওয়া ভার, আর আপনি সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন?’

লালমোহনবাবু একটা ফিশ ফ্রাইয়ের টুকরো মুখে পুরে দিয়ে বললেন, ‘আরে মশাই, সেরকম বলতে গেলে ত অনেক কিছুই বলতে হয়। নর্থ ক্যালকাটায় ক্যারম চ্যাম্পিয়ন ছিলুম ফিফটি নাইনে—এ খবর জানতেন? এনডিওরেন্স সাইক্লিং-এ আমার কত কীর্তি আছে সে সব আপনি জানেন? আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় মেডেল পেয়েছি—একবার নয়, থ্রী টাইমস্। দেবতার গ্রাস পুরো মুখস্থ ছিল। ফিল্মে অফার বিশ বছর আগেও পেয়েছি—তখন আমার মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল—ভাবতে পারেন? কিন্তু সে অফার নিইনি। তখন থেকেই মাইণ্ড মেক আপ করেছি যে লেখক হব। শখের লেখক নয়, পেশাদারী লেখক। স্রেফ লিখে পয়সা করা যায় কি না দেখব। তার পরের ইতিহাস অবিশ্যি খুব সহজ। খগেন জ্যোতিষী বলেছিল—তোমার কলমে জাদু আছে, তুমি লেখ। তবে এতটা যে সাকসেস হবে তা অবিশ্যি ভাবতে পারিনি।’

‘একটা কথা কিন্তু বলে রাখছি,’ বলল ফেলুদা।

‘কী?’

‘এরা আপনাকে দিয়ে চুরুট খাওয়াবে। আপনি দশ বছর হল স্মোকিং ছেড়েছেন। সুতরাং একটা বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আছে।’

‘বলছেন?’

‘বলছি। এক কাজ করবেন। আজই একটা চুরুট কিনে ধোঁয়াটা পেটে নিয়ে খাওয়া অভ্যাস করুন। পেটে গেলেই কিন্তু কাশির দমকের চোটে শট -একেবারে মাটিংচকার হয়ে যাবে।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি অ্যাডভাইস, স্যার।’

দুপুরে একটু বিশ্রাম করে চারটে নাগাত আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আজ অবজারভেটরি হিলটায় একটা চক্কর মারার ইচ্ছে আছে। পাহাড়ের উত্তর দিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়।

লালমোহনবাবু প্রথম যে সিগারেটের দোকানটা পেলেন সেখান থেকেই একটা চুরুট কিনে নিলেন। প্রথম টানে ধোঁয়া পেটে চলে গিয়ে সত্যিই একটা বিপর্যয় হতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভদ্রলোক সেটা কোনোমতে সামলে নিয়ে তারপর থেকে খুব সাবধানে ধোঁয়া টানামাত্র সেটা ছেড়ে দিতে লাগলেন। চুরুট হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের পার্সোনালটির একটা বদল লক্ষ করছিলাম। বেশ একটা মিলিটারি মেজাজ, জুতোর গোড়ালী দিয়ে শব্দ তুলে হাঁটা, ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি নিয়ে এদিক ওদিক চাওয়া। বুঝলাম ভদ্রলোক অঘোরচাঁদ বাটলিওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করতে করতে চলেছেন।

অবজারভেটরি হিলের পূবের রাস্তাটা দিয়ে গিয়ে যেই বাঁয়ে মোড় নিয়েছি, অমনি সামনে দেখি বিকেলের পড়ন্ত রোদে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সোনার রং ধরতে শুরু করেছে। লালমোহনবাবুর আবার কাব্যের মেজাজ এসে পড়ল, তবে ‘অয়ি কাঞ্চনজঙেঘ’ বলে আর বাকি কবিতাটা বললেন না। আমরা পুরো পাহাড়টা চক্কর দিয়ে আবার যখন ম্যালে ফিরে এলাম তখন পাঁচটা বেজে গেছে, সূর্য পাহাড়ের পিছনে চলে গেছে। পূবে জালাপাহাড় রোডের দিকে চেয়ে দেখি ঘোড়ার স্ট্যাণ্ডের সামনে দিয়ে শুটিং-এর দল মালপত্তর কাঁধে নিয়ে ফিরছে, তার পিছনে লোকের ভীড়। তবে এ ভীড় মোটামুটি ভদ্র, বেশি উৎপাত করবে বলে মনে হল না। রায়না আর ভার্মা দুজনকেই কিছু অটোগ্রাফে সই দিতে হল সেটা দেখলাম। তারপর দলটা বাঁয়ে নেহরু রোড ধরে বোধহয় সোজা হোটেলের দিকে চলে গেল।

‘গুড ইভনিং!’

ঘোড়ার পিঠে বিরূপাক্ষ মজুমদার। আমাদের দেখে নেমে এলেন।

‘একটা কথা আজ সকালে আপনাকে বলা হয়নি,’ মিঃ মজুমদার ফেলুদাকে উদ্দেশ করে গলা নামিয়ে কথাটা বললেন। তারপর আরো কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘এ খবরটা আমার মালির কাছ থেকে শোনা। কতদূর রিলায়েব্‌ল তা বলতে পারব না।’

‘কী খবর?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘ক’দিন থেকেই নাকি একটি লোককে আমাদের গেটের বাইরে বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।’

‘বলেন কী?’

‘মালিও তাই বলে। লোকটা পুরোন, তার কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।’

‘লোকটার কোনো বর্ণনা দিয়েছে?’

‘বলছে মাঝারি হাইট, রং মাঝারি, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে। মুখ ভালো করে দেখেনি, কারণ চোখে চোখ পড়তেই লোকটা গাছের আড়ালে চলে যায়। তবে সিগারেট বা বিড়ি খায় এটা মালি বলল, কারণ গাছের পিছন থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেছে।’

‘এইভাবে দৃষ্টি রাখার কোনো কারণ খুঁজে বার করতে পারেন আপনি?’

‘তা পারি। আমার বাড়িতে একটা মূল্যবান জিনিস আছে। অষ্টধাতুর তৈরি একটা বালগোপাল। আমাদের পৈতৃক বাড়ির মন্দিরের মধ্যে ছিল এটা। নয়নপুরে। জিনিসটা খুবই ভ্যালুয়েব্‌ল। আর সেটা এখানে অনেকেই দেখেছে।’

‘সেটা কোথায় থাকে?’

‘আমার শোবার ঘরে তাকের উপর।’

‘খোলা অবস্থায়?’

‘আমি ত রাত্রে জেগে থাকি, আর আমার সঙ্গে রিভলভার থাকে, কাজেই চোর বিশেষ কিছু করতে পারবে না।’

‘আর কোনো কারণে লোক হানা দিতে পারে?’

‘আমি এটুকু বলতে পারি যে আমার অনিষ্ট করতে চাইবে এমন লোক থাকা অসম্ভব নয়। এটা কেন বলছি তার কারণ জিগ্যেস করবেন না। আমি শুধু এইটুকু জানতে চাই যে এর মধ্যে যদি কিছু ঘটে তাহলে আপনার সাহায্য আশা করতে পারি ত?’

‘দ্যাট গোজ উইদাউট সেইং’, বলল ফেলুদা।

‘তাহলেই নিশ্চিন্ত,’ বললেন ভদ্রলোক।

এমন সময় একটি বছর ত্রিশের ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ‘এস সমীরণ, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই,’ বললেন মিঃ মজুমদার। ‘ইনি হচ্ছেন আমার একমাত্র পুত্র সমীরণ, আর ইনি প্রদোষ মিত্র, আর ইনি লালচাঁদ—সরি, লালমোহন….গাঙ্গুলি ত?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আর ইনি প্রদোষবাবুর কাজিন।’

সমীরণ মজুমদার বেশ স্মার্ট দেখতে, তার উপর একটা গাঢ় লাল জার্কিন পরাতে আরো স্মার্ট দেখাচ্ছে। বললেন, ‘আপনি ত বিখ্যাত ডিটেকটিভ?’

‘বিখ্যাত কিনা জানি না’, বলল ফেলুদা, ‘তবে ডিটেকশন আমার পেশা বটে।’

‘আমি আবার খুব গোয়েন্দাকাহিনীর ভক্ত। আপনার সঙ্গে একদিন বসে কথা বলার ইচ্ছা রইল।’

‘নিশ্চয়ই।’

‘আজ একটু শপিং-এ বেরিয়েছি। এক্সকিউজ মি।’

সমীরণবাবু চলে গেলেন।

‘আমিও আসি।’ ঘোড়ার পিঠে চড়ে বললেন মিঃ মজুমদার। ‘আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই।’

‘প্রয়োজনে টেলিফোন করতে দ্বিধা করবেন না,’ বলল ফেলুদা। ‘আমরা উঠেছি কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলে।’

ইতিমধ্যে একটি অচেনা ছেলে এসে লালমোহনবাবুর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেছে। সেটা নাকি ওঁর আগামীকালের ডায়ালগ। ‘হিন্দি ডায়ালগ বাংলা অক্ষরে লিখে দিয়েছে, সুবিধাই হল।’

‘অনেক কথা আছে?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘সাড়ে তিন লাইন,’ শুকনো গলায় বললেন লালমোহনবাবু।

‘হোটেলে ফিরে গিয়ে একবার দেবেন ত আমাকে ডায়ালগটা,’ বলল ফেলুদা। ‘আপনাকে একটু তালিম দিয়ে দেব। আপনার হিন্দিতে বড্ড বেশি শ্যামবাজারের টান এসে পড়ে।’

আমরা গতকালের মতো আজকেও ফেরার আগে একবার কেভেনটারসের ছাতে গিয়ে বসলাম হট চকোলেট খাবার জন্য। ঠাণ্ডা বেশ কনকনে, তার উপর মেঘ নেই বলে শীত আরো বেশি। এর মধ্যেই অনেক তারা বেরিয়ে পড়েছে আকাশে, আর তার সঙ্গে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে ছায়াপথটা।

‘এখানে বসতে পারি?’

আমরা তিনজন একটা টেবিলে বসেছিলাম। আমাদের পাশে একটা চেয়ার খালি ছিল; এবার দেখলাম একজন বছর ষাটেকের বাঙালি ভদ্রলোক সেটার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে আছেন। চেখে চশমা, কাঁচা-পাকা মেশানো গোঁফ আর মাথার চুল।

‘বসুন,’ বলল ফেলুদা।

‘আপনার পরিচয় আমার জানা আছে,’ ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, ‘আপনার একটা ছবি সমেত সাক্ষাৎকার বোধহয় একটা বাংলা পত্রিকায় বেরিয়েছিল। বছর খানেক আগে।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কিন্তু এঁকে তো—?’

‘ইনি ঔপন্যাসিক লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়।’

‘কিছু মনে করবেন না—এভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসলাম—কিন্তু আজ আপনাদের দেখলাম আমার পাশের বাড়িতে ঢুকতে। আমি নয়নপুর ভিলার উত্তরের বাড়িটায় থাকি। বাড়ির নাম দ্য রিট্রিট, আর আমার নাম হরিনারায়ণ মুখার্জি।’

‘নমস্কার।’

‘নমস্কার—ইয়ে, আপনি কি কোনো তদন্তের ব্যাপারে এখানে এসেছেন?’

‘আজ্ঞে না। এসেছি ছুটি কাটাতে।’

‘না, মানে, বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়িতে একজন গোয়েন্দা ঢুকছে দেখলে মনে হয়…’

‘কেন? উনি কি কোনো গোলমালে জড়িয়ে আছেন নাকি?’

‘ইয়ে, ওঁর সম্বন্ধে পাঁচ রকম গুজব শোনা যায় ত!’

‘ওঃ, তাই বলুন। না, উনি কোনো গোলমালে জড়িয়ে আছেন বলে মনে হল না। আর গুজবে কান দেওয়াটা আমি বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি না।’

‘তা ত বটেই। তা ত বটেই।’

আমার মনে হল ফেলুদা ইচ্ছে করেই মিঃ মজুমদারের লেটেস্ট ব্যাপারটা চেপে গেল। ইনি কোথাকার কে তা কে বলতে পারে? আর ভদ্রলোক সত্যিই ত উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন।

কেভেনটারসের ছাতে আলো অল্পই, কিন্তু তার মধ্যেই দেখছিলাম লালমোহনবাবু পকেট থেকে তাঁর কাগজটা বার করে ডায়লগটা আউড়ে দেখছেন।

‘তাহলে উঠি? আলাপ করে খুব ভালো লাগল।’

‘তাহলে উঠি? আলাপ করে খুব ভালো লাগল।’

হরিনারায়ণ মুখার্জি চলে গেলেন।

‘ভদ্রলোক মনে হল এখানকার অনেকদিনের বাসিন্দা,’ ফেলুদা মন্তব্য করল।

‘সেটা আবার কী করে বুঝলেন মশাই?’

‘আমাদের চেয়ে শীতটা বেশি সহ্য করতে পারেন। সুতির সার্টের উপর একটা গরম চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। পায়ে মোজাও পরেননি। ভদ্রলোককে একটু কালটিভেট করতে পারলে মন্দ হত না।’

‘কেন?’

‘আজ জানান দিয়ে গেলেন যে ওঁর কাছে খবর আছে।’

কেন জানি না, হট চকোলেটটা খেতে খেতে মনে হচ্ছিল যে ঘটনা যেভাবে এগোচ্ছে, যে সব লোকের সঙ্গে আলাপ করে যে সব খবর জানতে পারছি, তার থেকে একটা বিস্ফোরণ ঘটা খুব আশ্চর্য নয়। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে সেটা ভাবতেই পারিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *