যন্ত্রটার নাম সিনাপ্সুঘুঁটিয়া। যেকোনো স্বাভাবিক মানুষই এই যন্ত্রের নাম শুনে আঁতকে উঠবে এবং এই নামটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করলে তাদের দু-চারটা দাঁত ভেঙে যাবার অবস্থা হবে। কিন্তু মিয়া গিয়াসউদ্দিনের সে-রকম কিছুই হলো না, সে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে লেখাপড়া করলেও বিজ্ঞান খুব ভালোভাবে বোঝে। ইন্টারনেট থেকে সে কখনোই সুন্দরী নারীদের কেচ্ছাকাহিনী ডাউনলোড করেনি, সুযোগ পেলেই বিজ্ঞানের বিষয়-আশয় ডাউনলোড করে পড়েছে। কোন ক্রমোজমে কয়টা জিন−জিজ্ঞেস করলে সে বলে দিতে পারে; সব মিলিয়ে কয়টা কোয়ার্ক, আজব কোয়ার্ক কতটুকু আজব−সেটাও সে বলে দিতে পারে। তাই সিনাপ্সুঘুঁটিয়া নাম দেখেই সে বুঝে ফেলল এটা মস্তিষ্কেক ব্যবহার করার একটা যন্ত্র, বাইরে থেকে স্টিমুলেশন দিয়ে এই যন্ত্র মানুষের মাথার সিনাপ্সকে ঘুঁটে ফেলতে পারবে, যার অর্থ তাকে বুঝিয়ে দিতে হলো না।
সেদিন বিকেলেই সে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতাটা নিয়ে তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে গেল। গিয়াসের বাবা রাশভারী ধরনের মানুষ, বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না; গিয়াস পারতপক্ষে তার বাবার সামনে পড়তে চায় না। কিন্তু তার বাবা মোটামুটি টাকার কুমির এবং গিয়াসের টাকার দরকার হলে তার বাবার কাছে না গিয়ে উপায় নেই। বাবা তাকে দেখে ভুরু কুচকে বললেন, ‘কী ব্যাপার, গিয়াস?’
‘বাবা, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা বলতে এসেছি।
‘কী কথা, তাড়াতাড়ি বলে ফেল।’
কোনো ভনিতা না করে গিয়াস সরাসরি কাজের কথায় চলে এল; বলল, ‘বাবা, আমি ঠিক করেছি একটা রেস্টুরেন্ট দিব। আমাকে কিছু ক্যাশ টাকা দিতে হবে।’
‘ক্যাশ টাকা দিতে হবে? তোকে?’
‘জি, বাবা। আমি দুই বছর পর তোমাকে সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব।’
বাবা সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘তুই রেস্টুরেন্টের কী বুঝিস যে বলছিস দুই বছরে সব টাকা তুলে ফেলবি?’
‘বোঝার দরকার নেই, বাবা। কারণ আমি ব্যবহার করব সিনাপ্সুঘুঁটিয়া।’
বাবা বিদঘুটে শব্দটা শুনে চমকে উঠলেন; বললেন, ‘সেটা আবার কী জিনিস?’
‘আমাদের মস্তিষ্কেকর সিনাপ্সকে ঘুঁটে দেয়। আমাদের যা কিছু অনুভুতি, সেগুলো সবই আসে মস্তিষ্কক থেকে। তাই অনুভুতিটা সরাসরি মস্তিষ্কেক দিয়ে দেব।’
‘সরাসরি মস্তিষ্কেক দিয়ে দিবি?’
‘জি, বাবা। কেউ যখন খুব ভালো একটা কিছু খায়, তখন তার ভালো লাগার অনুভুতিটা আসলে তো মুখে বা জিবে হয় না, হয় মস্তিষ্কেক! আমি রেস্টুরেন্টে সিনাপ্সুঘুঁটিয়া লাগিয়ে রাখব, সেটা সেট করে রাখব সুস্বাদু মজার অনুভুতিতে। এখানে কাস্টমার যেটাই খাবে, সেটাইকেই মনে করবে সুস্বাদু। হু হু করে ব্যবসা হবে। সারা দেশের মানুষ খেতে আসবে আমার রেস্টুরেন্টে।’
বাবা কিছুক্ষণ শীতল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন; তারপর তাঁর কী মনে হলো কে জানে, ড্রয়ার থেকে চেকবই বের করে খসখস করে বিশাল অঙ্কের একটা চেক লিখে ছেলের দিকে এগিয়ে দিলেন।
প্রথম দিন যখন রেস্টুরেন্টটা খোলা হলো, সেদিন গিয়াস তার বাবাকে একটা টেবিলে নিয়ে বসাল। ওপরে আলো-আঁধারি একটা আলো, টেবিলে সুন্দর ন্যাপকিন, ঝকঝকে থালা, পাতলা কাচের গ্লাসে ঠান্ডা পানি। গিয়াস মেনুটা তার বাবার হাতে দিয়ে বলল, ‘বলো, বাবা, তুমি কী খেতে চাও।’
‘কোনটা ভালো?’
‘সবগুলোই ভালো।’
’ঠিক আছে, পরোটা আর শিক কাবাব, তার সঙ্গে ইলিশ মাছের ভাজা আর একটু পোলাও, সঙ্গে খাবার জন্য লাচ্ছি।’
‘খাওয়ার পর একটু দই-মিষ্টি দেব, বাবা?’
‘দে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই ধুমায়িত খাবার চলে এল। বাবা খুবই তৃপ্তি করে খেলেন। ঢেঁকুর তোলা বড় ধরনের অভদ্রতা জেনেও একটা বড়সড় ঢেঁকুর তুললেন। গিয়াস জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লেগেছে, বাবা?’
বাবা ঢুলুঢুলু চোখে বললেন, ‘আমি আমার জীবনে এর চেয়ে সুস্বাদু খাবার খাইনি। আমার ধারণা, বেহেশত ছাড়া আর কোথাও এত সুস্বাদু খাবার পাওয়া যাবে না। তোর বাবুর্চিকে ডাক, আমি তার হাতে চুমু খেয়ে যাই।’
গিয়াস হা হা করে হেসে বলল, ‘বাবা, এর সবই হচ্ছে সিনাপ্সুঘুঁটিয়ার গুণ। তুমি টের পাওনি তোমার মাথার কাছে একটা সিনাপ্সুঘুঁটিয়া বসানো আছে, আমি সেটা সেট করে দিয়েছি সুস্বাদু স্কেলে। তুমি যেটাই খেয়েছ, সেটাই তোমার মজা লেগেছে।’
‘কিন্তু বাবুর্চি কি রাঁধেনি?’
গিয়াস বলল, ‘আমার বাবুর্চিদের একজনের বয়স এগারো বছর, অন্যজনের সাড়ে বারো। সারা দিন পথেঘাটে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বেড়ায়, রাতে এসে রাঁধে।’
‘বলিস কী!’
‘এরা রান্নার র-ও জানে না, প্লেটে খালি এটা-সেটা তুলে দেয়।’
‘এটা-সেটা?’
‘হ্যাঁ, বাবা। তুমি ভেবেছ তুমি খেয়েছ পরোটা আর শিক কাবাব, পোলাও, ইলিশ মাছ ভাজা, হ্যানো-ত্যানো! আসলে কী খেয়েছ জানো?’
‘কী?’
‘খানিকটা খবরের কাগজ, একটা পুরোনো গামছার টুকরো, মোমবাতি, পোড়া মবিল, শেভিং ক্রিম আর কাপড় ধোয়ার সাবান।’
বাবা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘কী বলছিস তুই!’
‘সত্যি বলছি, বাবা। সিনাস্পুঘুঁটিয়া অফ করে দিলেই তুমি তা বুঝবে। দেখতে চাও?’
বাবা কাঁপা গলায় বললেন, ‘দেখা।’
গিয়াস তার সিনাস্পুঘুঁটিয়া বন্ধ করে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে বাবা হড়হড় করে খবরের কাগজ, গামছার টুকরো, মোমবাতি, পোড়া মবিল, শেভিং ক্রিম আর কাপড় ধোয়ার সাবান বমি করে দিলেন।
গিয়াস যে রকম আশা করেছিল, তার রেস্টুরেন্ট এর চেয়ে অনেক ভালো করে চলল। সে বাবাকে বলেছিল দুই বছর পরেই সে তার বাবাকে টাকাটা সুদে আসলে ফেরত দেবে, কিন্তু সে ছয় মাসের মাথাতেই পুরো টাকা ফিরিয়ে দিল। রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করে গিয়াস তার বাবার মতো টাকার কুমির না হলেও মোটামুটি টাকার গিরগিটি হয়ে গেল। তখন বাসা থেকে সবাই তাকে চাপ দিল বিয়ে করার জন্য। প্রথমে দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করে শেষ পর্যন্ত সে বিয়ে করতে রাজি হলো।
মেয়ের ব্যাপারে গিয়াস খুবই খুঁতখুঁতে। মেয়ের নাক পছন্দ হয় তো চুল পছন্দ হয় না। চুল পছন্দ হয় তো দাঁত পছন্দ হয় না। ডান চোখ পছন্দ হয়তো বাম চোখ পছন্দ হয় না। সবাই যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, তখন হঠাৎ করে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ের খোঁজ পাওয়া গেল। যারা তাকে দেখেছে, তাদের সবাই নাকি ট্যারা হয়ে গেছে। এই মেয়ে খুব সহজে সবার সামনে দেখা দেয় না, তাকে দেখতে হলে মায়ের একটা বুটিকের দোকানে গিয়ে দেখতে হয়।
খোঁজ-খবর নিয়ে গিয়াস বুটিকের দোকানে মেয়েকে দেখতে গেল এবং দেখে তার চোখের পলক পড়ে না। দুধে-আলতায় গায়ের রং, রেশমের মতো চুল, চোখে অতলান্তের গভীরতা, ঠোঁট দুটি ফুলের পাপড়ির মতো, ঠোঁটের ফাঁকে দাঁতগুলো মুক্তার মতোন ঝকমক করছে। গিয়াস মেয়ের দিকে তাকাল, মেয়েটিও তার দিকে তাকিয়ে মোহিনী ভঙ্গিতে একটু হাসল এবং সেই হাসি দেখে গিয়াসের বুকের ভেতরটা নড়েচড়ে গেল। গিয়াস ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি কি আমার হবে?’
মেয়েটি চোখের ভুরুতে বিদ্যুৎ ছুটিয়ে বলল, ‘কেন নয়?’
কাজেই যথাসময়ে ধুমধাম করে বিয়ে হলো। সুন্দরী বউ খুবই লাজুক; লম্বা ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। শেষে বাসররাতে বউয়ের মুখের ঘোমটা তুলে গিয়াস ভয়ে চিৎকার করে ওঠে, তাঁর বউয়ের জায়গায় যে বসে আছে তার চেহারা পুরোপুরি বানরের মতো! গিয়াস তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘তু-তু-তুমি?’
‘হ্যাঁ, আমি।’
‘কিন্তু তোমাকে তো অন্য রকম দেখেছি। অপরূপ সুন্দরী!’
‘আবার হয়ে যাব।’
‘কীভাবে?’
নতুন বউ তরমুজের বিচির মতো কালো দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘কাল সকালেই মায়ের দোকানের সিনাপ্সুঘুঁটিয়াটা বাসায় এনে লাগিয়ে দেব!’
মিয়া গিয়াসউদ্দিন তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘সি-সি-সি…?’ এত দিন যে যন্ত্রটার নাম সে অবলীলায় বলে এসেছে, হঠাৎ করে সেই নামটা তার মুখেই আসতে চাইল না।
পূর্ববর্তী:
« সাহস
« সাহস
Kona Jahan
Dr Muhammed Zafar Iqbal Sir er Onek Likha Porte Chai..
Aro Add korun please.
thanks a lot
Ansery
Zafar sir ki tar lekhai “সিনাপ্সুঘুঁটিয়া” mishiye lekhen, naki onno kono rohossho ache?
Sob.e to valo lage… Dekhi jontrota pele akta cafe dibo…
Ansery
mony
khubei valo laglo zafar sirer golpo pore. aro beshi rohossomoi golpo porte chai
সিনাপ্সুঘুঁটিয়া
এই লিখাটা একটু অন্যরকম! যাদের দুর্দান্ত রাগ, অসহনীয় বদমেজাজ, ঘন্টা খানেকের আগে রাগ পড়েই না, সামনে যা ছিল ছুড়ে ফেলে – ছিড়ে কুটি কুটি করে একাকার, ভাবছেন সামনে থাকলে কোন বিপদে অপদস্থ হতে হয়-এসব মানুষকে নিয়ে যত জ্বালা-যন্ত্রনা!
এমনি সিনাপ্সুঘুঁটিয়া মত কিছু মেডিসিন আছে যাদের নাম দিয়েছি Quantum medicine.পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে এসব মেডিসিন গ্রহনে,আরগ্য হওয়ার পর মনে হবে, মিছেই ছোট-খাটো বিষয়ে চেচমেচি করছিলাম । আসলে জীবনটা অনেক সুন্দর,সবাইকে বুঝতে শিখতে হয়, ভুলতো সবাই করে, এতে উত্তেজিত হতে নেই, বরং বিষয়টা আলোচনা করে একটা সুন্দর সমাধানে আসা যায়- ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর, সিনাপ্সুঘুঁটিয়ার নামটা কি জানতে ইচ্ছে করছে? অসম্ভব কিছু নয়, দূর্লভও নয়! সেটি হলো– হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় প্রতিকার।
Masum
Onek valo laglo.
Rasel Khan
ভাল লেগেছে ।
Rasel Khan
অপালা রায়, বিয়ে করতেও যে এক ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, সেটা হয়ত আলোচ্য মন্তব্যকারী ভুলে গিয়েছেন ।
Rasel Khan
অপালা রায়, বিয়ে করতে হলে যে এক ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন হয় সেটি হয়ত আলোচ্য মন্তব্যকারী ভুলে গিয়েছেন ।