০৮. দেবীকোট মেলায় যবন বৃদ্ধটি

দেবীকোট মেলায় যবন বৃদ্ধটিকে সমাধিস্থ করে বসন্তদাস যে স্বর্ণ ও মণিখণ্ডগুলি পায়, সেগুলি ক্রমে তার কাছে হয়ে ওঠে দুর্ভার। সে জানতে, ঐ সকল মণিমাণিক্য যদি বিক্রয় করতে হয়, তাহলে পুন্ড্রনগরীতে যেতে হবে। সেই চিন্তাক্রমে সে যাত্রাও করেছিলো পুন্ড্রনগরী অভিমুখে। সেই সঙ্গে আবার পথিমধ্যে ধনী বণিকের সন্ধানেও ছিলো তৎপর। তবে সমস্তই সাবধানে। নিজের কাছে যে মূল্যবান কিছু আছে, তা সে কখনই প্রকাশ হতে দেয়নি।

পথিমধ্যেই সাক্ষাৎ হয় এক বৃদ্ধ সুবর্ণবণিকের সঙ্গে। বণিকটি বৃদ্ধ এবং সজ্জন। তিনি বসন্তদাসকে নিজ গৃহে নিয়ে যান। সেখানে বসন্তদাস একটি হীরকখণ্ড বৃদ্ধকে দেখায়। জানতে চায়, এর প্রকৃত মূল্য কত হতে পারে, বলবেন?

বৃদ্ধ প্রথমত বিমূঢ় হয়ে যান। পরে হীরকখণ্ডটি হাতে নিয়ে মনোযোগসহকারে পরীক্ষা করে বলেন, মহাশয় যদি বিক্রয় করতে চান, তাহলে আমি দুইটি পর্যন্ত দীনার দিতে পারি।

ঐ কথা শুনে বসন্তদাস প্রমাদ গণনা করে। কী কাণ্ড দেখো, যেটি ক্ষুদ্রতম, তারই মূল্য দুই দীনার! এখন তার নিকট মণিমাণিক্য আছে, এই সংবাদটি প্রচারিত হলেই হয়েছে। আর দেখতে হবে না, দস্যুহস্তে মৃত্যু একেবারে অবধারিত। সে জানায়, মহাশয়, এই মণিটি আমি আপনার কাছে বিক্রয় করছি–কিন্তু এই ক্রয়–বিক্রয়ের কথাটি আপনাকে গোপন রাখতে হবে, আমি এইরূপ আরও কয়েকটি মণি আপনার কাছে বিক্রয়ের আশা রাখি।

বয়সে বৃদ্ধ হলেও বণিকটির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। মণিমাণিক্যাদি যেমন চেনেন, তেমনি চেনেন মানুষকেও। বসন্তদাসকে বললেন, মহাশয়, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনাকে আমি যে মূল্য দিয়েছি সেটি প্রচার করলে বিপদ কি শুধু আপনার? আমার নয়? আপনি নিশ্চিন্তে অন্য হীরকগুলি নিয়ে আসবেন–সমস্তই আমি ক্রয় করবো।

বসন্তদাসের একেকবার লোভ হচ্ছিলো হীরকগুলি বাহির করে। কিন্তু আবার ভয়ও হচ্ছিলো। সে নিজেকে সংযত রাখলো। এবং জানতে চাইলো, মহাশয়, যদি এমন হয় যে পুন্ড্রনগরীর বণিকেরা অধিক মূল্য দিতে চাইলো, তখন কি হবে?

বৃদ্ধ হাসলেন। বললেন, মহাশয়ের বোধ হয় সন্দেহ হচ্ছে যে কম মূল্য পেয়েছেন। কিন্তু বৃদ্ধের একটি কথা মনে রাখবেন, ভুলেও যেন মণিমাণিক্যাদি নিয়ে পুন্ড্রনগরীর বণিকদের কাছে যাবেন না। গেলে সর্বনাশ হবে, তারা দস্যু লুণ্ঠকদের পোষকতা করে। আপনি আমার কাছে না আসুন, অন্যত্র যান, কিন্তু কখনই ঐ পুন্ড্রনগরীর বণিকদের কাছে যাবেন না। প্রকৃত ধনী বণিকেরা কি এখন আর প্রকাশ্যে বণিকবৃত্তি করতে পারে? দেখছেন না, স্বর্ণ বণিকেরা কীভাবে রাজপুরুষদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। এখন প্রকৃত বণিক নেই–যারা আছে, তারা প্রতারক, নয়তো লুণ্ঠক।

বৃদ্ধের কথা যে অমূলক নয় তা বসন্তদাস অপেক্ষা অধিক আর কে জানে। সে কৌতূহলী হলো। বললো, আমি না হয় বণিকদের কাছে গেলাম না, কিন্তু আপনি ঐ মণিমাণিক্যাদি নিয়ে কি করবেন? নিশ্চয়ই আপনাকে বিক্রয় করতে হবে।

বৃদ্ধ ঐ কথা প্রসঙ্গেই সেদিন ফল্পগ্রামের সামন্তপতি শ্রীনাথবর্মণের সংবাদ জানান। দশ ক্রোশ উত্তর–পূর্বে গেলে ফল্পগ্রামে উপনীত হওয়া যাবে। ঐ ফরুগ্রামের সামন্তপতি শ্রীনাথবর্মণ বিলাসী, ব্যসনপ্রিয় এবং ধনী। মণিমাণিক্য সংগ্রহের উৎসাহ তাঁর প্রবল।

নামের সঙ্গে গ্রাম শব্দটি যুক্ত থাকলে কি হবে, ফল্পগ্রাম সমৃদ্ধ জনপদ। এই জনপদে ক্ষুদ্র একটি জয়স্কন্ধাবার বর্তমান। নিকটবর্তী সমৃদ্ধতর জনপদ বালিগ্রাম, সে স্থানের জয়স্কন্ধাবারটি বৃহত্তর। বসন্তদাস ফরুগ্রামে উপনীত হয়ে নিজের বণিক পরিচয়টিই প্রচারিত করে।

শ্রীনাথবর্মণের সম্মুখীন হয়ে বসন্তদাস প্রণাম জানিয়ে বলে, মহারাজ, আমি দূর দেশ থেকে এসেছি, আপনার খ্যাতি ও মহিমা বহুদূর বিস্তৃত–তদুপরি আপনার সৌন্দর্য বোধ ও সুরুচির পরিচয় লোকের মুখে মুখে প্রচারিত–আমি সেই কারণেই সামান্য কিছু সামগ্রী নিয়ে এসেছি–আপনি অনুগ্রহ করে গ্রহণ করলে আমি নিজের বণিকজীবন সার্থক মনে করবো।

শ্রীনাথবর্মণ প্রথমে বস্ত্র দুখানি দেখলেন। দেখে বললেন, তুমি দেখছি প্রকৃতই রুচিবান লোক হে, বস্ত্ৰ দুখানি তুমি আমাকে দিতে পারো।

গন্ধাসবের আধার দুটি শ্রীনাথবর্মণের হাতে দেওয়া হলে তিনি একেবারে উল্লসিত হয়ে উঠেন। বলেন, অহহ! কী সুগন্ধ! পারিজাত পুষ্পের সুগন্ধ কি এই প্রকার হয়? তুমি যে আমাকে অত্যাশ্চর্য বস্তু দেখালে হে!

অতঃপর একটি হীরকখণ্ড তার সম্মুখে রাখলো বসন্তদাস। হীরকখণ্ডটি অত্যধিক দ্যুতিময়। নিজ হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন সামন্তপতি। মনে হলো, চিন্তা করলেন কিছু। তারপর জানতে চাইলেন, আর কি আছে তোমার দেখি?

প্রভু যা দেখছেন, এই-ই আমার সম্বল, অধিক কোথায় পাবো–ক্ষুদ্র বণিক আমি এসব পণ্যের কিরূপ মূল্য তাতে আপনার অবিদিত নয়।

হুঁ, শ্রীনাথবর্মণ অর্ধশায়িত অবস্থা থেকে দেহটিকে সামান্য তুললেন। বললেন, বাকপটুতাতে দেখছি কম যাও না। কিন্তু ঐ বাকপটুতা অন্যত্র প্রদর্শন করো–এখন যা আছে, বাহির করো, আমি দেখবো।

বসন্তদাসের ইতস্তত ভাব দেখে শ্রীনাথবর্মণ দুজন প্রহরীকে ডাকলেন। আদেশ করলেন, দেখো তো এই দুর্বিনীত লোকটার কাছে আর কি কি আছে?

ঘোর বিপদ সম্মুখে। বসন্তদাস আর বাক্যব্যয় না করে কটিবন্ধের স্থলীটি উন্মোচিত করে সমুদয় দ্রব্যাদি ভূমিতে সামন্তপতির পদপ্রান্তে রাখলো।

শ্রীনাথবর্মণ কিছু বললেন না। প্রথমে হীরক খণ্ডগুলি হাতে তুলে নিলেন। তারপর এক দুই করে স্বর্ণখণ্ডগুলি গণনা শেষ হলে বললেন, নিলাম হে বণিক, সমস্তই নিলাম।

ঐ কথা বলে আসন থেকে উঠে তিনি অন্তঃপুরের দিকে পদক্ষেপণ করলেন। বসন্তদাসের মনে হলো, তার যথাসর্বস্ব চলে যাচ্ছে। সে কাতর কণ্ঠে বললো, প্রভু মূল্য কখন পাবো?

অ, মূল্য–না? শ্রীনাথবর্মণ ফিরলেন। পুনরায় আসনে উপবেশন করে বললেন, নাম কি?

আজ্ঞে বসন্ত।

বসন্ত কী?

বসন্তদাস।

উত্তম কথা, কুলবৃত্তি কী, সেটি বলছো না কেন?

আজ্ঞে আমরা ক্ষেত্রকর, আমার পিতা হেমন্তদাস আত্রেয়ী তীরে ক্ষেত্রকর্ম করেন।

উত্তম উত্তম–পিতৃনাম স্মরণে আছে তাহলে। তা ক্ষেত্রকররা কি ইদানীং বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেছে নাকি, আঁ? বৃত্তি সাংকর্য সৃষ্টি করে চলেছো, তোমার লজ্জা করে। না? পাপবোধ নেই, আঁ?

অদ্ভুত কথা! বসন্তদাস কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। শেষে সবিনয়ে বলে, প্রভু ক্ষমা করবেন, যদি অপরাধ হয়–কিন্তু প্রত্যেক বৃত্তিতেই তো এমন কিছু লোক থাকে যারা কুলবৃত্তি ত্যাগ করে অন্যবৃত্তি গ্রহণ করে।

মিথ্যা ভাষণ করো না বসন্তদাস। শ্রীনাথবর্মণ রোষ কষায়িত দৃষ্টি রাখেন বসন্তের মুখের উপর। বসন্তদাসের মনে ভয় ঈষৎ শিহরিত হয়।

শোন হে ক্ষেত্রকরের পুত্র, শ্রীনাথবর্মণ বলতে লাগলেন, তোমার অপরাধ সীমাহীন প্রথমত, তুমি মিথ্যা কথা বলেছো, অতঃপর এখন যা বলছো, তা যদি সত্য হয়, তাহলে তুমি ধর্মদ্রোহীও বটে। উপরন্তু আমার সন্দেহ, এ সমস্তই তোমার অপহৃত সম্পদ। নাহলে ক্ষেত্রকরের পুত্র হয়ে এতো মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী তুমি কোথায় পাবে? এমতাবস্থায়। এ দ্রব্যগুলি রাজকোষে গচ্ছিত থাকবে। তুমি যার কাছ থেকে এই মণিমাণিক্যাদি সংগ্রহ করেছে তাকে যদি আমার সম্মুখে আনতে পারো, তাহলেই এগুলির মূল্য পাবে, নচেৎ নয়। এখন তুমি যেতে পারো।

প্রভু, দয়া করুন, বলে বসন্তদাস কাকুবাদ করতে আরম্ভ করে। কিন্তু ফল হয় না তাতে। প্রাসাদের প্রহরীরা তাকে তুলে এনে প্রাসাদদ্বারের বাহিরে রেখে যায়। যাবার সময় এক প্রৌঢ় প্রহরী বলে যায়, বৎস তুমি নির্বোধ। ঐভাবে সমুদয় পণ্য নিয়ে কেউ যায় সামন্তপতির কাছে? যা হয়েছে, হয়েছে–এবার গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যাও। এ স্থানে গোলযোগ করলে হয়তো তোমাকে শূলেও দিতে পারেন, সামন্তপতি ভয়ানক ক্রোধী পুরুষ। তিনি যে তোমাকে বন্দী না করে প্রাসাদের বাহিরে পাঠিয়েছেন এ তোমার চতুর্দশ পুরুষের সৌভাগ্য মনে করবে।

বসন্তদাস হতবাক, এ কি হলো! মুহূর্তের মধ্যে তার সর্বস্ব অপহৃত হয়ে গেলো? তার কিছুই করণীয় নেই? সে বিভ্রান্ত হয়ে পথে পথে ভ্রমণ করতে লাগলো।

শেষে এক বিপণীকার পরামর্শ দিলো, মহাশয়, এভাবে শক্তিক্ষয় করে কোনো ফল হবে না–আপনি বরং মহাসামন্ত শক্তিবর্মণের কাছে যান–তিনি অত্যন্ত প্রতাপশালী, যদি তার দয়া হয়, তাহলে আপনার পণ্যের আংশিক মূল্য পেয়েও যেতে পারেন।

আবার এও জানালো লোকটি–তবে দেখবেন, যেন কোনো কারণে রুষ্ট না হন। তিনি, হলে কিন্তু বিপদ।

ফল্গুগ্রাম থেকে বালিগ্রামের দূরত্ব অধিক নয়–দুই প্রহরের পথ। বালিগ্রাম সমৃদ্ধতর জনপদ–এ স্থানের জয়স্কন্ধাবারটি বৃহত্তর। এটি নির্মিত হয়েছিলো বৈরী সমতট এবং কামরূপের উপর গৌড়াধিপের দৃষ্টি রাখার জন্য। এখন বৈরী কেউ–ই নয়, সুতরাং সেনাবাহিনীর তৎপরতাও সেরূপ নয়। তারা নগরে ভ্রমণ করে এবং আনন্দর্তিতে কালযাপন করে। পথিপার্শ্বের বিপণীগুলিতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত ক্রয়–বিক্রয় চলে। ভগবান বিষ্ণুর বিরাটাকার মন্দিরটিতে লোকজনের গমনাগমনের বিরতি নেই। শৌণ্ডিকালয়গুলিতে মাদকপায়ীদের সোল্লাস চিৎকার প্রায় সর্বক্ষণই শোনা যায়। অর্থাৎ জনপদটি যথার্থই সজীব এবং প্রাণময়।

বসন্তদাস মহাসামন্ত শক্তিবর্মণের প্রাসাদে প্রবেশের কোনো ব্যবস্থাই করতে পারে। না। প্রতিদিন প্রাসাদদ্বারে যায়, প্রহরীদের অনুনয় বিনয় করে এবং ব্যর্থ হয়। প্রতিদিনই এই ঘটনাক্রমে দ্বাররক্ষীরা বিরক্ত হয়ে উঠলো। একদা এক প্রৌঢ় রক্ষী কাছে ডেকে নিয়ে বললো, বৎস, তুমি অহেতুক নিজের বিপদ সৃষ্টি করছো, মহাসামন্তের গূঢ়পুরুষেরা তোমার আচরণে সন্দেহান্বিত হয়ে উঠেছে। আমি বলি কি, তুমি মঙ্গলমতে বিদায় হও, যদি একবার তাদের হাতে বন্দী হও, তাহলে কিন্তু তারা পিতৃনাম বিস্মরণ করিয়ে তবে ছাড়বে।

কিন্তু বসন্তদাসের সংকল্প টলে না। বলে, মহাশয়, তবে কি সুবিচার পাবো না? এদেশে আমাকে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে যেতে হবে?

লোকটি বিরক্ত হয়ে চলে যায়। বলে, তোমার মঙ্গলের জন্যই সৎ পরামর্শ দিলাম, এখন তোমার অভিরুচি–যা উত্তম বিবেচনা মনে হয়, তাই করো।

সে রাত্রিযাপন করতো একটি প্রাচীন মন্দিরের অতিথিশালায়। মন্দিরটি পরিত্যক্ত প্রায়। অবলোকিতেশ্বরের বিগ্রহটি অবশ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল কিন্তু বিগ্রহের পূজা হতো কি না। বলা কঠিন। কয়েকজন ভিক্ষু ও শ্রমণকে কখনও কখনও দেখা যেতো, কিন্তু তাদের যে। কী কাজ, তা কিছুই বুঝবার উপায় ছিল না।

পান্থশালাটির অবস্থা আরও শোচনীয়। অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে মনে হতো যেন বা গুহায় প্রবেশ করেছি। দ্বিপ্রহরেও সেখানে রাত্রির মতো অন্ধকার এবং সেই সঙ্গে বহুকালের প্রাচীন একটি শীতল ভাব। একাকী সেখানে দিবসকালেও অবস্থান করা যেতো না। অধিকক্ষণ অবস্থান করলে মনে হতো, যেন প্রাচীরের কঠিন শীতলতা সজীব প্রাণটিকে পিষ্ট করতে আসছে। তাই সে রাত্রিকালে নিদ্রার সময়টুকু ব্যতীত প্রায় সর্বক্ষণই। বাহিরে অতিবাহিত করতো।

তবে শয়নকালে প্রতিদিনই অনুভব করতো, কক্ষে সে একাকী নয়, আরও দুএকজন উপস্থিত আছে। তারা কে, কখন আসে, কখন যায়–কিছুই তার পক্ষে জানা সম্ভব হয় না।

একদা রাত্রে, প্রথম যামই হবে তখন, হঠাৎ তার নিদ্রা ভঙ্গ হলো। অনুভব করলো কে একজন তার কটিবন্ধটি মোচন করতে চাইছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না, তবে অনুমান করলো, পান্থশালাটি গ্রন্থিছেদকদেরও নিদ্রার স্থান। অন্য সময় হলে কি করতো বলা কঠিন। কিন্তু তখন তার অবস্থা মরিয়া। সামান্য কিছু অর্থ আছে সঙ্গে। ঐ অর্থটুকু চলে গেলে তাকে প্রকৃত অর্থেই পথে বসতে হবে। সে বিলম্ব করলো না, ক্ষিপ্রগতিতে লোকটিকে ধরাশায়ী করে তার বক্ষে দেহভার এবং গলদেশে দুহাত রেখে জানতে চাইলো, কে তুই বল–কেন তুই আমার কটিদেশে হাত দিয়েছিস? শীঘ্র বল, নতুবা এই তোর শেষ!

লোকটির কণ্ঠ থেকে বিচিত্র স্বর নির্গত হচ্ছিলো। বললো, আমাকে ছেড়ে দিন মহাশয়, এমন কাজ আর কখনও করবো না, অপরাধ মার্জনা করুন। আমি বড় ক্ষুধার্ত, ক্ষুধা নিবৃত্তির আশায় আমি এই দুষ্কার্যে প্রবৃত্ত হয়েছি–আপনি আমার প্রভু। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে–দয়া করুন।

লোকটির সমস্ত কথাই মিথ্যা। সে ক্ষুধাকাতর নিশ্চয়ই নয়–ক্ষুধাকাতর মানুষ অমন শক্তিমান হয় না–আর তখন হাত দুটি গলদেশে রাখা ছিলো মাত্র, তাতে শ্বাস রুদ্ধ হবার কথা নয়। একেকবার ইচ্ছা হচ্ছিলো, দুহাতের মুষ্টিতে গলাটি পিষ্ট করে। কিন্তু পরিণামের কথা চিন্তা করে বিরত হলো। সে চায় না, তাকে নিয়ে কোনো গোলযোগ সৃষ্টি হোক আর তাতে কোনো রাজপুরুষের দৃষ্টি তার উপর পতিত হোক। লোকটি নানান কথা বলে যাচ্ছিলো। তার কথায় জানা গেলো, ঐ স্থানে আরও দুজন গ্রন্থিছেদক রাত্রিযাপন করে। আজ তাদের উত্তম উপার্জন হয়েছে বলে শৌণ্ডিকালয়ে স্ফুর্তিতে মত্ত। শুধু তারই মন্দভাগ্য, নতুবা এমন হয়? বিদেশী পথিক যে এরূপ সাহসী আর শক্তিমান হবে, তা জানলে, কোন শ্যালক এই কাজ করতে আসে। সে মিনতি করে বললো, মহাশয়, আমি আপনাকে পিতা ডাকছি, আপনি আমাকে চলে যেতে দিন–আমি আর কদাপি এমন কাজ করবো না।

বসন্তদাসের মনে হলো, লোকটি সরল এবং কিঞ্চিৎ রসিকও। সে তার বক্ষ থেকে নেমে বসলো। লোকটি পারতো, কিন্তু তৎক্ষণাৎ পলায়ন করলো না। বললো, আমার চতুর্দশ পুরুষের সৌভাগ্য যে আপনার মত দয়ালু লোকের হাতে পড়েছিলাম, মহাশয় যে এমন মার্জার–চক্ষু, রাত্রিকালেও দেখতে পাবেন, আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

গৃহস্থ নয়, পথিক নয়–ভিক্ষু কিংবা যোগীও নয়, এই দূর দেশে যে লোকটির সঙ্গে তার আলাপ হচ্ছে সে একজন গ্রন্থিছেদক। উত্তম বসন্তদাস–নতুন স্থানে এসে অত্যন্ত উত্তম ব্যক্তির সঙ্গে হৃদ্যতা হচ্ছে তোমার। এই না হলে কপাল? সে ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে লাগলো।

গ্রন্থিছেদকের কাছে অনেক সংবাদ। যেমন, এই স্থানের লোকেরা বহিরাগতদের সম্পর্কে অতিমাত্রায় সাবধান। গূঢ়পুরুষ প্রায় সর্বত্রই আছে। বিশেষত যেদিন মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ প্রাসাদের বাহিরে আসেন, সেদিন প্রায় সকলেই তটস্থ থাকে। বহিরাগত ভিক্ষু যোগী ইত্যাদি দেখলেই নগরবাসী সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কেনো ভিক্ষু এবং যোগীরাই নানান অনর্থের মূল। কোথায় যে কোন নিরীহ গৃহস্থকে বিপদাপন্ন করবে তার স্থিরতা নেই।

ভিক্ষু যদি এতোই পরিত্যাজ্য হয়, তাহলে এই মন্দির তো থাকবার কথা নয়– বসন্তদাস মন্তব্য করে।

প্রশ্ন শুনে গ্রন্থিছেদক হাসে। বলে, না মহাশয়, আপনার ধারণা ভুল–এই মন্দির থাকবারই কথা। যদি মন্দিরটি না থাকতো, তাহলে মহাসামন্ত একটি বৌদ্ধ মন্দির এখানে নির্মাণ করতেন। এও তার একটি কৌশল। এই মন্দিরটি আছে বলেই সদ্ধর্মীদের উপর সহজে দৃষ্টি রাখতে পারেন। এই তো দিন কয় পূর্বের কথা। চারিদিকে হৈ হৈ রব। প্রহরীর দল পথে পথে ধাবমান। কি ব্যাপার? না একজন ভিক্ষুকে পাওয়া যাচ্ছে না। গূঢ়পুরুষদের কাছে সংবাদ ছিলো, এক ষড়যন্ত্রী ভিক্ষু নাকি নগরে প্রবেশ করেছে–তার কাছে নাকি রয়েছে একখানি গোপন পত্র। নগরের সমস্ত ভিক্ষু ও যোগীদের বন্দী করা হলো, কিন্তু দেখা গেলো, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি নেই। সে এক বিষম কাণ্ড, নগরবাসীর গৃহে গৃহে চললো অনুসন্ধান। এবং দেখা গেলো, শেষ পর্যন্ত সমস্তই নিষ্ফল।

বসন্তদাস যা শুনছিলো তা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি আবার আতঙ্কজনকও। বহিরাগত ব্যক্তি হওয়াতে তার শঙ্কিত হওয়ার কথা কিন্তু সে অধিকতর কৌতূহল বোধ। করছিলো। জানতে চাইলো, এই ভিক্ষুরা কী চায় বলতে পারো?

মহাশয়, ও বিষয়ে আমি একেবারেই অজ্ঞ, লোকটি জানায়। অতঃপর বলতে থাকে, তবে জনরব শুনেছি, তারা নাকি দ্রোহ উত্থাপন করতে চায়। ক্ষেত্রকর এবং অন্ত্যজদের সঙ্গে তাদের সবিশেষ মিত্রতা। অবশ্য আমার ধারণা তারা নির্বোধ, পিপীলিকার পক্ষ উদ্গয়ের মতো ব্যাপার আর কি! না হলে শস্ত্রধারী সুশিক্ষিত কুশলী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ডোম আর ক্ষেত্রকরেরা যুদ্ধ করতে পারবে, এই ধারণা কারও হয়?

সে ঐ কথার পর উঠলো। বললো, মহাশয়, আমি যাই, কিছু উপার্জনের সন্ধান করি–উদরে ক্ষুধা থাকলে নিদ্রা দেবী নিকটে আসতে চান না।

বসন্তদাস লোকটিকে দুই কুড়ি কড়ি দান করলে সে অভিভূত হয়ে পাদস্পর্শ করে প্রণাম করলো। তারপর বললো, মহাশয়, একটা কথা বলি আপনাকে–এ অধমকে অর্থ দান করলেন, এ বড় উত্তম কথা–কিন্তু সাবধান, এরূপ দয়া সর্বত্র প্রদর্শন করবেন না, বিপদ হবে।

কেন, বিপদ হবে কেন? বসন্তদাসকে অবাক হতে হয়।

বিপদ অন্য কিছুতে নয়, লোকটি জানায়, কোট্টপালের অনুচরেরা এ নগরীতে স্নানক তৎপর। ধনী পথিকের সর্বস্ব আত্মসাৎ করার কৌশল তাদের মতো আর কেউ জানে

–সুতরাং সাবধান।

গ্রন্থিছেদক দুই পদ অগ্রসর হয়েও ফিরে এলো। বললো, আর একটি কথা–আপনার মঙ্গলের জন্য বলি, যা শুনলেন সে বিষয়ে কোনোরূপ কৌতূহল প্রকাশ করবেন না। করলে সে আর এক বিপদ।

তুমি কি আবার এ স্থানে আসবে?

না মহাশয়, আজ মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ সপারিষদ প্রাসাদের বাহিরে এসেছেন– রাত্রিকালে বিষ্ণুমন্দিরে পূজা, ওদিকে আবার শৌণ্ডিকালয়ের দ্বার সমস্ত রাত্রি মুক্ত থাকবে সুতরাং বুঝতেই পারছেন

গ্রন্থিছেদক চলে গেলে বসন্তদাস পুনরায় শয়ন করলো। আশা, এবার নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবে। কিন্তু নিদ্রা আর আসে না–কেবলই ঘুরে ঘুরে গ্রন্থিছেদকের কথা স্মরণ হয়। কেবলই মনে প্রশ্ন জাগে, মহারাজ শক্তিবর্মণ কি তাহলে শঙ্কিত হয়ে রয়েছেন? বৃহৎ। কোনো যুদ্ধবিগ্রহ কি আসন্ন হয়ে উঠেছে?

সে পূর্বে কখনও এ সকল বিষয় নিয়ে চিন্তা করেনি। দেবীকোট মেলায় তিব্বতী ভিক্ষু দলটি এবং তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারী রাজসেনাদের দেখে তার মনে চিন্তার উদয় হয়েছিলো প্রথম–কিন্তু ঐ চিন্তা নিতান্তই কৌতূহলাচ্ছন্ন। যবন বৃদ্ধটিও আলাপ প্রসঙ্গে দেশ–বিদেশের অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন–কিন্তু তখনও তার কাছে ব্যাপারটি নিজের জীবন–সংলগ্ন বলে মনে হয়নি। এখন হচ্ছে–বারংবার মনে হচ্ছে, কি কুক্ষণেই না তার আলাপ হয়েছিলো যবন বৃদ্ধটির সঙ্গে। যদি না হতো, তাহলে আজ তার এই অবস্থা হয়? না জানি এরপরও কোনো দুর্দশা তার ভাগ্যে আছে। ঐ রত্নগুলির সদগতি করতে এসেই না তার এখন এমন দুর্দশা।

তৃষ্ণা বোধ হওয়ায় সে উঠলো। বাহিরেই কূপ, সে কূপস্থলের দিকে চললো।

হঠাৎ নারী কণ্ঠের আলাপ তার শ্রবণে আসে। দুটি নারী–স্বর ঐ কূপস্থলের দিক থেকেই আসছে–সে দূর থেকেই নারীমূর্তি দুটিকে দেখতে পায়। তার অবাক লাগে, এখন রাত্রিকাল, এই সময়ে মন্দিরকূপে নারীর আগমন কেন? এই ক্ষুদ্র নগরীর নারীরা কি এতোই অসূর্যম্পশ্যা যে গভীর রাত্রি ব্যতিরেকে জলাহরণ করতে পারে না? সম্মুখে দৃষ্টিপাত করতেই সে পুনরপি দেখতে পায়, অদূরে মন্দিরদ্বার উন্মুক্ত এবং সেই দ্বারপথে একজন রমণী নিষ্ক্রান্ত হয়ে আসছে। সে নিজেকে বৃক্ষতলে অন্তরাল করে।

অর্ধাঙ্গ চন্দ্রটি তখন মন্দিরশীর্ষে আরোহণ করেছে। তার আলোকে কূপস্থলের সমস্তটাই দৃশ্যগোচর। দেখা গেলো, পুরুষটি মন্দিরেরই একজন ভিক্ষু। রমণীরা কে, সে অনুমান করতে পারে না। তবে দেখলো, তিন রমণীই যুবতী এবং রূপসী।

ভিক্ষুটি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বললেন, কি সংবাদ বিভাবতী, তুমি নাকি ভয় পেয়েছো?

ভয়, বিভাবতী সম্ভবত মৃদু হাস্য করে। বলে, বিভাবতী যদি ভয় পায়, তাহলে অনাথ মিত্রানন্দের কি দশা হবে প্রভু?

না, অর্হৎ, বিভাবতীর এক সঙ্গিনী জানায়, সে ভয় পাওয়ার পাত্রী নয়, তবে শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন–আমরা মিত্রানন্দকে আর রাখতে পারছি না, প্রতিদিনই বিপদাশঙ্কা দেখা যাচ্ছে, মহাসামন্তের চরেরা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে।

এই রমণীরা কারা? আর এই ভিক্ষুটিই বা কে? বসন্তদাস কিছুই অনুমান করতে পারে না। শুধু এটুকু বুঝলো যে কিছু একটা অতীব গোপন ব্যাপারের সঙ্গে এরা যুক্ত।

একেকবার মনে হচ্ছিলো, এসব ষড়যন্ত্রমূলক ব্যাপার–এসব তার শোনা উচিত নয়–এই মুহূর্তেই তার এ স্থান ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু ঐ সঙ্গেই আবার এও মনে হচ্ছিলো, আহা রমণী এতো সুন্দর হয়! এমন তো পূর্বে কখনও দেখিনি। ঐ মুহূর্তে রমণী–কণ্ঠের মাদকতা তার কর্ণে মধুবর্ষণ করছিলো। চন্দ্রালোকেও রমণীদের দেহরেখা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। সূক্ষ্ম চীনাংশুকে ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত হলেও সুগোল স্কন্ধ, বঙ্কিম গ্রীবা, পীবরোন্নত বক্ষ, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব, নিতম্ববেষ্টিত রত্নখচিত মেখলায় বিম্বিত চন্দ্রালোক–সমস্তই সে দেখতে পাচ্ছিলো। তার মনে হচ্ছিলো, এরা কি রাজপ্রাসাদের কন্যা ও বধূ? নাকি স্বয়ং রাণী আর তার দুই সহচরী? সে কিঞ্চিৎ আবিষ্টও হয়ে পড়েছিলো। একইসঙ্গে ভীতি ও কৌতূহল, রহস্য ও সৌন্দর্য, চন্দ্রালোকের মায়া এবং মধ্যরাত্রির নির্জনতা–সমস্ত একত্রে মিলিত হয়ে বিচিত্র একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিলো তার মনে। স্থানকালের চেতনা প্রায় লুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছিলো ঐ সময়।

ফলে যা ঘটবার তা–ই ঘটলো। কখন যে সে বৃক্ষতলের অন্ধকার থেকে বাহিরের চন্দ্রালোকে এসে দাঁড়িয়েছে নিজেই জানে না। হঠাৎ সে একইসঙ্গে তিনটি কণ্ঠের অনুচ্চ চিৎকার শুনলো, কে, কে ওখানে?

ভিক্ষুটি ছুটে এলেন, পশ্চাৎ পশ্চাৎ এলো তিন যুবতী।

কে তুমি?

আমি পথিক, এই পান্থশালায় রাত্রিযাপন করি।

এই স্থানে কেন? মধ্যরাত্রে এই স্থানে কি করছিলে তুমি?

ভিক্ষুটির উত্তেজিত অবস্থা দেখে বসন্তদাস সবিনয়ে জানায়, অর্হৎ, আপনি উত্তেজিত হবেন না, আমি জলপানের নিমিত্তে এই স্থানে

চুপ করো, কোনো কথা নয়।

ভিক্ষু বসন্তদাসকে কোনো কথা বলতে দিলেন না। ইঙ্গিতে মন্দিরদ্বারের দিকে নির্দেশ করে বললেন, চলো।

মন্দিরের ভিতরে অন্ধকার। সেই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে অগ্রসর হওয়ার সময় এক তরুণী বসন্তদাসের সঙ্গে স্পৃষ্ট হয়–ক্ষণিকের স্পর্শমাত্র, কিন্তু তাতেই তটিনীকূলে মৃদু তরঙ্গাঘাতের শব্দের মতো অস্পষ্ট হাসি ছলকিত হলো। পশ্চাতে আবার মৃদু শাসনও শোনা গেলো। এক রমণী বললো, ওলো কৃষ্ণা, এতো হাসি কেন? হাসলে কাঁদতে হয় জানিস তো?

হ্যাঁ জানি, সময় হোক, কাঁদবো।

স্থান–কাল কিছুরই বিবেচনা নেই, কেবল কৌতুক। গুহাপথের মতোই পথ, অন্ধকারে নিজের হাত পর্যন্ত গোচরে আসে না। কিন্তু তথাপি কৌতুকের যেন শেষ নেই।

অবশেষে আলোর সন্ধান পাওয়া গেলো। ভিক্ষু যে প্রকোষ্ঠটিতে সবাইকে নিয়ে গেলেন, সেটি সম্ভবত তাঁর নিজেরই বসবাসের স্থান। এক পার্শ্বে শয়নবেদী, প্রাচীর গাত্রে দীপস্থান, সেখানে প্রদীপ জ্বলছিলো ঐ প্রদীপের আলোকে পরস্পরকে স্পষ্টভাবে দেখার সুযোগ হলো। বসন্তদাসের মুখপানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে ভিক্ষু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সত্যই পথিক?

আজ্ঞে হ্যাঁ অর্হৎ, এখন আমি পথিক ব্যতীত অন্যকিছু নই, আত্রেয়ী তীরে আমার নিবাস, পিতা হেমন্তদাস, ক্ষেত্রকর্ম করেন।

তা এ স্থানে আগমনের কারণটি বলো।

বসন্তদাস তখন তার প্রতি শ্রীনাথবর্মণের আচরণের কাহিনীটি বর্ণনা করে। বর্ণনা সমাপ্ত হলে জানতে চায়, বলুন আপনারা, আমি কি ন্যায় বিচার আশা করতে পারি না?

তার কথা শুনে ভিক্ষুটি হাসেন। বলেন, বৎস, ন্যায় কাকে বলে সেটি জানা থাকলে তবে না বিচার হবে?

ক্ষণেক পরে বলেন, যাক সে কথা, এখন বলল, এই নগরীতে তোমাকে কে জানে?

আজ্ঞে না, এ নগরীতে কেউ আমাকে জানে না।

তুমি যে গোপন চর নও, তার নিশ্চয়তা কি?

আজ্ঞে নিশ্চয়তা আমি এবং আমার কথা, এই মাত্র বলতে পারি–আর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তুমি আমাদের কথা শুনেছো?

বসন্তদাস মুহূর্তে ইতস্তত করে, সত্য কথা বলবে কিনা। তারপর সহজ স্বরে বলে ওঠে, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি শুনেছি।

কিছু বুঝতে পেরেছেন? এবার রমণীদের একজন জানতে আগ্রহী হয়।

বসন্তদাস পূর্ণদৃষ্টিতে রমণীটির মুখপানে চেয়ে দেখে। অত্যন্ত পরিপূর্ণ যুবতী এই রমণী, আর দেহকান্তি যে কি অপরূপ, তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। রমণীটির মুখপানে দৃষ্টি রেখে সে অকপটে স্বীকার করে, আজ্ঞে হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি যে মিত্রানন্দ নামক কোনো এক ব্যক্তিকে আপনারা লুক্কায়িত রেখেছেন, কিন্তু এখন আর রাখতে পারছেন না–মহাসামন্তের চরেরা আপনাদের সন্দেহ করছে।

অকপট ঐ স্বীকৃতির পর কেউ–ই কথা বলে না, কিছুক্ষণ। শেষে তিন রমণীর মধ্যে যে সুন্দরীতমা, সে বললো, শুনুন, আপনাকে আমি মহাসামন্ত শক্তিবর্মণের কাছে নিয়ে যাবো–আপনার পণ্যসামগ্রী উদ্ধার হবে কিনা বলতে পারি না, আপনি যাবেন?

বসন্তদাস সাগ্রহে সম্মত হয়, অবশ্যই যাবো।

তাহলে একটি শর্ত আছে।

বলুন কি শর্ত? বসন্ত এবার রমণীটির মুখের উপর তার পূর্ণ দৃষ্টি রাখে।

আপনি আমাদের অতিথি হবেন কয়েকদিনের জন্য–গোপন কিছু নয়, আপনি নিজ পরিচয়েই আমাদের সঙ্গে অবস্থান করবেন, তবে আমাদের এই মন্দিরে আগমন, মিত্রানন্দ প্রসঙ্গ, অথবা যা শুনেছেন–কিছুই অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারবেন না। আপনার প্রিয়তমা রমণীর কাছেও নয়–মনে করবেন, আজ রাত্রের ঘটনাটি আদৌ ঘটেনি–পারবেন?

বসন্তদাস এবার অন্য দুই রমণীর দিকে দৃষ্টিপাত করে। কৃষ্ণা সম্ভবত শ্যামাঙ্গীর নাম, আর সুন্দরীতমা রমণীটি বোধ হয় বিভাবতী। সে লক্ষ্য করে দেখে, প্রত্যেকের মুখ গম্ভীর। বুঝতে পারে, গম্ভীর হলে রমণী মুখ সত্যিই মলিন হয়। ক্ষণকাল পূর্বেও সকলের মুখে কৌতুকোজ্জ্বল ভাব লক্ষ্য করা গেছে। সে ভিক্ষুর মুখে দৃষ্টিপাত করে বলে, অর্হৎ, আপনি জ্ঞানী ব্যক্তি এবং সাধু–আমার অবস্থাটি নিশ্চয়ই আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন। দেখুন, আমি এদেশের বিষয়ে কিছুই জানতাম না–আজ রাত্রেই এই পান্থশালায় এক গ্রন্থিছেদকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে–তার মুখেই শুনলাম যে এদেশে বৌদ্ধ সদ্ধর্মীরা রাজরোষে পতিত হয়েছে, তারা নাকি এদেশে দ্রোহ উত্থাপন করতে চায়। এখন দেখছি, তার কথা অমূলক নয়। এমতাবস্থায় আমি কোনো প্রকার বিপদে পতিত হতে চাই না–যদি আমার পণ্যাদি উদ্ধারের আদৌ কোনো আশা না থাকে, তাহলে অহেতুক এ স্থানে আমি কেন থাকবো? রাত্রি প্রভাত হলেই আমি চলে যাবো–আমাকে আপনারা অনুমতি দিন।

শুক্লা, এ পথিক দেখছি বড়ই চতুর–বিভাবতীর চটুল মন্তব্য বসন্তের শ্রবণে আসে।

হ্যাঁ, আমারও মনে হয়, একেবারে গভীর জলের মৎস্য, শুল্কা তৎক্ষণাৎ নিজ মত ব্যক্ত করে।

মন্তব্য দুটি শুনে বসন্তদাস হাসে। বলতে পারতো যে অবস্থাগুণে সকলেই চতুর হয়। কিন্তু কিছুই না বলে সে পুনরায় অনুমতি চায়, অর্হৎ, আদেশ করুন, আমি এবার যাই।

ওলো কৃষ্ণা, পথিককে তুই আমন্ত্রণ কর না, ও যে চলে যায়। সুন্দরীতমা বিভাবতীর কৌতুকস্বর এবার মাদকতাময়।

বসন্তদাস হাস্যাননা বিভাবতীর মুখপানে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে। দুকূল উত্তরীয় ঈষৎ বিস্রস্ত, কণ্ঠের মুক্তামালা উন্নত বক্ষশয্যায় একবার উঠছে একবার নামছে। মুখে সে কিছুই বলে না। ভিক্ষুককে প্রণাম করে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়।

কিন্তু অন্ধকার অলিন্দে এসে উপনীত হতে না হতেই ডাক শুনতে পায়, পথিক কি নিদ্রার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন?

না, শেষ পর্যন্ত আর পারেনি, বসন্তদাসের এখনও স্পষ্ট স্মরণ হয়। বিভাবতী নয়, শুল্কা নয়, কৃষ্ণাই এসে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিলো সেদিন। বলেছিলো, আপনাকে আমাদের বিশ্বাস নেই, তাই চক্ষুরান্তরাল করবো না–আপনি আমাদের হাতে বন্দী।

কী ভেবেছিলো তারা, বসন্তদাস জানতে পারেনি, তবে তার অনুমান, কৃষ্ণার কথা একেবারেই কৌতুকের ছিলো না। সম্ভবত তাদের আশঙ্কা ছিলো যে সে রাজপ্রহরীদের। হাতে বন্দী হলে সমস্ত কথা প্রকাশ করে দেবে। সে জন্যেই তাদের চেষ্টা, যাতে সে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকে এবং তুষ্ট থাকে।

বসন্তদাসের ততক্ষণে প্রত্যেকের পরিচয় জানা হয়ে গেছে। তিনজনই বিষ্ণু মন্দিরের। দাসী এবং তিনজনই নর্তকী। রাত্রির তখন মাত্রই মধ্য যাম। শুক্লা, কৃষ্ণা উভয়েই চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। একজন বিভাবতাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলো, ওদিকে বিলম্ব হয়ে না যায়, চলো, শীঘ্র যাই।

মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি কানে আসছিলো না, হয়তো ওদিকে ততক্ষণে পূজা সমাপ্ত হয়েছে।

কৃষ্ণা নিকটে এসে বললো, চলো হে ক্ষেত্রকর, এবার বন্দীশালায় চলল।

আম্রকাননের মধ্য দিয়ে পথ, সম্ভবত এই পথেই তারা গমনগমন করে। ভিক্ষু ব্ৰজানন্দ তাদের সঙ্গে এলেন কানন পর্যন্ত। বিদায়কালে বললেন, মিত্রানন্দকে আজ রাত্রেই নগর ত্যাগ করতে বলবে–আজই সুযোগ।

পথিমধ্যে তিন সখীর পরামর্শ হয়। সিদ্ধান্ত হয় কৃষ্ণা বসন্তদাসকে নিয়ে গৃহে যাবে এবং বিভাবতী শুক্লাকে নিয়ে যাবে প্রথমে মন্দিরে, তারপর গৃহে। গৃহে ফিরতেই হবে কারণ পূজা শেষে মহাসামন্ত বিভার গৃহে যাবেন।

কাজটি বিপজ্জনক, কিন্তু ঐভাবেই তারা ভিক্ষু ব্ৰজানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। যেদিনই রাত্রে মন্দিরে পূজার বৃহৎ আয়োজন হয়, সেদিনই তারা পূজার আয়োজন সমাপ্ত করে অন্য দুই সেবক ও দাসীকে মন্দিরে রেখে দর্শনার্থী নারীপুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়। ঐভাবেই তারা মন্দিরের বাহিরে যায় এবং কাননের মধ্য দিয়ে রাত্রির অন্ধকারে অবলোকিতশ্বরের মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হয়। বোঝা যায়, তাদের এইভাবে গমনাগমনের ব্যাপারটি লোকচক্ষুর অগোচরেই ঘটে চলেছে। বসন্তদাস অনুমান করে মাত্র, প্রত্যক্ষ কিছুই সে দেখে না। তার অনুমান, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ভয়ানক কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত এই মন্দিরদাসীরাও। তার অবাক লাগে। মন্দিরদাসীদের আচরণ এমন কেন? দেশে যদি সত্য সত্যই দ্রোহ উত্থিত হয়, তাহলে এদের তো লাভালাভ কিছু নেই, তাহলে এরা কেন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত? বিভাবতী, কৃষ্ণা ও শুক্লার আচরণ সে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে না।

মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ বিভাবতীর গৃহদ্বারে উপনীত হয়ে অন্যান্য সহচরদের বিদায় দিলেন। সঙ্গে রাখলেন দুই বয়স্যকে। মন্দির থেকে এলেও তাঁর পদক্ষেপ স্থির নয়। থেকে থেকেই স্খলিত কণ্ঠে চিৎকার করছিলেন।

বিভা প্রস্তুত হয়েই ছিলো, সে রাজপুরুষদের সমাদরে কোনো ত্রুটি রাখে না। শক্তিবর্মণ বিভাবতাঁকে দেখে বললেন, সখী বিভু, তোমাকে যে মন্দিরে দেখলাম না?

মহারাজ সম্ভবত লক্ষ্য করেননি, আমার বেশ তখন অন্যরূপ ছিলো।

ও, তাই হবে তাহলে–ওহে তোমরা দেখেছিলে?

বয়স্য দুজন ইতস্তত করে বার দুই। তাদের বোধগম্য হচ্ছিলো না কোন উত্তরটি প্রভুর অভিপ্রেত। একজন বললো, না মহারাজ, দেখিনি–অন্যজন বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, দেখেছি।

দুজনের দুই প্রকার উক্তিতে হা হা অট্টরবে হেসে উঠলেন শক্তিবর্মণ। বললেন, ওহে, দেখছি তোমাদের দুজনেরই বিভ্রম, কিন্তু বিভ্রম কিসে? দৃষ্টিতে না জিহ্বায়?

দাসী পুষ্পমালা রেখে গিয়েছিলো। শক্তিবর্মণ মালাগুলি দেখলেন হাতে নিয়ে। একখানি মালা এক বয়স্যের গলায় দিয়ে বললেন, নাও হে মর্কট, এটিকেই মুক্তামালা জ্ঞান করো।

অল্পক্ষণ পরই সঙ্গীত আরম্ভ হয়। শুক্লার গীতটিতে ছিলো বিষাদময় ভাব–একটি শুকপক্ষীর পিঞ্জর ত্যাগ করে পলায়নের কারণে নায়িকার যে বেদনা ও বিরহ, তাই সে বার বার গেয়ে প্রকাশ করছিলো। শক্তিবর্মণ বিরক্তি বোধ করেন। গীতের মধ্যস্থানেই বলে উঠলেন, রমণীর রোদন শুনতে আসিনি আমরা–বিভু কোথায়–আমরা যে নৃত্য দেখবো বলে এসেছি।

অচিরেই বিভাবতী নৃত্য আরম্ভ করলো। এই কলায় সে অসাধারণ পারদর্শিনী। যৌবনে মহারাজ লক্ষ্মণ সেন কয়েকজন নৃত্যপটিয়সী মন্দিরদাসী আনয়ন করেছিলেন কান্যকুজের দক্ষিণাঞ্চল থেকে, বিভাবতীর মাতামহী তাদেরই একজন। মন্দিরদাসীদের। পিতৃপরিচয় থাকে না–কিন্তু বিভাবতীর মাতা জানতেন তাঁর পিতৃপরিচয় কী, এবং বিভাবতী নিজেও জানে নিজ পিতার পরিচয়। সে যা–ই হোক, দৌহিত্রীর নৃত্যকলা শিক্ষা হয়েছে মাতামহীর কাছে। সুতরাং বিভাবতীর নৃত্য দেখবার মতো। শক্তিবর্মণ নৃত্য দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। তিনি মধুকাসব পান করে পাত্রের পর পাত্র শূন্য করে দূরে নিক্ষেপ করছেন আর প্রমত্ত খলিত কণ্ঠে হা হা রবে অট্টহাসি হাসছেন। কখনও বামে, কখনও দক্ষিণে দুই বয়স্যের উপর ঢলে পড়ছেন। ওদিকে তখন নৃত্য উঠেছে তুঙ্গে–বয়স্য দুজন মহাসামন্তকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু শক্তিবর্মণ কি আর স্থির থাকার লোক? তিনি অট্টরবে হাসতে হাসতে বললেন, আমাকে স্থির থাকতে বলছো কেন হে, জানো না, শৃঙ্খলিত ও স্থির থাকে ভারবাহী পশুরা! শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করলে কি কেউ শৃঙ্খলা রক্ষক হতে পারে? সম্ভব নয় হে, অনুশাসন শৃঙ্খলিত সন্ন্যাসী কি এই অপ্সরা রমণীর নৃত্যলীলা উপভোগ করতে পারবে? পারবে না। সদ্ধর্মী ভিক্ষু আর পাষণ্ড যোগীদের দ্রোহদমনও কি সাধুসন্ন্যাসীদের পক্ষে সম্ভব? বলো?

শক্তিবর্মণ তাঁর বিপুল দেহ নিয়ে উল্লাসে হাসিতে একেবারে ভূমিতে লুণ্ঠিত হচ্ছেন তখন। সম্মুখে নৃত্য হচ্ছে কিন্তু সেদিকে তার মনোযোগ নেই। নানান কথা তার মনে উদিত হচ্ছে এবং সেগুলি তিনি বলে যাচ্ছেন একে একে।

বয়স্যদের ডেকে বললেন, ওহে বলীবর্দ, বলো দেখি, ক্ষাত্ৰতেজ কিসে উদ্দীপ্ত হয়?

বয়স্যটি বিপাকে পতিত হয়। পিতৃপুরুষের জন্মে সে এমন প্রশ্ন শোনেনি। অপ্রতিভ হয়ে সে বলে, মহারাজ, ক্ষাত্ৰতেজের কথা বলছেন? শুনেছি ময়ূর মাংস ভক্ষণে ….

কুক্কুর, তুমি প্রকৃতই একটি কুক্কুর হে–কেবল খাদ্যের দিকে মন তোমার। পারবে বলতে? হা হা হা–পারবে না হে, পারবে না–শুনে রাখো, ক্ষাত্ৰতেজ উদ্দীপ্ত হয় রণে ও রমণে।

ওদিকে বিভাবতীর নৃত্য সমাপ্ত হয়েছিলো। সে নিকটে এলে কোমলস্বরে ডেকে বললেন, অয়ি সখী বিভু, তুমি সেই নৃত্যটি দেখাবে? সেই যে কেশব বাসনা লক্ষ্মী মন্থন শেষে সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে আসছেন, হাতে তাঁর অমৃতভাণ্ডটি?

বিভাবতী প্রণাম জানিয়ে সহচরীদের নির্দেশ দিলো। তারপর আরম্ভ করলো সেই নৃত্যটি। স্বভাবতঃই সে মুদ্রা এবং তালে নতুন ভুবন সৃষ্টি করতে পারতো, তায় তখন রাত্রির মধ্যযাম এবং প্রদীপালোকের মায়ালোক। উপরন্তু আসবমত্ত দর্শকদের দৃষ্টি মদিরাতুর–ফলে চোখের সম্মুখে নানান বিভ্রম সৃষ্টি হতে লাগলো। দ্বারান্তরালে বাদিকা সুললিতার হাতে ছিলো মৃদঙ্গ এবং নীলাঞ্জনার হাতে বীণা। দৃশ্য এবং শ্ৰব্য উভয়ের এমন সুসমঞ্জস মিলন কদাচিৎ ঘটে। আরক্ত নেত্রে মহাসামন্তপতি এবং তার সহচর দুই বয়স্য যা দেখতে লাগলেন, তাতে ভাবলেন, তাঁরা ইন্দ্রসভায় বসে আছেন।

প্রদীপালোকের সম্মুখে কে একজন অন্তরাল সৃষ্টি করলো, তাতে আলোহীন অন্ধকারবিহীন একটি মায়ালোক জন্ম নিলো। অদৃশ্যে কোথায় যেন তখন অস্ফুট মৃদঙ্গের শব্দ হচ্ছে। যেন আলো অন্ধকারে সৃষ্টির প্রথম লগ্ন। সাগর–মৃত্তিকা–অন্তরীক্ষ ব্যাপ্ত সমগ্র চরাচরে গভীর, ধীর, অথচ প্রাণময় ওঙ্কার নাদটি সবে আরম্ভ হয়েছে, এমন মনে হলো। সেই অন্ধকারের বুকে রত্নখচিত মুকুটটি প্রথমে দেখা গেলো, তারপর লক্ষ্মীর বিদ্যানন, শেষে পূর্ণ দেহাবয়বটি। মেনকা কি এমন যৌবনধন্যা ছিলেন? নাকি ইনি উর্বশী? রম্ভার কটিদেশ কি এরূপ ক্ষীণ ছিলো এবং নিতম্ব এমন গুরুভার? বয়স্যরা চক্ষু কচালিত করলো। সূক্ষ্ম চীনাংশুকের অন্তরাল থেকে লক্ষ্মীর উরুদেশের যেটুকু সৌন্দর্য নৃত্যের প্রতিটি তালের সঙ্গে ঝলকে ঝলকে গোচরে আসছিলো তাতে স্তম্ভিত ও বিমূঢ় হওয়া ছাড়া দর্শকদের গত্যন্তর ছিলো না। গভীর তলদেশের স্থিরতায় প্রথমে কম্পন, তারপরে যেন কলরোল জেগেছে। মন্থিত সমুদ্রের জলরাশিতে নয়, বিষ্ণুবাসনা লক্ষ্মীর যৌবনময় দেহবল্লরীতেই যেন বিপুল উল্লসিত এবং ফেনাময় কলরোল উন্মথিত হচ্ছে। এই ঘটনা কি মর্ত্যের? দর্শকেরা বলতে পারবে না। ক্রমে লক্ষ্মী তার কক্ষে সুবর্ণ কলসটি নিয়ে স্মিত হাস্যে স্থির হলেন।

অর্থাৎ এতক্ষণে দেবীর পূর্ণ প্রকাশ ঘটলো। দীপাধারের ঘৃত প্রদীপগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এখন আর আলোছায়ার বিভ্রম নয়। উজ্জ্বল আলোক লক্ষ্মীর দেহত্বকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে–পরিপূর্ণ উরুদেশ, ক্ষীণ কটি, বিপুল নিতম্ব ও প্রমত্ত জঘন মানবী দেহে বিন্যস্ত হয়ে ক্রমে যেন দর্শকদের চোখের সম্মুখে একটি স্পর্শাতীত বাসনার মূর্তি হয়ে উঠলো। দর্শকরা বিভ্রান্ত। কেউ নিঃশ্বাস ত্যাগও করে না–কি জানি, যদি এই স্বপ্নঘোর ভেঙে যায়?

কিন্তু প্রকৃতই কি স্বপ্নঘোর? বিভাবতী স্বপ্নঘোর সৃষ্টি করতে চায়নি, তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। সে ধীর পদক্ষেপে এক সময় নিকটে এসে সুবর্ণ কলসের অমৃত ঢেলে পানপাত্রগুলি পূর্ণ করে দিলো।

নৃত্য শেষ হয়েছে, কিন্তু তখনও কক্ষের মধ্যে রেশটির গুঞ্জরণ শোনা যাচ্ছে–মৃদঙ্গ ও বীণার মূৰ্ছনা তখনও কক্ষের চারিদিকে কম্পমান–ঐ সময় বিভাবতীর মুখে কথা ফুটলো–মহারাজ, লক্ষ্মীর অমৃত পান করুন।

ও হ্যাঁ, সম্বিত ফিরলো যেন প্রত্যেকের। শক্তিবর্মণ ডেকে বললেন, ওহে অমৃত পান করো–অমর হবার এই–ই সুযোগ।

অতঃপর স্বল্প কিছু কথা, কয়েকমুহূর্তের উল্লাস এবং বিভাবতাঁকে নিকটে পাওয়ার জন্য উদ্বাহু আহ্বান–এই পর্যন্তই। অর্ধদণ্ডকালও অতিক্রম হয়নি, দেখা গেলো, বিশালাকার তিন ষণ্ডই ভূমিতে লুণ্ঠিত–তাদের নাসিকা গর্জনে পৃথিবী থরথর কম্পমান।

ঔষধি ক্রিয়ায় সম্ভবত কাণ্ডটি ঘটে থাকবে, বসন্তদাস অনুমান করে। সে সমস্ত প্রক্রিয়াটি দ্বারান্তরাল থেকে প্রত্যক্ষ করছিলো–কৃষ্ণাও ছিলো নিকটে উপবিষ্টা। শক্তিবর্মণ পপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রমোদ কক্ষে প্রবেশ করে প্রদীপগুলি নির্বাপিত করতে থাকে। শুক্লার কণ্ঠস্বর শোনা যায় ঐ সময়, সে বাহিরের প্রহরীদের ডেকে বলছে, মহারাজ নিদ্রাগত হয়েছেন–তোমরাও বিশ্রাম নিতে পারো।

ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে অসম্ভব এস্ত ব্যস্ত দেখা যায় তিনজনকেই। একজন মুণ্ডিতমস্তক ব্যক্তি যে কোন স্থান থেকে হঠাৎ আবির্ভূত হলেন সে এক রহস্য, আর তৎক্ষণাৎ কোথায় যে চলে গেলেন সে আরেক রহস্য। কৃষ্ণা ঐ মুহূর্তে বলে যায়, পলায়ন করবেন না, আমি এক্ষুনি আসছি।

স্বল্পক্ষণ পরই সে ফিরলো। মুখে বিজয়িনীর হাসি। বললো, এবার চল হে পথিক, তোমার সঙ্গে আলাপ করি।

পশ্চাতে শুক্লা কটাক্ষ করে। ওলো দগ্ধাননা রাক্ষুসি, রাত্রি কিন্তু অধিক নেই, ওকে স্বল্পক্ষণের জন্য হলেও ঘুমোতে দিস।

ঐরূপ সংলাপ বিলক্ষণ উত্তেজক। কিন্তু বসন্তদাসের মনে ভয় ছিলো। মনে হচ্ছিলো, এক সর্বনাশা খেলায় মত্ত হয়েছে ঐ তিন রমণী। তাদের সান্নিধ্য পরিহার করতে না পারলে বিপদ অনিবার্য। তাদের কৌতুকালাপের ইঙ্গিতগুলি তাই অযথা নষ্ট হচ্ছিলো। কৃষ্ণা তো একবার বলে বসলো, কি হে ক্ষেত্রকর, কর্ণে কি জল পশে না? বলল না, তোমার বধূটি বালিকা, না যুবতী?

তাকে নিজ কক্ষে নিয়ে যায় কৃষ্ণা। তারপর দ্বার অর্গলবদ্ধ করে। বসন্তদাস তখন শঙ্কিত, তবে কি সত্য সত্যই একটি ভয়ঙ্কর অবস্থার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে সে? কিন্তু কিছুই করণীয় ছিলো না তার। তবু সে বললো, আপনারা আমাকে কেন ভুল বুঝছেন, আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না আমার দ্বারা, বিশ্বাস করুন।

কৃষ্ণা উত্তরীয়খানি হেলাভরে দূরে নিক্ষেপ করলে সে অধর দংশন করে নিজেকে সংযত করে। কিন্তু যখন হাত ধরে কৃষ্ণা আহ্বান করে, এসো, শয্যায় এসো, তখন আর তার পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব হয় না। বলে, কেন আমাকে প্রলুব্ধ করছেন, আমি আপনাদের কোনো কথাই কোথাও প্রকাশ করবো না–বিশ্বাস করুন।

হ্যাঁ, বিশ্বাস করলাম, কৃষ্ণার ওষ্ঠদ্বয়ে ঐ সময় হাসি বিলোলিত হয়। বলে, বারংবার এক কথা বলার কি প্রয়োজন, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি, এসো শয়ন করি, রাত্রি যে চলে যায়।

তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, কৃষ্ণা এভাবে নিজের অবমাননা করো না। কিন্তু কথাটি ঐ ভাষায় সে বলতে পারে না। বললো, ভদ্রে, দক্ষিণাদানের কোনো সামর্থ্যই আমার নেই–আপনি আমাকে মার্জনা করবেন।

ঐ কথার কৃষ্ণায় যুগল ক্ষণিকের জন্য তীক্ষ্ণধার হয়ে ওঠে। পরক্ষণে সে স্মিতহাস্যে জানায়, মন্দিরদাসী সর্বদা দক্ষিণার প্রত্যাশা করে না হে নির্বোধ ক্ষেত্রকর, তাদের প্রণয়ও হয়।

না ভদ্রে, আমি বিশ্বাস করি না, বসন্তদাস জানায় উত্তরে। বলে, প্রণয় অতো সুলভ নয়, এতো অল্পকালের প্রণয় সেই প্রকার গম্ভীর হতে পারে না, যাতে দুজনে একত্রে শয্যাগ্রহণ করা যায়–আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন, আমি লম্পট নই।

কী যে হয় কৃষ্ণার, বোঝা যায় না। সে তার বিশাল চক্ষু দুটি মেলে ধরে বসন্তদাসের দৃষ্টির সম্মুখে। কী দেখে, ভগবান জানেন–তারপরই ওষ্ঠে ভারী ক্ষীণ একটি হাসি ফুটিয়ে বলে, না হে ক্ষেত্রকর, আমি তোমাকে ভুল বুঝিনি–এ পর্যন্ত বলে সে হাত ধরে বসন্তদাসের। তারপর বলে, আত্রেয়ীতীরের পুরুষ, মানুষই–অন্যকিছু নয়।

না, আবার আপনি ভুল বুঝলেন, বসন্তদাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। বলে, পৌরুষ বিচারের প্রশ্ন নয় এটা–আর সে বিচারও আপনারা করছেন না বরং আমি দেখছি, আপনারা আমাকে এমনভাবে প্রণয়পাশে আবদ্ধ করতে চান, যাতে আমি আপনাদের কোনো গোপন কথা কখনও প্রকাশ করে না দিই। আমি বলি, আপনার এই প্রণয়পাশের প্রয়োজন নেই, নিশ্চিত থাকুন, আমি কখনই কিছু বলবো না

হয়েছে হে বাক্যবাগীশ ক্ষেত্রকর, অধিক কথা বলো না–এসো ক্ষেত্রকর্ম করো।

কৃষ্ণা তখন কৌতুকে, কপট ক্রোধে এবং লীলাবিলাসে এমন হয়ে উঠেছে যে, সাধ্য কি বসন্তদাসের তাকে নিরস্ত করে। সে দেখে, প্রগলভা মন্দিরদাসী প্রেমদানে উন্মুখ হলে পুরুষ বড়ই অসহায়।

এবং রাত্রির ঐ শেষ যামে বসন্তদাসকে কৃষ্ণার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়।

.

মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ যখন চক্ষুরুন্মীলন করলেন, তখন সকাল। নগরীর কর্মকোলাহল শোনা যাচ্ছে। প্রথমে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলেন। চিন্তা করলেন, তিনি কোথায়? তাঁর পূর্ব রাত্রির কথা স্মরণ হলো–কিন্তু সম্পূর্ণ ঘটনাটি স্মরণ করতে পারলেন না।

মস্তক আন্দোলন করলেন কয়েকবার। যদি ঘোর কাটে–কিন্তু কাটলো না ঘোর। শরীরময় মেদুর একটি অবসাদ, প্রত্যঙ্গে প্রত্যঙ্গে শিথিলতা। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, কক্ষের বাইরে অলিন্দের চত্বরে পদচারণা করলেন কয়েকবার। অদূরেই একটি আম্রকানন–সেখানে বৃক্ষ শাখায় পীতবর্ণ পক্কা দুলতে দেখলেন। বৃক্ষতলের প্রহরীটিও তাঁর দৃষ্টিতে এলো। আকাশে মেঘ দেখা দিয়েছে। তিনি পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করলেন।

বয়স্য দুজন তখনও নিদ্রিত। একজনের নাসিকা গর্জনে তখনও কক্ষটি প্রকম্পিত হচ্ছে। তাকে পদাঘাত করে বললেন, ওহে নাসিক্যানন্দ, তোমার বাদ্য কি থামাবে? ভূকম্পনে ধরণী যে রসাতলে গেলো।

বয়স্য দুজন জাগ্রত হয়ে উঠে বসলে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে–প্রাসাদে চলো।

ওদিকে তখন প্রাতরাশের ব্যবস্থা হয়েছে। শূলপ ময়ূর, মৃগমাংস, পলান্ন, পক্ক আম্র, পনসকোষ, দধি, মিষ্টান্ন ইত্যাদি নিয়ে ষোড়শোপচার আয়োজন। মধুকাসবের স্বর্ণকলসটি যথাস্থানেই রাখা হয়েছে।

আহার যখন শেষ পর্বে, ঐ সময় বিভাবতী তার প্রার্থনা নিবেদন করে। বলে, মহারাজ, অনুমতিদান করলে এক হৃতসর্বস্ব বণিককে আপনার পদপ্রান্তে আনি, সে আপনার সাক্ষাপ্রার্থী।

শক্তিবর্মণ শূলপকু ময়ুরমাংস চর্বণ করছিলেন। বললেন, আরে অধিক বিনয়ের কি প্রয়োজন–যাও, নিয়ে এসো তোমার বণিককে।

বসন্তদাস তখন কৃতাঞ্জলি হয়ে সম্মুখে দাঁড়ায়, মহারাজের জয় হোক।

 কি হে বণিক পুত্র, সংবাদ কি তোমার?

বসন্তদাস তখন নিজ পরিচয় জানিয়ে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে। শক্তিবর্মণ মনোযোগ দিয়ে শোনেন। শেষে বলেন, সমস্তই বুঝলাম, তুমি এখন কী চাও?

প্রভু, আমার পণ্যসামগ্রীর প্রত্যর্পণ প্রার্থনা করি।

রে মূর্খ, তা কি হয়, শক্তিবর্মণ প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন। যেন কোনো বালকের অবাস্তব আবেদন শুনছেন। অতঃপর বলেন, সামন্ত হচ্ছেন রাজার প্রতিভূ, তাঁর কাজ রাজকার্যের সমতুল্য। রাজার গৃহীত সামগ্রীর কি প্রত্যর্পণ হয়? তুমি অন্য কিছু প্রার্থনা করো।

মহারাজ তাহলে অনুগ্রহ করে আমার পণ্যাদির মূল্য পরিশোধ করার জন্য আদেশ দিন।

বসন্তদাসের কথা শুনে মহাসামন্তের জ কুঞ্চিত হয়। তিনি চর্বণে বিরত হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখেন বসন্তদাসকে। মনে হয় যেন বহুকষ্টে নিজেকে আত্মস্থ করছেন। তারপর বলেন, তুমি দূরের লোক–অধিকন্তু পথিক এবং বিভাবতীর আশ্রয়ে আছে, তাই রক্ষা পেলে, ভবিষ্যতে কদাপি এরূপ বাক্য উচ্চারণ করবে না, সামন্ত বা মহাসামন্ত কারও প্ররোচনায় আদেশ প্রদান করেন না–কথাটি স্মরণ রেখো, এখন যাও।

বসন্তদাসের কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না, এরূপ উম্মার কারণ কি! সে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। একজন বয়স্য বলে উঠলো, কি হে বণিক পুত্র, কর্ণে কি জল প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে?

মহাসামন্ত বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন। বিভাবতাঁকে বললেন, কে এই বণিক? এ কেন তোমার গৃহে?

ঐ সময় একজন লোক এসে তাকে কিছু বললে তিনি বিলম্ব করলেন না। আহার ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন এবং কিছুই না বলে বিভাবতীর গৃহ ত্যাগ করলেন।

মহাসামন্ত বিদায় হবার সঙ্গে সঙ্গে বিভাবতী চঞ্চল হয়ে উঠলো। বসন্তদাসকে বললো, আপনি কেন ঐ কথা বললেন? এখন কী হবে কে জানে, মহাসামন্তের রোষ ভয়ানক, আপনি শীঘ এ স্থান ত্যাগ করুন।

কেন, কি হয়েছে, ইত্যাকার প্রশ্ন করতে পারতো। কিন্তু দেখলো, ঐসব প্রশ্ন শোনার মতো মানসিক অবস্থা কারও নেই। ওরা তিনজনই নিদারুণ বিচলিত। বিভাবতী বারবার বলছে, গত রাত্রে মিত্রানন্দকে স্থানান্তরিত করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম–আজ আবার এ কোন বিপদ সৃষ্টি করলেন আপনি, কেন ওকথা বলতে গেলেন?

বসন্তদাস কিছু বলতে পারে না। সমস্ত অপরাধ যেন তার একার। সে বিভ্রান্ত বোধ করছিলো। প্রকাণ্ড এক অপরাধের ভার নিয়ে কি সে পলায়ন করবে, না সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে রাজরোষের সম্মুখীন হবে। সে শেষে জানালো, আমার কারণে আর চিন্তিত হবেন না–আমি চলে যাচ্ছি।

ঐ সময় কৃষ্ণা এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। বলে, তুমি চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা? আমরা কোথায় যাবো?

তোমাদের তো কোনো দোষ নেই, অপরাধ আমি করেছি, যদি শাস্তি দেয়–আমাকে দেবে।

এই তোমার বুদ্ধি! জানো, শক্তিবর্মণের চরেরা কত প্রকার উৎপীড়নের প্রক্রিয়া জানে? তুমি জানতেও পারবে না, কখন তুমি সমস্ত কথা প্রকাশ করে দিয়েছো আর সকল সংবাদ যদি তারা জানতে পারে, তাহলে আমাদের কি দশা হবে ভাবো তো?

বসন্তদাসের ক্রোধ হয় এ কথা শুনে। বলে, ষড়যন্ত্র করলে তার শাস্তি হবে না?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই শাস্তি হবে, তার জন্য আমরা প্রস্তুতও কিন্তু তুমি? নিষ্কৃতি পাবে কি? তুমিও নিষ্কৃতি পাবে না–এই সামন্তরাই তোমার সর্বস্ব অপহরণ করেছে। তোমার কোনো অপরাধ ছিলো না, তথাপি তুমি অপহৃত হয়েছে। নিরপরাধ হলেই যে তুমি রক্ষা পাবে–এমন নিশ্চয়তা কি কেউ তোমাকে দেবে?

না, দেবে না, বসন্তদাসকে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু বারবার একই প্রশ্ন সে করে, আমি তো কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত নই–আমি তো কোনো প্রকার দ্রোহের উত্থান সমর্থন করি না, তথাপি কেন আমি পলায়ন করবো?

কৃষ্ণার দুচোখে অগ্নি স্কুরিত হয়। বলে, এই তোমার পৌরুষ? নির্বোধ, একাকী, দায়হীন–বিদ্রোহ যদি হয়, তাহলে তা হবে কার জন্য, আমার জন্য? বলো? আমাকে কী দেবে সেই উপপ্লব? আমরা মন্দিরদাসী, আমাদের গৃহ নেই, সংসার নেই, ভবিষ্যৎ। নেই–তথাপি আমাদের মনে হয়েছে, অনাচারের অবসান হওয়া প্রয়োজন, অত্যাচার দূর হওয়া উচিত, মানুষের অপমান এবং লাঞ্ছনা আর সহ্য হয় না। যদি আমাদের নিষ্ফল জীবন মানুষের জন্য কল্যাণময় ভবিষ্যৎ এনে দিতে পারে, তাহলেই মনে করবো জীবন আমাদের সার্থক হয়েছে। কল্যাণ ও মঙ্গলময় সেই ভবিষ্যৎ আমাদের হবে না, হবে তোমাদের, যাদের গৃহ আছে, সংসার আছে–তথাপি আমরা মনে করবো, আমাদের জীবন জগতের কাজে লাগলো।

বসন্তদাস শুনছিলো। কৃষ্ণার প্রতিটি কথা তার মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যাচ্ছিলো। একেকবার স্মরণ হচ্ছিলো বিগত রাত্রির কথা। এ কোন রমণী, এ কি গত রাতের সেই কামবিলাসিনী মন্দিরবারাঙ্গনা? যার কাছে আত্মসমর্পণ না করে উপায় ছিলো না? নাকি এ অন্য কোনো তেজস্বিনী নারী। স্বয়ং আদ্যাশক্তি কি আশ্রয় নিয়েছেন এই সুন্দর রমণী দেহের ভিতরে? পরিশেষে সে বিগত রাত্রির মতোই আত্মসমর্পণ করলো। বললো, উত্তম কথা, আমি নগরী ত্যাগ করছি এবং সেই সঙ্গে তোমাদের সংসর্গও।

তুমি বড় নিষ্ঠুর হে ক্ষেত্রকর! কৃষ্ণা সহাস্য মন্তব্য করেছে তারপর। নিজ কক্ষে নিয়ে গিয়েছে। দুটি সুবর্ণ মুদ্রা কটিবন্ধে বেঁধে দিয়েছে। বলেছে, তুমি মঙ্গলদ্বীপ গ্রামে যাবে, দক্ষিণে নয়, বামে নয়–একেবারে স্থির পশ্চিমেমঙ্গলদ্বীপে তুমি দিবানাথের গৃহে আশ্রয় নেবে, যদি সেখানে মিত্রানন্দকে পাও, উত্তম, যদি না পাও, তাহলে দিবানাথের পরামর্শ মতো অন্যত্র যাবে।

সর্বশেষে কৃষ্ণা দুহাত ধরে মুখপানে দৃষ্টিপাত করেছে। বলেছে, ওহে, আত্রেয়ী তীরের ক্ষেত্রকর, এক রাত্রির সাক্ষাতেও মন্দিরদাসী প্রণয়ীকে হৃদয়দান করতে জানে এখন বিশ্বাস হয় সে কথা?

দারুণ হাসছিলো তখন কৃষ্ণা। আর ঐ একটি প্রশ্নই বারবার করছিলো, বিশ্বাস হয় না তোমার? বলো, বিশ্বাস হয় না?

বসন্তদাস ঐ কথার উত্তর দিতে পারেনি। উত্তরের ভাষা তার জানা ছিলো না। শুধু দুহাতে আকর্ষণ করে কৃষ্ণার সীমন্তে একটি চুম্বন এঁকে দিয়েছে।

ঐ তার শেষ সাক্ষাৎ।

এবং ঐ শেষ সাক্ষাই তাকে যুক্ত করে দিয়েছে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে। ঐ বিদায় যেন বিদায় নয়, বন্ধন। তারপর সে একাকী নয়। জগতের নানান প্রসঙ্গ এখন তার চিন্তা ভাবনার বিষয় হয়ে যায়। তার বণিক জীবনের মৃত্যু ঘটেছে ফল্পগ্রামে, বালিগ্রামে হয়েছে। তার অন্ত্যেষ্টি এবং ঐ অন্ত্যেষ্টির পর আরম্ভ হয়েছে তার নতুন জীবন। সে জানে না, এই নতুন জীবনের কী নাম–কিন্তু সে একটি গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করে। এই উপলব্ধিটি মুক্তির। সীমারেখা থেকে মুক্তি, গণ্ডিরেখা থেকে মুক্তি, স্বার্থবুদ্ধি থেকে মুক্তি–এবং এইভাবে ঘৃণা থেকে, সংকোচ থেকে, হীনমন্যতা থেকে ক্রমাগত একের পর এক মুক্তি।

অবশ্য এই গভীর তাৎপর্যময় উপলব্ধিটি স্পষ্ট হয়েছে অনেক পরে। তবে তার সূচনা ঐদিন, যেদিন সে বালিগ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে আসে।

বালিগ্রাম ত্যাগ করে সে মঙ্গলদ্বীপে যায়, সেখানে তার জন্য যেন অপেক্ষা করে ছিলেন দিবানাথ, তার আশ্রয়েই সাক্ষাৎ হয় ভিক্ষু মিত্রানন্দের সঙ্গে।

বসন্তদাসের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে নবীন ভিক্ষু মিত্রানন্দ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। নিঃসংকোচে বলে, মহাশয়, আপনি সর্বনাশ করেছেন–আপনার শাস্তি হওয়া উচিত।

তীব্র উল্কণ্ঠা তখন বসন্তদাসের মনে, কলহে প্রবৃত্তি ছিলো না। তথাপি বলে, মহাশয় অহেতুক ক্ষিপ্ত হচ্ছেন, আপনি ভিক্ষু, ক্রোধ আপনাতে শোভা পায় না।

ঐ কথায় মিত্রানন্দ সত্য সত্যই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। বলে, ক্রোধের এখনই আপনি কি দেখেছেন, ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন–অপেক্ষা করুন।

ভ্রাতঃ আমি তো বুঝলাম না আমার অপরাধ কোথায়! বসন্তদাস বিনয় ত্যাগ করে না।

আপনি তিনটি তরুণীর সর্বনাশ করেছেন, মিত্রানন্দ তীব্রস্বরে বলে, আমাদের মহান একটি কার্য–সম্পাদনের পথে বাধা সৃষ্টি করেছেন, তথাপি বলছেন, আপনার অপরাধ নেই? আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।

কিন্তু আমি তো তাদের কিছু করতে বলিনি–তারাই আমাকে আমন্ত্রণ করে গৃহে নিয়ে গিয়েছিলেন।

চুপ করুন, লোভী, লম্পট, মিথ্যাচারী!

বসন্তদাস দেখলো, এ ভারী অদ্ভুত কাণ্ড। ক্রোধে মিত্রানন্দের একেবারে হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছে। সে বললো, মহাশয়, আপনার মুখে সংযম আনুন, না হলে আমিও অসংযমী হয়ে উঠতে পারি।

মিত্রানন্দ আরও কী বলতো কে জানে! ঐ সময় দিবানাথ মধ্যস্থলে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, এ কী করছেন আপনারা–ছি ছি–বিপদে মানুষকে ধীরস্থির থাকতে হয়, আপনারা ধৈর্যহারা হয়ে যদি কলহ করতে থাকেন, তাহলে লাভ কার হবে? এখন না আপনাদের উচিত বিপর্যয় কতখানি হয়েছে সেইটি জানা, আর তা না করে আপনারা কলহে প্রবৃত্ত হয়েছেন?

এ কথায় মিত্রানন্দের যেন সম্বিৎ হয়। সে নত মুখে ঐ স্থান ত্যাগ করে। দিবানাথ জানালেন, আমি এখনই নগরীর উদ্দেশে যাত্রা করছি–সংবাদ নিয়ে আসি–প্রকৃত ঘটনা কী।

দিবানাথ প্রত্যাগমন করলেন সন্ধ্যাকালে। জানালেন, বিভাবতী ও শুক্লা প্রাসাদে বন্দিনী–শত পীড়নেও তারা কোনো কথা প্রকাশ করেনি–আর কৃষ্ণার কোনো সংবাদ নেই, কেউই তার সংবাদ জানে না।

আরও সংবাদ এই যে, মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ যথার্থই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন, নগরীর গৃহে গৃহে সন্ধান করা হচ্ছে–মিত্রানন্দ এবং বসন্তদাসকে চাই–সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে।

কৃষ্ণার সংবাদ নেই শুনে বসন্তদাস বিচলিত হয়। কৃষ্ণার মুখখানি সে বিস্মৃত হতে পারছিলো না। তার উচ্ছল হাসি, কপট ক্রোধের ভ্রূ-ভঙ্গি, তার প্রগাঢ় আলিঙ্গন, তার আশ্লেষ গভীর চুম্বন এবং অশ্রু উদ্বেলিত অথচ হাস্যমুখরিত বিদায় জ্ঞাপন–সমস্তই বারংবার তার মনে পড়ছিলো। কে জানে, হয়তো শক্তিবর্মণের অনুচরেরা এতোক্ষণে তার দেহটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। সন্ধ্যাকাশের উজ্জ্বল তারকাটির দিকে দৃষ্টি রেখে সে উচ্চারণ করে, কৃষ্ণা ক্ষমা করো আমি তোমার অক্ষম প্রণয়ী, তোমাকে রক্ষা না করে আমি পলায়ন করে এসেছি।

মিত্রানন্দ সন্ধ্যাকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলো। তার চিন্তা ভিন্ন। তার চিন্তা হচ্ছিল, বিপুল একটি উপপ্লব কি সত্যই আসন্ন? দাসত্ব ও লাঞ্ছনা থেকে মানুষ কি মুক্তি পেতে চলেছে? মনের আকাক্ষা কি এখন বিশ্বাসে পরিণত হবার পথে? না হলে ঐ তিনটি মন্দিরবাসী যুবতী কেন বিপজ্জনক সহযোগিতাদান করতে এসেছিলো?

মিত্রানন্দের কষ্ট হয় বিভাবতী ও তার সহচরী তরুণী দুটির জন্য। আবার সেই সঙ্গে আশাও গভীরতর হয়। মনে হয়, ঐ তিন মন্দিরবাসীর আত্মাহুতি মানুষের মুক্তি ত্বরান্বিত করে আনছে।

সে বসন্তদাসের কাছে যায়। বসন্তদাসের মুখে বিষাদের ছায়া দেখে বলে, মিত্র বসন্ত, দুঃখ করবেন না–যুদ্ধ আরম্ভ হলে আঘাত তো আসবেই–মনে করুন, এ সেই প্রকারেরই একটি আঘাত।

বসন্তদাস জানায়, আমি তো যুদ্ধ চাইনি, কোথায় যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? কিছুই। জানি না–আমি সাধারণ মানুষ। কৃষ্ণাদেরও কি যুদ্ধ প্রয়োজন ছিলো? আমি বুঝি না ভিক্ষু মিত্ৰানন্দ, কেন এই দ্রোহ উত্থাপনের প্রস্তাবনা, এতে তো মৃত্যু এবং ধ্বংস ব্যতীত অন্য কিছুই আমি দেখছি না।

মিত্রানন্দের সন্দেহ হয়, তবে কি এই লোকটি তাদের কাজের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন, কোনো সংবাদই জানে না? তাহলে দিবানাথের গৃহেই বা তার আশ্রয় কেন হলো? সে নিশ্চিত হতে পারে না।

তথাপি সে বলে, বসন্তদাস, আমি জানি না, আপনি কী চিন্তা করেন। কিন্তু নিজের জীবনের কথা কখনও ভেবেছেন? আপনার, আপনার পিতার, আপনার পিতামহের? মনে হয় না কি আপনি পুরুষানুক্রমে দাস? সামন্তপতির দাস, কায়স্থের দাস? আপনার কি ভগবান আছে? আপনি ভগবানের পূজা করতে পারেন? চণ্ডালদের কথা চিন্তা করুন, ডোম হড়ডিদের কথা চিন্তা করুন। নিমশূদ্রে কত বর্ণ ভেবে দেখেছেন? শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদ, একে অপরের ওপর লাঞ্ছনা করে, শোষণ করে, লুণ্ঠন করে। আপনি কি লুণ্ঠিত হননি, বলুন? সামন্তপতি যে আপনার সমস্ত কিছু অপহরণ করলো, তার প্রতিকার কোথায়?

মিত্রানন্দের কথায় বসন্তদাসের প্রত্যয় হয় না। তার মনে হয় না যে এতো সরলভাবে প্রশ্নগুলি করা যায়। সে বলে, এভাবে প্রশ্ন করলে তো সমাধান পাওয়া যাবে না। রাজপুরুষ অত্যাচারী হলে রাজার কাছে যেতে হবে–সে জন্য দ্রোহের প্রয়োজন নেই। আর শ্রেণীর কথা বলেছেন, ব্রাহ্মণ শূদ্র এক হতে পারে কখনও? ভগবান যদি কারও জন্য শূদ্র জন্ম নির্দিষ্ট করে থাকেন, তাহলে শূদ্রের কাজই তার কর্তব্য। সে কেন ব্রাহ্মণের কাজ করতে যাবে? সকলেই কি রাজা হয়? যার সৌভাগ্য ভগবান নির্দিষ্ট করে দেন সে–ই রাজা হয়। মনে করুন, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ও সেইরূপ।

আপনি যুক্তির কথা বলুন–আপনি তো দেখছি বিশ্বাসের কথা বলছেন?

না যুক্তি আমারও আছে, বসন্তদাস জানায়। বলে, সকার্য যে করে, সৎ জীবন যে যাপন করে, জ্ঞানালোচনা করে, যে মানুষকে পথ নির্দেশ করে, সে মানুষকে আমি শ্রেষ্ঠ বলবো না? ব্রাহ্মণ তো সেই বিচারেই শ্রেষ্ঠ। নীচ–স্বভাব যে, হীন যে, যার মুখে সর্বদা মিথ্যা ভাষণ, যে তস্কর–সেই লোক এবং ব্রাহ্মণ এক হওয়া কখনই সম্ভব নয়।

হ্যাঁ, আমারও সেই কথা, মিত্রানন্দ স্বীকার করে। বলে, শ্রেষ্ঠমানব তার গুণে, জন্মে নয়, কুলক্রমে নয়। যদি কোনো ব্রাহ্মণ লুণ্ঠন করে, হত্যা করে, আপাদমস্তক যে লম্পট, তাকে আমি ব্রাহ্মণ কেন বলতে যাবো? বাস্তবে আমরা কী দেখি, বলুন? সকল ব্রাহ্মণ কি ব্রাহ্মণের মতো আচরণ করে? ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য প্রজা পালন, সে কি প্রজা পালন করে? আবার দেখুন, আপনি পুরুষানুক্রমে সৎ জীবনযাপন করলেও ব্রাহ্মণ হতে পারবেন না।

বসন্তদাস তথাপি সংশয়মুক্ত হতে পারে না। বলে, মিত্রানন্দ শ্রেণীভেদের এ বিধান সনাতন–হঠাৎ পরিবর্তন করতে চাইলেই পরিবর্তন হবে না। সদ্ধর্মী বৌদ্ধরাও ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ ভেদ লুপ্ত করতে পারেনি।

এই প্রশ্নে সদ্ধর্মীরা দুর্বল, মিত্রানন্দ জানে। তাই সে ব্রাহ্মণব্রাহ্মণ প্রশ্নে ভগবান তথাগতের কথা স্মরণ করে। তার বিশ্বাস, ব্রাহ্মণব্রাহ্মণে যে ভেদ করে, সে প্রকৃত সদ্ধর্মী নয়। সেই একই কথা সে বসন্তদাসকে জানালো, বললো, মানুষের অপমান যদি কোনো সদ্ধর্মী কখনও সমর্থন করে, তাহলে বুঝবেন, সে সদ্ধর্মী নয়।

সে না হয় হলো, বসন্তদাস এবার সহজ হয়। বলে, ধরে নিলাম দ্রোহের পতাকা উত্থাপিত হলো, রাজাও হলো নতুন–কিন্তু তারপর? ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদির আধিপত্য না থাকলেও অন্য কোনো শ্রেণীর আধিপত্য যে থাকবে না–তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? তথাগত ধর্ম তো সর্বত্রই ছিলো একদা–সেইকালে কি সামন্ত মহাসামন্তদের দৌরাত্ম ছিলো না? চণ্ডাল ডোমেরা কি তখনও নিগৃহীত হয়নি? বলুন আপনি?

মিত্রানন্দ কিন্তু নিজ বিশ্বাসে অবিচল। সে হাসে। বলে, প্রশ্নটা ধর্মীয়, যৌক্তিকতার নয় বসন্তদাস, প্রশ্নটা হলো মানব মুক্তির, মানব মুক্তির পথে যা অন্তরায় তা–ই অধর্ম এবং পরিত্যাজ্য–আমাদের এই দৃষ্টিতে সমগ্র বিষয়টি বিচার করে দেখতে হবে।

বসন্তদাস বিভ্রান্ত বোধ করে। বলে, আপনি যা বলছেন তা আমার ধারণায় আসে। মুক্তি কথাটি তো বিপজ্জনক–কোন বন্ধন থেকে মুক্তি সেটার নিশ্চয়ই উল্লেখ থাকতে হবে। অর্থাৎ একটি বিধিমালা আপনার থাকতে হবে–তার অর্থ আর একখানি অর্থশাস্ত্র। মানব মুক্তি তো বায়বীয় ব্যাপার হয়ে থাকলে চলবে না। এবং তখনই আপনার কার্যক্রমের ভিত্তিটি লোকে পেতে চাইবে–সেখানেই আসে ধর্ম এবং শাস্ত্র। বলতে হবে, আপনার ধর্ম কি প্রকার–বলতে হবে, সমাজ কি প্রকার বলতে হবে, ধন ব্যবস্থা কি প্রকার–মিত্রানন্দ, তাই বলছিলাম, যত সরল ও সহজভাবে আমরা প্রশ্নগুলি তুলছি–এগুলি এত সহজ ও সরল নয়।

আপনি কি তাহলে বিশ্বাস করেন, যে ব্যবস্থা এখন প্রচলিত, তাতেই মানুষ সুখী হবে? তাতেই জীবনের বিকাশ ধারা প্রবাহিত হবে? মিত্রানন্দ এবার স্পষ্ট উত্তর চায়।

না, আমি প্রচলিত ব্যবস্থায় তুষ্ট নই, বসন্তদাস জানায়। বলে, আমি জানি এই ব্যবস্থা আমার ধনার্জনের পথ উন্মুক্ত রাখেনি, আমাকে বিদ্যার্জন করতে দেয়নি–এমনকি, আমার মতো একজন সাধারণ মানুষও যে নিরুপদ্রব সংসার জীবনযাপন করবে, তারও কোনো সুযোগ সৃষ্টি করেনি–আমি প্রচলিত ব্যবস্থা চূর্ণ বিচূর্ণ ও বিধ্বস্ত করতে চাই কিন্তু এও আমি জানতে চাই যে, পরিবর্তে আমি কী পাবো।

মিত্ৰানন্দ হাসে। বলে, জীবনের প্রক্রিয়ায় পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস হবে বন্ধু, নতুন সৃষ্টি হোক অথবা না হোক।

না, তা সম্ভব নয়, বসন্তদাস জানায়, শূন্যতায় জীবন বিধৃত থাকে না।

তাহলে কি বলতে চান, তৃতীয় কোনো শক্তির আগমন ঘটবে? যার মধ্য দিয়ে ধর্ম সমাজ রাষ্ট্র সর্বত্র নতুন বিন্যাসের সূচনা হবে?

বসন্তদাস সচকিত হয়, এ কোন কথা বলছে মিত্রানন্দ? তার মনে ঐ তৃতীয় শক্তির কথাটি বিদ্ধ হয়ে যায়। সে আর কিছু বলে না। মিত্রানন্দের মুখপানে চায়। লক্ষ্য করে দেখে, সেখানে দুরভিসন্ধির কোনো ছায়াপাত দেখা যায় কিনা। দেখে, কোনো ছায়া নেই মিত্রানন্দের মুখে। সহজ, স্বচ্ছ, তপশ্চর্যায় শান্ত পবিত্র একখানি মুখ। তবু অস্বস্তি বোধ হয় তার। এবং তখন সে জানতে চায়, ভিক্ষু মিত্রানন্দ, সত্য সত্যই কি তৃতীয় শক্তির কথা আপনারা চিন্তা করেছেন?

না বসন্ত, সে কথা আমি জানি না, বিশ্বাস করুন। তবে আমার মনে হয়, বর্তমান ব্যবস্থার অবসান হওয়া উচিত না হলে জীবনের বিকাশ অসম্ভব। আমরা মানুষকে স্বপরিচয়ে উখিত হতে বলছি, নতজানু দাসত্বের জড়তা থেকে মুক্ত হতে বলছি–আমি এই পর্যন্ত জানি–এর অধিক আমার জানা নেই।

মিত্রানন্দ একখানি গোপন পত্র বহন করছে। পট্টিকেরা রাজ্যের যুবরাজ রণবঙ্কমল্লদের রচিত ঐ পত্রখানি তুলে দিতে হবে মহাভিক্ষু প্রজ্ঞানন্দের হাতে। তিনি এখন কোথায় সে সংবাদটিও জানা নেই। পুন্ড্রবর্ধনে গেলে তবে জানা যাবে তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারে এখনও অবস্থান করছেন, না জগদ্দল মহাবিহারে প্রস্থান করেছেন। ঐ পত্রের বিষয় কী তা সে জানে না। সে বাহক মাত্র, পত্রের বিষয় তার জানবার কথা নয়। তবে এটুকু সে অনুমান করতে পারে যে রণবঙ্কমল্লদের তাঁর নিজস্ব কোনো অভিমত জানিয়েছেন। ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ যে সংবাদ অথবা প্রস্তাব প্রেরণ করেছিলেন তারই প্রত্যুত্তরে এই অভিমত। এই অভিমত বিচার করেই ভিক্ষুসংঘ সিদ্ধান্ত নেবে। কী সিদ্ধান্ত হতে পারে তাও সে অনুমান করতে পারে না। তবে নিজে যখন ভিক্ষুসংঘের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে, তখন অবশ্যই জানতে পাবে কী সিদ্ধান্ত হলো শেষ পর্যন্ত। সে অস্থির হয় না।

বালিগ্রামে মন্দিরদাসীদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে তা জানবার জন্য দিন দুই অপেক্ষা করে অবশেষে মিত্রানন্দের সঙ্গে বসন্তদাস যাত্রা করলো। এবার গন্তব্য পুন্ড্রনগর, সে স্থান থেকে সংবাদ নিয়ে মিত্ৰানন্দকে যেতে হবে জগদ্দল অথবা বিক্রমশীলা আর বসন্তদাস যাবে স্বগৃহে।

আর কোনো ঘটনা ঘটেনি পথিমধ্যে। বিলম্বও হয়নি। পথিমধ্যে দুই বন্ধুর আলাপ হয়েছে জগতের নানান বিষয় নিয়ে। ক্রমে বন্ধুত্ব হয়েছে গাঢ়–সম্বোধন নেমে এসেছে তুমিতে। বসন্তদাস এখন অন্য মানুষ। গৃহ ত্যাগের সময় যে বসন্তের মনে চিন্তা ছিলো কি উপায়ে সে ধনী বণিক হবে, এখন সেই বসন্তের মনে ভিন্ন চিন্তা। তার দৃষ্টি এখন মানবজীবনের লাঞ্ছনা, অপমান এবং দাসত্বের দিকে। মনে এখন জ্বালা ও বেদনা। সেই সঙ্গে আর একটি নতুন ভাব জন্ম নিয়েছে মনে। অসহায় মানুষ দেখলে সে যুগপৎ ক্রুদ্ধ। ও করুণার্দ্র হয়ে ওঠে।

অবশেষে, দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে, প্রায় অর্ধ-বর্ষকাল শেষে, বসন্তদাস পত্নী মায়াবতীর কাছে প্রত্যাগমন করলো।

কিন্তু আমরা জানি, বসন্তদাস যুবতী স্ত্রী মায়াবতীর বাহুডোরে বাঁধা থাকতে পারেনি। কেননা তার স্বল্পকাল পূর্বে ঘটেছিলো পিপ্পলী হাটের ঘটনা। ফলে বসন্তদাসের গৃহীর জীবনযাপন আর হলো না। ভয়ানক দুষ্কাল তাকে তাড়িত করছে–তার সাধ্য কি যে সে গৃহসুখের আস্বাদ ভোগ করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *