০৩. বরেন্দ্রভূমির এ অঞ্চল

বরেন্দ্রভূমির এ অঞ্চলটি বৎসরে একবার মাত্র শস্যময় হয়ে ওঠে। ধানক্ষেত্রগুলিতে হল স্পর্শ এখনও ঘটেনি। খরায় বরীন্দ্রের মৃত্তিকা লৌহপ্রায়, তৃণখণ্ডও গোচরে আসে না। চারণভূমি সম্ভবত দূরে কোথাও। সন্ধ্যাগমে তখন গৃহপালিত গবাদি সদলে গৃহে ফিরছে, তাদের খুরোৎক্ষিপ্ত ধূলিরাশি পশ্চিমাকাশে একটি ধূসর গৈরিক আবরণ বিস্তৃত করে দিয়েছে। ঐ সময় আবার খেয়ালী একটি রাখাল বালক বংশীতে শেষবারের মতো তার সুরটি বাজিয়ে নিচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গের মন ঐ সুর শুনে উদাস হয়ে উঠলো।

দূরে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গ বুঝলো, যেদিকে মন্দিরের ধ্বজা দেখা যাচ্ছে সম্ভবত সেদিকে ব্রাহ্মণদের বাস। গবাদি পশুর দল ঐ দিকেই চলেছে। শ্যামাঙ্গ বাম দিকের পথ ধরলো। পথ সংকীর্ণ, কখনও আম্রকাননের মধ্য দিয়ে, কখনও বা বেনুবীথিকার মধ্য দিয়ে। কিছু দূর অগ্রসর হতেই দেখলো কয়েকটি কুটির, ভয়ানক জীর্ণ দশা কুটিরগুলির। শ্যামাঙ্গ অনুমান করে, সম্ভবত এখানে ডোম শ্রেণীর বাস। এক প্রৌঢ়াকে দেখা গেলো সন্ধ্যার ম্লান আলোতেও চাঙাড়ি নির্মাণে ব্যস্ত। নিকটেই কর্দমাক্ত নালিকায় শূকর পাল। একটি উলঙ্গ বালক কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে মা মা ডাকে কেঁদে যাচ্ছে। শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করলো, বালকটির পঞ্জরাস্থিগুলি ভারী প্রকট। নিকটে গেলে নির্ভুলভাবে গণনা করা যাবে।

অধিক দূর যেতে হলো না। ডোমপল্লী অতিক্রম করে সামান্য অগ্রসর হয়েছে–ঐ সময় দেখলো একটি সপ্তপর্ণ বৃক্ষের নিচে দুই প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে গেলে তারাই জানতে চাইলেন, মহাশয়ের নিবাস কি আত্রেয়ী তীরে?

শ্যামাঙ্গ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক, আপাতত দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া গেলো। সে বুঝলো, মায়াবতী যথার্থই মায়াবতী। বয়োজ্যেষ্ঠ প্রৌঢ়টি বললেন, আমার কন্যা মায়াবতী আপনার আগমনের কথা আমাকে জানিয়েছে। আপনি নাকি মন্দিরে আর গ্রামপতির গৃহে আশ্রয় সন্ধান করছিলেন?

শ্যামাঙ্গ শুকদেবকে আভূমি বিনত হয়ে প্রণাম জানায়। সৌম্যকান্তি এই বৃদ্ধটিকে দেখে তার খুব ভালো লাগছে। দৃষ্টিমাত্র মনোহরণ করতে পারে এমন লোক শুকদেব। পার্শ্ববর্তী প্রৌঢ়টিকে দেখিয়ে বললেন, ইনি আমার পরমাত্মীয়, মায়াবতীর মাতুল দীনদাস নিবাস নিকটবর্তী গ্রাম উদয়পুর––বর্তমানে আমার গৃহে কিছুদিন অবস্থান করছেন।

বিনয়ে বিগলিত হওয়ার অবস্থা শ্যামাঙ্গের। কিছুক্ষণ পূর্বে সে পুনর্ভবা তীরবাসীর শীতল নিস্পৃহতা দেখে মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো, এখন সে মনে মনে লজ্জিত হলো। পথিককে যে এমন সম্মান দেখানো যেতে পারে, তার জানা ছিলো না।

পথক্রমণে আলাপ হচ্ছিলো। পিতৃপরিচয়, কি হেতু এই দূর–যাত্রা, পরিবারে কে কে বর্তমান, এইসব প্রসঙ্গ এবং সেই সঙ্গে আত্রেয়ী তীরের শস্য পরিস্থিতি, বস্ত্র–তৈজসাদির মূল্য, রাজপাদোপজীবীদের আচরণ–এই সকল বিষয়েও তারা নানান কথা জানতে চাইলেন।

সাংসারিক বিষয়াদি শ্যামাঙ্গের সম্যক জানা নেই। তবে যা সে জ্ঞাত ছিলো, জানালো। যেমন, তণ্ডুল বর্তমানে অধিক সুলভ নয়, গোধূম কদাচিৎ পাওয়া যায়–বস্ত্রাদি ক্রমেই মহার্ঘ হয়ে উঠছে, তৈজসাদির জন্য দক্ষিণের নৌযানগুলি আর আত্রেয়ী করতোয়া সঙ্গম পর্যন্ত আসছে না, রাজপুরুষদের হাতে প্রায়ই মানুষ অহেতুক লাঞ্ছিত হয়–এই সকল সংবাদ সে প্রৌঢ় দুটিকে জানাতে পারলো।

জলযোগ আগমন মাত্রই হয়েছে–সুতরাং তার ক্ষুধা ছিলো না। এবং ক্লান্তিও না। প্রায় সমগ্র অর্ধদিবস সে তো বিশ্রাম করেই কাটিয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা তাকে ঘিরে ছিলো। তাদের সান্নিধ্য শ্যামাঙ্গের ভালো লাগছিলো না। সে মনে মনে এমন সমবয়সী যুবাপুরুষ খুঁজছিলো, যাদের সান্নিধ্যে সে সহজ হাসি এবং আনন্দের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে পারে। সে ভাবছিলো, কখন গৃহের বাইরে যাবে, সে ঘুরে ফিরে জিজ্ঞাসা করছিলো, নিকটে শিবমন্দির আছে কি না, ধর্মক্রিয়াদি তাহলে কোথায় সম্পন্ন হয়? ব্রাহ্মণপল্লীতে কি নাট্টমন্দির আছে? কায়স্থপল্লী কতদূর? এ স্থানের কায়স্থরা কি যথার্থই কায়স্থ, নাকি ভূম্যাধিকারী মাত্র?

তার প্রশ্নের উত্তর কেউ কেউ দিচ্ছিলো। সমবেত লোকদের মধ্যে তরুণ বয়স্ক কয়েকজন ছিলো, তবে তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের উপস্থিতির কারণে অধিক আগ্রহ প্রকাশ করতে পারছিলো না। প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরা স্থানটিকে মুখরিত করে রেখেছেন। তারা প্রত্যেকে যত না শুনছিলেন তদপেক্ষা বলছিলেন বেশি। একজন তার ভাগিনেয়ীর কথা বললে অন্যজন তাঁর পাটল রঙের গাভীটির কথা আরম্ভ করে দেন। ওদিকে একজন আবার তাঁর দৌহিত্রটি কেমন চতুর হয়ে উঠেছে সেই সংবাদ জানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

দুজন একজন করে আরও প্রতিবেশীর আগমন ঘটেছে ততক্ষণে। দূরদেশী পথিকের সাক্ষাৎ অহরহ ঘটে না। তদুপরি শোনা গেছে যে পথিক যেমন প্রাজ্ঞ তেমনি সুরসিক। ফলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন আরম্ভ হয়ে গেলো এক সময়। যেমন, পথিক যে গ্রাম থেকে আসছেন, সে গ্রামে দ্রব্যসামগ্রী সুলভ, না মহার্ঘ? রাজপুরুষের ব্যবহার কেমন? পথিক কি লক্ষ্মণাবতীর সংবাদ জানেন? মহাসামন্ত হরি সেনের অনুচরেরা নাকি হাটের বিপণীকারদের কাছ থেকে কর আদায় করছে? মহাসামন্ত যজ্ঞদত্ত কি সত্যই বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী?

এসব প্রশ্নের উত্তর শ্যামাঙ্গ কেমন করে দেবে? সে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করলো। তার সৌভাগ্য যে বৃদ্ধেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাই ঐ প্রশ্নগুলির সূত্রে নানান প্রসঙ্গের অবতারণা করে ফেললেন। ফল হলো এই যে শ্যামাঙ্গকে আর কেউ কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারলো না।

শ্যামাঙ্গ কতক শুনছিলো, কতক শুনছিলো না। কিন্তু এক সময় তাকে মনোযোগী হতে হলো। আলোচনা হচ্ছিলো সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের সম্পর্কে। সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের নাকি অধিক সংখ্যায় আগমন ঘটছে এ অঞ্চলে। দীনদাস তার কাছে জানতে চাইলেন, আপনাদের অঞ্চলেও কি ভিক্ষুদের আগমন ঘটেছে?

অবাক হয় শ্যামাঙ্গ। বলে, কেন এ অঞ্চলে কি ভিক্ষু নেই?

আছে, দীনদাস জানান, তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য ছিলো, দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে। ছিলো দুজন, এখন তারা সংখ্যায় পাঁচজন।

শ্যামাঙ্গ ঠিক বুঝতে পারে না। বিশ ক্রোশ কি দুরতিক্রম্য দূরত্ব? না হলে এখানে এমন ভিন্ন পরিস্থিতি কেন? নিজ গ্রাম রজতপটে কোনো মন্দির নেই, কিন্তু ভিক্ষুরা তো ঠিকই আছে–ক্রমে হয়তো সংখ্যা বৃদ্ধিও হয়েছে তাদের। আম্রপট্টলীর সংবাদও তার জানা আছে–সেখানেও ভিক্ষুদের সংখ্যা কম নয়–বিল্বমূল গ্রামেও তো সে দেখে এলো ভিক্ষুদের। ভিক্ষুরা এমন কি গুরুত্ব ধারণ করে যে তাদের সংখ্যার হ্রাস–বৃদ্ধি আলোচনার বস্তু হয়ে উঠবে?

সে বললো, আমাদের অঞ্চলে সর্বত্রই ভিক্ষুরা আছে, বহুকাল ধরেই আছে, তাদের সংখ্যা নিয়ে কখনও কোনো সমস্যা হয়েছে এমন শুনিনি।

দীনদাস হাসেন। বলেন, তাহলে বলতে হবে, আপনাদের অঞ্চলে ব্রাহ্মণাদি কুলীনের সংখ্যা কম, নাকি রাজপাদোপজীবীরা যথেষ্ট শক্তিমান নয়?

শ্যামাঙ্গ প্রশ্নটির তাৎপর্য বুঝলো। আত্রেয়ী তীরে ব্রাহ্মণ কায়স্থাদি কুলীনের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়–এবং রাজপাদোপজীবীরাও বিলক্ষণ সেখানে উপস্থিত। তবে ভিক্ষু, শ্ৰমণ বা যোগীদের ব্যাপারে তাদের মারমুখী হতে কখনও দেখা যায় না। কে জানে, এ অঞ্চলে হয়তো এখনও প্রাচীনকালের বিধি–বিধানই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। মাতামহের কাছে সে শুনেছিলো, এক সময় নাকি ভিক্ষুদের গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো, কোনো গৃহস্থ–দ্বারে এলে তাদের দূর দূর করে তাড়না করা হতো।

সে জানায়, আজ্ঞে না, আপনার অনুমান ঠিক নয়। আত্রেয়ী তীরেও ব্রাহ্মণ কায়স্থ আছে এবং রাজপুরুষেরাও আছে। মনে হয়, ভিক্ষু নিগ্রহে তারা আর যথেষ্ট উৎসাহী নয়। হলে, আমি সে সংবাদ পেতাম।

মুহূর্তেক পর সে আবার বললো, এ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে আপনাদের এ অঞ্চলে ভিক্ষুর সংখ্যা মাত্রই পাঁচজন।

অহেতুক তোমরা ভিক্ষুদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অস্থির হচ্ছো, মায়াবতীর পিতা শুকদেব বলেন, ভিক্ষুরা তো এদেশী, তোমরা কি পশ্চিম দেশাগত যবন জাতীয়দের কেউ দেখেছো?

ঐ কথায় সকলে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পথিক কি দেখেছেন? পথিক নিশ্চয়ই যবন জাতীয়দের কথা জানেন, উনি নিশ্চয়ই কিছু বলবেন–এই প্রকার গুঞ্জন উঠলো। শ্যামাঙ্গ শুনেছে যে পশ্চিম দেশ থেকে যবন জাতীয় অশ্ব ব্যবসায়ীরা মধ্যে মধ্যে এসে থাকে। কিন্তু সে কখনও তাদের দেখেনি। সে বললো, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না, আমি তাদের দেখিনি।

তার কথায় সকলেই হতাশ হয়। তবে দীনদাস হলেন না। তিনি একটি যুবাপুরুষের দিকে ইঙ্গিত করলেন, গৌরদাস, তুমি তো যবনদের দেখেছো, তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ, গোকুল হাটে তারা এসেছিলো। অধিকক্ষণ থাকেনি, অপরাহ্নে এসে সন্ধ্যা সমাগমে তারা আবার চলে গিয়েছিলো, বড় অদ্ভুত জাতি।

গোকুল হাট উজুবট থেকে তিন ক্রোশ দূরবর্তী। সাধারণত গো–মহিষাদি পশু ক্রয় বিক্রয়ের জন্য সেখানে বহু দূরাগত ক্রেতা–বিক্রেতার সমাগম হয়। সকলেই উৎকর্ণ হয়ে উঠলো গৌরদাসের অভিজ্ঞতার বিবরণ শোনার জন্য।

কিন্তু শোনা হলো না। তার পূর্বেই অন্তঃপুরের আহ্বান এসে গেলো। একটি বালক এসে জানালো, আহারের আসন দেওয়া হয়েছে, রাত্রি কম হয়নি, মাতামহী পথিককে নিয়ে অন্তঃপুরে যেতে বলেছেন।

সবাইকে উঠতে হলো। প্রতিবেশীরা বিদায় নিলো একে একে। শ্যামাঙ্গের মনে কিন্তু ভিক্ষুদের সংখ্যাবৃদ্ধির প্রশ্নটি তখনও রয়েই গেছে। কেন এরা ভিক্ষুদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে এতো চিন্তিত? এই সংখ্যাবৃদ্ধির কি কোনো তাৎপর্য আছে? না হলে দীনদাস কেন ঐ প্রসঙ্গ তুললেন? আর যবন জাতি? এরাই বা কেন এদেশে আসছে? তার মনে একের পর এক প্রশ্নগুলি আসতে লাগলো।

আহারে মনোনিবেশ করতে পারলো না। অথচ আয়োজন ছিলো ভালো। মৎস্যের ব্যঞ্জনই তিন প্রকার, ভর্জিত ইল্লিশখণ্ড, সন্তলিত চিতলপেটিকা এবং নবাম্রসহযোগে মৌরলা। অলাবুসহ মুগও ছিলো সঙ্গে। দেখা গেলো, একটি মাত্র পাত্রে মাংস–ব্যঞ্জন। তবে তার প্রায়–রক্তিম তৈলাক্ত রূপ রসনাকে ব্যাকুল করার জন্য যথেষ্ট। এতদতিরিক্ত দধি খণ্ড–মিষ্টান্ন ইত্যাদি তো ছিলোই।

দ্বারান্তরাল থেকে গৃহিণী অবলোকন করছিলেন। তরুণ পথিকটিকে দর্শনমাত্রই তাঁর পুত্রশোক উদ্বেল হয়ে উঠেছে। গত বৎসর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রটি দস্যুহস্তে নিহত হয়েছে। তার সঙ্গে পথিকের মুখাবয়বে অদ্ভুত সাদৃশ্য। তিনি বস্ত্রাঞ্চলে নয়নজল মুছেছেন বার দুই। শ্যামাঙ্গকে অমনোযোগী দেখে মায়াবতীকে ইঙ্গিত করলেন। সে বলে উঠলো, ভ্রাতঃ কিছুই যে নিচ্ছেন না, গৃহের জন্য কি চিন্তা হচ্ছে?

ঐ কথার পর আহারে মনোযোগী হতে হলো। তবে প্রশ্নটি না তুলে পারলো না শ্যামাঙ্গ। দীনদাসের মুখপানে দৃষ্টি রেখে জানতে চাইলো, ভিক্ষুদের সংখ্যা বৃদ্ধির কি কোনো তাৎপর্য আছে বলে বোধ হয় আপনার?

দীনদাস তখন মুখ গহ্বরে মৎস্যপেটিকার তৈলাক্ত অংশটি নিয়ে ওষ্ঠদ্বয় সংবদ্ধ করে দক্ষিণ হস্তে কণ্টক গুচ্ছ টানতে ব্যস্ত। তিনি ঐ অবস্থাতেই মস্তক হেলন করলেন। তবে ঐ পর্যন্তই, তাকে আর বলতে হলো না। শুকদেব জানালেন, নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না–তবে বাল্যকাল থেকে শুনে আসছি, কাষায় বস্ত্রধারী মুণ্ডিতমস্তক ঐ ভিক্ষুরা নানাবিধ দুষ্কর্মের আকর। তারা এক সময় রাজদ্রোহী ছিলো, এ কারণে গৌড়াধিপতি ও তাঁর অনুচর রাজপুরুষেরা তাদের সমূলে উৎপাটিত করেন তাদের মন্দিরগুলিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এবং ঐ প্রজ্বলিত অগ্নিতে পুরোহিতদের নিক্ষেপ করা হয়। এতোকাল পরে যখন আবার তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে, তখন সেটি একেবারেই তাৎপর্যবিহীন হতে পারে, বলুন?

বৌদ্ধ প্রসঙ্গটি শ্যামাঙ্গেরও কিঞ্চিৎ জানা আছে। সে জানে, সমগ্ৰ গৌড়বঙ্গে বৌদ্ধ নিগ্রহের ঘটনাটি ঘটে, কিন্তু সে তো প্রায় শতাধিক বর্ষ পূর্বের কথা। দুর্বল, বিতাড়িত এবং প্রায় নিশ্চিহ্ন কাষায় বস্ত্রধারী ভিক্ষুদের এখন এমন কি শক্তি সঞ্চয় হয়েছে যে তারা মাণ্ডলিক ও সামন্ত মহাসামন্তদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে? সে বুঝে উঠতে পারে না।

দীনদাস, তুমি কি পশ্চিম দেশাগত যবনদের দেখোনি? হঠাৎ শুকদেব শ্যালককে প্রশ্ন করেন।

হ্যাঁ, দেখেছি, অত্যন্ত নিকট থেকে দেখেছি–সে বড় আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আপনি দেখেছেন ধর্ম প্রচারকদের, কিন্তু আমি দেখেছি বণিকদের। আচ্ছা, আপনি কি ওদের উপাসনা করতে দেখেছেন? দীনদাস জানতে চান।

না তো? শুকদেব কৌতূহলী হলেন। বললেন, তুমি কোথায় দেখলে, বলোনি তো?

গোকুল হাটেই আমি দেখেছি–আমার সঙ্গে গৌরদাস ছিলো। বলতে বলতে দীনদাস দধি ভাণ্ডটি কাছে টেনে নিলেন। অতঃপর পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন, সে এক বিরল অভিজ্ঞতা, এবং অভিনব দৃশ্য। গোকুল হাটে ওরা সেদিন তিনটি অশ্ব নিয়ে আসে–অশ্বারোহণেই তারা এসেছিলো। তাদের অশ্বগুলি দেখবার মতো। আহা! যেমন তাদের উচ্চতা, তেমনি তাদের দেহসৌষ্ঠব, মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় একেবারে।

বণিক দলটি ছিল ক্ষুদ্র, সংখ্যায় তারা মাত্রই চারিজন। দ্বিপ্রহরের পরে তারা হাটে উপনীত হয়। বলাই বাহুল্য, তাদের অশ্ব ক্রয় করার মতো লোক গোকুল হাটে ছিলো না। সম্ভবত ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছিলো তারা। তাই অপরাহ্নের শেষে তারা বিশ্রাম এবং আহারের আয়োজন করে। একজন প্রথমে একখানি বস্ত্র বিস্তৃত করে। তার মধ্যস্থলে রাখা হয় খাদ্যবস্তুগুলি, খণ্ড–মিষ্টান্ন এবং কদলী। অতঃপর একে একে তারা হস্তমুখ প্রক্ষালন সম্পন্ন করে। ঐ প্রক্ষালন ক্রিয়াও সম্ভবত তাদের উপাসনার অঙ্গ। কারণ হস্তমুখ প্রক্ষালনের সময় তারা মন্ত্রপাঠ করছিলো, নিঃশব্দে।

হঠাৎ মনে হয়, গৃহদ্বারে কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে। সে উৎকর্ণ হলো। কটিবন্ধে হস্তস্পর্শ করলো, চোর দস্যু নয় তো?

কিন্তু ক্ষণকাল পরই তার মনে হলো কেউ যেন তাকে ডাকছে। শুনতে পেলো, ভ্রাতঃ আপনি কি নিদ্রাগত?

স্পষ্ট এবং পরিচিত নারী কণ্ঠস্বর। মায়াবতীর কথা স্মরণ হয়। এবং স্মরণ মাত্রই তার মনে এবং দেহে বিচিত্র একটি ভাবের জাগরণ ঘটে। ভাবে, তবে কি পুনর্ভবা তীরের রমণীরা সত্যিই শিথিলশাসনা? এবং স্বাধীন ভর্ত্তৃকা?

সে দ্বার অর্গলমোচন করে দাঁড়ায়–আর মুহূর্তের মধ্যে দুটি রমণীর ছায়ামূর্তি অন্ধকার কুটিরে প্রবেশ করে।

এ ঘটনায় উল্লসিত না হয়ে ঈষৎ শঙ্কিত হয় সে। এই দূর ভিন্ন দেশে অপরিচিতা নারী কি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে কে জানে। সে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। আর তাতেই যেন অস্ফুট অথচ ক্ষুব্ধ স্বর শোনা গেলো। একজন বলছে, চল এখন যাই, উনি হয়তো বিরক্তি বোধ করছেন।

তার কথার উত্তরে মৃদু ভৎর্সনা উচ্চারিত হয়। মায়াবতী বলে, আহ্ চুপ কর তো তুই–আমার ভ্রাতাকে যদি আমি কিছু বলতে চাই, তাতে তিনি বিরক্ত কেন হতে যাবেন–এতদূর এসে ফিরে যাবো?

দুই সখীর মধ্যে ঐ প্রকার বাদানুবাদ আরম্ভ হলে শ্যামাঙ্গ আশ্বস্ত বোধ করে। তার স্বরে কৌতুকস্পর্শ পাওয়া যায়। সে বললো, কি সংবাদ মায়াবতী, রাত্রির এই মাধ্যমে হঠাৎ কি প্রয়োজন?

মায়াবতী বারেক ইতস্তত বোধ করে। তারপর বলে, ভ্রাতঃ আমাদের কিছু কথা আছে, সেই কারণে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি–অপরাধ নেবেন না–আপনি তো প্রভাতেই স্বগ্রামাভিমুখে যাত্রা করবেন–সময় হবে না বলেই রাতের এই মধ্যযামে আসতে হলো।

মায়াবতী ক্রমে সহজ হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আপনার যাত্রাপথেই আম্রপট্টলী গ্রাম পড়বে। আপনি যদি সেখানে দণ্ড পরিমাণ কাল অবস্থান করে ললিতদাসের পুত্র অভিমন্যু দাসের সংবাদ নেন তো বড় উপকার হয়। বৎসরাধিক কাল হয় সে স্ত্রীকে পিত্রালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে–কিন্তু তারপর আর কোনো সংবাদের আদান–প্রদান নেই। বলবেন, তার স্ত্রী লীলাবতী ভারি উদ্বিগ্না। সে যেন সত্বর একবার উজুবটে আসে।

শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝে নেয় এবং কৌতুক বোধ করে। বলে, এই প্রকার কাজে আমার দক্ষতা কিরূপ তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। তবে একটা কথা—

কি কথা? লীলাবতীর আগ্রহী স্বর শোনা যায়।

আপনি বলুন, যদি সুসংবাদ প্রেরণ করতে পারি, তাহলে আমার জন্য কী পুরস্কার আছে?

না, কৌতুক নয় ভ্রাতঃ, মায়াবতী জানায়। বলে, সখী লীলাবতী সত্যিই উদ্বিগ্না। তার পিতা দীর্ঘদিন রোগশয্যায় শায়ী।

মায়াবতীর স্বরে বিলক্ষণ আকুলতা ছিলো। শ্যামাঙ্গ সেটা উপলব্ধি করে বলে, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, অভিমন্যু দাসের সন্ধান আমি অবশ্যই করবো।

ক্ষণেক পরে সে পুনরায় জানতে চাইলো, তার পূর্বে আমার জানা প্রয়োজন, অভিমন্যু দাস স্বগ্রামে অবস্থান করছেন কিনা। তিনি অন্য কোথাও চলে গেলে তাঁর সন্ধান করা কঠিন হবে।

না, সে সংবাদ এখানে আমরা পাইনি, মায়াবতী জানায়, অতঃপর বলে, তবু আপনি সন্ধান করে দেখবেন–যদি কোথাও গমন করে থাকেন, তাহলে সে সংবাদটিও তো আমাদের জানা প্রয়োজন।

অবশ্যই, শ্যামাঙ্গকে স্বীকার করতে হয়। বলে, আম্রপট্টলীতে নিজের প্রয়োজনেই আমাকে যেতে হবে, যদি অভিমন্যু দাসের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় তাহলে তাকে আমি উজুবটে নিয়ে আসতে পারবো বলে আশা করি–কারণ আমার মাতুলালয় ঐ গ্রামেই।

ঐ আলাপের ক্ষণকাল পরই মায়াবতী এবং তার সখী চলে গেলো, যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো, তেমনি নিঃশব্দেই।

আরও কি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে? শ্যামাঙ্গ নিজের কাছে প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ শয্যায় বসে রইলো। বাইরে কদলীপত্রে বায়ু তাড়নার শব্দ তখনও হয়ে চলেছে–এবং দীর্ঘক্ষণ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যখন আর কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো না, তখন, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শ্যামাঙ্গ দাস শয্যায় শয়ান হলো। এবার সে নিদ্রা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *