০১. দেবতার নারীবন্দনা

দেবতার নারীবন্দনা

ভাবতেই পারতাম না, গরুর চেয়ে উপকারী কোনো জন্তু থাকতে পারে। কিন্তু সেদিন কাক-ডাকা ভোরে এক দিব্যজ্যোতি দেবতা এসে উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, “বৎস, গরুর চাইতে উপকারী জন্তু পশুপতি। অবশ্যই সৃষ্টি করিয়াছেন। তাহাকে চিনিতে পারিতেছ না? চক্ষু থাকিতেও তুমি অন্ধ। একবার নয়ন মেলিয়া চাহিয়া দেখো। দেখিতে পাইবে, তোমার গৃহেই গরুর চাইতে বহু গুণে উপকারী একটি জন্তু মনুষ্যরূপ ধরিয়া বাস করিতেছে। আমি তোমাদের গৃহলক্ষ্মী–নারীদের কথা বলিতেছি।”

এই দিব্যজ্যোতি দেবতা যে মহাদেব নন, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তবু তাঁকে খুশি করার জন্যে (তেল দিলে কে না খুশি হয়!)। আমি বললাম, “দেবাদিদেব! আপনি এ কি বলছেন? গরু তো পশু নয়–গরু হলেন গোমাতা! না, ভুল বললাম! মাতার মাতা। কারণ মা সন্তানকে দুধ দেন মাত্র কয়েক মাস। অপর পক্ষে, গরু আমাদের দুধ দেয়। সারা বছর, সারা জীবন। আর, খাদ্যপ্ৰাণের কথা বিবেচনা করলে দুধ হচ্ছে সব খাবারের শ্ৰেষ্ঠ। তদুপরি, এই দুধ দিয়ে দৈ, সন্দেশ, রসগোল্লা-সহকতো রকমের অতি সুস্বাদু খাবার তৈরি হয়। আপনি হয়তো চিনলেও চিনতে পারেন, নোবেল প্ৰাইজ পাওয়া এক বাঙালি কবি কোনো এক দোকানের দৈ খেয়ে এমন মোহিত হয়েছিলেন যে, তাকে পয়োধি বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। প্ৰভু, আপনি আপনার অভিমত রিভাইজ করুন।”

দেবতা বললেন, “তোমার বক্তব্য একেবারে যুক্তিবর্জিত, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু পূৰ্ণ মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করো। তাহা হইলে গরুর তুলনায় নারীদের শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্যই দর্শন করিতে পরিবে। গরু দুধ দেয় বটে, কিন্তু তাহার শিং আছে। অনেক সময় সে মাথায় ঝাকুনি দিয়া গুঁতাইতে আসে। অনেক সময় দোহন করিবার সময় পা তুলিয়া ঝটিকা লাথি মারে। কিন্তু মানুষের অর্থাৎ পুরুষের শত অত্যাচার সহ্য করিয়াও নারী কখনো গুঁতাইতে আসে না। অথবা লাথিও মারে না। প্রয়োজনমতো গুঁতাইলে তোমাদের দেহ ঝাঁঝরা হইয়া যাইতো। লাথি দিলে। লাথি খাইতে খাইতে তোমাদের হাড় ভাঙিয়া গুড়া হইয়া যাইতো। তুমি চাটুকারিতা করিয়া আমাকে দেবাদিদেব বলিয়াছ বটে, কিন্তু আমি তাঁহার আজ্ঞাবাহী দাস মাত্র। আসল দেবাদিদেব উত্তমরূপে জানিতেন যে, মনুষ্যজাতি অর্থাৎ পুরুষকুল কি অসম্ভব কৃতঘ্ন এবং বদমাশ। নারীরা তাহাদের সমান হইলে অথবা তাহাদের ব্যবহারের উপযুক্ত উত্তর দিলে পুরুষ জাতি পুনঃপুন ভস্ম হইয়া যাইতো। কিন্তু তাহা হইলে মনুষ্য জাতিও বিলুপ্ত হইতো। অতএব তিনি ঠিক করিলেন যে, জানোয়ার-শ্রেষ্ঠ পুরুষদের জন্য ঢ়োড়া সাপের মতো নারী সৃষ্টি করাই নিরাপদ। কারণ এই সাপের বিষ নাই, তাহারা কামড়ায় না, এমন কি ঢুসঢাসও করে না।”

আমার স্বীকার করতেই হলো যে, হ্যাঁ, নারীদের মনের ইচ্ছা যেমনই হোক না কেন (তাদের সত্যিকার ইচ্ছার কথা দেবতারও জানা নেই), কিন্তু তাঁরা প্রকাশ্যে গুঁতোয় না অথবা পদাঘাতও করে না। কিন্তু তবু দেবতাকে বললাম, “যে-গরু কেবল দুধ দেয় না, তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ার জন্যে নিজেদের দেহও দান করে; যে-গরু ফসল জন্মানোর জন্যে চাষবাসে আমাদের অশেষ উপকার করে; যে-গরুর গোবর খেয়ে মানুষের প্রায়শ্চিত্য করতে হয়; যে-গরুর গোবর সার এবং জ্বালানী হিশেবে ব্যবহার করা হয়; যে-গরুর শিং এবং হাড়ও ফেলার বস্তু নয়–আপনি সেই গোমাতাকে তুচ্ছ নারীর সঙ্গে তুলনা করছেন। দয়া করে বেয়াদবি বলে বিবেচনা করবেন না, কিন্তু হে প্ৰভু, আপনি আর-একবার বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করে দেখুন।”

দেবতা বললেন, “তুমি বেয়াদবেরও অধম। দীর্ঘ জটিল বাক্য দিয়া এবং বাগাড়ম্বর করিয়া আমাকে ঠকাইবার ফন্দি আঁটিতেছ। ভাবিয়াছ পুরাকালের দেবতা আধুনিক লৌকিক ভাষার অর্থ ভালো করিয়া বুঝিতে পরিবেন না। ইহা তোমার ভুল ধারণা। (নোয়াখালির ভাষায়: বুল দারণা।) তুমি কেবল বেয়াদব নও, তুমি একটি গোমূর্খ। পাছে তুমি আমার কথা অনুধাবন করিতে সমর্থ না হও, সেই নিমিত্ত রামমোহন নামে তোমার এক পূর্বপুরুষের বাক্য দিয়া বুঝাইয়া দিতেছি। কোনো গরু তোমাদের দুই-তিন বেলা টক, মিষ্টি, ঝাল, কষায় ইত্যাদি বিচিত্র স্বাদের সুস্বাদু খাদ্য রাঁধিয়া দেয়? তোমার বাড়ি পাহারা দেয়? বরঞ্চ গরুকে পাহারা দিয়া রাখিতে হয়। গরু অতি ভোরবেলা হইতে মধ্য রাত্রি পর্যন্ত পুরুষকুলের সেবা করে? গরু কি তোমাদের সন্তানাদি লালন-পালন করে? তোমার প্রতিবেশিনীর সঙ্গে যখন ঝগড়া লাগিয়া যায়, তখন কোনো গরু কি কোমরে কাপড় প্যাঁচাইয়া তোমার হইয়া গলা ফাটাইয়া শ্রাবণের ধারার মতো গালি বর্ষণ করে? তুমি, নরাধম এবং চরম নেমকহারাম, সেই কারণে গরুর সহিত নারীর তুলনা করিতেছ। নারী গরুর তুলনায় সহস্ৰ গুণ উপকারী।”

দেবতা যেসব পয়েন্ট উত্থাপন করলেন, তার মধ্যে দু-একটার কথা সত্যি সত্যি আমি আগে থেকে চিন্তা করিনি। সে জন্যে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যুক্তি খণ্ডন করার মতো কথা খুঁজে পেলাম না। তা সত্ত্বেও বললাম, “হে তাত! আপনি যা বলছেন, তা হয়তো ঠিকই। কিন্তু নারীর চামড়া কোনো কাজে লাগে, বলুন! অথচ গরুর চামড়া–মহা উপকারী বস্তু।”

দেবতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিলো, তাঁর কণ্ঠ থেকেই সেটা টের পেলাম। কিন্তু পর মুহূর্তেই একটু থেমে দয়াময় এবং ক্ষমাশীল দেবতা তাঁর কণ্ঠ সংযত এবং নিচু করে বললেন, “তুমি একটি বলদ নয়তো গরুর পক্ষ লইয়া এই সকল কুযুক্তি দিতে না। গরুর চক্ষু দুইটি সুন্দর–এই পর্যন্ত। কিন্তু নারীদের কেবল নয়ন দুটি সুন্দর নয়। এমন মায়া দিয়া তাঁহাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃজন করা হইয়াছে যে, তাহাদের অতীব মনোহর দেহের দিকে তোমরা বেহারার মতো চাহিয়া থাকো। শত আবরণে নিজেদের দেহ ঢাকিয়াও নারীরা তোমাদের লুব্ধ দৃষ্টি হইতে নিজেদের বাঁচাইতে পারে না। তোমাদের নির্লজ্জ এবং লালসার দৃষ্টি তাহাদের পুরু বস্ত্ৰ ভেদ করিয়া ধারালো তিরের মতো তাহাদের দেহে বিধিতে থাকে। লুকাইয়া লুকাইয়া এবং তির্যক দৃষ্টিতে প্রতিদিন নারীদের না-দেখিলে তোমাদের ভীত হজম হয় না। সেই নারীদের সম্পর্কে তোমাদের এতো অশ্রদ্ধা! বৎস! সত্য করিয়া বলো: কোনো গরুর সহিত শয়ন করিয়াছ? অপর পক্ষে, নারীদের সহিত প্রতিদিন শয়ন করিয়া স্বৰ্গসুখে উন্মত্ত হইয়া তাহাদের দেহ মন্থন করিয়া স্বাৰ্থপরের মতো নিজেদের যৌনক্ষুধা মিটাইয়া থাকো। তাহাদের ক্ষুধা মিটিল। কিনা, তাহার কথা ভাবিয়াও দেখো না। সঙ্গম সারিয়া তোমরা বজুনিৰ্ঘোষে নাক ডাকাইতে আরম্ভ করো। আর নারী পরবর্তী ন মাস তোমার সন্তান গর্ভে ধারণ করিয়া কতো না ক্লেশ স্বীকার করে! তারপরও সেই নারীদের তোমরা গরুর চাইতেও হেয় জ্ঞান করে! তোমরা এতো নিকৃষ্ট জীব!”

শেষের কথাটা দেবতা সঠিক বলিয়াছেন বলিয়া বোধ হইলো। কিন্তু প্রতিবাদ না-করলে নারীরা পাছে আশকারা পায়, সেই হেতু হাত কচলে এবং যাদুর সম্ভব ছদ্মবিনয়ে বিগলিত হয়ে দেবতাকে আবার বললাম, হে দেব! নারীদের আমরা পূজা করিনে বটে, কিন্তু তাই বলে তাদের গরুর চেয়ে কম যত্ন করি, এই অভিযোগ সম্ভবত ন্যায্য নয়। বৈষম্যের একটা সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টার পুনর্বিবেচনা প্রার্থনীয়।

দিব্যজ্যোতি প্ৰসন্নবদন শান্তকণ্ঠ দেবতা। হঠাৎ রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, “তুমি তো বাপু মহা ফাজিল! মুখে মুখে তর্ক করিতেছ? বৈষম্যের সব চাইতে বড়ো দৃষ্টান্ত হইল তোমরা নারীদের নিজেদের মতো মানুষ বলিয়াই গণ্য করো না। তোমরা তাহাদের যতো দূর সম্ভব শোষণ এবং ব্যবহার করো। কিন্তু তাহার পর তাহাদের একটা জন্তুর মতোও খাতির করো না। যেমন, গরুকে যত্নের সঙ্গে ঘাস খাওয়াও। খড়, জাবনা, খৈল এবং ফেন দেও। কিন্তু নারীদের কখনো নিজ হাতে কোনো খাবার পরিবেশন করিয়া খাওয়াইয়াছ? তোমরা নিজেরা গোগ্রাসে উদরপূর্ণ করিয়া শয্যায় আশ্রয় লও, কিন্তু যে-নারী তোমাদের আহার প্রস্তুত করিয়াছে, তাহারা খাইল কিনা অথবা কি খাইল কখনো খবর লইয়াছ? আমার মেজাজ খারাপ করিয়া দিও না, শেষে মুখে অভিশাপ বাক্য আসিয়া পড়িতে পারে। তাহা না-চাহিলে বুদ্ধিমানের মতো মৌন অবলম্বন করো।”

তোশামদ করে বললাম, হে মহাদেব! আমাকে শেষ কথা বলতে দেওয়ার নিবেদন মঞ্জুর করুন। দেবতা ক্ষণিকের জন্য নীরবে থেকে বললেন, “ঝটপট বলিয়া ফেলো!” আমি বললাম, “হে মহাদেব, গরুর এমন কিছু নেই, যা কাজে লাগে না। কিন্তু নারীরা বহু অনর্থের হেতু। বিশেষ করে তাদের নিয়ে পুরুষে পুরুষে প্রায়শ লড়াই লাগে। মুশকিল এই যে পীস কীপিং ফোর্স দিয়ে এ ধরনের লড়াই বন্ধ করা যায় না। শাস্ত্রে আপনারা বলেছেন, নারী নরকের দ্বার। পথে নারী বিবর্জিতা। নারীর কাম পুরুষের অষ্ট গুণ। কতো কি! তা ছাড়া, নারীরা মাঝে মধ্যে মশারির ভেতরে থেকে বক্তৃতা করে–ইংরেজিতে একে কার্টেন লেকচার বলে। এই বক্তৃতা শাস্ত্র বিষয়ক সেমিনারের চেয়েও বিরক্তিকর। হে দেব, গরুকে নিয়ে এসব ঝামেলা মোটেই সহ্য করতে হয় না। গরুচাের গরুর প্রতি লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় বটে, কিন্তু গরুকে নিয়ে ডুয়েল লড়ার কোনো কাহিনী শোনা যায় না। অতএব গরুকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলা যায়। কিনা, আপনিই ন্যায় বিচার করে রায় দিন।”

দেবতার প্রসন্নবদন আকস্মিকভাবে কুৎসিত আকার ধারণ করলো। বুঝলাম তিনি খুবই চটে গেছেন। তিনি প্ৰায় ভেঙচি দিয়ে বললেন, “তুমি অতীব বেহায়া। তিল মাত্র চক্ষুলজ্জা নাই। তাই এই রূপ বলিতেছ। নারীদের কী উদ্দেশে আমরা সৃষ্টি করিয়াছিলাম, আর তোমরা কিভাবে তাহাদের ভালোমন্দ উভয় কাজে সারাক্ষণই ব্যবহার করিতেছ! ধিক তোমাদের।”

আমার মুখ দিয়ে অনিচ্ছায় অস্ফুট এবং দুর্বোধ্য একটা শব্দ বেরিয়ে গেলো। দেবতা আরও উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বললেন, “চুপ রও শয়তান!! নারীদের তোমরা চরম অপব্যবহার করিতেছ। তুমি গবেট এবং কুতর্কবাগীশ। তথাপি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।–নারীদের কখনো শ্মশ্রু হইতে দেখিয়াছ? নিষেধ করিতেছি— মুখ খুলিও না। তাঁহাদের কদাপি শ্মশ্রু হয় না। তথাপি ক্ষৌরিকর্মের বিজ্ঞাপনেও তাঁহাদের চিত্ৰই ব্যবহার করো। কৌটোর দুধ সাধারণত গরুর দুধ। কিন্তু তাহার বিজ্ঞাপনেও তোমরা নারীদের টানাটানি করো। নারী না-হইলে তোমাদের অশন,  বসন, শয়ন, স্বপন–কিছুই হয় না। আবোল-তাবোল অর্থহীন কবিতা লিখিতেও নারীকে টানিয়া আনো। কেবল ঐড়ে তর্ক করিবার সময়ে নারীর তুলনায় গরুকে সেরা বলো। তোমরা পুরুষরা মহাভণ্ড এবং জীবজগতের কুলাঙ্গার। মহাদেব অচিরেই নারীদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া নারীবাদী নামক এক দল নারীবেশী পুরুষহন্তা পাঠাইবেন। তাঁহারা তাবৎ নারীবিদ্বেষী পুরুষদের নাশ করিয়া বিশ্বে শান্তি এবং সাম্য ফিরাইয়া আনিবেন। মনে রাখিও, শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর! যদি বিনাশ হইতে বঁচিবার কিছুমাত্র বাসনা থাকে, তাহা হইলে এই দণ্ডে নাকে খত দিয়া নারীদের নিকট অতীতের সমস্ত অবিচার এবং অত্যাচারের জন্য জোড়হস্ত করিয়া আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আশ্বাস দিয়া বলিতে পারি, সেই নারী-বিপ্লবের পর অনন্ত কাল ধরিয়া বিশ্বে অসীম আনন্দের ধারা বহিতে থাকিবে।”

আমার ঘুম ভেঙে গেলো। স্বপ্ন দেখছিলাম বুঝতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাক, নারীবাদী বিপ্লবের কাল অত্যাসন্ন নয়! এখনো কিছুকাল আমরা নির্বিবাদে নারীদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবো! দে গরুর গা ধুয়ে!

(প্ৰথম আলো, ডিসেম্বর ২০০৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *