০৪. দুপুর পর্যন্ত ধৈৰ্য ধরে

বাড়ি এসে দুপুর পর্যন্ত ধৈর্য ধরে তারপর ফেলুদাকে আর না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।—

‘কাল যে নরেন বিশ্বাসের ব্যাগ থেকে একটা সাদা কাগজ বেরোল, তাতে কী লেখা ছিল?’

নরেন বিশ্বাসের খাতাটা ফেলুদা বিকেলে ফেরত দিতে যাবে। সে খবর নিয়ে জেনেছে যে, ভদ্রলোক পার্ক হসপিটালে আছেন।

ফেলুদা তার খাতাটা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিল।

‘যদি এর মানে বার করতে পারিস তা হলে বুঝব নোবেল প্রাইজ তোর হাতের মুঠোয়।’

খাতার রুল টানা পাতায় লেখা রয়েছে—

B/S 141 SNB for WG Victoria & P.C. (44?)

Re Victoria’s letters try MN, OU, GAA, SJ, WN

আমি মনে মনে বললাম, নোবেল প্রাইজটা ফসকে গেল। তাও মুখে বললাম, ‘ভদ্রলোক কুইন ভিক্টোরিয়া সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড পি সি টা কী ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘পি সি বোধ হয় প্রিন্স কনসর্ট; তার মানে ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট।’

‘আর কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘কেন, ফর মানে জন্য আর ট্রাই মানে চেষ্টা বুঝলি না?’

ফেলুদার মেজাজ দেখে বুঝলাম সেও বিশেষ কিছু বোঝেনি। সিধু জ্যাঠার কথাটা যে আমারও মনে ধরেনি তা নয়। ফেলুদা সত্যিই হয়তো যেখানে রহস্য নেই সেখানে জোর করে রহস্য ঢোকাচ্ছে। কিন্তু তার পরেই মনে পড়ে যাচ্ছে কালকের সেই জ্বলন্ত সিগারেটটা, আর সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভিতরটা কেমন যেন খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা আছি জেনে কে পালাল গোরস্থান থেকে? আর বাদলা দিনে সন্ধে করে সে সেখানে গিয়েছিলই বা কেন?

আগে থেকেই ঠিক ছিল যে চারটের সময় আমরা নরেন বিশ্বাসের ব্যাগ ফেরত দিতে যাব, আর লালমোহনবাবুই আমাদের এসে নিয়ে যাবেন। টাইমমাফিক বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ পেলাম। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন হাতে একটা পত্রিকা নিয়ে। ‘কী বলেছিলুম মশাই? এই দেখুন বিচিত্রপত্র, আর এই দেখুন নরেন বিশ্বাসের লেখা। সঙ্গে একটা ছবিও আছে মনুমেন্টের, যদিও ছাপেনি ভাল।’

‘কিন্তু এও তো দেখছি নরেন্দ্রনাথ বলছে; নরেন্দ্রমোহন তো নয়। তা হলে কি অন্য লোক নাকি?’

‘আমার মনে হয় ভিজিটিং কার্ডেই গণ্ডগোল। বাজে প্রেসে ছাপানো। আর ভদ্রলোক হয়তো প্রুফও দেখেননি। কিন্তু ব্যাগের মধ্যে ওই কাটিং আর তার পর এই লেখা—ব্যাপারটা স্রেফ কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?’

ফেলুদা লেখাটায় চোখ বুলিয়ে পত্রিকাটা পাশের টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে বলল, ‘ভাষা মন্দ না, তবে নতুন কিছু নেই। এখন জানা দরকার এই লোকই গাছ পড়ে জখম হওয়া নরেন বিশ্বাস কি না।’

পার্ক হসপিটালের ডাঃ শিকদারকে বাবা বেশ ভাল করে চেনেন। আমাদের বাড়িতেও এসেছেন দু-একবার, তাই ফেলুদার সঙ্গেও আলাপ। ফেলুদা কার্ড পাঠানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমাদের ডাক পড়ল।

‘কী ব্যাপার? কোনও নতুন কেস-টেস নাকি?’

ফেলুদা যেখানেই যে-কারণেই যাক না কেন, চেনা লোক থাকলে তবে এ প্রশ্নটা শুনতেই হয়।

ও হেসে বলল, ‘আমি এসেছি এখানের এক পেশেন্টকে একটা জিনিস ফেরত দিতে।’

‘কোন পেশেন্ট?’

‘মিস্টার বিশ্বাস। নরেন বিশ্বাস। পরশু—’

‘সে তো চলে গেছে! এই ঘণ্টা দু-এক আগে। তার ভাই এসেছিল গাড়ি নিয়ে; নিয়ে গেছে।’

‘কিন্তু কাগজে যে লিখল—’

‘কী লিখেছে? সিরিয়াস বলে লিখেছে তো? কাগজে ওরকম অনেক লেখে। আস্ত একটা গাছ মাথায় পড়লে কি আর সে লোক বাঁচে? একটা ছোট ডাল, যাকে বলে প্রশাখা, তাই পড়েছে। জখমের চেয়ে শকটাই বেশি। ডান কবজিটায় চোট পেয়েছে, মাথায় ক’টা স্টিচ—ব্যাস এই তো।’

‘আপনি কি বলতে পারেন ইনিই পুরনো কলকাতা নিয়ে—’

‘ইয়েস। ইনিই। একটা লোক সন্ধেবেলা গোরস্থানে ঘোরাঘুরি করছে, ন্যাচারেলি কৌতূহল হয়। জিজ্ঞেস করতে বললেন পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করছেন। তা আমি বললুম ভাল লাইন বেছেছেন; নতুন কলকাতাকে যতটা দূরে সরিয়ে রাখা যায় ততই ভাল।’

‘জখমটা স্বাভাবিক বলেই মনে হল?’

‘অ্যাই!… পথে আসুন বাবা। এতক্ষণে একটা গোয়েন্দা মার্কা প্রশ্ন হয়েছে!’

ফেলুদা অপ্রস্তুত ভাবটা চাপতে পারলে না।

‘মানে, উনি নিজেই বললেন যে গাছ পড়ে…?’

‘আরে মশাই, গাছটা যে পড়েছে তাতে তো আর ভুল নেই? আর উনি সেখানেই ছিলেন। সন্দেহ করার কোনও কারণ আছে কি?’

‘উনি নিজে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু বলেননি তো?’

‘মোটেই না। বললেন, চোখের সামনে দেখলাম গাছটা ভাঙল—তার ডালপালা যে কতখানি ছড়িয়ে আছে সেটা তো আর আঁচ করা সম্ভব হয়নি। তবে হ্যাঁ—ইয়েস—জ্ঞান হবার পরে ‘উইল’ কথাটা দু-তিনবার উচ্চারণ করেছিলেন। এতে যদি কোনও রহস্য থাকে তো জানি না। মনে তো হয় না, কারণ উইলের উল্লেখ ওই একবারই; আর করেননি।’

‘ভদ্রলোকের পুরো নামটা আপনার জানা আছে?’

‘কেন, কাগজেই তো বেরিয়েছিল। নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস।’

‘আরেকটা প্রশ্ন—বিরক্ত করছি, কিছু মনে করবেন না—ওনার পোশাকটা মনে আছে?’

‘বিলক্ষণ। শার্ট আর প্যান্ট। রংও মনে আছে—সাদা শার্ট আর বিস্কিটের রঙের প্যান্ট। গ্ল্যাক্সো না, ক্রিম ক্র্যাকার—হেঃ হেঃ!’

ফেলুদা ডাঃ শিকদারের কাছে নরেন বিশ্বাসের ঠিকানা নিয়ে নিয়েছিল। আমরা নার্সিংহোম থেকে সটান চলে গেলাম নিউ আলিপুরে। ভারী ঝামেলা নিউ আলিপুরে ঠিকানা খুঁজে বার করা, কিন্তু জটায়ুর ড্রাইভার মশাইটি দেখলাম কলকাতার রাস্তাঘাট ভালই চেনেন। বাড়ি বার করতে তিন মিনিটের বেশি ঘুরতে হয়নি।

দোতলা বাড়ি, দেখে মনে হয় পনেরো থেকে বিশ বছরের মধ্যে বয়স। গেটের সামনে রাস্তার উপর একটা কালো অ্যামবাসাডর দাঁড়িয়ে আছে, আর গেটের গায়ে দুটো নাম—এন বিশ্বাস ও জি বিশ্বাস। বেল টিপতে একজন চাকর এসে দরজা খুলে দিল।

‘নরেনবাবু আছেন কি?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।

‘তার তো অসুখ।’

‘দেখা করতে পারবেন না? একটু দরকার ছিল।’

‘কাকে চাই?’

প্রশ্নটা এল চাকরের পিছন দিক দিয়ে। একজন চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের ভদ্রলোক এগিয়ে এসেছেন। ফরসা রং, চোখ সামান্য কটা, দাড়ি-গোঁফ কামানো। পাজামার উপর বুশ শার্ট, তার উপর একটা মটকার চাদর জড়ানো। ফেলুদা বলল, ‘নরেন বিশ্বাস মশাই-এর একটা জিনিস তাঁকে ফেরত দিতে চাই। ওঁর মানিব্যাগ, পকেট থেকে পড়ে গেসল পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে।’

‘তাই বুঝি? আমি ওঁর ভাই। আপনারা ভিতরে আসুন। দাদা বিছানায়। এখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা। কথা বলছেন, তবে এ রকম অ্যাক্সিডেনট…একটা বড় রকম ইয়ে তো!…’

দোতলায় যাবার সিঁড়ির পিছন দিকে একটা বেডরুম, তাতেই নরেনবাবু শুয়ে আছেন। ভাইয়ের চেয়ে রং প্রায় দু-পোঁচ কালো, ঠোঁটের উপর বেশ একটা পুরু গোঁফ, আর মাথার ব্যান্ডেজটার নীচে যে টাক আছে সেটা বলে দিতে হয় না।

বাঁ হাতে ধরা স্টেটসম্যান কাগজটা নামিয়ে ভদ্রলোক ঘাড় হেঁট করে আমাদের নমস্কার জানালেন। ডান কবজিতে ব্যান্ডেজ, তাই হাত জোড় করে নমস্কারে অসুবিধা আছে। ভাইটি আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। শুনলাম চাকরকে হাঁক দিয়ে আরও দুটো চেয়ারের কথা বলে দিলেন। এ ঘরে রয়েছে একটিমাত্র চেয়ার, খাটের পাশে ডেস্কের সামনে।

ফেলুদা মানিব্যাগটা বার করে এগিয়ে দিল।

‘ও হো হো—অনেক ধন্যবাদ। আপনি আবার কষ্ট করে…’

‘কষ্ট আর কী’—ফেলুদা বিনয়ভূষণ—‘ঘটনাচক্রে ওখানে গিয়ে পড়েছিলাম, আমার এই বন্ধুটি কুড়িয়ে পেলেন, তাই…’

নরেনবাবু এক হাতেই মানিব্যাগের খাপগুলো ফাঁক করে তার ভিতরে একবার চোখ বুলিয়ে ফেলুদার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। ‘গোরস্থানে…?’

‘আমিও আপনাকে ঠিক ওই প্রশ্নই করতে যাচ্ছিলাম,’ ফেলুদা হেসে বলল, ‘আপনি বোধহয় প্রাচীন কলকাতার ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করছেন?’

ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

‘করছিলাম তো বটেই—কিন্তু যা ঘা খেলাম! মনে হয় পবনদেব চাইছেন না আমি এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করি।’

‘বিচিত্রপত্র কাগজে যে লেখাটা—’

‘ওটা আমারই। মনুমেন্ট তো? আমারই। আরও লিখেছি দু-একটা এখানে সেখানে। চাকরি করতাম, গত বছর রিটায়ার করেছি। কিছু তো একটা করতে হবে! ছাত্র ছিলাম ইতিহাসের। ছেলেবেলা থেকেই ওদিকটায় ঝোঁক। কলেজে থাকতে বাগবাজার থেকে হেঁটে দমদম যাই ক্লাইভ সাহেবের বাড়ি দেখতে। দেখেছেন? এই সেদিন অবধি ছিল—একতলা বাংলো টাইপের বাড়ি, সামনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোট-অফ-আর্মস৷’

‘আপনি প্রেসিডেন্সিতে পড়েছেন?’

খাটের ডান পাশেই টেবিল, আর তার দু-হাত উপরেই দেয়ালে একটা বাঁধানো গ্রুপ ছবিতে লেখা—

‘Presidency College Alumni Association 1953.’

‘শুধু আমি কেন,’ বললেন নরেন বিশ্বাস, ‘আমার ছেলে, ভাই, বাপ, ঠাকুর্দা সবাই প্রেসিডেন্সির ছাত্র। ওটা একটা ফ্যামিলি ট্রাডিশন। এখন বলতে লজ্জা করে—আমরা সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র—গিরিন, আমি, দুজনেই!’

‘কেন, লজ্জা কেন!’

‘কী আর করলুম বলুন জীবনে? আমি গেলাম চাকরিতে, গিরিন গেল ব্যবসায়। কে আর চিনল আমাদের বলুন?’

ফেলুদা এগিয়ে গিয়েছিল ছবিটা দেখতে। এবার তার দৃষ্টি নামল নীচের দিকে। টেবিলের উপর একটা নীল খাতা। সেটার প্রথম পাতাটা খোলা রয়েছে, দেখে বোঝা যাচ্ছে একটা লেখা শুরু হয়ে আট-দশ লাইনের বেশি এগোয়নি।

‘আপনার নাম কি নরেন্দ্রনাথ না নরেন্দ্রমোহন?’

‘আজ্ঞে?’

ভদ্রলোক বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। ফেলুদা আবার প্রশ্নটা করল। ভদ্রলোক একটু হেসে একটু যেন অবাক হয়ে বললেন, ‘নরেন্দ্রনাথ বলেই তো জানি৷ কেন, আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে?’

‘আপনার ভিজিটিং কার্ডে দেখলাম এন এম বিশ্বাস রয়েছে।’

‘ও হো! ওটা তো ছাপার ভুল। কাউকে কার্ড দেবার আগে ওটা কলম দিয়ে শুধরে দিই। অবশ্য নতুন কার্ড ছাপিয়ে নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু গাফিলতি করে আর করিনি। আর সত্যি বলতে কী, আমাদের আর ভিজিটিং কার্ডের কী প্রয়োজন বলুন। ইদানীং মিউজিয়ম-টিউজিয়মের কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গে একটু দেখা-টেখা করতে হচ্ছিল তাই ব্যাগে কয়েকটা ভরে নিয়েছিলাম। ভাল কথা—আপনিও কি ওই গোরস্থান নিয়ে লিখবেন-টিখবেন নাকি? আশা করি না! আপনার মতো ইয়াং রাইভ্যালের সঙ্গে কিন্তু পেরে উঠব না!’

ফেলুদা যাবার জন্য উঠে পড়ে বলল, ‘আমি লিখিটিখি না—শুধু জেনেই আনন্দ। ভাল কথা—একটা অনুরোধ আছে। পুরনো কলকাতা নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে যদি গডউইন পরিবারের কোনও উল্লেখ পান তা হলে অনুগ্রহ করে জানালে উপকার হবে।’

‘গডউইন পরিবার?’

‘টমাস গডউইনের সমাধি পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে রয়েছে। ইন ফ্যাক্ট, একই গাছ একসঙ্গে আপনাকে এবং গডউইনের সমাধিকে জখম করেছে।’

‘তাই বুঝি?’

‘আর সার্কুলার রোড গোরস্থানে গডউইন পরিবারের আরও পাঁচটা সমাধি রয়েছে।’

‘অবিশ্যি জানাব। কিন্তু কোথায় জানাব? আপনার ঠিকানাটা?’

ফেলুদা তার প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর লেখা কার্ডটা নরেনবাবুর হাতে তুলে দিল।

‘এই আপনার পেশা নাকি? গোয়েন্দাগিরি?’ ভদ্রলোক বেশ একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কলকাতায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ আছে বলে শুনেছি, কিন্তু চোখে দেখলাম এই প্রথম!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *