৩২. বিদ্যা ও বিশ্বাস

বিদ্যা ও বিশ্বাস

মনে মনে আমরা কতোগুলো জিনিশ আগে থেকেই ধরে নিই। যেমন, উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষ ভদ্র হবেন বলে আমরা প্ৰত্যাশা করি। একজন ধাৰ্মিক লোক সৎ হবেন–এও আমরা আগে থেকেই ভেবে রাখি। কিন্তু কাৰ্যকালে আমাদের ধারণা যে সব সময়ে সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ উপাধিধারী একজন লোক হয়তো অসভ্যোর মতো আচরণ করেন। মস্ত উপাধিধারী একজন বিজ্ঞানী হয়তো কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন। অনেক সময়ে তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা অশিক্ষিত লোকের চেয়েও বেশি মূর্খতার পরিচয় দেন। আমরা তখন দুঃখ করে বলি— উপাধি থাকলেও অমুক লোকটি আসলে মুর্থ। এটা কী করে সম্ভব? ছেলেবেলা (অথবা তসলিমা নাসরীনের ভাষায় মেয়েবেলা) থেকে আরম্ভ করে ষোলো-সতেরো-আঠারো (সেশন জটের ওপর নির্ভরশীল) বছর ধরে অনেক পড়ালেখা করে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখস্থ করে প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় (নকলের যুগে তৃতীয় শ্রেণী কি এখনো আছে?) শ্রেণীতে পাশ করে তারপর এক-একজন অশিক্ষিতের মতো আচারণ করে কী করে? অতো বছর যে গদ্যে-পদ্যে এতো শ্লোক আওড়ালো, তার কি কোনো আছরই হলো না কঠিন হৃদয়ের ওপর? এ জন্যেই ধর্মগ্রন্থে সম্ভবত বলা হয়েছে, এদের কানে (আসলে হৃদয়ে) তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরা তোতা পাখির মতো পড়া মুখস্থ করে, কিন্তু তাদের দিলে তা কোনো আঁচড় কাটে না। ডিগ্রি আর বিদ্যা আসলে ভিন্ন বস্তু। বিদ্যা আর বিশ্বাসও আলাদা।

একটা উদাহরণ দিই। অনেক বছর আগে এক শিশু-বিশেষজ্ঞের কাছে অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক বিদেশ থেকে উচ্চ উপাধি নিয়ে এসেছিলেন। শিশু-চিকিৎসায়। সামান্য জ্বর এবং সেই সঙ্গে পেটের অসুখ। শিশুটির বয়স আড়াই বছর। ওষুধ দিলেন। বলেন, খাওয়ান আর আল্লাহ আল্লাহ করেন। উদ্বিগ্ন বাবা আল্লাহ আল্লাহ করতেই পারি, কিন্তু সে উপদেশ ডাক্তারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করিনি। তাঁর কাছে গিয়েছিলাম দোয়ার জন্যে নয়, দাওয়াইয়ের জন্যে। আল্লাহআল্লাহ ছাড়াই দুদিনের মধ্যে শিশুটির পেটের অসুখ ভালো হলো। জ্বরও কমে গেলো। কিন্তু গায়ের তাপমাত্রা নেমে গেলো ৯৬ ডিগ্রিতে। বিচলিত হয়ে ডাক্তারকে ফোন করলাম। ডাক্তার বললেন, গায়ে একটু বেশি কাপড়চোপড় পেঁচিয়ে রাখুন। আর আল্লাহ আল্লাহ করুন। কিন্তু ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন না। স্যালাইন দেওয়ার কথাও বললেন না। তারপর সারা রাত ধরে যমে মানুষে যে টানাটানি হলো, সে কথা এখানে অবান্তর। উচ্চশিক্ষা যে ডাক্তারকে মানুষ করতে পারেনি, সেটাই বড়ো কথা।

আমাদের দেশে শিক্ষার হার এখন আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া, প্রাথমিক শিক্ষার তুলনায় উচ্চশিক্ষা ছড়িয়েছে অনেক বেশি। অপরিকল্পিত শিক্ষার ফলেই দেশে এতো শিক্ষিত বেকার। এতো শিক্ষিত বেকার বলেই চারদিকে এতো চাঁদাবাজ, এতো রাজনৈতিক “নেতা-কর্মী।” (অর্থাৎ টাউট), এতো হাইজ্যাকার, এতো সন্ত্রাসী। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এতো দুর্নীতি এবং অপরাধ। কয়েক মাস আগে এক ভূমি রেজিষ্ট্রোরের এজলাশে যেতে হয়েছিলো কপালের ফেরে। নিজের চোখে দেখলাম অন্তত পচিশ জন লোকের ভিড়ের মধ্যে মহামান্য রেজিস্ট্রর সাহেব হাত বাড়িয়ে ঘুস নিলেন। এ রকমের চোখের চামড়াহীন ঘুসখের আমি জীবনে দেখিনি। কিন্তু ভদ্রলোক এমএ পাশ। বুঝলাম, শিক্ষা তার মনে সততার কোনো ছাপ এঁকে দেয়নি। সাধারণ লজ্জার মনোভাবও নয়। এর থেকে বেশ্যারও চক্ষুলজ্জা বোধ হয় বেশি থাকে।

আমাদের দেশে সর্বোচ্চ চাকুরে থেকে আরম্ভ করে চৌকিদার পর্যন্ত তাবৎ লোকই বোধ হয় কমবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। এখন প্রাইমারিতে চাকরি পেতে হলেও এমএ পাশ করতে হয়। কাজেই অনুমান করি চৌকিদার সাহেবও কোনো পাশ দিয়ে থাকবেন। কিন্তু এই লাখ লাখ শিক্ষিত লোকের মধ্যে নীতির, মূল্যবোধের, সততার, সত্যবাদিতার, দয়ার, দক্ষিণ্যের, ত্যাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। অথবা থাকলেও তাদের বিদ্যার তুলনায় তা এতোই কম যে, তা অনুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়।

অথচ এখন থেকে কয়েক দশক আগেও শিক্ষার সঙ্গে আদর্শবাদের একটা যোগ ছিলো। দেশের লোকেদের শিক্ষিত করবেন–এই মহান ব্ৰত নিয়ে একজন শিক্ষক হতেন। ছাত্রদের মধ্যে আদর্শ প্রচার করতেন। এখন প্রথমেই শিক্ষা-ব্যবসায় নামবেন। বলে ঘুস দিয়ে তথাকথিত শিক্ষক চাকরি জোগাড় করেন। টিউটরিয়াল হোম খোলেন। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে একই সঙ্গে দু-তিন দল ছাত্রছাত্রীকে পড়ান। ক্লাসে না-পড়িয়ে বাড়িতে পড়ান। নিজের ছাত্রদের প্রশ্ন বলে দেন। ছাত্রদের পরীক্ষার খেয়া পার হবার উপায় বাৎলে দেন। কিন্তু শিক্ষা দেন না। সত্য কথা বলতে শেখান না। সৎ হওয়ার আদর্শ দেখান না তাদের। সমাজসেবার আদর্শ উচ্চারণও করেন না। বরং দফায় দফায় পড়িয়ে কিভাবে শিক্ষা-বাণিজ্য করা যায় নিজেই তার জলজ্যান্ত এবং অনুকরণীয় আদর্শ তুলে ধরেন শিক্ষার্থীর সামনে।

আগে সমাজসেবকরা রাজনীতিক হতেন। শিক্ষিত লোকেরা রাজনীতিক হতেন। গান্ধীজী, জিন্নাহ, নেহেরু, আবুল কালাম আজাদ, চিত্তরঞ্জন, সুভাষ বসু, ফজলুল হক, শ্যামাপ্রসাদ, হরেন মুখোপাধ্যায়–সবাই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। সবাই দেশসেবা করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে জমি-জমা কেনেননি। শিল্প-বানিজ্যের মালিক হয়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেননি। বরং দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্যে তারা বিখ্যাত ছিলেন। চিত্তরঞ্জন তার সমস্ত সম্পত্তি দান করেছিলেন দেশের কাজে। এমন কি, ব্যারিস্টারিও ছেড়ে দিয়েছিলেন দেশের কাজ করবেন বলে। ফজলুল হকও দয়ার জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। হরেন মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবার আগে ইংরেজিতে পিএইচডি করেছিলেন। তিনি জীবনযাপন করতেন অতি সাধারণ গরিব মানুষের মতো। মারা যাওয়ার সময় আঠারো লাখ টাকা দান করে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর হাসপাতালে। এখনও অনেক রাজনীতিক এমএ পাশ, পিএইচডি পাশ। কিন্তু রাজনীতি আর দুর্নীতি এখন প্রায় সমার্থক। যে-যতো বড়ো রাজনীতিক, তাঁর ততো প্রতিপত্তি। যতো বেশি প্রতিপত্তি, ততো বেশি দুর্নীতি। রাজনীতি মানে কোটি কোটি টাকা। রাজনীতি মানে অন্যের গলা কাটা। এখন শিক্ষার সঙ্গে আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই। শিক্ষা আর নীতিহীনতার এখন নিত্য সহবাস।

(যুগান্তর, ২০০৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *