০৭. ছবিটা কি লোপাট হয়ে গেল

আমরা আধ ঘণ্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম।

‘ছবিটা কি লোপাট হয়ে গেল নাকি মশাই?’ যেতে যেতে জিগ্যেস করলেন লালমোহনবাবু।

‘সেইটেই ত ভয় পাচ্ছি।’

‘অ্যাদ্দিন ছবির ব্যাপারটায় ঠিক ইন্টারেস্ট পাচ্ছিলুম না, জানেন। এখন বইটা পড়ে, আর ভূদেব রাজার সঙ্গে কথা বলে কেমন যেন একটা নাড়ীর যোগ অনুভব করছি ওই টিরিনটোরোর সঙ্গে।’

ফেলুদা গম্ভীর, লালমোহনবাবুর ভুল শুধরোনর চেষ্টাও করল না।

এবারে হরিপদবাবু স্পীডোমিটারের কাঁটা আরো চড়িয়ে রাখায় আমরা ঠিক দু’ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম।

নিয়োগীবাড়িতে এই তিনদিনে যেমন কিছু নতুন লোক এসেছে—নবকুমারবাবুর স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে—তেমনি কিছু লোক চলেও গেছে।

চন্দ্রশেখরের ছেলে রুদ্রশেখর আজ ভোরে চলে গেছেন কলকাতা।

আর বঙ্কিমবাবুও নেই।

বঙ্কিমবাবু খুন হয়েছেন।

কোনো ভারী জিনিস দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করা হয়, আর তার ফলেই তাঁর মৃত্যু হয়। বেশ বেলা পর্যন্ত তাঁর কোনো হদিস না পেয়ে খোঁজাখুঁজি পড়ে যায়। শেষে চাকর গোবিন্দ স্টুডিওতে গিয়ে দেখে তাঁর মৃতদেহ পড়ে আছে মেঝেতে, মাথার চার পাশে রক্ত। পুলিশের ডাক্তার দেখে বলেছে মৃত্যু হয়েছে আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে। সময়—আন্দাজ রাত তিনটে থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে।

নবকুমার বললেন, ‘আপনাকে ফোনে পাওয়া গেল না, তাই বাধ্য হয়েই পুলিশে খবর দিতে হল।’

‘তা ভালোই করেছেন’, বলল ফেলুদা—‘কিন্তু কথা হচ্ছে—ছবিটা আছে কি?’

‘সেটাই ত আশ্চর্য ব্যাপার মশাই। আততায়ী যে কে সেটা আন্দাজ করা ত খুব মুশকিল নয়; ভদ্রলোকের হাবভাব এমনিতেই সন্দেহজনক মনে হত। বোঝাই যাচ্ছিল টাকার দরকার, অথচ আইনের পথে যেতে গেলে সম্পত্তি পেতে অন্তত ছ’সাত মাস ত লাগতই—’

‘আরো অনেক বেশি’, বলল ফেলুদা, পাঁচ বছর আগেও ভূদেব সিং চন্দ্রশেখরের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন।’

‘তাই বুঝি? তাহলে ত ভদ্রলোকের কোনো লিগ্যাল রাইটই ছিল না।’

‘তাতে অবিশ্যি চুরি করতে কোনো বাধা নেই।’

‘কিন্তু চুরি হয়নি! ছবি যেখানে ছিল সেখানেই আছে।’

‘তাজ্জব ব্যাপার,’ বলল ফেলুদা। ‘এ জাতীয় ঘটনা সমস্ত হিসেব-টিসেব গুলিয়ে দেয়। পুলিশে কী বলে?’

‘এক দফা জেরা হয়ে গেছে সকালেই। আসল কাজ ত হল, যে চলে গেছে তাকে খুঁজে পাওয়া। কারণ, কাল রাত্রে এ বাড়িতে ছিলাম আমি, আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে, বাবা, মা, রবীনবাবু আর চাকর-বাকর।’

‘রবীনবাবু ভদ্রলোকটি—?’

‘উনি প্রায় রোজ রাত দেড়টা-দুটো অবধি ওঁর ঘরে কাজ করেন। চাকরেরা ওঁর ঘরে বাতি জ্বলতে দেখেছে। তাই সকাল আটটার আগে বড় একটা ঘুম থেকে ওঠেন না। আটটায় ওঁর ঘরে চা দেয় গোবিন্দ। আজও দিয়েছে। রুদ্রশেখরও যে খুব সকালে উঠতেন তা নয়, তবে আজ সাড়ে ছ’টার মধ্যে উনি চলে গেছেন। উনি আর ওঁর সঙ্গে একজন আর্টিস্ট।’

‘আর্টিস্ট?’

‘আপনি যেদিন গেলেন সেদিনই এসেছেন কলকাতা থেকে। রুদ্রশেখরই গিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। স্টুডিওর জিনিসপত্রের একটা ভ্যালুয়েশন করার জন্য। সব বিক্রী করে দেবেন বলে ভাবছিলেন বোধহয়।’

‘ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করে যাননি?’

‘উঁহু। আমি ত জানি কলকাতায় যাচ্ছেন উকিল-টুকিলের সঙ্গে কথা বলতে; কাজ হলেই আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু এখন ত আর মনে হয় না ফিরবেন বলে।’

আমরা এক তলার বৈঠকখানায় বসে কথা বলছিলাম। নবকুমারবাবু বোধহয় আমাদের দোতলায় নিয়ে যাবেন বলে সোফা ছেড়ে উঠতেই ফেলুদা বলল—

‘রুদ্রশেখর যে ঘরটায় থাকতেন সেটা একবার দেখতে পারি কি?’

‘নিশ্চয়ই। এই ত পাশেই।’

ঘরের দক্ষিণ দিকের দরজা একটা দিয়ে আমরা মেঝেতে চীনে মাটির টুকরো বসানো একটা শোবার ঘরে ঢুকলাম। ঢুকেই মনে হল যেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে পড়েছি। এমন খাট, খাটের উপর মশারি টাঙানোর এমন ব্যবস্থা, এমন ড্রেসিং টেবল, এমন রাইটিং ডেস্ক, কাপড় রাখার এমন আলনা—কোনোটাই আর আজকের দিনে দেখা যায় না। নবকুমারবাবু বললেন, এ ঘরটাতে আগে চন্দ্রশেখরের ভাই সূৰ্যশেখর—অর্থাৎ নবকুমারবাবুর ঠাকুরদাদা—থাকতেন। ‘ঠাকুরদাদা শেষের দিকে আর দোতলায় উঠতে পারতেন না। অথচ রোজ সকালে-বিকেলে মন্দিরে যাওয়া চাই, তাই একতলাতেই বসবাস করতেন।’

‘বিছানা করা হয়নি দেখছি,’ বলল ফেলুদা। সত্যি, মশারিটা পর্যন্ত এখনো ঝুলে রয়েছে।

‘সকাল থেকেই বাড়িতে যা হট্টগোল, চাকরবাকররা সব কাজকর্ম ভুলে গেছে আর কি!’

‘পাশের ঘরটায় কে থাকে?’

‘ওটায় থাকতেন বঙ্কিমবাবু।’

দুটো ঘরের মাঝখানে একটা দরজা রয়েছে, কিন্তু সেটা বন্ধ। ফেলুদা রুদ্রশেখরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকল বঙ্কিমবাবুর ঘরে।

এঘরে স্বভাবতই জিনিসপত্র অনেক বেশি। আলনায় জামা-কাপড়, তার নিচে চটি-জুতো, টেবিলের উপর কিছু বই, কলম, প্যাড, একটা রেমিংটন টাইপরাইটার। দেয়ালে টাঙানো কিছু ফোটোগ্রাফ, তার মধ্যে একটা একজন সন্ন্যাসী-গোছের ভদ্রলোকের। এ ঘরেও বিছানা করা হয়নি। মশারি ঝুলে রয়েছে।

ফেলুদা হঠাৎ খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে মশারিটা তুলে ধরল, তার দৃষ্টি বালিশের দিকে।

বালিশটা তুলতেই তার তলা থেকে একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ল।

একটা ছোট্ট নীল বাক্সের মধ্যে একটা ট্র্যাভেলিং অ্যালার্ম ক্লক।

‘এ জিনিস ত আমরাও এককালে করতুম মশাই’ বললেন লালমোহনবাবু। ‘আমার পাশের ঘরে ছোটকাকা শুতেন; পরীক্ষার সময় অ্যালার্ম দিয়ে ভোরে উঠতুম, আর ওঁর যাতে ঘুম না ভাঙে তাই ঘড়িটা রাখতুম বালিশের নিচে।’

‘হুঁ’, বলল ফেলুদা, ‘কিন্তু ইনি অ্যালার্ম দিয়েছিলেন সাড়ে তিনটেয়।’

‘সাড়ে তিনটে!’

নবকুমারবাবু অবাক।

‘এবং সেই সময়ই বোধহয় গিয়েছিলেন চন্দ্রশেখরের স্টুডিওতে। মনে হয় ভদ্রলোক কিছু একটা সন্দেহ করছিলেন। সেই সন্দেহের কথাটাই বোধহয় আমায় বলতে চেয়েছিলেন গতবার।’

*

এই খুনের আবহাওয়াতেও লালমোহনবাবুর হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে ওঠার কারণ আর কিছুই না; নবকুমারবাবুর এগারো বছরের ছেলে আর ন’ বছরের মেয়ে দুজনেই বেরিয়ে গেল জটায়ুর অন্ধ ভক্ত। ভদ্রলোককে বৈঠকখানার সোফায় ফেলে দুজনেই চেপে ধরল—‘একটা গপ্প বলুন! একটা গপ্প বলুন!’

লালমোহনবাব খুব স্পীডে উপন্যাস লেখেন ঠিকই, তাই বলে কেউ চেপে ধরলেই যে টুথপেস্টের টিউবের মতো গল গল করে নতুন গল্প বেরিয়ে যাবে এমন নয়। ‘আচ্ছা বলছি’ বলে পর পর তিনবার খানিকদূর এগোতেই ভাই বোনে চেঁচিয়ে ওঠে—‘আরে, এ তো সাহারায় শিহরণ!’ ‘আরে, এ তো হনডুরাসে হাহাকার!’ এ তো অমুক, এ তো তমুক…

শেষে ভদ্রলোকের কী অবস্থা হল জানি না, কারণ ফেলুদা নবকুমারবাবুকে বলল যে একবার খুনের জায়গাটা দেখবে।

লালমোহনবাবুকে দোতলায় রেখে আমরা তিনজনে গেলাম চন্দ্রশেখরের স্টুডিওতে।

প্রথমেই যেটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ফেলুদা থেমে গেল সেটা হল ঘরের মাঝখানের টেবিলটা।

‘এর ওপর একটা ব্রঞ্জের মূর্তি ছিল না—একটা ঘোড়সওয়ার?’

‘ঠিক বলেছেন। ওটা ইন্সপেকটর মণ্ডল নিয়ে গেলেন আঙুলের ছাপ নেওয়ার জন্য। ওঁর ধারণা ওটা দিয়েই খুনটা করা হয়েছে।’

‘হুঁ…’

এবার আমরা তিনজনেই দক্ষিণের দেয়ালের কোণের ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

আজ যেন যীশুর জৌলুস আরো বেড়েছে। কেউ পরিষ্কার করেছে কি ছবিটাকে?

ফেলুদা এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে ছবিটার একেবারে কাছে দাঁড়াল। তারপর মিনিটখানেক সেটার দিকে চেয়ে থেকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল।

‘ইটালিতে রেনেসাঁসের যুগে মিনি-শ্যামাপোকা ছিল কি?’

‘মিনি-শ্যামাপোকা?’ নবকুমারবাবুর চোখ কপালে উঠে গেছে।

‘আজকাল তিনরকম শ্যামাপোকা হয়েছে জানেন ত? মিনি, মিডি আর ম্যাক্সি। ম্যাক্সিগুলো সাদা, সবুজ নয়। মিনিগুলো রেগুলার কামড়ায়। সবুজ মিডিগুলো অবিশ্যি চিরকালই ছিল। কিন্তু ষড়বিংশ শতাব্দীর ভেনিসে ছিল কিনা সে বিষয় আমার সন্দেহ আছে।’

‘ভেনিসে না হোক, এই বৈকুণ্ঠপুরে ত আছেই। কাল রাত্রেও হয়েছিল।’

‘তাহলে দুটো প্রশ্ন করতে হয়,’ বলল ফেলুদা, ‘প্রাচীন পেন্টিং-এর শুকনো রঙে সে পোকা আটকায় কি করে, আর যে ঘরে রাত্রে বাতি জ্বলে না সে ঘরে পোকা আসে কি করে।’

‘তার মানে—?’

‘তার মানে এ ছবি আসল নয়, মিস্টার নিয়োগী। আসল ছবিতে যীশুর কপালে শ্যামাপোকা ছিল না, আর ছবির রঙও এত উজ্জ্বল ছিল না। এ ছবি গত দু’এক দিনে আঁকা হয়েছে মূল থেকে কপি করে। কাজটা রাত্তিরে মোমবাতি বা কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে হয়েছে, আর সেই সময় একটি শ্যামাপোকা ঢুকে যীশুর কপালের কাঁচা রঙে আটকে গেছে।’

নবকুমারবাবুর মুখ ফ্যাকাসে।

‘তাহলে আসল ছবি—?’

‘আসল ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে মিস্টার নিয়োগী। খুব সম্ভবত আজ ভোরেই। এবং কে সরিয়েছে সেটা ত নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *