১০. আমাদের হংকং যাওয়া

১০

মঙ্গলবার ১২ই অক্টোবর রাত দশটায় এয়ার ইন্ডিয়ার ৩১৬ নম্বর ফ্লাইটে আমাদের হংকং যাওয়া। বোইং ৭০৭ আর ৭৩৭-এ ওড়ার অভিজ্ঞতা ছিল এর আগে, এবার ৭৪৭ জাম্বো-জেটে চড়ে আগের সব ওড়াগুলো ছেলেমানুষী বলে মনে হল।

প্লেনের কাছে পৌঁছে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এত বড় জিনিসটা আকাশে উড়তে পারে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভিতরে ঢুকে যাত্রীর ভীড় দেখে সেটা আরো বেশি করে মনে হল। লালমোহনবাবু যে বলেছিলেন শুধু ইকনমি ক্লাসের যাত্রীতেই নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম ভরে যাবে, সেটা অবিশ্যি বাড়াবাড়ি, কিন্তু একটা মাঝারি সাইজের সিনেমা হলের একতলাটা যে ভরে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।

ফেলুদা গতকাল সকালেই পূর্ণেন্দুবাবুকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছে। আমরা হংকং পৌঁছাব আগামীকাল সকাল পৌনে আটটা হংকং টাইম—তার মানে ভারতবর্ষের চেয়ে আড়াই ঘণ্টা এগিয়ে।

যেখানে যাচ্ছি সেটা যদি নতুন জায়গা হয় তাহলে সেটা সম্বন্ধে পড়াশুনা করে নেওয়াটা ফেলুদার অভ্যাস, তাই ও গতকালই অক্সফোর্ড বুক অ্যান্ড স্টেশনারি থেকে হংকং সম্বন্ধে একটা বই কিনে নিয়েছে। আমি সেটা উলটে পালটে ছবিগুলো দেখে বুঝেছি হংকং-এর মতো এমন জমজমাট রংদার শহর খুব কমই আছে। লালমোহনবাবু উৎসাহে ফেটে পড়ছেন ঠিকই, কিন্তু যেখানে যাচ্ছেন সে-জায়গা সম্বন্ধে ধারণা এখনো মোটেই স্পষ্ট নয়। একবার জিগ্যেস করলেন চীনের প্রাচীরটা দেখে আসার কোনো সুযোগ হবে কিনা। তাতে ফেলুদাকে বলতে হল যে চীনের প্রাচীর হচ্ছে পীপ্‌লস রিপাবলিক অফ চায়নায়, পিকিং-এর কাছে, আর হংকং হল বৃটিশদের শহর। পিকিং হংকং থেকে অন্তত পাঁচশো মাইল।

আবহাওয়া ভালো থাকলে জাম্বো জেটের মতো এমন মোলায়েম ঝাঁকানি-শূন্য ওড়া আর কোনো প্লেনে হয় না। মাঝরাত্রে ব্যাংককে নামে প্লেনটা, কিন্তু যাত্রীদের এয়ারপোর্টে নামতে দেবে না শুনে দিব্যি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম।

সকালে উঠে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি আমরা সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি।

তারপর ক্রমে দেখা গেল জলের উপর উঁচিয়ে আছে কচ্ছপের খোলার মতো সব ছোট ছোট দ্বীপ। প্লেন নিচে নামছে বলে দ্বীপগুলো ক্ৰমে বড় হয়ে আসছে, আর বুঝতে পারছি তার অনেকগুলোই আসলে জলে-ডুবে-থাকা পাহাড়ের চুড়ো।

সেগুলোর উপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখতে পেলাম পাহাড়ের ঘন সবুজের উপর সাদার ছোপ।

আরো কাছে আসতে সেগুলো হয়ে গেল পাহাড়ের গায়ে থরে থরে সাজানো রোদে-চোখ-ঝলসানো বিশাল বিশাল হাইরাইজ।

হংকং-এ ল্যান্ডিং করতে হলে পাইলটের যথেষ্ট কেরামতির দরকার হয় সেটা আগেই শুনেছি। তিনদিকে সমুদ্রের মাঝখানে এক চিলতে ল্যান্ডিং স্ট্রিপ—হিসেবে একটু গণ্ডগোল হলে জলে ঝপাং, আর বেশি গণ্ডগোল হলে সামনের পাহাড়ের সঙ্গে দড়াম্‌।

কিন্তু এ দুটোর কোনোটাই হল না। মোক্ষম হিসেবে প্লেন গিয়ে নামল ঠিক যেখানে নামবার, থামল যেখানে থামবার, আর তারপর উলটো মুখে গিয়ে টার্মিন্যাল বিল্ডিং-এর পাশে ঠিক এমন জায়গায় দাঁড়ালো যে চাকার উপর দাঁড় করানো দুটো চারকোনা মুখ-ওয়ালা সুড়ঙ্গ এগিয়ে এসে ইকনমি ক্লাস আর ফার্স্ট ক্লাসের দুটো দরজার মুখে বেমালুম ফিট করে গেল। ফলে আমাদের আর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হল না, সোজা দরজা দিয়ে বেরিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে টার্মিন্যাল বিল্ডিং-এর ভিতরে পৌঁছে গেলাম।

‘হংকং-এর জবাব নেই’, বললেন চোখ-ছানাবড়া লালমোহনবাবু।

‘এটা হংকং-এর একচেটে ব্যাপার নয় লালমোহনবাবু’, বলল ফেলুদা। ‘ভারতবর্ষের বাইরে পৃথিবীর সব বড় এয়ারপোর্টেই প্লেন থেকে সোজা টার্মিন্যাল বিল্ডিং-এ ঢুকে যাবার এই ব্যবস্থা।’

হংকং-এ এক মাসের কম থাকলে ভিসা লাগে না, কাস্টমস-এও বিশেষ কড়াকড়ি নেই, তাই বিশ মিনিটের মধ্যে সব ল্যাঠা চুকে গেল। লাগেজ ছিল সামান্যই, তিন জনের তিনটে ছোট সুটকেস, আর কাঁধে একটা করে ছোট ব্যাগ। সব মাল আমাদের সঙ্গেই ছিল।

কাস্টমস থেকে বেরিয়ে এসে দেখি একটা জায়গায় লোকের ভীড়, তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটা হাতলের মাথায় একটা বোর্ডে লেখা ‘পি. মিটার’। বুঝলাম ইনিই হচ্ছেন পূর্ণেন্দু পাল। পরস্পরের মুখ চেনা নেই বলে এই ব্যবস্থা।

‘ওয়েলকাম টু হংকং’, বলে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন পাল মশাই! নবকুমার বাবুরই বয়স, অর্থাৎ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ-এর মধ্যেই। মাথায় টাক পড়ে গেছে, তবে দিব্যি চকচকে স্মার্ট চেহারা, আর গায়ের খয়েরি সুটটাও স্মার্ট আর চকচকে। ভদ্রলোক যে রোজগার ভালোই করেন, আর এখানে দিব্যি ফুর্তিতে আছেন, সেটা আর বলে দিতে হয় না।

একটা গাঢ় নীল জার্মান ওপেল গাড়িতে গিয়ে উঠলাম আমরা। ভদ্রলোক নিজেই ড্রাইভ করেন। ফেলুদা ওঁর পাশে সামনে বসল, আমরা দুজন পিছনে। আমাদের গাড়ি রওনা দিয়ে দিল।

‘এয়ারপোর্টটা কাউলূনে,’ বললেন মিঃ পাল। ‘আমার বাসস্থান এবং দোকান দুটোই হংকং-এ। কাজেই আমাদের বে পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে।’

‘আপনার উপর এভাবে ভর করার জন্য সত্যিই লজ্জিত’, বলল ফেলুদা। ভদ্রলোক কথাটা উড়িয়েই দিলেন।

‘কী বলছেন মশাই। এটুকু করব না? এখানে একজন বাঙালীর মুখ দেখতে পেলে কিরকম লাগে তা কী করে বলে বোঝাব? ভারতীয় গিজগিজ করছে হংকং-এ, তবে বঙ্গসন্তান ত খুব বেশি নেই!’

‘আমাদের হোটেলের কোনো ব্যবস্থা—?’

‘হয়েছে, তবে আগে চলুন ত আমার ফ্ল্যাটে! ইয়ে, আপনি ত ডিটেকটিভ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কোনো তদন্তের ব্যাপারে এসেছেন ত?’

‘হ্যাঁ। একদিনের মামলা। কাল রাত্রেই আবার এয়ার ইন্ডিয়াতেই ফিরে যাব।’

‘কী ব্যাপার বলুন ত।’

‘নবকুমারবাবুদের বাড়ি থেকে একটি মহামূল্য পেন্টিং চুরি হয়ে এখানে এসেছে। এনেছে সোমানি বলে এক ভদ্রলোক। হীরালাল সোমানি। সেটা চালান যাবে এক আর্মেনিয়ানের হাতে। জিনিসটার দাম বেশ কয়েক লাখ টাকা।’

‘বলেন কি!’

‘সেইটেকে উদ্ধার করতে হবে।’

‘ওরে বাবা, এ তো ফিল্মের গপ্পো মশাই। তা এই আর্মেনিয়ানটি থাকেন কোথায়?’

‘এঁর আপিসের ঠিকানা আছে আমার কাছে।’

‘সোমানি কি কলকাতার লোক?’

‘হ্যাঁ, এবং তিনি এসেছেন গত শনিবারের ফ্লাইটে। সে ছবি ইতিমধ্যে সাহেবের কাছে পৌঁছে গেছে।’

‘সর্বনাশ! তাহলে?’

‘তাহলেও সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করে ব্যাপারটা বলতে হবে। চোরাই মাল ধরে রাখা তার পক্ষেও নিরাপদ নয়। সেইটে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।’

‘হুঁ…’

পূর্ণেন্দুবাবুকে বেশ চিন্তিত বলে মনে হল।

লালমোহনবাবুকে একটু গম্ভীর দেখে গলা বেশি না তুলে জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার।

‘হংকংকে কি বিলেত বলা চলে?’ জিগ্যেস করলেন ভদ্রলোক।

বললাম, ‘তা কী করে বলবেন। বিলেত ত পশ্চিমে। এটা ত ফার ইস্ট। তবে বিলেতের যা ছবি দেখেছি তার সঙ্গে এর কোনো তফাৎ নেই।’

ফেলুদার কান খাড়া, কথাগুলো শুনে ফেলেছে। বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, লালমোহনবাবু। আপনার গড়পারের বন্ধুদের বলবেন হংকংকে বলা হয় প্রাচ্যের লণ্ডন। তাতেই ওঁরা যথেষ্ট ইমপ্রেস্‌ড হবেন।’

‘প্রাচ্যের লণ্ডন! গুড।’

ভদ্রলোক ‘প্রাচ্যের লণ্ডন’ ‘প্রাচ্যের লণ্ডন’ বলে বিড়বিড় করছেন, এমন সময় আমাদের গাড়িটা গোঁৎ খেয়ে একটা চওড়া টানেলের ভিতর ঢুকে গেল। সারবাঁধা হলদে বাতিতে সমস্ত টানেলের মধ্যে একটা কমলা আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। পূর্ণেন্দুবাবু বললেন আমরা নাকি জলের তলা দিয়ে চলেছি। আমাদের মাথার উপরে হংকং বন্দর। আমরা বেরোব একেবারে হংকং-এর আলোয়।

লালমোহনবাবু বললেন, ‘এমন দুর্দান্ত শহর, তার নামটা এমন হুপিং কাশির মতো হল কেন?’

‘হংকং মানে কি জানেন ত?’ জিগ্যেস করলেন পূর্ণেন্দুবাবু।

‘সুবাসিত বন্দর,’ বলল ফেলুদা। বুঝলাম ও খবরটা পেয়েছে ওই বইটা থেকে।

বেশ কিছুক্ষণ এই পথে চলার পর টানেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম ছোট-বড়-মাঝারি নানারকম জলযান সমেত পুরো বন্দরটা আমাদের পাশে বিছিয়ে রয়েছে, আর তারও পিছনে দূরে দেখা যাচ্ছে ফেলে আসা কাউলূন শহর।

আমাদের বাঁয়ে এখন বিশাল হাইরাইজ। কোনোটা আপিস, কোনোটা হোটেল, প্রত্যেকটারই নিচে লোভনীয় জিনিসে ঠাসা দোকানের সারি। পরে বুঝেছিলাম পুরো হংকং শহরটা একটা অতিকায় ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মতো। এমন কোনো জিনিস নেই যা হংকং-এ পাওয়া যায় না।

কিছুদূর গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে দুটো হাইরাইজের মাঝখান দিয়ে আমরা আরেকটা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়লাম।

এমন রাস্তা আমি কখনই দেখিনি।

ফুটপাথ দিয়ে চলেছে কাতারে কাতারে লোক, আর রাস্তা দিয়ে চলেছে ট্যাক্সি, বাস, প্রাইভেট গাড়ি আর ডবলডেকার-ট্রাম। ট্রামের মাথা থেকে ডাণ্ডা বেরিয়ে তারের সঙ্গে লাগানো, কিন্তু রাস্তায় লাইন বলে কিছু নেই। রাস্তার দুপাশে রয়েছে দোকানের পর দোকান। তাদের সাইনবোর্ডগুলো দোকানের গা থেকে বেরিয়ে আমাদের মাথার উপর এমন ভাবে ভীড় করে আছে যে আকাশ দেখা যায় না। চীনে ভাষা লেখা হয় ওপর থেকে নিচে, তাই সাইন- বোর্ডগুলোও ওপর থেকে নিচে, তার একেকটা আট-দশ হাত লম্বা।

ট্র্যাফিক প্রচণ্ড, আমাদের গাড়িও চলেছে ধীরে, তাই আমরা আশ মিটিয়ে দেখে নিচ্ছি এই অদ্ভুত শহরের অদ্ভুত রাস্তার চেহারাটা। কলকাতার ধরমতলাতেও ভীড় দেখেছি, কিন্তু সেখানে অনেক লোকের মধ্যেই যেন একটা যাচ্ছি-যাব ভাব, যেন তাদের হাতে অনেক সময়, রাস্তাটা যেন তাদের দাঁড়িয়ে আড্ডা মারার জায়গা। এখানের লোকেরা কিন্তু সকলেই ব্যস্ত, সকলেই হাঁটছে, সকলেরই তাড়া। বেশির ভাগই চীনে, তাদের কারুর চীনে পোষাক, কারুর বিদেশী পোষাক। এদেরই মধ্যে কিছু সাহেব-মেমও আছে। তাদের হাতে ক্যামেরা, চোখে কৌতূহলী দৃষ্টি আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরানো থেকেই বোঝা যায় এরা টুরিস্ট।

অবশেষে এ-রাস্তাও পিছনে ফেলে একটা সরু রাস্তা ধরে একটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি অঞ্চলে এসে পড়লাম আমরা। পরে জেনেছিলাম এটার নাম প্যাটারসন স্ট্রীট। এখানেই একটা বত্রিশ তলা বাড়ির সাত তলায় পূর্ণেন্দুবাবুর ফ্ল্যাট।

গাড়ি থেকে যখন নামছি তখন আমাদের পাশ দিয়ে একটা কালো গাড়ি হঠাৎ স্পীড বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল আর ফেলুদা কেমন যেন একটু টান হয়ে গেল। এই গাড়িটাকে আমি আগেও আমাদের পিছনে আসতে দেখেছি। এদিকে পূর্ণেন্দুবাবু নেমেই এগিয়ে গেছেন কাজেই আমাদেরও তাঁকে অনুসরণ করতে হল।

‘একটু হাত পা ছড়িয়ে বসুন স্যার,’ আমাদের নিয়ে তাঁর বৈঠকখানায় ঢুকেই বললেন পূর্ণেন্দুবাবু। ‘দুঃখের বিষয় আমার এক ভাগনের বিয়ে, তাই আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে এই সেদিন রেখে এসেছি কলকাতায়! আশা করি আতিথেয়তার একটু-আধটু এুটি হলে মাইণ্ড করবেন না। —কী খাবেন বলুন।’

‘সবচেয়ে ভালো হয় চা হলে,’ বলল ফেলুদা।

‘টী-ব্যাগস-এ আপত্তি নেই ত?’

‘মোটেই না।’

ঘরের উত্তর দিকে একটা বড় ছড়ানো জানালা দিয়ে হংকং শহরের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। লালমোহনবাবু দৃশ্য দেখছেন, আমি দেখছি সোনি কালার টেলিভিশনের পাশে আরেকটা যন্ত্র, সেটা নিশ্চয়ই ভিডিও। তারই পাশে তিন তাক ভরা ভিডিও ফিল্ম। তার মধ্যে বেশির ভাগই হিন্দি, আর অন্য পাশে টেবিলের উপর ডাঁই করা ম্যাগাজিন। ফেলুদা তারই খানকতক টেনে নিয়ে পাতা ওলটাতে আরম্ভ করেছে। মিঃ পাল ঘরে নেই তাই এই ফাঁকে প্রশ্নটা না করে পারলাম না।

‘গাড়িতে কে ছিল ফেলুদা?’

‘যে না-থাকলে আমাদের আসা বৃথা হত।’

‘বুঝেছি।’

হীরালাল সোমানি।

‘কিন্তু লোকটা কী করে জানল যে আমরা এসেছি?’

‘খুব সহজ,’ বলল ফেলুদা। ‘আমরা যে ভাবে ওর আসার ব্যাপারটা জেনেছি সেই ভাবেই। প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করেছে। এয়ারপোর্টে ছিল নিশ্চয়ই। ওখান থেকে পিছু নিয়েছে।’

লালমোহনবাবু জানালা থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘ছবি যদি পাচার হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আর আমাদের পিছনে লাগার কারণটা কী?’

‘সেটাই ত ভাবছি।’

‘আসুন স্যার!’

পূর্ণেন্দুবাবু ট্রে-তে চা নিয়ে এসেছেন, সঙ্গে বিলিতি বিস্কুট। টেবিলের উপর ট্রে-টা রেখে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি যে মান্ধাতার আমলের ফিল্মের পত্রিকায় মস্‌গুল হয়ে পড়লেন।’

ফেলুদা একটা ছবি বেশ মন দিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘স্ক্রীন ওয়র্লডের এই সংখ্যাটা কি আপনার খুব কাজে লাগছে? এটা সেভনটি-সিক্স-এর।’

‘মোটেই না। আপনি স্বচ্ছন্দে নিতে পারেন। ওগুলো আমি দেখি না মশাই, দেখেন আমার গিন্নী। একেবারে ফিল্মের পোকা!’

‘থ্যাঙ্ক ইউ। তোপ্‌সে, এই পত্রিকাটা আমার ব্যাগের মধ্যে ভরে দে ত। ইয়ে, আপনাদের এখানকার আপিস-টাপিস খোলে কখন?’

‘আর মিনিট দশেকের মধ্যেই খুলে যাবে। আপনি সেই সাহেবকে ফোন করবেন ত?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘নম্বর আছে?’

‘আছে।’

ফেলুদা নোটবুক বার করল।—‘এই যে—৫-৩১,১৬৮৬।’

‘হুঁ। হংকং-এর নম্বর। আপিসটা কোথায়?’

‘হেনেসি স্ট্রীট। চোদ্দ নম্বর।’

‘হুঁ। আপনি দশটায় ফোন করলেই পাবেন।’

‘আমাদের হোটেল কোনটা ঠিক করেছেন জানতে পারি কি?’

‘পার্ল হোটেল। এখান থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিট। তাড়া কিসের? দুপুরের খাওয়াটা সেরে যাবেন এখন। কাছেই খুব ভালো ক্যান্টনীজ রেস্টোরান্ট আছে। তারপর, আপনাদের মিশন যদি আজ সাক্‌সেসফুল হয়, তাহলে কাল নিয়ে যাব কাউলূনের এক রেস্টোরান্টে। এমন একটা জিনিস খাওয়াবো যা কখনো খাননি।’

‘কী জিনিস মশাই?’ লালমোহনবাবু জিগ্যেস করলেন। ‘এরা ত আরসোলা-টারসোলাও খায় বলে শুনিচি।’

‘শুধু আরসোলা কেন,’ বলল ফেলুদা, ‘আরসোলা, হাঙরের পাখনা, বাঁদরের ঘিলু, এমন কি সময় সময় কুকুরের মাংস পর্যন্ত।’

‘এ একেবারে অন্য জিনিস,’ বললেন পূর্ণেন্দুবাবু। ‘ফ্রাইড স্নেক।’

‘স্‌-স্‌-স্‌-স্নেক?’ লালমোহবাবুর চোখ-নাক সব একসঙ্গে কুঁচকে গেল।

‘স্নেক।’

‘মানে সাপ? সর্প?’

‘সর্প। সাপের সূপ, সাপের মাংস, ফ্রাইড স্নেক—সব পাওয়া যায়।’

‘খেতে ভালো?’

‘অপূর্ব। ব্যাঙের মাংস ত অতি সুস্বাদু জিনিস, জানেন বোধহয়। তা ব্যাঙের ভক্ষক কেন ভালো হবে না খেতে বলুন।’

লালমোহনবাবু যদিও বললেন ‘তা বটে’, কিন্তু যুক্তি পুরোপুরি মানলেন বলে মনে হল না।

ফেলুদা উঠে পড়েছে।

‘যদি কিছু মনে না করেন—আপনার টেলিফোনটা…’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’

ফেলুদা আর্মেনিয়ান সাহেবের নম্বরটা ডায়াল করল। এ ডায়ালিং আমাদের মতো ঘুরিয়ে ডায়ালিং নয়। এটা বোতাম টিপে ডায়ালিং। টেপার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নম্বরে বিভিন্ন সুরে একটা ‘পিঁ’ শব্দ হয়।

‘আমি একটু ক্ৰিকোরিয়ান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘তিনি ত নেই।’

‘কোথায় গেছেন?’

‘তাইওয়ান।’

‘কবে?’

‘গত শুক্রবার। আজ সন্ধ্যায় ফিরবেন।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

ফেলুদা ফোন রেখে তারপর কী কথা হয়েছে সেটা বলল আমাদের।

‘তার মানে সে ছবি ত এখনো সোমানির কাছেই আছে,’ বললেন পূর্ণেন্দুবাবু।

‘তাই ত মনে হচ্ছে,’ বলল ফেলুদা। ‘তার মানে আমাদের এখানে আসাটা ব্যর্থ হয়নি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *