ইতিহাসের মুক্তি

ইতিহাসের মুক্তি

মানুষ মানুষের কথা শুনতে ভালবাসে— প্রাচীন মানুষের কাহিনি, সমকালীন মানুষের সংবাদ। আধুনিক সভ্য জগতে এই দ্বিতীয় চাহিদার জোগান দেয় খবরের কাগজ। প্রথম আকাঙ্ক্ষাটি পূরণের জন্য অনেক পূর্ব থেকেই মানুষ রচনা করছে। ইতিহাস। কোনও ঐতিহাসিক নিশ্চয়ই স্বীকার করতে রাজি হবেন না যে তাদের ইতিহাস-রচনা খবরের কাগজ প্রকাশের সমধর্মী। ইতিহাস গড়ার মালমশলা, প্রত্নতাত্ত্বিক ও সম্ভব অসম্ভব নানা মূল থেকে বহু বিচিত্র উপাদান সংগ্ৰহ কি খবরের কাগজের জন্য ঋজু পথে ও কুটিল কৌশলে সাংবাদিকের সংবাদ-সংগ্রহের সমতুল্য? সংগৃহীত সংবাদের সত্যাসত্য ও লঘুগুরু যাচাই করে সম্পাদকীয় সন্দর্ভ যে তথ্য ও তত্ত্ব প্রকাশ করে, সংগৃহীত উপকরণের তীক্ষ বিশ্লেষণে ও নির্মম বিচারে খাঁটি সত্য নির্ণয় করে ঐতিহাসিক সে ব্যাপারের যে বিবরণ দেন ও তার মৰ্মগত ঐতিহাসিক তত্ত্বের বিচার করেন, সে কি ওই খবরের কাগজের সম্পাদকীয় সন্দর্ভের সমগোত্রীয়? নিজ কর্মের গুরুত্বে অবহিত কোনও আত্মসম্মানী ঐতিহাসিক এমন কথা ভাবতে পারেন যে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কাছে তিনি অতীত ঘটনার সাংবাদিক! যদিচ মনে পড়ছে, ইংরেজ লেখক ওয়ার্ড ফাউলার তার রোমের চটি ইতিহাসে, প্রাচীন রোমান সেনেটের যে বিবরণ পণ্ডিতেরা অনেক নিরীক্ষা-পরীক্ষায় সংগ্রহ করেছেন, তার কিছু পরিচয় দিয়ে বলেছেন যে, এসব পাণ্ডিত্য বিস্মৃতির অতলে ডোবাতে তিনি রাজি আছেন যদি ওই রোমান সেনেটের একদিনকার অধিবেশনে তিনি উপস্থিত থাকতে পারতেন, অর্থাৎ যদি একদিনের অধিবেশনের রিপোর্টার হতে পারতেন।

খবরের কাগজের সঙ্গে ইতিহাসের নাম একসঙ্গে উচ্চারণে ঐতিহাসিকের বিরক্তির কারণ তার চেষ্টা ও সৃষ্টিকে খেলো করে দেখাতে। যে বিচারবুদ্ধি ও মননশক্তি, সত্যসন্ধিৎসা ও বস্তুনিষ্ঠ কল্পনা ইতিহাস-রচনায় প্রয়োজন তার তুলনা বিজ্ঞানীর বিজ্ঞানকর্মের সঙ্গে। সেখানে খবরের কাগজের রিপোর্টার ও সম্পাদকীয় স্তম্ভের পেশাদার লেখকদের কথা তোলা বিকৃতরুচি রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকের উচ্চাঙ্গ মানসিক চেষ্টাকে খাটো করে দেখাই ইতিহাসকে হেয় করার মুখ্য কথা নয়। বড় কথা ইতিহাসের লক্ষ্যকেই ছোট করে ফেলা। মনের নানা খেয়ালখুশির চরিতার্থতায় মানুষ অনেক রকম সৃষ্টি কবেছে। রাজারাজড়া এবং বীরপুরুষেরা প্রাচীন বীরত্বের কাহিনি শুনতে চেয়েছে। চারণেরা কিংবদন্তি ও কল্পনায় মিশিয়ে গাথা রচনা করে রাজসভা ও বীরসভায় গান করেছে। মানুষ সাধারণ ও অসাধারণ মানুষকে নিয়ে হাসি-কান্না উপহাস-পরিহাসের কথায় মশগুল হয়। তাই কথাসরিৎসাগরের মতো বই দেশে দেশে লেখকেরা লেখে। মানুষ গল্প শুনতে ভালবাসে। পড়তে-লিখতে-জানা আধুনিক পৃথিবী গল্প-উপন্যাসে ছেয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাস এসব মনোরঞ্জকদের দলে নয়। তার লক্ষ উঁচু। অতীতের কাহিনি সে বলে বটে।–সমস্ত রকম মিথ্যা রাগ-বিরাগ-কল্পনার খাদমুক্ত অতীতের খাঁটি সত্য। কিন্তু সত্য গল্প বলাই ইতিহাসের কাজ নয়, যদিও গল্প সত্য হলে লোকের তাতে বেশি অনুরাগ। লোকে ভূতের গল্পেও সত্য-ভূতের গল্প শুনতে চায়; কারণ গল্প বলাটা ইতিহাসের উপলক্ষ না হোক, উপায় মাত্র। (ইতিহাসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, অতীতের আলোতে বর্তমানের পথ দেখানো, সমাজ ও গোষ্ঠীর চলাচলের পথ ও বিপথ দেখিয়ে মানুষকে সাবধান করা) তত্ত্বদশী জ্ঞানীরা যেসব উপদেশ করেছেন তাদের উপদেশের বাস্তব রূপ দেখা যায় ইতিহাসে। (সমাজ ও সভ্যতার অভু্যদয় ও পতনের বন্ধুর পথে মানুষের যাত্রা ও যাত্রাশেষের দিগদর্শন হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাস কাহিনিকার নয়, ইতিহাস উপদেষ্টা। মানুষের চরিত্রের নিগূঢ় তত্ত্বদশীদের নীতিসূত্রের ভাষ্য হচ্ছে ইতিহাস।)

ইতিহাসের এই উপদেষ্টার পদগৌরব অনেককাল থেকে স্বীকৃত হয়ে আসছে। দশরূপকের লেখক ধনঞ্জয়, যেসব লোক আনন্দনিস্যন্দী নাট্যের ফলও বলেন ইতিহাসের মতো সাংসারিক জ্ঞানের বুৎপত্তি, সেইসব অল্পবুদ্ধি অরসিক সাধুলোকদের নমস্কার করেছেন।

আনন্দনিস্যন্দিষু রূপকেষু
বুৎপত্তিমাত্রং ফলমল্পবুদ্ধিঃ।
যোহপীতিহাসদিবদাহ সাধুঃ
তস্মৈ নমঃ স্বাদপরাঙামুখায়।।

ধনঞ্জয়ের মতে নাট্যের স্থান ইতিহাসের উপরে কি না সে কথা অবাস্তর। (কিন্তু ইতিহাসের কাজ যে আনন্দ দেওয়া নয়, উপদেশ দেওয়া, তার এ অভিমত সুস্পষ্ট।)

ধনঞ্জয় আধুনিক লেখক। মাত্র হাজার বছর পূর্বেকার লোক। কিন্তু ধনঞ্জয়ের সময়ের অনেক পূর্ব থেকেই আমাদের দেশের নানা পুথিতে ইতিহাস নামে বিদ্যার উল্লেখ আছে।

যজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে দ্বিজাতির পাঠ্যের তালিকায় একটি পাঠ্যবিষয় হচ্ছে ইতিহাস।

বাকোবাক্যং পুরাণং চ নারাশংসীশচ গাথিকাঃ।
ইতিহাসাংস্তথা বিদ্যাঃ শক্ত্যাধীতে হি যোহন্বহম। (আচার, ৪৫)

বেদাথৰ্বপুরাণানি সেতিহাসানি শক্তিতঃ।
জপযজ্ঞার্থসিদ্ধ্যর্থং বিদ্যাং চাহধ্যাত্মিকীং জপেৎ।। (আচার, ১০১)

যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি খুব কম করেও ধনঞ্জয়ের পাঁচশো বছর পূর্বের।

মনুস্মৃতিতে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধের সময় যেসব শাস্ত্র পড়ে শোনাবার বিধি আছে তার মধ্যে ইতিহাস একটি।

স্বাধ্যায়ং শ্রাবয়েৎ পিত্র্যে ধর্মশাস্ত্ৰাণি চৈব হি।
আখ্যানোনীতিহাসিাংশ্চ পুরাণানি খিলানি চ।৷ ৩।২৩২

মনুস্মৃতির যে পুথি আমরা পেয়েছি, খ্রিস্টীয় অষ্টম কি নবম শতকে মেধাতিথি যার ভাষ্য লিখেছিলেন, তার রচনা বা গ্রন্থন-কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মতভেদ আছে। কিন্তু কোনওমতেই সে রচনাকাল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের পরে নয়। তার চেয়ে দু-তিনশো বছর পূর্বে হওয়াই খুব সম্ভব।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰে সামবেদ ঋগবেদ ও যজুৰ্বেদ এই ত্রয়ীর বাইরে ইতিহাসকেও অথর্ববেদের সঙ্গে বেদ বলা হয়েছে।

সামর্গ্যজুৰ্বেদাস্ত্ৰয়ন্ত্রয়ী।
অথর্ববেদেতিহাসবেদেী চ বেদাঃ ॥ (প্রথম প্রকরণ, তৃতীয় অধ্যায়)

ইতিহাসকে বেদ বলতে বোঝা যায় যে, নানা বিদ্যাকে লক্ষ করে ব্যাপক অর্থে শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। ওর অর্থ কী তা রাজার নানাবিদ্যাচর্চার প্রসঙ্গে কৌটিল্য নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন। রাজা দিনের পূর্বভাগে যুদ্ধের নানা অঙ্গের বিদ্যা শিখবেন।

পশ্চিমমিতিহাসশ্রবণে। পুরাণমিতিবৃত্তমাখ্যা-
য়িকেদাহরণং ধর্মশাস্ত্রমর্থশাস্ত্ৰং চেতীতিহাসঃ ॥ (দ্বিতীয় প্রকরণ, পঞ্চম অধ্যায়)

দিনের শেষভাগে ইতিহাস-শ্রবণে শিক্ষালাভ করবেন। পুরাণ, ইতিবৃত্ত, আখ্যায়িকা, উদাহরণ, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র–এদের বলে ইতিহাস। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল পণ্ডিতদের বিরাট তর্কস্থল। কিন্তু অপণ্ডিত লোকও যদি প্রচলিত মনুস্মৃতির সঙ্গে এ অর্থশাস্ত্র পড়েন তবে প্রতীতি হতে দেরি হয় না যে, কৌটিল্যের বহু অংশ মনুস্মৃতির চেয়ে প্রাচীনতর। সুতরাং যে পণ্ডিতেরা অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল বলেন খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক তাদের মত অগ্রাহ্য করবার কোনও সংগত কারণ নেই।

গৌতমধর্মসূত্রে, যে-সকল বহুশ্রুত ব্ৰাহ্মণ রাজার সঙ্গে সমাজ বা রাষ্ট্রের স্থিতি রক্ষা করেন

দ্বৌ লোকে ধৃতব্ৰতৌ রাজা ব্ৰাহ্মণশ্চ বহুশ্রুতঃ।। ৮১
স এষ বহুশ্রুতো ভবতি।
লোকবেদবেদাঙ্গবিৎ।
বাকোবাক্যেতিহাসপুরাণকুশলঃ ॥ ৮॥৪-৬

বাকোবাক্য নামে বিদ্যাটির উল্লেখ যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির বচনেও আছে–টীকাকাররা ব্যাখ্যায় বলেছেন প্রশ্নোত্তর-রূপ বিদ্যা, সম্ভব তৰ্কশাস্ত্র, গ্রিসে Socratic dialogue-এ যার আরম্ভ।

যে-সকল প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রের পুথি টিকে আছে বা এ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে, গৌতমধৰ্মসূত্র তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। এর যেসব প্রসঙ্গ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে এক তাদের মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে, গৌতমধর্মসূত্রের ব্যবস্থা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের চেয়ে প্রাচীনতর কালের ব্যবস্থা। পণ্ডিতপ্ৰবর কানে তার ‘ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন যে, গৌতমধর্মসূত্রের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ছয়শো থেকে চারশে শতকের পরে নয়। এ মত গ্রহণযোগ্য।

অর্থাৎ অন্তত আড়াই হাজার বছর পূর্বে থেকেই আমাদের দেশে ইতিহাস নামে বিদ্যার সৃষ্টি হয়েছিল ও চর্চা চলেছিল। এ বিদ্যার স্বরূপ কী ছিল?

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ইতিহাসের মধ্যে ধর্মশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্রের গণনা স্পষ্টই পারিভাষিক ব্যাপার। ওর মূল অপারিভাষিক অর্থ, অন্য যেসব বিদ্যার নাম করা হয়েছে তাদের সমষ্টিপুরাতনকালের বৃত্তান্ত, আখ্যায়িকা ও তাদের মধ্যে যে উপদেশ নিহিত আছে, যেসব ঘটনার উদাহরণ তাদের দৃঢ় করে। এরকম উদাহরণের বেশ একটু চমকপ্ৰদ নমুনা কৌটিল্য থেকে উদ্ধার করা যেতে পারে।

কৌটিল্য রাজাকে বাইরের ও ঘরের নানা শত্রু থেকে আত্মরক্ষায় সাবধানতার উপদেশ করেছেন। তার মধ্যে একটি উপদেশ এই: অন্তঃপুরে মহিষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে রাজা পূর্বে পরিচারিকাকে দিয়ে অনুসন্ধান নেবেন যে বিপদের কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা এবং এমন পরিচারিকাকে সঙ্গে না নিয়ে একাকী যাবেন না, কারণ

দেবীগৃহে লীনো হি ভ্ৰাতা ভদ্রসেনং জঘন।।
মাতুঃশয্যান্তর্গতশ্চ পুত্ৰঃ কারূশম।
লাজান্মধুনেতি বিষেণ পর্যস্য দেবী কাশিরাজম।
বিষদিগ্ধোন নূপুরেণ বৈরন্ত্যং মেখলামণিনাং সৌবীরং।
জালুথমাদর্শেন বেণ্যাগঢ়ং শস্ত্ৰং কৃত্বা দেবী
বিদূরথং জঘন।। ১॥১৭

পট্টমহিষীর ঘরে লুকিয়ে থেকে রাজা ভদ্রসেনকে তার ভাই হত্যা করেছিল। মা’র শয্যার তলে প্রচ্ছন্ন থেকে কারূশ-রাজাকে তার ছেলে হত্যা করেছিল। মধুর ছলে খই-এ বিষ মেখে কাশিরাজের মহিষী তাকে হত্যা করেছিল। বিষদিগ্ধ নুপুরের আঘাতে বৈরন্ত্য-রাজাকে, হত্যা করেছিল। বেণীতে অস্ত্ৰ লুকিয়ে রেখে বিদূরথ-রাজার মহিষী বিদূরথকে হত্যা করেছিল।

সন্দেহ নেই যে, কৌটিল্য প্রকৃত ঐতিহাসিক বৃত্তান্তবোধেই উদাহরণগুলির উল্লেখ করেছেন, কল্পিত আখ্যায়িকার নয়। সে ইতিহাসের মূলে তথ্যের সঙ্গে কিংবদন্তির যতই মিশ্রণ থাক। অজ্ঞাতি-অতীরের ভদ্রসেন-বিদূরথের হত্যা থেকে হাল-আমলের ‘লিকুইডেশন’ পর্যন্ত ক্ষমতালোভী মানুষের ছল ও নিষ্ঠুরতার পরিবর্তন হয়নি।

8

মনুস্মৃতির যে শ্লোকে ‘ইতিহাসাংশ্চ’ বলে বহুবচনে ইতিহাসের উল্লেখ আছে তার ভাষ্যে মেধাতিথি লিখেছেন, ‘ইতিহাস মহাভারতাদয়ঃ’। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির ইতিহাসিাংস্তথা’র ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানেশ্বর মিতাক্ষরায় ওই এক কথাই বলেছেন, ‘ইতিহাসান্মহাভারতাব্দীন। মেধাতিথি ও বিজ্ঞানেশ্বর মনুর তুলনায় অনেক আধুনিক। মেধাতিথি খ্রিস্টীয় অষ্টম কি নবম শতকের, বিজ্ঞানেশ্বর দশম কি একাদশ শতকের লোক। কিন্তু ইতিহাস যে মহাভারতের মতো গ্ৰন্থ এ ঐতিহ্য প্রাচীন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অথর্ববেদের সঙ্গে ইতিহাসকে বেদ বলা ও মহাভারত যে পঞ্চম বেদ এই প্রচলিত ধারণা, সম্ভব তার প্রমাণ। মনুস্মৃতির কোথাও নাম করে মহাভারতের উল্লেখ নেই। অনেকে মনে করেন যে, মনুস্মৃতির বর্তমান আকারে রচনার সময় বর্তমান আকারের মহাভারতের রচনা হয়নি। কিন্তু মহাভারতের মূল কাহিনী অবশ্য অনেক প্রাচীন; এবং সে কাহিনি নিয়ে অনেক রচনা, অনেক গাথিকার নিশ্চয় সৃষ্টি হয়েছিল। মহাভারতের আদিপর্বের প্রথম অধ্যায়েই সে স্বীকৃতি রয়েছে। সৌতি বলছেন, অদ্ভুতকর্ম ব্যাসের যে রচনা তিনি শোনাতে যাচ্ছেন–

আচখুঃ কবয়ঃ কোচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পারে।
আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাসমিমং ভুবি।। (আদি, ১।২৬)

সে ইতিহাস কোনও কোনও কবি পূর্বে আংশিক বলেছেন, অপর কবিরা বর্তমানে বলছেন এবং অন্য কবিরা ভবিষ্যতে বলবেন। এবং সে ইতিহাসের সঙ্গে যে অনেক কল্পিত উপাখ্যানের মিশ্রণ ঘটেছে, সে কথা মহাভারতে স্পষ্ট করেই বলা আছে। উপাখ্যান নিয়ে মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা এক লক্ষ। কিন্তু উপাখ্যান বাদ দিয়ে যে চব্বিশ হাজার শ্লোকে বেদব্যাস ভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন পণ্ডিতেরা তাকেই বলেন প্রকৃত মহাভারত।

ইদং শতসহস্ৰস্তু শ্লোকানাং পুণ্যকৰ্মণাম।
উপাখ্যানৈঃ সহ জ্ঞেয়ং শ্রাব্যং ভারতমুত্তমম।
চতুৰ্বিংশতিসাহস্ৰীং চক্ৰে ভারতসংহিতাম।
উপাখ্যানৈর্বিনা তা বঙারতং প্রোচ্যতে বুধৈঃ ॥ (আদি, ১।৬৩-৬৪)

অনুমান করা কঠিন নয় যে, লক্ষকে কেটে নয়, চব্বিশ হাজারকে বাড়িয়েই লক্ষ করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত রচনাটিই মূল ভারতেতিহাস। সে কাহিনি যে ঐতিহাসিক, প্রাচীনকালে সত্য সত্যই ঘটেছিল, প্রাচীনদের এ বিশ্বাস দৃঢ়। আখ্যায়িকা ও পুরাণ থেকে তাঁরা মহাভারতের কাহিনিকে ভিন্ন করে দেখেছেন। পুরাণের কথায় মেধাতিথি বলেছেন, ‘পুরাণানি ব্যাসাদিপ্রণীতানি সৃষ্ট্যাদিবর্ণনরূপাণি’, অর্থাৎ যার বেশির ভাগ কল্পনা। আমাদের দেশের প্রাচীনেরা মহাভারতের কাহিনিকে ঐতিহাসিক মনে করেছেন, যেমন থুকিডিডের হোমার-বর্ণিত ট্রোজান-যুদ্ধকে ঐতিহাসিক মনে করেছেন। তবে মহাভারতের কাহিনিও যে উপদেশাত্মক, শাস্ত্রকারেরা সে কথা বলতে ভোলেননি। মনুস্মৃতির সপ্তম অধ্যায়ে বিনয়ের সুফল ও অবিনয়ের কুফল বর্ণনা আছে। জ্ঞানবৃদ্ধদের উপদেশে চলার নাম বিনয়, তাকে অগ্রাহ্য করা অবিনয়। অবিনয়ের ফলে রাজারা সপরিগ্রহ বিনষ্ট হয়, আর বিনয়ের গুণে কৌশহীন বনবাসীও রাজ্যলাভ করে। উদাহরণ,

বেণো বিনষ্ট্যোহবিনয়ান্নাহুষশ্চৈব পার্থিবঃ।
সুদাস-যাবনিশ্চৈব সুমুখো নিমিরেব চ।
পৃথুস্ত বিনয়াদ্রাজ্যং প্রাপ্তবান মনুরেব চ। আদি, ৭।৷ ৪১-৪২

মেধাতিথি খুব সংক্ষেপে ভাষ্য করেছেন, ‘এতানি মহাভারতাদাখ্যাননি জ্ঞেয়ানি’। এবং মহাভারতেই তার উপদেশের শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা আছে। ‘এতে চার বেদেরই কথা আছে, এ কাহিনি পবিত্র ও পাপভয়হারী’।

বেদৈশ্চতুভিঃ সংযুক্তং ব্যাসস্যাস্তুতকৰ্মণঃ।
সংহিতাং শ্রোতুমিচ্ছামঃ পুণ্যাং পাপভয়াপহাম।। আদি, ১। ২১

নৈমিষারণ্যের ঋষিরা সৌতির কাছে সোপাখ্যান লক্ষশ্লোকের ‘শ্রাব্যং ভারতমুত্তমম’ শুনতে চেয়েছিলেন।।

মহাভারতের কাহিনি থেকে নানা উপদেশ-সংগ্ৰহ কিছুই কঠিন নয়। মানুষের অনেক কর্মচেষ্টা ও তার পরিণতি থেকেও কঠিন নয়। কিন্তু মহাভারতের দীর্ঘ ও বিচিত্র ইতিহাসের রচনা হয়েছিল গুটিকয়েক উপদেশের উদাহরণ-স্বরূপে–ওই উপদেশই লক্ষ্য, কাহিনির বর্ণনাটা উপলক্ষ–এমন কল্পনা সুস্থ মনের কল্পনা নয়। কোনও তত্ত্বের মায়ায় বুদ্ধির বিভ্রান্তি না ঘটলে সৰ্পে এমন রজ্জ্বভ্রম হয় না। নৈমিষাবণ্যবাসী তপস্বীরা মহাভারত-কথা শোনার জন্য সৌতিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ সে কথা বিচিত্র—‘চিত্ৰাঃ কথাঃ’।

তমাশ্রমমনুপ্রাপ্তং নৈমিষ্যারণ্যবাসিনঃ।
চিত্ৰাঃ শ্রোতুং কথাস্তত্র পবিবাবুস্তপস্বিনঃ ॥ আদি, ১।৩

যে কাহিনি বিচিত্র, গতানুগতিক সাধারণ ঘটনা নয়, তা মানুষের মনে গভীর দাগ কাটে। মানুষ সে কাহিনি ভুলতে চায় না। তাকে রচনায় নিবদ্ধ করে স্থায়ী করে রাখতে চায়। উপদেশের চিরকালীন ভাণ্ডবোধে নয়, অসাধারণ বিচিত্ৰকে স্থায়িত্ব দেবার মনের স্বাভাবিক প্রবণতায়। ‘প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং’। কিন্তু সমাজের হিতে যাঁরা অনন্যচিত্ত তাঁরা একে উপদেশের পুণ্যজলে শোধন করে মানুষের কাজে লাগাতে চান। ঐতিহাসিক কাহিনি যে কাহিনিমাত্র নয়, সংসারের যাত্রাপথে অঙ্গুলিসংকেত, সে শিক্ষা তাঁরা ইতিহাসের কাহিনি থেকে নিষ্কাশিত্ব করেন— সহজে বা কষ্ট। সমাজহিতৈষীদের প্রবৃত্তি-রেষা’। ঐতিহাসিক বলেন, ‘তথাস্তু। ভেবেছিলাম অতীত নিয়ে খেলা করছি, কিন্তু দেখি সমাজের হিত করছি। মনে করেছিলাম, প্রাচীন কাহিনি-তৃষ্ণার জল এনেছি, কিন্তু দেখছি যা এনেছি তা উপদেশের অমৃত। ধন্যোহহং।’

বর্তমানে আমরা যাকে বলি যথার্থ ইতিহাস’ (real history), হোমারের ট্রয়-যুদ্ধের কি বেদব্যাসের ভারতযুদ্ধের ইতিহাসের মতো ইতিহাস নয়, তার লেখকেরাও অনেকে বলেছেন যে, তাঁরা ইতিহাস লিখেছেন কেবল অতীতের কাহিনিকে বর্ণনার জন্য নয়, যাতে অতীতের কাহিনির আলোতে বর্তমানের ও ভবিষ্যতের পথ-বিপথ চেনা যায়। সেই উদ্দেশ্যে। থুকিডডেস পেলপনেসিয়ান যুদ্ধের ইতিহাস লিখেছিলেন, যাতে সেই অতীত ঘটনা থেকে এর পর অনুরূপ ঘটনার ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা যায়। পলিবিয়াস রোম-কার্থেজ যুদ্ধের ইতিহাসে ঘটনার কার্যকরণ-সম্বন্ধের অনুসন্ধান করেছেন, যাতে ভবিষ্যতের সদৃশ ঘটনায় এ সম্বন্ধের প্রয়োগ করা যায়। ইউরোপের কেবল গ্রিক কি গ্রিকো-রোমান যুগে নয়, তখন থেকে আজ পর্যন্ত বহু ঐতিহাসিক ইতিহাসের এই রূপই কল্পনা করেছেন। ইতিহাস লোকশিক্ষক–ন্যায়াপথের শিক্ষা দেয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জ্ঞানের সে পরামর্শদাতা। এই কল্পনাকে মৃদু উপহাস করে র‍্যাঙ্কে তাঁর বিশ্ব-ইতিহাসের গোড়ায় বলেছেন, ‘ইতিহাসের উপরে যে কর্তব্য ন্যস্ত করা হয়, অতীতকে যাচাই করে বর্তমানকে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া, সে গুরুভার-বহনে তিনি অক্ষম। তিনি কেবল এইটুকু মাত্র দেখাতে চেষ্টা করতে পারেন যে, যা ঘটেছে তা ঠিক কেমন করে ঘটেছে।’

শাস্ত্ৰকৃৎ কি দার্শনিকেরা যে কারণে ইতিহাসকে মর্যাদা দিয়েছেন এবং ঐতিহাসিককে উপদেষ্টার আসনে বসিয়েছেন সে সম্মান বহু ঐতিহাসিক লিওপোলডু র্যাঙ্কের মতো প্রত্যাখ্যান করেননি। সে মৰ্যাদা ও সম্মান শিরোধাৰ্য করেছেন এবং নিজেদের কাজ সম্বন্ধে সেই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। কিন্তু যদি বাইরের দেওয়া পদবির মোহ থেকে মুক্ত হয়ে ঐতিহাসিকেরা তাদের নিজের কাজ পরীক্ষা করে দেখেন ‘কিমিদং’ তবে ইতিহাসের স্বরূপ ও লক্ষ্যের যথার্থ জ্ঞান, বৌদ্ধেরা যাকে বলেন, ‘সম্যক জ্ঞান’, তা লাভ হয়।

থুকিডডেস তাঁর ইতিহাসের গ্রন্থ এই বলে আরম্ভ করেছেন :

‘এথেন্সবাসী থুকিডডেস পেলপনেসিয়ান ও এথেনিয়ানদের মধ্যে যুদ্ধের ইতিহাস সংকলন করেছেন। যুদ্ধের সূচনাতেই তিনি লিখতে আরম্ভ করেন এই ধারণায় যে, পূর্বে পূর্বে যা সব ঘটেছে। এ যুদ্ধের গুরুত্ব তাদের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি দেখলেন, সমস্ত গ্রিস দেশ এই যুদ্ধে এক পক্ষে নয় অন্য পক্ষে যোগ দিয়েছে বা দেবার জন্য প্ৰস্তুত হয়েছে, এবং অনেক অ-গ্রিকেরাও যোগ দিচ্ছে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, পৃথিবীর অধিকাংশ লোক এই যুদ্ধের ব্যাপারে লিপ্ত হবে। অতীতের, বিশেষ দূর-অতীতের, কথা কালের ব্যবধানে সম্পূর্ণ জানা যায় না। কিন্তু অনুসন্ধান ও গবেষণায় যতদূর জানতে পেরেছেন তাতে মনে হয় না যে অতীতের কোনও যুদ্ধ বা ঘটনার এই যুদ্ধের মতো গুরুত্ব ছিল।’

পরবর্তী আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে থুকিডডেসের পেলপিনেসিয়ান-যুদ্ধের গুরুত্ব ও ব্যাপকত্বের ধারণা অতিমাত্রায় মাত্রাজ্ঞানহীন মনে হওয়া স্বাভাবিক। যেমন এইচ. জি. ওয়েলস বলেছেন যে, শেষ পর্যন্ত ও যুদ্ধটা ছিল একটা মাঝারি রকমের ঝগড়া; ওর স্মৃতি একটু বেশি টিকে আছে এইজন্য যে, থুকিডডেস তার ইতিহাস রচনা করেছিলেন। থুকিডডেসের ধারণায় বিজ্ঞতার হাসি হাসার পূর্বে মনে করা ভাল যে, যেসব ঘটনা ও ব্যাপারের গুরুত্বে ও ব্যাপকত্বে আকৃষ্ট হয়ে বর্তমানের ঐতিহাসিকেবা ইতিহাস লিখছেন, আড়াই হাজার বছর পরে সেসব ঘটনা ও ব্যাপারে তাদের ধারণা লোকে কী চোখে দেখবে–অবশ্য যদি ততদিন তার স্মৃতি বেঁচে থাকে।

থুকিডডেস তাঁর গ্রন্থোৎপত্তির যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে দেখা যায় যে, উপদেশ দেবার মহৎ কর্তব্য পালনের জন্য তিনি রচনায় প্রবৃত্ত হননি। এ রচনায় তার প্রবৃত্তি এসেছিল, কারণ এ যুদ্ধের কাহিনি তার মনে হয়েছিল ‘চিত্ৰাঃ কথাঃ’; এবং অতীতের সমস্ত ঘটনার তুলনায় ‘বিচিত্ৰাঃ কথাঃ’।

এর পর খুঁকিডিডেস তার ইতিহাসের উপাদান-সংগ্রহ ও রচনারীতির কথা বলেছেন :

‘এই যুদ্ধে যেসব ঘটনা ঘটেছিল কেবল লোকের মুখে গল্প শুনে কি অনুমানে নির্ভর করে তাদের বর্ণনা করিনি। যে ঘটনা আমি নিজে প্ৰত্যক্ষ করেছি নিজের জ্ঞান থেকে তা লিখেছি। যেখানে তা সম্ভব হয়নি সেখানে প্রত্যক্ষদশীদের বিবরণ বহু পরীক্ষার পর গ্রহণ করেছি। এ কাজ কঠিন, কারণ একই ঘটনা যাঁরা দেখে তাদের বিবরণের মধ্যে অনেক অসংগতি। মনের পক্ষপাতিত্ব ও স্মৃতিশক্তির তারতম্য এই অসংগতির কারণ। আমার বিবরণে গল্প ও কল্পনার মিশাল নেই, সেজন্য হয়তো তেমন সুখপাঠ্য নয়। তবে তাদের তৃপ্তি দেবে যাঁরা অতীত ঘটনার অবিকৃত বিবরণ ভালবাসেন। আমার ইতিহাস সাধারণের স্থায়ী সম্পত্তি, সাময়িক হাততালি লাভের কৌশল নয়।’

থুকিডডেসকে বলা হয়। আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার গুরু। এ সম্মান তার প্রাপ্য। ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ ও বিচারের এবং অপক্ষপাত কল্পনাশূন্য অনাবিল কাহিনি রচনায় যে সূত্রের তিনি সূত্রকার, আধুনিক ঐতিহাসিক রীতিকে তার ভাষ্য বলা যায়। অবশ্য অতি বিস্তৃত ভাষ্য। কারণ, আধুনিক কালে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ ও মূল্যবিচারের চেষ্টা ও পদ্ধতি যেমন বিপুল তেমনি জটিল। দু-তিনশো বছরের মধ্যে আবিষ্কৃত অনেক বিজ্ঞানবিদ্যা ইতিহাসের তথ্যনির্ণয়ের সহায়, যার কল্পনাও থুকিডডেসের কালে সম্ভব ছিল না। বহু বিজ্ঞানবিদ্যার সুপ্ৰতিষ্ঠা সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখা স্পষ্ট করে ঐতিহাসিককে অনেক প্রাচীন মুলহীন সংস্কার থেকে মুক্তি দিয়েছে। এবং এসব দৃষ্টফল বিদ্যার সার্থক অনুশীলন সত্যমিথ্যা-পরীক্ষার যে কঠোর মনোভাবের জন্ম দিয়েছে, ইতিহাসের তথ্যনির্ণয়ে ঐতিহাসিককে তা প্রভাবিত করেছে। তার স্বীকৃতির সঙ্গে উৎকর্ষের দাবি মিশিয়ে আধুনিক ইতিহাসকার নিজের রচিত ইতিহাসের নাম দিয়েছেন ‘বৈজ্ঞানিক ইতিহাস’, অর্থাৎ যা প্রাচীনদের টিলেঢালা ইতিহাস থেকে ভিন্ন। এ নামকরণে সত্যাভাস কিছু আছে, নামের মহিমায় বস্তুর তথ্য প্রকাশের চেষ্টায় যা অপরিহার্য। কিন্তু আজকের দিনের ঐতিহাসিকের হাতে সত্যনির্ণয়ের যা সব উপায় এসেছে তার তুলনায় প্রাচীনকালের ইতিহাসকার ছিলেন রিক্ত-অন্ত্র মুষ্টিযোদ্ধা মাত্র। একটু দূর-অতীতের ইতিহাস রচনা থুকিডডেসের কাছে খুব সম্ভব মনে হয়নি। কারণ, তত পূর্বের ঘটনা সম্পূর্ণ জানা যায় না। বস্তুত থুকিডডেসের একুশ বছরের ইতিহাস তাঁর সমকালীন ঘটনার ইতিহাস। পলিবিয়াসের পিউনিক-যুদ্ধের ইতিহাস ঠিক তেমন না হলেও প্রায় সমধর্মী। দূর-অতীতের ইতিহাসের উপকরণ-সংগ্রহে আধুনিক ঐতিহাসিকদের রীতিপদ্ধতি অনেক অগ্রসর ও অনেক সূক্ষ্ম। যে প্রাচীনেরা তাদের কালের ইতিহাস লিখে গেছেন বা এমন বিবরণ লিখে গেছেন যা থেকে ইতিহাসের মালমশলা পাওয়া যায়, সে ইতিহাস ও বিবরণকে বহু দিক থেকে পরীক্ষা করে সত্যনির্ণয়ের অসীম চেষ্টা— যে কাজকে থুকিডডেস কঠিন বলেছেন তা থেকে বহুগুণে কঠিন কাজ–আধুনিক ইতিহাস-লেখকেরা নিত্য করছেন। বিবরণের লিপি কত প্ৰাচীন, তার ভাষা কোন কালের, যে প্রাচীন ভাষা ও লিপির স্মৃতি লোপ হয়েছে তার পাঠোদ্ধার, মানুষের সভ্যতার যেসব সৃষ্টি মাটির নীচে চাপা পড়েছে মাটি খুঁড়ে তার পরিচয়-লাভ, মনে হয় যেন অসাধ্যসাধন। সে অসাধ্যসাধন আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার সাধারণ কাজ। অতীতকে জানার এই চেষ্টা ও পরিশ্রম সম্ভব হয়েছে অতীতকে জানার আগ্রহে। আর কোনও কিছুর উপলক্ষ হিসাবে নয়, ওই জ্ঞানই ঐতিহাসিকের চরম লক্ষ্য বলে। অতীতের নির্ভুল নিখুঁত জ্ঞানলাভের এই বিদ্যা মানুষ সৃষ্টি করেছে। সেই বিদ্যার ও তার আদর্শের আকর্ষণ ইতিহাসকারের উদ্যমের উৎস। সেই আদর্শে পৌঁছবার কোনও শ্রমকেই শ্রম মনে হয় না। এই আদর্শের মাপকাঠি ছাড়া অন্য যে-কোনও মাপকাঠির মাপে ঐতিহাসিকের অনেক শ্রম মনে হবে নিরর্থক পণ্ডশ্রম। যিশু জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব চার অব্দে না দশ অব্দে, যুদ্ধটা আরম্ভ হয়েছিল শনিবার দুপুরে না রবিবার প্রাতে, সে গবেষণায় শ্রম ও বুদ্ধি ব্যয়ের আর কোন সার্থকতা আছে? সে সার্থকতা হচ্ছে সত্য আবিষ্কার ও সত্য কথনের ঐতিহাসিক আদর্শ থেকে অবিচ্যুতি। সত্যের জন্যই সত্যের অনুসরণ। ‘সত্যে নাস্তি ভয়ং কিঞ্চিৎ’–ঐতিহাসিকের সে ভয় হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্যের আদর্শ থেকে ভ্ৰষ্ট হবার ভয়। অন্য কোনও ভয় নয়। ইতিহাসের উদ্দেশ্য যদি হত অতীত সত্য ঘটনার উদাহরণে নীতিমার্গের উপদেশ দেওয়া–ধর্মের নীতি, সামাজিক নীতি, রাষ্ট্রের নীতি— তবে অনেক ইতিহাসকে কিছু বিকৃত করলেই তা উপদেশের বেশি উপযোগী হত। অনলংকৃত নিরাবরণ সত্যের চেয়ে কল্পনায় রাঙানো ও সাজানো কাহিনির আকর্ষণ লোকের কাছে অনেক বেশি–যে আকর্ষণের অভাব আছে বলে থুকিডডেস তার ইতিহাস-রচনার ব্যাজনিন্দা করেছেন। যে কারণে নৈমিষারণ্যের ঋষিরা সোপাখ্যান ভারতকথাকে অধিকতর শ্রাব্য মনে করেছেন।

ইউরোপের মধ্যযুগে সকল বিদ্যার ধারক ও বাহক ছিলেন ক্যাথলিক চার্চের ধর্মগুরু ও ধর্মযাজকেরা। তাঁরা যে ইতিহাস তখন লিখেছেন তার বেশির ভাগ খ্রিস্টধর্মের নানা ঘটনার ও খ্রিস্টান সাধুসন্তদের জীবনের ইতিহাস। সে ইতিহাসকে বিচিত্র কল্পনায় পুষ্ট ও মনোহারী করে ধর্মের উপর লোকের ভক্তি ও ভয় গাঢ় করার চেষ্টা দোষের ছিল না। তাতে লেখকের ধর্মপ্রচারের নিষ্ঠাই প্ৰমাণ হত। এ প্রয়োজনে অসত্যকথনেও দোষ ছিল না। কারণ ধর্মের মহিমা সত্যের মহিমার অনেক উর্ধে। সে কাল গত হয়েছে, কিন্তু সে মনোভাবের বীজ মরেনি। আজ ক্রমশ ধর্মের দাবির জায়গা নিচ্ছে রাষ্ট্রের দাবি। ধর্মগুরুর আসনে বসেছে রাষ্ট্রনেতা। সেই ইতিহাস হবে তাদের কাম্য যাতে রাষ্ট্রের উপর, অর্থাৎ রাষ্ট্রনেতাদের উপর, লোকের ভক্তি ও ভয় প্রবল ও প্রগাঢ় হয়। তাতে যদি কিছু অসত্যভাষণের প্রয়োজন হয় তাতে প্রমাণ হবে রাষ্ট্রসচেতন ঐতিহাসিকের দেশপ্রেম। ইউরোপের মধ্যযুগে থুকিডডেসের ইতিহাসের আদর্শ বেঁচে ছিল না। আজ সে পুনজীবিত আদর্শ অনেক বেশি কঠোর হয়েছে। কিন্তু স্বদেশপ্রেমিক ঐতিহাসিকের অভাব হবে না। শোনা যাবে ইতিহাসের জন্য ইতিহাস নয়। কেবল সত্যভাষণের আদর্শ থেকে তার লক্ষ্য অনেক উচুতে, তাব লক্ষ্য রাষ্ট্রের হিত, জাতির মঙ্গল।

এক কাল ছিল, যখন আজ যে সকল বিদ্যা গৌরবে স্বপ্রতিষ্ঠ তার অনেকগুলি ছিল অন্য সাধনার অঙ্গ ও উপায়। সেই উপায়ের কাজ সম্পন্ন করাই ছিল তার লক্ষ্য ও পরিণতি। কিন্তু মানুষের চঞ্চল কর্মকৃৎ মন ও প্রতিভা উপায়ের গণ্ডি ভেদ করে স্বতন্ত্র বিদ্যায় তাদের গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশের প্রাচীন বেদাঙ্গবিদ্যাগুলি তার উদাহরণ। যে বিদ্যা ছিল বেদমন্ত্রের শুদ্ধ উচ্চারণ ও সত্য অর্থ গ্রহণের উপায় মাত্র, তা গড়ে উঠল। ভাষাতত্ত্বের বিজ্ঞান হয়ে। ছন্দঃশাস্ত্ৰ বৈদিক ছন্দোবিচারে আবদ্ধ থাকল না। জ্যোতিষ ও জ্যামিতি বৈদিক ক্রিয়াকর্মের প্রয়োজন ছাড়িয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্র বিদ্যায় পরিণতি পেল। মানুষের প্রতিভার এসব সৃষ্টি ও বিদ্যার চৰ্চাকে বৈদিক কুলপতিরা সুনজরে দেখেননি। মনুসংহিতায় তার স্মৃতি রয়ে গেছে। ‘যে দ্বিজ বেদ অধ্যয়ন না করে অন্য বিদ্যায় শ্রম করে এই জন্মেই তার সবংশ আশু শূদ্রত্নপ্রাপ্তি হয়।’

যোহনধীত্য দ্বিজো বেদমন্যত্র কুরুতে শ্ৰমম।
স জীবশ্লোব শূদ্র ত্বমাশু গচ্ছতি সান্ধয়ঃ ॥ ২।১৬৮

‘অন্যত্ৰ’ কথার ব্যাখ্যায় মেধাতিথি লিখেছেন, ‘শাস্ত্রাঙ্গেষু তৰ্কশাস্ত্রগ্রন্থেষু বা৷’ কুল্লুক সোজাসুজি বলেছেন, ‘অর্থশাস্ত্রাদৌ।’ সৰ্বজ্ঞ নারায়ণ শুধু বলেছেন, ‘অন্যত্র শাস্ত্ৰে’, অর্থাৎ বেদ ভিন্ন অন্য বিদ্যায়।

ইউরোপের মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের আলোচনা ছেড়ে অন্য বিদ্যার যাঁরা চর্চা করত। ধর্মগুরুরা তাদের সন্দেহের চোখেই দেখতেন। এর প্রেরণা যে ভগবানের নয়, আসে। শয়তানের কাছ থেকে, সে সম্বন্ধে তাঁরা প্ৰায় নিঃসংশয় ছিলেন। ফাউস্টের প্রাচীন গল্প এর উদাহরণ। ধর্ম ও নীতির রথচক্রের বন্ধন থেকে বিদ্যাগুলির মুক্তি হয়েছে অনেক প্রতিকূলতার দ্যাধা কাটিয়ে। ইতিহাসেরও ঘটেছে সেই মুক্তি। কিন্তু কোনও বন্ধন থেকে মুক্তিই চরম মুক্তি নয়। মুক্তিকে রক্ষার জন্য মানুষকে অতন্দ্র থাকতে হয়। কারণ পুরাতন বন্ধন নূতন নূতন রূপে মানুষের মুক্ত মন ও বিদ্যাকে আবার বাঁধতে চায়। মানুষের মুক্ত মন ও বুদ্ধির উপর আজকের পৃথিবী অনুকুল নয়। সম্ভব ঐতিহাসিক সত্যনিষ্ঠাকে আবার কঠিন পবীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

প্রশ্ন উঠবে, তবে কি ইতিহাস মনের একটা খেয়াল-পরিতৃপ্তির উপায় মাত্র, মানুষের কোনও কাজে লাগে না? মানুষ নিজের কাজেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, সুতরাং মানুষেব তা কাজে লাগে। কিন্তু যে মানুষের কাজে লাগে সে মানুষ সত্যের পূর্ণাঙ্গ মানুষ, তত্ত্বের মাপে কাটাছোটা প্রমাণসই, স্ট্যান্ডারডাইজড মানুষ নয়। মানুষ পৃথিবীকে জানতে চায় মুখ্যত জীবনযাত্রার প্রয়োজনে। সুতরাং প্রয়োজন সিদ্ধির কাঠামে সে বস্তুকে পুরতে চায়। তাতে বস্তুর সমগ্ৰতা ধরা পড়ে না। কিন্তু সমগ্রকে ধরা কাঠামের কাজ নয়; তাতে কাঠামো-সৃষ্টির উদ্দেশাই ব্যর্থ হয়। কার্যসিদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন তা থেকে নিম্প্রয়োজন অবাস্তরকে দূরে রাখার জন্যই কাঠামো। যা থাকে কাঠামোর বাইরে, প্রয়োজন সিদ্ধির দৃষ্টিতে তা অবস্তু। তাকে অগ্রাহ্য করেই কাজ চলে এবং অগ্রাহ্য করলেই কাজ ভাল চলে। ক্ৰমে মানুষের ব্যাবহারিক মনের ধারণা জন্মে যে, কাঠামোর মধ্যে যা রয়েছে তাই বস্তু, তার বাইরে বস্তুর আর অস্তিত্ব নেই।

আজ যাঁরা সভ্য মানুষ, একদিন ছিল যখন তাদের পূর্বপিতামহদের শরীর ও মনের সমস্ত শক্তি ব্যয় হত। শরীরকে বঁচিয়ে রাখার আহার আবাস ও আচ্ছাদন সংগ্রহের চেষ্টায়। সে মানুষের কাঠামো বুদ্ধিমান দেহসর্বস্ব জীবের কাঠামো। তার পর অনেক হাজার বছরের নানা সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মন শরীরের একান্ত দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। সেই মুক্ত বাহুল্য মন সৃষ্টির প্রেরণায় ও আনন্দে বহু সৃষ্টি করে চলেছে যা শরীরের কাজে লাগে না, বাহুল্য মুক্ত মনের কাজে লাগে। কাব্য ও সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান, চিত্র ও ভাস্কৰ্য সবই এই মুক্ত মনের সৃষ্টি। কিন্তু সেই আদিম কাঠামোর স্মৃতি মানুষের মনে বেঁচে আছে। তার এক কারণ, অনেক মানুষের মন আজও শরীরের সেই একান্ত দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়নি। তাই যখন প্রশ্ন হয়, এ বস্তু মানুষের কোন কাজে লাগে, তখন প্রশ্নকর্তা যে মানুষের কথা বলেন সে মানুষ হচ্ছে দেহসর্বস্ব জীবের কাঠামোর মানুষ। প্রশ্নের অর্থ, সে বস্তু শরীরের পুষ্টি ও স্বাচ্ছন্দ্যের কাজে লাগে কি না। যত গান্তীর্য ও মুরবিয়ানার সঙ্গে প্রশ্ন হোক না কেন, একটু বাজিয়ে দেখলেই আওয়াজ চিনতে ভুল হয় না। যে ইতিহাসের কথা বলছি সে ইতিহাসও মানুষের মুক্ত মনের সৃষ্টি। তাকে শরীরের কাজে লাগানো যায় না। যে সমাজ বহু শরীরের সমষ্টি মাত্র তার কাজেও লাগানো যায় না। চিরপরিচিত মানুষ মানুষের চিরকালের বিস্ময়। সেই চিরবিস্ময়ের বার্তা বহন করে ইতিহাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *