• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১৫. মুর্গীর কাশ্মীরী কোর্মা

লাইব্রেরি » শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ব্যোমকেশ সমগ্র (ব্যোমকেশ বক্সী) » ১৫. বহ্নি-পতঙ্গ - ব্যোমকেশ বক্সী - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ১৫. মুর্গীর কাশ্মীরী কোর্মা

পাণ্ডেজির বাড়িতে নৈশ ভোজনের নিমন্ত্রণ। অতিথির সংখ্যা বাড়িয়াছে; ডাক্তার পালিত‌, মিস মান্না‌, ব্যোমকেশ ও আমি। টেবিল ঘিরিয়া খাইতে বসিয়াছি। আহার্য দ্রব্যের মধ্যে প্রধান–মুর্গীর কাশ্মীরী কোর্মা।

ব্যোমকেশ এক টুকরা মাংস মুখে দিয়া অর্ধ-নিমীলিত চক্ষে আস্বাদ গ্রহণ করিল‌, তারপর

পাণ্ডেজি হাসিমুখে ভ্রূ তুলিলেন‌, ‘কী চুরি করবেন?’

‘আপনার বাবুর্চিকে।’

পাণ্ডেজি হাসিতে লাগিলেন‌, বলিলেন‌, ‘অসম্ভব।’

‘অসম্ভব কেন?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘আমার বাবুর্চি আমি নিজেই।’

‘অ্যাঁ—এই অমৃত আপনি রেধেছেন। তবে আর আপনার পুলিসের চাকরি করার কি দরকার? একটি হোটেল খুলে বসুন‌, তিন দিনে লাল হয়ে যাবেন।’

কিছুক্ষণ হাস্য-পরিহাস চলিবার পর মিস মান্না বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আমাকে কিন্তু আপনারা ফাঁকি দিয়েছেন। সে হবে না‌, সব কথা আগাগোড়া বলতে হবে। কি করে কি হল সব বলুন‌, আমি শুনব।’

ডাক্তার পালিত বলিলেন‌, ‘আমিও শুনব। এ ক’দিন আমি আসামী। কিনা। এই ভাবনাতেই আধমরা হয়ে ছিলাম। এবার বলুন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখন মুখ চলছে। খাওয়ার পর বলব।’

আকণ্ঠ আহার করিয়া আমরা বাহিরে আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ গড়গড়ার নল হাতে লইল‌, ডাক্তার পালিত একটি মোটা চুরুট ধরাইলেন।

মিস মান্না জব্দ মুখে দিয়া হাসিমুখে বলিলেন‌, ‘এবার আরম্ভ করুন।’

ব্যোমকেশ গড়গড়ার নিলে কয়েকটি মন্দ-মন্থর টান দিয়া ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল।

‘এই ঘরেই রতিকান্তকে প্রথম দেখেছিলাম। পাণ্ডেজিকে নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। সুন্দর চেহারা‌, নীল চোখ। দীপনারায়ণ সিং-এর উদ্দেশ্যে হাল্কা ব্যঙ্গ করে বলেছিল-বড় মানুষ কুটুম্ব। তখন জানতাম না। ওই হাল্কা ব্যঙ্গের আড়ালে কতখানি রিষ লুকিয়ে আছে। তখন কিছুই জানতাম না‌, তাই ‘কুটুম্ব’ কথাটাও কানে খোঁচা দিয়ে যায়নি। এখন অবশ্য জানতে পেরেছি শকুন্তলা আর রতিকান্তের মধ্যে একটা দূর সম্পর্ক ছিল; দু’জনেরই বাড়ি প্রতাপগড়ে‌, দু’জনেই পড়ে-যাওয়া ঘরানা ঘরের ছেলে মেয়ে‌, দু’জনে বাল্য প্রণয়ী।

‘রতিকান্ত সে-রাত্রে আমার পরিচয় জানতে পারেনি‌, পাণ্ডেজি কেবল বলেছিলেন,–আমার কলকাতার বন্ধু। তাতে তার মনে কোনও সন্দেহ হয়নি। যদি সে-রত্রে সে জানতে পারত যে অধমের নাম ব্যোমকেশ বক্সী তাহলে সে কি করত বলা যায় না‌, হয়তো প্ল্যান বদলে ফেলত। কিন্তু তার পক্ষে মুশকিল হয়েছিল। এই যে‌, পৌঁছুবার আর সময় ছিল না‌, একেবারে শিরে সংক্রান্তি এসে পড়েছিল।

‘শকুন্তলা আর রতিকান্তর গুপ্ত-প্রণয়ের অতীত ইতিহাস যত দূর আন্দাজ করা যায় তা এই। ওদের বিয়ের পথে সামাজিক বাধা ছিল‌, তাই ওদের দুরন্ত প্রবৃত্তি সমাজের চোখে ধুলো দিয়ে গুপ্ত-প্রণয়ে লিপ্ত হয়েছিল; ওদের উগ্ব অসংযত মন আধুনিক স্বৈরাচারের সুযোগ নিয়েছিল পূর্ণ মাত্রায়। কিন্তু তবু সবই চুপি চুপি। নৈতিক লজ্জা না থাক‌, লোকলজ্জার ভয় ছিল; তার উপর ‘চোরি পিরিতি লাখগুণ রঙ্গ’। লুকিয়ে প্রেম করার মধ্যে একটা তীব্র মাধুর্য আছে।

‘তারপর একদিন দীপনারায়ণ শকুন্তলাকে দেখে তার রূপ-যৌবনের ফাঁদে পড়ে গেলেন। শকুন্তলা দীপনারায়ণের বিপুল ঐশ্বর্য দেখল‌, সে লোভ সামলাতে পারল না। তাঁকে বিয়ে করল। কিন্তু রতিকান্তকেও ছাড়ল না। রতিকান্তর বিয়েতে মত ছিল কিনা আমরা জানি না। হয়তো পুরোপুরি ছিল না‌, কিন্তু শকুন্তলাকে ত্যাগ করাও তার অসাধ্য। শকুন্তলা বিয়ের পর যখন পাটনায় এল তখন রতিকান্তও যোগাড়যন্ত্র করে পাটনায় এসে বসল‌, বোধহয় মোহান্ধ দীপনারায়ণ সাহায্য করেছিলেন। ফলে ভিতরে ভিতরে আবার রতিকান্তর আর শকুন্তলার আগের সম্বন্ধ বজায় রইল। বিয়েটা হয়ে রইল ধোঁকার টাটি।’

‘কুটুম্ব হিসাবে রতিকান্ত দীপনারায়ণের বাড়িতে যাতায়াত করত‌, কিন্তু প্রকাশ্যে শকুন্তলার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা দেখাত না। তাদের সত্যিকারের দেখা সাক্ষাৎ হত সকলের চোখের আড়ালে। শকুন্তলা চিঠি লিখে গভীর রাত্রে নিজের হাতে ডাক-বাক্সে ফেলে আসত; রতিকান্ত নির্দিষ্ট রাত্রে আসত‌, খিড়কির দরজা দিয়ে হাতায় ঢুকত‌, তারপর লোহার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেত। শকুন্তলা দোর খুলে প্রতীক্ষা করে থাকত–

‘এইভাবে চলছিল‌, হঠাৎ প্রকৃতিদেবী বাদ সাধলেন। দীপনারায়াণের যখন গুরুতর অসুখ ঠিক সেই সময় শকুন্তলা জানতে পারল সে অন্তঃসত্ত্বা। এখন উপায়? অন্য সকলের চোখে যদি বা ধুলো দেওয়া যায়‌, দীপনারায়ণের চোখে ধুলো দেওয়া যায় না। দু’জনে মিলে পরামর্শ করল তাড়াতাড়ি দীপনারায়ণকে সরাতে হবে; নইলে মান-ইজ্জত রাজ-ঐশ্বৰ্য কিছুই থাকবে না‌, গালে চুন কালি মেখে ভদ্রসমাজ থেকে বিদায় নিতে হবে।

‘মৃত্যু ঘটাবার এই চোস্ত ফন্দিটা রতিকাস্তের মাথা থেকে বেরিয়েছিল সন্দেহ নেই। দৈব যোগাযোগও ছিল; এক শিশি কিউরারি একটা ছিচকে চোরের কাছে পাওয়া গিয়েছিল। সেটা যখন রতিকান্তর হাতে এল‌, রতিকান্ত প্রথমেই খানিকটা কিউরারি সরিয়ে ফেলল। তারপর যথাসময়-রতিকান্ত নিজেই ডাক্তারবাবুর ডিসপেনসারির তালা ভেঙে লিভারের ভায়াল বদলে রেখে এল‌, তারপর নিমন্ত্রণ-বাড়িতে গিয়ে খবর দিলে। সকলেই ভাবলে ছিচকে চোরের কাজ।

‘সেই রাত্রেই রতিকান্ত আমার নাম জানতে পারল। অনুবাদের কল্যাণে হিন্দী শিক্ষিত সমাজে আমার নামটা অপরিচিত নয়। রতিকান্ত ঘাবড়ে গেল। কিন্তু তখন আর উপায় নেই‌, হাত থেকে তীর বেরিয়ে গেছে।

‘পরদিন সকালে ডাক্তারবাবু ইনজেকশন দিলেন‌, দীপনারায়ণের মৃত্যু হল। রতিকান্ত ভেবেছিল‌, কিউরারি বিষের কথা কারুর মনে আসবে না‌, সবাই ভাববে লিভার ইনজেকশনের শকে মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারবাবুও প্রথমে তাই ভেবেছিলেন‌, কিন্তু যখন কিউরারির কথা উঠল। তখন তাঁর খটকা লাগিল। তিনি বললেন,–হতেও পারে।

‘রতিকান্ত আগে থাকতে ঘাবড়ে ছিল‌, এখন সে আরও ঘাবড়ে গিয়ে একটা ভুল করে ফেললে। এই বোধহয় তার একমাত্র ভুল। সে ভাবল‌, দীপনারায়ণের শরীরে নিশ্চয় কিউরারি পাওয়া যাবে; এখন যদি লিভারের ভায়ালে কিউরারি না পাওয়া যায় তাহলে আমাদের সন্দেহ হবে ডাক্তার পালিতাই ভায়াল বদলে দিয়েছেন। রতিকাম্ভের কাছে একটা নির্বিষ লিভারের ভায়াল ছিল‌, যেটা সে ডাক্তার পালিতের ব্যাগ থেকে বদলে নিয়েছিল। সে অ্যানালিসিসের জন্যে সেই নির্বিষ ভায়ালটা পাঠিয়ে দিলে।

‘যখন জানা গেল ভায়ালে বিষ নেই তখন ভারি ধোঁকা লাগল। শরীরে বিষ পাওয়া গেছে অথচ ওষুধে বিষ পাওয়া গেল না‌, এ কি রকম? দীপনারায়ণের মৃত্যুর পর কেবল তিনজনের হাতে ভায়ালটা গিয়েছিল-ডাক্তার পালিত‌, পাণ্ডেজি আর রতিকান্ত। পাণ্ডেজি আর রীতিকান্ত পুলিসের লোক; সুতরাং ডাক্তারবাবুরই কাজ‌, তিনি এই রকম একটা গোলমেলে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে পুলিসের মাথা গুলিয়ে দিতে চান। কিন্তু ডাক্তার পালিতের মোটিভ কি?

‘ইতিমধ্যে দুটো মোটিভ পাওয়া গিয়েছিল-টাকা আর গুপ্ত-প্রেম। গুপ্ত-প্রেমের সন্দেহটা ডাক্তার পালিতাই আমাদের মনে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যদি গুপ্ত-প্ৰেমই আসল মোটিভ হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে‌, শকুন্তলার দুষ্মন্ত কে? আর যদি টাকা মোটিভ হয় তাহলে তিনজনের ওপর সন্দেহ-দেবনারায়ণ‌, চাঁদনী আর গঙ্গাধর বংশী। শকুন্তলাও কলঙ্ক এড়াবার জন্যে লোক লাগিয়ে স্বামীকে খুন করতে পারে। এদের মধ্যে যে-কেউ ডাক্তার পালিতকে মোটা টাকা খাইয়ে নিজের কাজ হাসিল করে থাকতে পারে। একুনে সন্দেহভাজনের সংখ্যা খুব কম হল না; দেবনারায়ণ থেকে নর্মদাশঙ্কর‌, ঘোড়া জগন্নাথ সকলেরই কিছু না কিছু স্বাৰ্থ আছে।

‘রতিকান্ত কিন্তু উঠে-পড়ে লেগেছিল দোষটা ডাক্তার পালিতের ঘাড়ে চাপাবে। সে বক্সারে গিয়ে কয়েদীর কাছ থেকে জবানবন্দী লিখিয়ে নিয়ে এল। আমরা জানি এ-ধরনের কয়েদীকে হুমকি দিয়ে বা লোভ দেখিয়ে পুলিস যে-কোনও জবানবন্দী আদায় করতে পারে। তাই আমরা কুলগুলির মতলব বলে মেন মনে হাসলাম। রফিকাই যে অপরাধী তা আমরা তখন জানতে পেরেছি।

‘অন্যদিকে ছোটখাটো দু’ একটা ব্যাপার ঘটছিল। পিতা-পুত্র গঙ্গাধর আর লীলাধর মিলে বারো হাজার টাকা হজম করবার তালে ছিল। ওদিকে নর্মদাশঙ্কর দীপনারায়ণের মৃত্যুতে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল‌, ভেবেছিল শকুন্তলার হৃদয়ের শূন্য সিংহাসন সেই এবার দখল করবে। সে জানত না যে শকুন্তলার হৃদয়-সিংহাসন কোনওকালেই শূন্য হয়নি।

‘হঠাৎ সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল‌, শকুন্তলার দুষ্মন্ত কে তা জানতে পারলাম। শকুন্তলা দেয়ালে একটা ছবি এঁকেছিল। সেকালে শকুন্তলার পূর্বরাগের ছবি। প্রথম যে-রাত্রে ছবিটা দেখি সে-রত্রে কিছু বুঝতে পারিনি‌, নীল আলোয় ছবির নীল-রঙ চাপা পড়ে গিয়েছিল। পরদিন দিনের আলোয় যখন ছবিটা দেখলাম এক মুহুর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। যেন কুয়াশায় মুক্তি ঝাপসা হয়ে ছিল‌, হঠাৎ কুয়াশ খুঁড়ে সূর্ব বেরিয়ে এল। ছবিতে দুষ্মন্তের চোখের মণি নীল।

‘প্ৰেম বড় মারাত্মক জিনিস। প্রেমের স্বভাব হচ্ছে নিজেকে প্রকাশ করা‌, ব্যক্ত করা‌, সকলকে ডেকে জানানো-আমি ওকে ভালবাসি। অবৈধ প্ৰেম তাই আরও মারাত্মক! যেখানে পাঁচজনের কাছে প্ৰেম ব্যক্ত করবার উপায় নেই। সেখানে মনের কথা বিচিত্র ছদ্মবেশে আত্মপ্রকাশ করে।‘ শকুন্তলা ছবি এঁকে নিজের প্রেমকে ব্যক্ত করতে চেয়েছিল। ছবিতে দুষ্মন্তের চেহারা মোটেই রতিকান্তের মত নয়‌, কিন্তু তার চোখের মণি নীল। ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান!’ অজিত আর পাণ্ডেজিও ছবি দেখেছিলেন‌, কিন্তু তাঁরা নীলচোখের ইশারা ধরতে পারেননি।

‘এই ব্যাপারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যত লোক আছে তাদের মধ্যে কেবল রতিকান্তরই নীল চোখ। সুতরাং রতিকান্তাই শকুন্তলার প্রচ্ছন্ন প্রেমিক। মোটিভ এবং সুযোগ‌, বুদ্ধি এবং কর্মতৎপরতা সব দিক দিয়েই সে ছাড়া আর কেউ দীপনারায়ণের মৃত্যুর জন্যে দায়ী নয়।

‘কিন্তু তাকে ধরব কি করে? শুধু নীল-চোখের প্রমাণ যথেষ্ট নয়। একমাত্র উপায়‌, যদি ওরা নিভৃতে পরস্পর দেখা করে‌, যদি ওদের এমন অবস্থায় ধরতে পারি যে অস্বীকার করবার পথ না থাকে।

‘ফাঁদ পাতলাম। আমি একা শকুন্তলার সঙ্গে দেখা করে স্পষ্ট ভাষায় বললাম-তোমার দুষ্মন্ত কে তা আমি জানতে পেরেছি এবং সে কি করে দীপনারায়ণকে খুন করেছে তাও প্রমাণ দিতে পারি। কিন্তু আমি পুলিস নয়; তুমি যদি আমাকে এক লাখ টাকা দাও। তাহলে আমি তোমাদের পুলিসে ধরিয়ে দেব না। আর যদি না দাও পুলিসে সব কথা জানতে পারবে। বিচারে তোমাদের দু’জনেরই ফাঁসি হবে। শকুন্তলা কিছুঁতেই স্বীকার করে না। কিন্তু দেখলাম ভয় পেয়েছে। তখন বললাম-তোমাকে আজকের দিনটা ভেবে দেখবার সময় দিলাম। যদি এক লাখ টাকা দিয়ে আমার মুখ বন্ধু করতে রাজী থাকে‌, তাহলে আজ রাত্রে আমার নামে একটা চিঠি লিখে‌, নিজের হাতে ডাক-বাক্সে দিয়ে আসবে। চিঠিতে স্রেফ একটি কথা লেখা থাকবে-হাঁ। রাত্রি দশটার পর মিস মান্নাকে এখান থেকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা আমি করব‌, রাত্ৰে হাতায় পুলিস পুহারাও থাকবে না। যদি কাল তোমার চিঠি না পাই‌, আমার সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাণ্ডেজির হাতে সমর্পণ করব।

‘ভয়-ব্বিৰ্ণ শকুন্তলাকে রেখে আমি চলে এলাম‌, মিস মান্না তার ভার নিলেন। এখন শুধু নজর রাখতে হবে শকুন্তলা আড়ালে রতিকান্তের সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ না পায়। তারপর আমি পাণ্ডেজির সঙ্গে পরামর্শ করে বাকি ব্যবস্থা ঠিক করলাম। রাত্রে রতিকান্ত বক্সার থেকে ফিরলে তাকে এক নতুন গল্প শোনালাম‌, তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে পাণ্ডেজির এখানে এলাম।

‘আমি আর অজিত সকাল সকাল এখান থেকে বেরিয়ে দীপনারায়ণের বাড়ির পাশে আমবাগানে গেলাম; তিওয়ারী দু’জন লোক নিয়ে উপস্থিত ছিল‌, সবাই আম গাছে উঠে লুকিয়ে রইলাম। এদিকে পাণ্ডেজি রাত্রি সাড়ে নটা পর্যন্ত রতিকান্তকে আটকে রেখে ছেড়ে দিলেন‌, আর নিজে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। অন্ধকারে গাছের ডালে বসে শিকারের প্রতীক্ষ্ণ আরম্ভ হল।

‘আমি ছিলাম। খিড়কির দরজার কাছেই একটা গাছে। পাণ্ডেজি এসে আমার পাশের গাছে উঠেছিলেন। নিঃশব্দ অন্ধকারে ছয়টি প্রাণী বসে আছি। দশটা বাজল। আকাশে কুয়াশা জমতে আরম্ভ করেছিল; গাছের পাতা থেকে টপ টপ শব্দে জল পড়তে লাগল। তারপর মিস। মান্না মোটরে বাড়ি চলে গেলেন।

‘রতিকান্ত কখন এসেছিল। আমরা জানতে পারিনি। সে বোধ হয় একটু দেরি করে এসেছিল; পাণ্ডেজির কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে সে নিজের বাসায় গিয়েছিল‌, সেখান থেকে পিস্তল নিয়ে আমবাগানে এসেছিল।

‘রতিকান্তের চরিত্র আমরা একটু ভুল বুঝেছিলাম—যেখানেই দেখা যায় দু’জন বা পাঁচজন একজোট হয়ে কাজ করছে সেখানেই একজন সদর থাকে‌, বাকি সকলে তার সহকারী। বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা ভেবেছিলাম শকুন্তলাই নাটের গুরু‌, রতিকান্ত সহকারী। আসলে কিন্তু ঠিক তার উল্টো। রতিকান্তের মনটা ছিল হিংস্ব শ্বাপদের মত‌, নিজের প্রয়োজনের সামনে কোনও বাধাই সে মানত না। সে যখন শুনল যে শকুন্তলা চিঠি লিখে অপরাধীর নাম প্রকাশ করে দিতে রাজী হয়েছে তখনই সে স্থির করল শকুন্তলাকে শেষ করবে। তার কাছে নিজের প্রাণের চেয়ে প্রেম বড় নয়।

‘আমরা ভেবেছিলাম রতিকান্ত শকুন্তলাকে বোঝাতে আসবে যে শকুন্তলা যদি অপরাধীর নাম প্রকাশ না করে তাহলে কেউ তাদের ধরতে পারবে না‌, শাস্তি দিতেও পারবে না। আমাদের প্ল্যান ছিল‌, যে-সময় ওরা এই সব কথা বলাবলি করবে। ঠিক সেই সময় ওদের ধরব।

‘রতিকান্ত কিন্তু সে—ধার দিয়ে গেল না। সে মনে মনে সঙ্কল্প করেছিল অনিষ্ট্রের জড় রাখবে না‌, সমুলে নির্মূল করে দেবে।

শকুন্তলা কখন চিঠি হাতে নিয়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বেরুল আমরা জানতে পারিনি, চারিদিকের টপ টপ শব্দের মধ্যে তার পায়ের আওয়াজ ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু রতিকান্ত বোধহয় দোরের পাশেই ওৎ পেতে ছিল‌, সে ঠিক শুনতে পেয়েছিল। হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে দপ করে টর্চ জ্বলে উঠল‌, সেই আলোতে শকুন্তলার ভয়ার্তা মুখ দেখতে পেলাম। ওদের মধ্যে কথা হল না‌, কেবল কয়েকবার পিস্তলের আওয়াজ হল। শকুন্তলা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

‘আমার কাছে পুলিস হুইসল ছিল‌, আমি সেটা সজোরে বাজিয়ে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়লাম। পাণ্ডেজিও গাছ থেকে লাফিয়ে নামলেন। তাঁর বাঁ হাতে টর্চ‌, ডান হাতে রিভলবার।

‘রতিকান্ত নিজের টর্চ নিভিয়ে দিয়েছিল। পাণ্ডেজির টর্চের আলো যখন তার গায়ে পড়ল তখন সে পিস্তল পকেটে রেখে হাঁটু গেড়ে শকুন্তলার হাত থেকে চিঠিখানা নিচ্ছে। আহত বাঘের মত সে ফিরে তোকাল‌, তারপর বিদ্যুৎবেগে পকেট থেকে পিস্তল বার করল।

‘কিন্তু পিস্তল ফায়ার করবার অবকাশ তার হল না; পাণ্ডেজির রিভলবারে একবার আওয়াজ হল—‘

ব্যোমকেশ থামিলে ঘর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। ডাক্তার পালিতের চুরুট নিভিয়া গিয়াছিল‌, তিনি সেটা আবার ধরাইলেন। মিস মান্না একটা কম্পিত নিশ্বাস ফেলিলেন।

‘শকুন্তলা ভাল মেয়ে ছিল না। কিন্তু—‘

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ। সে সম্মোহন মন্ত্র জানত।–চাঁদনী এখনও বিশ্বাস করে না যে শকুন্তলা দোষী। —‘

আমি বলিলাম‌, ‘ওদের জীবিত ধরতে পারলেই বোধহয় ভাল হত–’

পাণ্ডেজি মাথা নাড়িলেন‌, ‘না‌, এই ভাল।’

Category: ১৫. বহ্নি-পতঙ্গ - ব্যোমকেশ বক্সী - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ১৪. এক্কা হইতে নামিয়া

Reader Interactions

Comments

  1. Ranit Ghorui

    October 28, 2020 at 5:01 pm

    অসাধারণ

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑