০৪. তসলিমার ভালোমন্দ

তসলিমার ভালোমন্দ

শুরুতেই সালাম সংগ্ৰামী তসলিমাকে–যে-তসলিমা জীবনের ঝুকি নিয়েও বারবার নিজের বক্তব্য চীৎকার করে প্রকাশ করেন; সমাজ, সংসার, ধর্ম এবং প্রচলিত মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করে নিজের পথে চলেন।

এমন কালাপাহাড় বলেই তাঁর নাম সবার মনেই এক রাশ আবেগ সৃষ্টি করে। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য হলো: পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর ধর্ম। তবে পুরুষই প্রধান লক্ষ্য তাঁর। পুরুষরা যেহেতু ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং নরকের ভয় দেখিয়ে নিজেদের সুবিধেটা বহাল রাখে, সে কারণে ধর্মও। পুরুষদের বিরুদ্ধে জেহাদ করেন বলেই তাঁর নাম শুনলেই পুরুষরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। এমন কি যে-পুরুষরা আপাতদৃষ্টিতে উদারপন্থী, তারাও। আর ধর্মব্যবসায়ীদের তো কথাই নেই। বস্তুত, তসলিমার ধর্মবিরোধী কথাবার্তা শুনে তারা রীতিমতো জঙ্গী হয়ে ওঠেন। আইনের অপেক্ষা রাখেন না তারা। নিজেরাই বিচারক সেজে তারা তার গলা কাটার ফতোয়া দেন। তার পক্ষে যারা, তাদের সংখ্যাও কম নয়, তারাও আবেগে আত্মহারা হন কখনো কখনো, যুক্তিজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তারা এতোটা যুদ্ধংদেহি নন। এই যা! পার্থক্যটা মাত্রার, প্রকৃতির নয়।

আর-কিছু লেখার আগে নিজের পরিচয় দিয়ে নিই। আমি নারীবিদ্বেষী নই। বরং মেয়েরা যে মানুষ এবং পুরুষের চেয়ে কোনোক্রমে ছোটো নন, তত্ত্বত কেন, মনেপ্ৰাণে এটা বিশ্বাস করি। সেই নির্যাতিত মহিলাদের অধিকারের কথা অমন তলোয়ার হাতে যিনি লিখেছেন, তাঁকে তাই সালাম না জানিয়ে পারিনে। তা ছাড়া, আমি ধর্মনিরপেক্ষতার কট্টর সমর্থক হিশেবেও তসলিমার ভক্ত। হাজার মাইলের দূরের মন্দির ভাঙার জন্যে যখন ভোলার নিরপরাধ হিন্দুদের বাড়িতে আগুন লাগানো হচ্ছিলো, ধর্ষণ করা হচ্ছিলো হিন্দু নারীদের, তখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে তাঁর প্রতিবাদ করেছিলেন তসলিমা। হোক না অতি তুচ্ছ একটি উপন্যাস লিখে! সাহিত্য হিশেবে সেই উপন্যাস উপন্যাস হয়েছিলো কিনা, সেটা অপ্রাসঙ্গিক। অন্য কেউ তো সেই বলাৎকারের প্রতিবাদ করেননি! তাই তসলিমার অকুণ্ঠ প্ৰশংসা না-করে পারিনে।

এখানে শেষ করতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তসলিমার প্রতি আমার এই শ্রদ্ধা সম্প্রতি অবিচল রাখা একটু কঠিন হয়ে পড়ছে। সে কি আমারই ভুলে, নাকি তাঁর সাম্প্রতিক লেখা বুঝতে পারছিনে বলে, ঠিক জানিনে।

কলম হাতে নিয়ে প্রথমেই তসলিমা লিখেছিলেন কবিতা আর কলাম। প্রথম দিকে দুটোরই লক্ষ্য ছিলো পুরুষশাসিত সমাজে মহিলারা কতোভাবে অত্যাচারিত হন, চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখানো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একই কথা বারবার লিখছেন কেন? ওতে পুনরাবৃত্তির দোষ হয় না? তিনি বলেছিলেন, ‘নারীর প্ৰতি অত্যাচার তো কমেনি। যতোদিন এ অত্যাচার চলতে থাকবে, ততোদিন লিখতে থাকবো।” যতোদিন তিনি দেশে ছিলেন, তার লেখা থেকে তাই মনে হতো। তিনি নারীনির্যাতনের কথাই লিখেছেন ততোদিন। তাঁর কলামে সেসব কথা তিনি লিখেছেন। ফেনিয়ে ফেনিয়ে। কিন্তু কবিতায় সেই একই কথা লিখেছেন, ছন্দের বন্ধনে, খানিকটা সংযমের শাসনে। কলামগুলোর চেয়ে তার এই কবিতা সে জন্যে আমার অনেক ভালো লাগে।

এক-একটা কবিতায় নারীদের এক-একটা বেদনা, এক-একটা ক্ষোভের কথা বলেছেন তসলিমা। অসহ্য বেদনার কথা–পুরুষের প্রবঞ্চনা, সীমাহীন শোষণ, বমিউদ্রেককারী ভণ্ডামি, নিরঙ্কুশ স্বার্থপরতা, নির্লজ্জ বৈষম্য, নিষ্কারুণ হৃদয়হীনতা, নারীকে ভোগ্যবস্তু হিশেবে ব্যবহার করে ছিবড়ের মতো ফেলে দেওয়া ইত্যাদি। আমি আমার দুর্বল (এবং জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে পুরুষালি) ভাষা দিয়ে তাঁর অভিযোগের তীব্ৰতা ঠিক বোঝাতে পারবো না, তাই তার ভাষাতেই বলি:

১. আমার শরীর চেয়েছে সে নিজের অধীন। / ইচ্ছে করলেই যেন মুখে থুতু, গালে চড়, নিতম্বে চিমটি দিতে পারে।

২. প্রতি রাতে আমার বিছানায় এসে শোয় এক নপুংসক পুরুষ। …আমাকে উত্তপ্ত করে নপুংসক বেঘোরে ঘুমোয়।

৩. আপাতমস্তক তুমি এক ভণ্ড, প্রতারক / তোমার লাম্পট্য সব জানি

৪. কিছুটা কায়দা করে রমণীকে ভোগ না হলে / সে ভোগে তৃপ্তি নেই, তৃপ্তির সুগন্ধী ঢেকুর নেই।

৫. পুরুষেরা ভদ্রলোক, / পুরুষের জন্যে সতীত্বের সনদ লাগে না।

৬. একশ’ একর জমি নিজস্ব রেখে / এক কাঠা খোজ বর্গার তাড়নায় / বর্গার চাষ পৃথক স্বাদের কিনা!

৭. বেহেস্তের লোভে নারীরা চেটে খাবে / স্বামীর ধুলো কাদা / নিয়ম নীতি সব তৈরি করেছিল / পুরুষ নামজাদা। (এখানটায় ছন্দপতন৷ হলো–পুরুষ তিন মাত্রা, তারপর নামজাদা চার মাত্রা। যদি লিখতেন, পুরুষ হারামজাদা, তা হলে মনের কথা বলা হতো। কিনা জানিনে, ছন্দ রক্ষা পেতো।)

৮. ছুয়েছে সে সব, কেবল দেখেনি ছুয়ে / … যে হৃদয় সেধেছিলাম।

৯. যে কারণে নারী বেশ্যা হয়, যে সংসর্গে, … একই সংসর্গে পুরুষ পুরুষই থাকে।

১০. ভালোবাসা ছাড়া কোনো মাংসের শরীর ছুতে / পারঙ্গম জন্তু ও পুরুষ / নারী নয়।

পুরুষের এসব এবং অন্য আরও নানা ধরনের অত্যাচারের মর্মান্তিক সত্য কথা তুলে ধরেছেন তসলিমা। সেই সঙ্গে তুলে ধরেছেন নারীদের নীরবে-নিভৃতে-কাঁদা বঞ্চনার কথা। তাঁর বিরুদ্ধে পুরুষ সমাজে হৈচৈ হবে না কেন! হওয়াওই তো স্বাভাবিক।

তবে স্বীকার করতে হবে, পুরুষরা তাঁর ওপরই প্রথম অত্যাচার করেনি, সনাতন কাল থেকে তাবৎ নারীর ওপরই অত্যাচার করেছে। তা হলে, তিনি কলমের বল্লম তুলে নিলেন কেন? আমি অনেক বছর আগে একবার বিবিসির হয়ে তাঁকে এ কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। নানাভাবে প্রশ্ন করেও উত্তরটা তখন ঠিক পাইনি। তবে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি সেইদিন হবেন ক্ষান্ত, যাবে পুরুষের লাথিচড় গৃহরণভূমে রণিবে না। তিনি মহিলাদের সচেতনতা জাগাবেনই জাগাবেন। সচেতন করে তুলবেন পুরুষেরও— তাদের আচরণ সম্পর্কে। এবং আমার সত্যি বিশ্বাস, তাঁর সৎ সাহস এবং সংগ্রামী স্পিরিট দেখে ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বহু বঙ্গনারী উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, সাহস পেয়েছিলেন। নীরবতা ভেঙে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। এটা কম অর্জন নয়। এ জন্যে তাঁর কাছে, আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অন্তত, আমি কৃতজ্ঞ।

কিন্তু তারপর কী হলো?

বলতে গেলে অনেক বলতে হবে। তার চেয়ে এখনটায় দশ-বারো বছরের ইতিহাস পাখির চক্ষু দিয়ে দেখছি।

তসলিমা সংস্কারকের ভূমিকা নিয়ে খুশি থাকতে পারলেন না। রাতারাতি বিপ্লব চাইলেন তিনি। কিন্তু অন্ত্রশস্ত্ৰ, দলবল না-জুটিয়ে বিপ্লব করা তো সম্ভব নয়। করলে সেটা ক্ষুদিরাম কি বাঘা যতীনের মতো আত্মহত্যার সামিল হয়। এমন কি, বিপ্লবের কারণটাও পিছিয়ে যায়। কারণ, গৃহস্থ হুশিয়ার হয়ে যায়। পটভূমি তৈরি হবার আগেই অকাল বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে তসলিমা নিজে ডুবলেন, নারীদেরও বোধ হয় পিছিয়ে দিলেন। তাঁর কট্টরপন্থী মনোভাব এবং ধর্মের ওপর প্রচণ্ড আঘাত ঐতিহ্যিক সমাজ নিতে পারলো না।

দেশের আইনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফতোয়া দিলেও ফতোয়াবাজরা তাঁকে মারতে পারলেন না। কিন্তু তাঁকে বিচলিত করলেন তাঁর আসল পথ থেকে। কখন যে তিনি তাঁর পথ এবং লক্ষ্য থেকে সরে গেলেন, বোধহয় তিনি নিজেও তা টের পেলেন না। ধর্মীয় রাজনীতির শিকার হয়ে তসলিমা দেশ ছাড়লেন। যাদের জন্যে কাজ করতে শুরু করেছিলেন, তাদের থেকে দূরে ছিটকে পড়লেন। যাদের জন্যে লিখছিলেন, সেই লেখা নিষিদ্ধ হয়ে তাদের কাছে আর পৌছলো না। এমন কি, তার হঠকারিতায় বাংলাদেশের সাধারণ নারীদের উন্নতির মন্থর গতিও বোধ হয় আরও মন্থর হয়ে গেলো। আর, বনবাসে গিয়ে তিনি স্বয়ং তাঁর লক্ষ্য হারিয়ে ফেললেন। তিনি নারীদের সবার কথা না-লিখে, নিজের কথা লিখতে শুরু করলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার জেহাদ বন্ধ করে, বরং এমন সব কথা বলতে আরম্ভ করলেন ধর্ম এবং নৈতিকতা থেকে যা অনেক দূরের।

তিনি যেসব কথা বললে শুরু করলেন, তার উৎস ছিলো। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর নিজেরই পরিবারে। ‘৯৩ সালে অতোভাবে প্রশ্ন করেও যেসব কথা তার কাছ থেকে বের করতে পারিনি, সেই কথা তসলিমা নিজেই অকাতরে বলতে শুরু করলেন মহাকাব্যের মতো সর্গে সর্গে। আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখলেন তিনি। কিন্তু তার থেকেও সিয়েরিয়াস–প্ৰচণ্ড চিৎকার করে একেবারে নিজের জীবনের কথা লিখলেন। তার প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো উপন্যাস হিশেবে যেমনই হোক, অন্তত তার মধ্যে এক ধরনের শিল্প সৃষ্টি করার প্রয়াস ছিলো। ইংরেজিতে যাকে বলে কাজ, তেমন একটা কজও ছিলো। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিলো, নিপীড়িত মানবতার কথা ছিলো। নারীদের ওপর অত্যাচারের কথাতো ছিলোই। কিন্তু নির্বাসনে গিয়ে তিনি যা লিখলেন, তার মধ্যে এসব তেমন দেখা যায় না। যে-তসলিমা নিজেকে বলেন, ফেমিনিস্ট্র, অর্থাৎ নারীবাদী, সেই তসলিমা নারীদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা দূরে থাক, নারীদের জন্যে লিখলেনও না। বরং আত্মরতিতে তলিয়ে যাবার উপক্রম হলেন। তাঁর আত্মজীবনীগুলো দেশ অথবা দশের জন্যে নয়। তাঁর আত্মজীবনী সংকীর্ণ স্বার্থপরতারই স্বাক্ষর।

বাংলা ভাষায় প্রথম আত্মজীবনী ছাপিয়েছিলেন একজন ভদ্রমহিলা–রাসসুন্দরী দেবী (১৮৬৯)। তারপর থেকে শত শত আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। জীবনস্মৃতি এবং ছেলেবেলার মতো আত্মজীবনী সবাই লিখবে–এটা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু আত্মজীবনী কি কেবল সমাজ এবং সংসারের অত্যাচার, কেবল যৌনকর্ম, কেবল কুৎসার কেচ্ছা?

তসলিমা একালের একজন বিখ্যাত বাঙালি। যদি পরিচিতির পরিধি বিবেচনা করি, তা হলে দেশে-বিদেশে তাঁর চেয়ে বিখ্যাত বাঙালি গত পঁচিশ বছরে অন্য কাউকে দেখতে পাইনে। তাঁর পরিচিতি এবং বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি দেখে গর্বিত হই। কিন্তু তাঁকে যখন নিচে নামতে দেখি, তখন অবিমিশ্রভাবে দুঃখ অনুভব করি। কয়েক মাস আগে তাঁর আত্মজীবনীর তৃতীয় সর্গ প্রকাশিত হওয়ার পর বিবিসি থেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, চরিত্র হনন করে তিনি অন্যদের ছোটো করলেন কেন? তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি যদি কাউকে ছোটো করে থাকেন, তা হলে নিজেকেই ছোটো করেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছিলেন কিনা, জানিনে। কিন্তু এ কথাটা যে ষোলো আনা সত্যি, সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। আমি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করি, যে-তসলিমা অমন মহৎ উদেশ্য নিয়ে সাহিত্যের আসরে নেমেছিলেন, শুরুতেই অমন শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে আত্মজীবনী অবশ্যই চাই, কিন্তু তার মধ্যে তিনি যেসব ময়লা মিশিয়ে দিচ্ছেন, সেসব নয়। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বলতে হবে, তা না হলে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না।

মেয়েবেলা নামটাই চকিতে তসলিমার নারীবাদী মনোভাবকে মনে করিয়ে দেয়। আমাদের ভাষা যে সেকসিস্ট, সেটাকে তিনি সুন্দরভাবে শুধরে দিয়েছেন। তাকে সাধুবাদ জানাই। এ বইতে তিনি তাঁর ওপর নিকট-আত্মীয়দের যেসব অত্যাচার এবং বৈষম্যের কথা লিখেছেন, তাতে তাঁর অকপট ভাষণ এবং সৎ সাহসেরও তারিফ না-করে পারিনে। তসলিমা ডাক্তার। তিনি জানেন, অনেক ওষুধই আসলে বিষাক্ত। সেসব ওষুধ ঠিক মাত্রায় খাওয়ালে রোগী সেরে ওঠে, কিন্তু মাত্রা বেশি হলে রোগী মরেও যায়। মাত্রা ঠিক রাখা যে-কোনো বড়ো লেখকের কাজ। কে কতো বড়ো, তার একটা পরিমাপও। বালিকা তসলিমাকে ধর্ষণ করতে চান তাঁর দুই নিকটাত্মীয়। এমন ঘটনা কি বাঙালি সমাজে এই প্ৰথম ঘটলো? মোটেই না। কিন্তু তসলিমা এই প্রথম লিখলেন। তাঁর অসাধারণ সাহস এবং স্পষ্টভাষণের প্রশংসা না-করে পারছিনে। কিন্তু ধর্ষণ করতে চেষ্টা করার সময় তারা কাপড় খুলেছিলেন। কিনা, কতোটা খুলেছিলেন, অথবা আর কি কি করেছিলেন, তা বলার কি দরকার আছে? তার থেকেও বড়ো কথা, সে কথা বলে কি লাভ হচ্ছেনিজের বা পাঠকের?

ওপর রুদ্র এবং তসলিমা উভয়ই কবি। সুতরাং তসলিমা সে মিলনের দীর্ঘ এবং উচ্ছসিত বর্ণনা দিতেই পারেন। কিন্তু তিনি যে-বৰ্ণনা দেন, তা কবির নয়।

“রুদ্র আমাকে চুমু খায়। ঠোঁটে গাঢ় করে চুমু খায়। … শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে ফেলে। ব্লাউজের বোতাম খুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। স্তনবৃন্ত কেবল ভিজিয়ে দেয় না, দাঁতে কাটে। দুহাতে মুঠো করে ধরে স্তন, মুঠোর ভেতর এমন জোরে চাপে, যেন গলিয়ে একে জল বানাবে… রুদ্র আমার শাড়ি ওঠাতে থাকে ওপরের দিকে…আমার শরীরের ওপর নিজের শরীর তুলে দিয় রুদ্র। …এর পর সেই একই পদ্ধতি, দু পায়ে বিযুক্ত করতে থাকে আমার দু পা।… এর পর আচমকা একটি আঘাতে আমি চিৎকার করে উঠি। … রুদ্র ক্রমাগত আঘাত করেও নড়াতে পারে না কোনও পাথর। শরীর থেকে নেমে এসে রুদ্র তার আঙুল ব্যবহার করে অদৃশ্য পাথর সরাতে। … যে করেই হোক পথ প্রশস্ত করে তার এগোতে হবে, …”

এ বর্ণনা ধর্ষণের মামলায় পুলিশ অথবা কোর্টের সামনে বাধ্য হয়ে দিতে হতে পারে। কিন্তু কেউ আত্মজীবনীতে লিখতে পারেন— এটা বিশ্বাস করা শক্ত। অভিনব অবশ্যই। এমন কি, তিনি যদি এর মাধ্যমে রুদ্র অথবা পুরুষের ধৈর্য এবং বিবেচনার অভাব বোঝাতে চেয়ে থাকেন, তা হলেও।

রুদ্রকে ভালোবাসার সাধ মেটেনি। তসলিমার। বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। রুদ্রই। অন্য মেয়ের অথবা বেশ্যার] সংসৰ্গ করেছেন। রুদ্র। তারই ফল সিফিলিস উপহার দিয়েছেন তসলিমাকে। কিন্তু এতো সব সত্ত্বেও ভালোবাসার সাধ মেটেনি বলেই রুদ্রকে আঘাত করলেও, বারবার তাঁর জন্যে তসলিমা এক ধরনের দুর্বলতা অনুভব করেছেন। একটা ঘটনার কথা বলি। রুদ্রের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে গেছে। অন্যের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। সে বিয়েও ভেঙে গেছে। তারপর একদিন রুদ্রের সঙ্গে দেখা। মলিন মুখ, অসুস্থ দেহ। তসলিমা তাঁকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন। যত্ন আত্মি করলেন। রাতের বেলায় শুতে দিলেন নিজের কাছেই। বাকিটা আমরা আহাম্মুক হলেও মোটামুটি অনুমান করে নিতে পারি। আত্মজীবনী কেন, উপন্যাসের জন্যেও এটাই যথেষ্ট। এ দিয়ে তিনি কিছু মাত্র অর্জন করতে পারেন না। পারেননি। কিন্তু তসলিমা সেখানে থামেননি তা সত্ত্বেও। এবং সে কারণেই এটা পর্নোগ্রাফির চেয়েও বেশি পর্নোগ্র্যাফিক। কারণ, এটা উপন্যাস নয়, আত্মজীবনী। সে কারণেই তাঁর পুরুষ-ঘূণা সত্ত্বেও তাঁর এসব লেখার বেশির ভাগ পাঠক পুরুষ।

সত্যি বলতে কি, তাঁর ইদানীংকার লেখাগুলো পাঠকদের যৌন-অনুভূতিকেও সুড়সুড়ি দিতে পারে। যে-পুরুষের মুখে তসলিমা আগুন দিয়েছেন, সেই পুরুষরাই এই রচনা গোগ্রাসে গিলবেন। আমি বুঝতে ব্যর্থ হই, তসলিমা এসব লিখছেন কেন? তা হলে বই বেশি বিক্রি হোক, তাঁর লেখা (যে উপায়েই হোক না কেন) বেশি প্রচারিত হোক, এটাই কি তাঁর উদ্দেশ্য?

খিদের পরেই যৌনতা আমাদের একেবারে জীবনের সবচেয়ে বড়ো অনুভূতি। কাজেই যৌনতার কথাও না-হয় ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এমন সব অপ্রয়োজনীয় স্কুল বিষয় নিয়ে এসেছেন। তসলিমা তাঁর আত্মজীবনীতে, যা আমাদের বিস্মিত না-করে পারে না। তাঁর দুই বড়ো ভাই কে কতো জোরে দুৰ্গন্ধওয়ালা বায়ু ছাড়তে পারেন, তার প্রতিযোগিতা করেন। এই তুচ্ছ ঘটনা কি লেখার মতো একটা বিষয়? কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এর থেকেও তুচ্ছ এবং বমি-উদ্রেককারী ঘটনার কথাও তিনি লেখেন তাদের সম্পর্কে। নিজেই স্বীকার করেন, তা দেখলে পেটে যা কিছু আছে, তা বেরিয়ে আসে:

“লুঙ্গি পরেই তিনি যখন চুলকোনো শুরু করেন পা ফাঁক করে দু উরুর মধ্যিখানে, তখন দেখে মনে হয় না দাদা আদৌ কোনও সুর্দশন পুরুষ। এর পরও যে-কাণ্ড করেন, সেটি দেখলে কেবল বমির উদ্রেক নয়, রীতিমতো পেটে যা কিছু আছে সত্যিকার বেরিয়ে আসে। গায়ের ময়লা অর্থাৎ দুই উরুর মাঝখানের, হাতে ডলে তুলে কালো গুলি বানিয়ে ফেলে দেওয়ার আগে তিনি শুঁকে দেখেন। দাঁতের ফাঁকে বাধা মাংস এনেও গুলি বানিয়ে শোঁকেন।“

আমার প্রশ্ন হচ্ছে: তাঁর নিজেরই যদি মনে হয় যে, এটা বমি উদ্রেককারী, তা হলে সেটা আর পাঠকদের উপহার দেন কেন? কার লাভ তাতে? পাঠকের? তাঁর?

তসলিমা কেবল নারীবাদী নন, তিনি সম্ভবত নারীশ্রেষ্ঠতাবাদী এবং নরবিদ্বেষী। পুরুষদের তিনি আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন। নিজের পরিবারের পুরুষ-সহ পরপুরুষেরা তাঁর ওপর এতো ধরনের অত্যাচার করেছেন যে, তাদের ঘৃণা করলে তাঁকে আমি দায়ী করতে পারিনে। তিনি যখন ডাক্তারি করছেন, সেই সময়ে তাঁর পিতা যেভাবে তাকে মারধর করেন, তাকে বাড়িতে তালা দিয়ে বন্দী করে রাখেন, ঘরের মধ্যে একটা বালতি দেন পায়খানা-প্রস্রাব করার জন্যে, তা আইয়ামে জাহেলিয়াতকে হারিয়ে দিতে পারে। তাঁর এক স্বামী তাঁকে যেভাবে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে পুরুষত্ব দেখান, তাতে সে রকম পুরুষদের ঝাটা মারলে তসলিমাকে দোষ দেওয়া যায় না। বারবার যেভাবে পুরুষরা তাঁকে প্রতারনা করেন, তাতে পুরুষবিদ্বেষী হতেই পারেন তিনি।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও স্বীকার করবো, তসলিমার চরিত্র বোঝার ক্ষ্যামতা আমার নেই। সেই বেল্টওয়ালা স্বামীর ভয়ে পাশের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন তসলিমা। বিয়ে ভেঙে যায়। তারপর সেই পুরুষ যখন আবার তাঁর দেহ চান, তসলিমা তাতে তক্ষুণি রাজি হন। এ কি একজন আপোশহীন সংগ্রামী নারীবাদীর চরিত্ৰ? অথচ তিনি মোল্লাদের বিরুদ্ধে যে-অবস্থান নিয়েছিলেন, তাতে তাঁকে দুর্বল চরিত্রের মানুষ বলবো কিভাবে?

পুরুষরা নারীদের এক্সপ্লয়েট করেছে যুগে যুগে। তার জন্যে আজ কি মেয়েরা এক্সপ্লয়েট করবে পুরুষদের? সব পক্ষের এক্সপ্লয়টেশান বন্ধ করাই তো একজন মানবতাবাদীর কর্তব্য, তাই না? কিন্তু তসলিমা তাঁর কবিতার অনবদ্য ভাষায় লেখেন:

আমার খুব ছেলে কিনতে ইচ্ছে হয়
ডাঁশা ডাঁশা ছেলে, বুকে ঘন লোম–
ছেলে কিনে ছেলেকে আমূল তছনছ করে
কুঞ্চিত অণ্ডকোষে জোর লাথি কষে বলে উঠব–যাহ্‌ শালা।

এতো পুরুষের উল্টো পিঠ! পুরুষের সঙ্গে এখানে তাঁর চরিত্রের কোনো ফারাক নেই। আমি তা হলে তাকে আদর্শবাদী বলবো কেন? মহৎ বলবো কেন? নারীবাদ কি মানবতার চেয়েও বড়ো?

দ্বিখণ্ডিত ওরফে ক পড়ে আরও একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো। তসলিমার অনেক পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। হতেই পারে। পারস্পরিক সম্মতিতে প্রাপ্তবয়স্ক লোকেদের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে–সেটা তাঁরাই বিবেচনা করবেন। কিন্তু সেই সম্পর্ক অতীত হলে, সে সম্পর্কে লেখা সঙ্গত কিনা এবং লিখলে, সেটাকে কেউ এক্সপ্লয়টেশান বলতে পারেন। কিনা। একজনকে ব্যবহার করে অথবা একজনের কাছে ব্যবহৃত হয়ে, তারপর সেই অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনী বর্ণনা করে বই লিখে পরিচিতি অর্জন করা, টাকা উপার্জন করা—এটাকে কি ফেয়ার প্লে বলা যায়?

তা সত্ত্বেও স্বীকার করবো, প্রথমে ব্যবহার করে তারপর প্রতাড়না করে থাকলে, আক্রোশের আগুনে জুলে তার বিরুদ্ধে মন্তব্য করা অসম্ভব নয়। মানুষ তো! কিন্তু কারো সম্পর্কে কেবল শুনে তার চরিত্র হননের অধিকার আমাদের আছে কি? প্রসঙ্গত আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে আদর্শ খুব কম। আদর্শ চরিত্র, রোল-মডেল, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বও কম। যে-স্বল্পসংখ্যক চরিত্র আছেন, সমাজ যাদের কথা শোনে, যারা আমাদের বিবেকের কথা বলেন সংকটকালে, সেই মুষ্টিমেয় চরিত্রগুলো ধ্বসিয়ে দিয়ে লাভ কি? বিশেষ করে শোনা-কথার ওপর নির্ভর করে?

ব্যক্তিগত জীবনে তসলিমা মৃদুভাষী, অত্যন্ত বিনয়ী। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। কিন্তু বল্লমের মতো কলম হাতে যে-তসলিমাকে দেখি, তিনি খুব বিনয়ী নন। তাঁর ভাষা, তাঁর বর্ণনা কখনো কখনো শোভন সীমানা ছাড়িয়ে যায়। আমরা যখন একজন মাননীয় ব্যক্তি সম্পর্কে বলি, বয়স্ক লোক সম্পর্কে বলি, এমন কি, গল্পের শ্রদ্ধাভাজন কোনো চরিত্র সম্পর্কে বলি, তখন সাধারণত আমরা ক্রিয়াপদের শেষে “ন” লাগিয়ে সম্মান দেখাই। রামায়ণের রামচন্দ্র রক্তমাংসের মানুষ সম্ভবত নন। খুব সম্ভব কল্পিত চরিত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর সম্পর্কে যখন লিখি, তখন মনে হয়, তাঁকে সম্মান দেখানোই সাধারণ সৌজন্য। না-দেখালে, নিজেকেই ছোটো করা হয় আসলে। রক্তমাংসের চরিত্র, ঐতিহাসিক চরিত্র–বিশ্বের একটা বড়ো ধর্মের প্রবর্তক সম্পর্কে লিখতে গিয়েও তসলিমা তার প্রতি সম্মান দেখাননি। আমি কি বলতে পারি, “ব্যাটা” ধর্মপ্রবর্তক? আমার মনে হয়, তাকে মানি অথবা না-ই মানি, এটা লেখা শোভন নয়। এমন কি, এটা লিখে আমি এমন বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারি, যা থেকে আমার অমঙ্গল হতে পারে, একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে হানাহানি হতে পারে।

তসলিমা অবশ্যই বলতে পারেন যে, তার বাকস্বাধীনতা আছে। তিনি যা খুশি লিখতে পারেন, এবং অন্যরা যা খুশি লিখে তাঁর উত্তর দিতে পারেন। কিন্তু সত্যি কি তাই? বাক প্রকাশের স্বাধীনতা কি অফুরন্ত, সীমাহীন? আমি রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে যা খুশি তাই বলতে পারি? বাক প্রকাশের সঙ্গে কি ঔচিত্যবোধ৷ এবং মানবকল্যাণের ধারণার কোনো যোগাযোগ নেই? বছর পনেরো আগে, সালমন রুশদী তার শয়তানের পদাবলী লিখেছিলেন। তার মধ্যে সরাসরি ইসলাম ধর্মের প্রবর্তকের চরিত্র নিয়ে অশ্ৰীল কোনো কথা ছিলো না। তা ছাড়া, তিনি লিখেওছিলেন, সাহিত্যের উচ্চাঙ্গ রীতিতে, রেখে-ঢেকে। কিন্তু তাই নিয়ে দাঙা বঁধলো দেশে দেশে। নিরপরাধ কতোগুলো মানুষের জীবন গেলো। এই উগ্ৰবাদী দাঙার নিন্দা আমরা অবশ্যই করতেই পারি। আবার এ দাঙার ব্যাপারে সালমান রুশদীর দায়িত্বও ভুলে যেতে পারিনে।

বাক প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই আছে। সভ্যতার, মানবতার এটা একটা আবশ্যিক শর্ত। কিন্তু বাক প্রকাশের স্বাধীনতা কি অ্যাবসোলুট? চরম? অন্য কোনো বিবেচনা যার কাছে ঠাই পাবে না? তা হলে যে-বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে মারণাস্ত্ৰ আবিষ্কার করেন, তাঁদের কেন নিন্দা করবো? পর্নোগ্রাফি তৈরি করে যাঁরা অনেকের অনুভূতিকে উস্কে দেন, তাদের কেন নিন্দা করবো? আমার মনে হয়, বাক স্বাধীনতার সঙ্গে মানবকল্যাণের ধারণাটাও জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। অধিকারের সঙ্গে দায়িত্বের যোগাযোগও অস্বীকার করা যায় না।

সব শেষে একটা কথা মনে হচ্ছে। তসলিমা কলম হাতেই আমাদের সামনে হাজির হয়েছিলেন। এবং রাতারাতি লাভ করেছিলেন অসামান্য খ্যাতি। তার কবিতা এবং ধারালো গদ্যই নয়, তাঁর খ্যাতির একটা প্ৰধান কারণ নারীমুক্তির সংগ্রামে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা। সেই ভূমিকায় তাঁকে অটল থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তিনি নারীমুক্তির পথ থেকে সরে গিয়ে অবশ্যই লেখিকার ভূমিকা নিতে পারেন। অথবা সেটাকেই বড়ো করে তুলতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে: তাঁর সত্যিকার শক্তি কোথায়? আমার মনে হয়, সীমাহীন সাহসে আর আত্যন্তিক আন্তরিকতায়। অনেক কাল আগে রবীন্দ্রনাথ একটি তরুণের মধ্যে একই ধরনের অসামান্য শক্তি লক্ষ্য করে তাকে বলেছিলেন, তুমি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাচিছো। আশা করি, প্রতিভাবান এবং প্ৰতিশ্রুতিশীল তসলিমা তার শক্তির অপচয় করবেন না।

(প্ৰথম আলো, মার্চ ২০০৫)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *