ছিন্নমস্তার অভিশাপ – ৪

॥ ৪ ॥

রাজরাপ্পা হাজারিবাগ থেকে আশি কিলোমিটার। ৪৮ কিলোমিটার গিয়ে রামগড় পড়ে, সেখান থেকে বাঁয়ে রাস্তা ধরে গোলা বলে একটা জায়গা হয়ে ভেড়া নদী পর্যন্ত গাড়ি যায়। নদী হেঁটে পেরিয়ে খানিকদূর গিয়েই রাজরাপ্পা।

শঙ্করলাল মিশ্রের গাড়ি নেই। তিনি আমাদের গাড়িতেই এলেন। দু’জন বেয়ারাকেও নেওয়া হয়েছে পিকনিকের দলে, তাদের একজন হল বুড়ো নূর মহম্মদ, যে মহেশবাবুর ওকালতির জীবনের শুরু থেকে আছে। অন্য জন হল ষণ্ডা মার্কা জগৎ সিং, যার জিম্মায় রয়েছে অরুণবাবুর বন্দুক আর টোটার বাকস।

মিঃ মিশ্রকে দেখেই বেশ ভালো লেগেছিল, তার সঙ্গে কথা বলে আরো ভালো লাগল। ভদ্রলোকের জীবনের ঘটনাও শোনবার মতো। শঙ্করলালের বাবা দীনদয়াল মিশ্র ছিলেন মহেশবাবুর দারোয়ান। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে, যখন শঙ্করলালের বয়স চার—দীনদয়াল নাকি একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। দু’দিন পরে এক কাঠুরে তার মৃতদেহ দেখতে পায় মহেশবাবুর বাড়ি থেকে প্রায় সাত-আট মাইল দূরে একটা জঙ্গলের মধ্যে। কোনো জানোয়ারের হাতে তার মৃত্যু হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দীনদয়াল ওই জঙ্গলে কেন গিয়েছিল সেটা জানা যায়নি। একটা পুরনো শিবমন্দির আছে সেখানে, কিন্তু দীনদয়াল কোনোদিন সেখানে যেত না।

এই ঘটনার পর থেকে নাকি মহেশবাবুর ভীষণ মায়া পড়ে যায় বাপহারা চার বছরের শিশু শঙ্করলালের উপর। তিনি শঙ্করলালকে মানুষ করার ভার নেন। শঙ্করলালও খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিল; পরীক্ষায় বৃত্তি পায়, বি এ পাশ করে রাঁচিতে শঙ্কর বুক স্টোর্স নামে একটা বইয়ের দোকান খোলে। হাজারিবাগে ব্রাঞ্চ আছে, দু জায়গাতেই যাতায়াত আছে ভদ্রলোকের।

এই খবরটা শুনে অবিশ্যি লালমোহনবাবু জিগ্যেস করার লোভ সামলাতে পারলেন না এই বইয়ের দোকানে বাঙলা বইও পাওয়া যায় কিনা। ‘নিশ্চয়ই’, বললেন শঙ্কলাল, ‘আপনার বইও বিক্রী করেছি আমরা।’

ফেলুদা সব শুনে বলল, ‘মহেশবাবুর দ্বিতীয় ছেলে তাহলে আপনারই বয়সী ছিলেন?’

‘বীরেন্দ্র ছিল আমার চেয়ে কয়েকমাসের ছোট’, বললো শঙ্করলাল। ‘আমরা দুজন ইস্কুলে এক ক্লাসেই পড়েছি, যদিও কলেজের পড়াটা ওরা তিন ভাইই করেছে কলকাতায় ওদের এক জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে থেকে। বীরেনের পড়াশুনায় মন ছিল না। সে ছিল বেপরোয়া, রোম্যান্টিক প্রকৃতির ছেলে। উনিশ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।’

ফেলুদা বলল, ‘মহেশবাবু কি সাধুসংসর্গ-টর্গ করেন নাকি?’

‘আগে করতেন না মোটেই, তবে ওঁর জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি যদিও দেখিনি, তবে শুনেছি এককালে মিলিটারি মেজাজ ছিল, প্রচুর মদ্যপান করতেন। সব ছেড়ে দিয়েছেন। সাধুসঙ্গ না করলেও, আমার বিশ্বাস আজ রাজরাপ্পায় পিকনিকের কারণ ছিন্নমস্তার মন্দির।’

‘এটা কেন বলছেন?’

‘উনি বাইরে বিশেষ প্রকাশ করেন না, কিন্তু আমি এর আগেও কয়েকবার রাজরাপ্পা গিয়েছি ওঁর সঙ্গে। মন্দিরের সামনে এলে ওঁর মুখের ভাব বদলে যায় এটা লক্ষ করেছি।’

‘অতীতে কি এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে যার ফলে এটা হওয়া সম্ভব?’

‘সেটা আমি বলতে পারব না। ভুলে যাবেন না, আমি ছিলাম ওঁর দারোয়ানের ছেলে।’

সাড়ে দশটা নাগাৎ পরপর তিনখানা গাড়ি এসে থামল ভেড়া নদীর ধারে। আমাদের গাড়িটা ছিল সবচেয়ে পিছনে; আমাদের সামনে প্রীতীনবাবুর গাড়ি। তিনিই প্রথমে নামলেন গাড়ি থেকে, হাতে টেপ রেকর্ডার আর নেমেই চলে গেলেন বাঁয়ে জঙ্গলের দিকে। আমরা সবাই নামলাম। মহেশবাবু ছিলেন প্রথম গাড়িতে, তিনি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘তাড়া নেই, নদী পেরিয়েই রাজরাপ্পা, সঙ্গে ফ্লাস্কে কফি আছে, একটু রিল্যাক্স করে তবে ওপারে যাত্রা।’

আমরা সবাই নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। পাহাড়ে নদী, যাকে বলে খরস্রোতা। বর্ষার ঠিক পরে এ নদী পেরোন নাকি মুশকিল, কারণ তখন জল থাকে হাঁটু অবধি। ছোট বড় মেজ সেজো নানান সাইজের সাদা কালো খয়েরি পাটকিলে ছিটদার সব পাথর ডিঙিয়ে পাশ কাটিয়ে, যুগ যুগ ধরে সেগুলোকে মোলায়েম করে, পালিশ করে ব্যস্তবাগীশ ভেড়া নদী তড়িঘড়ি ছুটে চলেছে দামোদরে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। এই ঝাঁপের জায়গাই হল রাজরাপ্পা।

নীলিমা দেবী কফি ঢেলে দিলেন কাগজের কাপে, আমরা সবাই একে একে গিয়ে নিয়ে নিলাম। প্রীতীনবাবুকে বোধহয় নদীর শব্দ বাঁচিয়ে পাখির ডাক রেকর্ড করতে হবে বলে বনের একটু ভিতর দিকে যেতে হয়েছে। পাখি যে ডাকছে নানারকম সেটা ঠিকই।

এখানে এসে নতুন যাদের সঙ্গে আলাপ হল, ফেলুদার কায়দায় তাদের একটু স্টাডি করার চেষ্টা করলাম।

বয়সে যে সবচেয়ে ছোট, সে তার ডলটাকে একটা পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘চুপটি করে বসে থাক। দুষ্টমি করলেই ভেড়া নদীতে ফেলে দেব, তখন দেখবে মজা।’

অরুণবাবু হাত থেকে কাগজের কাপ ফেলে দিয়ে একটু দূরে একটা ঝোপের পিছনে অদৃশ্য হলেন, আর তার পরেই ঝোপের মাথার উপর ধোঁয়া দেখে বুঝলাম এই বয়সেও ভদ্রলোক বাপের সামনে সিগারেট খান না।

মহেশ চৌধুরী হাত দুটো পিছনে জড়ো করে নদীর কাছেই দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে জলের দিকে চেয়ে আছেন।

ফেলুদা দুটো পাথর ঠোকাঠুকি করে সেগুলো চকমকি কিনা পরীক্ষা করছিল, অখিলবাবু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনার রাশিটা কি জানা আছে?’ ফেলুদা বলল, ‘কুম্ভ। সেটা গোয়েন্দার পক্ষে ভালো না খারাপ?’

নীলিমা দেবী মাটি থেকে একটা বুনো হলদে ফুল তুলে সেটা খোঁপায় গুঁজে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে গিয়ে কী একটা বলায় লালমোহনবাবু মাথাটা পিছনে হেলিয়ে স্মার্টলি হাসতে গিয়ে এক লাফে বাঁয়ে সরে গেলেন, আর নীলিমা দেবী খোলা হাসি হেসে বললেন, ‘সে কী, আপনি গিরগিটি দেখে ভয় পাচ্ছেন?’

শঙ্করলালকে খুঁজতে গিয়ে দেখি উনি ইতিমধ্যে কখন জানি নদী পেরিয়ে গিয়ে ওপারে একজন গেরুয়াধারী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। একটা বাসে কিছু, যাত্রী এসেছিল, তারা একটুক্ষণ আগেই নদী পেরিয়েছে সেটা দেখেছিলাম।

কফি খাওয়া শেষ, প্রীতীনবাবুও এসে গেছেন, তাই আমরা ওপারে যাবার জন্য তৈরি হলাম। ধুতি, শাড়ি, প্যান্ট সবই একটু ওপরদিকে উঠে গেল, বিবি চড়ে বসল বুড়ো নূর মহম্মদের পিঠে, লালমোহনবাবু জলে নামবার আগে মনে হল চোখ বুজে কী জানি বিড়বিড় করে নিলেন, পেরোবার সময় বার তিনেক বেসামাল হতে হতে সামলে নিলেন, আর ওপারে পৌঁছিয়েই বললেন ব্যাপারটা যে এত সহজ সেটা উনি ভাবতেই পারেননি।

বাকি পথটার দু পাশে গাছপালা ছিল, যদিও সেটাকে জঙ্গল বলা চলে না। তাও লালমোহনবাবু সেদিকে বারবার আড়চোখে চাওয়াতে বুঝলাম উনি বাঘের কথা ভোলেননি।

একটা মোড় ঘুরতেই থিয়েটারের পর্দা সরে যাওয়ার মতো চোখের সামনে রাজরাপ্পা বেরিয়ে পড়াতে লালমোহনবাবু এত জোরে বাঃ বললেন যে পাশের গাছ থেকে একসঙ্গে দুটো ঘুঘু উড়ে পালাল।

অবিশ্যি বাঃ বলার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমরা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে দুটো নদীই দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকে উত্তরে ভেড়া, আর ডাইনে নিচে দামোদর। জলপ্রপাতের জায়গাটা দেখতে হলে আরো এগিয়ে বাঁয়ে যেতে হবে, যদিও শব্দটা এখান থেকেই পাচ্ছি। সামনে আর নদীর ওপারে বিশাল বিশাল কচ্ছপের পিঠের মতো পাথর, দূরে বন, আর আরো দূরে আবছা পাহাড়ের লাইন।

মন্দির আমাদের বাঁয়ে বিশ হাতের মধ্যে। বোঝাই যায় অনেকদিনের পুরোন, কিন্তু সেটাকে আবার নতুন করে সাজগোজ পরানো হয়েছে। এই ক’দিন আগেই কালীপুজোতে এখানে মোষ বলি হয়েছে বলে শুনলাম। লালমোহনবাবু বললেন এককালে নির্ঘাৎ নরবলি হত। অবিশ্যি সেটা যে খুব ভুল বলেছেন তা হয়ত না। বাসে যেসব যাত্রী এসেছে তাদের দৃশ্য দেখার উৎসাহ নেই, তারা সবাই মন্দিরের সামনে জড়ো হয়েছে। শঙ্করলাল ঠিকই বলেছিলেন। মহেশ চৌধুরী প্রায় মিনিট খানেক ধরে মন্দিরের দরজার দিকে চেয়ে রইলেন, যদিও অন্ধকারে বিগ্রহটা দেখাই যায় না। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেলেন অন্যরা যেদিকে গেছে সেইদিকে। আমরা তিনজনও সেইদিকেই এগিয়ে গেলাম।

খানিকটা যেতেই ফল্‌সটা দেখতে পেলাম। যেখানে বালির উপর সতরঞ্চি পাতা হচ্ছে সেখান থেকে ওটা দেখা যাবে। লালমোহনবাবু বললেন, ‘এটা কিন্তু ফাউ হয়ে গেল মশাই। হাজারিবাগ এসে সেকেণ্ড দিনেই একজন রিটায়ার্ড অ্যাডভোকেটের জন্মদিনে পিকনিকে ইনভাইটেড হবেন, এটা কি ভাবতে পেরেছিলেন?’

‘এ তো সবে শুরু’, বলল ফেলুদা।

‘বলছেন?’

‘দাবা খেলেছেন কখনো?’

‘রক্ষে করুন মশাই।’

‘তাহলে ব্যাপারটা বুঝতেন। দাবার শেষ দিকে যখন দু’পক্ষের পাঁচটি কি সাতটি ঘুঁটি বোর্ডের এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন অনড় অবস্থাতেই তাদের পরস্পরের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ চলতে থাকে। যারা খেলছে তারা তাদের প্রত্যেকটি স্নায়ু দিয়ে ব্যাপারটা অনুভব করে। এই চৌধুরী পরিবারটিকে দেখে আমার দাবার ঘুঁটির কথা মনে হচ্ছে, যদিও কে সাদা কে কালো, কে রাজা কে মন্ত্রী, তা এখনো বুঝিনি।’

আমরা মন্দির আর পিকনিকের জায়গার মাঝামাঝি একটা জায়গায় একটা অশ্বখগাছের তলায় পাথরের উপর বসলাম। এগারোটাও বাজেনি এখনো, খাবার তাড়া নেই, সবাইয়ের মধ্যে একটা নিশ্চিন্ত ঢিলেঢালা ভাব। অখিলবাবু বালিতে উবু হয়ে বসে বিবিকে হাত নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছেন; নীলিমা দেবী সতরঞ্চিতে বসে তাঁর ব্যাগের ভিতর থেকে একটা ইংরিজি পেপারব্যাক বার করলেন, সেটা নির্ঘাৎ ডিটেকটিভ বই; প্রীতীনবাবু একটি ঢিবির উপর বসে তাঁর টেপ রেকর্ডারে একটা নতুন ক্যাসেট ভরলেন; অরুণবাবু, জগৎ সিংয়ের কাছ থেকে তাঁর বন্দুকটা নিলেন, মহেশবাবু মাটি থেকে একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে সেটা নেড়ে চেড়ে দেখে আবার ফেলে দিলেন। ‘শঙ্করলালকে দেখছি না’, বললেন লালমোহনবাবু।

‘আছেন, তবে দূরে’, বলল ফেলুদা।

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম মন্দির ছাড়িয়ে আরো বেশ কিছুটা দক্ষিণে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে শঙ্করলাল কিছুক্ষণ আগে দেখা সেই গেরুয়াধারীটির সঙ্গে কথা বলছেন। ‘একটু যেন সাস্‌পিশাস বলে মনে হচ্ছে’, মন্তব্য করলেন লালমোহনবাবু।

ফেলুদারও সাস্‌পিশাস মনে হচ্ছে কিনা সেটা জানবার আগেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন অরুণবাবু, তাঁর হাতে বন্দুক। ‘ওটা দিয়ে কি বাঘ মারা যায়?’ জিগ্যেস করল ফেলুদা।

‘সার্কাসের বাঘ এতদূর আসবে না’, হেসে বললেন অরুণবাবু। ‘সাম্বার মেরেছি এটা দিয়ে, তবে সাধারণত পাখিটাখিই মারি। এটা টোয়েন্টি-টু।’

‘তাই ত দেখছি।’

‘আপনি শিকার করেন?’

‘শুধু মানুষ!’

‘আপনার কি কোনো এজেন্সি আছে নাকি? না প্রাইভেট?’

ফেলুদা তার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর লেখা একটা কার্ড অরুণবাবুকে দিয়ে দিল। ভদ্রলোক বললেন, ‘থ্যাঙ্কস। কখন কাজে লেগে যায় বলা ত যায় না।’

ভদ্রলোক যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেইদিকেই চলে গেলেন। ফেলুদা এই ফাঁকে কখন যে সেই সকালের কাগজটা পকেট থেকে বের করেছে সেটা দেখতেই পাইনি। লালমোহনবাবু কাগজটার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘বাঙলা নামের কথা কী বলছিলেন মশাই?’

‘এই দেখুন।’

ফেলুদা পাশাপাশি লেখা চারটে ইংরিজি অক্ষরের দিকে দেখাল। লালমোহনবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘ওটা ত মনে হচ্ছে লক্‌ লিখতে গিয়ে বানান ভুল করে LOKC লিখেছে।’

‘এলোকেশী!’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। এরকম ভাবে ইংরিজি অক্ষরে বাঙলা কথা আমিও লিখেছি ছেলেবেলায়।

‘বাঃ’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘সত্যিই ত। আর এই জাপানী নামটা?’

‘ওকাহা? এটা একটা বাংলা সেনটেন্স। OKAHA।’

‘ও, কে, এ, এইচ, এ? এটা একটা বাংলা সেনটেন্স? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি?’

‘ও, কে, এ, এইচ, এ—এটা তাড়াতাড়ি বলুন ত, না থেমে। দেখুন ত কি রকম শোনায়।’

এবার লালমোহনবাবুর মুখে একটা বিস্ময় আর খুশি মেশানো ভাব দেখা দিল। ‘ও কে এয়েছে! ওয়ান্ডারফুল!…বাঃ, বাঃ, এইত, জলের মত সোজা—SO—এসো; DO—দিও; NADO—এনে দিও; NHE—এনেচি।—ও বাব্বা! এটা যে বিরাট সেনটেন্স; এর ত শেষ নেই মশাই!—AKLO ATBB BBSO ADK SO RO ADK SO AT KLO PC LO ROT OT DD OK OJT RO OG এ আমার সাধ্যি নেই।’

‘ধৈর্য নেই বলুন। তোপ্‌সে পড়। পাংচুয়েট করে নিলে জলের মত সোজা।’

খুব বেশি না ঠেকেই পড়ে গেলাম আমি।—

‘এ কে এল? এটি বিবি। বিবি এস। এদিকে এস। আরো এদিকে এস। এটি কে এল? পিসি এল। আর ওটি? ওটি দিদি। ও কে? ও জেঠি। আর ও? ও ঝি।’

‘ওটা কোথায় পেলেন আপনারা?’ মহেশবাবু হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছেন।

‘আপনার বাগানের ধারে পড়ে ছিল,’ বলল ফেলুদা।

‘বিবিদিদিমণির সঙ্গে একটু খেলা করছিলাম আর কি।’

‘সেটা আন্দাজ করেছি’, বলল ফেলুদা। আমরা তিনজনেই উঠতে যাচ্ছিলাম, ভদ্রলোক বাধা দিয়ে আমাদের পাশেই পাথরের উপর বসে পড়লেন।

‘আরেকটি কাগজ দেখাব আপনাদের।’

মহেশবাবুর মুখে আর হাসি নেই। পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে তার ভিতর থেকে একটা পুরোন ভাঁজ করা পোস্টকার্ড বার করলেন।—‘আমার দ্বিতীয় পুত্রের শেষ পোস্টকার্ড।’

ফেলুদা পোস্টকার্ডটা নিয়ে ভাঁজ খুলল। একদিকে রঙীন ছবি। লেক সমেত জুরিখ শহরের দৃশ্য। উল্টোদিকে শুধুই নাম ঠিকানা দেখে আমরা সকলেই বেশ অবাক।

মহেশবাবু বললেন, ‘শেষের দিকে ও তাই করত। শুধু জানান দিয়ে দিত কোথায় আছে। আগেও দু’ এক লাইনের বেশি লেখেনি কখনো।’

ভদ্রলোক ফেলুদার হাত থেকে পোস্টকার্ডটা নিয়ে আবার ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিলেন।

ফেলুদা বলল, ‘বীরেনবাবু বিলেতে কী করতেন সেটা জানতে পেরেছিলেন?’

মহেশবাবু মাথা নাড়লেন। মামুলি চাকরি করার ছেলে ছিল না বীরেন। সে ছিল যাকে বলে রেবেল। একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। গতানুগতিকের একেবারে বাইরে। তার আবার একটি হিরো ছিল। বাঙালী হিরো। একশো বছর আগে তিনিও নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজের খালাসী হয়ে বিলেত যান। তারপর শেষ পর্যন্ত ব্রেজিল না মেক্সিকো কোথায় গিয়ে আর্মিতে ঢুকে কর্নেল হয়ে সেখানকার যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব দেখান।’

‘সুরেশ বিশ্বাস কি?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল। লালমোহনবাবুরও চোখ চকচক করে উঠেছে। বললেন, ‘ইয়েস ইয়েস, সুরেশ বিশ্বাস। ব্রেজিলে মারা যান ভদ্রলোক। কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস।’

মহেশবাবু বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। ওই নাম। কোত্থেকে তার একটা জীবনী জোগাড় করেছিল, আর সেটা পড়েই ওর অ্যাডভেঞ্চারের শখ হয়। আমি বাধা দিইনি। জানতাম দিলে কোনো ফল হবে না। উধাও হয়ে গেল। তারপর মাস দুয়েক পরে এল ইউরোপ থেকে এক চিঠি। হল্যাণ্ড, সুইডেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া… কী করছে কিছু বলে না, শুধু জানিয়ে দেয় সে আছে। চলে গেছে বলে যেমন দুঃখ হত, তেমনি নিজের চেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে বলে গর্বও হত। তারপর সিক্সটি সেভনের পর আর চিঠি নেই।’

মহেশবাবু কিছুক্ষণ উদাস চোখে দূরের গাছপালার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘সে আর আমার কাছে আসবে না। এত সুখ আমার কপালে নেই। আমার উপরে যে অভিশাপ লেগেছে!’

‘সে কি হে, তুমি আবার অভিশাপ-টভিশাপে বিশ্বাস কর কবে থেকে?’—অখিলবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। মহেশবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তুমি আমার কোষ্ঠীই বিচার করেছ অখিল, মানুষটাকে বিচার করনি।’

‘ওইখানেই ত ভুল’, বললেন অখিলবাবু, ‘মানুষের কুষ্ঠী, মানুষের রাশি গ্রহ লগ্ন—এ সবের থেকে ত আলাদা নয় মানুষ। তোমায় বলেছিলুম সেই ফর্টিটুতে, যে তোমার জীবনে একটা বড় চেঞ্জ আসছে—মনে আছে তোমার? —শুনুন মশাই—’ ফেলুদার দিকে ফিরলেন অখিলবাবু—‘এই যে দেখছেন এঁকে, এখন দেখলে বুঝতে পারবেন কি যে ইনি এককালে রাঁচি টু নেতারহাট যাবার পথে এঁর একটি পুরোন ফোর্ড গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়ায় তার উপর রাগ করে সেটাকে পাহাড় থেকে হাজার ফুট নিচে ফেলে দিয়েছিলেন?’

মহেশবাবু উঠে পড়েছিলেন। বললেন, ‘বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায় সেটা বলে দিতে কি জ্যোতিষীর দরকার হয়?’

কথাটা বলে মহেশবাবু উত্তরদিকে চলে গেলেন, বোধহয় পাথরের সন্ধানে। অখিলবাবু বসলেন তাঁর জায়গায়। গল্প বলার মুডে ছিলেন ভদ্রলোক। বললেন, ‘আশ্চর্য লোক এই মহেশ। আমি ওঁর পড়শী ছিলাম। যদিও অন্য দিক দিয়ে ব্যবধান বিস্তর। আমি শিক্ষক, আর ও উদীয়মান অ্যাডভোকেট। ওর ছেলেদের টিউশনি করেছি কিছুদিন, সেই থেকে আলাপ। অ্যালোপ্যাথিতে আস্থা ছিল না, তাই অসুখ-টসুখ করলে মাঝে মাঝে শিকড় বাকল চেয়ে নিত আমার কাছে। সামাজিক ব্যবধানটা কোনোদিন বুঝতে দিত না। আমার ছেলেকেও নিজের ছেলের মতই স্নেহ করত। কোনো স্নবারি ছিল না।’

‘আপনার ছেলে কী করে?’

‘কে, অধীর? অধীর ইঞ্জিনিয়ার। বোকারোয় আছে। খড়্গপুরে পাশ করে ডুসেলডর্ফে চাকরি নিয়ে চলে গেসল। বিদেশেই ছিল বছর দশেক, তারপর—’

একটা বিস্ফোরণের শব্দ অখিলবাবুর কথা থামিয়ে দিল। ‘বন্দুক!’—চেঁচিয়ে উঠল বিবি—‘জেঠু পাখি মেরেছে! আমরা রাত্তিরে তিতিরের মাংস খাব!’

‘দেখি মহেশ আবার কোথায় গেল।’ অখিলবাবু যেন কিছুটা চিন্তিত ভাবেই উঠে পড়লেন। ‘পাথর খুঁজতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে-টড়ে গেলে জন্মদিনটাই…’

‘পিকনিক বলে মনেই হচ্ছে না।’ প্রীতীনবাবুর স্ত্রী হাতের বইটা বন্ধ করে সতরঞ্চির উপর রেখে উঠে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ‘সবাই এমন ছড়িয়ে আছে কেন বলুন ত?’

‘খিদে পেলেই সুড়সুড় করে এসে হাজির হবে,’ বলল ফেলুদা।

‘কিছু খেললে হত না?’

‘তাস?’ বললেন লালমোহনবাবু, ‘আমি কিন্তু স্ক্রু ছাড়া আর কিছু জানি না।’

‘তাও আবার ঢিলে,’ বলল ফেলুদা।

‘তাস ত আনিনি সঙ্গে,’ বললেন নীলিমা দেবী। ‘এমনি মুখে মুখে কিছু খেলা যেতে পারে।’

‘জল-মাটি-আকাশ হলে লালমোহনবাবু যোগ দিতে পারেন,’ বলল ফেলুদা।

‘সেটা আবার কী মশাই?’

‘খুব সহজ,’ বললেন নীলিমা দেবী, ‘ধরুন, আপনার দিকে তাকিয়ে আমি জল, মাটি, আকাশ এই তিনটের যে কোনো একটা বলে দশ গুনতে শুরু করব। জল বললে জলের, মাটি বললে মাটির, আর আকাশ বললে আকাশের একটা প্রাণীর নাম করতে হবে আপনাকে ওই দশ গোনার মধ্যে।’

‘এটা খুব কঠিন খেলা বুঝি?’

‘খেলে দেখুন একবার। আমি আপনাকেই প্রশ্ন করছি।’

‘বেশ। রেডি।’ লালমোহনবাবু দম নিয়ে সোজা হয়ে যোগাসনে বসলেন। নীলিমা দেবী ভদ্রলোকের চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন—

‘আকাশ! এক দুই তিন চার পাঁচ—’

‘এঁ-এঁ-এঁ—’

‘ছয় সাত আট নয়—’

‘বেঙুর!’

ছিন্নমস্তার অভিশাপ – ৪

ফেলুদা অবিশ্যি জানতে চাইল বেঙুরটা কোন গ্রহের আকাশে চরে বেড়ায়। তাতে লালমোহনবাবু বললেন যে ব্যাঙ, হাঙর আর বেলুন—এই তিনটে তিনি ভেবে রেখেছিলেন, বলার সময় তালগোল পাকিয়ে গেছে। তাতে ফেলুদা বলল যে বেলুনকে প্রাণী বলা যায় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে; কিন্তু লালমোহনবাবু কথাটা মানতে চাইলেন না। বললেন, ‘বেলুনে অক্সিজেন লাগে, প্রাণীরও অক্সিজেন ছাড়া চলে না, সুতরাং প্রাণী বলব না কেন মশাই?’ ফেলুদা বলল যে সে হাওয়া, হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের বেলুনের কথা শুনেছে, এমন কি কয়লার গ্যাসের বেলুনের কথাও শুনেছে, কিন্তু অক্সিজেন বেলুনের কথা এই প্রথম শুনল।

নীলিমা দেবী তর্ক থামানোর জন্য হাত তুলেছিলেন, ঠিক সেই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটল যে তর্ক আপনিই থেমে গেল।

প্রীতীন্দ্রবাবু।

মানুষে একসঙ্গে দুঃখ আর আতঙ্ক অনুভব করলে তার কিরকম ভাবভঙ্গী হতে পারে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির করা তার একটা ড্রইং ফেলুদা একবার আমাকে দেখিয়েছিল। প্রীতীনবাবুর চেহারা অবিকল সেই ছবির মতো।

ভদ্রলোক একটা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়লেন।

নীলিমা দেবী ছুটে গেলেন স্বামীর দিকে, যদিও ফেলুদা তার আগেই পৌঁছে গেছে। কিন্তু ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে কথা বেরোতে বেশ সময় লাগল।

‘বা…বা…বাবা!’ বললেন প্রীতীনবাবু, আর সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতটা পিছন দিকে নির্দেশ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *