০৪. নদী এ স্থানে অগভীর

নদী এ স্থানে অগভীর। উজুবট থেকে স্থানটি ক্রোশ চারেক উত্তরে। নদীবক্ষে স্থানে স্থানে বালুকাস্তূপ। নৌকাটি পরপারে উপনীত হতে সময় নেয়। নৌকার অন্যান্য আরোহীদের আলাপ শ্রবণে অনুমান হয় নদীর পূর্বতীরে গোহালিহাট, বিল্বগ্রাম, সুনন্দপুর ইত্যাদি গ্রাম জনপদগুলি পরস্পর নিকটবর্তী। পরপারের কদম্বঘাট থেকে ঐ সকল গ্রামের দিকে যাওয়ার সুব্যবস্থাও নাকি আছে। প্রায় প্রতিদিনই দুএকখানি গো অথবা মহিষ শকট ঐ সকল গ্রামে যায়।

বসন্তদাসের গন্তব্য স্থির নয়। নদীতীরে সংবাদাদি নিয়ে তবে নিজ গন্তব্য স্থির করতে হবে।

নৌযানটি যখন তীরবর্তী হলো তখন সকাল। সবে সূর্যোদয় হয়েছে। নদীবক্ষে বীচিমালার শীর্ষে শীর্ষে নবীন সূর্যালোক এমত ঝলকিত হচ্ছে যে সেদিকে দৃষ্টি রাখা যায় না। রাখলে নয়ন ধাঁধে। নদীজলে কয়েকজন স্নানার্থী ছিলো, তাদের একজন সূর্যস্তর সমাপন করে একজন নৌকারোহীকে ডেকে বললো, ওহে পীতাম্বর, তুমি এতো বিলম্ব করলে কেন, তোমার শ্যলিকাটির অবস্থা ওদিকে এখন–তখন, শীঘ গৃহে যাও।

পীতাম্বর কিছু বলে না, সে অধোমুখে থাকে। তার বন্ধুটি মৃদু ভৎর্সনা করে বলে, এ তোমার উচিত হয়নি, ছি ছি!

তারা আরও কিছু বলাবলি করে, কিন্তু সেদিকে মনোযোগী হবার আর অবকাশ ছিলো না। কারণ নৌকাটি ঐ মুহূর্তেই ভূমিস্পর্শ করেছে। বসন্তদাস পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিটির কাছে জানতে চাইলো, বিল্বগ্রামের পথ কোনদিকে, বলবেন?

আহা দণ্ডকাল পূর্বে এলে তো শকটারোহণে যেতে পারতেন, লোকটি জানায়। বলে, পথ খুবই সহজ, এই পথই গোহালিহাট হয়ে বিশ্বগ্রামে গেছে।

মহাশয়, মনে হচ্ছে, নতুন এসেছেন এদিকে?

লোকটির কৌতূহল নিবৃত্ত করে বসন্তদাস। বলে, হ্যাঁ, নতুনই বলতে পারেন।

ক্ষণকাল পরে ঐ লোকটির কাছেই সে জানতে চাইলো, এখানে পান্থশালা নেই?

আজ্ঞে না, পান্থশালা নেই, তবে ঐ যে মন্দির দেখতে পাচ্ছেন, লোকটি হাত তুলে দেখায়, ওখানে যান, দূরের যাত্রীরা ওখানেই রাত্রিযাপন করে।

মন্দিরে তখন ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিলো। সেখানে জনসমাগমও হয়েছে দেখলো। সে মন্দিরের দিকেই অগ্রসর হলো।

একেবারে নিকটে নয় মন্দিরটি। পদব্রজে যেতে সময় লাগে। যখন উপস্থিত হলো, তখন আরতি চলছে। ভক্তরা চত্বরে যুক্ত করে দাঁড়িয়ে।

সেও দুই কর যুক্ত করে প্রথমে বিগ্রহের উদ্দেশে প্রণাম জানালো, তারপর অন্যদের মতো করযুগল যুক্ত করে দাঁড়ালো। সংক্ষিপ্ত আরতি, অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রসাদ বিতরণ আরম্ভ হয়ে যায়। তাতে বালক-বালিকারা প্রসাদ সংগ্রহের জন্য হয়ে ওঠে তৎপর। ফলে চাঞ্চল্য জাগে ক্ষণেকের জন্য।

প্রসাদ বিতরণ করছিলো একজন তরুণ এবং একজন যুবতী। তারা সম্ভবত মন্দিরের সেবক এবং সেবিকা। সেবিকাটি অপরূপ সুন্দরী। মস্তকোপরি অবগুণ্ঠন ছিলো, তথাপি উত্তোলিত হাত দুখানি ব্যস্ত থাকায় প্রভাতকালের বায়ুতাড়না তাকে বিস্ৰস্তবাসা করে দিলো। এবং ঐ মুহূর্তটিতে যা দৃষ্টিগোচর হলো তা যে কোনো পুরুষ মানুষকে আমূল চঞ্চল করে দেবার জন্য যথেষ্ট। বলাবাহুল্য, এমন রূপ–যৌবন কদাচিৎ দেখা যায়। কৃষ্ণার কথা মনে পড়ে গেলো বসন্তদাসের। ক্ষুদ্র একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে দুই পা পশ্চাতে ফিরলো। এবং ক্ষুদ্র জনসমাবেশটি থেকে কিঞ্চিৎ দূরে দাঁড়ালো।

ভক্ত এবং প্রসাদ প্রার্থীরা একে একে সকলেই বিদায় হলো। বসন্তদাস দুএকজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তারা কেউ-ই তার প্রতি মনোযোগী হয়নি। মন্দিরের সেবিকাটি সম্ভবত বসন্তদাসকে দেখে থাকবে। সে মন্দিরের দ্বারান্তরাল থেকে মন্দিরসেবক বালকটিকে ডেকে বললো, দেখো তো অংশুমান, লোকটি কি চায়?

মন্দিরটি সূর্যদেবতার। বিগ্রহটি ক্ষুদ্র কিন্তু ধাতু নির্মিত, প্রদীপের আলোকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। তরুণটি নিকটে এলে বসন্তদাস পুরোহিতের সন্ধান করলো। তাতে জানলো, পুরোহিত মন্দিরে থাকেন না, পূজা শেষে স্বগৃহে গমন করেন। স্বল্প পূর্বে যে বৃদ্ধটি চলে গেলেন, বসন্তদাস বুঝলো, তিনিই পুরোহিত। সন্ধ্যাকালে পুনরায় আসবেন। তখন সাক্ষাৎ হতে পারে।

মন্দিরের সেবিকা তখনও দ্বারান্তরালে এবং কৌতূহলী। অনুচ্চ কণ্ঠে জানতে চাইলো, আপনার কি বিশেষ প্রয়োজন? বৃদ্ধ মানুষ, সন্ধ্যাকালে নাও আসতে পারেন, তাহলে আপনাকে তাঁর গৃহে যেতে হবে।

বসন্তদাস চারিদিকে দৃষ্টিপাত করছিলো। এদেশে সূর্যদেবতার পূজা হয় জানে, কিন্তু মন্দির এই প্রথম দেখলো। এতদঞ্চলে সম্ভবত এই একটিই মন্দির। প্রাচীনতার চিহ্ন মন্দির গাত্রের প্রায় সর্বত্রই প্রকট। এইরূপ প্রায় অযত্নরক্ষিত মন্দিরেও সেবাদাসী রয়েছে দেখে সে অবাক হচ্ছিলো। দাসীটি সপ্রতিভ ভঙ্গীতে তখনও দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। বসন্তদাস জানালো, ভদ্রে, আমি কতিপয় আত্মীয়ের সন্ধান করছি, তারা একটি যবন উপদ্রুত গ্রাম থেকে পলায়ন করে এসেছেন–এই গ্রাম বা নিকটবর্তী কোনো গ্রামে, ঐ প্রকার পলায়নপর লোকেদের আগমনের সংবাদ কি আপনার জানা আছে?

দাসীটি দ্বারান্তরাল থেকে এবার বাইরে এলো। বললো, না জানা নেই তেমন লোকের সংবাদ–কিন্তু যবনরা কি সত্যই গ্রাম লুণ্ঠন আরম্ভ করে দিয়েছে?

মনে হলো, সেবিকাটি একেবারে অন্তঃপুরবাসিনী নয়। জগৎ সংসারের বহুবিধ বিষয় তার জানা। সে বললো, আপনি বরং মন্দিরের ভিতরে এসে কথা বলুন। মন্দির বলেই ভাববেন না যে এ স্থান নিরাপদ। এ স্থানেও গূঢ়পুরুষদের দৃষ্টি আছে।

কি অদ্ভুত কথা। সে বিস্ময় মানে, এই দেবমন্দিরের উপরও কেন দৃষ্টি রাখবে গূঢ়পুরুষেরা!

যুবতীটির মুখপানে দৃষ্টিপাত করা যায় না। বসন্তদাসের দৃষ্টি বার বার নত হয়ে আসছিলো। দৃষ্টি যে লগ্ন হয়ে থাকতে চায় ওষ্ঠদ্বয়ে, গ্রীবাদেশে, বক্ষে। এ তো বড় যন্ত্রণা। কৃষ্ণাকে দেখে তো এমন মনে হয়নি। সে নিদারুণ ব্ৰিত বোধ করে। সেবিকাটি তখনও বলছিলো, ক্রোশ দুই দূরে বিল্বগ্রাম। সেখানে সামন্ত সুধীমিত্র একটি বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করছেন। তার ধারণা, ঐ মন্দিরই হবে এতদঞ্চলের ধর্মীয় পীঠস্থান। তিনি মনে করেন, আমরা সূর্যোপাসকরা অন্তরে সদ্ধর্মী–সূর্যদেবতার পূজা করলেও। এবং এই মন্দির নাকি সদ্ধর্মীদের মিলিত হবার গোপন স্থান। এই সন্দেহের কথাটি তিনি প্রচারও করছেন।

মন্দিরদাসী আরও সংবাদ জানে। বললো, কেবল আপনাদের গ্রামেই নয়–আরও কয়েকটি গ্রামে ঐ প্রকার কাণ্ড ঘটেছে।

পূর্বে প্রতি পক্ষকালে দু’দশজন ভিক্ষু এসে এই মন্দিরে রাত্রিযাপন করতো, এখন তারা কেউ আসে না। পক্ষকাল পূর্বে এক যোগীর সঙ্গে দুটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রীলোক এই মন্দিরে রাত্রিযাপন করে গেছে–পরিচয় জানায়নি। তবে আমার সন্দেহ, তারা কোনো আক্রান্ত গ্রামের লোক।

দীর্ঘ আলাপ, বসন্তদাস ক্রমে সহজ হয়ে উঠলো। কথা বললো নানান প্রসঙ্গে। শেষে উঠলো, আমি এবার যাই।

সে কি, কোথায় যাবেন? দ্বিপ্রহরের তো বিলম্ব নেই, মন্দিরের প্রসাদ আছে, আহারাদি সম্পন্ন এখানেই করুন।

বসন্তদাস রীতিমতো সঙ্কোচ বোধ করে। এতো অল্প সময়ের পরিচয়–এই পরিচয়ে কি আতিথ্য গ্রহণ করা উচিত? সে সবিনয়ে মস্তক আনত করে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছিলো। ঐ সময় যেন নারী কন্ঠে আদেশ শুনলো। হ্যাঁ আদেশই বলতে হবে। দ্বারে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে রমণীটি। বলছে, আপনি মন্দিরে প্রবেশ করে দেবতাকে অপমান করতে চান?

অপমান! কী বলে এই উন্মাদিনী? সে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চায়।

নিশ্চয়ই অপমান! মন্দিরদাসীর কণ্ঠে যেন ক্রোধ শাণিত হয়ে ওঠে। তীক্ষ্ণ স্বরে সে বলে, পূজার প্রসাদ প্রত্যাখ্যান কি দেবতার অপমান নয়?

বসন্তদাস অনুধাবন করার চেষ্টা করে, সত্যই কি তার আচরণে কোনো অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে? মন্দিরদাসীর মুখপানে দৃষ্টি তোলে সে এবং বিভ্রান্ত বোধ করে। কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পেলেও রমণীর চক্ষু দুটিতে ক্রোধ কোথায়? বরং দেখতে পায় সেখানে কৌতুকের অস্পষ্ট একটি আভা কম্পমান।

যাক, তবে এ কৌতুক, অন্য কিছু নয়–স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বসন্তদাস। তার ভয় হচ্ছিলো। না জানি কী করে বসে রহস্যময়ী এই মন্দিরদাসী। সে কৃতাঞ্জলি হয়ে বিনয়সহকারে জানালো, উত্তম কথা ভদ্রে, আমি আপনার কথামতোই কাজ করবো।

এখানেই আপনি বিশ্রাম নিন। আদেশটি উচ্চারণ করে রমণীটি তৎক্ষণাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন এক দ্বার পথে অন্তর্হিত হয়।

মন্দিরের গর্ভগৃহটি অন্ধকার। সেখানে দিবানিশি প্রদীপ জ্বলে, কিন্তু বাহিরের অংশে প্রদীপের প্রয়োজন হয় না। মন্দিরচূড়ার গঠন কৌশলে সম্ভবত কোনো ব্যবস্থা করা আছে যাতে বাইরের আলোক মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। বসন্তদাস একটি স্তম্ভে পৃষ্ঠদেশ এলায়িত করে বসে ছিলো। ঐ সময় মন্দির গাত্রের একটি চিত্রণ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের ধাতুমূর্তিটির গঠন কিরূপ তা সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। তবে অনুমান, সপ্তাশ্ববাহী রথে আকাশমণ্ডল পরিক্রমণরত সূর্যদেবের মূর্তিটিই এই মন্দিরের বিগ্রহ। কিন্তু মন্দির গাত্রে এ কিরূপ অলংকরণ? তার বিস্ময় জাগে। একদিকে একটি বৃক্ষ অপরদিকে সকিরণ সূর্য, সেই সঙ্গে একটি সর্প বৃক্ষের কাণ্ডটি বেষ্টন করে আছে। বৃক্ষ, সূর্য এবং সর্পের এমন একত্র যোজনা তো সে পূর্বে কোথাও দেখেনি! সে মন্দির গাত্রে হাত রাখে–অসম্ভব শীতল বোধ হয়। তার মনে হয়, কাল যেন সংহত শিলীভূত ও স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে এই স্থানে। তার স্মরণ হয়, বালিগ্রামের অবলোকিতেশ্বর মন্দিরটির গাত্রেও এইরূপই শীতলতা অনুভব করেছিলো সে।

অংশুমান নিকটে এলে সে জিজ্ঞাসা করে, ভ্রাতঃ, মন্দির গাত্রে এ কিরূপ চিত্ৰণ? এমন চিত্ৰণ তো আমি অন্য কোথাও দেখিনি।

অংশুমান চিত্রণের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে, মহাশয়, এর ব্যাখ্যা আমরাও জানি না। তবে পুরোহিত বলেন যে, বহু প্রাচীনকালে সূর্যদেব এইরূপেই পূজিত হতেন–আমি শুধু এইটুকু জানি যে, এই মন্দির বহু প্রাচীন–এর অধিক আমি আর কিছু বলতে পারবো না।

মন্দিরদাসী কখনও সম্মুখে আসছিলো, কখনও অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো না যে বসন্তদাসের উপস্থিতি সম্পর্কে সে সচেতন। মন্দিরপ্রাঙ্গণে ইতোমধ্যে কয়েকটি পুরুষ কণ্ঠের আলাপ শুনতে পেয়েছে সে। একবার মনে হচ্ছিলো, মন্দিরদাসী যেন কাউকে তিরস্কার করছে। কাদের সঙ্গে ঐ বাদানুবাদ সে কিছু অনুমান করতে পারেনি। সে কৌতূহলী মনকে শাসন করেছে। নিজেকেই ডেকে বলেছে, ওহে বসন্তদাস, অধিক কৌতূহলী হয়ো না, নিজের চক্রে অগ্রে তৈলদান করো, পরে অন্যের কথা চিন্তা করতে যেও।

বাহিরে রৌদ্রদগ্ধ প্রাঙ্গণে বৃক্ষছায়া কাণ্ডের নিকটবর্তী হয়ে আসছিলো। বোঝা যাচ্ছিলো দ্বিপ্রহরের আর বিলম্ব নেই। বাহিরে যে বাদানুবাদ শোনা যাচ্ছিলো, এখন আর তা নেই। বসন্তদাসের চিন্তা হচ্ছিলো, অতঃপর মন্দির ত্যাগ করে কোন পথে গমন তার কর্তব্য? সে কি বিল্বগ্রামের দিকে যাবে, নাকি যাবে সুনন্দপুরের দিকে? একটি সূত্র তার। জানা প্রয়োজন। মন্দিরদাসীর কাছ থেকে শোনা সংবাদটি তাকে আশান্বিত করে তুলেছে। পক্ষকাল পূর্বে এ মন্দিরে এক যোগী পুরুষের সঙ্গে যে রমণী ও পুরুষ দুটি এসেছিলো, তারা যদি কোনো আক্রান্ত গ্রাম থেকে পলায়ন করে থাকে, তাহলে ওদের পক্ষেই শুকদেব ও মায়াবতীদের সংবাদ জানা সম্ভব। তার ধারণা, এই অঞ্চলেই কোথাও শুকদেব ও মায়াবতীরা আছে।

ঐ সময় মন্দিরের দাসী ক্ষণে ক্ষণে চত্বরের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো এবং আসছিলো। কেন, সেই জানে। তবে চক্ষুতে চক্ষুতে মিলন হলেই অতীব রহস্যময় হাসি ফুটছিলো তার ওষ্ঠপ্রান্তে।

বসন্তদাসের মনে হচ্ছিলো, বালিগ্রামের কৃষ্ণার চাইতেও অধিক রহস্যময়ী এই মন্দিরসেবিকাটি। কেন যে সে এভাবে তাকে আতিথ্য গ্রহণে বাধ্য করলো, তার ধারণায় আসে না। তবে হ্যাঁ, একটি বিষয়ে সে নিশ্চিত, তীব্র আকর্ষণ এই রূপসী নারীর। যদি সে প্রগলভা হয়ে বারেক আহ্বান করে, তাহলে যে কী হবে, সে চিন্তা করতে পারে না। কারণ পুরুষের সংযমী থাকার ক্ষমতা কতটুকু সে তো তার উত্তম রূপে জানা।

মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে ক্ষুদ্র চত্বরটিতে আসন দেওয়া হয়। প্রসাদে উপচার ছিলো বহুবিধ। তবে কিছু মিষ্টান্ন এবং কয়েকটি ফল মাত্র গ্রহণ করে সে। দুগ্ধ ক্ষীরাদি স্পর্শ করে না।

মন্দিরদাসী দ্বারদেশে উপস্থিত ছিলো। বললো, আপনি বোধ হয় এরূপ আহারে অভ্যস্ত নন।

কি যে বলেন, এ তো রাজভোগেরও অধিক, বসন্ত নতমুখে জানায়।

এ আপনার বিনয় ভাষণ।

কেন, বিনয় ভাষণ কেন হবে! বসন্ত রমণীর মুখপানে সপ্রশ্ন দৃষ্টি তোলে।

গৃহী মানুষের রুচি কিরূপ তা আমি জানি–মনে রাখবেন, এ মন্দিরে যারা প্রতিদিন আসে, তারা প্রত্যেকেই গৃহী।

হতে পারে, বসন্তদাস জানায়। কিন্তু এখন তো আমি গৃহে নেই, পথে পথে দিনযাপন করি। আজ আমার পরম সৌভাগ্য যে দেবতার প্রসাদ পেলাম–কাল যে কী পাবো, তার কি নিশ্চয়তা আছে কিছু, বলুন? এ মন্দিরে কি কাল আমার অবস্থান সম্ভব হবে?

মন্দিরদাসী ঐ কথায় গম্ভীর হয়। কিছু বলে না, দূর আকাশে তার দৃষ্টি প্রসারিত থাকে। ক্ষণকাল পরে সে ধীর কণ্ঠে বলে, ভবিষ্যতের কথা ভবিতব্য জানেন–বড় অনিশ্চিত আমাদের বর্তমান, আজো সামন্তপতির দুই অনুচর এসেছিলো মন্দিরে।

কেন, এখানে ওরা কী চায়? বসন্তদাস প্রশ্ন না করে পারে না।

কেন, জানেন না? মন্দিরদাসীর ওষ্ঠ প্রান্তে ঐ মুহূর্তে ক্ষীণ একটি শ্লেষের রেখা দেখা যায়। বলে, ওরা সদ্ধর্মীদের চায়, নাথযোগীদের চায়, সূর্যোপাসকদের চায়–প্রত্যেককেই ওদের সন্দেহ।

বসন্তদাসের মস্তিষ্কে হঠাৎ একটি নতুন চিন্তার উদয় হয়। সে বলে, মন্দির প্রাচীন হলেই ওদের সন্দেহ হয়–কেন, বলতে পারেন?

মন্দিরদাসীর মুখে পুনরায় ক্ষীণ হাসির রেখাটি দেখা যায়। বলে, জানি না, হয়তো প্রাকৃতজন ওদের ভয়ের কারণ–প্রাচীন মন্দিরগুলিই তো প্রাকৃতজনের সঙ্গে যুক্ত, বিষ্ণুমন্দির তো সেদিনকার ঘটনা–বৈষ্ণব আর কয়জন?

ব্যাখ্যাটি একেবারে অযৌক্তিক মনে হয় না। নতুবা প্রাচীন মন্দিরগুলিকে কেন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে? দেবীকোটের বজ্রতারা মন্দির, বালিগ্রামের অবলোকিতেশ্বর মন্দির, এবং কদম্বঘাটের এই সূর্যদেবতার মন্দির–এই তিনটি মন্দিরই প্রাচীন এবং এই প্রাচীন মন্দিরগুলিই একেকটি গোপন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র–অন্তত সামন্তপতি এবং রাজপুরুষেরা এইরূপই প্রচার করছে। এখন বোঝা যায়, কেবল সদ্ধর্মীরাই তাদের সন্দেহের পাত্র নয়। তারা সূর্যোপাসকদের সন্দেহ করছে, নাথযোগীদের সন্দেহ করছে, ব্রাত্যশ্রেণীর ডোম চণ্ডালদের সন্দেহ করছে–সন্দেহের আর শেষে নেই।

একটা কথা চিন্তা করেছেন? আচমন শেষে বসন্তদাস বলে।

কী কথা? মন্দিরদাসী সাগ্রহে অতিথির মুখপানে চায়।

যাদের ওরা সন্দেহ করে, সেই সন্দেহের পাত্ররা সকলে যদি একত্রিত হয়? যদি কোনো কারণে নির্যাতিত মানুষের অপমান–জ্বালা–বেদনা–হাহাকার–ক্রোধ–হিংস্রতা সমস্তই একত্রিত হয়ে বিস্ফোরিত হয়? তাহলে সামন্ত মহাসামন্ত রাজপুরুষদের ভবিষ্যৎ কী হবে?

চুপ, বলবেন না–আর বলবেন না।

বসন্তদাস দেখে মন্দিরদাসীর মুখভাবে শঙ্কা ও ত্রাসের ছায়া। সে প্রায় গোপন স্বরে জানায়, সাবধান, অমন কথা ভ্রান্তিবশতও মুখে আনবেন না।

বিদায়কালে মন্দিরদাসী বললো, আপনার পরিচয় কিন্তু জানা হলো না।

তার কি আর প্রয়োজন আছে? বসন্তদাস হাসে।

ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? মন্দিরদাসীর মুখভাবে বিষাদের ছায়া নামে। বলে, যে দুষ্কালের মধ্যে আমরা পতিত হয়েছি, তাতে কিছুই বলা যায় না–এই হীনা মন্দিরদাসীরও আপনাকে প্রয়োজন হতে পারে–অবশ্য নিজ পরিচয় যদি আপনি গোপন রাখতে চান, তাহলে ভিন্ন কথা–

ঐ উক্তির পর নিজের পরিচয়দানে কুণ্ঠাবোধ থাকার কথা নয়। বসন্তদাসেরও রইলো না। সে জানালো, অধমের নাম বসন্তদাস, নিবাস আত্রেয়ী–তীরের আম্রপট্টলী– রজতপট অঞ্চলে, পিতা ক্ষেত্রকর্ম করেন, তাঁর নাম–

থাক হয়েছে, মন্দিরদাসী ছায়ার জন্য ঐটুকুই যথেষ্ট।

বসন্তদাস রমণীটির বাকপটুতায় চমকিত হয়। নাম জানতে পেরে সে ঈষৎ হাসেও। বলে, আপনি তাহলে ছায়া–কিন্তু কিসের ছায়া?

কেন, ছায়ার বঙ্কিম ভ্রূধনুতে চকিতে শর যোজিত হয়। বলে, সূর্যের ছায়া, সূর্যদেব ব্যতীত ছায়া সৃষ্টি আর কে করতে পারে, বলুন?

ছায়ার হাসি শতধারে বিচ্ছুরিত হয় ঐ কথার পর। কিন্তু বসন্তদাস হাসিতে যোগ দিতে পারে না। এ কি কৌতুক? তার মনে প্রশ্ন জাগে। প্রত্যয় হতে চায় না যে ঐ ভ্রূভঙ্গী, ঐ হাস্যধারা, ঐ ভাষা, নিতান্তই কৌতুক সৃষ্টির কারণে।

অবশেষে ছায়া জানায়, আপনি যদি এ অঞ্চলে দিবস দুই অপেক্ষা করতে পারেন, তাহলে আশা করি, কোনো না কোনো সংবাদ অবশ্যই জানাতে পারবো।

আর হ্যাঁ, ছায়ার চক্ষু দুটিতে পুনরায় বিদ্যুৎ চমকিত হয়। বলে, আপনার রাত্রিযাপনের সমস্যা হলে স্মরণ রাখবেন, এ মন্দিরের দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত থাকে।

এ কি আমন্ত্রণ! বসন্তদাসের বিশ্বাস হতে চায় না। মন্দিরদাসীরা কি সর্বত্রই তাকে কণ্ঠলগ্ন করার জন্য উদ্বাহু হয়ে আছে? এ কি সম্ভব? সে মনের গোপনে একটি মধুর বিভ্রান্তি নিয়ে মন্দির ত্যাগ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *