১৭. আধুনিকতা

আধুনিকতা

চল্লিশোত্তীর্ণ খালাম্মাকে দেখলেন হাল ফ্যাশানের শাড়ি-ব্লাউজ পরা / চোখে সান-গ্লাস / শরীরের কোনো কোনো অংশ একটু বেশি বের-করা / উঁচু হিল-ওয়ালা জুতো পরে খট খট করে করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলেন। আপনার বন্ধুরা তাকে বলতে পারেন— “আধুনিকা।” বলতে পারেন তাঁর সহকর্মীরাও। এমন কি, আড়ালে আপনিও তাদের দলে যোগ দিতে পারেন। খালাম্মার চেয়ে কম বয়সী, ধরা যাক, মধ্য-তিরিশের কোনো মহিলাকেও একটু সাহসী পোশাক পরলে আধুনিকা বলে আপনি হয়তো টিটকারি দিতে পারেন। মোট কথা, নতুন ঢঙের পোশাক পরতে দেখলে, অথবা সবাই সাধারণত যা করে না, তেমন কিছু করতে দেখলে আমরা তাকে অনেক সময় বলি “অমুক আধুনিক, মডার্ন।” বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে এ বিশেষণটা বোধ হয় আরও বেশি প্রযোজ্য। কিন্তু এ হলো আধুনিক কথাটার অপব্যবহার।

তা হলে আধুনিক মানে কী? আধুনিক মানে কি কেবল সাম্প্রতিক? বৰ্তমানে যা ঘটছে, সেটাই কি আধুনিক? ধরা যাক, হাল ফ্যাশানের বোরকা পরলে, অথবা নতুন ডিজাইনের পাগড়ি কিংবা রামাবলী পরলে তাঁকে কি আপনি বলবেন আধুনিক? ধরে নিচ্ছি, বলবেন না। কারণ, নতুন ফ্যাশানের পোশাক পরলেও এই ব্যক্তির যেমনটি প্রকাশ পাচ্ছে, সে মনটি রীতিমতো প্রাচীনপন্থী, রক্ষণশীল। বস্তুত, বাজারে এক-একটা সময়ে নতুন ফ্যাশানের হুজুগ দেখা দেয়। মার্কেট ফোর্স কাজ করে তার পেছনে। কিন্তু সেটা আধুনিকতা নয়। কোনো উপকরণ ব্যবহার করে কেউ আধুনিক হতে পারে না। অথবা আধুনিক কালে কারো জন্ম হলেও সে আধুনিক মানুষ, তা প্রমাণিত হয় না।

জসীমউদ্দীনের জন্ম জীবনানন্দের চেয়ে কয়েক বছর পরে। অর্থাৎ জন্মতারিখের নিরিখে জীবনানন্দের তুলনায় জসীমউদ্দীন আধুনিক। কিন্তু এটা কেউ স্বীকার করে না। জীবনানন্দ কেবল তাঁর জীবদ্দশায় আধুনিক বলে বিবেচিত হননি। আজও তিনি আধুনিক। অপর পক্ষে, জসীমউদ্দীন সেই যে খেতাব পেলেন পল্লীকবির, এখনো তা ঘুচে যায়নি। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা-ছন্দ-চিত্ৰকল্পসহ তাঁর কবিতার আঙ্গিক, সর্বোপরি, তাঁর রস ও রুচি তিনি নিয়েছিলেন পলী বাংলা থেকে। সে কারণে আধুনিক কবি জীবনানন্দের তুলনায় পাঁচ বছর পরে জন্ম নিলেও তিনি আধুনিক উপাধি পেলেন না।

সাম্প্রতিক কালে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন। কমবেশি সবাই। প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় নতুন প্ৰযুক্তির প্রয়োগ। এমন কি, ঘড়ির কাটা ঘুরিয়ে দিয়ে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার লড়াই করছে যারা, তারাও ব্যবহার করছে একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি। একেবারে হাল আমলের বিস্ফোরক, ডিটোনেটর, অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় বন্দুক, মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটার না-হলে তাদের চলে না। কিন্তু তাদের সমস্ত চিন্তাধারা আচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ দিয়ে। সে জন্যেই বলতে হয়: পঞ্জিকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই আধুনিকতা নয়। একবিংশ শতাব্দীতেও একই নগরীতে পাশাপাশি বাস করতে পারে–পারে বলছি কেন, বাস করছে–আধুনিকতা এবং মধ্যযুগীয়তা। একই ঘরের মধ্যেও একজন হতে পারেন আধুনিক, একজন হতে পারেন মধ্যযুগীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী।

সমাজতত্ত্বে আধুনিকতার মানে হলো: পরিবর্তনকে স্বীকার করে নেওয়ার মনোভাব। এতোকাল ধরে যা চলে এসেছে, তার বদলে ভিন্ন কিছু স্বীকার করে নেওয়ার মানসিকতাকেই বলে আধুনিকতা। সে জন্যে একবিংশ শতাব্দীতে এসে যারা পুরোনো মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে রাখতে চান, তাঁরা তারিখের হিশেবে একেবারে হাল আমলের হলেও, মানসিকতার দিক দিয়ে রক্ষণশীল। বস্তুত, এই ২০০৬ সালে এসেও চারদিকে আমরা যা যা দেখতে পাচ্ছি, সবই আধুনিক নয়। বরং অনেক কিছুই সেকেলে। জীৰ্ণ পুরাতন।

যেসব সামাজিক মূল্যবোধ দিয়ে পরিচালিত হয় আমাদের জীবন, তার বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে–লোকবিশ্বাস, লোকাচার, দেশাচার, রীতিনীতি, কুসংস্কার, ধর্মীয় বিধান, আচার-অনুষ্ঠান, শিক্ষা ইত্যাদির প্রশস্ত ভিত্তির ওপর। অনেকেই বাপ-দাদা চোদ্দো পুরুষ যা করে এসেছে, তাকেই আগলে রাখতে চায়। কুষ্ঠিত বোধ করে সহজে কোনো পরিবর্তন স্বীকার করে নিতে। ভয় পায় নতুন কিছু আলিঙ্গন করতে। এই ভয়ের প্রধান কারণ, পাছে লোকে কিছু বলে, পাছে সমাজে নিন্দা হয়। সমাজও নতুন কিছুকে স্বাগত জানায় না। ব্যক্তিকে সে আর পাঁচজনের সঙ্গে এক কাতারে বেঁধে রাখতে চায়। কেউ সামনের দিকে একটু বেশি এগিয়ে গেলে তাকে বাধা দেয়। অর্থাৎ এক কথায় বলা যেতে পারে: সমাজ মূলত রক্ষণশীল। পুরোনোকে সযত্নে ধরে রাখাই তার স্বভাব। সামনের দিকে এগুতে চায় না সে।

তা সত্ত্বেও সমাজের মূল্যবোধ একেবারে অনড় নয়, এক জায়গায় তা দাঁড়িয়েও থাকে না। একজন-দুজন নতুন কিছু করলে তার সমালোচনা করে বটে, কিন্তু যখন অনেকেই তা করতে শুরু করে, তখন সেটাকে স্বীকার করে নেয়। সেটাই তখন সমাজ-স্বীকৃত রীতি বলে গৃহীত হয়। ফলে রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও সমাজের রীতিনীতি এবং মূল্যবোধ ধীরে ধীরে বদলে যায়।

এক-এক সময়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, তাও সমাজের মূল্যবোধকে বিচলিত করে। তা ছাড়া, যুগে যুগে এমন এক-একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আবির্ভূত হন, যিনি তাঁর চিন্তা দিয়ে সমসাময়িক এবং পরবর্তী প্রজন্মের মূল্যবোধকে নাড়া দেন। দার্শনিকরা যেমন। ধর্মপ্রবর্তকরা যেমন। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্ৰযুক্তিরও এমন পরিবর্তন দেখা দেয় ধীরে ধীরে, যা মানুষের চিরাচরিত মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে। এক সময়ে মানুষ বিশ্বাস করতো: পৃথিবীটা চ্যাপ্টা। অথবা সূর্য ঘুরছে। পৃথিবীর চার দিকে। ধর্মগুরুরা এই বিশ্বাসকেই সমৰ্থন করতেন। কিন্তু কোপার্নিকাস আর গেলিলিও ধর্মীয় বিশ্বাসের গোড়ায় আঘাত করলেন। তার জন্যে চার্চের ফতোয়ায় গেলিলিওকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। চাঁদে মানুষ পা রাখলো। ধর্মীয় ভ্ৰান্ত বিশ্বাসের গোড়ায় অমনি আঘাত লাগলো। কোনো কোনো ধর্মে বলা হয়েছে গৰ্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ আগে থেকে জানার উপায় নেই। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে। পছন্দ-মতো লিঙ্গ বেছে নেওয়া যাচ্ছে। এমন কি, যৌনমিলন ছাড়াই সন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে প্ৰচলিত বিশ্বাসে টোল খাচ্ছে বই কি! ধর্মে যা কিছু বলা হয়েছে, তার সবই যে আক্ষরিকভাবে সঠিক নয়, গোড়ামি সত্ত্বেও তা অনেকে অনুভব করতে পারছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতো নগরায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রণ, ভিন্ন সভ্যতার অভিঘাত–এসবও চিরদিনের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করে। ফলে পরিবর্তন অর্থাৎ আধুনিকতা আসে।

মানুষের মূল্যবোধ পরিবর্তিত হওয়ার আর-একটা মস্ত কারণ হলো: ভিন্ন সভ্যতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং সমন্বয়। যেমন, আর্যরা ভারতবর্ষে এসে অনার্যদের চিন্তাধারাকে বদলে দিয়েছিলো। মুসলমানরা ভারতবর্ষের আর্য-অনার্য এবং উত্তর আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধ এবং জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছিলো। বৌদ্ধদের প্রভাবে দূর প্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিন্তা-চেতনায় গভীর পরিবর্তন এসেছিলো। ইংরেজরাও একেধারে নতুন সভূতার হাওয়া দিয়ে বিপ্লব এনেছিলো ভারতীয় চিন্তাধারায়। ফলে বহু শতাব্দীর মন-মানসিকতা, শিক্ষাদীক্ষা, রীতিনীতি এবং প্রাত্যহিক জীবনযাত্ৰা পাল্টে গিয়েছিলো। অতি সাম্প্রতিক এ রকমের আর-একটা বিরাট পরিবর্তন এনেছে কমিউনিজম এবং ইসলাম। এর অভিঘাতে একটা বড়ো জনগোষ্ঠীর পুরোনো বহু মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস রাতারাতি বদলে গেছে।

এ ধরনের নতুন সভ্যতা অথবা আদর্শবাদের অভিঘাতে এক দিকে মানুষ যেমন আধুনিক হতে পারে, তেমনি সব আদর্শবাদের মধ্যে এক ধরনের গোড়ামিও লুকিয়ে থাকে। আজকের আধুনিকতা কাল প্রাচীন হয়ে যায়। নবায়ন ছাড়া আদর্শবাদ। আসলে কঠিন রক্ষণশীলতার বেদীতে পরিণত হয়। ধর্ম এমনি একটা আদর্শবাদ। কমিউনিজম অথবা অন্ধ জাতীয়বাবাদ এমনি আদর্শবাদ। এগুলো গোড়াতে মানুষকে নতুন পথ দেখায়, নতুন মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু সেই আদর্শবাদই যখন আবার সংস্কার-রোধক ডগমায় পরিণত হয়, তখন তা সামনের দিকে যাওয়ার পথকে রুদ্ধ করে, মানুষকে পেছনের দিকে টেনে রাখে।

বামপন্থা গত আশি বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর একটা বিরাট জনগোষ্ঠীকে উন্নতির পথে যেতে সহায়তা করেছিলো। কিন্তু উনিশ শতকের মার্কসীয় দর্শন দিয়ে বিশ শতকের সমস্যার সমাধান করা গেলো না বলে, বিশ শতক শেষ হবার আগেই কমিউনিস্ট অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক দর্শন ব্যৰ্থ বলে স্বীকৃত হলো। এখন নানা দেশেই ধর্মীয় উন্মাদনা এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মানুষকে যে-পথে নিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে আধুনিক মূল্যবোধের কোনো মিল নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি, রেনেসন্স, সংস্কারবাদ, যুক্তিবাদ, উদারনৈতিকতা, শিল্প বিপ্লব, শিক্ষা প্রসার, মুদ্রণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অসাধারণ উন্নতি–সবই ধর্মীয় উগ্ৰবাদের মুখে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বর্ন এগেইন ক্রিশ্চিয়ান হোক, জিহোবাস উইটনেস হোক, মর্মন হোক, ইভ্যানজেলিকাল হোক, উগ্ৰবাদী হিন্দুত্ব হোক, অথবা জঙ্গী ইসলামী জাতীয়তাবাদ হোক–সবই আধুনিক কালের প্রাচীনপন্থী আন্দোলন। সভ্যতার অর্জনকে অস্বীকার করার আন্দোলন। বস্তুত, এসব দেখে ফরাসী দার্শনিকের সেই কথাই মনে হচ্ছে। যে-ধর্ম আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না, সে ধর্ম ধর্মীই নয়। সত্যি সত্যি আধুনিকতার জন্যে চাই নতুন ধর্ম, নতুন দর্শন, নতুন বিপ্লব। সর্বোপরি চাই, নতুনকে দু বাহু বাড়িয়ে স্বাগত জানানোর মুক্ত মানসিকতা।

(যুগান্তর, ২০০৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *