০৫. শ্যামাঙ্গ নবগ্রাম হাটে

শ্যামাঙ্গ নবগ্রাম হাটে যখন উপনীত হলো তখন চৈত্রের প্রখর পশ্চিমা বাতাস এবং রৌদ্রতাপ তাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বেলা তখন দ্বিপ্রহর। হাটের মধ্যস্থলে প্রাচীন একটি বটবৃক্ষ এবং বৃক্ষতলে বিপণী। সে ছায়াতলে ক্ষণেক বসলো। অদূরে দীর্ঘিকা–কাকচক্ষু স্বচ্ছ জল তাকে স্নিগ্ধ আহ্বান করতে থাকলে সে তীরে নেমে যেতে বাধ্য হলো।

জল অতিশয় শীতল, হস্তমুখ প্রক্ষালন শেষে আকণ্ঠ জলপান করে সে বৃক্ষতলে আবার এসে বসলো। অবাক লাগছিলো তার, হাট এমন পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে কেন? নাকি আজ হাটবার নয়? সে বামে দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করে। জনসমাগম নেই, গো–মহিষের শকটাদি থাকার কথা–একখানি শকটও তার দৃষ্টিপথে আসে না।

ঐ সময় বৃক্ষতলের বিপণীকার, ব্যবসায়ের আশায়, নাকি নিতান্তই সৌজন্যবশে, বলা কঠিন, অতীব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কাছে এসে বসলো এবং জানতে চাইলো, মহাশয় কি দূরে যাবেন?

শ্যামাঙ্গ প্রীত বোধ করে বিপণীকারের ঐ স্নিগ্ধ সম্বোধনে। সে তার গন্তব্যের কথা জানায়। তারপর জানতে চায়, বিপণীতে আহার্য বস্তু কী আছে। শ্যামাঙ্গের ক্লান্ত মুখ দেখে বিপণীকার দ্রুত হস্তে একটি পদ্মপত্র এগিয়ে দিয়ে বলে, আপনি বসুন, আমি ফলাহারের ব্যবস্থা করছি।

ফলাহারটি সত্যিই উপাদেয়। সুগন্ধী এবং কোমল চিপিটক, প্রগাঢ় দধি, তৎসহ খণ্ড–মিষ্টান্ন এবং স্ফীতাঙ্গ, প্রায় বর্তুলাকার, হরিদ্রাভ কদলী। পরম পরিতোষের সঙ্গে আহার সমাপ্ত করে আচমন শেষে যখন বিপণীকারের কুশাসনটি বিস্তৃত করেছে, বাসনা, ক্ষণকালের জন্য লম্বমান হবে–ঐ সময়ই বিপণীকার বিশ্রম্ভালাপের জন্য কাছে এসে বসলো। হাতে করে নিয়ে এসেছে পর্ণ ও গুবাক।

শয়ন আর হলো না। শ্যামাঙ্গ উঠে বসলো। বুঝলো, লোকটি আলাপপ্রিয়। বিপণীকার জানতে চাইলো, নিশ্চয়ই অনেক দূর থেকে আসছেন?

হ্যাঁ, বিল্বমূল গ্রাম থেকে আসছি, বিল্বমূল গ্রাম কি এই স্থান থেকে অধিক দূর?

বিপণীকার হাসে, মহাশয়ের দূরত্ব জ্ঞান দেখছি প্রখর।

কেন? শ্যামাঙ্গ ঈষৎ বিব্রত বোধ করে।

বিল্বমূল কি এখানে? বিপণীকার জানায় এই নবগ্রাম হাটে বিল্বমূল গ্রামের বণিকেরা আসে–ওখানে নাকি একটি মন্দির নির্মিত হচ্ছে–ঐ বণিকেরাই বলে, শকট বাহনে গেলে বিল্বমূল এক দিন এক রাত্রির পথ।

আচ্ছা, হঠাৎ বিপণীকারের কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়। নিম্নস্বরে, প্রায় অস্ফুটে, বলে, আপনি পিপ্পলী হাটের সংবাদ কিছু জানেন? কিছু শুনেছেন?

না তো, শ্যামাঙ্গ মস্তক হেলন করে। বলে, না, তেমন কোনো সংবাদ আমার কাছে আসেনি। আমি কোনো সংবাদ জানি না–আপনি কিছু শুনেছেন?

না, আমিও কিছু শুনিনি, বিপণীকার জানায়, তবে আমার সন্দেহ হচ্ছে ওখানে কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। উঠুন, একটি দৃশ্য দেখাবো আপনাকে–এই বলে সে শ্যামাঙ্গের হাত ধরে তার বিপণীর পশ্চাতে নিয়ে গেলো এবং বটমূলের অন্তরাল থেকে দেখালো, ঐ দেখুন।

শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে। দেখবার মতোই একখানি দৃশ্য বটে। অদূরেই অতিথিশালা এবং কূপ, কয়েকটি আম্রবৃক্ষও রয়েছে ইতস্তত। সমস্ত স্থানব্যাপী বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম–কেউ বসে, কেউ অর্ধ–শয়ান, কেউ, কৌতুক–ক্রীড়ায় রত। কয়েকজন শস্ত্রধারী পুরুষকে দেখে মনে হয় তারা প্রহরায় রয়েছে। প্রায় সকলের পরিধানেই বীরটিকা, হস্তে শূল, কটিদেশে কোষবদ্ধ তরবারি। অল্প কিছু দূরে নবীন একটি অশ্বত্থতলে আরও একটি দল। বোঝা যায় তারা ধানুকী। ধনুকগুলি বৃক্ষকাণ্ডে একত্রে রক্ষিত, ক্ষুদ্র শরাসন ও তৃণীরগুলি বৃক্ষ শাখায় লগ্ন অবস্থায় দুলছে।

দৃশ্যটি দেখে শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে, কোনো সামন্তপতি নিশ্চয়ই।

না, তবে মনে হয়, প্রকৃত রাজপাদোপজীবী কেউ–নতুবা এমন কেন হবে বলুন? ঐ যে, ধ্বজা আর পতাকা, দেখতে পাচ্ছেন?

কিন্তু এখন কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে এমন তো শুনিনি, শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে। বলে, তবে কি দস্যু দমনের জন্য এই অভিযান?

হ্যাঁ, কী যে বলেন, বিপণীকারের কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপ ধ্বনিত হয়। বলে, এরা করবে দস্যুদমন! কাক কি স্বজাতির মাংস ভক্ষণ করে? বলুন?

ক্ষণকাল পরে বিপণীকার নিম্নস্বরে জানায়, একজন বলছিলো এরা নাকি পিপ্পলী হাটে যাচ্ছে সেখানে নাকি চণ্ডালেরা দ্রোহ উত্থাপন করেছে। কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি, তাই আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আপনি কিছু জানেন কিনা। অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে সংবাদটা, কেন জানেন? দ্রোহকারী নাকি পুরুষ নয়, চণ্ডালদের রমণীরা এ কাণ্ডটি ঘটিয়েছে–এ কি বিশ্বাস করা যায়? আপনিই বলুন?

শ্যামাঙ্গের মস্তিষ্কে উত্তেজনাকর সংবাদ প্রবেশ করতে চায় না। সে বুঝতে পারছে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণেই এখানে হাট বসেনি। সেই কারণেই গো–মহিষের শকটাদিও আসেনি। এখন সে কীভাবে স্বগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করবে, সেটাই সমস্যা। সে বললো, হাটে কি কেউ আসেনি? দূরের বণিকেরা?

বিপণীকার হাসে, মহাশয় অবোধের মতো প্রশ্ন করছেন। এরা গতকাল কয়েকটি শকটের দ্রব্যসামগ্রী লুণ্ঠন করেছে–তারপর আর কে আসবে হাটে, বলুন? সবাই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করেছে। আপনাকে পদব্রজেই যেতে হবে–তবে বিল্বমূলেই প্রত্যাগমন করা বোধ হয় আপনার জন্য মঙ্গল। শোনা যাচ্ছে, এদের পশ্চাতে আরও একটি বাহিনী আসছে, পথিমধ্যে আপনি তাদেরও সাক্ষাৎ পেয়ে যেতে পারেন। এরা তো মানুষ নয়, কখন কি করে কিছুই স্থির নয়।

বিপণীকারের ভ্রূতে কুঞ্চনরেখা। সেখানে কখনও বিরক্তি প্রতিফলিত হচ্ছে, কখনও ঘৃণা। বললো, এদের আসবপানের আগ্রহ দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। মনে হবে না যে এরা জলপান করতে জানে। ডোমপল্লীর কাছাকাছি প্রয়োজনেও কেউ যেতে পারছে না। বৃদ্ধ, যুবক এবং শিশুরা নিকটস্থ বনে আশ্রয় নিয়েছে। ঐ অতিথিশালার নিকটে গেলে আর চক্ষু মেলে রাখতে পারবেন না। শূকরপুত্রদের ঐ সমস্ত আচরণ চক্ষু মেলে দেখা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। দলপতিটি সর্বক্ষণ রক্তনেত্র। গতকাল থেকে দুটি যুবতী ডোমনী নির্বস্ত্র হয়ে তার অঙ্গ সংবাহন করে চলেছে–আর গবাক্ষ পথে সাধারণ সৈন্যরা ঐ দৃশ্য উল্লাস ভরে চেয়ে চেয়ে দেখছে, একেবারেই নরকের কীট!

বিপণীকার উত্তেজিত হয়ে উঠলো বর্ণনা করতে করতে। ক্ষুব্ধস্বরে এক সময় বললো, এই পাপাচার কি সহ্য করা যায়, বলুন? আপনি কি কদাচ শুনেছেন যে রাজপুরুষেরা এইরূপ কদাচারে নিমজ্জিত থাকে?

শ্যামাঙ্গ উত্তেজিত হয় না। শুধু সে কেন, অনেকেই শুনেছে, রাজপুরুষদের বিলাসী আচরণের নানান কাহিনী। রাজপুরুষ কিংবা তাদের অনুচরদের এইরূপই তো এখন আচরণ। তার মনে পড়ে, লক্ষ্মণাবতীর এক শিল্পী রাজপুরুষদের বহু প্রকার কাহিনী বর্ণনা করেছিলো। সামন্ত ও মহাসামন্তেরা নাকি রাজকার্য ব্যপদেশে রাজধানীতে গমন করলে নগর নটিনীর গৃহে অষ্টপ্রহর যাপন করে এবং কদাচ জলপান করে না।

শ্যামাঙ্গের ঐ সময় বৎস রাজা উদয়নের কাহিনীটি স্মরণ হয়। রমণী সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে বলে প্রজাদের রাজদর্শনের সুযোগটুকু পর্যন্ত তিনি দিতেন না। গবাক্ষপথে একটি পদাঙ্গুলি শুধু উত্তোলন করতেন আর তাই দর্শন করে প্রজাদের তুষ্ট থাকতে হতো। শ্যামাঙ্গ বিপণীকারের কাছে কাহিনীটি বললো না। শুধু ক্ষুদ্র মন্তব্য করলো, পিপ্পলী গ্রামের অধিবাসীদের দেখছি ঘোর বিপদ সমাসন্ন। ক্ষণকাল পর সে আবার বললো, আপনারাও যে নিরাপদ, এমন কথা কিন্তু চিন্তা করবেন না।

মহাশয় কি আমাকে নির্বোধ ভাবছেন? বিপণীকার বললো, আমি দুইবার এ স্থান ত্যাগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু শূকরপুত্ররা দুইবারই পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। আমাকে দেখলেই বলে, তোমার ভয় নেই, তুমি নির্ভয়ে থাকো। কিন্তু আমি জানি, ডোমপল্লীর রমণী এবং মধুকাসবের আকর্ষণ কিঞ্চিৎ শিথিল হলেই তারা গৃহস্থ পল্লীতে প্রবেশ করবে এবং তখনই হবে আমার বিপদ।

শ্যামাঙ্গ নিজেও বুঝছিলো যথাশীঘ্র তার নবগ্রাম ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু কোন পথে যাবে তাই সে স্থির করতে পারছিলো না। বললো, আমি কোন পথে যাবো, বলতে পারেন?

এই পর্যন্ত বলতে পারলো সে। ঠিক ঐ সময় দুজন সৈনিক পুরুষ নিকটে এসে দাঁড়ালো।

একজন কৃষ্ণবর্ণ, খর্ব কিন্তু স্ফীতকায়। অন্যজন গৌর, দীর্ঘ এবং কিঞ্চিৎ বয়স্ক।

ওহে, একজন বিপণীকারকে সম্বোধন করে বলে, লোকটিকে নতুন দেখছি যেন?

 বিপণীকার শঙ্কিত দৃষ্টিতে বারেক শ্যামাঙ্গের দিকে তাকায়। তারপর বলে, মহাশয়, প্রভু, ইনি পথিক, আত্রেয়ী তীরের অধিবাসী।

দীর্ঘদেহ সৈনিক পুরুষ শ্যামাঙ্গের দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কি হে, কি পরিচয় তোমার?

মহাশয়, শ্যামাঙ্গ সবিনয়ে জানায়, অধমের নাম শ্যামাঙ্গ, হেমাঙ্গদাস আমার পিতা, আমরা মৃৎশিল্পী, আত্রেয়ী তীরের রজতপীঠ গ্রামে আমার নিবাস।

অ, তুমি তাহলে কুম্ভকার পুত্র, বেশ ভালো কথা–খর্বকায় সৈনিক পুরুষটির কৌতুক প্রকাশ পায়। বলে, তা কুম্ভকার পুত্রের হঠাৎ পরদেশ গমন কেন?

শ্যামাঙ্গকে তখন কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। তার কথা শুনে দুজনের মুখেই অবিশ্বাসের হাসি দেখা যায়। একজন কপট কৌতুকে বলে উঠে, ভালো ভালো–অতি চমৎকার তোমার উদ্ভাবন, বসুদেব তাহলে মূর্তি নির্মাণ পরিত্যাগ করে কুম্ভকার বৃত্তি অবলম্বন করেছেন। অতি উত্তম কল্পনা তোমার। এখন সুবোধ বালকের মতো চলো। দেখি, আমরা তোমার প্রকৃত পরিচয়টি উদ্ধার করতে পারি কি না।

এ প্রায় অবিশ্বাস্য কাণ্ড। শ্যামাঙ্গ হতচকিত হয়ে যায়। সে কি চোর না দস্যু? এভাবে বন্দী করবে? সে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে। বলে, মহাশয়রা বিশ্বাস করুন, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার কোনো লাভ নেই।

হ্যাঁ, বৎস, আমরা বালক নই–সবই বুঝতে পারি। শুধু বুঝতে পারি না, কিছু কিছু কাজও করতে পারি–পিতৃনাম বিস্মরণ মানুষের কি প্রকারে হয় জানো?

বিদ্রূপটি স্থূল এবং অপমানজনক। কিন্তু শ্যামাঙ্গ উত্তেজিত হয় না, নিজ মস্তিষ্ক শান্ত রাখে। সে বুঝতে পারছিলো, এ সব সাধারণ সৈনিকের কাছে ক্রোধ প্রকাশ করা প্রকাণ্ড মূর্খতা। সে ভাবছিলো, বরং দলপতির কাছে নিয়ে যাক আমাকে, উধ্বর্তন রাজপুরুষেরা নিশ্চয়ই আমার কথা বুঝবেন। সে জানতে চাইলো, মহাশয়রা কি আমাকে বন্দীশালায় নিয়ে যাচ্ছেন?

না বৎস, একজন হাসলো। বললো, শ্বশুরালয়ে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। কথাটি বলে দারুণ হাসিতে ফেটে পড়লো দুজনে।

কিন্তু অবাক কাণ্ড এই যে, তারা অতিথিশালার দিকে, যেখানে সৈন্যদলটি বিশ্রামরত ছিলো, সেদিকে নিয়ে গেলো না। হাটের আরেক প্রান্তে একটি বটবৃক্ষের অন্তরালে দাঁড়ালো। তারপর অকস্মাৎ রোষকষায়িত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে বললো, অরে সদ্ধর্মী কীট, তোর গুপ্তচর বৃত্তির কি পরিণতি হয় এখনই দেখতে পাবি। এখনও সময় আছে, বল, কি হেতু তোর এই হাটে আগমন? পিপ্পলী হাটে তোরাই কি মহাসামন্ত হরিসেনের পরিজনদের উপর আক্রমণ করিসনি? তোরাই কি মূল দ্রোহকারী নোস?

শ্যামাঙ্গ এবার অনুমান করতে পারে যে পিপ্পলী হাটে কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সৈনিক পুরুষ দুটির অভিযোগের উত্তরে কী বলবে, সে ভেবে উঠতে পারে না। অসহায়ভাবে একবার বামে একবার দক্ষিণে তাকায়। এবং ঐ তাকাবার সময় দূর থেকে বিপণীকারকে দেখতে পায়। দেখে, বিপণীকার বারবার নিজ কটিদেশ স্পর্শ করে একটি মুদ্রা দেখিয়ে ইঙ্গিত করছে। সে বুঝে নিলো, কিছু উৎকোচ দিলে হয়তো সে। নিষ্কৃতি পেতে পারে। চকিতে তার মস্তিষ্কে নতুন বুদ্ধি খেললো। খুবই কাতর স্বরে সে জানালো, মহাশয়রা, বিশ্বাস করুন, আমি বৌদ্ধ নই, আমার চতুর্দশ পুরুষ কেউ সদ্ধর্মী ছিলো না। আমার প্রকৃত পরিচয় আপনাদের কাছে বলছি–কিছুই গোপন করবো না। তার আগে অনুমতি দিন, ঐ বিপণীকারের কাছে আমার কিছু অর্থ গচ্ছিত আছে, সে অর্থ। নিয়ে আসি।

ঐ কথায় কাজ হয়। দুজনেই উৎসাহী হয়ে ওঠে। একজন বলে, নিজ অর্থ অন্যের কাছে কেউ রাখে? তুই দেখছি, একটি উৎকৃষ্ট গর্দভ। যা, তোর কি গচ্ছিত আছে, নিয়ে আয়।

শ্যামাঙ্গ দ্রুত বিপণীর অভ্যন্তরে ছুটে গেলো। এবং অন্তরালে অবস্থান করে ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই নিজ কটিবদ্ধ স্থলী থেকে অর্ধাংশ ভূমিতে রেখে অন্য অর্ধাংশ স্থলীসুদ্ধ হাতে নিয়ে সৈনিক পুরুষদের কাছে এসে দাঁড়ালো। বললো, এবার চলুন মহাশয়রা।

কয়েকপদ অগ্রসর হতে না হতেই একজন জানতে চাইলো, তোমার স্থলীতে কি পরিমাণ অর্থ হে?

অতীব সামান্য মহাশয়।

কত?

তা দুই কুড়ি মুদ্রা হতে পারে।

শ্যামাঙ্গের উত্তরে কিছু বুঝলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে কয়েকপদ অগ্রসর। হয়েই তারা আবার দাঁড়ালো। একজন এবার বললো, তোমার কিন্তু প্রাণসংশয় হতে পারে, আমাদের প্রভুর ক্রোধ চণ্ডালের মতো।

শ্যামাঙ্গ এবার আরও বিনয় প্রদর্শন করে। বলে, মহাশয় আমি আপনাদের দাস বই অন্য কিছু নই–আপনারা রাজপাদোপজীবী–আপনাদের অসীম ক্ষমতার বলে আমার মতো দীনহীন দাসের জীবন রক্ষা পাবে। আপনারা দয়া করুন, প্রভু!

তাহলে আমরা যে প্রভু তা তোরা স্বীকার করিস?

হ্যাঁ মহাশয়। শুধু আমি কেন, আমার চতুর্দশ পুরুষ স্বীকার করে।

প্রমাণ? প্রমাণ দেখাও

প্রভু এই যে আমি মস্তক নত করে বলছি, এই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?

না, দক্ষিণা কোথায়? জানিস না, প্রভুকে প্রণামের সঙ্গে দক্ষিণা দিতে হয়?

স্পষ্ট কথা। শ্যামাঙ্গ ঐ কথার পর ভূমিতে উপবেশন করে। তারপর স্থলীর মুদ্রাগুলি ভূমিতে রেখে দুই ভাগ করে। শেষে এক ভাগ একজনের হস্তে তুলে দিয়ে বলে, মহাশয়, আমার যা ছিলো, তার অধিকাংশই আমি দক্ষিণা স্বরূপ দিচ্ছি, আপনারা দয়া করে গ্রহণ করুন।

আর ঐ অর্ধাংশ? খর্বকায় সৈনিক পুরুষের কণ্ঠস্বরে নিদারুণ অসন্তোষ।

মহাশয়, শ্যামাঙ্গ মিনতি জানায়, এ সামান্য অর্থের বড়ই প্রয়োজন, আমার গৃহে পুত্রকন্যা রয়েছে।

আর মূর্খ, একজন প্রবল উম্মাভরে বলে, স্বয়ং জীবিত থাকলে তবে না পিতৃনাম! অন্য সৈনিকটির রসবোধ প্রচুর। সে বলে, জালিকের গল্পটি জানা আছে তোর?

শ্যামাঙ্গ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালে সৈনিকটি বলে, তবে শোন–একদা এক জালিক মৎস্য শিকারে নির্গত হয়ে রাত্রির প্রথম যামেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করে। এদিকে তার প্রত্যাবর্তনের কথা পরদিবস দ্বিপ্রহরে। জালিক পত্নী কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় যে অন্যের জলাশয়ে মৎস্য শিকার করার অপরাধে তাকে অর্থদণ্ড দিয়ে চলে আসতে হয়েছে। এ দুঃসংবাদ শুনে জালিক গৃহিণী অতিশয় কুপিতা হয়ে বলে, অর্থ দিয়েছে। ভালো–কিন্তু দণ্ডটি দিতে গেলে কেন?

গল্পটি অতিশয় অশ্লীল। শ্যামাঙ্গ বুঝেও না বোঝার ভান করলে সৈনিক পুরুষটি আবার। ব্যাখ্যা করে বলে, গৃহিণীকে এই জালিকের গল্পটি বুঝিয়ে বলিস এবং জানাস যে অর্থ গিয়েছে, কিন্তু দণ্ডটি তোর অক্ষতই আছে, তাহলেই দেখবি গৃহিণীর আর কোনো ক্ষোভ নেই।

ঐ কথার পর সৈনিক পুরুষ দুজন শ্যামাঙ্গের হাতের স্থলীটি নিয়ে চলে গেলো। আর তৎক্ষণাৎ শ্যামাঙ্গ বিপণীকারের নিকট প্রত্যাগত হয়ে সেখানে রেখে যাওয়া মুদ্রা কটি নিয়ে অতিদ্রুত নবগ্রাম হাট ত্যাগ করলো। তার তখন আর দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই। যে পথে এসেছিলো সেই পথেই সে ফিরে চললো। সে জানে না, গৃহে প্রত্যাগমন তার আশু সম্ভব হবে কি না।

পুনর্ভবা, আত্রেয়ী, করতোয়ার উভয় তীরের বিস্তীর্ণ ভূ–ভাগের জনপদগুলির তখন প্রায় এরূপই অবস্থা। গৌড়বঙ্গের রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে মহামহিম পরম ভট্টারক শ্রী লক্ষ্মণ সেন দেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। রাজসভায় উমাপতি, ধোয়ী এবং জয়দেবের কাব্যগীতির সুললিত মূৰ্ছনায় সভাস্থল বিমুগ্ধ। জয়দেবের কৃষ্ণলীলার বর্ণনা শ্রবণে সভাসদবর্গ তুরীয়ানন্দে বিহ্বল, ধোয়ীর পবনদূতের বর্ণনায় কামকলানিপুণা রমণীকুলের উল্লেখে স্রোতৃবর্গ অহো অহো উল্লসিত স্বর উচ্চারণ করে উঠছেন। স্মার্ত পণ্ডিতের ভাগবত বিশ্লেষণে মুহুর্মুহু। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাধু সাধু রব। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সন্দেহ করা হচ্ছে, যবন কেন্দ্রগুলিতে। কেন তাদের যাতায়াত, গূঢ় পুরুষেরা বিচিত্র সংবাদ আনছে। তথাপি প্রজাকুল সুখী। ব্রাহ্মণ সুখী, কায়স্থ সুখী, বৈশ্য সুখী। কেবল ব্রাত্য শূদ্রদের গৃহে অন্ন নেই, দেহে বস্ত্র নেই, মস্তকোপরি গৃহের আচ্ছাদন থাকে না। আজ যদি গ্রামপতি বসবাসের স্থান দিলেন, তো কালই বললেন, দূর হ, দূর হ, পামরের দল।

তা সকলের সুখ সম্পাদন কি মানুষের পক্ষে সম্ভব? ভগবান যাকে শূদ্র জন্ম দিয়েছেন পূর্ব জন্মের পাপের নিমিত্ত, সেখানে মানুষ কী করতে পারে? ভবিতব্য খণ্ডাবে মানুষের কি এতোই সাধ্য?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *