২৮. স্বাধীনতার লাভ লোকসান

স্বাধীনতার লাভ লোকসান

প্রতিদিন যেসব নতুন ঘটনা ঘটে, তার প্রতিবেদন থাকে খবরের কাগজে। সেসব ঘটনার প্রতিটি আলাদা, তাদের চরিত্রও আলাদা। কিন্তু বছর ঘুরে গেলে সেই আলাদা-আলাদা ঘটনাগুলো মিলে একটা কোলাজ তৈরি হয়। তার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে একটা সামগ্রিক প্রবণতা। সেই প্রবণতা, সেই প্যাটার্ন নিয়ে আলোচনা করা ইতিহাসকারের কাজ। সেই সামগ্রিক ঘটনাবলীর মূল্যায়নও ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পর যাদের জন্ম হয়েছে, তাদের বয়স এখন ৩৫। আর, লড়াই করে যারা দেশকে স্বাধীন করেছিলেন তাঁরা এখন বৃদ্ধ– অনেকেই মৃত। একটা মূল্যায়ন করার জন্যে সময়ের যে-দূরত্ব প্রয়ােজন, তা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা আসায় কি পেয়েছি, কি পাইনি–তার হিশেবে খানিকটা মেলানো এখন সম্ভব। খানিকটা বলছি। এই জন্যে যে, কিভাবে পাকিস্তান গড়ে উঠলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এবং তারপর কিভাবে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে আবার পাকিস্তান ভেঙে গেলো, দূর থেকে তাকালে সেটা প্রায় জ্যামিতিক ধারাবাহিকতার মতো লক্ষ্য করা যায়। অপর পক্ষে, বাংলাদেশ হবার ফলে যেসব লাভ-লোকসান হয়েছে, সেগুলো এখনো অতোটা স্পষ্ট নয়, তার কারণ আমরা তারই মধ্যে এই মুহূর্তে ডুবে আছি।

স্বাধীন দেশ হিশেবে বাংলাদেশের আত্মপ্ৰকাশই একটা অসাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনা। তাবৎ বিশ্বে আমরা এখন বাংলাদেশ নামক একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিশেবে পরিচিত। এই স্বাধীন দেশ গড়ে ওঠার ফলে এই অঞ্চল এবং এই অঞ্চলের জনগণের উন্নতির বহু পথ খুলে গেছে–রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি— প্রতিটি ক্ষেত্রে। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা প্ৰায় নজিরবিহীন উন্নতি লক্ষ্য করেছি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ্যিক্ষত উন্নতি আসেনি আমাদের অযোগ্যতা এবং দুর্নীতির ফলে। এমন কি, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। মোট কথা, স্বাধীনতা থেকে যে-ফল আমরা পেয়েছি, তার সবটাই অমৃত ফল নয়, তার মধ্যে হলাহলও আছে।

স্বাধীনতা লাভের ফলে আমরা যে একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পেরেছি— এটা যেমন সবচেয়ে বড়ো লাভ; তেমনি স্বাধীনতা লাভের ফলে আমাদের পরিচয় বদলে গেছে অথবা আমাদের পরিচয় আমরা স্বেচ্ছায় বদলে নিয়েছি।–এটাকে আমার মনে হয়েছে সবচেয়ে বড়ো লোকসান। আমরা বহু মূল্যের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছিলাম বাঙালি হবো বলে কিন্তু স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক বছর পরেই আমরা মুসলমান হয়েছি। এখন কেবল সাধারণ মুসলমান নয়, তালেবান হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এই পরিণতি হবে জানলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাণ দিতেন কিনা, মুসলমান-অমুসলমান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতেন। কিনা, সন্দেহ হয়। জাপানের নাগরিক হতে হলে প্রথমেই প্রার্থীকে তার পুরোনো নাম বদলে একটা জাপানী নাম নিতে হয়। আত্মপরিচয়ের বিনিময়ে আত্মসম্মানবিশিষ্ট কেউ জাপানের নাগরিক হতে চাইবেন কিনা, আমার জানা নেই। কিন্তু আমি চাইবো না। আমার ধারণা মুক্তিযোদ্ধারা তালেবান রাষ্ট্র গঠনের জন্যে সংগ্রাম করতেন না। স্বাধীনতার এটা সবচেয়ে বড়ো বিষফল।

তবে ক্ষমতা দখলের খেলায় আমাদের পরিচয় পাল্টে গেলেও, রাজনৈতিক কোনো অগ্রগতিই হয়নি, তা নয়। পাকিস্তানী আমলের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছিলো ফৌজী শাসনে। গণতন্ত্র আদৌ। তার শিকড় গাড়তে পারেনি সেখানকার উষর মাটিতে। সেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে শিক্ষাপ্রাপ্ত জিয়াউর রহমান এবং হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ পাকিস্তানী ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে বাংলাদেশে ফৌজী একনায়কত্ব চালিয়েছিলেন প্রায় পনেরো বছর। কিন্তু এ দেশের সেনাবাহিনী যেহেতু দূর থেকে আসেনি, বরং গড়ে উঠেছে আমাদেরই আত্মীয়স্বজন দিয়ে, সে জন্যে তা আইয়ুবী নির্যাতনের চেহারা নিতে পারেনি। অথবা স্থায়ীও হতে পারেনি। সেনাবাহিনী এখনো দেশের শাসনব্যবস্থায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, গত পনেরো বছর ধরে শিশু গণতন্ত্ৰ হাঁটি-হাঁটি পা পা করে চলতে শুরু করেছে, যদিও দলগুলো এখনো চলে নেতার মর্জিমাফিক। নেতৃত্ব গড়ে ওঠে বংশীয় ধারায়। কাজেই এ দেশের গণতন্ত্র এখনো কাৰ্যত নির্বাচিত একনায়কত্ব। এ দেশের রাষ্ট্রপতির চাকরিও নির্ভর করে ক্ষমতাসীন দলের একজন ব্যক্তির ওপর। কোনো রাষ্ট্রপতি দলতন্ত্রের উর্ধে উঠে খানিকটা নিরপেক্ষতার ভান করলেও তার চাকরি চলে যায়। তবে এই একনায়কত্ব সত্ত্বেও কোনো নেতা সাধারণ নির্বাচনকে একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। নির্বাচনের মাধ্যমেই তাদের ক্ষমতায় যেতে হয়। কারচুপি করে যাতে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায়, তার জন্যে তাদের কলকাঠি নাড়তে হয়। তা ছাড়া, যতো দুর্বল হোক গণতন্ত্র, তাকে উল্টে দিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করছে না। অথবা দখল করতে পারছে না। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া গণতন্ত্র নয়, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। সবাই যে এই পদ্ধতি মেনে নিয়েছেন–এটা নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার একটা ইতিবাচক দিক।

এই অমূল্য রাজনৈতিক লাভ ছাড়াও প্রশাসনিক দিক দিয়েও আমাদের পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার আগে এবং তারপরের এক দশক আমাদের প্রশাসন কাঠামো এতো বিস্তৃত অথবা স্তরবিশিষ্ট ছিলো না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা এখন ডানেবায়ে, সামনে-পেছনে, উপরে-নিচে ডালপালা মেলেছে। একটা জনবহুল দেশের জন্যে সেটার প্রয়োজনও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তার ফলে এখন প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে–সরকারের সবচেয়ে ধামা-ধরা সমর্থকের পক্ষেও তা বলা অসম্ভব। বরং স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত প্রশাসনের কাছ থেকে যে-কাজ পাওয়া যেতো, এখন তার অনেকটাই পাওয়া যায় না, অথবা অতো সহজে পাওয়া যায় না। বরং স্তর বৃদ্ধির ফলে এখন কাজ সম্পন্ন হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার গতিও হয়েছে মন্থর।

সম্পদের তালিকায় বিশ্বের তাবৎ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে নিচের দিকে হলেও, পর পর গত পাঁচ বছর পৃথিবীর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ সবার সেরা বিবেচিত হয়েছে। (সেরা কথাটার কী অপব্যবহার!) দুর্নীতির এই বিষাক্ত হাওয়া দেশ অথবা সমাজের একটি ক্ষুদ্র কোণে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অফিস-আদালতের চত্বরেও নয়। তা ছড়িয়ে পড়েছে সবচেয়ে বড়ো পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি থেকে আরম্ভ করে একেবারে সবার পিছে সবার নিচে যে আছে, তার মধ্যেও । সব পেশায়–সব মানুষের মধ্যে। এক সময়ে রাজনীতি ছিলো সমাজসেবার মতো, একটা মহৎ কাজ। এখন রাজনীতি মানে দুর্নীতি এবং বাহুবল। আগে চিকিৎসকের কাজ ছিলো মানুষের সেবা করা। এখন সেটা হলো মানুষের দুৰ্গতি ভাঙিয়ে ব্যবসা করার সর্বজন-প্ৰশংসিত প্রশস্ত রাজপথ। আইন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকেরা এখন আইনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কেবল টাকা কামাই করার কাজে শশব্যস্ত। বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। অথচ আইন বলবত করা এবং দুর্নীতি দমন করাই পুলিশের কাজ। তা ছাড়া, আদালতও, বিশেষ করে নিম্ন আদালতগুলো, দুর্নীতির ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। আর বড়ো আদালত রাজনীতির ছোবলে কালিমা-লিপ্ত হয়েছে।

প্রশাসনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বেড়েছে দু ভাবে। প্রথমত, অফিসের বড়ো সাহেব থেকে আরম্ভ করে একেবারে অধস্তন কর্মচারী পর্যন্ত কেউই এখন উপরি পাওনা / অনুগ্রহ লাভ / রাজনৈতিক ফয়দা ছাড়া কোনো কাজ করেন না। মিশরে ঘুসের একটা সৰ্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি আছে। সব কাজের জন্যে সেখানে এক-একটা নির্দিষ্ট ঘুসের অঙ্ক ঠিক করা আছে। সরকারী মাশুলের সঙ্গে সেটাও দিতে হয়। দিনের শেষে অফিসের সবাই সেই ঘুস আনুপাতিক হারে ভাগ করে নেয়। কিন্তু ভালো দিক হলো এই যে, দিনের শেষে কাজটাও সম্পন্ন হয়। ফলে যার কাজ সেও সন্তুষ্ট হয়। তার কোনো অভিযোগ থাকে না। বাংলাদেশে ঘুসের এ রকম কোনো স্বীকৃত পদ্ধতিও নেই। এমন কি, ঘুস দিলেও কাজ হবে–তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই।

দুর্নীতির দ্বিতীয় এবং সম্ভবত প্রধান কারণ: রাজনৈতিক প্রভাব। মন্ত্রী, যন্ত্রী, সন্ত্রিীরা–সবাই প্রভাব খাটান। সবার হাতেই টেলিফোন। আগে টেলিফোন যখন সর্বত্রগামী ছিলো না, তখন অন্তত থানা, ইউনিয়ন ইত্যাদি পর্যায়ে কর্মকর্তাদের তোেয়াজ করে অথবা টাকা পয়সা দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যেতো। কিন্তু এখন গ্রামীণ ফোনের দৌলতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামও রাজনৈতিক প্রভাবের আওতায় এসেছে। কেবল মন্ত্রী নন, সাংসদ, ক্ষমতাসীন দলের কমী, দালাল এবং চাঁদাবাজসবাই ফোনাফুনিতে পারদশী। থানায় একটা মামলা নেওয়া হবে। কিনা, সেটাও সাংসদ এবং তার চামচাদের মর্জির ওপর নির্ভর করে। ওদিকে প্রশাসনের অনেক কর্মচারীই যেহেতু দুর্নীতিগ্ৰস্ত সে জন্যে তারা এই রাজনৈতিক টাউট এবং চেলাদের ফোন অগ্রাহ্য করতে পারেন না। সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না নিজেদের বিবেক-বিবেচনা অনুযায়ী। বরং যে-কর্মকর্তা রাজনৈতিক প্রভাব যতো বেশি স্বীকার করে নেন, তাঁর উন্নতি ততো দ্রুত গতিতে হয়। কেউ ভিন্ন পথে চলতে চাইলে তাকে ওএসডি হতে হয়। ব্যাচ-মেইটদের পেছনে পড়ে থাকতে হয়। এমন কি, ক্ষেত্রবিশেষে চাকরি হারাতে হয়। সুতরাং নিতান্ত অবিবেচক না-হলে সব কর্মকর্তা বাধাপথেই চলেন। বাংলাদেশে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হয়–এটা ঐ সৰ্ব্বগ্রাসী দুর্নীতিরই প্রত্যক্ষ ফলাফল। এটা স্বাধীনতার সুফল নয়, অবাঞ্ছিত কুফল। কোন তথাকথিত নিরপেক্ষ বিচারপতিকে দিয়ে ভোট কারচুপির পথ পরিষ্কার হবে–সেই হিশেবে করে বাংলাদেশে বিচারপতির অবসর গ্রহণের সময় পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। দুর্নীতির এমন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেন রাজনীতিকরা! কে বলে বাঙালিরা মেধাবী নন? উর্বর মস্তিষ্কবিশিষ্ট লোক নন?

বাংলাদেশে যে-জিনিশটার অস্তিত্ব বলতে গেলে লোপ পেয়েছে, তা হলো আইনের শাসন। ষাটের দশকে আমরা ছিলাম ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে। তার ওপর সেই শাসনের চরিত্র ছিলো সঙিন—উচানো। তা সত্ত্বেও তখন দেশে আইনআদালত ছিলো। অপরাধ হলে তার বিচার হতো। জীবন এবং মালের নিরাপত্তাও ছিলো। এমন কি, পত্রপত্রিকায় ধর্মীয় রক্ষণশীলতা-সহ নানা বিষয়ে লেখা যেতো। রক্ষণশীলতার দুর্গে হামলা চালালে অথবা সরকারের সমালোচনা করলে লোকে প্ৰগতিশীল বলে প্ৰশংসা করতো।

মানুষ খুন করেও শাস্তি না-পেতে পারে। এমন কি, প্ৰাণদণ্ড-প্রাপ্ত অপরাধীও বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীরা বহাল তবিয়তে জেলখানায় জামাই আদরে না-থাকলেও অন্তত খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। এর মধ্যে সাধারণ খুনী থেকে আরম্ভ করে এমন খুনীও আছে যারা দেশের নির্বাচিত সরকার-প্রধানকে হত্যা করার অপরাধে প্ৰাণদণ্ডে দণ্ডিত। আবার প্রাণদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী বিদেশে অবস্থান কালেই তার দেশে ফেরার পথে লাল গালিচা বেছানোর জন্যে তার দণ্ডাদেশ রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দেন– এমন ঘটনাও ঘটে। কেবল তাই নয়, মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্তকে দণ্ড দিতে যে-প্ৰশাসন ব্যর্থ হচ্ছে, সেই একই প্রশাসন আবার চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী অথবা চরমপন্থীকে নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে হত্যা করে। এভাবে ন্যূনতম মানবাধিকার পর্যন্ত লোপ পায়।

দেশের বেশির ভাগ লোক অবশ্য খুনখারাপি নয়, ক্ষতিগ্ৰস্ত হন। ছোটোখাটো অপরাধ থেকে। তারও কোনো বিচার হয় না। বিচার হলেও ন্যায্য বিচার হয় না। ন্যায্য বিচার হলেও শাস্তি হয় না। শোনা যায়, এখন টাকা দিয়ে জামিন নিশ্চিত করা যায়। এমন কি, মামলার রায়কে প্রভাবিত করা যায়। ক্ষমতাসীন দলের হাতের পুতুল হওয়ায় উচ্চ আদালত সেই বিচারকের ক্ষমতাকে স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছে— এমন দৃষ্টান্ত এর আগে কোথাও স্থাপিত হয়নি। রাজনীতি দিয়ে বিচার-ব্যবস্থাকে এতো প্রভাবিত করা যাচ্ছে বলেই ক্ষমতাসীন দল বিচার-ব্যবস্থাকে প্রশাসন ব্যবস্থা থেকে আলাদা করার দাবিকে নানা কৌশলে ঠেকিয়ে রাখে। আবার সেই দল বিরোধী দলে পরিণত হলে তখন বিচার-ব্যবস্থাকে স্বাধীন করার দাবি জানায়। বিচার বিভাগের এ হেনো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে এখনো মাঝেমধ্যে এক-একটা স্বাধীন রায়ের কথা শোনা যায়, এমন কি সরকারের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে।

আর্থিক দিক দিয়েও বাংলাদেশ কিন্তু অনেকটা অর্জন করেছে। প্রবৃদ্ধির পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। আর ব্যক্তির কথা বিবেচনা করলে বাংলাদেশের কয়েক লাখ পরিবার রীতিমতো ধনী হয়েছে। বস্তুত, স্বাধীনতার ননী-মাখন তাঁরাই নিঃশেষে শোষণ করেছেন। তবে এ কথা বোধহয় স্বীকার করতে হবে যে, ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানও বৈদেশিক সাহায্যের কল্যাণে আগের তুলনায় খানিকটা উন্নত হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে এও স্বীকার নাকরে উপায় নেই যে, এ দেশে শিল্পায়ন এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ যতোটা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, তার তুলনায় সামান্যই হয়েছে। এই সীমিত বিকাশের কারণ: সর্বব্যাপী দুর্নীতি, দলবাজি ট্রেড ইউনিয়ন এবং অস্থিতিশীল রাজনীতি।

ব্যবসায়ীরা চিরকালই টাকা করার ধান্ধায় ছিলেন। মানুষকে ঠকিয়ে বাড়তি মুনাফা করাই তাদের কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে সৎ ব্যবসায়ীও আগে ছিলেন। লাভ করলেও, অন্তত লোভে তারা বিবেক বিসর্জন দিতেন না। অপর পক্ষে, এখনকার ব্যবসায়ী ব্যস্ত ভেজাল মেশাতে। সিন্ডিকেট করে জিনিশের দাম বেঁধে দিতে। কিভাবে কম কষ্টে রাতরাতি বড়ো লোক হওয়া যায়, ঠিকাদার থেকে আরম্ভ করে দোকানদার পর্যন্ত সবারই সেই একই স্ট্র্যাটিজি। এক কথায়, মানুষ টাকার জন্যে এখন কেবল সততা নয়, মনুষ্যত্ব এবং বিবেক ধুয়ে-মুছে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো ছুটছে। টাকা দিয়ে এখন সবাইকেই কেনা যায়। কেবল এক-একজনের একএকটা দাম। কারো একটু বেশি, কারো কিছু কম।

সামাজিক দিক দিয়ে আমাদের লাভ বেশি হয়েছে, নাকি লোকসান, তা অবশ্য বিতর্কের বিষয়। শিক্ষার হার লক্ষযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে–এটা অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক পরিবর্তন। সেই সঙ্গে আর-একটা অত্যন্ত ইতিবাচক পরিবর্তন হলো স্ত্রীশিক্ষার বিকাশ। যে দেশে পঞ্চাশ বছর আগেও বেশির ভাগ পরিবারে স্ত্রীশিক্ষাকে মনে করা হতো অগ্রহণযোগ্য এবং লোকাচারিবিরোধী, সেই দেশে স্ত্রীশিক্ষার এই বিকাশকে অসাধারণ অগ্রগতি না-বলে উপায় নেই। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মেয়েরা এখন ছেলেদের চেয়ে ভালো ফলাফল করছে। কিন্তু এই অগ্রগতি সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান নিচে নেমে গেছে বলেই অনেকে ধারণা করেন। এটা আদৌ ইতিবাচক নয়।

স্ত্রীশিক্ষা বিকাশের ফলে মহিলারা এখন নানা পেশার ছোটো-বড়ো নানা পুদে কাজ করছেন। আগে যেখানে কয়েকটা মাত্র পেশা খোলা ছিলো মেয়েদের জন্যে, এখন সেখান প্ৰায় সব পেশাতেই তাদের দেখতে পাওয়া যায়। এবং তারা এসব কাজে যোগ্যতারও পরিচয় দিয়েছেন। দুর্নীতিও তাদের মধ্যে পুরুষদের চেয়ে কম বলে মনে হয়। স্বাধীন উপার্জন করার ক্ষমতা লাভ করায় সমাজ এবং পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের কণ্ঠ জোরালো হয়েছে। ইউনিয়ন থেকে সংসদ পর্যন্ত সব স্তরের রাজনীতিতে তাদের নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। যে-পুরুষ সমাজ এক সময়ে “স্ত্রীবুদ্ধি’ বলে মেয়েদের মননশীলতাকেই প্রশ্ন করতেন, এখন সেই পুরুষকুল নারীনেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতা যেমনই হোক, দেশে পর পর দুজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ফলে সামগ্রিকভাবে নারীনেতৃত্বের প্রতি পুরুষদের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে-নারীকে পুরুষরা এক কালে মেয়েমানুষ বলে হেয় জ্ঞান করতেন, সেই নারীদেরই এখন তারা ম্যাডাম ম্যাডাম’ করে তাদের অনুগ্রহ লাভের জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন। একে বিশেষ ইতিবাচক পরিবর্তন বলে বিবেচনা করতে হবে।

সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রেও উন্নতির অনেক লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সাহিত্য, সঙ্গীত, থিয়েটার, সিনেমা— প্রতিটি ক্ষেত্রে। স্বাধীনতা উন্নতির যে-পথ খুলে দেয়–সেই পথ ধরেই এসব বিকাশ ঘটেছে। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত ঢাকায় মঞ্চ ছিলো না। নাটকের অভিনয় ছিলো ব্যতিক্রমী ব্যাপার। এখন ঢাকায় অনেকগুলো থিয়েটার গোষ্ঠী হয়েছে। তার চেয়েও বড়ো কথা–ঢাকায় রীতিমতো উচ্চমানের অভিনয় হচ্ছে। অভিনয়ের প্রয়োজনে ভালো নাটকও লেখা হচ্ছে। এমন কি, টেলিভিশনের কল্যাণেও অনেক নাটক লেখা হচ্ছে। থিয়েটারের দিক দিয়ে ঢাকা কলকাতাকে ছাড়িয়ে না-গেলেও টেলিভিশন নাটকের দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত সিনেমা-শিল্প ছিলো নিতান্ত শিশুতোষ। বিশেষ করে পশ্চিবঙ্গে যেখানে সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র তৈরি করছিলেন, সেখানে বাংলাদেশের সিনেমা রূপকথার জগতে বিরাজ করছিলো। কিন্তু এখন সিনেমার বিকাশ অনেকটাই ঘটেছে। তারেক মাসুদ, হুমায়ূন আহমেদ, তানভীর মোকাম্মেল প্রমুখ ভালো ছবি নির্মাণ করতে এগিয়ে এসেছেন। শ্যামল ছায়া, চন্দ্ৰকথা, মাটির ময়না এবং লালসালুর মতো ছবি এখন তৈরি হচ্ছে। মুখ ও মুখোশ থেকে বাংলাদেশের সিনেমা অনেক দূর এগিয়ে এসেছে।

সঙ্গীতেও অনেক উন্নতি হয়েছে। এর সঙ্গে সামাজিক উন্নতিরও যোগ রয়েছে। এক সময়ে মুসলিম সমাজে গান-বাজনার চর্চা বলতে গেলে নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু এখন নিতান্ত মৌলবাদী ছাড়া সবাই গানকে মেনে নিয়েছেন। সুযোগ-সুবিধে এবং ভালো শিল্পীর সংখ্যাও অনেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে সঙ্গীতের মানও উন্নত হয়েছে। এর একটা প্রমাণ এই যে, বাংলাদেশের রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, পল্লীগীতি, এমন কি, আধুনিক গান এখন পশ্চিমবাংলায়ও সমাদৃত হচ্ছে। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে বাংলাদেশ অবশ্য এখনো পিছিয়ে আছে। তার কারণ, এই ক্ষেত্রে অতো কম সময়ের মধ্যে উন্নতি করা কঠিন। প্রসঙ্গত নাচের কথাও বলা যায়। যেমুসলিম সমাজে গানই ছিলো ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ, সে সমাজে মেয়েদের নাচের কথা ভাবাও যেতো না। এখন শহরের শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা নাচতে পারে–এ কথা শুনলে বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার কারণ থাকে না।

পাকিস্তানী আমল থেকেই সাহিত্যের উন্নতি শুরু হয়েছিলো। কিন্তু তখন প্রকাশের সুযোগ এবং শিক্ষার হার এখনকার তুলনায় অনেক কম থাকায় সে বিকাশ হয়েছিলো সীমিত পরিমাণে। এখন প্ৰযুক্তির উন্নতির ফলে প্রকাশনা-শিল্পে বলতে গেলে বিপ্লব ঘটে গেছে। কেবল বই নয়, পত্রপত্রিকার সংখ্যা খুবই বৃদ্ধি পেয়েছে। এতো ছোটো একটা দেশে এতোগুলো দৈনিক পত্রিকা–প্ৰায় কল্পনাই করা যায় না। এসব পত্রপত্রিকার প্রয়োজনে নাম-করা কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার না-হলেও, কতো যে কলাম লেখক তৈরি হয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এ ধরনের বেশির ভাগ খবরের কাগুজে লেখা না-লিখলেও ক্ষতি হতো না। কিন্তু পত্রিকার ভরাট করার জন্যে লিখতে হয়। এসব কলাম লেখকদের। এই প্ৰায় সংখ্যাহীন রচনার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই দুচারটা ভালো লেখাও প্রকাশিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম এবং সরকারী ভাষা যেহেতু বাংলা, সে জন্যে নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষার প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটা প্রধান কারণ পাঠ্যপুস্তক এবং পরিভাষা। তা ছাড়া, পত্রপত্রিকার প্রয়োজনে এখন এন্তার লেখা হচ্ছে এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে লেখা হচ্ছে। ফলে ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি না-হলেও, প্রকাশক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ধারণা আগে যা ইংরেজি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হতো, এখন তা লেখা হয়। বাংলা দিয়ে, যদিও বেশির ভাগ কষ্ট করে বুঝে নিতে হয়। কতোগুলো সুন্দর শব্দও তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো আঞ্চলিক শব্দও এখন লিখিত ভাষায় সর্বজন স্বীকৃত না-হোক, সর্বজনবোধ্য শব্দে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো শব্দের অর্থ বদলে যাচ্ছে। যেমন “জব্দ” শব্দটি। চিরকাল এর অর্থ ছিলো কাউকে বেকায়দায় ফেলা, নাজেহাল করা ইত্যাদি। কিন্তু এখন অনেক পত্রিকায় লক্ষ্য করছি এর অর্থ দাঁড়িয়েছে পুলিশ কর্তৃক কোনো কিছু আটক করা। ‘বিধায়’ বলে কোনো শব্দ স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত জানতাম না। কিন্তু এখন বিধায় একটি বহুলব্যবহৃত শব্দে পরিণত হয়েছে। মুখের ভাষাতেও শব্দটার ব্যবহার লক্ষ্য করেছি।

বাংলা ভাষার ব্যবহার আগের তুলনায় অনেক বাড়লেও, বেশির ভাগ শিক্ষিত লোক ভুল বানানে, ভুল ব্যাকরণে কোনো মতে নিজের মনের কথা প্ৰকাশ করতে পারেন। শুদ্ধ বানানে এবং শুদ্ধ ব্যাকরণে একটি চিঠি লিখতে পারেন–এমন লোকের সংখ্যা দেশে শিক্ষার হারের তুলনায় অনেক কমে গেছে। আগে গ্রাম থেকে এসে সবাই মোটামুটি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শিখতেন। এখন কর্মকর্তা, সাংসদ, মন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে শিক্ষকরা পর্যন্ত প্ৰামাণ্য ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলেন। এমন কি, বেতার-টেলিভিশনের মতো একটা মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়েও তারা শুদ্ধ উচ্চারণে প্ৰামাণ্য বাংলা বলতে পারেন না।

গত তিন দশকে মানুষের গড় আয়ু আগের তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্যাল সালাইনের মতো স্পল্পমূল্যের কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বহু লোকের প্রাণ রক্ষায় সাহায্য করেছে। এমন কি, টিকা দান সম্পর্কে সচেতনতাও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গড় আয়ু বৃদ্ধি থেকে জীবনযাত্রার মান এবং চিকিৎসা-সুযোগ বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। (এর সঙ্গে কোনো অলৌকিক শক্তির যোগাযোগ কল্পনা করার মানে নেই।) পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কেও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবারের আকার কতো বড়ো হবে–সে ব্যাপারে অনেক নারী এখন তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্ৰকাশ করতে আরম্ভ করেছেন। এও নিঃসন্দেহে উন্নতির সূচক।

অপর পক্ষে, সমাজের দিকে আর-একটু গভীরভাবে তাকালে খুশিতে আট-খানা হবার উপায় থাকে না। এক সময়ে শিক্ষক এবং অধ্যাপকরা ছিলেন সমাজের চোখে আদর্শ মানুষ। এখন সেই আদর্শ মানুষেরা তাদের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অসৎ পথে টাকা করছেন। তাদের অনেকে ক্লাস নেন না। যারা ক্লাস নেন, তারা ক্লাসে নাপড়িয়ে টিউটরিয়াল হোমে পড়ান। একটা চাকরির দায়িত্ব পুরো পালন না-করেই আর-একটা উপরি চাকরি জুটিয়ে নেন। এমন কি, পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারেও সততা পালন করেন না।

শুধু শিক্ষক-অধ্যাপক নন, সাংবাদিক, আইনজীবী, পেশাদারদের মতো বুদ্ধিজীবী বলে যে-শ্রেণী একদিন সমাজে পরিচিত ছিলো, সমাজবিবেকের কণ্ঠস্বর ছিলেন যারা, তারাও এখন তাদের বোধ এবং মননশীলতার পণ্য দিয়ে বাণিজ্য করছেন। সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি ভুলে গেছেন তারা; অথবা ভুলে যাওয়ার ভান করছেন। কোনো নীতি অথবা আদর্শের প্রতি তাদের আনুগত্য নেইবেশ্যার মতো তাদের দ্বার সবার জন্যেই অবারিত। দরদস্তুর ঠিক থাকলেই হলো। যখন দেশে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মাত্র চার-পাঁচজন, তখন তোফাজ্জল হোসেনের মতো সাংবাদিক জেল খেটেছিলেন। তাঁর পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়েছিলো। এখন সম্পাদকের সংখ্যা নির্ণয় করার জন্যে ক্যাকুলেটর প্রয়োজন হয়, কিন্তু কোনো সম্পাদক কারারুদ্ধ হন না। খুব কম বুদ্ধিজীবীই সরকারী রক্তচক্ষুর শিকার হন। কারণ তারা আপোশ করার জন্যে তৈরি থাকেন সব সময়। তারা বন্দী স্ব-আরোপিত সেন্সর এবং প্রলোভনের কারাগারে।

৬০-এর দশকে বাঙালিয়ানা যখন তুঙ্গে পৌঁছেছিলো, তখন বুদ্ধিজীবীরা অনায়াসে ধর্মীয় গোড়ামির কঠোর সমালোচনা করতে পারতেন এবং করতেনও। সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলনে মানুষ রাস্তায় নামতো। আমীর হোসেন চৌধুরীর মতো মানুষ তাতে প্রাণও দিয়েছিলেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত হলেও, তখনো পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র ছিলো না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে যে-বাংলাদেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশ এখন কেবল মুসলমানপ্রধান দেশ নয়, কার্যত ইসলামী দেশ। অমুসলমানরা সেই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। হিটলারের আমলের ইহুদীদের মনে করিয়ে দেন তারা। সেই দেশের জন্মের বিরুদ্ধে যারা এক সময়ে অস্ত্ৰ ধারণ করেছিলো, সেই রাজাকারদের নেতারা এখন পতাকা উড়িয়ে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেন। সেই রাজাকার-নেতারা এখন দেশের আইনের থেকেও ফতোয়াকে বড়ো বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। আইন-আদালত তুলে দিয়ে মসজিদ-রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান। তার থেকেও দুঃখের বিষয়—সমগ্র বুদ্ধিজীবী সমাজ আমিনীদের সেই দৰ্পিত উক্তি বিনা প্রতিবাদে শুনে যান।

ধর্মের নামে এমন উগ্ৰবাদ বঙ্গদেশে কখনো ছিলো না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইতিহাসে দেখা গেছে ধর্মের ব্যাপারে বাঙালিরা সহনশীল। বাংলার হিন্দুধর্ম ভারতীয় হিন্দুধর্ম থেকে আচার-উৎসবে অনেকটাই ভিন্ন। বাঙালির বৌদ্ধধর্ম ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম থেকে অনেকাংশে আলাদা। আর বাংলার ইসলাম মধ্যপন্থী, গুরুমুখীআরব দেশের ইসলাম থেকে যথেষ্ট আলাদা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-ডলারের প্লাবনে ইসলামের সেই সহনশীলতা ধুয়ে-মুছে বঙ্গোপসাগরে নেমে গেছে। সেই সঙ্গে লুপ্ত হয়েছে মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই— এই চিরন্তন সত্য। এ দেশে মানুষের জন্যে ধর্ম নয়, ধর্মের জন্যে মানুষ। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসার ফলে আমরা নিঃসন্দেহে কট্টরপন্থার অধীনতা গ্ৰহণ করেছি। স্বাধীনতার বহু লাভের মধ্যে এই আদর্শ বিসর্জন সবচেয়ে বড়ো লোকসান।

(যুগান্তর, ২০০৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *