১০. করতোয়া তীরে এসে

করতোয়া তীরে এসে উপনীত হয় তারা এক প্রকার নির্বিঘ্নেই। নদীতীরেই একখানি গ্রাম, সেখানে কুম্ভকারদের বাস। ঐ গ্রামে সহজেই তারা স্থান পায়। প্রবীণ কুম্ভকার অবনীদাস সম্পন্ন গৃহস্থ! তাঁরই আশ্রয়, কুটিরটিও তাঁরই। অবনীদাসের লোকের প্রয়োজন ছিলো, তাই তিনি শ্যামাঙ্গকে সাদরে স্থান দিয়েছেন।

বর্ষা গত হয়েছে, শরৎ আসন্ন, তাই ব্যস্ততাও অধিক। মধুপুর গ্রামখানি পুন্ড্রনগরী থেকে মাত্রই দুই ক্রোশ। ফলে নগরীর প্রয়োজনীয় তৈজসাদি অধিকাংশই এই গ্রাম থেকে যায়।

শ্যামাঙ্গ সহজেই নিজেকে কর্মব্যস্ততার সঙ্গে যুক্ত করে। বাহির থেকে মনে হয়, দম্পতিটির জীবন ভারী সুখী। নবীনা গৃহিণীটি সর্বক্ষণ সংসার–কর্মে ব্যস্ত। কখনও অঙ্গন লেপন করছে, কখনও নদী থেকে জল আনছে, কখনও রন্ধন করছে। প্রতিবেশিনীরা দেখে বধূটি নিতান্তই স্বল্পভাষিণী। প্রশ্ন ব্যতিরেকে কোনো কথাই বলে না। যদি পিতৃগৃহের কথা জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে তার ক্ষুদ্র উত্তর, আমার পিতা–মাতা নেই, কেবল একজন মাতুল আছেন। শ্বশুরগৃহের কথা জানতে চাইলে বলে, তাঁরাও গত হয়েছেন, আমাদের অশেষ দুর্ভাগ্য। বিবাহ কতোদিন, সন্তানাদি কি একেবারেই হয়নি, দেশত্যাগ কেন করেছো–ইত্যাকার প্রশ্ন হলে সে উত্তর দেয় না, অধোমুখে নিজ কাজে অধিকতর মনোযোগী হয়ে ওঠে।

দিবসকালে সে কুটিরটির দ্বার ক্বচিৎ উন্মুক্ত রাখে। যখনই দেখো, তার কুটির দ্বারে অর্গল। কেন সে কুটির দ্বার রুদ্ধ রাখে নিজেও জানে না। তার অস্পষ্ট কেমন একটি ধারণা হয়েছে যে, অন্তঃপুরে কী আছে তা অন্যলোকের দৃশ্যগোচর করা অনুচিত। কিন্তু নারীর স্বভাবে যে এক প্রকার দুর্নিবার কৌতূহল আছে, সে ঐ কৌতূহল নিবৃত্ত করবে। কোন্ উপায়ে? অবনীদাসের নববিবাহিতা কন্যাটি এসে যখন বলে, ভগিনী, তোমার কুটিরে চলো, নিভৃতে দুটি কথা বলি–তখন সে বিপদে পড়ে। বহু ছলনা করে সুকৌশলে সে তখন প্রভু কন্যার মনকে প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে যায়। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? মনে প্রশ্ন জাগে।

শয়নগৃহে এলে এমন কিছু দেখতো না। রাত্রিকালে তারা শয়ন করে এক শয্যায় না দুশয্যায় এই সংবাদ দিবাভাগে আর কে জানতে পারছে? তথাপি লীলার মনে হয়, এভাবে আর কতোদিন?

শ্যামাঙ্গেরও দুশ্চিন্তা হয় একেকদিন। কেনো নিজেকে একেবারেই অপরিচিত রাখবে এমন আশা আর করা যাচ্ছে না। বিমূলের এক কুম্ভকার একদা তাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি সামন্তপতি সুধীমিত্রের বিষ্ণুমন্দির নির্মাণের সময় আমাদের গ্রামে ছিলেন না? আর একদিন একজন আগন্তুক বললো, আপনাকে তো আমি জানি, কুসুম্বী গ্রামে আপনি মনোহরদাসের গৃহে ছিলেন, আপনি কি এখনও পুত্তলি গঠন করেন?

এইভাবে হঠাৎ দুএকজন লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আর তাতেই দুশ্চিন্তা হয়। সে অনুভব করে, পরিচয় গোপন করে এক স্থানে অবস্থান করা প্রকৃতই কঠিন কাজ। যদি স্থান থেকে স্থানান্তরে ভ্রমণ করতো, পরিধানে থাকতো যোগীবেশ, তাহলে কথা ছিলো না। জীবনযাপন করবে গৃহীর অথচ স্বামী–স্ত্রী নয়, এমন নরনারীকে কোনো লোক সহ্য করবে? লোকচক্ষে এ তো চূড়ান্ত ব্যভিচার।

কথাটি সে লীলাবতীকে অন্যভাবে জানায়। সাবধান করে দেয়। বলে, নিজ গ্রামের কথা কাউকে জানাবে না, তাতে আমাদের বিপদ।

লীলাবতী শ্যামাঙ্গের মুখপানে চায়। তাহলে কি লোকের সন্দেহ হচ্ছে–তার অর্থ আবার পথে পথে ভ্রমণ! এক প্রকার অস্বস্তিতে তার মন আক্রান্ত হয়ে যায়।

ঐ অস্বস্তি ক্রমে যন্ত্রণা হয়ে ওঠে। প্রতিবেশী রমণীদের প্রশ্নে সে নীরব থাকে। কিন্তু ঐ নীরবতারও তো শেষ আছে। একেকদিন একেকজন একেক মন্তব্য করে। একজন বলে, হ্যাঁ লো সাধুর ঝি, তোকে কেউ দেখতে আসে না? তোর কি কোনোই আত্মীয় পরিজন নেই? একদিন একজন দূর থেকে মন্তব্য করে–ঐ বন্ধ্যা নারীর মুখ দর্শন যেন সকালে না করতে হয় ঠাকুর। অন্য আরেকদিন শোনে, একজন অন্যজনকে বলছে, তোমার কন্যাকে ঐ বিদেশিনীর কুটিরে যেতে দিও না বাছা–আমার সন্দেহ, ওটি কামরূপ কামাখ্যার ডাকিনী যোগিনীদের কেউ, তা না হলে তার পুরুষ অমন বশ হয়?

অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর নিত্যকার কলহ শুনতে পায় না কেউ–এও একটি দোষ।

অবনীদাসের মাতা তাকে নিজ পৌত্রীর মতোই জ্ঞান করেন। কুটিরে এলে নানান হাস্য কৌতুক হয়। একদিন হাত দিয়ে লীলার মুখখানি তুলে ধরে জানতে চাইলেন, হ্যাঁ লো সুন্দরী, তোর পুরুষ কেমন আদর–সোহাগ করে বল দেখি? গতরাত্রে কবার চুম্বন করছে তোকে? গ্রীবায় কখনও চিহ্ন অঙ্কন করেছে? হ্যাঁ লো, লজ্জা কি, এ্যাঁ?

এ প্রকার প্রশ্ন হলে লীলার সহ্য হয় না। বক্ষের ভেতরে জ্বালা ধরে। সেদিন যখন বললেন, হ্যাঁ লো, তোর পুরুষ তোকে অলঙ্কার দেয় না কেন? এই শাটিকা ব্যতীত কি। তোর অন্য শাটিকা নেই? তখন সে আর সংযত থাকতে পারলো না। দুহাতে মুখ ঢেকে বেপথু কান্নায় ভেঙে পড়লো।

ঐদিন রাত্রিকালে শ্যামাঙ্গকে জানালো, চলো আর এ স্থানে নয়।

শ্যামাঙ্গ কোনো প্রশ্ন করলো না। বললো, তাই চলো, আর এ স্থানে নয়।

শ্যামাঙ্গ যেন প্রস্তুত। লীলাবতী শ্যামাঙ্গের মুখপানে চায়, এ কি বিদ্রূপ, না কৌতুক? কিন্তু দেখলো, না শ্যামাঙ্গ সত্য সত্যই প্রস্তুত। তখন সে জানতে চাইলো, এ স্থানে নয়, তো কোথায়, বলো?

কোথায় তাদের স্থান হবে তা কি শ্যামাঙ্গ জানে? কোন স্থানে দুজনের একত্র–জীবন বিকশিত হবে, প্রস্ফুটিত হবে, ফলবান হবে? না কোনো স্থানের কথা তার জানা নেই। বললো, চলো, পথই আমাদের ভবিতব্য–আর গত্যন্তর দেখি না।

লীলাবতীর কান্না উদ্বেলিত হয়। বলে, এভাবে আর কতদিন, বলো? জীবন কি পথে পথে যাপিত হয়? এমন জীবন তো আমি চাইনি–আমার যে সংসার প্রয়োজন। লীলাবতী দুবাহু দিয়ে শ্যামাঙ্গকে সজোরে আলিঙ্গন করে রাখে আর কাঁদে। বলে, আমি তোমার জীবনে কেন এলাম–মরণ হয় না আমার?

ঐ রাত্রে কুটিরের প্রদীপালোক হয়ে ওঠে অপরূপ। ক্ষুব্ধ, বেপথু এবং ক্রন্দনময় রাত্রিকে যেন ঐ আলোক নিরাবরণ করে দেয়। লীলা উন্মাদিনীর মতো বলে, তুমি ত্যাগ করে যাও আমাকে। আমি তাহলে মরতে পারি। তুমি ত্যাগ না করলে যে আমার বাসনা শতবাহু মেলে জীবনকে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু এ কেমন জীবন বলল, এ জীবনযাপন। করা অসম্ভব, তুমি যাও শ্যামাঙ্গ, আমাকে ত্যাগ করে চলে যাও।

আলুলায়িত কেশভার, বিস্ৰস্তবাস আর ঐ প্রকার অবরুদ্ধ হাহাকার। শ্যামাঙ্গ লীলাকে বক্ষলগ্ন করে। পৃষ্ঠে হাত রাখে, সীমন্তে চুম্বন করে। যতোবার করে, ততোবার হাহাকার উদ্বেল হয়, রোদন উচ্ছ্বসিত হয়, ক্ষোভ তীব্রতর হয়। এবং ঐ তীব্র, ক্ষুব্ধ এবং হাহাকারময় আবেগের মধ্যেই, অত্যন্ত গভীর তলদেশে, ছিলো ভিন্ন, অনির্বচনীয়, একটি আনন্দ স্রোতের প্রবাহ। যে প্রবাহটির পরিচয় দুজনের কেউই জানতো না। হঠাৎ প্রদীপটি নির্বাপিত হলে শিল্পী শ্যামাঙ্গের হাত দুখানি যেন শিল্প নির্মাণ আরম্ভ করে দেয়। আহা এইভাবেই না। সে লীলাবতী পুত্তলিটির সুগোল অথচ বঙ্কিম গ্রীবাটি গঠন করেছিলো, এইভাবেই না গঠিত হয়েছিলো স্তনযুগল, ক্রমে কটিদেশ, নিতম্ব, জঙ্দ্বয়। পুত্তলি নির্মাণকালের আনন্দ ঐ সময় শত গুণে তার সমগ্র অস্তিত্বকে আন্দোলিত করতে থাকে।

বাইরে উন্মথিত রাত্রি অতিবাহিত হয়। দক্ষিণে বামে দোল খায় মহাকাশের তারকামালা, অনাহত ডমরু ধ্বনির মত স্পন্দিত হয় জগতের প্রাণ স্পন্দন–আর সেই সঙ্গে লীলাবতী যেন তার অনিশ্চিত অস্তিত্বের মধ্যে একটি মূলের সন্ধান পেয়ে যায়। নিজেকে সে নিঃশেষে নিবেদন করে। তার মনে হয়, এরপরে যদি মৃত্যু হয়, তো হোক। জীবনের মর্মে কোথায় যেন সে নিজেকে প্রোথিত বোধ করে।

এক সময় দুজনেরই সম্বিত ফেরে। লীলাবতী শ্যামাঙ্গের কণ্ঠ বেষ্টন করে মৃদু স্বরে বলে, দস্যু কোথাকার, সমস্তই তো হরণ করলে–এবার?

শ্যামাঙ্গ জানায়–চলো, এ স্থান ত্যাগ করি। আর এখানে নয়।

রাত্রির মধ্য প্রহরে তারা পথে নামে এবং যাত্রা করে পুন্ড্রনগরীর উদ্দেশে। কিঞ্চিদধিক দুই দণ্ডকালের পথ। যখন নগরীতে উপনীত হয় তখন প্রত্যুষকাল। এক প্রাচীন নির্জন অট্টালিকার বহিরলিন্দে দুজনে অপেক্ষা করে সূর্যোদয়ের। সূর্যোদয় হলেই তারা কোনো পান্থশালা সন্ধান করে নেবে। এবং ঐ সময়ই প্রমত্ত মাদকসেবীদের একটি ক্ষুদ্র দল ঐ স্থানে উপনীত হয়। একাকী যুবতী ও গ্রাম্য পুরুষ দেখলে নগরবাসী তস্করেরা যা চিন্তা করে–এরাও সেই চিন্তা করলো। সামান্য কথায় বচসা হলো এবং সেইসূত্রে শ্যামাঙ্গকে আহত ও সংজ্ঞাহীন করে লীলাবতীকে স্কন্ধে তুলে নিয়ে তারা ধাবমান হলো। লীলাবতী তখন প্রাণপণ চিৎকার করে। ঐ সময়ই সে দেখে দীর্ঘ পরিচ্ছদধারী শ্মশ্রুমণ্ডিত–মুখ কয়েকজন লোক ছুটে আসছে। তাদের আসতে দেখে তস্করের দল লীলাবতীকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে পলায়ন করলো। লীলাবতী তখনও চিৎকার করছিলো। একজন নিকটে এসে জানালো, ভয় নেই ভগিনী–আর ভয় নেই, তুমি কে? কোথায় যাবে?

অতঃপর লীলাবতীর নতুন আশ্রয় হলো পুন্ড্রনগরীর যবন কেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রের লোকেরাই আহত, অচেতন, শ্যামাঙ্গকে সন্ধান করে নিয়ে আসে এবং চিকিৎসা ও শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *