০২. নিরঞ্জনবাবুর ঘরে বসে

নিরঞ্জনবাবুর ঘরে বসে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ভদ্রলোক বললেন ওঁর হাতে কিছুটা সময় আছে, তারপর নাকি ব্যাঙ্কে যেতে হবে, তার আগে পর্যন্ত উনি আমাদের সঙ্গে ঘুরবেন।

হোটেল থেকে বেরিয়ে ডান দিকে কিছু দূর গেলেই রাস্তার লোক আর গাড়ি চলাচলের শব্দের সঙ্গে একটা নতুন শব্দ কানে আসতে থাকে। আরও কিছু দূর গেলেই একটা মোড় ঘুরে সামনে গঙ্গা দেখতে পাওয়া যায়। এখান থেকে রাস্তাটা ঢালু হয়ে সিঁড়ির ধাপ আরম্ভ হয়ে যায়। প্রত্যেক ধাপের মাঝখানে আর দু পাশে লাইন করে ভিখিরি। এক সঙ্গে এত ভিখিরি এর আগে কখনও দেখিনি। এই ভিখিরির আশেপাশেই চরে বেড়াচ্ছে বোকা-পাঁঠার দল। লালমোহনবাবু বললেন, ‘ধন্যি আপনার নাকের স্মরণশক্তি মশাই। এ গন্ধ তো আমি নিজেও পেয়েছি আগের বার—কিন্তু ভুলে গেলাম কী করে?’

দশাশ্বমেধ ঘাটের বর্ণনা দিতে গেলে আমিও হয়তো লালমোহনবাবুর মতো জমজমাট কথাটা ব্যবহার করতাম, কিন্তু ফেলুদার ধমকের পর আর করব না। হোটেলে ফিরে এসে ঘাটের লোককে কী কী কাজ করতে দেখেছি তার একটা নম্বর দেওয়া লিস্ট করতে গিয়ে একশো তেরো অবধি পৌঁছে থেমে গেলাম। সেটা আবার ফেলুদা পড়ে বলল, ‘দিব্যি হয়েছে—কেবল গোটা ত্রিশেক বাদ পড়েছে।’

ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে চাইলে রেলের ব্রিজটা দেখা যায়, আর পুব দিকে নদীর ওপারে দেখা যায় রামনগর—যেখানে রাজা আছে, কেল্লা আছে, আর নদীর ধারে নাকি সন্ন্যাসীদের একটা আস্তানা আছে।

দশাশ্বমেধের পাশেই উত্তরে হল মানমন্দির ঘাট। ঘাটের উপরেই একটা বাড়ির ছাতে প্রায় চারশো বছর আগে রাজা জয়সিংহের তৈরি জ্যোতির্বিদ্যার যন্ত্রপাতি রয়েছে। দিল্লিরটার মতোই এটাও একটা ছোটখাটো যন্তর-মন্তর। ফেলুদা হয়তো সেটা দেখবার মতলবেই মানমন্দির ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল, এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল।

এটা বলা দরকার যে এদিকটায় দশাশ্বমেধের স্নানের হট্টগোল প্রায় পৌঁছোয় না বললেই চলে। আওয়াজের মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসা লাউডস্পিকারে হিন্দি ফিল্মের গান, আর আমাদের থেকে বেশ কয়েক ধাপ নীচে দুজন লোকের কাপড় কাচার শব্দ। আমাদের ডান দিকে একটা বটগাছ, তাতে কতগুলো বাঁদর বাঁদরামো করছে। গাছের উপর দিকের ডালপালা একটা হলদে বাড়ির ছাতের উপর নুয়ে পড়েছে। একটা চিৎকার শুনে আমাদের চারজনেরই দৃষ্টি ছাতটার দিকে চলে গেছে।

একটি ছেলে ছাতের পাঁচিলের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে। তিনতলা বাড়ির ছাত। ছেলেটি যেখানে দাঁড়িয়েছে তার সামনে একটা সরু গলি, আর গলির ওপাশে আরেকটা তিনতলা বাড়ি। সেটার রং লাল। সেটার ছাতেও নিশ্চয়ই একজন কেউ আছে, যদিও তাকে দেখা যাচ্ছে না। তাকেই উদ্দেশ করে প্রথম ছেলেটি চ্যাঁচাচ্ছে।

‘শয়তান সিং!’

হাঁক দেবার মেজাজটা যেন সে একটা ফিল্মের হিরো।

পাশ থেকে নিরঞ্জনবাবু ফিসফিস করে বললেন, ‘ঘোষালদের বাড়ির ছেলে। দুর্দান্ত ডানপিটে।’

আমার তলপেটটা কেমন জানি করছে। ছেলেটি যদি একবার টাল হারায় তো চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট নীচে পাথরে বাঁধানো রাস্তায় পড়বে।

‘আর লুকিয়ে কোনও লাভ নেই। আমি জানি তুমি কোথায় আছ?’—আবার চিৎকার করে উঠল ছেলেটি।

ফেলুদাও টান হয়ে উপরের দিকে চেয়ে ঘটনাটা দেখছে। এবার লালমোহনবাবুর খসখসে চাপা গলা শোনা গেল।

‘শয়তান সিং হচ্ছে অক্রুর নন্দীর লেখা পাঁচখানা বইয়ের ভিলেন মশাই—রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ।’

‘আমি আসছি তোমার কাছে!’—আবার চিৎকার এল—‘তুমি আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হও।’

ছেলেটি হঠাৎ পাঁচিল থেকে নেমে উধাও। ভাবছি এবার কী নাটক দেখব কে জানে, এমন সময় হঠাৎ দেখি একটা বাঁশ হলদে বাড়ির পাঁচিলের উপর দিয়ে বেরিয়ে সামনের লাল বাড়ির ছাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুই বাড়ির মাঝখানে একটা ব্রিজ তৈরি করল। এইবার ফেলুদা মুখ খুলল, যদিও গলার স্বর চাপা।

‘ওনার মতলবটা কী?’

‘শয়তান সিং!’—আবার হুঙ্কার। ‘তুমি দশ গুনতে গুনতে আমি তোমার কাছে এসে পড়ব।’

এবার যেটা ঘটল তাতে আমাদের সকলেরই ঘাম ছুটে গেল।

ছেলেটি পাঁচিল থেকে কার্নিশে নেমে খপ্‌ করে বাঁশটা ধরে শূন্যে ঝুলে পড়ল।

ছেলেটি পাঁচিল থেকে কার্নিশে নেমে খপ্‌ করে বাঁশটা ধরে শূন্যে ঝুলে পড়ল।

‘এক…দুই…তিন…চার…’

উলটো দিকের ছাত থেকে শয়তান সিং গুনতে শুরু করেছে, আর এ ছেলেটি বাঁশ ধরে ঝুলতে ঝুলতে এগোচ্ছে।

‘একটা কিছু করুন মশাই।’ নিরঞ্জনবাবু ধরা গলায় বললেন,—‘আমার কলিক পেনটা আবার—’

ফেলুদার ডান হাতের তর্জনীটা গোখরোর ফোঁস করার মতো এক লাফে ঠোঁটে চলে এল। আমরা সবাই দম বন্ধ করে এই খুদে ছেলের দুঃসাহসিক ব্যাপারটা দেখতে লাগলাম।

‘ছয়…সাত…আট…ন—য়!’

নয় গোনার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি উলটো দিকে পৌঁছে গিয়ে কার্নিশে পা ফেলেই বাঁশেরই উপর ভর করে পাঁচিল টপকে লাল বাড়ির ছাতে নেমে গেল। তারপর শোনা গেল একটা অচেনা গলায় এক বিকট চিৎকার, আর সেই সঙ্গে প্রথম ছেলেটির এক অদ্ভুত হাসি।

লালমোহনবাবু বললেন, ‘মেরেই ফেললে নাকি মশাই?—কোমরে যেন ছোরা গোছের কী একটা ঝুলতে দেখলুম।’

ফেলুদা গলির দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘ভিলেনটি কীরকম জানি না, হিরোটি যে দুর্দান্ত সাহসী তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’

নিরঞ্জনবাবু বললেন, ‘ঘোষাল বাড়িতে রিপোর্ট করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।’

আমরা আরেকটু এগোতেই লাল বাড়িটার দরজার সামনে পৌঁছে গেলাম । ভিতরে অন্ধকার। কাছেই বোধ হয় সিঁড়ি, কারণ ধুপ ধাপ পায়ের শব্দ পাচ্ছি, আর সেই সঙ্গে ছেলেটির কথা এগিয়ে আসছে।

…‘তারপর ঝপাৎ করে পড়বে জলে, আর ভাসতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে একেবারে সমুদ্রে, আর সেখানে একটা হাঙর এসে টপ্‌ করে গিলে ফেলবে। আর সেই হাঙরটা যখন ক্যাপ্টেন স্পার্কের দিকে চার্জ করবে, তখন ক্যাপ্টেন স্পার্ক হারপুন দিয়ে ঘ্যাচাং করে মারবে সেটার পেটে, আর—’

এইটুকু বলে আর বলা হল না, কারণ ঘামে চপ্‌ চপ্‌ ছেলে দুটি দরজা দিয়ে বাইরে এসে পড়েছে, আর প্রথম ছেলেটি আমাদের দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছে। বয়স বছর দশের বেশি নয়, ধপধপে ফরসা রং, চোখ নাক একেবারে রাজপুত্তরের মতো। অন্য ছেলেটির বয়স কিছুটা বেশি। ইনি যে বাঙালি নন সেটা দেখলেই বোঝা যায়। দুজনেরই চোয়াল যেভাবে চলছে তাতে বোঝাই যায় তারা মুখে চুইং গাম পুরে নিয়েছে।

ফেলুদা প্রথম ছেলেটিকে বলল, ‘ও-তো শয়তান সিং আর তুমি কে?’

‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’, চাবুকের মতো উত্তর দিল ছেলেটি।

‘তোমার আরেকটা নাম আছে না? তোমার বাবা তোমাকে কী বলে ডাকেন?’

‘আমার নাম ক্যাপ্টেন স্পার্ক। আমার বাবাকে বিষাক্ত তীর মেরে খুন করেছিল শয়তান সিং আফ্রিকার জঙ্গলে। তখন আমার বয়স সাত। তখন থেকে আমার চোখে প্রতিহিংসার বিদ্যুৎ জ্বলে, তাই আমার নাম স্পার্ক।’

‘সর্বনাশ,’ বললেন লালমোহনবাবু, ‘এ যে অক্রুর নন্দীর বই মুখস্থ করে ফেলেছে মশাই!’

ছেলেটি লালমোহনবাবুর দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে তার বন্ধুকে নিয়ে গম্ভীরভাবে গলি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘বর্ন অ্যাকটর’—মন্তব্য করলেন জটায়ু।

ফেলুদা নিরঞ্জনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘোষাল বাড়িতে কাউকে চেনেন?’

‘চিনব না? অ্যাদ্দিন রয়েছি কাশীতে। ওদের সকলেই চেনে। প্রায় একশো বছর হল বেনারসে বাস। এই যে খোকাকে দেখলেন, এর ঠাকুরদা অম্বিকা ঘোষাল এখানেই থাকেন। ওকালতি করতেন, বছর খানেক হল ছেড়ে দিয়েছেন। খোকার বাপ উমানাথ ঘোষাল কলকাতায় থাকেন, কেমিক্যালের ব্যবসা। প্রত্যেক পুজোয় ফ্যামিলি নিয়ে এখেনে আসেন। এদের বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয়। খানদানি পরিবার মশাই। এদের জমিদারি ছিল ইস্টবেঙ্গলে পদ্মার ধারে।’

‘একবার উমানাথের সঙ্গে দেখা করা যায়?’

‘কেন যাবে না। আপনারা তো আবলুসবাবা দর্শনে যাবেন বলছিলেন, সেখানেও দেখা হয়ে যেতে পারে। শুনচি নাকি ইনিও দীক্ষা নেবেন নেবেন করছেন।’

আবলুসবাবাকে দেখে নিরঞ্জনবাবুর নামকরণের তারিফ না করে পারা যায়। ফেলুদা দেখেছে কি না জানি না, আমি নিজে জীবনে এত মিশকালো লোক দেখিনি। শুধু কালো নয়, এমন মসৃণ কালো যে হঠাৎ দেখলে মনে হয় গায়ে বুঝি সাপের খোলসের মতো একটা কিছু পরে আছেন। তার উপরে কাঁধ অবধি ঢেউ খেলানো চুল, আর বুক অবধি ঢেউ খেলানো দাড়ি—দুটোই কুচকুচে কালো। সাধুবাবা জোয়ান লোক; বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হলে আশ্চর্য হব। অবিশ্যি জোয়ান না হলে আর এত সাঁতার কাটেন কী করে। বাবার চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে তার গায়ের টকটকে লাল সিল্কের চাদর আর লুঙ্গির জন্য।

আমরা চারজন উঠনে ভক্তদের ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়েছি, বাবাজী বারান্দায় শীতল-পাটির উপর বিছানো একটা সাদা চাদরে বসেছেন, তার দু পাশে দুটো আর পিছনে একটা হলদে মখমলের তাকিয়া। বাবার বাঁ পাশে একজন বৃদ্ধ চোখ বুঁজে হাত জোড় করে বসে আছেন, বোঝাই যাচ্ছে ইনি হলেন অভয় চক্রবর্তী। বাবা নিজে পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসে অল্প অল্প দুলছেন, আর ডান হাতের তেলো দিয়ে হাঁটুতে হাত বুলোচ্ছেন। দোলনিটা হচ্ছে তালে তালে, কারণ বারান্দার এক ধারে বসে একজন লোক কাঠের খঞ্জনি বাজিয়ে একটা হিন্দুস্থানি ভজন গাইছে। গানের প্রথম দুটো লাইন মনে ছিল, হোটেলে ফিরে এসে খাতায় লিখে রেখেছিলাম—

ইতনী বিনতি রঘুনন্দন সে

দুখ দ্বন্দ্ব হামারা মিটাও জী—

আজ আর সেই মাছের আঁশের ব্যাপারটা হচ্ছে না। তার বদলে আজ একটা বিশেষ ঘটনা ঘটবার কথা আছে; মছলিবাবা আজ তার ভক্তদের কাছ থেকে জেনে নেবেন আর কদ্দিন পরে তাঁকে কাশী ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেটা যে কী ভাবে জানা হবে তা এখনও কেউ জানে না।

লালমোহনবাবুর দেখছি বেনারসে এসেই ভক্তিভাবটা একটু বেড়ে গেছে। সকালে দশাশ্বমেধ ঘাটে ওঁকে বার তিনকে বেশ গলা উঁচিয়ে ‘জয় বাবা বিশ্বনাথ’ বলতে শুনেছি। এখানে এসে দেখছি বাবাজীকে দেখেই ওঁর হাত দুটো আপনা থেকেই জোড় হয়ে গেছে। এত ভক্তি দেখালে অ্যাডভেঞ্চার গল্পের প্লট মাথায় কী করে আসবে জানি না। বোধ হয় ভাবছেন মছলিবাবা ওঁকে স্বপ্নে প্লট দিয়ে দেবেন।

কালো প্যান্ট আর নীল রঙের গুরু শার্ট পরা একজন ভদ্রলোক সবেমাত্র আমাদের পিছন দিয়ে ঢুকে আমাদেরই পাশে দাঁড়িয়ে বোধহয় ভাবছেন ভিড় ঠেলে কী করে এগোনো যায়। নিরঞ্জনবাবু লোকটির দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘ঘোষাল সাহেব এলেন না?’ ভদ্রলোক গলা নামিয়ে উত্তর দিলেন, ‘আজ্ঞে না, ওনার খুড়তুতো ভাই আর তার স্ত্রী এসে পৌঁছেছেন আজ দুর্গাপুর থেকে, বাড়িতে তাই…’

ভদ্রলোকের রং ফরসার দিকে, জুলপিটা হাল ফ্যাশানের, চোখে চশমা, সব মিলিয়ে মোটামুটি চালাক চতুর চেহারা। ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই’—নিরঞ্জনবাবু ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন—‘ইনি বিকাশ সিংহ—উমানাথবাবুর সেক্রেটারি।’

তারপর আমাদের তিনজনেরও পরিচয় করিয়ে দিলেন নিরঞ্জনবাবু। ফেলুদার নাম শুনেই সিংহি মশাইয়ের ভুরুটা কুঁচকে গেল।

‘প্রদোষ মিত্র? গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র?’

‘হ্যাঁ মশাই’,—নিরঞ্জনবাবু গলা চাপতে ভুলে গেলেন—‘স্বনামধন্য ডিটেকটিভ। আর ইনিও অবিশ্যি কম ইয়ে নন—’

নিরঞ্জনবাবু লালমোহনবাবুর দিকে দেখানো সত্ত্বেও সিংহ মশাইয়ের দৃষ্টি ফেলুদার দিকেই রয়ে গেল। ভদ্রলোক কী যেন বলতে চাইছেন।

‘ইয়ে আপনি এখানে আছেন জানলে…কোথায় উঠেছেন বলুন তো?’

‘আমারই হোটেলে মশাই!’—নিরঞ্জনবাবু এবার খেয়াল করে গলাটা নামিয়ে কথাটা বললেন।

‘ঠিক আছে, মানে…’ বিকাশবাবু এখনও আমতা-আমতা করছেন—‘একবারটি বোধ হয়…ঠিক আছে, কাল না হয় যোগাযোগ করব।’

ভদ্রলোক নমস্কার করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন।

‘এক ব্রহ্ম, এক সূর্য, এক চন্দ্র।’

মছলিবাবা দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠছেন। ভজন থেমে গেল। ভক্তরা সবাই থমকে গিয়ে সোজা হয়ে বসল। এতক্ষণ লক্ষ করিনি, এবার দেখলাম বাবার যেদিকে অভয়বাবু বসেছেন তার উলটোদিকে আরেকটি ভদ্রলোক—বছর চল্লিশেক বয়স—সামনে একটা নকশা করা থলি নিয়ে বসেছেন। থলির পাশে স্তূপ করে কালো কালো কী জানি রাখা রয়েছে।

‘দু হাত দু পা দু চোখ দু কান!’—বাবাজী আবার শুরু করলেন। এ সব বলার কী মানে কিছুই বুঝতে পারছি না; অন্যেরা কেউ বুঝছে কি না তাও বুঝতে পারছি না।

‘তিন কুল তিন কাল চার দিক চার যুগ পঞ্চ ভূত পঞ্চ ইন্দ্রিয় পঞ্চ নদ পঞ্চ পাণ্ডব—এক, দো, তিন, চার, পাঁচ!’

বাবাজী একটু থামলেন। থলিওয়ালা ভদ্রলোক তার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন, ভক্তরাও সব চেয়ে আছে। লালমোহনবাবু আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, “থ্রিলিং।” বাবাজী আবার শুরু করলেন—

‘ছে রিপু ছে ঋতু, সপ্ত সুর সপ্ত সিন্ধু, অষ্ট ধাতু অষ্ট সিদ্ধি, নবরত্ন নবগ্রহ, দশকর্ম দশ মহাবিদ্যা দশাবতার দশাশ্বমেধ—এক থেকে দশ।’

এইটুকু বলে বাবাজী থলিওয়ালা ভদ্রলোকের দিকে ইশারা করলেন। ভদ্রলোক ফিসফিস করে বাবাজীকে কী যেন বলে দিলেন। তারপর ভক্তদের দিকে ফিরে অস্বাভাবিক রকম সরু গলায় বললেন, ‘এবার আপনারা এক থেকে দশের মধ্যে একটি সংখ্যা বেছে নিয়ে একে একে বাবাজীর সামনে এসে এই থলির মধ্যে থেকে একটি কাগজের টুকরো নিয়ে তাতে এই কাঠকয়লার সাহায্যে সংখ্যাটি লিখে আমার হাতে দিয়ে দেবেন।’ প্রথমে বাংলায় বলে আবার সেটা হিন্দি করে বললেন।

ফেলুদা নিরঞ্জনবাবুর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘যে সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি বার পড়বে, সেটাই কি বলে দেবে বাবা কদিন থাকবেন?’

‘হয়তো তাই। সেটা তো বললে না কিছু!’

‘যদি তাই হয় তা হলে বোধহয় বাবাজীর সাতদিনের বেশি মেয়াদ নেই।’

‘আপনি লিখবেন নাকি?’

‘না মশাই। বাবা থাকছেন কি যাচ্ছেন সে নিয়ে তো আমাদের অত মাথাব্যথা নেই। আমরা দেখতে এসেছি, দূর থেকে দেখে চলে যাব—ব্যস্। তবে একটা জিনিস জানার কৌতূহল হচ্ছে। এইসব ভক্তদের মধ্যে কিছু কিছু গণ্যমান্য লোকও আছেন তো, নাকি সবাই সাজানো ভক্ত?’

‘কী বলছেন মশাই!’—নিরঞ্জনবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল। ‘এরা সব বলতে পারেন একেবারে ক্রিম অফ কাশী। ওই দেখুন—সাদা চাদর গায়ে, মাথায় টাক—উনি হলেন শ্রুতিধর মহেশ বাচস্পতি, মহাপণ্ডিত—আজন্ম কাশীতে রয়েছেন। তারপর ওই দেখুন মৃত্যুঞ্জয় সেন কবিরাজ, দয়াশঙ্কর শুক্লা—এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের এজেন্ট। যিনি বাবাজীর পাশে থলি নিয়ে বসে আছেন তিনি হলেন অভয় চক্কোত্তির ভাইপো—আলিগড় ইউনিভার্সিটিতে ইংরিজির প্রোফেসার। উকিল ব্যারিস্টার ডাক্তার প্রোফেসর হালুইকর—কিচ্ছু বাদ নেই মশাই। আর মহিলা কত আছেন সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। আর ওই দেখুন—’

নিরঞ্জনবাবু একজন সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা বেনারসি টুপি পরা জাঁদরেল লোকের দিকে দেখালেন।

‘ওকে চেনেন? উনি হলেন মগনলাল মেঘরাজ। ওঁর মতো পয়সা আর দাপট কাশীতে আর কারুর নেই। বেনারসে যদি বাঘ থাকত তো এখানকার বলদগুলোর সঙ্গে এক ঘাটে জল খেত ওঁর নামে।’

‘মগনলাল মেঘরাজ?…নামটা চেনাচেনা মনে হচ্ছে।’

নিরঞ্জনবাবু ফেলুদার দিকে আরও খানিকটা ঝুঁকে পড়লেন—আর সেই সঙ্গে আমিও।

‘দুবার পুলিশ রেড হয়ে গেছে ওর বাড়িতে। একবার কলকাতায়—ওর বড়বাজারের গদিতে—একবার এখেনে। চোরা কারবার, কালো টাকা—যা ভাবতে চান ভাবুন না।’

‘পুলিশ তো পায়নি কিছু—তাই না?’

‘পুলিশ তো সব ওর হাতের মুঠোয় মশাই। রেড তো নামকাওয়াস্তে।’

ভক্তের দল এখনও একজন একজন করে গিয়ে কাগজে নম্বর দিয়ে আসছে। দেখে মনে হয় বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। আমরা আরও মিনিট পাঁচেক দেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম। গেটের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতে পিছন থেকে একটা ডাক শুনে ঘুরে দেখি যার সঙ্গে নিরঞ্জনবাবু আমাদের আলাপ করিয়ে দিলেন, সেই মিস্টার সিংহ ব্যস্তভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন।

‘আপনারা চললেন?’—ভদ্রলোক বিশেষ করে ফেলুদার দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলেন। উত্তরে ফেলুদা কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক বললেন, ‘ইয়ে, আপনাদের এখনই একবারটি আমাদের বাড়ি আসা সম্ভব হবে কি? মিস্টার ঘোষাল আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে খুশি হতেন।’

ফেলুদা হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, ‘আমাদের আর কী অসুবিধা বলুন। নিরঞ্জনবাবুকে অবিশ্যি হয়তো হোটেলে ফিরে যেতে হবে।’

‘আপনারা তিনজনে ঘুরে আসুন’, নিরঞ্জনবাবু বললেন, ‘তবে বেশি রাত না করলে খাবারটা গরম গরম খেতে পারবেন—এইটে শুধু বলে রাখলাম। আজ আপনাদের জন্য ফাউল কারি করতে বলিচি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *