০১. উজুবট গ্রামখানি যখন লুণ্ঠিত

০১.

উজুবট গ্রামখানি যখন লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয় তখন বসন্তদাস পুনর্ভবার পশ্চিম তীরের গ্রামগুলিতে ভিক্ষু মিত্রানন্দের সন্ধান করে ফিরছে। মিত্রানন্দকে তার বিশেষ প্রয়োজন। তাকে যে উজুবট গ্রামের উত্তরপাটক পল্লী থেকে পলায়ন করে আসতে হয়েছে শুধু সেই কারণেই নয়। তার আশঙ্কা হচ্ছিলো, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির শীঘ্রই পুনরাবৃত্তি হবে। সামন্ত হরিসেন তো আর একাকী ঘটনাটি ঘটাননি। তাঁর সঙ্গে বহু অনুচর ছিলো। ঐদিন যারা ঘটনাটি ঘটাতে সহায়তাদান করেছিলো তারা নিজেরাও যদি ঐ প্রকার ঘটনা ঘটাতে চায়, তাহলে কে বাধা দেবে? ব্যাঘ একবার শোণিতের স্বাদ পেলে তা কি আর ত্যাগ করে? একইসঙ্গে আবার সে শুনতে পাচ্ছিলো, যবন সেনাদল নাকি পশ্চিমে অবস্থান করছে। অশ্বারোহণে দশ/পঞ্চদশ ক্রোশ আর এমন কি দূরত্ব? তদুপরি জানে, লাঞ্ছিত অপমানিত ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ এই পথেই গমন করেছেন। এখন যদি তরুণ ভিক্ষুদের আগ্রহাতিশয্যে শুদ্ধানন্দ যবন সেনাদলকে আহ্বান করেন, তাহলে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হবে। নিকটবর্তী গ্রাম জনপদগুলি একেবারে শ্মশান হয়ে যাবে। তার ধারণা, এই ভয়াবহ সঙ্কটকালে পরিত্রাণের পথ কেউ যদি উদ্ভাবন করতে পারে তো সে হলো মিত্রানন্দ এবং তার সহচরেরা।

কিন্তু কোথায় মিত্ৰানন্দ? যে স্থানেই সে উপনীত হয়, সে স্থানেই শোনে, আহা দিনেক পূর্বে এলেন না–মাত্র গতকালই তিনি এ গ্রাম ত্যাগ করেছেন।

সে গ্রামের পর গ্রাম অতিক্রম করে যাচ্ছিলো। ঐ সময় মালঞ্চ হাটে এক গন্ধবণিক তাকে সংবাদটি দেয়। বিশদ কিছুই বলতে পারেনি সে। শুধু জানায় যে, উজুবট গ্রামখানি একেবারেই ভস্মসাৎ হয়েছে–একটি প্রাণীও নাকি রক্ষা পায়নি।

সংবাদটি আকস্মিক এবং ভয়াবহ। বসন্তদাস কয়েকমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে। পরক্ষণেই সে উদভ্রান্ত হয়ে ছুটতে আরম্ভ করে। বলা বাহুল্য, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থা হয় তার। তখন অপরাহ্নকাল, পথ নির্বিঘ্ন নয় এবং যেতেও হবে তিন ক্রোশাধিক পথ। কিন্তু সেসব বিষয়ে চিন্তা করার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিলো না।

দ্রুত পথক্ৰমণ করছিলো সে, আর ঐ সময় ক্ষণে ক্ষণে মায়াবতীর মুখখানি সে মনের ভেতরে দেখতে পাচ্ছিলো। বড় মায়া মুখখানিতে। তার বাহু দুখানির উষ্ণ স্পর্শ সে গণ্ডদেশে এখনও অনুভব করে। কি স্নিগ্ধ, কি পবিত্র এবং কি গম্ভীর হতে পারে প্রিয়তমা নারী, তা সে মায়াবতাঁকে না পেলে কখনই জানতে পারতো না। মায়াবতীর সান্নিধ্যই তাকে সেই উপলব্ধি দান করেছে যার কারণে মুক্তস্বভাব পুরুষ সংসার–জীবনে স্থির থাকতে পারে। সন্তানের কথাও তার কল্পনায় উদিত হচ্ছিলো। আহা, শিশু কোলে না থাকলে রমণী কি আর রমণী? তার এখন মনে হয়, সে সংসার–জীবনের সারাৎসারে প্রায় উপনীত হতে যাচ্ছিলো। ক্রমেই তার উপলব্ধি হচ্ছিলো, জীবন এইভাবেই ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়, পূর্ণতা লাভ করে এবং ক্রমে একটি পরমার্থতায় উপনীত হয়। তার বিশ্বাস, জীবনের পরমার্থতা অন্য কিছুতে প্রকাশ পায় না, প্রকাশ পায় সৃজনে। আর এও তার মনে হয় যে, সংসারই সৃজনের আধার, সংসার ধ্বংস হয়ে গেলে সৃজন প্রক্রিয়া আর থাকে না। ধর্ম বলো, সংঘ বলো, রাষ্ট্র বলো, সকলই সংসারকে রক্ষা করার কারণে। সংসারের কারণেই মানুষের যাবতীয় বৃত্তি এবং কর্মকাণ্ড। সুতরাং সংসারকেই জগতের সকল অস্তিত্বের কেন্দ্রে স্থাপন করতে হবে। এই প্রকার একটি সরল মীমাংসায় উপনীত হচ্ছিলো সে। এবং ঐ সংসার সম্পর্কেই প্রেমধর্মের কথাটি এসে যাচ্ছিলো। প্রেম না হলে কি সংসার হয়? আর সংসার না হলে তো জীবন হয় না। এবং জীবন যদি না থাকে, তাহলে জগতের অস্তিত্ব কোথায়? মীমাংসাটি এইভাবে বিন্যস্ত করে সে মিত্রানন্দের কাছে জানিয়েছিলো। এবং ঐ সূত্রেই মানুষে মানুষে প্রীতি ও সদ্ভাবের কথাটি তুলেছিলো। সনাতন ও সদ্ধর্মীদের মিলন যে ঐ সূত্রেই হতে পারে তাও সে জানিয়েছিলো। মিত্রানন্দ জগদ্দল মহাবিহারে একখানি পত্র নিয়ে যাচ্ছে তখন। ঐ সময়ই সে অনুরোধটি করে। মহাভিক্ষু ও মহাশ্রমণদের মধ্যে ঐ সরল মীমাংসার কথাটিও যেন আলোচিত হয়।

কিন্তু এ কোন দুষ্কালের আবির্ভাব ঘটলো! জীবনের ধ্বংস প্রক্রিয়া কি এতোই দ্রুত অগ্রসর হয়? সময় এত বৈরী কেন? মানুষ কি সামান্য কিছুকালও ধৈর্য ধারণ করতে পারে না? বলাধিকার থাকলেই তা প্রয়োগ করতে হবে? তার কিছুতেই বোধগম্য হয় না একজন বয়স্ক, বুদ্ধিমান, সম্ভ্রান্ত ও সামাজিক মানুষ কীভাবে অন্যের ধনসম্পদ, সংসার, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত হরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠতে পারে। এ কি শুধুই লোভ? শুধুই জিঘাংসা? তোমার পুত্র তোমার নয়, সে আমার দাস হবে। তোমার সুন্দরী স্ত্রী তোমার নয়–সে আমার শয্যাসঙ্গিনী হবে। তোমার ধনসম্পদ কেন থাকবে তোমার অধিকারে? তা থাকবে আমার অধিকারে।

তার একেক সময় জানার বাসনা হয়, এ কি তাহলে মানুষের চূড়ান্ত পতন? এখন পাশবিকতার জয়জয়কারই হবে সত্য? মহাকাল তার শেষ ঘোষণাটি দিয়ে বসে আছেন– কেবল মৃত্যু ও মিথ্যাই সত্য–অন্য কিছু নয়।

আবার একেক সময় মনে হয়, এ হলো এক প্রকার ক্ষয়। জরা এসে তোমার দেহের শক্তি হরণ করছে, তোমার মনের চিন্তাকে স্থবির করে দিচ্ছে, তোমার উদ্যমকে বিনষ্ট করছে। তোমার অস্তিত্বকে ধারণ করে যে শক্তি, সেই শক্তিই ক্ষয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক থেকে। ফলে তোমার দেহ মন কিছুই আর তোমার নয়। এ হলো সেই পুত্তলির মতো যার অঙ্গ–প্রত্যঙ্গাদি আর একত্র থাকছে না। তোমার হস্তপদ তোমার নয়। সমস্তই ক্ষয় হয়ে, শিথিল হয়ে, ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সংসারেরই কি কোনো গঠন থাকে?

অথচ সংসারই মূল। আমার হস্তপদাদি আমার থাকতে হবে–চক্ষু দুইটিকেও আমি সংলগ্ন চাই। স্ত্রী–পুত্র, পরিবার–পরিজন, গৃহ, কর্মক্ষেত্র সমস্তই আমি সংলগ্ন চাই। ঐ সব সংলগ্ন না থাকলে আমি যে আর আমি থাকতে পারি না। সুতরাং এই সংলগ্নতাই সংসারের সৃষ্টি করে। এরই অন্য নাম প্রেম। প্রেমে জগৎ হয়ে ওঠে একান্ত আপন। সৃজনের আধার সংসার, সংসারের আধার আবার জগৎ। যে পথেই অগ্রসর হই, প্রেম ব্যতীত জগৎ নেই।

একাকী মনের চিন্তা এসব। একদিনের নয়। বাণিজ্য যাত্রার সময় থেকে আরম্ভ। নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসব চিন্তার জন্ম হয়েছে, বিচ্ছিন্নভাবে–অসংলগ্নভাবে। পরে এগুলি ক্রমশ স্পষ্টতর হয়েছে শ্বশুরালয়ে অবস্থানকালে, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি ঘটবার পর, যখন ভিক্ষুরা একাদিক্রমে তার কাছে আসতে আরম্ভ করে, তখন।

কিন্তু এখন এসব চিন্তার কি আর আদৌ কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে? সমস্ত কিছুর এখন ছিন্নভিন্ন অবস্থা। মস্তিষ্কের চিন্তার যেমন, বাইরের দৃশ্যাবলীরও তেমনই।

সমস্ত পথ তার মনে অসংলগ্ন আরও নানান চিন্তার উদয় হচ্ছিলো। সেই সঙ্গে আবার মায়াবতীর প্রণয়ভাষণের কথাগুলিও থেকে থেকে কর্ণকুহরে মর্মরিত হচ্ছে তখন। ফলে সে নিজের মধ্যেই হয়ে যাচ্ছিলো নিমজ্জিত। পথের প্রতিকূলতা তার সম্মুখে কোনো বাধারই সৃষ্টি করতে পারেনি।

খিল ভূমির মধ্য দিয়ে পথ। কোথাও ঈষদুচ্চ ঝোপ, কোথাও আইল, কোথাও বা জল প্রবাহিনী নালিকা। কিন্তু কিছুই তার বোধগোচর হচ্ছিলো না। তবে সৌভাগ্য যে। আকাশে ছিলো পূর্ণচন্দ্র এবং তার দৃষ্টিশক্তিও ছিলো প্রখর। তার অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ এবং স্বাভাবিক অনুভূতিগুলি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতোই ছিলো সচল।

অবশেষে রাত্রির মধ্যমে পুনর্ভবা তীরের একটি হাটে এসে উপস্থিত হলো। পদযুগল আর বশে ছিলো না তখন। একটি হট্টকুটিরের চালার নীচে ভূমিতেই সে শয়ান হলো। ভয়ানক তৃষ্ণার্ত ছিলো সে। কিন্তু নদীর জলধারা পর্যন্ত যাবে, এমন ক্ষমতা দেহে তখন আর অবশিষ্ট ছিলো না।

হাটের প্রান্তে ছিলো একটি হড়ডিপল্লী। পল্লী বলতে সামান্য কয়েকটি পর্ণ কুটির মাত্র। ঐ কুটিরবাসীদের মধ্যে সম্ভবত কেউ তার আগমন লক্ষ্য করে থাকবে। এক সময় সে দেখলো, অদূরে কয়েকটি মানবমূর্তি দাঁড়িয়ে। একজন আবার প্রশ্নও করছে, মহাশয় আপনি কে? কি হেতু এ স্থানে আগমন, এই দশাই বা কেন?

আমাকে জল দিন, বসন্তদাসের মুখে ঐ একটি কথা তখন। প্রশ্নগুলি কর্ণে প্রবেশ করলেও কোনো উত্তরই তার মুখে আসছিলো না।

মহাশয় কি আমাদের হাতে জলপান করবেন?

বসন্তদাসের কাছে প্রশ্নটি ভয়ানক হাস্যকর বোধ হয়। ঐ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে পুনরায় জল চায়। বলে, জল দিন ভ্রাতঃ, আমি তৃষ্ণার্ত, পরে কথা বলবেন।

এক বৃদ্ধ মৃৎপাত্রে জল এনে দিলে সে তা পান করে এবং স্বস্থ হয়। শেষে নিজ পরিচয় জানিয়ে সে তার উজুবট যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে।

শুভ্রকেশ এক বৃদ্ধ ছিলেন ঐ স্থানে। তিনি বললেন, মহাশয়, উজুবট যাওয়া একেবারেই অর্থহীন, শুকদেব মহাশয়কে আমি জানি, অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি–তার সন্ধান করার জন্য আমরাও গিয়েছিলাম, কিন্তু কাউকেই পাইনি–আপনিও পাবেন না–বরং এই আশঙ্কা যে, সামন্ত হরিসেনের গুপ্তচরদের হাতে বন্দী হয়ে যেতে পারেন।

হ্যাঁ মহাশয়, যাবেন না! অধিকতর বয়স্ক আরেকজন বললেন। পরামর্শ দিলেন, আপনি বরং নদীর এই পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতেই সন্ধান করে দেখুন।

বসন্তদাস লোকগুলির কথা শোনে এবং তার অদ্ভুত বোধ হয়। শেষে সে বলে, এ আপনারা কী বলছেন, আমার আদৌ বোধগম্য হচ্ছে না। মায়াবতী আমার স্ত্রী, আমার ধর্মপত্নী, অগ্নিসাক্ষ্য করে তাকে আমি বিবাহ করেছি। সে মৃত, না জীবিত, সে সংবাদ আমি নেব না? যদি মৃত হয়, তাহলে তার শেষকৃত্যেরও তো একটি প্রশ্ন আছে।

বৃদ্ধটি বসন্তদাসের কথা শুনে করুণ ও মলিন হাসি হাসেন। বলেন, মহাশয়, আমি পকূকেশ বৃদ্ধ, নিম্নজাতি, কিন্তু কেশগুলি আমার অহেতুক পাকেনি। সেই জন্যই বলছি, বুদ্ধিভ্রষ্ট হবেন না–এ বড় দুঃসময়–এখন স্থির এবং শান্তচিত্তে সমস্ত কাজে হাত দেওয়া উচিত। আপনি কিঞ্চিৎ স্বস্থ হয়ে বাস্তব অবস্থাটি চিন্তা করে দেখুন। আজ ষষ্ঠ দিবস, তায় গ্রীষ্মকাল, আপনি কি মনে করেন শৃগাল–কুক্কুর মৃতদেহগুলিকে অক্ষত রেখেছে? প্রকৃত ব্যাপার তো মহাশয় ললাটে, ললাটলিপি আর কে খণ্ডাতে পারে?

বসন্তদাসের মনেও যে ঐ প্রকার চিন্তা আসেনি তা নয়। সে অনুমান করতে পারে, উজুবটে গেলে হয়তো সে কাউকেই পাবে না, কিন্তু তথাপি সে অন্তরের হাহাকারটি প্রশমিত করতে পারছিলো না। তার কেবলি মনে হচ্ছিলো থেকে থেকে–আছে, জীবিত আছে মায়াবতী, লোকে যা–ই বলুক।

অতি প্রত্যুষে বনকুকুটের ডাক আরম্ভ হতেই সে আর স্থির থাকতে পারলো না। হডিপল্লীর ঘাটে বাঁধা ক্ষুদ্র কোষা নৌকাখানি নিয়ে সে নদী অতিক্রম করে পূর্বতীরে উপনীত হলো।

নদীতীর একেবারেই নিঃশব্দ। কেবল ঊষাকালের শীতল বায়ুতাড়নায় বৃক্ষরাজির পত্রপল্লবে মর্মরধ্বনি উঠছে। ঐ তো বট এবং অশ্বত্থ বৃক্ষগুলি, বৃক্ষতলের উচ্চবেদীসমূহ। ঐ সকল বেদীতে কতদিন অপরাহ্নে সে বিশ্রাম নিয়েছে। বটবৃক্ষের সংখ্যাধিক্যের কারণেই কি গ্রামখানির নাম উজুবট? বটবৃক্ষ কি ঋজু হয়? সে একবার নামটির তাৎপর্য ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলো, সফল হয়নি। গ্রাম বৃদ্ধেরাও কেউ তাকে ঐ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেনি। আহা মাত্র সেদিনই না সে এই নদীতীরে ভ্রমণ করেছে! বালক ও কিশোরদের খেলার সঙ্গী হয়েছে! কি নাম ছিলো যেন বালকটির? অর্কাস? হ্যাঁ, ভারী সুন্দর নামটি আর মুখখানি কেমন ভারী কোমল, আর এতো মায়া চক্ষু দুটিতে যে দৃষ্টিপাত হলে সে দৃষ্টিকে আর সরানো যেতো না। সেই অর্কাস এখন কোথায়? এবং সেই বৃষস্কন্ধ বলশালী কিশোরটি? প্রতিটি কথায় যার হাসি উচ্ছ্বসিত হতো?

নদীতীরে নৌকা নেই কেন? এখানে না বীথির পর বীথি নৌকা ভাসমান থাকতো! তার মনে পড়ে, পল্লীটি কোলাহলে মুখর হয়ে জেগে উঠতো প্রত্যুষকালে। গোধনের হাম্বা রব, ক্ষেত্রকরদের সচিৎকার আহ্বান, ধার্মিক প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের কণ্ঠে শিবের মঙ্গলগীতি, সমস্ত একত্রে পল্লীটির প্রাণ–চাঞ্চল্য প্রকাশ করতো। এখন একেবারেই নিঃশব্দ। ভ্রম হয়, যেন কোনো শোনে এসে উপস্থিত হয়েছে।

এখানে ভস্মস্তূপ, ওখানে অর্ধদগ্ধ কুটির চালা, চারিদিকে ভগ্ন তৈজসাদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। কোনো এক গৃহবধূর হাতে সীবনকৃত একখানি অর্ধদগ্ধ কন্থার প্রান্তদেশে বৃক্ষশাখার তোতাপাখিটি বড় মনোহর। সে হাতে তুলে নিতে গিয়েও নিলো না। অনুমান করতে চেষ্টা করলো, কার গৃহ ছিলো এ স্থানে? দেখলো, বৃথা চেষ্টা। কিছুই অনুমান করা যায় না। সমস্ত কিছু একাকার। উকট একটি দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসছিলো। ক্রমে দুর্গন্ধ অসহ্য হয়ে উঠলো। ঐ সময় সে একটি পথকুক্কুর দেখলো। তার স্ফীতোদরটি দেখবার মতো। এবং আরও দেখলো, অনতিদূরে একটি শিশুর ছিন্নবাহু নিয়ে দুটি শ্মশান শৃগাল কলহ করছে। শৃগাল ও কুকুরের যে সহাবস্থান হতে পারে, তার জানা ছিলো না।

বসন্তদাস অধিকদূর অগ্রসর হতে পারলো না। দূরে ব্রাহ্মণপল্লীর মন্দিরে ঐ সময় ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। সে ঘণ্টাধ্বনিটি শুনলো অনেকক্ষণ ধরে। কল্যাণ ও মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায় পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা আরম্ভ হয়েছে। শ্লোকটি তার মনে পড়লো, যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি …. ধর্মে যখন গ্লানির অনুপ্রবেশ ঘটে, জগত পাপে পূর্ণ হয়ে যায়, দুষ্কৃতকারীদের শাস্তির নিমিত্ত এবং সাধু ব্যক্তিদের পরিত্রাণের জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই। বড় আশ্বাসের কথা। ধর্মে এবং জীবনে মানুষকে সুস্থির করার জন্য এতদপেক্ষা বৃহৎ ও মহৎ আশ্বাস আর কী হতে পারে।

ভগবান বিষ্ণুর অধিষ্ঠান কোথায়? তার মনে প্রশ্ন জাগে। যেখানে এবং যাদের মধ্যে তাঁর অধিষ্ঠান, সেখানে কি গ্লানি আছে? নির্যাতিত মানব শিশুর রোদন ধ্বনি কি অতদূরে কারও শ্রবণ স্পর্শ করে? কে জানে, বসন্তদাসের অন্তত জানা নেই। ভগবান বিষ্ণু, মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন, নৃসিংহ ইত্যাদি সকল রূপেই মর্তে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু চণ্ডালের, কি ব্রাত্য শূদ্রের গৃহে কখনও কি তাঁর জন্ম হয়েছে? কেন হয়নি, বলা কঠিন। তবে হলে বড় ভালো হতো। চণ্ডাল ডোম হড়ডিরা ভাবতে পারতো যে নর সত্য সত্যই নারায়ণ। এই চিন্তা করে সুস্থ ও সাহসী হতে পারতো যে তারাও একই ভগবানের আশ্রিত।

পুরাণ-কথার সঙ্গে সঙ্গে তার জাতক–কাহিনীও মনে পড়লো। কিন্তু সবই বিচ্ছিন্ন, সংলগ্নতাবিহীন ও পারম্পর্যশূন্য–ক্ষণে ক্ষণেক আলোকোদ্ভাসের মতো। সে জানে, এমন তুলনা একেবারেই অনর্থক–কেউ এমন তুলনা কখনও করবে না। ন্যায় এবং মীমাংসার পদ্ধতিগুলিও তার জানা নেই। আর জানা থাকলেই বা লাভ কি? তার কি সাধ্য যে পুরাণ ও জাতক কাহিনীর তুলনামূলক বিচার করবে? বিশেষত এই সময়ে? সুতরাং চারিদিকে যা ঘটছে তা স্বীকার করে নাও। তোমার মানবজন্মের এই-ই ললাট লিপি।

সে আরেকবার চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে। এখন তার চারিদিকে ধ্বংস ও মৃত্যু। নরক কি এই প্রকার? হতে পারে–তার অনুমান হয়। জীবনহীনতা এবং সম্ভাবনাহীনতা একত্রিত হওয়ার নামই সম্ভবত নরক। বিকৃতি, পচন, পাপ, পতন–এ সমস্তই নরকের লক্ষণ। আর সমস্তই সম্ভব হয় জীবনের অনন্ত প্রবাহটি স্তব্ধ হয়ে গেলে। সৃজন ও জীবনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেই নরকের আরম্ভ। সে যেখানে দাঁড়িয়ে তা এখন নরকই, অন্য কিছু নয়। এবং একইসঙ্গে বাইরের যে জগৎ বিস্তৃত, যেখানে পিপ্পলী হাটের মতো ঘটনা ঘটে, সে স্থানও নরক ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তার মনে হয় না দুইয়ের মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য আছে।

বিধ্বস্ত পল্লীটির বুকে দাঁড়িয়ে বসন্তদাস কেবলই উদভ্রান্ত হচ্ছিলো। নানান কথা আসছিলো মনে। বেদনা-শোক-ক্ষোভ-ক্রোধ ইত্যাকার অনুভূতিগুলি তখন আর সজাগ ছিলো না। যেন বিচিত্র এবং প্রকাণ্ড শূন্যতার মধ্যে সে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে, তার কিছুই করণীয় নেই। কোনো কিছুর সঙ্গেই সে আর সম্পর্কিত নয়।

ঐ সময় সে দূরে দেখতে পায় দুজন লোক আসছে। লোক দুটিকে এক সময় হঠাৎ ধাবমান হতে দেখে তার সন্দেহ হলো। এবং পরক্ষণেই তাদের হাতের অস্ত্র দুখানিও দৃষ্টিতে এলো। সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই, সুতরাং সে আর কোনো প্রকার বিলম্ব করতে পারে না। দ্রুত নদীতীরে এসে নৌকাখানি নিয়ে সে পশ্চিমতীরে চলে এলো। দেখলো, হড়ডি বৃদ্ধটির কথাই যথার্থ। পূর্বতীরে তার বিপদাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা পদে পদে।

তুমি এখন তবে কার? বৃক্ষছায়ার নীচে, হট্টকুটিরে অর্ধশয়ান অবস্থায় নিজেকে প্রশ্ন করে সে। তুমি কি পিতামাতার? নাকি প্রিয়তমা পত্নীর? নাকি সেই বালগ্রামের কৃষ্ণা নাম্নী মন্দিরদাসীটির?

সে যেমন এখন কারও নয়, তেমনই আবার নিজেরও নয়। তুমি কি তোমার বসন্তদাস? প্রশ্ন করে সে উত্তর পায় না। ব্যক্তির অস্তিত্ব তো সম্পর্কে–তা সে যেমনই হোক বস্তুসম্পর্ক হোক, অথবা হোক ব্যক্তিসম্পর্ক। আমি আমি বলে চিৎকার করলেই কি তাতে কিছু প্রমাণিত হয়? আমার এখন মানবসম্পর্ক নেই–পিতামাতা, আত্মীয়–পরিজন, স্ত্রী বন্ধু, কোনো সম্পর্কেই তো আমি এখন যুক্ত বোধ করি না। আর বস্তু সম্পর্ক? সেখানেও কি আমি যুক্ত? কোন পরিচয়টি আমার? আমি কি বণিক? বণিক হলে বিত্তহীন সম্বলহীন অবস্থায় আমি হট্টগৃহে একাকী শয়ান কেন? নাকি আমি ক্ষেত্ৰকর? তাহলে তো আমার গৃহবাসী হয়ে ক্ষেত্রকর্মে যুক্ত থাকার কথা।

না সে বণিক নয়। ঐ পরিচয় তার অপহৃত হয়ে গেছে ফরুগ্রাম জনপদে। এবং ক্ষেত্রকর পরিচয়টি ত্যক্ত হয়েছে আরও পূর্বে। এখন তাহলে কি সে ভূত্য? দাস? নাকি সাধু অথবা যোগী? সে নিজের জন্য কোনো অভিধা আবিষ্কার করতে পারে না। দুর্বাত্যা প্রবাহে উন্মুলিত ক্ষুদ্র পাদপের মতো অবস্থা তার। সে উপলব্ধি করে, এই অবস্থা তার একার নয়। প্রায় সকল মানুষেরই এই অবস্থা। তুমি ক্ষেত্রকর? কিন্তু ঐ পরিচয়ে তুমি স্থিত থাকতে পারবে না। একজন সামন্ত বা রাজপাদোপজীবী তোমাকে ভূমি থেকে উচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। তুমি বণিক? তোমার ধন–সম্পদ, পণ্যসামগ্রী সমস্তই এক সুন্দর প্রভাতে দেখবে যে অপহৃত হয়ে গেছে। তুমি গৃহবধূ? তোমার রূপ–যৌবন দেখবে একদিন লম্পটের ভোগ্য হয়ে উঠেছে। বসন্তদাস উঠলো। শরীরে ক্লান্তি, মনে অবসাদ। আপাতত একটি কাজ তার এখন। আর তা হলো, মায়াবতীর অনুসন্ধান করা। হড়ডি বৃদ্ধের অনুমানটি সম্ভবত যথার্থ। পশ্চিম তীরের গ্রামগুলিতেই, যদি জীবিত থাকে, মায়াবতীর সন্ধান করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *