১১. শহীদের অপমৃত্যু

শহীদের অপমৃত্যু

সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ :

একজন রাজাকার (সুশান্তি বৰ্ষিত হোক তাহার উপর!)–
নামজাদা এক রাজাকার
অপঘাতে হয়েছেন, আহা রে, শহীদ…

সত্যি সত্যি এখন প্রতিদিন যে-হারে শহীদ হচ্ছে সবাই, তাতে উপরের খবরটা হঠাৎ একদিন ছাপা হলে অবাক হওয়ার কারণ থাকবে না (এমন ঢালাওভাবে শহীদ কথাটা সম্প্রতি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, এর তাৎপর্য তো নয়ই, কোনো অর্থই বাকি আছে কিনা, বলা শক্ত। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে শব্দটা অর্থবহ ছিলো, এখন কেবল অর্থহীন নয়, রীতিমতো দুর্বিষহ।

ইহুদী এবং খৃষ্টান ধর্মে মার্টায়ার কথাটার অর্থ গোড়াতে ছিলো সাক্ষী–নিজের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করার বদলে যে নিজের মৃত্যু অথবা হত্যা প্রত্যক্ষ করে অর্থাৎ তার সাক্ষী হয়, সে হলো মার্টায়ার ইসলাম ধর্মে শহীদ কথাটা এসেছে এই ধারণা থেকেই। এবং প্রথমে এর অর্থ সাক্ষীই ছিলো–নিজের বিশ্বাসের জন্যে যে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে মেনে নয়। অপর পক্ষে, হাদিসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার আদেশে ধর্মযুদ্ধে যে নিহত হয়, সে-ই হলো শহীদ। মহাযান বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ত্ব কথাটার সঙ্গেও শহীদের ধারণার খানিকটা যোগ রয়েছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মে শহীদের ধারণা নেই। বাংলা ভাষাতেও না।

দোভাষী ইসলামী পুঁথি, বিশেষ করে মহররমের কাহিনী নিয়ে রচিত পুঁথির মাধ্যমে শহীদ শব্দটা প্রথম বারের মতো বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ে। একটি পুঁথির নামই যেমন শহীদে কারবালা। কিন্তু মূলধারার মুদ্রিত বাংলা সাহিত্যে শহীদ শব্দের ব্যবহার বিশ শতকের আগে হয়েছিলো কিনা, আমার জানা নেই। তবে ১৯০৫ সালে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর রচনায় এ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। তার বছর পনেরো/ষোলো পরে নজরুল ইসলামও এ শব্দ ব্যবহার করেন তার রচনায় এভাবে বাংলা ভাষায় ভীরু ভীরু পায়ে এ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে থাকলেও, এখন কারণ্যে-অকারণে শহীদ কথাটার যথেচ্ছ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর ফলে কথাটার মাহাত্ম্য এবং ধার একেবারে ক্ষয়ে গেছে। এমন কি, লোপ পেয়েছে বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না।

১৮৬৬ সালে কানাইলাল শীল বাংলা ভাষার অন্যতম পুরোনো অভিধান— শব্দার্থ রত্নমালায় এ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেননি। তিনি সম্ভবত শোনেনওনি। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত রামকমল বিদ্যালঙ্কারের সচিত্ৰ প্ৰকৃতিবাদ অভিধানেও এ শব্দটা নেই। এমন কি, ১৯১৩ সালে প্রকাশিত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির শব্দকোষেও শহীদ শব্দটি অনুপস্থিত। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত সুবল মিত্রের অভিধানেও।

এ শব্দটি প্রথমবারের মতো অভিধানের অন্তর্ভুক্ত হয় সম্ভবত ১৯১৬ সালেজ্ঞানেন্দ্ৰনাথ দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে। এ শব্দের সঙ্গে তিনি রোকেয়ার মতিচুর থেকে দৃষ্টান্তও দেন। ১৯৩০-এর দশকে সংকলিত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান–বঙ্গীয় শব্দ কোষেও আছে। এ শব্দটা। কিন্তু তাতে এর অর্থ–যথার্থভাবেই— দেওয়া আছে: ধর্মের কারণে নিহত মুসলমান। ১৯৩৮ সালে আশুতোষ দেব তাঁর নূতন বাঙ্গালা অভিধানে শহীদ কথাটাই নয়, সেই সঙ্গে শাহাদাৎ কথাটাও অন্তর্ভুক্ত করেন। এবং শাহাদাৎ শব্দের সঠিক অর্থ দিয়েছেন: সাক্ষ্য।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা আশুতোষ দেব এই শব্দের সঠিক সংজ্ঞা দিলেও, তার আগেই কাজী নজরুল ইসলাম এ শব্দের অপব্যাখ্যা করেছিলেন। ১৯২২ সালের অগস্ট মাসে ধূমকেতু পত্রিকার ষষ্ঠ সংখ্যায় ক্ষুদিরাম বসুর একটি ছবি ছাপিয়েছিলেন। তিনি। ছবির জন্যে ছবি। তার সঙ্গে কোনো খবর, নিবন্ধ অথবা কবিতা ছিলো না। কেবল লেখা ছিলো “বাঙলার প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম”। নজরুলের উদ্দেশ্য ছিলো যারা দেশের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ছবির মধ্য দিয়ে তাদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা এবং অন্যদের তা দিয়ে অনুপ্রাণিত করা। এর আগে কোনো অমুসলমানকে কেউ শহীদ বলে আখ্যায়িত করেছেন বলে আমার জানা নেই। এমন কি, ধর্মযুদ্ধ ছাড়া অন্য কারণে নিহত কোনো ব্যক্তিকেও শহীদ বলে তাঁর ওপর গৌরব আরোপ করার দৃষ্টান্ত অজ্ঞাত সূতা সত্ত্বেও নজরুলের হাতে ক্ষুদিরাম শহীদ হয়ে যান। মুসলমান নজরুল ইসলামের হাতেই নয়, হিন্দু লেখকদের হাতেও ক্ষুদিরাম পরে এই বিশেষণে সম্মানিত হয়েছিলেন। যেমন, ঈশানচন্দ্র মহাপাত্ৰ ক্ষুদিরামের যে-জীবনী লিখেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন শহীদ ক্ষুদিরাম। কমলা দাশগুপ্তও ভারতকোষে ক্ষুদিরামের কথা লিখতে গিয়ে তাকে শহীদ আখ্যায়িত করেন।

মোট কথা, নজরুল ইসলাম নতুন অভিধায় শহীদ কথাটা ব্যবহার করার পর থেকে এ শব্দের মূল অর্থ পাল্টে যেতে থাকে। এর ব্যবহারও বৃদ্ধি পায় ক্রমবর্ধমান মাত্রায়। সন্ত্রাসবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনে তখন যারা প্ৰাণ দিচ্ছিলেন, তার ত্যাগকে গৌরবান্বিত করার জন্যে শহীদ কথাটাকে বিশেষ উপযোগী মনে হয় তখনকার লেখকদের। সন্ত্রাসবাদীরাও এই ঐহিত্য বজায় রাখেন। এমন কি, তার পরে কমিউনিস্টরাও। বাংলা ভাষায় এর কোনো প্রতিশব্দ না-থাকায় হিন্দু লেখকরাও তাই এ শব্দটি অকাতরে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন।

তবে এ শব্দটি পূর্ব বাংলায় বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর। আর পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকে বামপন্থীদের কল্যাণে ) ভাষা আন্দোলনের সময়ে একুশে এবং বাইশে ফেব্রুয়ারি যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন, (বেশির ভাগই নিজেদের অনিচ্ছায়), তাদের সবাইকে শহীদ আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। কোনো একজন তাদের এই বিশেষণ দেননি— সবার মুখে মুখেই ধীরে ধীরে তারা শহীদে পরিণত হন। এই ঘটনা নিয়ে একেবারে প্রথম দিকে মাহবুব আলম অথবা আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো যারা কবিতা অথবা গান লিখেছিলেন, তাঁরা এ শব্দটি তখনই ব্যবহার করেননি। কিন্তু পরে এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।

আসলে, ভাষা আন্দোলন যে-তৃতীব্ৰ ভাবাবেগের জন্ম দিয়েছিলো, সেই ভাবাবেগের পরিপ্রেক্ষিতেই তখনকার লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক এবং সংস্কৃতিসেবীরা নিহতদের “শহীদ” শব্দ দিয়ে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন–যদিও এই নিহত ব্যক্তিরা বেশির ভাগই আন্দোলনে যোগ দেননি, স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন তো দূরের কথা। আমার ধারণা, শহীদ শব্দের ব্যবহার নিয়ে প্রথম দিকে খানিকটা দ্বিধা ছিলো। এই দ্বিধাটা এসেছিলো আরবি-ফারসির সঙ্গে বাংলার বিবাদ থেকে। সে জন্যেই দেখতে পাই প্রথম দিকের শ্লোগানে জিন্দাবাদ নাবলে, বলা হতো অমর হোক। অসম্ভব নয় যে, বাংলা ভাষার কারণে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের আরবি ভাষায় শহীদ বলা হবে কিনা, তা নিয়ে খানিকটা সংশয় দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু যেহেতু এই আত্মত্যাগ বোঝানোর জন্যে বাংলায় কোনো জুৎসই শব্দ ছিলো না, সে জন্যে অল্পকালের মধ্যেই এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

পশ্চিম বাংলায় যখন কমিউনিস্ট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ষাটের দশকে, তখন সেখানেও এই শব্দ ব্যহৃত হতে থাকে। তারা যেমন নামের আগে বিদেশী কমরেড শব্দ দিয়ে নিজেদের চিহ্নিত করতেন, তেমনি এই আন্দোলনের জন্যে যারা প্ৰাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের আত্মত্যাগকে গৌরাবান্বিত করার জন্যে বিদেশী শব্দ শহীদের স্মরণাপন্ন হন। এর ব্যবহার এতো বৃদ্ধি পায় যে, একবার এক সম্ভাব্য আততায়ীর হামলায় জ্যোতি বসু এক হাতের কড়ে আঙুলে আঘাত পেলে পত্রিকায় লেখা হয়েছিলো হাফ-শহীদ জ্যোতি বসু।

অপর পক্ষে, ভাষা আন্দোলনের পরেও বাংলাদেশের একাধিক রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে এবং ১৯৭১ সালের আগে পর্যন্ত তাতে নিহতও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু তাদের সবাইকে শহীদ আখ্যা দেওয়া হয়নি। কেউ কেউ শহীদ উপাধি পেয়েছিলেন। যেমন, অধ্যাপক শামসুজ্জোহা এবং আসাদ। এদের দুজনের মৃত্যুই তখনকার রাজনৈতিক আন্দোলনকে দারুণ উস্কে দিয়ে। সে জন্যে, তাদের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছিলো শহীদ বলে। কিন্তু শহীদ দিবস বললে তখন একুশে ফেব্রুয়ারিকেই বোঝাতো। শহীদ মিনার বললেও একটি মিনারকেই বোঝাতো। প্রথম দিকে শহীদ কথাটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত না-হওয়ার একটা পরোক্ষ প্ৰমাণ তখনকার ইংরেজি পত্রিকাগুলো। এতে তাদের ইংরেজিতে বলা হতো: মার্টায়ার। শহীদ দিবসকে বলা হতো: মার্টায়ার্স ডে। মোট কথা, শহীদ কথাটা তখনো বাংলাদেশের ইংরেজি পত্রিকায় চালু হয়নি।

শহীদ শব্দ দিয়ে যে-চরম আত্মবিসর্জনের কথা বোঝানো যায়, যে-আবেগের জন্ম দেওয়া যায়, কোনো বাংলা শব্দ দিয়ে তা যায় না 79সুতরাং ভাষা আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের এই বিশেষণ দিয়ে চিহ্নিত করার যুক্তি বোঝা যায়। কিন্তু এ শব্দ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর। যারা এই যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে হানাদার বাহিনী অথবা তাদের দালালদের হাতে নিহত হন, তারা ধর্মের জন্যে না-হলেও দেশের জন্যে প্ৰাণ দিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে তাদের শহীদ বললে কথাটার পুরোপুরি অপব্যবহার করা হয়। কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। অথবা যারা বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাস বজায় রাখতে গিয়ে স্বেচ্ছায় অথবা বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাসের দরুন অনিচ্ছায় প্ৰাণ বিসর্জন করেছিলেন, তাদেরও শহীদ বলা হয়তো গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যারা পাইকারী হত্যাকাণ্ডে সাধারণভাবে নিহত হনু, তাদের শহীদ বলা যায় কেমন করে। বস্তুত, পাইকারী হারে এভাবে সবাইকে শহীদ আখ্যা দেওয়ার ফলে শহীদ কথাটা ৭২ সাল থেকে খানিকটা মূল্য হারিয়ে ফেলে–পশ্চিমবঙ্গের মতোই। কিন্তু পুরোপুরি নয়। পুরোপুরি যে নয়, সেটা বোঝা যায় শেখ মুজিবের দৃষ্টান্ত থেকে।

শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা— এখন জাতীয়তাবাদীরা (আসলে ভিন-জাতীয়তাবাদীরা) তাতে যা-ই বলুন না কেন। তাঁরই আহবানে সমগ্ৰ জাতি স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করেছিলো— কোনো সেপাই বা সেনাপতির আহবানে নয়। কিন্তু সেই শেখ মুজিব যখন সেনাবাহিনীর উচ্চপদে নিয়োজিত কয়েকজন বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় এবং কয়েকজন নিম্নপদস্থ সদস্যের সক্রিয় চেষ্টায় নিহত হলেন, তখন জাতির জনক হওয়া সত্ত্বেও শহীদ পদবী তাঁর ভাগ্যে জুটলো না।

এমন কি, তার বছর ছয়েক পরে যখন জিয়াউর রহমান তার সহকর্মীদের হাতে নিহত হলেন, তখনো তিনি সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হতে পারলেন না। কিন্তু কয়েক বছর পরে তাঁর নাম ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক ফয়দা লোটার কথা ভেবে বেশ হিশেবে-নিকেশ করে তার দলের নেতারা তাকে এই অন্যায্য উপাধি দেন বলছি এ জন্যে যে, সত্যি সত্যি তিনি ধর্মের জন্যে স্বেচ্ছায় প্ৰাণ দেননি) দেশের জন্যেও নয়। তিনি যেভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাকেও সেরাতুল মুস্তাকিম তো দূরের কথা, ঠিক সহজ সরল পথ বলা যায় না (তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। সেনাবাহিনীর ভেতরকার ক্ষমতার দ্বন্দুের কারণে। নিহতও হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর অন্তৰ্দ্ধন্দু থেকে। নিহত হওয়ার আগেই তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর বিরুদ্ধে তেইশটি ব্যৰ্থ সামরিক অভু্যখান হয়েছিলো। তাই তাঁকে কিভাবে শহীদ জিয়া বলা যায়, অথবা হাফ-আরবি ভাষা দিয়ে গৌরব আরোপ করে তাঁর মৃত্যুদিবসকে শাহাদাত বরণের দিন বলা যায়–বাংলাভাষী একজন মানুষ হিশেবে সেটা আমার মাথায় আসে না) তা-ও তিনি দেশের জন্যে ৭১-এ লড়াই করেছিলেন। বীর উত্তম উপাধি পেয়েছিলেন স্বাধীনতা-যুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্যে। সুতরাং ন্যায়ত না-হলেও তাঁকে না-হয় শহীদই বলাই হলো।

কিন্তু ৮০-র দশক থেকে এ শব্দটা উল্কার গতিতে যেভাবে নিজের চরিত্র হারালো, তা দেখে শব্দটার দুর্ভাগ্যের কথাই মনে হয়। দেখে দুঃখ হয় যে, বেচারা “শহীদ” এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে অকালে শাহাদত বরণ করলো!

এখন যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার প্রকাশ্য সংগ্রামে অংশ নিচ্ছে, তারা তো বটেই, এমন কি, দালাল, আলবদর, পাড়ার মাস্তান, সন্ত্রাসী এবং চাঁদাবাজ-সহ যে-কোনো লোক অন্যের হাতে নিহত হলে কবর দেওয়ার আগেই শহীদ হয়ে যায়। বাস-চাপা পড়ে মারা গেলেও শহীদ হয় সম্ভবত। আর, রাজাকার নিহত হলে আর রক্ষা নেই–অমনি তার সাগরেদরা তাকে শহীদ আখ্যা দেয়। শুনেছি, অনেক রাজাকার নাকি সরকারী মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পেয়েছে। কোনো ফ্ৰী অথবা ঘুসন্টুস দিয়ে মরার আগেই একটা অগ্রিম শহীদের সার্টিফিকেট জোটানোর ব্যবস্থাও কালে কালে হবে কিনা, সেটা এখন বিবেচনার বিষয়। তা হলে একটা সার্টিফিকেট অনেকে জুটিয়ে রাখবেন। (আমি নই–বাপরে! অপঘাতে মরার সামান্যতম। ইচ্ছে আমার নেই।

যেভাবে মরে ভূত হয়ে গেছে, তাতে মনে হয় না। “শহীদ”কে আর বাঁচানো যাবে। তবে একটা ভরসা দিগন্তে দেখা দিয়েছে। তাবলিগীদের চেষ্টায় সাম্প্রতিক কালে খোদা তার শুদ্ধ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আল্লাহ-য় পরিণত হয়েছেন। পয়গম্বর রসুলে পরিণত হয়েছেন। তা ছাড়া, ক্রমবর্ধমান মাত্রায় আরবি শব্দ সৌদী উচ্চারণে এবং সঠিক অর্থে ব্যবহার করার প্রবণতাও দেখা দিয়েছে। সাত জন্মে যা দেখিনি, রাতারাতি বাদশা মিয়া, গনি মিয়া ইবনে আলি হোসেন কিংবা ইবনে কালু মিয়ায় পরিণত হচ্ছেন। মোট কথা, প্রচলিত বহু বাংলা শব্দকে হটিয়ে দিয়ে অনেকেই কুফুরি জবান বাংলার সংস্কার করার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছেন। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ বা গোপনে। ইদানীং বামপন্থী (আসলে পাকিস্তানপন্থী) কোনো কোনো লেখকের জবান থেকে সংস্কারের এই খোশবু পাচ্ছি। শহীদের অপমৃত্যুর কথাটা এই সংস্কারবাদীদের নজরে আনলে হয়। তাঁরা তা হলে হয়তো একটা ফতোয়া দিয়ে মৃত শহীদকে ফের জীবন দিতে পারেন।

(যুগান্তর, ২০০৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *